হাদীস ও আসারে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ও রাকাত-সংখ্যা
ভূমিকা
মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
الحمد لله وسلام على عباده الذين اصطفى، وأشهد أن لا إله إلا الله وأشهد أن محمدا عبده ورسوله، أما بعد :
এটা তো প্রতিটি মুসলিমের জানা- আল্লাহ তাআলার নিকট সে-ই মুমিন ও মুসলিম হিসেবে গণ্য, যার আল্লাহ্র কুরআনের প্রতিও ঈমান আছে এবং আল্লাহ্র সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিও ঈমান আছে। সুতরাং কেউ যদি কুরআনকে আল্লাহ্র নাযিলকৃত সত্য কিতাব হিসেবে মানে, কিন্তু রাসূলকে না মানে, সে মুমিন নয়; বরং নিঃসন্দেহে সে অমুসলিম। তেমনিভাবে কেউ যদি রাসূলকে মানে, তবে কুরআনকে অবিশ্বাস করে, সেও মুমিন নয়; বরং নিঃসন্দেহে সে অমুসলিম।
এটা তো একদম স্পষ্ট- যে লোক কুরআনের কিছু কথা মানে আর কিছু কথা মানে না, সে কখনো মুমিন হতে পারে না। মুমিন হওয়ার জন্য সম্পূর্ণ কুরআনের প্রতি ঈমান আনা জরুরি। তেমনিভাবে রাসূলের প্রতি ঈমান আনা তখনই শুদ্ধ হবে যখন নিঃশর্তভাবে রাসূলকে মানবে এবং তাঁর সকল কথাকে সত্য জ্ঞান করবে।
যদি কেউ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই কথা মানে- ‘আল্লাহ তাআলা আমার প্রতি এই কুরআন অবতীর্ণ করেছেন’, কিন্তু তাঁর এই কথা না মানে যে, ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর অমুক কাজ ফরয করেছেন’, কিংবা ‘অমুক জিনিস তোমাদের জন্য হারাম করেছেন’- তাহলে সে কখনো মুমিন হিসেবে গণ্য হবে না।
সকল মুসলিম এ বিষয়ে একমত এবং ইসলামের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অসংখ্য-অগণিত সূত্রে ও অবিচ্ছিন্ন কর্মধারায় একথা বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য কুরআনে কারীম নিয়ে এসেছেন, সেভাবে তিনি আমাদেরকে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয হওয়ার হুকুমও দান করেছেন এবং শিখিয়েছেন- কোন্ সালাতের ওয়াক্ত কোন্টি এবং কোন্ সালাত কত রাকাত?
অতএব যে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত বিষয়াবলির কিছু মানে আর কিছু মানে না, তার মুমিন ও মুসলিম হওয়ার কল্পনাই করা যায় না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্র পক্ষ থেকে আমাদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের যে হুকুম ও আমল দান করেছেন সেটা এমনই স্বতঃসিদ্ধ, যেমন স্বতঃসিদ্ধ এই কথা- তিনি আমাদের জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে কুরআনে কারীম নিয়ে এসেছেন।
আল্লামা ইবনে হাযম রাহ. তাঁর কিতাব ‘আলফিসাল ফিল মিলালি ওয়াননিহাল’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এ বিষয়ে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা ও দ্বীনী বিষয়াবলি তাঁর থেকে আমাদের পর্যন্ত কতভাবে পৌঁছেছে। এর কিছু বিষয় এমন, যেগুলো সবচাইতে শক্তিশালী মাধ্যমে এবং সবচেয়ে নিশ্চিতভাবে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে। এ ধরনের কিছু বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আল্লামা ইবনে হাযম রাহ. লেখেন-
...شَيْءٌ يَنْقُلهُ أهل الْمشرق وَالْمغْرب عَن أمثالهم جيلاً جيلاً، لَا يخْتَلف فِيهِ مُؤمنٌ وَلَا كَافِرٌ منصفٌ غير معاندٍ للمشاهدة، وَهُوَ الْقُرْآن الْمَكْتُوب فِي الْمَصَاحِف، فِي شَرْق الأَرْض وغربها، لَا يَشُكُّونَ وَلَا يَخْتَلِفُونَ فِي أَن مُحَمَّد بن عبد الله بن عبد الْمطلب أَتَى بِه، وَأخْبر أَن الله عز وَجل أوحى بِهِ إِلَيْهِ، وَأَن من اتبعهُ أَخذه عَنهُ كَذَلِك، ثمَّ أَخذ عَن أُولَئِكَ حَتَّى بلغ إِلَيْنَا.
وَمن ذَلِك الصَّلَوَات الْخمس، فَإِنَّهُ لَا يخْتَلف مُؤمن وَلَا كَافِر وَلَا يشك أحد أَنه صلاهَا بِأَصْحَابِهِ كل يَوْم وَلَيْلَة فِي أَوْقَاتهَا الْمَعْهُودَة، وصلاها كَذَلِك كل من اتبعهُ على دينه، حَيْثُ كَانُوا كل يَوْم هَكَذَا إِلَى الْيَوْم، لَا يشك أحد فِي أَن أهل السِّنْد يصلونها كَمَا يُصليهَا أهل الأندلس، وَأَن أهل الأرمِيْنية يصلونها كَمَا يُصليهَا أهل الْيمن.
وكصيام شهر رَمَضَان، فَإِنَّهُ لَا يخْتَلف كَافِر وَلَا مُؤمن وَلَا يشك أحد فِي أَنه صَامَهُ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم، وصامه مَعَه كل من اتبعهُ فِي كل بلد كل عَام، ثمَّ كَذَلِك جيلاً جيلاً إِلَى يَوْمنَا هَذَا.
وكالحج فَإِنَّهُ لَا يخْتَلف مُؤمن وَلَا كَافِر وَلَا يشك أحد فِي أَنه عَلَيْهِ السَّلَام حج مَعَ أَصْحَابه وَأقَام الْمَنَاسِك، ثمَّ حج الْمُسلمُونَ من كل أفق من الآفاق كل عَام فِي شهر وَاحِد مَعْرُوف إِلَى الْيَوْم.
وكجملة الزَّكَاة، وكسائر الشَّرَائِع الَّتِي فِي الْقُرْآن، من تَحْرِيم القرائب وَالْميتَة وَالْخِنْزِير، وَسَائِر شرائع الْإِسْلَام، وكآياته من شقّ الْقَمَر وَدُعَاء الْيَهُود الَّتِي تمنى الْمَوْت، وَسَائِر مَا هُوَ فِي نَص الْقُرْآن مقروءٌ ومنقولٌ.
