তাঁকেই আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন
তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। খাতামুন্নাবিয়্যীন, রাহমাতুল্লিল আলামীন। সমগ্র মানবতার তিনি মহান শিক্ষক। তাঁর শিক্ষারই আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। মানুষের চেতনা-বিশ্বাস, স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ, সবকিছুর জন্য তিনি সর্বোত্তম আদর্শ। এই পৃথিবীকে বারবার তাঁর কাছেই ফিরে আসতে হবে। তাঁর আদর্শের সাহচর্য গ্রহণ করতে হবে। এই রুগ্ণ পৃথিবীর এ ছাড়া মুক্তির কোনো উপায় নেই।
কেমন ছিলেন তিনি? কী ছিল তাঁর জীবনাদর্শ? এককথায় এ প্রশ্নের জবাব-
وَ اِنَّكَ لَعَلٰی خُلُقٍ عَظِیْمٍ.
তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত। -সূরা কলাম (৬৮) : ৪
كَانَ خُلُقُهُ الْقُرْآنَ.
অর্থাৎ তিনি ছিলেন (বাস্তব) কুরআন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৪৬০১; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ১৩৬০
কুরআন মাজীদে আদর্শ মানুষের বিশ্বাস ও ব্যক্তিত্বের যে রূপরেখা বর্ণিত হয়েছে, তিনি ছিলেন তারই বাস্তব দৃষ্টান্ত। তাঁর পবিত্র জীবনাদর্শের আলোকেই কুরআনকে বুঝতে হবে। সেই ছাঁচে জীবন ও কর্মকে গড়ে তুলতে হবে। তাই তিনি আল্লাহ-মুখী বান্দাদের সর্বোত্তম আদর্শ।
কুরআন নাযিলের সময় যেমন ছিল দেড় হাজার বছর পরও তাঁর জীবনাদর্শ তেমনিই প্রাসঙ্গিক ও অনিবার্য। কিয়ামত পর্যন্ত তা এরকমই থাকবে। এই জগতের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তাঁকে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন কিয়ামত পর্যন্ত গোটা বিশ্ববাসীর জন্য। কুরআনে কারীমও নাযিল হয়েছে কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানবতার জন্য। তাই সব যুগের সকল শ্রেণির মানুষের জন্য তিনি অনিবার্য আদর্শ। মানবতার প্রকৃত প্রয়োজন এবং চারপাশের শূন্যতা সম্পর্কে সচেতন যে কেউ তা উপলব্ধি করবেন।
ফ্রান্সের সাম্প্রতিক ঘটনায় এ শূন্যতা আবারো বড় হয়ে সামনে এসেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তিতে উন্নত একটি জাতিও সঠিক আদর্শের অভাবে কত নিচে নামতে পারে তার দৃষ্টান্ত এই ঘটনা। এইসব ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, মানবজাতির এক বিরাট অংশ পোষাক-পরিচ্ছদে ফিটফাট হয়েও ভিতরে ভিতরে কত রুগ্ণ ও বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
ঘটনাটা ঠাণ্ডা মাথায় বিশ্লেষণ করা হলে অনেকগুলো ভয়াবহ চারিত্রিক উপসর্গের সন্ধান পাওয়া যাবে। অহঙ্কার-বিদ্বেষ, শঠতা-প্রতারণা, হিংস্রতা-অভদ্রতা, অশ্লীলতা-সাম্প্রদায়িকতার মতো বিধ্বংসী সব বৈশিষ্ট্য ও আচরণে গোটা ব্যাপারটা পুঁতিগন্ধময় হয়ে আছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এইসব হীন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সেই মরণব্যাধিরই বিভিন্ন উপসর্গ, যাকে ইসলামের পরিভাষায় ‘কুফর’ বলা হয়। এ সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে, কাফির-কওম বৈষয়িক কিছু ক্ষেত্রে যতই উন্নতি করুক, কুফর ও তার বৈশিষ্ট্যাদির ক্ষেত্রে বরাবরই রুগ্ণ ও অপ্রকৃতিস্থ সাব্যস্ত হয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তি, বাহ্যিক সৌজন্য ও কূটকৌশল ইত্যাদি কোনো আবরণ দ্বারাই এই ব্যাধি গোপন রাখা যাচ্ছে না, নিরাময় তো দূরের কথা। সত্যি কথা হচ্ছে, এই চারিত্রিক ব্যধি থেকে মুক্ত হয়ে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন ও সমাজ পেতে হলে মানবজাতিকে রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছেই ফিরে আসতে হবে। একমাত্র তাঁর আদর্শের চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমেই ব্যক্তি ও সমাজ সুস্থ-সুন্দর হতে পারে।
অহঙ্কার-আত্মগরিমা নয়, বিনয় ও নমতা
