প্রতিবাদস্বরূপ পণ্য বয়কট
সালাফের যুগের কিছু ঘটনা এবং আলেমগণের মতামত
ফ্রান্স সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিকৃত মস্তিষ্কের কিছু লোক সে দেশে প্রকাশ্যে আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে অবমাননাকর বিভিন্ন কর্মকা- করে চলেছে। তারা বাকস্বাধীনতার নামে মুসলিমদের কলিজায় আঘাতের পর আঘাত দিয়ে যাচ্ছে।
পৃথিবীব্যাপী মুসলমানরা তাদের এ ঘৃণিত কাজের প্রতিবাদ করেছে। এখনো নানাভাবে নানা জায়গায় প্রতিবাদ হচ্ছে। প্রতিবাদের অংশ হিসাবে ফ্রান্সের পণ্য বয়কটের ডাকও দেওয়া হয়েছে। বহু মুসলিম ব্যবসায়ী তাদের দোকান থেকে ফ্রান্সের পণ্য সরিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু সেইসাথে দেখা যাচ্ছে, দেশে বা দেশের বাইরে কেউ কেউ এই বয়কট বৈধ হওয়া নিয়ে আপত্তি তুলছেন। তারা বলতে চান, শরীয়তে এ ধরনের পণ্য বয়কটের ভিত্তি নেই। কোনো কোনো মহল থেকে আবার বলা হচ্ছে, অর্থনীতির বিষয়টাকে ধর্মের সাথে মেলানো উচিত নয়। ইসলাম মুক্ত-বাণিজ্যের অনুমতি দিয়েছে। এ ধরনের বয়কট ইসলামের মূল শিক্ষার সাথে যায় না ইত্যাদি। ফলে কারো কারো মাঝে বিষয়টি নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।
বাস্তবেই কি এ ধরনের বয়কটের শরয়ী কোনো ভিত্তি নেই! সালাফের যুগে কি এ ধরনের বয়কটের কোনো নজীর নেই! এব্যাপারে উম্মাহ্র আলেমগণই বা কী বলেন? এ বিষয়গুলোই এ নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য।
। এক।
প্রথমেই নযর দেয়া যাক কুরআনুল কারীমের এ আয়াতটির দিকে-
فَالَّذِیْنَ اٰمَنُوْا بِهٖ وَ عَزَّرُوْهُ وَ نَصَرُوْهُ وَ اتَّبَعُوا النُّوْرَ الَّذِیْۤ اُنْزِلَ مَعَهٗۤ اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ۠.
অর্থাৎ, যারা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছে, তাঁকে যথাযথ সম্মান করেছে ও সহযোগিতা করেছে এবং সেই নূরের অনুগত হয়েছে, যা তার সঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে তারাই সফলকাম। -সূরা আরাফ (৭) : ১৫৭
ইবনে আব্বাস রা. থেকে আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন-
وَ عَزَّرُوْهُ : حموه وقَّروه.
আয়াতে উল্লেখিত عَزَّرُوْهُ -এর অর্থ হচ্ছে, সম্মান করা, তাঁকে শত্রুর সব ধরনের আক্রোশ ও আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। (তাফসীরে তাবারী, সূরা আরাফ, আয়াত ১৫৭-এর অধীনে)
আরো দেখুন, সূরা তাওবা (৯) : ৪০; সূরা হাদীদ (৫৭) : ২৫
অতএব মুসলিমের ঈমানী দায়িত্ব- তার স্বর্বস্ব দিয়ে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যে কোনো ধরনের অবমাননা ও অসম্মান প্রতিহত ও প্রতিরোধ করবে।
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী আলবা‘লী রাহ. (৭৭৮ হি.) বলেন-
أن الله فرض علينا تعزيز رسوله وتوقيره ونصره ومنعه... وذلك يوجب صون عرضه بكل طريق.
(উক্ত আয়াতে) আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূলের সম্মান ও সাহায্য করা এবং তাঁকে (সব ধরনের প্রতিকূলতা থেকে) রক্ষা করা ফরয করেছেন। ...ফলে সর্ব প্রকার শক্তি ব্যয় করে হলেও মুসলিমদের জন্য তাঁর সম্মান রক্ষা করা কর্তব্য। -মুখতাসারুস সারিমিল মাসলূল, পৃ. ৮০
ইমাম নববী রাহ. বলেন-
النصيحة لرسول الله صلى الله عليه وسلم فتصديقه على الرسالة ...ونصرته حيا وميتا ومعاداة من عاداه وموالاة من والاه وإعظام حقه وتوقيره.
