দরূদ শরীফের ফযীলত বিষয়ক দুটি বানোয়াট কিসসা
ঢাকার একটি লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত ‘বার চাঁদের ফযীলত’ নামক পুস্তকে দরূদের ফযীলত বর্ণনা করতে গিয়ে দুটি কিসসার অবতারণা করা হয়েছে-
১. দরূদ শ্রবণকারী মাছ...
“একবার এক সওদাগরের একখানি বাণিজ্য-তরী নীল নদী দিয়া যাইতেছিল। সেই জাহাজে এরূপ একজন লোক ছিল, যে প্রত্যহ হযরত (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নামে দরূদ পাঠ করিত। একদা সে দরূদ পাঠ করিতেছিল; এমন সময় দেখিতে পাইল, জাহাজের গা ঘেঁষিয়া নদীর একটি মাছ কান পাতিয়া তাহার দরূদ পাঠ শুনিতেছে। যখন তাহার দরূদ পাঠ শেষ হইল তখনই মাছটি পানিতে ডুবিয়া গেল।
ঘটনাক্রমে সেই মাছটি এক জেলের জালে ধরা পড়িল। অতঃপর জেলে মাছটিকে বিক্রয় করার জন্য বাজারে উপস্থিত করিল। সেদিন হযরত ওমর রা. বা মতান্তরে আবু বকর সিদ্দীক রা. এই উদ্দেশ্যে বাজারে আসিয়াছিলেন যে, একটি বড় মাছ পাওয়া গেলে উহা কিনিয়া আনিবেন এবং হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দাওয়াত করিয়া উহা খাওয়াইবেন। বাজারে এই মাছটিকে দেখিয়া তিনি খুব খুশি হইলেন এবং ইহা ক্রয় করিয়া নিয়া স্ত্রীকে বলিলেন, এই মাছটিকে খুব ভালোভাবে রান্না করিও; আজ ইনশাআল্লাহ হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দাওয়াত করিব।
বিবি সাহেবা মাছটির আঁশ ছাড়াইয়া ভালোভাবে ধুইয়া পরিষ্কার করিয়া নানারকম মসলা মাখিয়া উহাকে রান্না করিবার জন্য চুলায় তুলিয়া হাঁড়ির নিচে আগুন দিতে লাগিলেন। কিন্তু আগুন জ্বলিল না। বহু চেষ্টা করিয়া কোনমতে আগুন ধরাইলেই আবার উহা নিভিয়া যাইত। এভাবে বহুক্ষণ যাবৎ চেষ্টা করিয়াও আগুনকে উত্তপ্ত করিতে না পারিয়া স্বামীকে ব্যাপারটি অবগত করিলেন। তিনিও খুব চেষ্টা করিলেন। কিন্তু কোনোই ফল হইল না। অবশেষে মজবুর হইয়া তাঁহারা হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এই ঘটনা বিবৃত করিলেন। তিনি মাছের অবস্থা অবগত হইয়া বলিলেন, দুনিয়ার আগুন তো দূরের কথা দোযখের আগুনও ইহাকে জ্বালাইতে পারিবে না। কারণ, কোনো ব্যক্তি যখন দরূদ পাঠ করিতেছিল তখন এই মাছটি মনোযোগ সহকারে উহা শুনিতেছিল। উহার বরকতেই তোমরা ইহাকে রান্না করার জন্য আগুন জ্বালাইতে পার নাই।”
এটি একটি বানোয়াট কিসসা। কিসসাটির মাঝেই তা বানোয়াট হওয়ার বিভিন্ন আলামত বিদ্যমান। মাছটি দরূদ শুনতে পেল নীলনদে আর ওমরা রা. বা আবু বকর রা. মদীনার বাজারে তা কিনতে গেলেন! কিসসাটি কোন্ যামানার ঘটনা হিসাবে দাবি করা হচ্ছে তাও মাথায় রাখুন! আবার সাহাবী মাছ কেনার উদ্দেশ্যে বাজারে যাচ্ছেন; মদীনার বাজার কি এমন ছিল যে, সচারচর সেখানে মাছ পাওয়া যেত? এছাড়াও আরো অসামঞ্জস্য কথাবার্তা আছে ঘটনাটিতে।
মূলত এটি শিয়াদের বানানো একটি কিসসা। শিয়াদের মাধ্যমে পাক-ভারত উপমহাদেশে এজাতীয় অনেক বানোয়াট কথা প্রসিদ্ধ হয়েছে।
শিয়াদের বেশ কিছু সাইটে এই কিসসাটিই একটু ভিন্ন আঙ্গিকে এসেছে। সেখানে ওমরা রা. বা আবু বকর রা.-এর কথা নেই। তেমনি নবীজীকে দাওয়াত করার বিষয়টিও নেই। সেখানে আছে, কোনো এক ব্যক্তি একটি মাছ কেনে; রান্না করার জন্য প্রস্তুতও করে; কিন্তু দেখে যে, আগুনে তার কিছুই হচ্ছে না। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিষয়টি জানালে তিনি মাছটিকে জিজ্ঞাসা করেন-কেন এমনটি হচ্ছে। তখন মাছটি বলে, এক ব্যক্তিকে ‘আপনার ও আপনার আহলে বাইতের উপর’ দরূদ পড়তে শুনে সে খুব প্রভাবিত ও আনন্দিত হয় এবং সেও ‘নবীজী ও তাঁর আহলে বাইতের উপর’ বেশি বেশি দরূদ পড়তে থাকে এবং একটি গায়েবী আওয়ায পায়- ‘হে মাছ! আল্লাহ তোমার দেহের জন্য আগুনকে হারাম করে দিয়েছেন। আগুন তোমাকে পোড়াতে পারবে না।’ একারণেই এমনটি ঘটেছে।
