সন্তানের হৃদয়ে জ্বেলে দিন তাওহীদ ও ঈমানের আলো
দুটি ক্ষেত্র এমন রয়েছে, যেখানে নারীর অবদান সবচাইতে বেশি। ইসলাম এক্ষেত্রে নারীকে বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এ দুই অঙ্গনে একজন নারী যে ভ‚মিকা রাখতে সক্ষম, অন্য কারো পক্ষে তা সম্ভব নয়। উম্মাহর আগামী প্রজন্মের কেবল অস্তিত্ব রক্ষায় নয়; তাদের চিন্তা-চেতনা, বোধ-বিশ্বাস, সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং আদর্শ ও নৈতিকতার সুরক্ষায় মৌলিক অবদান রাখেন মায়েরা। এক্ষেত্রে তারা ভিত্তিমূলের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হন। যুগে যুগে এ দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে এসেছেন তারাই। গুরুত্বপূর্ণ এ অধ্যায়টি তাদের সহায়তায় নয়; বরং মূল কর্মযজ্ঞটা তাদের হাত ধরেই হতে হয়। নতুবা মানবতা ও মনুষ্যত্বের ধারা (প্রকৃতপক্ষে যা উম্মাহর প্রকৃত মূল্য ও অবস্থান এবং তার অস্তিত্বের প্রয়োজন ও গুরুত্বের স্বাক্ষর বহন করে।) টিকে থাকতে পারে না।
হাঁ, আমি যে দুটি ক্ষেত্রের কথা বলতে চাইছি, তা হল-
এক. শিশুর দ্বীনী তালীম-তরবিয়ত এবং ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষার প্রথম পাঠটা তাকে রপ্ত করিয়ে দিন। তার দিল ও দেমাগে ঈমান ও ইসলাম খোদাই করে দিন এবং দ্বীনী চেতনা ও মূল্যবোধ তার মাঝে প্রোথিত করে দিন।
দুই. ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুনের হেফাযত করুন এবং বিজাতীয় কৃষ্টি-কালচারের ছোবল থেকে সন্তানকে রক্ষা করুন।
কোনো অভ্যাস বা বিশ্বাস কিংবা কোনো ভালো-মন্দ অথবা যে কোনো বিষয় যদি কারো মন-মগজে বসে যায় তখন আমরা সেটাকে আমাদের ব্যবহারিক ভাষায় বলি ‘য়ে চীয ঘুট্টি ম্যাঁ পড়ি হ্যয়’। অর্থাৎ অস্থি-মজ্জায় মিশে একাকার হয়ে যা স্বভাবে পরিণত হয় তাকেই বলা হয় ‘ঘুট্টি ম্যাঁ ব্যঠ জানা’। তো একটি শিশু যখন অল্পস্বল্প বুঝতে আরম্ভ করে তখন তার ‘ঘুট্টিতে’ কী প্রোথিত হবে আর কী হবে না-এ দায়িত্বটা আঞ্জাম দিতে হয় মাকে এবং ঘরের অন্যান্য মুরব্বী মামী-চাচী, খালা-ফুফু ও দাদী-নানীদেরকে। ঘরোয়া পরিবেশে অনায়াসেই তারা তা আদায় করতে পারেন।
শিক্ষা-বিশেষজ্ঞ এবং মনোবিজ্ঞানীগণ এ বিষয়ে জোর দিয়েই বলে থাকেন, শিশুর দিল-দেমাগের স্বচ্ছ শ্লেটে যে রেখাই টানো না কেন তা অঙ্কিত হয়ে যায়। আর বিলীন হয় না। অনেকসময় মনে হয়, হয়ত তা হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা বিলকুল উধাও হয়ে যায় না। কোনো কারণে চাপা পড়তে পারে। কিন্তু সময় মতো তা আবার ফুটে ওঠে, জেগে ওঠে।
এভাবে চিন্তা করলে সন্তানের প্রতি মা ও ঘরের অন্যান্য নারীদের কর্তব্য অনেকাংশে বেড়ে যায়। তারা খুব সহজে শিশুর নির্মল অন্তরে পবিত্র আল্পনা আঁকতে পারেন। পরবর্তীতে কোনো শক্তি, কোনো চক্রান্ত, কোনো শিক্ষা, কোনো দীক্ষা, কোনো সভ্যতা, কোনো সংস্কৃতি, কোনো ধরনের কোনো কিছু খুব সহজে তা মুছে দিতে পারবে না। মিটিয়ে দিতে পারবে না।
মা ও শিশুর সেবা ও দেখভালে নিয়োজিত নারীগণ এবং ঘরের বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলাগণ, পরিবারে যাদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে, এতটুকুতেই আপনাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না যে, বাচ্চাকে আল্লাহ-রাসূলের নাম শিখিয়ে দিলেন। কালিমা মুখস্থ করিয়ে দিলেন। নামাযের বয়স ঘনিয়ে এসেছে নামাযে অভ্যস্ত করলেন। কুরআন শরীফ শিখিয়ে দিলেন। এমনকি উর্দুও পড়িয়ে দিলেন।
এখন তো হিন্দি চর্চা দৌরাত্ম্যে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, অসংখ্য মুসলিম শিশু এক লাইন উর্দুও পড়তে পারে না। এমনকি নিজের নামটাও লিখতে পারে না। এর ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে। ইন্টারভিউ দিতে গেলে, স্কুলে ভর্তি হতে গেলে কিংবা কোথাও চাকরির আবেদন করতে গেলে এ হালত দেখা যায়। তো আজকাল মুসলিম ঘরগুলো থেকেই উর্দু শেখানোর ক্ষেত্রে অবহেলা এবং সীরাতে আম্বিয়া, সীরাতে ছাহাবা, আযওয়াজে মুতাহহারাহ তথা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র স্ত্রীগণ, আহলে বাইত তথা নবীজীর পরিবার-পরিজন এবং ইসলামের মহান মনীষীদের নাম-পরিচয় এবং ইসলামের ইহিহাস সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে আজ এ সঙ্কটময় অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