কুরআন মানুষকে বিনয়-নম্রতার শিক্ষা দান করে। দম্ভ-অহঙ্কারের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে। কুরআন মাজীদের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা এই যে, যেসব দাম্ভিক-অহঙ্কারির কাছে এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে আত্মগরিমা প্রদর্শন খুবই উপভোগ্য, চিরস্থায়ী আখেরাতে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ধ্বংস ও লাঞ্ছনা। আখিরাতের শুভ পরিণাম তো শুধু আল্লাহভীরু বিনয়ী বান্দাদের জন্য-
تِلْكَ الدَّارُ الْاٰخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِیْنَ لَا یُرِیْدُوْنَ عُلُوًّا فِی الْاَرْضِ وَ لَا فَسَادًا وَ الْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِیْنَ.
ঐ পরকালের ঘর আমি তাদের জন্য নির্ধারিত করি, যারা দুনিয়ার বুকে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করতে ও অনাচার ছড়াতে চায় না। পরিণাম তো আল্লাহভীরুদের শেষ। -সূরা কাসাস (২৮) : ৮৩
জান্নাতী ও জাহান্নামীদের স্বভাব-চরিত্রের পরিচয় দিয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ الجَنَّةِ؟ كُلُّ ضَعِيفٍ مُتَضَعِّفٍ، لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللهِ لَأَبَرَّهُ، أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ: كُلُّ عُتُلٍّ، جَوَّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ.
আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতবাসীদের ব্যাপারে বলব না? তারা হচ্ছে দুর্বল, নরম লোক, তাদের কেউ যদি আল্লাহ তাআলাকে কসম দিয়ে কিছু বলে, আল্লাহ অবশ্যই তার কসম রক্ষা করবেন।
আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামীদের সম্পর্কে বলব না? ওরা হচ্ছে রূঢ় ও কর্কশ স্বভাবের, উদ্ধত, আত্মম্ভরী লোক। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৯১৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮৫৩
অহঙ্কারের প্রকাশ অবজ্ঞা ও বিদ্রূপে
যেসব আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে দম্ভ-অহঙ্কারের প্রকাশ ঘটে তার অন্যতম হচ্ছে, তাচ্ছিল্য, বিদ্রূপ, অবজ্ঞা ও অবমাননা। হাদীস শরীফে এইসব আচরণগত উপসর্গের দ্বারা অহঙ্কারকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বিখ্যাত ফকীহ সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বলেছেন-
لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ قَالَ رَجُلٌ: إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُونَ ثَوْبُهُ حَسَنًا وَنَعْلُهُ حَسَنَةً، قَالَ: إِنَّ اللهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ، الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ، وَغَمْطُ النَّاسِ.
যার মধ্যে এক কণা পরিমাণ কিবির আছে সে জান্নাতে যাবে না। একজন জিজ্ঞাসা করলেন, মানুষ পছন্দ করে- তার কাপড়টা সুন্দর হোক, জুতাটা সুন্দর হোক? তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা সুন্দর, সৌন্দর্য তিনি পছন্দ করেন। কিবির হচ্ছে সত্যকে অস্বীকার করা আর মানুষকে তাচ্ছিল্য করা। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯১
একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে, চেতনা-বিশ্বাস, কর্ম ও আচরণ সব ক্ষেত্রের জন্যই কত বিস্তৃত ও গভীর শিক্ষা এই হাদীসে আছে। শুধু এই একটি হাদীসের উপরও দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে। এখানে শুধু এইটুকু নিবেদন করা উদ্দেশ্য যে, অবজ্ঞা-অবমাননা এবং বিদ্রূপ ও তাচ্ছিল্য প্রদর্শনের ব্যাধি থেকে মুক্ত হতে না পারলে কোনো ব্যক্তি ও সমাজ কিছুতেই সভ্য-ভদ্র হতে পারে না। জাতি হিসেবে এর উদাহরণ বর্তমান ইউরোপ।
মানবতার মহান শিক্ষক হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই বিশেষভাবে বিনয় ও নম্রতার শিক্ষা দান করেছেন। তাঁর নির্দেশ-
إِنَّ اللهَ أَوْحَى إِلَيَّ أَنْ تَوَاضَعُوا حَتَّى لَا يَبْغِيَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ، وَلَا يَفْخَرَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ.