হাদীসে নির্দেশিত- النصيحة لرسول الله (তথা রাসূলের প্রতি কল্যাণকামিতা)-এর অর্থ হচ্ছে, তাঁর রিসালাতকে সত্য বলে বিশ্বাস করা। ...তাঁর জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর তাঁকে সাহায্য করা। তাঁর শত্রুকে শত্রু জ্ঞান করা, তাঁর বন্ধুকে বন্ধুরূপে বরণ করা, তাঁর পরিপূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করা এবং তাঁর যেকোনো হককে সবার উপরে প্রাধান্য দেয়া। -শরহে মুসলিম, নববী ২/৩৮
এক যুদ্ধে মুসলিম ও কাফেররা যখন সামনাসামনি হল, এক কাফের আল্লাহর রাসূলকে গালি দিল। তখন এক সাহাবী এগিয়ে গিয়ে বললেন, আমার নাম অমুক, আমার মায়ের নাম অমুক। তুই আমাকে গালি দে, আমার মাকে গালি দে; কিন্তু আমার রাসূলকে গালি দিস না। কাফের আরো উগ্র হল... একপর্যায়ে তিনি তার পিছু নিলেন এবং তাকে তরবারি দ্বারা আঘাত করলেন। তখন কাফেররা তাকে ঘিরে ধরল এবং তিনি শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করলেন। এ দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম খুশি হয়ে বললেন-
أعجبتم من رجل نصر الله ورسوله؟
তোমরা কি এই ব্যক্তিকে দেখে মুগ্ধ হচ্ছ না; যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করেছে। -আসসিয়ার, আবু ইসহাক ফাযারী, পৃ., ২১৫
ইতিহাসে এরকম আরো বহু ঘটনা ও বর্ণনা রয়েছে। যুগে যুগে মুসলমানরা নিজেদের জান-মাল ও স্বর্বস্ব দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মান রক্ষা করেছে এবং তাঁর যে কোনো ধরনের অবমাননা-অসম্মান প্রতিরোধ করেছে।
দেখুন, সহীহ বুখারী হাদীস, ২৫১০; সহীহ মুসলিম হাদীস, ১৮০১ আসসাইফুল মাসলূল আলা মান সাব্বার রাসূল, পৃ. ২৯১-৩৬৬
। দুই।
অন্যান্য অন্যায় কাজের বিরোধিতার মতো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবমাননার বিরোধিতা ও প্রতিবাদের ক্ষেত্রেও শরীয়তের স্বীকৃত মূলনীতি হল, সরাসরি বাধা প্রদান ও প্রতিহত করার শক্তি না থাকলে ‘সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিবাদ করা’। এর আলোকে প্রত্যেকে যার যার শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী এ ঘৃণ্য কাজটির বিরোধিতা ও প্রতিবাদ করবে। ‘তাকরিবুস সারিমিল মাসলূল’ গ্রন্থে এসেছে-
تطهير الأرض من إظهار سب رسول الله صلى الله عليه وسلم واجب بحسب الإمكان.. وذلك لأنه من تمام ظهور دين الله وعلو كلمة الله.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে গালি দেওয়ার মত ঘৃণ্য কাজ থেকে পৃথিবীকে মুক্ত রাখা সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিটি মুসলিমের উপর ওয়াজিব। কেননা এটা হচ্ছে, আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং তাঁর কালেমা সমুন্নত হওয়ার অংশ। -তাকরিবুস সারিমিল মাসলূল, পৃ. ১৭০
এ বিষয়ে সুবকী রাহ.-এর ভাষ্য হল-
وليس لي قدرة أن أنتقم بيدي من هذا الساب المعلون، والله يعلم أن قلبي كاره/منكر، ولكن لا يكفي الإنكار بالقلب هاهنا، فأجاهد بما أقدر عليه من اللسان والقلم، وأسأل الله عدم المؤاخذة بما تقصر يدي عنه.
