জুমাদাল উলা-জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪২   ||   জানুয়ারি ২০২১

শব্দ-বাক্যের মুক্তি চাই!

ওয়ারিস রব্বানী

শব্দ তৈরি ও প্রয়োগ হয় ভাষার স্বাভাবিক গতিপ্রবাহের মধ্য দিয়েই। কোনো শব্দ ব্যাপকতা পায়, কোনো শব্দ হারিয়ে যায়। আবার কোনো কোনো শব্দকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহার করার একটা প্রবণতাও চোখে পড়ে। তখন ওইসব শব্দের ব্যবহার নিয়ে একধরনের ‘বন্দিত্ব’ ও উদ্দেশ্যমূলক সংকোচন তৈরি হয়।

এমন কয়েকটি শব্দের দিকে এখন চোখ ফেরানো যেতে পারে। এ শব্দগুলোকে রাজনৈতিক বিরোধ ও স্বার্থের আঙ্গিক থেকে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মাদর্শের বিরোধিতা ও দেশ বিরোধী গোয়েন্দা স্বার্থের সুবিধা থেকেও একটি নির্দিষ্ট মর্মবলয়ে আটকে রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ। একই ধরনের মর্ম ও তাৎপর্যের ধারণক্ষমতা থাকলেও বিপরীত কোনো প্রয়োগক্ষেত্রে শব্দগুলিকে ব্যবহার করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।

যেমন, চরমপন্থা/ চরমপন্থি, কট্টরপন্থা/ কট্টরপন্থি একই অর্থের  এ দুটি শব্দরূপ নিয়ে কিছু কথা  বলা যায়। সেকুলার ও ভারতীয় উগ্র হিন্দু রাজনীতির সমর্থকরা অকাতরে এ শব্দটাকে বাংলাদেশি মুসলমানদের অনুশীলনশীল অংশের সঙ্গে যুক্ত করে দেয় এবং তাদের অনুগামী সব প্রচারণাবাদী মিডিয়াও এই কাজটিকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য নিজেদের দায়িত্ব পালন করে থাকে। মুসলমানদের কেউ বা কোনো দল আদর্শিক কারণে কোনো বিষয়ে অনমনীয় অবস্থান নিলে সেকুলার ও হিন্দুতোষক মহল তাদেরকে ‘চরমপন্থি’ হিসেবে আখ্যা দেয়। যেমন কোনো মুসলমান যদি প্রকাশ্যে মদপান/ব্যভিচার/মূর্তি নির্মাণ-এর বিরুদ্ধে তার বক্তব্য ও অবস্থান তুলে ধরতে থাকে, তাহলে বিপরীত পক্ষের লোকেরা তাদের ‘চরমপন্থি/কট্টরপন্থি’ বলতে শুরু করে এবং তাদের অনুসারী গণমাধ্যমজীবীরাও এ ধ্বনির সঙ্গে সুর মিলায়। অথচ বাস্তবতা হল, একই ‘দোষের’ দায়ে তারাও দায়ী। তারা মাদক ছাড়তে প্রস্তুত নয়, ব্যভিচার বন্ধ করতে পারছে না, কিংবা প্রকাশ্যে মূর্তি স্থাপনের অনড় অবস্থান ত্যাগ করছে না-এ অবস্থায় তারাও কিন্তু চরমপন্থি/কট্টরপন্থি আচরণ করছে। আমরা বলতে পারি-কট্টরপন্থি মদ্যপ/ চরমপন্থি ব্যভিচারী/ কট্টরপন্থি মূর্তিবাদী। কিন্তু শব্দটির দুদিকের এবং ব্যাপক মর্ম অনুযায়ী প্রয়োগ করার সুযোগ না দিয়ে ‘কট্টর ব্যভিচারী’ ও ‘মূর্তিপন্থিরা’ উল্টো ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে ভাষায়-ব্যবহারে কট্টরপন্থি মূর্তিবিদ্বেষী বা মূর্তিবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করার কাজ করছে।

এতে শব্দদুটির প্রকৃত মর্মের ব্যাপকতা রুদ্ধ হচ্ছে। মূর্তিবিরোধীদের কট্টরপন্থি হিসেবে চিহ্নিত করতে দিলেও ‘মূর্তি প্রতিষ্ঠায় কট্টরপন্থি’ কথাটি বলতে দিচ্ছে না। শব্দ প্রয়োগের একটা সত্য ও সঠিক প্রবাহ ও ব্যাপকতা এতে মারাত্মকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। শব্দের মুক্তি দরকার। এজাতীয় সংকোচন থেকে বাঁচা দরকার ভাষার।

এরকম আরেকটি শব্দ : ধর্মব্যবসা। ‘ধর্মব্যবসা/ ধর্মব্যবসায়ী’ শব্দদুটিও গালি হিসেবে চর্চা করছে এদেশের সেকুলার ও বিজেপিপন্থি কট্টর ইসলাম-বিদ্বেষী লোকেরা। তারা গালিটা দেয় মুসলমানদের সক্রিয় আলেমদের, যারা নানাভাবে সেকুলারদের ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করেন। হিন্দু-বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সাম্প্রদায়িকদের অনেকেই এ গালিটা দিচ্ছে মুসলমানদের। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, তারা তাদের মতলবী ও অসদুদ্দেশ্যপূর্ণ কর্মকাণ্ডের পক্ষে কাজ করার সময় মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান, মুক্তচিন্তা, বাকস্বাধীনতা ইত্যাদি শব্দের ইতিবাচক আবহের ব্যবহারটা করার চেষ্টা করে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে ‘ধর্মব্যবসায়ী’ বলে গালি দিলেও তারাও যে তাদের প্রয়োজনে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের  চেতনা ও ‘সংবিধান’ এর ব্যবহার বা ব্যবসাও করে যাচ্ছে, এ কথাটি কাউকে উচ্চারণ করতে দিচ্ছে না।