যাইহোক, এটি একটি জাল ও বানোয়াট কিসসা; যা শিয়াদের কর্তৃক জালকৃত।
২. দরূদ পড়ে ফুঁ দেওয়াতে ভিক্ষুকের হাতের মুঠোয় মুক্তদানা!
আলোচ্য পুস্তিকায়ই আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে-
“একদা আবু জেহেল এবং আরো কয়েকজন কুরায়েশ কাবা শরীফের অদূরে এক স্থানে বসিয়া আলোচনা করিতেছিল। এমন সময় একটি ভিক্ষুক আসিয়া তাহাদের নিকট কিছু ভিক্ষা চাহিল। তদুত্তরে তাহারা উপহাসের সুরে ভিক্ষুকটিকে বলিল, কাবাঘরে আলী আছে, তুমি তাহার নিকট চলিয়া যাও। সে তোমাকে প্রচুর অর্থ দান করিবে। কেননা সে একজন দাতা লোক। তাহাদের ধারণা ছিল, হযরত আলী রা.-এর নিজের দুই বেলার আহার জোটানোই মুশকিল, এই অবস্থায় তিনি ভিক্ষুককে কিছু দান করিতে পারিবেন না; ফলে, তিনি তাহার নিকট লজ্জিত হইবেন। ভিক্ষুকটি তাহাদের কথানুসারে কাবা প্রাঙ্গণে হযরত আলীর নিকট উপস্থিত হইয়া কিছু ভিক্ষা চাহিল। তাহাকে দেওয়ার মত কোন কিছুই তখন তাঁহার নিকট ছিল না। তাই তিনি তাহাকে বলিলেন, দুই হাত একত্রিত করিয়া আমার দিকে বাড়াও। সে হস্তদ্বয় বাড়াইয়া দিলে তিনি কোনও দোয়া পড়িয়া তাহার হাতের তালুতে ফুঁ দিলেন। বলিলেন, মুষ্টিবদ্ধ অবস্থায়ই তুমি তাহাদের নিকট চলিয়া যাও, যাহারা তোমাকে আমার কাছে পাঠাইয়াছেন এবং সেখানে পৌঁছিয়া হাতের মুষ্টি খুলিবে। তাঁহার নির্দেশ মত সে কাফেরদের নিকট যাইয়া স্বীয় মুষ্টি খুলিয়া দেখিতে পাইল যে, হাতের মধ্যে এক হাজার দীনার মূল্যের একটি মুক্তা রহিয়াছে। মুক্তাটি দেখিয়া কাফেরগণ আশ্চর্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তুমি ইহা পাইলে কাথায়? সে বলিল, তিনি আমার হাতে একটি ফুঁ দিয়াছিলেন, উহার বরকতে এই মুক্তা সৃষ্টি হইয়াছে। একথা শ্রবণ করায় তাহাদের বিস্ময়ের মাত্রা আরো বাড়িয়া গেল।
তাহারা হযরত আলী রা.-এর নিকট যাইয়া এ সম্পর্কে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, তিনি বলিলেন, ভিক্ষুকটি আসিয়া যখন আমার নিকট কিছু ভিক্ষা চাহিল, তখন তাহাকে খালি হাতে ফিরাইয়া দিতে আমার লজ্জা বোধ হইল। তাই আমি দরূদ শরীফ পাঠ করিয়া তাহার হাতে ফুঁ দিয়াছি। উহারই বরকতে আল্লাহ তাআলা তাহার হাতের মধ্যে এই মুক্তাটি দান করিয়াছেন। ইহা শুনিয়া তাহারা খুবই আশ্চর্যান্বিত হইল, এমনকি তাহাদের মধ্য হইতে তিন ব্যক্তি তখনই ইসলাম গ্রহণ করিল।”
পূর্বোক্ত কিসসাটির মত এটিও একটি বানোয়াট কিসসা। নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্রে তা পাওয়া যায় না।
দরূদের মাধ্যমে এর চেয়েও অলৌকিক বিষয় ঘটতে পারে। কারণ, দরূদের মাধ্যমে আল্লাহ্র রহমত বান্দার শামিলে হাল হয়। কিন্তু দরূদের ফযীলত প্রকাশ করতে গিয়ে এসব বানোয়াট কিসসা-কাহিনী বলার দ্বারা কী ফায়েদা! কুরআনে কারীম ও সহীহ হাদীসে দরূদ শরীফের বহু ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ صَلّى عَلَيّ وَاحِدَةً صَلّى الله عَلَيْهِ عَشْرًا.