আমার এই সামর্থ্য নেই যে, আমি হাত দিয়ে এই অভিশপ্ত গালিদাতা থেকে প্রতিশোধ নিব। তবে আল্লাহ তো জানেন- আমার মনের অবস্থা কী! তবে এটি এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে শুধু অন্তরের প্রতিবাদ যথেষ্ট নয়। (মুসলিম হিসেবে) আমার কর্তব্য হল, আমি সামর্থ্য অনুযায়ী নিজের যবান ও কলম দ্বারা তার বিরুদ্ধে জিহাদ করব। আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবো- তিনি যেন আমার এ অক্ষমতাকে ক্ষমা করে দেন। -আসসাইফুল মাসলূল, পৃ. ১১৪
সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিবাদ হতে পারে অর্থনৈতিক, সামাজিক বা অন্য যে কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ইবনুল কায়্যিম রাহ. বলেন-
فالطرق التي تتضمن نفع المسلمين والذب عن الدين ونصر المظلومين وإغاثة الملهوفين ومعارضة المحتالين بالباطل ليدحضوا به الحق من أنفع الطرق وأجلها.
যত পন্থা ও পদক্ষেপ (অর্থনৈতিক, সামাজিক বা অন্য যে কোনো ধরনের পদক্ষেপ যা) মুসলমানদের উপকারে আসে, দ্বীন ও শরীয়তের উপর আগত যে কোনো আক্রমণ প্রতিহত করে, মজলুম ও বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করে এবং বাতিলপন্থীদের হক-বিরুদ্ধ ষড়যন্ত্র নস্যাতের কাজ দেয়- তা উত্তম ও মর্যাদাশীল পদক্ষেপের অন্তর্ভুক্ত। -ইগাছাতুল লাহফান ২/৭৬৫
। তিন।
কাউকে কোনো কাজ থেকে নিবৃত্ত করার জন্য অর্থনৈতিক বয়কট যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটি পন্থা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের যুগেও এ ধরনের পদক্ষেপের নজীর পাওয়া যায়। কয়েকটা ঘটনার বিবরণ দেখুন :
প্রথম ঘটনা : সহীহ বুখারীর এক দীর্ঘ হাদীসে এসেছে, একটি অভিযানে ইয়ামামাবাসীদের সরদার ছুমামা ইবনে উছাল রা.-কে গ্রেফতার করে নিয়ে আসার কয়েকদিন পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মুক্ত করে দিলে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর উমরা আদায়ের জন্য মক্কায় গমন করেন। মক্কার কাফেররা তাকে উত্ত্যক্ত করে। এর জবাবে তিনি তাদেরকে বলেন-
وَلاَ وَاللهِ، لاَ يَأْتِيكُمْ مِنَ اليَمَامَةِ حَبَّةُ حِنْطَةٍ، حَتَّى يَأْذَنَ فِيهَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
আল্লাহর কসম! নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুমতি ছাড়া ইয়ামামা থেকে আর একটা শস্যদানাও তোমাদের কাছে আসবে না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৩৭২
হযরত ছুমামা রা. নিজ শহরে ফিরে গেলেন এবং মক্কায় শস্য রফতানী বন্ধ করে দিলেন। মক্কার সকল খাদ্যশস্যের যোগান হতো ইয়ামামা থেকে। ফলে কুরাইশরা দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হল। তখন তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে চিঠি লিখল। ছুমামা কর্তৃক খাদ্যশস্য বন্ধ করে দেওয়ার কারণে তাদের উপর নেমে আসা কষ্টের কথা জানাল। আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে ছুমামাকে খাদ্য সরবরাহের জন্য চিঠি লিখতে অনুরোধ করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছুমামাকে চিঠি লিখলেন- তিনি যেন মক্কায় খাদ্য রফতানি জারি করে দেন। (দ্রষ্টব্য : মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৩৬১; সুনানে কুবরা, বায়হাক, হাদীস ১৮০৩১)
হাদীসটির আলোচনায় ‘আল মুকাতাআতুল ইকতিসাদিয়্যা’ গ্রন্থে লেখা হয়েছে-
وهذه القصة واضحة الدلالة فيما يأتي :
১. وقوع المقاطعة الإقتصادية وكونها مشروعا في الصدر الأول من الإسلام.
২. استخدام هذه المقاطعة ضد العدو لتحصيل مكاسب أو تقليل مفاسد.
৩. أثر الأفراد ودورهم المؤثر في تفعيل هذه المقاطعة وتقويتها.