এর সারকথা হল, ইসলামের কিছু বিষয় এমনই স্বতঃসিদ্ধ যে, সেগুলো পূর্ব-পশ্চিমের অধিবাসীরা প্রজন্ম পরম্পরায় বর্ণনা করে আসছে। এসব বিষয়ে কোনো মুসলিমের মাঝে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি কোনো অমুসলিমও এতে সন্দেহ পোষণ করে না।
যেমন কুরআন মাজীদ। পূর্ব-পশ্চিমের কারো এ বিষয়ে সন্দেহ নেই- ‘মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এটি নিয়ে এসেছেন। তিনি জানিয়েছেন, আল্লাহ তাআলা এটি তাঁর প্রতি ওহীরূপে নাযিল করেছেন। তাঁর সাহাবীগণ এটি তাঁর থেকে সেভাবেই গ্রহণ করেছেন। তাঁদের থেকে গ্রহণ করেছেন তাঁদের পরবর্তীগণ। এভাবে তা আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে।
এ ধরনের আরেকটি বিষয় হল পাঁচ ওয়াক্ত সালাত। কারণ, কোনো মুমিনের এ বিষয়ে সন্দেহ নেই এবং কোনো অমুসলিমও এতে সন্দেহ পোষণ করে না যে, ‘হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের নিয়ে দৈনিক নির্দিষ্ট সময়ে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতেন। স্থান-কাল নির্বিশেষে আজ পর্যন্ত তাঁর সকল অনুসারীও তাঁর মত দৈনিক নির্ধারিত সময়ে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে।’
এরকম আরেকটি বিষয় রমযান মাসে সিয়াম পালন। কেননা, কোনো মুমিনের এ বিষয়ে সন্দেহ নেই এবং কোনো অমুসলিমও এতে সন্দেহ পোষণ করে না যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে সিয়াম পালন করেছেন। স্থান-কাল নির্বিশেষে তাঁর সকল অনুসারী তাঁর মত রমযান মাসে সিয়াম পালন করেছে। এভাবে তা প্রজন্ম পরম্পরায় আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে।
হজ¦ ও যাকাতও এমনই স্বতঃসিদ্ধ ও সর্ববাদিসম্মত বিষয়। এছাড়া ওসব বিধান, যেগুলো কুরআনে কারীমে সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে সেসবও এই প্রকারের। -আলফিসাল ফিলমিলালি ওয়াননিহাল, খ. ২, পৃ. ৬৭-৬৮
আল্লামা ইবনে হাযম রাহ. তাঁর আরেক কিতাব ‘আলইহকাম ফী উসূলিল আহকামে’ এ বিষয়ে লিখেন-
وجدنا الأخبار تنقسم قسمين-
خبرٌ تَواتَر : وهو ما نَقَلتْه كافةٌ بعد كافةٍ حتى تَبلُغَ به النبيَّ صلى الله عليه وسلم
وهذا خبرٌ لم يختلفْ مسلمان في وجوب الأخذِ به وفي أنه حق مقطوع على غيبه، لأن بمثلِه عَرَفنا أن القرآن هو الذي أَتَى به محمدٌ صلى الله عليه وسلم، وبه علِمنا صحةَ مبعثِ النبيِّ صلى الله عليه وسلم، وبهِ علِمنا عددَ ركوعِ كلِّ صلاةٍ وعددَ الصلوات، وأشياءَ كثيرةً من أحكامِ الزكاة وغيرِ ذلك مما لم يُبَيِّنْ في القرآن تفسيرُه.
এর সারকথা হল, দ্বীনের অনেক বিষয় এমন, যেগুলো অসংখ্য-অগণিত সূত্রে বর্ণিত। পরিভাষায় এগুলোকে বলা হয় মুতাওয়াতির। অর্থাৎ প্রত্যেক যুগে অসংখ্য-অগণিত মানুষ তা বর্ণনা করে। এভাবে অগণিত-অসংখ্য সূত্রে বর্ণনার ধারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছে।
এ ধরনের বিষয় অকাট্য এবং অবশ্য-অনুসরণীয়। এ বিষয়ে কোনো মুসলিমের মাঝে কোনো মতবিরোধ নেই। এরূপ অকাট্য সূত্রেই আমরা সন্দেহাতীতভাবে জানতে পেরেছি- কুরআন সেই কিতাব, যা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়ে এসেছেন এবং আল্লাহ তাআলা তাঁকে (সর্বশেষ) নবী ও রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন। সন্দেহাতীতভাবে আরো জানতে পেরেছি সালাত-সংখ্যা ও প্রত্যেক সালাতের রাকাত-সংখ্যাসহ আরো অনেক বিধান। -আলইহকাম ফী উসূলিল আহকাম, খ. ১, পৃ. ১০২১
ইমাম তবারী রাহ. ইসলামী আকীদার কিতাব ‘আততাবসীর ফী মাআলিমিদ্দীন’-এ সেই লোকদের আলোচনা করেন, যারা ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাওয়ার কারণে মুরতাদ হয়ে গেছে। আলোচনার একপর্যায়ে বলেন, যারা যোহর ও আসরের সালাত অস্বীকার করে (অর্থাৎ বলে, সালাত তিন ওয়াক্ত) বা ইসলামের যে কোনো একটি ফরয অস্বীকার করে তারা বেদ্বীন এবং মুরতাদ। তাঁর পুরো আলোচনা এই-
والذين جَحَدوا من الفرائض ما جاءت به الحجةُ من أهل النقلُ بنَقْلِه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم ظاهراً مستفيضاً قاطعاً للعذر، كالذين أنكروا من وجوبِ صلاة الظهر والعصر، والذين جحدوا رَجْمَ الزاني المُحصِنِ الحرِّ من أهل الإسلام، وأَوجَبوا على الحائض الصلاةَ في أيام حَيضها، ونحوِ ذلك من الفرائض، فإنهم عندي بما دَانُوا به من ذلك مَرَقَةٌ من الإسلام، خَرَجُوا على إمامِ المسلمين أولَمْ يَخرُجوا عليه، إذا دَانُوا بذلك بعدَ نقلِ الحجةِ لهم الجماعةُ التي لا يَجُوز في خبرها الخطأ ولا السهوُ والكذبُ.
وعلى إمام المسلمين استِتابَتُهم مِمَّا أَظهَروا أنهم يَدِينُون به بعد أن يُظهِرُوا الديانةَ به والدعاءَ إِلَيْهِ، فمَنْ تاب منهم خَلَّى سَبيلَه، ومَنْ لَمْ يَتُبْ مِن ذلك منهم قَتَلَه على الرِّدَّة؛ لِأنَّ مَنْ دَانَ بذلك فهو لِدِينِ الله -الذي أمرَ به عِبَادَه بما لا نَعْذرُ بالجهلِ به نَاشِئاً نشأ في أرض الإسلام- جَاحِدٌ.
ومَنْ جحدَ من فرائضِ الله -عز وجل- شيئاً بعد قيام الحُجَّة عليه به فهو مِنْ ملةِ الإسلام خارجٌ.