আল্লাহ আমার কাছে ওহী পাঠিয়েছেন যে, তোমরা বিনয়ী হও। একে-অন্যের উপর জুলুম করবে না এবং একে অন্যের উপর বড়ত্ব জাহির করবে না। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৮৯৫
এই হাদীস কিছুটা সংক্ষিপ্ত আকারে সুনানে ইবনে মাজাহতেও আছে। ওখানে একথাও আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের সম্মুখে এক খুৎবায় উপরের কথা বলেছিলেন। (দ্র. সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৪১৭৯)
কুরআন মজীদের পরিষ্কার নির্দেশ-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا یَسْخَرْ قَوْمٌ مِّنْ قَوْمٍ عَسٰۤی اَنْ یَّكُوْنُوْا خَیْرًا مِّنْهُمْ وَ لَا نِسَآءٌ مِّنْ نِّسَآءٍ عَسٰۤی اَنْ یَّكُنَّ خَیْرًا مِّنْهُنَّ وَ لَا تَلْمِزُوْۤا اَنْفُسَكُمْ وَ لَا تَنَابَزُوْا بِالْاَلْقَابِ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوْقُ بَعْدَ الْاِیْمَانِ وَ مَنْ لَّمْ یَتُبْ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الظّٰلِمُوْنَ.
হে ঈমানদারেরা! তোমাদের এক সম্প্রদায় যেন অন্য সম্প্রদায়কে তাচ্ছিল্য না করে। হতে পারে এরা ওদের চেয়ে ভালো। (তোমাদের) নারীদেরও এক শ্রেণি যেন অপর শ্রেণিকে তাচ্ছিল্য না করে। হতে পারে এরা ওদের চেয়ে ভালো। তোমরা পরস্পরকে দোষারোপ করো না। একে অপরকে মন্দ উপাধীতে আখ্যায়িত করো না। ঈমানের পর ফাসিক-নাম কতই না মন্দ! যারা তাওবা করে না, তারাই তো জালিম। -সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১১
সমাজ-জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি রক্ষায় উপরোক্ত আচরণবিধি মেনে চলা যে কত জরুরি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সভ্য-ভদ্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী হওয়ার জন্য কথা-কাজে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের প্রবণতা থেকে মুক্ত থাকা অতি প্রয়োজন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ-
بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ.
অর্থাৎ নিজ মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার স্বভাব যদি কারো মধ্যে থাকে, তাহলে আর কিছু লাগবে না- খারাপি হিসেবে এটাই যথেষ্ট! -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৬৪
ব্যক্তি ও সমাজ বড় হয় নির্মল বিশ্বাস ও যথার্থ কর্মের দ্বারা, অন্যকে তাচ্ছিল্য ও বিদ্রূপ করার দ্বারা নয়। কেউ যদি উন্নত কর্ম ও মার্জিত আচরণের পরিবর্তে অন্যের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের মাধ্যমে বড় হতে চায় তাহলে সে আরো ছোট হয়ে যায়। তার রিক্ততা ও ক্ষুদ্রতাই আরো বেশি করে প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
তাচ্ছিল্য নয়, নয় তোষামোদও
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম যেমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ নিষিদ্ধ করেছেন তেমনি নিষিদ্ধ করেছেন মিথ্যাচার, কপটচারিতা ও চাটুকারিতার মতো হীন স্বভাব ও আচরণও। সমাজের কিছু লোকের মধ্যে দর্প-অহঙ্কার দৃঢ় ও বদ্ধমূল হওয়ার পিছনে একশ্রেণির মেরুদ-হীন লোকের অতিরঞ্জন, অতিভক্তি ও তোষামুদে আচরণেরও বিরাট প্রভাব থাকে।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিজের সম্পর্কে উম্মতকে নির্দেশ দিয়ে গেছেন-
لاَ تُطْرُونِي، كَمَا أَطْرَتْ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُولُوا عَبْدُ اللهِ، وَرَسُولُه.