তো যাই হোক, শিশুকে কালিমা, নামায, তিলাওয়াত শিখিয়ে দেওয়া, তাকে আল্লাহ-রাসূলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এই কাজগুলোর পাশাপাশি শিশুকে এ তরবিয়তেও গড়ে তুলতে হবে, যাতে সে কুফর ও শিরক চিনতে পারে, এর অসারতা অনুধাবন করতে পারে এবং এর প্রতি বিতৃষ্ণ মনোভাব নিয়ে বেড়ে উঠে। তাওহীদের বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা রাখে এবং এর প্রতি মহব্বত রাখে। মুসলিম পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে। ঈমান-ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারায় পুলক অনুভব করে। দ্বীনের ব্যাপারে আত্মমর্যাদাশীল হয়। আল্লাহর আনুগত্যে অটল-অবিচল থাকে। আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ইশক ও মহব্বতে দিওয়ানা থাকে। গুনাহের প্রতি ঘৃণা বোধ করে। পার্থিব উৎকর্ষকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য-উদ্দেশ্য মনে না করে এবং একেই চ‚ড়ান্ত সফলতা জ্ঞান না করে। সততাপূর্ণ জীবন যাপন, সত্যবাদিতার অভ্যাস, পরোপকারিতা ও পরার্থপরতার আগ্রহ, সৃষ্টির সেবার মানসিকতা এবং দেশাত্মবোধ জাগ্রত করাও তাদের দায়িত্ব।
একটি শিশু এই দীক্ষা যদি ঘর থেকে লাভ করতে না পারে তাহলে বিশ্বের নামিদামি বিদ্যাপীঠ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বড় বড় প্রতিষ্ঠানও তাকে সেই সবক দিতে পারবে না। দিলেও কাক্সিক্ষত ফলাফল লাভ হবে না।
এখানে একথাটিও পরিষ্কার করতে চাই, মুসলিম শিশুর অন্তরে কুফর-শিরক ও ইলহাদ এবং পৌত্তলিকতা ও নাস্তিক্যবাদের প্রতি-চাই তা বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনে হোক কিংবা দেশীয় পুরাণ চর্চার মাধ্যমে, পাঠ্যপুস্তক এবং শিক্ষাব্যবস্থার কারণে হোক অথবা প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে, কোনো লেকচার শুনে বা শিট পড়ে হোক অথবা কারো খপ্পরে পড়ে, দ্বীন সম্পর্কে বে-খবর থাকার কারণে হোক অথবা জাগতিক ফয়দা সিদ্ধির জন্যে, ইহবাদী সম্প্রদায়ের সংশ্রবে হোক কিংবা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কোনো প্রভাবে, যে সূত্রই এর উৎস হোক না কেন একজন মুসলিম শিশুর অন্তরে কুফর ও শিরকের প্রতি, নাস্তিকতা ও পৌত্তলিকতার প্রতি তীব্র ঘৃণা ও বিতৃষ্ণাবোধ জাগ্রত হতে হবে; যেমনটি হয়ে থাকে কোনো নাপাক ও দুর্গন্ধ বস্তুর ক্ষেত্রে। নতুবা তার ঈমান ও দ্বীনী মূল্যবোধের সুরক্ষা হবে না। তার ব্যাপারে একজন সহীহ আকীদাসম্পন্ন মুসলিম সত্তার জামানত দেওয়া যাবে না।
ভক্তি ও ঘৃণার এ অনুভ‚তি তাকে মুসলিম ঘর থেকেই জাগ্রত করতে হবে। এমন তরবিয়তেই তাকে গড়ে তুলতে হবে, যাতে ঈমান ও তাওহীদের প্রতি আকর্ষণ এবং শিরক-কুফর ও ইলহাদের প্রতি ঘৃণাবোধ তার অস্থি-মজ্জায় মিশে যায়। একটি মুসলিম পরিবারের ঐতিহ্য এতেই নিহিত। আর এভাবেই হতে পারে আগামী প্রজন্মের মনুষ্যত্ব ও মুসলমানিত্বের সুরক্ষা। শিশুর অন্তরে এ বিষয়গুলো গেঁথে দেওয়ার মূল ভ‚মিকা রয়েছে ঘরের মায়েদের, বড় বোনদের, মামী-খালা, চাচী-ফুফুদের, নানী-দাদী এবং মুরব্বী নারীদের। যদি মায়ের আঁচল থেকে শিশু এ দীক্ষা লাভ না করে তাহলে বিশাল বিশাল ওয়াজ মাহফিল, চমৎকার চমৎকার দ্বীনী কিতাব, বড় বড় উলামা-মাশায়েখের হাত ধরেও ব্যাপকভাবে তা হাছিল করা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়।
[দ্রষ্টব্য : তামীরে হায়াত, ২৫ মে ১৯৯২ ঈসাব্দ (ইসলাম মে আওরত কা দরজা আওর উসকে হুকুক ও ফারায়েয, পৃ. ২৩০-২৩২)]
ভাষান্তর : মুহাম্মাদ আশিক বিল্লাহ তানভীর