-আততাবসীর ফী মাআলিমিদ্দীন, পৃ. ১৬১-১৬২
কথা লম্বা হয়ে গেল। আমি শুধু বলতে চেয়েছিলাম- দ্বীন ও শরীয়ত জানার জন্য মুমিন শুধু এটুকু দেখে যে, এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কী শিক্ষা দিয়েছেন; এক্ষেত্রে তিনি আমাদেরকে আল্লাহ্র কী পয়গাম শুনিয়েছেন। সে এই পার্থক্য করে না- তাঁর এই শিক্ষা কুরআনে আছে, নাকি হাদীস ও সুন্নাহ্য়; কুরআনে থাকলে মানবে আর কুরআনে না থাকলে মানবে না- নাউযু বিল্লাহ।
কোনো মুসলমান এটা কল্পনাও করতে পারে না। যেই লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই কথা মানে না- ‘আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন’, এরপর কোন্ যুক্তিতে সে তাঁর এই কথা সত্য মনে করবে যে, ‘আল্লাহ তাআলা আমার উপর এই কুরআন নাযিল করেছেন?! ব্যস, এই হল তথাকথিত ‘আহলে কুরআনের’ নির্বুদ্ধিতা। ওরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিছু কথা মানে আর কিছু কথা মানে না। এভাবে ওরা ঈমানহারা হয়ে অমুসলিমদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
সাধারণ মুসলমান ভাইদের উপকারের জন্য আমরা এই প্রবন্ধে ফরয সালাত কত ওয়াক্ত, কোন্ সালাত কোন্ ওয়াক্তে, কোন্ সালাত কত রাকাত- এসব বিষয়ে বর্ণিত খাতামুন নাবিয়্যীন হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস শরীফের একটি বড় অংশ বাংলা তরজমাসহ পেশ করছি। যে কেউ চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে এই হাদীসসমূহ অধ্যয়ন করবে, সে অনুভব করবে- যে লোক পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের কোনো একটিকে অস্বীকার করে, সে কত বড় অপরাধী এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা থেকে বিমুখ হয়ে সে কীভাবে নিজেকে ঈমান ও ইসলাম থেকে বের করে দিয়েছে!
এমনিভাবে যারা আকীদা হিসেবে তো বিশ্বাস করে- আল্লাহ তাআলা আমাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন, কিন্তু আমলের ক্ষেত্রে অবহেলা করে; সালাত কখনো পড়ে, কখনো পড়ে না; কিংবা শুধু জুমা ও দুই ঈদের সালাত গুরুত্বের সঙ্গে পড়ে আর অন্যান্য সালাতের ক্ষেত্রে অবহেলা করে- এরা মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও কত বড় গুনাহগার!! তাদের উচিত, কুরআনে কারীমের এই বাণী সর্বদা স্মরণে রাখা-
فَوَیْلٌ لِّلْمُصَلِّیْنَ، الَّذِیْنَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُوْنَ .
সুতরাং বড় দুর্ভোগ আছে সেই নামাযীদের জন্য, যারা তাদের নামাযে গাফলতি করে। -সূরা মাউন (১০৭) : ৪-৫
ব্যস, সকল মুসলমানের উচিত, তারা যেন পরিপূর্ণ সালাত আদায়কারী হয়ে যায়। সেইসঙ্গে সবাইকে সজাগ-সতর্ক থাকতে হবে- কেউ যেন কুরআন অনুসরণের মিথ্যা শ্লোগান দিয়ে তাদেরকে বিভ্রান্ত না করে এবং রাসূল-অস্বীকার বা অবমাননার কুফরে না নিয়ে যায়।
যেসকল মুসলিম এ ধরনের লোকদের কথায় প্রভাবিত হয়ে গেছে, আমরা তাদের জন্য দুআ করি- আল্লাহ তাআলা তাদেরকে দ্বীনে হক ও ইসলামী শরীয়তের দিকে ফিরে আসার তাওফীক দান করুন এবং তাদেরকে কুরআনের প্রতি ও রাসূলের প্রতি সঠিক ঈমান আনার তাওফীক দান করুন- আমীন।
এখন পাঠকবৃন্দের প্রতি অনুরোধ, তারা চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হাদীস ও আসারগুলো তরজমাসহ অধ্যয়ন করবেন। প্রত্যেক হাদীস ও আসারের সঙ্গে সূত্র উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ বলে দেয়া হয়েছে, কোন্ হাদীস বা আসার হাদীসের কোন্ কিতাব থেকে নেয়া হয়েছে। যে হাদীস এমন কিতাব থেকে নেয়া হয়েছে, যেখানে সহীহ-হাসান সনদের হাদীসের সঙ্গে যয়ীফ সনদের হাদীসও রয়েছে, সেক্ষেত্রে (সাধারণত) আমরা উল্লেখকৃত হাদীসের সনদের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণের বক্তব্যও উদ্ধৃত করেছি যে, এটির সনদ নির্ভরযোগ্য। কিন্তু সেই বক্তব্যগুলোর বাংলা অনুবাদ করার প্রয়োজন আমরা বোধ করিনি।
সালাত সংশ্লিষ্ট হাদীস ও আসার সম্বলিত এই প্রবন্ধটি সংকলন করেছেন মাওলানা ইমরান বিন তাজুল ইসলাম (শহীদবাড়ীয়া) এবং মাওলানা মাহমুদ বিন ইমরান (ঢাকা)। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দিন এবং তাদের ইলম ও আমলে বরকত দিন- আমীন।
[বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
(গুফিরা লাহু)
৭ রবিউল আখির, ১৪৪২ হিজরী, সোমবার]
ভূমিকার টীকা : ...
১. আরো দেখুন, উসূলুল বাযদাবী, পৃ. ৩৫৩, মুতাওয়াতির অধ্যায়। ইমাম বাযদাবী রাহ. লেখেন-
الْخَبَرُ الْمُتَوَاتِرُ الَّذِي اتَّصَلَ بِكَ مِنْ رَسُولِ اللهِ - صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - اتِّصَالًا بِلَا شُبْهَةٍ حَتَّى صَارَ كَالْمُعَايَنِ الْمَسْمُوعِ مِنْهُ وَذَلِكَ أَنْ يَرْوِيَهُ قَوْمٌ لَا يُحْصَى عَدَدُهُمْ، وَلَا يُتَوَهَّمُ تَوَاطُؤُهُمْ عَلَى الْكَذِبِ لِكَثْرَتِهِمْ وَعَدَالَتِهِمْ وَتَبَايُنِ أَمَاكِنِهِمْ وَيَدُومُ هَذَا الْحَدُّ فَيَكُونُ آخِرُهُ كَأَوَّلِهِ، وَأَوْسَطُهُ كَطَرَفَيْهِ وَذَلِكَ مِثْلُ نَقْلِ الْقُرْآنِ وَالصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ، وَأَعْدَادِ الرَّكَعَاتِ وَمَقَادِيرِ الزَّكَوَاتِ وَمَا أَشْبَهَ ذَلِكَ، وَهَذَا الْقِسْمُ يُوجِبُ عِلْمَ الْيَقِينِ بِمَنْزِلَةِ الْعِيَانِ عِلْمًا ضَرُورِيًّا.
***
তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ أَهْلِ نَجْدٍ ثَائِرَ الرَّأْسِ، يُسْمَعُ دَوِيُّ صَوْتِهِ وَلاَ يُفْقَهُ مَا يَقُولُ، حَتَّى دَنَا، فَإِذَا هُوَ يَسْأَلُ عَنِ الإِسْلاَمِ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: خَمْسُ صَلَوَاتٍ فِي اليَوْمِ والليلة، فقال: هَلْ عَلَيَّ غَيْرُهَا؟ قَالَ: لاَ، إِلاَّ أَنْ تَطَوَّعَ...