হাদীসে বর্ণিত উপরিউক্ত ঘটনাটি নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রমাণ বহন করে :
১. ইসলামের প্রাথমিক যুগে অর্থনৈতিক বয়কটের প্রমাণ এবং তা বৈধ হওয়া।
২. শত্রুর অনিষ্টতার বিলোপ বা অন্য কোনো উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য এ ধরনের অর্থনৈতিক বয়কট আরোপ।
৩. এ ধরনের বয়কট শক্তিশালী ও কার্যকরী করার ক্ষেত্রে ব্যক্তি-প্রভাবের ভূমিকা। -আল মুকাতাআতুল ইকতিসাদিয়্যাহ, পৃ. ৫৬
উপরিউক্ত হাদীসটি দ্বারা সমসাময়িক আরো অনেক গবেষক আলেম প্রচলিত পণ্য বয়কটের পক্ষে দলীল প্রদান করেছেন। বিশিষ্ট গবেষক আলেম শায়েখ হুসামুদ্দীন আফফানা বলেন-
وما قام به ثمامة بن أثال رضي الله عنه يعتبر نوعاً من المقاطعة الاقتصادية وقد أقره النبي صلى الله عليه وسلم على تلك المقاطعة الاقتصادية واستمرت تلك المقاطعة إلى أن طلب الرسول صلى الله عليه وسلم من ثمامة بن أثال وقفها.
ছুমামা রা. যা করেছেন তা এক প্রকার অর্থনৈতিক বয়কট। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার এ পদক্ষেপে বাধা দেননি। তার উপর কোনো আপত্তি করেননি। এ বয়কট অব্যাহত ছিল- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা উঠিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে চিঠি লেখা পর্যন্ত। -ফাতাওয়া ইয়াসআলুনাক ১১/২৪
দ্বিতীয় ঘটনা : খলীফা আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ানের যুগে রোম থেকে দিনার-দিরহাম আমদানী করা হত। এর বিনিময়ে মুসলমানরা তাদের কাছে কাগজ রফতানি করত। মুসলমানরা যে পাত্রে করে কাগজ পাঠাত তার গায়ে লেখা থাকত-
لَنْ یَّسْتَنْكِفَ الْمَسِیْحُ اَنْ یَّكُوْنَ عَبْدًا للهِ وَ لَا الْمَلٰٓىِٕكَةُ الْمُقَرَّبُوْنَ .
(মাসীহ কখনো আল্লাহর বান্দা হওয়াতে লজ্জাবোধ করেন না; অনুরূপ নৈকট্যশীল ফিরিশতারাও না। -সূরা নিসা (৪) : ১৭২
একবার রোমের সম্রাট এ লেখাটি দেখে ভীষণ রেগে যান। কেননা তারা ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহর পুত্র বলে ধারণা করত। সংক্ষুব্ধ সম্রাট খলীফা আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ানের কাছে চিঠি লেখে- যদি এ লেখাটি বাদ দেওয়া না হয় তাহলে আমি দিনার-দিরহামের উপর তোমাদের নবীর ব্যাপারে কটাক্ষমূলক কথা লিখে দিব। চিঠি পেয়ে আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান চিন্তায় পড়ে গেলেন। ইত্যবসরে খালেদ ইবনে ইয়াযিদ ইবনে মুআবিয়া রাহ. উপস্থিত হলেন। তিনি খলীফার চিন্তার কারণ জানতে পেরে তাকে বললেন-
لا تغتم، اجعل عندك دارا للضرب، واضرب فيها وامنعه القراطيس فإنه سيحتاج إليها فيأخذها على ما تشاء.
