দুআয়ে মাগফিরাত
তালীমুল কুরআনের খেদমতে নিবেদিত নাটোরের মাওলানা উবায়দুল্লাহ মাত্র দুই সপ্তাহ আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। মোটরসাইকেলে চেপে গন্তব্যে যাওয়ার পথে মহাসড়কে এক আকস্মিক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। গত ২৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪২ হি. মোতাবেক ১৫ নভেম্বর ২০২০ঈ. রবিবার সকালে এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে।
সেদিন ছিল নাটোর শহরের অদূরে অবস্থিত শিঙরা মাদরাসায় এক দ্বীনী প্রোগ্রাম। সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন বরেণ্য ওলামায়ে কেরামের এক বড় জামাত। তাদের যাওয়ার পথেই পড়ে ‘দারুল উলুম শাপলার মোড়’। এ মাদরাসার যিম্মাদার মরহুমের ছোট ভাই মাওলানা খুবাইবের অনুরোধে মূল প্রোগ্রামে যোগদানের আগে অল্প সময়ের জন্য এখানে তাশরীফ রাখতে সম্মত হন মেহমানরা। সকাল আটটায় তাদের এখানে এসে পৌঁছার কথা।
এই মেহমানদের এস্তেকবালের উদ্দেশ্যেই বাদ ফজর রওয়ানা হয়েছিলেন মাওলানা উবায়দুল্লাহ। আনুমানিক সাড়ে সাতটার দিকে শাপলার মোড়ের কাছাকাছি আসার পর বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ট্রাক সামনের বাসকে তড়িঘড়ি অতিক্রম করতে গিয়ে তাকে চাপা দিয়ে দেয়! ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক ভ্যানচালক দৌড়ে এসে মোটরসাইকেলের নিচ থেকে তাকে উদ্ধার করেন। সমস্ত শরীর তার তখন রক্তে ভেসে গেছে। ভেঙ্গে থেতলে গিয়েছে ডান হাত ও ডান পা।
ভ্যানচালকের বর্ণনামতে, ঐ অবস্থাতেই তিনি বলছিলেন, ‘ভাই দুনিয়া বহুত দেখেছি, দুনিয়া কইরেন না। আমি উবায়দুল্লাহ চলে যাচ্ছি, আপনাদেরও যাইতে হবে।’ এরপর তিনি কালেমা পাঠ করতে থাকেন।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ছুটে আসেন মাওলানার মামা এবং ছোট ভাই খুবাইব। প্রথমে তাকে নাটোর হাসপাতালে, তারপর রাজশাহী হাসপাতালে নেয়া হয়। তবে সেখানে পৌঁছার পর ইমার্জেন্সি রোগীদের দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষমাণ অবস্থায় তিনি ‘আখেরাতের সফরে’ রওয়ানা হয়ে যান!
إن لله ما أخد و له ما أعطي وكل شيء عنده إلى أجل مسمى.
মাওলানা খুবাইব জানিয়েছেন, এ্যাম্বুলেন্সে তোলার পর তিনি বেশ কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করেন, কিন্তু আওয়াজ ছিলো এতই ক্ষীণ যে, কী বলছেন কিছুই বোঝা যাচ্ছিলো না। শুধু এইটুকু বোঝা গেলো যে, ‘আমাকে ডান কাত করে শুইয়ে দাও’। এরপর সারা পথ তার ঠোঁট নড়তে থাকে। কখনো মনে হচ্ছিল, ইস্তেগফার পাঠ করছেন। কখনো মনে হচ্ছিল, কোনো সূরা তিলাওয়াত করছেন।
মরহুমের ইন্তেকাল হয় সকাল সাড়ে দশটায়। জানাযা অনুষ্ঠিত হয় রাত নয়টায়, তাদের বাড়ীর কাছে হৈবৎপুর ফাযিল মাদরাসার মাঠে। তাঁর বাবা মাওলানা আবুল বারাকাত ছাহেবের বক্তব্য হল, ‘এই মাঠে গত সত্তর বছরে জানাযায় মানুষের এত বৃহৎ সমাগম আমি আর দেখিনি’।
তালীমুল কুরআনের খেদমতের বদৌলতে মাওলানা উবায়দুল্লাহ মানুষের সীমাহীন ভালবাসা অর্জন করেছিলেন। ইন্তেকালের আগের বছরগুলোতে তিনি নাটোর শহরে মোট পাঁচ জায়গায় বয়স্কদের কুরআন শেখানোর মুবারক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। স্থানের দূরত্ব সত্তে¦ও সবক’টি জায়গাতেই তিনি দৈনিক যেতেন। এছাড়া তিনি নাটোর পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউট জামে মসজিদে ইমাম ও খতীব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এর আগে তিনি কিশোরগঞ্জে দীর্ঘ এক যুগ তালীমুল কুরআনের খেদমত আঞ্জাম দেন। সেখানেও আছে তার অনেক ভক্ত ও শিষ্য।
তিনি ছিলেন হাসিখুশী, সহজ-সরল, অমায়িক স্বভাবের মানুষ। তবে ছিলেন বিচক্ষণ, কর্মঠ এবং দায়িত্বশীল। খুব সহজেই সবার সাথে মিশতে পারতেন। তাঁর সাথে আমার একবারই সাক্ষাৎ হয়েছে। সেই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি আমার মন জয় করে ফেলেছিলেন।
তাঁর জন্ম ১৯৮১ সনে। পড়াশোনা করেছেন বগুড়া জামিল মাদরাসায়। দাওরা শেষ করেছেন ২০০৫-এ।
তিনি চার সন্তানের জনক। এক মেয়ে, তিন ছেলে। ছোটো ছেলের জন্ম তার ইন্তেকালের মাত্র পাঁচ দিন পরে, ২০ নভেম্বর ২০২০, জুমাবার। বাবার সাক্ষাৎ তার নছীব হয়নি। আল্লাহ তাআলা তাকে বাবার মতোই ঈমানওয়ালা এবং কুরআনওয়ালা বানান- আমীন।
মাওলানা উবায়দুল্লাহকে আল্লাহ তাআলা ভরপুর মাগফিরাত করুন এবং তাকে জান্নাতের আলা মাকাম দান করুন। তার শোকসন্তপ্ত পরিবারকে উত্তম ধৈর্যধারণের তাওফীক দিন এবং মরহুমের অবর্তমানে তিনিই তাদের কাফীল হয়ে যান- আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন!
-মাসউদুযযামান