নাজ্দ অঞ্চলের এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এল। উস্কোখুস্কো মাথা। তার বিড়বিড় আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল; তবে কী বলছিল বোঝা যাচ্ছিল না। কাছে এসে ইসলাম সম্পর্কে জানতে চাইল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত। সে জিজ্ঞেস করল, এছাড়া আর কোনো সালাত কি আমার উপর ফরয? তিনি বললেন, না; তবে ইচ্ছে করলে নফল আদায় করতে পার।... -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
أَرَأَيْتُمْ لَوْ أَنَّ نَهْرًا بِبَابِ أَحَدِكُمْ يَغْتَسِلُ مِنْهُ كُلَّ يَوْمٍ خَمْسَ مَرَّاتٍ، هَلْ يَبْقَى مِنْ دَرَنِهِ شَيْءٌ؟ قَالُوا: لَا يَبْقَى مِنْ دَرَنِهِ شَيْءٌ، قَالَ: فَذَلِكَ مَثَلُ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ، يَمْحُو اللهُ بِهِنَّ الْخَطَايَا.
কী ধারণা- তোমাদের কারো দুয়ারে যদি নদী থাকে আর সে তাতে প্রতিদিন পাঁচ বার গোসল করে, তার দেহে কি কোনো ময়লা থাকবে? সাহাবীগণ বললেন, না; তার শরীরে কোনো ময়লা থাকবে না। তিনি বললেন, এটা হল পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের দৃষ্টান্ত। এগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা গোনাহসমূহ মোচন করে দেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৬৭; সহীহ বুখারী, হাদীস ৫২৮
আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন-
نُهِينَا أَنْ نَسْأَلَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ شَيْءٍ، فَكَانَ يُعْجِبُنَا أَنْ يَجِيءَ الرَّجُلُ مِنْ أَهْلِ الْبَادِيَةِ الْعَاقِلُ، فَيَسْأَلَهُ، وَنَحْنُ نَسْمَعُ، فَجَاءَ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْبَادِيَةِ، فَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ، أَتَانَا رَسُولُكَ فَزَعَمَ لَنَا أَنَّكَ تَزْعُمُ أَنَّ اللهَ أَرْسَلَكَ، قَالَ: صدق قَالَ: فَمَنْ خَلَقَ السَّمَاءَ؟ قَالَ: اللهُ، قَالَ: فَمَنْ خَلَقَ الْأَرْضَ؟ قَالَ: اللهُ، قَالَ: فَمَنْ نَصَبَ هَذِهِ الْجِبَالَ، وَجَعَلَ فِيهَا مَا جَعَلَ؟ قَالَ: اللهُ، قَالَ: فَبِالَّذِي خَلَقَ السَّمَاءَ، وَخَلَقَ الْأَرْضَ، وَنَصَبَ هَذِهِ الْجِبَالَ، آللهُ أَرْسَلَكَ؟ قَالَ: نَعَمْ، قَالَ: وَزَعَمَ رَسُولُكَ أَنَّ عَلَيْنَا خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِي يَوْمِنَا، وَلَيْلَتِنَا، قَالَ: صَدَقَ، قَالَ: فَبِالَّذِي أَرْسَلَكَ، آللهُ أَمَرَكَ بِهَذَا؟ قَالَ: نَعَمْ...
আমাদের নিষেধ করা হয়েছিল- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোনো (অপ্রয়োজনীয়) বিষয়ে প্রশ্ন করতে। তাই আমাদের আকাক্সক্ষা ছিল, গ্রাম্য বুদ্ধিমান ব্যক্তি এসে তাঁকে প্রশ্ন করবে আর আমরা শুনব।
একবার এক গ্রাম্য লোক এসে বলল, হে মুহাম্মাদ! আপনার দূত আমাদের কাছে এসে বলল, আপনি দাবি করেছেন- আল্লাহ আপনাকে (রাসূল হিসেবে) পাঠিয়েছেন? তিনি বললেন, সে সত্য বলেছে। লোকটি বলল, আকাশ কে সৃষ্টি করেছেন? বললেন, আল্লাহ। বলল, ভূমি কে সৃষ্টি করেছেন? বললেন, আল্লাহ। বলল, এই পাহাড়সমূহ কে প্রোথিত করেছেন এবং তাতে যেসব সৃষ্টি সেগুলো কে সৃষ্টি করেছেন? বললেন, আল্লাহ। লোকটি বলল, সেই সত্তার শপথ, যিনি আকাশ সৃষ্টি করেছেন, ভূমি সৃষ্টি করেছেন এবং পাহাড়সমূহ প্রোথিত করেছেন- আল্লাহ-ই কি আপনাকে প্রেরণ করেছেন? তিনি বললেন, হাঁ।
বলল, আপনার দূত বলেছে, আমাদের উপর দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয। তিনি বললেন, সে ঠিক বলেছে। বলল, সেই সত্তার শপথ, যিনি আপনাকে প্রেরণ করেছেন- আল্লাহ-ই কি আপনাকে এই আদেশ করেছেন? তিনি বললেন, হাঁ।.... -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১২; সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩
আবুু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন-
الصَّلَوَاتُ الْخَمْسُ، وَالْجُمْعَةُ إِلَى الْجُمْعَةِ، وَرَمَضَانُ إِلَى رَمَضَانَ، مُكَفِّرَاتٌ مَا بَيْنَهُنَّ إِذَا اجْتَنَبَ الْكَبَائِرَ.
পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, এক জুমা থেকে আরেক জুমা এবং এক রমযান থেকে আরেক রমযান- এগুলো তাদের মধ্যবর্তী গুনাহসমূহ দূর করে দেয়; যদি কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩৩
জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَثَلُ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ كَمَثَلِ نَهْرٍ جَارٍ غَمْرٍ، عَلَى بَابِ أَحَدِكُمْ، يَغْتَسِلُ مِنْهُ كُلَّ يَوْمٍ خَمْسَ مَرَّاتٍ.
পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের দৃষ্টান্ত হল, তোমাদের কারো দুয়ারে প্রবহমান গভীর নদীর মত, যাতে সে দৈনিক পাঁচ বার গোসল করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৬৮
আনাস ইবনে মালিক রা.-এর সূত্রে বর্ণিত মেরাজ বিষয়ক এক দীর্ঘ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
قال (الله عز وجل): يَا مُحَمَّدُ، إِنَّهُنَّ خَمْسُ صَلَوَاتٍ كُلَّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ، لِكُلِّ صَلَاةٍ عَشْرٌ، فَذَلِكَ خَمْسُونَ صَلَاةً.