তোমরা আমার সম্পর্কে অতিরঞ্জন করো না যেমন খ্রিস্টানেরা ইবনে মারইয়ামের ব্যাপারে করেছে। আমি তো আল্লাহর বান্দা। সুতরাং তোমরা (আমার সম্পর্কে) বলবে- ‘আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।’ -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৪৪৫, ৬৮৩০
হাদীস শরীফে তোষামোদকারীর মুখে মাটি নিক্ষেপ করতে বলা হয়েছে যাতে চাটুকার শ্রেণি নিরুৎসাহিত হয় এবং মুসলিম-সমাজে এই ব্যাধির বিস্তার ঘটতে না পারে।
জ্ঞান-প্রজ্ঞাহীন কাঁচা মগজে তোষামোদের ক্রিয়া বিষতুল্য হয়ে থাকে। আর ধোঁকাবাজ, ভণ্ড, চাটুকারদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকলে তো কথাই নেই। ঘরভর্তি প্রশংসা আর ন্যায়-অন্যায় সবকিছুতে অকুণ্ঠ সমর্থন-ধ্বনিতে নরক গুলজার হয়ে ওঠে। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অন্য সবাইকে ছোট মনে করার, তাদের দিকে তাকিয়ে নাক কুচকানোর, কপাল ভাঁজ করার স্বভাব গড়ে ওঠে। সমাজের যেখানেই এই প্রবণতার বিস্তার ঘটবে সেখানেই অন্যায়-অনাচার বাড়তে থাকবে। সদুপদেশ, সৎপরামর্শ ও গঠনমূলক সমালোচনার পরিবেশ বিলুপ্ত হবে। নীতি-নৈতিকতা ভুলুণ্ঠিত হবে। দেশ-জাতি রসাতলে যাবে।
সচেতন ব্যক্তিদের অজানা নয় যে, বর্তমান সভ্য দুনিয়ায় রাজনীতি-প্রশাসনসহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই অবক্ষয় কী ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। অবস্থা এই দাঁড়িয়েছে যে, যে কোনো ধরনের বিচ্যুতি-বিভ্রান্তি, অন্যায়-অনাচারের সমর্থনের জন্যও সমর্থকের কোনো অভাব হয় না। সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবীকে এই ধ্বংসের পথ থেকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবনাদর্শের দিকে ফিরে আসা।
তাঁর শিক্ষা ও সাহচর্যে এমন এক জাতি তৈরি হয়েছিল, যারা ছিলেন চারিত্রিক দৃঢ়তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। স্তব-স্তুতির কোনো প্রয়োজন তাঁদের ছিল না। এইসব বেহুদা-আড়ম্বরে তারা অস্বস্তি ও আতঙ্ক বোধ করতেন। এর কুপ্রভাব সম্পর্কে তাঁরা গভীরভাবে সচেতন ছিলেন।
ইমাম বায়হাকী রাহ. বর্ণনা করেছেন যে, এক ব্যক্তি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন-
يَا خَيْرَ النَّاسِ وَابْنَ خَيْرِ النَّاسِ.
‘হে সর্বোত্তম ব্যক্তি, হে সর্বোত্তম ব্যক্তির সন্তান!’
ইবনে ওমর রা. তার জবাবে বলেছিলেন-
مَا أَنَا بِخَيْرِ النَّاسِ وَلَا أَبِي خَيْرُ النَّاسِ وَلَكِنِّي عَبْدُ مِنْ عِبَادِ اللهِ أَرْجُو اللهَ وَأَخَافُهُ، وَاللهِ لَنْ تَزَالُوا بِالرَّجُلِ حَتَّى تُهْلِكُوهُ.
‘আমি সর্বোত্তম ব্যক্তি নই, আমার বাবাও সর্বোত্তম ব্যক্তি নন। আমি তো আল্লাহর বান্দাদের একজন। আমি তাঁর দয়ার প্রত্যাশা করি। তাঁর শাস্তির ভয় করি। আল্লাহর কসম তোমরা তো এভাবে মানুষের পিছনে লেগে তাকে শেষ করে ছাড়বে।’ -আলমাদখাল ইলাস সুনানিল কুবরা, বায়হাকী ১/৩৩৪, বর্ণনা ৫৪১
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সাহচর্যে সাহাবায়ে কেরাম কত উন্নত মানসিকতার অধিকারী হয়েছিলেন!