বাস্তবে রাজনীতি, সংস্কৃতি বা সমাজে ‘ব্যবসা’ শুধু ধর্মের হচ্ছে না। হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের, গণতন্ত্রের, সংবিধানের এবং আরো কিছু রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক পরিভাষা ও  চরিত্রের। এমনকি ‘ধর্মের ব্যবসা’ ব্যাপারটাও শুধু দৃশ্যমান ধার্মিক মানুষের সঙ্গে সীমাবদ্ধ কোনো প্রসঙ্গ নয়; বরং সেকুলার রাজনীতিকদের অনেকেই ১২ মাস ধর্মীয় বিষয়ে উন্নাসিকতা প্রকাশ করলেও নির্বাচনের আগে ধর্মীয় পোশাক-আশাক পরে ধর্মীয় বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি উচ্চারণে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে ইসলাম বিষয়ে ‘পাণ্ডিত্যপূর্ণ’ আলোচনা শুরু করে দেন। অনেক ক্ষমতাসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতাকে বিভিন্ন মাহফিলে প্রধান অতিথি বানিয়ে দাওয়াত করেও আনতে হয়। পোস্টারে প্রায় সবার উপরে বড় অক্ষরে তাদের নাম লিখতে হয়। এরাই মুখে সেকুলার রাজনীতির কথা বলে, বাস্তবে ইসলাম-বিদ্বেষী  ভমিকা পালন করে আর রাজনীতির প্রয়োজনে ব্যবসায়ীদের মতো ধর্মীয় পোশাক উপস্থাপন করে।

রাজনীতির জন্য ‘ধর্ম-ব্যবসার’ একটা মহড়া তারাই দিয়ে থাকে বলে ব্যাপক অভিযোগ। তারপরও মৌসুমী ‘ধর্ম-ব্যবসায়ী’ সেকুলার রাজনীতিকরা ১২ মাসের ইসলামভিত্তিক সক্রিয় ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতিকদের ‘ধর্মব্যবসায়ী’ হিসেবে গালি দেওয়ার কাজটি সীমাবদ্ধ করে রাখে। একটি ব্যাপক শব্দ ও শব্দ-পরিচিতিকে এভাবে তারা তাদের মর্জিমতো নির্দিষ্ট একটি শ্রেণির মধ্যে আবদ্ধ করে রাখে। এর মর্মকে ব্যাপক হতে দিতে চায় না। এ শব্দেরও মুক্তি দরকার।

সমস্যা শব্দের মধ্যে থেমে নেই। শব্দ থেকে সমস্যাটি আগে বেড়ে বাক্য পর্যন্ত চলে গেছে। রাজনৈতিক কারণে ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও আলেম সমাজের দিকে ইঙ্গিত করে একটি রাজনীতিক মহল গত কিছু দিন ধরে বলতে শুরু করেছেন- ‘বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানানোর চেষ্টা চলছে।’ হঠাৎ করে চমকে দেওয়ার মতো করে এজাতীয় বাক্য উচ্চারণ করা হচ্ছে। কেউ কেউ এর সঙ্গে যুক্ত করে আরও বলছেন- ‘বাংলাদেশকে আফগানিস্তান-পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’ ভাবটা এমন যে, মনে হচ্ছে গোপন কোনো তথ্য উদ্ঘাটন করে এসব বাক্য তারা উচ্চারণ করছে। অথচ বাস্তবতা এরকম নয়। এখানেও বাক্যের একটি সংকীর্ণ অথবা উল্টো ব্যবহারের ঘটনা ঘটছে

যারা কথায় কথায় ‘বাংলাদেশকে আফগানিস্তান/পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা চলছে’ বলে দাবি করছে, রাজনৈতিকভাবে এরা হচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সকল সাম্প্রদায়িকতা ও রাষ্ট্রীয় জুলুমের আনুকলে একেকজন নিঃশব্দ সমর্থক। দেশের সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী বিএসএফ কর্তৃক বিভিন্ন সময় গুলি করে বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করা হলে তারা কোনো প্রতিবাদ করে না। ভারতে মুসলমানদের হত্যা করা হলে এখানে তারা বলে, এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এরা বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্য, পানি আটকে রাখা, জুলুম-বৈষম্য বিস্তারের পক্ষে ভমিকা রাখে। অনেকেই মনে করেন, আফগিনাস্তানের কথা বলে বাংলাদেশকে এশ্রেণির রাজনীতিকরাই ‘হিন্দুস্তান বানাতে চাইছে’-সত্য থেকে  আড়াল করতে চাইছে। এই বাক্য ও শব্দ প্রয়োগেও একটি প্রয়োজনীয় সত্যকে ঢেকে রাখা এবং একটি মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টার ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে ‘হিন্দুস্তান বানানোর’ কথা উল্লেখ করলে এই বাক্য ও শব্দ হয়তো তার প্রয়োগে কিছুটা যথার্থতা পেত।

তর্কের খাতিরে বলা যেতেই পারে যে, যারা বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে কথায় কথায় পাকিস্তান-আফগানিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করতে চায়, তারা আসলে দেশটাকে হিন্দুস্তানের আগ্রাসন-ভমি বানানোর চক্রান্ত থেকে জনগণের চোখটাকে সরিয়ে রাখতে চায়। বস্তুত দেশপ্রেমিক মানুষের দাবি হচ্ছে, পাকিস্তান, আফগানিস্তান কিংবা হিন্দুস্তান নয়; স্বাধীন, ঈমানদার ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিকাশ।

 

 

advertisement