আল্লাহ তাআলা বললেন, হে মুহাম্মাদ! এই হল দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত। প্রত্যেক সালাতের জন্য দশ। অতএব সর্বমোট পঞ্চাশ সালাত। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬২; জামে তিরমিযী, হাদীস ২১৩
উসমান রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
سَمِعْتُ رَسُول اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: أَرَأَيْتَ لَوْ كَانَ بِفِنَاءِ أَحَدِكُمْ نَهَرٌ يَجْرِي يَغْتَسِلُ فِيهِ كُلَّ يَوْمٍ خَمْسَ مَرَّاتٍ، مَا كَانَ يَبْقَى مِنْ دَرَنِهِ؟ قَالَ: لَا شَيْءَ، قَالَ: فَإِنَّ الصَّلَاةَ تُذْهِبُ الذُّنُوبَ كَمَا يُذْهِبُ الْمَاءُ الدَّرَنَ.
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমাদের কী ধারণা- যদি তোমাদের কারো আঙিনায় প্রবহমান নদী থাকে, যাতে সে প্রতিদিন পাঁচবার গোসল করে, তার দেহে কি কোনো ময়লা থাকবে? সাহাবীগণ বললেন, কোনো ময়লা থাকবে না। তিনি বললেন, (পাঁচ ওয়াক্ত) সালাতও গুনাহসমূহ দূর করে দেয়, যেভাবে পানি ময়লা দূর করে দেয়। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩৯৭
قال البوصيري في "مصباح الزجاجة" (৪৯৮): هذا إسناد صحيح رجاله ثقات.
সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা.-এর পুত্র আমের রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
سَمِعْتُ سَعْدًا، وَنَاسًا مِنْ أَصْحَابِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُونَ: كَانَ رَجُلانِ أَخَوَانِ فِي عَهْدِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَكَانَ أَحَدُهُمَا أَفْضَلَ مِنَ الآخَرِ، فَتُوُفِّيَ الَّذِي هُوَ أَفْضَلُهُمَا، ثُمَّ عُمِّرَ الْآخَرُ بَعْدَهُ أَرْبَعِينَ لَيْلَةً، ثُمَّ تُوُفِّيَ، فَذُكِرَ لِرَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَضْلُ الْأَوَّلِ عَلَى الْآخَرِ، فَقَالَ: " أَلَمْ يَكُنْ يُصَلِّي؟ " فَقَالُوا: بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ فَكَانَ لَا بَأْسَ بِهِ. فَقَالَ: " مَا يُدْرِيكُمْ مَاذَا بَلَغَتْ بِهِ صَلاتُهُ؟ " ثُمَّ قَالَ عِنْدَ ذَلِكَ: " إِنَّمَا مَثَلُ الصَّلَاة كَمَثَلِ نَهَرٍ جَارٍ بِبَابِ رَجُلٍ، غَمْرٍ عَذْبٍ يَقْتَحِمُ فِيهِ كُلَّ يَوْمٍ خَمْسَ مَرَّاتٍ، فَمَاذا تُرَوْنَ يُبْقِي ذَلِكَ مِنْ دَرَنِهِ؟
আমি সা‘দ রা.-সহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কতিপয় সাহাবীকে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে দুই ভাই ছিল। তাদের একজন অপরজনের চেয়ে উত্তম ছিল। অধিক উত্তম যে ভাইটি, সে মারা গেল। অপরজন তার পর চল্লিশ রাত বেঁচে ছিল। এরপর সেও মারা গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট দ্বিতীয়জনের উপর প্রথমজনের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলা হলে তিনি বললেন, সে কি সালাত আদায় করত না? সাহাবীগণ বললেন, হাঁ, আল্লাহ্র রাসূূল! তার মধ্যে কোনো সমস্যা ছিল না। তিনি বললেন, তোমরা কীভাবে জানবে- তার সালাত তাকে কোথায় পৌঁছে দিয়েছে? এরপর বললেন, সালাতের দৃষ্টান্ত তো হল, কারো দুয়ারে প্রবহমান সুগভীর সুমিষ্ট নদীর ন্যায়, যাতে সে দৈনিক পাঁচবার অবগাহন করে। তোমাদের কী ধারণা- তার দেহে কি কোনো ময়লা অবশিষ্ট থাকবে? -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৫৩৩; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ৩১০; মুসতাদরাকে হাকেম, খ.১ পৃষ্ঠা ২০০
قال الحاكم : هذا حديث صحيح الإسناد.
وقال الهيثمي في "مجمع الزوائد" (১: ২৯৬): رجال أحمد رجال الصحيح.
আবু সাইদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
الصلوات الخمس كفارة ما بينها
পাঁচ ওয়াক্ত সালাত তাদের মধ্যবর্তী সময়ের গোনাহসমূহের জন্য কাফফরা। -তা‘যীমু কদরিস সালাত, মুহাম্মাদ ইবনে নসর আলমারওয়াযী, হাদীস ৮৬; আলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ২০০
قال الهيثمي في "مجمع الزوائد" ১: ২৯৭ : وَفِيهِ عَبْدُ اللهِ بْنُ قُرَيْطٍ، ذَكَرَهُ ابْنُ حِبَّانَ فِي الثِّقَاتِ، وَبَقِيَّةُ رِجَالِهِ رِجَالُ الصَّحِيحِ.
তারেক ইবনে শিহাব রাহ. থেকে বর্ণিত; তিনি সালমান ফারসী রা.-এর নিকট রাত্রিযাপন করলেন তাঁর (রাত্রিকালীন) ইবাদত-বন্দেগী দেখার জন্য। তারেক ইবনে শিহাব বলেন, তিনি শেষরাতে উঠে সালাত আদায় করলেন। অর্থাৎ তিনি যেমন ভেবেছিলেন তেমন দেখলেন না। বিষয়টা তিনি সালমান রা.-কে জানালেন। তখন সালমান রা. বললেন-
حَافِظُوا عَلَى هَذِهِ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ، فَإِنَّهُنَّ كَفَّارَاتٌ لِهَذِهِ الْجِرَاحَاتِ مَا لَمْ تُصَبُ الْمَقْتَلَةُ.
এই পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের বিষয়ে যতœবান হও। কেননা এগুলো এই ত্রুটিসমূহের কাফফরা, যতক্ষণ না কোনো (অন্যায়) হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়। -মুসনাদে আবদুর রাযযাক, হাদীস ১৪৮; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৬০৫১
قال المنذري في "الترغيب والترهيب" (১: ২৩৬): رَوَاهُ الطَّبَرَانِيّ فِي الْكَبِير مَوْقُوفا هَكَذَا بِإِسْنَاد لَا بَأْس بِهِ.
وقال الهيثمي في "مجمع الزوائد"(১: ২৯৮): رجاله موثقون.