চিন্তা করবেন না, নিজেরা দিনার বানানো শুরু করেন এবং রোমের কাছে কাগজ রফতানী বন্ধ করে দেন। তাদের কাগজের প্রয়োজন হলে আপনি যেভাবে চান তারা সেভাবেই নিতে বাধ্য হবে। আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান তার কথা মতো নিজেরা মুদ্রা বানানো শুরু করেন এবং রোমে কাগজ রফতানি বন্ধ করে দেন। -বুগইয়াতুত তলাব ফী তারিখি হালাব ৭/৩১৯৪
অর্থনৈতিক বয়কট সম্পর্কে সমকালীন উলামায়ে কেরামের মন্তব্য
ভারতীয় উপমহাদেশের উলামায়ে কেরামের অভিমত
হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. বলেন-
بائكاٹ يا نان كوأپرشين يہ شرعا افراد جہاد ميں سے نہيں بلكہ مستقل تدابير مقاومات كی ہيں جو فی نفسہ مباح ہيں۔
অর্থাৎ বয়কট ও অসহযোগ আন্দোলন এটা মৌলিকভাবে জিহাদ নয়; তবে তা শত্রুকে দুর্বল করার একটি কৌশল। যা মুবাহ তথা একটি বৈধ পন্থা। -হাকীমুল উম্মত কী সিয়াসী আফকার, পৃ. ৬০
হযরত মাওলানা যফর আহমদ উসমানী রাহ. বলেন-
اگر كسى مصلحت كے لئے ولايتى مال کو چهوڑ كر ديسى مال اختيار كرليا جائے اور اعتقادا اسكو بهی جائز سمجها جائے تو يہ بهى جائز ہے بلكہ مصلحت پر نظر كركے اچھا ہے ۔
যদি কোনো বৃহৎ স্বার্থের কারণে শত্রু-রাষ্ট্রের পণ্য ছেড়ে দেশি পণ্য ব্যবহার করা হয় তবে সেটা বৈধ; বরং বৃহৎ স্বার্থ বিবেচনায় এমনটি করা উত্তমও বটে। -ইমদাদুল আহকাম ৪/৩৩২
মুফতী কেফায়াতুল্লাহ রাহ. বলেন-
کھدر پہننے کا حکم ملک و وطن کی بھلائی اور دشمن کو کمزور کرنے کی ایک تدبیر ہے۔
(ইংরেজদের কাপড় বয়কট করে) খদ্দরের কাপড় পরা দেশ ও জাতির কল্যাণ এবং শত্রুকে দুর্বল করার একটি কৌশল। -কিফায়াতুল মুফতী ৯/৩৮৫
আরব উলামায়ে কেরামের অভিমত
অর্থনৈতিক বয়কট সম্পর্কে আরবের উলামায়ে কেরামের অবস্থান বর্ণনা করতে গিয়ে ‘আলমুকাতাআতুল ইকতিসাদিয়্যাহ’ কিতাবের লেখক বলেন-
بعد البحث والاستقصاء والنظر في أقوال العلماء المعاصرين الذين خاضوا في المقاطعة الاقتصادية لم أجد ممن يعتد بقوله قد نصر عدم مشروعية المقاطعة الاقتصادية ...غاية القول أن من أهل العلم من قال بمشروعية المقاطعة مطلقا. وفريق آخر ربط حكم المقاطعة بإذن ولي الأمر.
সমসাময়িক উলামায়ে কেরামের বক্তব্য নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা ও অনুসন্ধানের পর নির্ভরযোগ্য এমন কোনো আলেমকেই পাইনি, যিনি এ ধরনের বয়কটকে নাজায়েয বলেছেন। সর্বোচ্চ এতটুকু যে, তাদের মধ্য থেকে কিছু আলেম এ ধরনের বয়কটকে শর্তহীনভাবে জায়েয বলেছেন। আর কিছু আলেম এ ধরনের বয়কট জায়েয হওয়ার জন্য শর্ত দিয়েছেন যে, তা রাষ্ট্রপ্রধানের বা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলের নির্দেশনা ও অনুমতিক্রমে হতে হবে।
এরপর তিনি উভয় মতের উলামায়ে কেরামের নাম ভিন্ন ভিন্নভাবে উল্লেখ করেন, যারা শর্তহীনভাবে বয়কটকে জায়েয বলেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন :
শায়েখ আব্দুর রহমান ইবনে নাসির আসসাদী রাহ., শায়েখ নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহ., আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে জিবরীন, ইউছুফ আলকারযাভী, শায়েখ হামূদ ইবনে উকালা আশশা‘বীসহ অন্যান্যরা।
আর যারা রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশনা ও অনুমতি সাপেক্ষে জায়েয বলেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন : শায়েখ সালেহ আলফাওযান, আললাজনাতুদ দায়িমা ফতোয়াবোর্ডের আলেমগণ। -আলমুকাতাআতুল ইকতিসাদিয়্যাহ, পৃ. ৯৯-১০১
উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, বর্তমানে ফ্রান্সে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ এবং তাঁর শানে বেয়াদবিমূলক যে ঘৃণ্য কাজগুলো হচ্ছে, এর প্রতিবাদস্বরূপ সে দেশের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং তাদের পণ্য বয়কট করা- এ ঘৃণ্য কাজের প্রতিবাদের একটি উত্তম ও কার্যকর পন্থা। এটা নিজেদের ঈমানী দায়িত্ব পালনেরই একটি অংশ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাসসহ সালাফে সালেহীনের যুগেও এ ধরনের বয়কটের দৃষ্টান্ত রয়েছে।
সুতরাং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শত্রুদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক বয়কট জায়েয হওয়ার বিষয়েকোনো প্রকার সংশয়ের অবকাশ নেই।