যে আমার প্রতি একবার দরূদ পাঠ করে আল্লাহ তার প্রতি দশবার রহমত বর্ষণ করেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪০৮
এর চেয়ে বড় ফযীলত আর কী হতে পারে যে, দরূদ পাঠের মাধ্যমে আমি আল্লাহ্র রহমতের বৃষ্টিতে স্নাত হব! দরূদ পাঠের মাধ্যমে আল্লাহ্র রহমত আমার সঙ্গী হয়ে যাবে। এই একটি ফযীলত লাভ করতে পারলে কি বান্দার দুনিয়া-আখেরাতে আর কোনো কিছুর প্রয়োজন আছে!
তারপরও নির্ভরযোগ্য সূত্রে দরূদ পাঠের আরো কত ফযীলত বর্ণিত হয়েছে! দরূদ পাঠের মাধ্যমে গুনাহ মাফ হয় এবং মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ صَلّى عَلَيّ مِنْ أمّتِي صَلَاةً مُخْلِصًا مِنْ قَلْبِهِ، صَلّى الله عَلَيْهِ بِهَا عَشْرَ صَلَوَاتٍ، وَرَفَعَهُ بِهَا عَشْرَ دَرَجَاتٍ، وَكَتَبَ لَهُ بِهَا عَشْرَ حَسَنَاتٍ، وَمَحَا عَنْهُ عَشْرَ سَيِّئَاتٍ.
যে ব্যক্তি আমার প্রতি অন্তর থেকে একবার দরূদ পেশ করবে আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে তার উপর দশবার রহমত বর্ষণ করবেন। তার মর্তবা দশ স্তর পর্যন্ত উন্নীত করবেন। তাকে দশটি নেকী দান করবেন এবং তার দশটি গুনাহ মাফ করে দেবেন। -সুনানে কুবরা, নাসায়ী, হাদীস ৯৮৯২, ৯৮৯৩; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ১২৯৭; আমালুল ইয়াউমি ওয়াল লাইলাহ, নাসায়ী, হাদীস ৩৬২
তেমনি বেশি বেশি দরূদ পাঠের মাধ্যমে নবীজীর নৈকট্য লাভ হয়। আখেরাতে তাঁর সঙ্গ লাভ হয়, তাঁর কাছের মানুষ হওয়া যায়। আখেরাতে তাঁর সঙ্গ লাভ-এর চেয়ে কি আর বড় ফযীলত হতে পারে! আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
أَوْلَى النّاسِ بِي يَوْمَ القِيَامَةِ أَكْثَرُهُمْ عَلَيّ صَلاَةً.
কিয়ামতের দিন আমার নৈকট্য লাভ করবে ঐ ব্যক্তি, যে আমার প্রতি অধিক পরিমাণে দরূদ পাঠ করে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৪৮৪
এছাড়াও নির্ভরযোগ্য সূত্রে দরূদের আরো অনেক বড় বড় ফযীলত বর্ণিত হয়েছে; তার পরও কেন যেন কিছু মানুষের এসকল অমূলক কিসসা-কাহিনী ও ভিত্তিহীন ফযীলতের প্রতি আগ্রহ! আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।