আমর ইবনে মুররা আলজুহানী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
جَاءَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلٌ مِنْ قُضَاعَةَ، فَقَالَ لَهُ: يَا رَسُولَ اللهِ أَرَأَيْتَ إِنْ شَهِدْتُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّكَ رَسُولُ اللهِ، وَصَلَّيْتُ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسَ، وَصُمْتُ الشَّهْرَ، وَقُمْتُ رَمَضَانَ، وَآتَيْتُ الزَّكَاةَ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ مَاتَ عَلَى هَذَا كَانَ مِنَ الصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কুযাআ গোত্রের এক ব্যক্তি এল। বলল, হে আল্লাহ্র রাসূল! আপনার কী সিদ্ধান্ত, যদি আমি সাক্ষ্য দিই- ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং আপনি আল্লাহ্র রাসূল’, আর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করি, রমযানে পূর্ণ মাস (দিনে) সিয়াম পালন করি ও রাতে সালাত আদায় করি এবং যাকাত আদায় করি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এর উপর যার মৃত্যু হবে সে (আখেরাতে) সিদ্দীকগণ ও শহীদগণের সঙ্গে থাকবে। -সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ২২১২; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩৪৩৮
قال ابن حجر في "مختصر الترغيب والترهيب" (১২১) : صححه ابن خزيمة وابن حبان،
وقال الهيثمي في "مجمع الزوائد" ১: ৪৫ : رواه البزار ورجاله رجال الصحيح، خلا شيخي البزار، وأرجو إسناده أنه إسناد حسن أو صحيح.
আবু উসমান রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
كُنْتُ مَعَ سَلْمَانَ الْفَارِسِيِّ تَحْتَ شَجَرَةٍ، وَأَخَذَ مِنْهَا غُصْنًا يَابِسًا فَهَزَّهُ حَتَّى تَحَاتَّ وَرَقُهُ، ثُمَّ قَالَ: يَا أَبَا عُثْمَانَ، أَلَا تَسْأَلُنِي لِمَ أَفْعَلُ هَذَا؟ قُلْتُ: وَلِمَ تَفْعَلُهُ؟ فَقَالَ: هَكَذَا فَعَلَ بِي رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَنَا مَعَهُ تَحْتَ شَجَرَةٍ، فَأَخَذَ مِنْهَا غُصْنًا يَابِسًا، فَهَزَّهُ حَتَّى تَحَاتَّ وَرَقُهُ فَقَالَ: يَا سَلْمَانُ: أَلَا تَسْأَلُنِي لِمَ أَفْعَلُ هَذَا؟ قُلْتُ: وَلِمَ تَفْعَلُهُ؟ قَالَ: إِنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ، ثُمَّ صَلَّى الصَّلَوَاتِ الْخَمْسَ، تَحَاتَّتْ خَطَايَاهُ، كَمَا يَتَحَاتُّ هَذَا الْوَرَقُ، وَقَالَ: وَ اَقِمِ الصَّلٰوةَ طَرَفَیِ النَّهَارِ وَ زُلَفًا مِّنَ الَّیْلِ، اِنَّ الْحَسَنٰتِ یُذْهِبْنَ السَّیِّاٰتِ، ذٰلِكَ ذِكْرٰی لِلذّٰكِرِیْنَ.
আমি সালমান ফারসী রা.-এর সঙ্গে একটি গাছের নিচে ছিলাম। তিনি তার একটা শুকনো ডাল ধরে নাড়া দিলেন। এতে তার পাতা ঝরে পড়ল। এরপর বললেন, হে আবু উসমান! তুমি কি জিজ্ঞেস করবে না, কেন আমি এমন করছি? আমি বললাম, আপনি কেন এমন করছেন? তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে একটি গাছের নিচে ছিলাম, তখন তিনিও আমার সঙ্গে এরূপ করেছিলেন। তিনি গাছের একটা শুকনো ডাল ধরে নাড়া দিলেন। এতে তার পাতা ঝরে পড়ল। তখন বললেন, হে সালমান! তুমি কি জিজ্ঞেস করবে না, কেন আমি এমন করছি? আমি বললাম, আপনি কেন এমন করছেন? তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে মুসলিম যখন অযু করে এবং উত্তমরূপে অযু করে, অতঃপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে তখন তার গুনাহসমূহ ঝরে যায়, যেমন গাছের পাতাসমূহ ঝরে যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত করলেন-
وَ اَقِمِ الصَّلٰوةَ طَرَفَیِ النَّهَارِ وَ زُلَفًا مِّنَ الَّیْلِ، اِنَّ الْحَسَنٰتِ یُذْهِبْنَ السَّیِّاٰتِ، ذٰلِكَ ذِكْرٰی لِلذّٰكِرِیْنَ.
[(হে নবী!) আপনি দিনের উভয় প্রান্তে এবং রাতের কিছু অংশে সালাত কায়েম করুন। নিশ্চয়ই পুণ্যরাজি পাপরাশিকে দূরীভূত করে। যারা উপদেশ গ্রহণ করে তাদের জন্য এটা এক উপদেশ। -সূরা হূদ (১১) : ১১৪] -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস (২৩৭০৭); মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী, হাদীস ৬৮৭; মুসনাদে বাযযার, হাদীস ২৫০৮
قال المنذري في "الترغيب والترهيب" (১ : ২৩৭): ورواة أَحْمد مُحْتَج بهم فِي الصَّحِيح إِلاَّ عَليّ بن زيد.
وقال الهيثمي في "مجمع الزوائد" ১: ২৯৭ : وَفِي إِسْنَادِ أَحْمَدَ عَلِيُّ بْنُ زَيْدٍ، وَهُوَ مُخْتَلَفٌ فِي الِاحْتِجَاجِ بِهِ، وَبَقِيَّةُ رِجَالِهِ رِجَالُ الصَّحِيحِ.
আবু হুরায়রা রা. ও আবু সাঈদ রা. থেকে বর্ণিত, তাঁরা বলেন-
خَطَبَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمًا، فَقَالَ: وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ، ثُمَّ أَكَبَّ، فَأَكَبَّ كُلُّ رَجُلٍ مِنَّا يَبْكِي لَا نَدْرِي عَلَى مَاذَا حَلَفَ، ثُمَّ رَفَعَ رَأْسَهُ فِي وَجْهِهِ الْبُشْرَى، فَكَانَتْ أَحَبَّ إِلَيْنَا مِنْ حُمْرِ النَّعَمِ، ثُمَّ قَالَ: " مَا مِنْ عَبْدٍ يُصَلِّي الصَّلَوَاتِ الْخَمْسَ، وَيَصُومُ رَمَضَانَ، وَيُخْرِجُ الزَّكَاةَ، وَيَجْتَنِبُ الْكَبَائِرَ السَّبْعَ، إِلاَّ فُتِّحَتْ لَهُ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ، فَقِيلَ لَهُ: ادْخُلْ بِسَلَامٍ.
একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশে বয়ান করলেন। বললেন, সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ। এটি তিনবার বললেন, তারপর মাথা নত করে ফেললেন। তখন আমাদের সকলে মাথা নত করে কান্না আরম্ভ করল। আমরা জানি না- তিনি কী বিষয়ে কসম করেছেন। এরপর তিনি মাথা তুললেন; তাঁর চেহারায় আনন্দের উদ্ভাস! আর সেটা আমাদের কাছে অনেকগুলো লাল উটের চেয়েও প্রিয়। তারপর বললেন, যে বান্দা পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করবে, রমযান মাসে সিয়াম পালন করবে, যাকাত আদায় করবে এবং সাতটি কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকবে, তার জন্য অবশ্যই জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হবে এবং বলা হবে, প্রবেশ কর প্রশান্তির সাথে। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২৪৩৮; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৭৪৮, সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ৩১৫; মুসতাদরাকে হাকেম, খ. ২ পৃ. ২৪০
قال الحاكم: هذا حديث صحيح على شرط الشيخين، ولم يخرجاه.
আবু দারদা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
خَمْسٌ مَنْ جَاءَ بِهِنَّ مَعَ إِيمَانٍ دَخَلَ الْجَنَّةَ: مَنْ حَافَظَ عَلَى الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ عَلَى وُضُوئِهِنَّ وَرُكُوعِهِنَّ وَسُجُودِهِنَّ وَمَوَاقِيتِهِنَّ، وَصَامَ رَمَضَانَ، وَحَجَّ الْبَيْتَ إِنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا، وَأَعْطَى الزَّكَاةَ طَيِّبَةً بِهَا نَفْسُهُ، وَأَدَّى الْأَمَانَةَ قَالُوا: يَا أَبَا الدَّرْدَاءِ، وَمَا أَدَاءُ الْأَمَانَةِ قَالَ: الْغُسْلُ مِنَ الْجَنَابَةِ.
পাঁচটি বিষয় যে ঈমানের সঙ্গে পালন করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (অর্থাৎ) যে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের প্রতি যত্নবান হবে, অর্থাৎ সেগুলোর অযু, রুকু, সিজদা ও ওয়াক্তসমূহের প্রতি যত্নবান হবে, রযমানে সিয়াম পালন করবে, সামর্থ্য থাকলে বাইতুল্লাহ্র হজ্ব করবে, স্বতঃস্ফূর্ত হৃদয়ে যাকাত প্রদান করবে এবং আমানত আদায় করবে। উপস্থিত লোকেরা বলল, আবু দারদা! আমানত আদায় কী? তিনি বললেন, জানাবাতের গোসল (অর্থাৎ ফরয গোসল)। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪২৯; আলমুজামুস সগীর, তবারানী, হাদীস ৭৭২
قال المنذري في "الترغيب والترهيب" ১: ২৪১، والحافظ ابن حجر في "مختصره" (১২৩)، والهيثمي في "مجمع الزوائد" ১: ৪৬ : إسناده جيد.
উবাদা ইবনে সামেত রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
أَشْهَدُ لَسَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: خَمْسُ صَلَوَاتٍ افْتَرَضَهُنَّ اللهُ عَلَى عِبَادِهِ مَنْ أَحْسَنَ وُضُوءَهُنَّ وَصَلاَّهُنَّ لِوَقْتِهِنَّ، فَأَتَمَّ رُكُوعَهُنَّ وَسُجُودَهُنَّ وَخُشُوعَهُنَّ كَانَ لَهُ عِنْدَ اللهِ عَهْدٌ أَنْ يَغْفِرَ لَهُ، وَمَنْ لَمْ يَفْعَلْ فَلَيْسَ لَهُ عِنْدَ اللهِ عَهْدٌ إِنْ شَاءَ غَفَرَ لَهُ، وَإِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ.
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি বলতে শুনেছি, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের উপর ফরয করেছেন। যে এই সালাতগুলোর জন্য উত্তমরূপে অযু করবে, সময়মতো সালাতগুলো আদায় করবে, রুকু-সিজদা পূর্ণাঙ্গরূপে করবে এবং পরিপূর্ণ খুশূ ও বিন¤্রতা বজায় রাখবে, তার জন্য আল্লাহ্র নিকট এই প্রতিশ্রুতি রয়েছে যে, তাকে তিনি ক্ষমা করে দেবেন। আর যে করবে না তার জন্য আল্লাহ্র নিকট কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। তিনি ইচ্ছা করলে তাকে ক্ষমা করবেন, আবার ইচ্ছা করলে শাস্তি দেবেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৭০৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪২৫ ও ১৪২০
قال النووي في "خلاصة الأحكام" (১৮৫৯): صحيح.
হানযালা আলকাতিব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ: مَنْ حَافَظَ عَلَى الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ: رُكُوعِهِنَّ، وَسُجُودِهِنَّ، وَوُضُوئِهِنَّ، وَمَوَاقِيتِهِنَّ، وَعَلِمَ أَنَّهُنَّ حَقٌّ مِنْ عِنْدِ اللهِ، دَخَلَ الْجَنَّةَ " أَوْ قَالَ: وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ.
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের বিষয়ে, অর্থাৎ সেগুলোর রুকু, সিজদা, অযু ও ওয়াক্তসমূহের বিষয়ে যতœবান হবে এবং বিশ্বাস করবে- এগুলো সত্য, আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। অথবা বলেছেন, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৩৪৫ ও ১৮৩৪৬; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৩৪৯৪
قال المنذري في "الترغيب والترهيب" ১ : ২৪৭ : رواه أحمد بإسناد جيد، ورواته رواة الصحيح.
وقال الهيثمي في "مجمع الزوائد" ১ : ২৮৮ : ورجال أحمد رجال الصحيح.
আবুল মিনহালের সূত্রে আবু বারযা রা. থেকে বর্ণিত-
كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي الصُّبْحَ وَأَحَدُنَا يَعْرِفُ جَلِيسَهُ، وَيَقْرَأُ فِيهَا مَا بَيْنَ السِّتِّينَ إِلَى المِائَةِ، وَيُصَلِّي الظُّهْرَ إِذَا زَالَتِ الشَّمْسُ، وَالعَصْرَ وَأَحَدُنَا يَذْهَبُ إِلَى أَقْصَى المَدِينَةِ، رَجَعَ وَالشَّمْسُ حَيَّةٌ - وَنَسِيتُ مَا قَالَ فِي المَغْرِبِ - وَلاَ يُبَالِي بِتَأْخِيرِ العِشَاءِ إِلَى ثُلُثِ اللَّيْلِ، ثُمَّ قَالَ: إِلَى شَطْرِ اللَّيْلِ " وَقَالَ مُعَاذٌ: قَالَ شُعْبَةُ: لَقِيتُهُ مَرَّةً، فَقَالَ: أَوْ ثُلُثِ اللَّيْلِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সালাত সম্পন্ন করতেন; তখন (চারিদিক ফর্সা হয়ে যাওয়ায়) আমাদের প্রত্যেকে তার পাশে বসা ব্যক্তিকে চিনতে পারত। ফজরে তিনি ষাট থেকে একশ আয়াত পড়তেন। যোহর পড়তেন- যখন সূর্য (পশ্চিমাকাশে) ঢলে পড়ত। আসর পড়তেন; এরপর আমাদের কেউ মদীনার প্রান্তে গিয়ে ফিরে আসত আর তখনও সূর্য উজ্জ্বল থাকত। (আবুল মিনহাল বলেন,) মাগরিবের ক্ষেত্রে তিনি (আবু বারযা রা.) কী বলেছেন তা ভুলে গেছি। আর এশা রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত বিলম্ব করা তিনি অপছন্দ করতেন না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৪১, ৫৪৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৪৭
জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي الظُّهْرَ بِالهَاجِرَةِ، وَالعَصْرَ وَالشَّمْسُ نَقِيَّةٌ، وَالمَغْرِبَ إِذَا وَجَبَتْ، وَالعِشَاءَ أَحْيَانًا وَأَحْيَانًا، إِذَا رَآهُمُ اجْتَمَعُوا عَجَّلَ، وَإِذَا رَآهُمْ أَبْطَؤُوا أَخَّرَ، وَالصُّبْحَ كَانُوا - أَوْ كَانَ - النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّيهَا بِغَلَسٍ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যোহর আদায় করতেন দ্বিপ্রহরে। আসর আদায় করতেন সূর্যালোক স্বচ্ছ থাকাবস্থায় এবং মাগরিব আদায় করতেন সূর্য যখন অস্ত যেত তখন। এশা আদায় করতেন বিভিন্ন সময়ে। যেদিন দেখতেন মুসল্লীরা সমবেত হয়ে গেছে সেদিন আগে পড়ে ফেলতেন আর যেদিন দেখতেন মুসল্লীরা আসতে দেরি করছে সেদিন বিলম্ব করতেন। ফজর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্ধকারে পড়তেন।১ -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৬০, ৫৬৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৪৬
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
وَقْتُ الظُّهْرِ إِذَا زَالَتِ الشَّمْسُ وَكَانَ ظِلُّ الرَّجُلِ كَطُولِهِ، مَا لَمْ يَحْضُرِ الْعَصْرُ، وَوَقْتُ الْعَصْرِ مَا لَمْ تَصْفَرَّ الشَّمْسُ، وَوَقْتُ صَلَاةِ الْمَغْرِبِ مَا لَمْ يَغِبِ الشَّفَقُ، وَوَقْتُ صَلَاةِ الْعِشَاءِ إِلَى نِصْفِ اللَّيْلِ الْأَوْسَطِ، وَوَقْتُ صَلَاةِ الصَّبْحِ مِنْ طُلُوعِ الْفَجْرِ مَا لَمْ تَطْلُعِ الشَّمْسُ، فَإِذَا طَلَعَتِ الشَّمْسُ فَأَمْسِكْ عَنِ الصَّلَاةِ، فَإِنَّهَا تَطْلُعْ بَيْنَ قَرْنَيْ شَيْطَانٍ.
যোহরের ওয়াক্ত হয়- যখন সূর্য (পশ্চিমাকাশে) হেলে পড়ে এবং মানুষের ছায়া থাকে তার দৈর্ঘ্যরে সমান। এর সময়সীমা আসর পর্যন্ত। আর আসরের ওয়াক্ত থাকে সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করা পর্যন্ত।২ মাগরিবের সালাতের সময় থাকে শাফাক (পশ্চিমাকাশের আলোক-আভা) অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত। এশার সালাতের সময় থাকে মধ্যরাত পর্যন্ত।৩ আর ফজরের সালাতের সময় হল ফজর উদিত হওয়া থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত। যখন সূর্য উদিত হয় তখন সালাত থেকে বিরত থাক। কারণ তা উদিত হয় শয়তানের দুই শিংয়ের মধ্যখানে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬১২
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
টীকা সমূহ....
১. ফজরের সালাতের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণত এমনই করেছেন। হয়ত এজন্য যে, মসজিদে নববীর তখনকার প্রায় সব মুসল্লী তাহাজ্জুদগুযার ছিলেন। তাঁরা ফজরের সালাতের জন্য আগে আগে হাযির হয়ে যেতেন। যে নিয়মটি সাধারণভাবে অনুসরণীয় সেটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের বাণীতে ইরশাদ করেছেন। হাদীস শরীফে আছে, রাফে ইবনে খাদীজ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
أَسْفِرُوا بِالفَجْرِ، فَإِنَّهُ أَعْظَمُ لِلأَجْرِ.
তোমরা ফজরের সালাত ফর্সা করে পড়। কারণ এর সওয়াব বেশি। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫৪
قال الترمذي : حَدِيثُ رَافِعِ بْنِ خَدِيجٍ حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ.
২. এখানে আসরের ওয়াক্তের ওই অংশের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, যে অংশে সালাত আদায়কারী তার ইচ্ছানুযায়ী সালাত আগ-পর করতে পারে। ফিকহের পরিভাষায় এ সময়টুকুকে বলা হয় ‘ওয়াক্তুল ইখতিয়ার’। অর্থাৎ আসরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পর থেকে সূর্য হলুদ বা লাল বর্ণ ধারণ করা পর্যন্ত- এই সময়ের যে কোনো অংশে আসরের সালাত আদায় করার সুযোগ রয়েছে। ইচ্ছে করলে শুরুভাগেও আদায় করা যায়, আবার শেষভাগেও আদায় করা যায়। তবে এই সময়ের মধ্যেই আদায় করতে হবে। এর চেয়ে বিলম্ব করলে সালাত মাকরূহ হবে।
কিন্তু আসরের মূল ওয়াক্ত এতটুকুতে সীমাবদ্ধ নয়; আরো দীর্ঘ। বিভিন্ন হাদীস ও আসার দ্বারা প্রমাণিত- আসরের ওয়াক্ত সূর্যাস্ত পর্যন্ত। যেমন হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَنْ أَدْرَكَ رَكْعَةً مِنَ الْعَصْرِ قَبْلَ أَنْ تَغْرُبَ الشَّمْسُ، فَقَدْ أَدْرَكَ الْعَصْرَ.
অর্থাৎ সূর্যাস্তের আগে যে আসরের এক রাকাত আদায় করতে পারল সে আসর পেয়ে গেল। -সহীস মুসলিম, হাদীস ৬০৮; সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৬
৩.এটা এশার সালাতের ‘ওয়াক্তুল ইখতিয়ার’। উমর রা. আবু মুসা আশআরী রা.-এর উদ্দেশে পাঠানো এক পত্রে লিখেন-
صَلُّوا صَلَاةَ الْعِشَاءِ فِيمَا بَيْنَكُمْ وَبَيْنَ ثُلُثِ اللَّيْلِ، فَإِنْ أَخَّرْتُمْ فَإِلَى شَطْرِ اللَّيْلِ، وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْغَافِلِينَ.
তোমরা এশা রাতের এক তৃতীয়াংশের মধ্যে আদায় করবে। যদি বিলম্ব কর তাহলে মধ্যরাত পর্যন্ত। তোমরা উদাসীনদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। -মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীস ২১০৮
তবে অনেক হাদীস ও আসার দ্বারা এটা প্রমাণিত যে, এশার ওয়াক্ত সুবহে সাদিক পর্যন্ত। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত-
وَقْتُ الظُّهْرِ إِلَى الْعَصْرِ، وَالْعَصْرِ إِلَى الْمَغْرِبِ، وَالْمَغْرِبِ إِلَى الْعِشَاءِ، وَالْعِشَاءِ إِلَى الصُّبْحِ.
যোহরের ওয়াক্ত আসর পর্যন্ত। আসরের ওয়াক্ত মাগরিব পর্যন্ত। মাগরিবের ওয়াক্ত এশা পর্যন্ত। আর এশার ওয়াক্ত ফজর পর্যন্ত। -মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীস ২২২৬