তাঁদের সুস্থ-স্বাভাবিক রুচি ও নির্মল-পরিচ্ছন্ন চেতনার মূলে ছিল ঈমান ও তাওহীদের বিশ্বাস। এটা নিছক মৌখিক সৌজন্যের ব্যাপার ছিল না। চেতনা-বিশ্বাসের অনেক গভীর থেকে উৎসারিত ছিল।
বড়কে সম্মান, ছোটকে স্নেহ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সীরাত থেকে যে ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষা আমরা পাই তা হচ্ছে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য নয়, তোষামোদ-চাটুকারিতাও নয়। আল্লাহ তাআলা যাকে যে পর্যায়ে রেখেছেন তার সাথে ঐরকম আচরণ করতে হবে। বড়কে সম্মান করতে হবে, ছোটকে স্নেহ করতে হবে। সামাজিক জীবনে ছোট-বড়র পর্যায়গত অবস্থান এবং এ হিসেবে পারস্পরিক সৌজন্য ও শিষ্টাচার মেনে চলা কত যে গুরুত্বপূর্ণ তা বলে শেষ করা যাবে না। এর দ্বারা ভারসাম্য অটুট থাকে, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকে, সমাজ সুসংহত হয় এবং ব্যক্তি ও সমাজের আভিজাত্য রক্ষা পায়।
নবী সাল্লøাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সীরাতে দেখতে পাই- কীভাবে তিনি দৈনন্দিন জীবনের ছোট-ছোট বিষয়েও ছোট-বড়র সৌজন্য ও শিষ্টাচার রক্ষার তাকীদ করেছেন।
বুখারী-মুসলিমসহ বিভিন্ন হাদীসের কিতাবে একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যে, একটি প্রতিনিধিদল একটি অভিযোগ নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে আব্দুর রহমান ইবনে সাহল রা. ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তিনি কথা বলতে গেলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
كَبِّرْ كَبِّرْ.
‘বড়কে বলতে দাও, বড়কে বলতে দাও।’
তখন তিনি নীরব হয়ে যান এবং বড় দু’জন কথা বলেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩১৭৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৬৯
জীবনের বিভিন্ন ঘটনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই তরবিয়াতের দরুন সাহাবীদের মধ্যে বড়র প্রতি শ্রদ্ধা ও ভদ্রতা রক্ষার মেযাজ তৈরি হয়েছিল।
হযরত সামুরাহ ইবনে জুনদুব রা. বলেন-
لَقَدْ كُنْتُ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ غُلَامًا، فَكُنْتُ أَحْفَظُ عَنْهُ، فَمَا يَمْنَعُنِي مِنَ الْقَوْلِ إِلاَّ أَنَّ هَا هُنَا رِجَالًا هُمْ أَسَنُّ مِنِّي.
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় আমি ছিলাম কিশোর। আমি তাঁর কাছ থেকে (ইলম ও সুন্নাহ শিখতাম এবং) স্মরণ রাখতাম। কিন্তু এরপরও শুধু এইজন্য কথা বলা থেকে বিরত থাকতাম যে, তাঁর মজলিসে আমার চেয়ে বয়সে বড়রা উপস্থিত থাকতেন...। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯৬৪
বয়সের দিক থেকে ছোট-বড়র ক্ষেত্রে যেমন সৌজন্য-শিষ্টাচার রক্ষা করা কতর্ব্য তেমনি ইলম, তাকওয়া, দানশীলতা, বদান্যতা ইত্যাদি সদগুণের ক্ষেত্রে যারা বড় তাদের সাথেও আদব রক্ষা করা, আচার-ব্যবহারে বিনয়ী ও মার্জিত হওয়া কর্তব্য।
হাদীস ও সীরাতে এ প্রসঙ্গে অনেক শিক্ষণীয় বাণী ও ঘটনা আছে। সেসকল শিক্ষা ও নির্দেশনার সারকথা উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বর্ণিত এই হাদীস-
أَمَرَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ نُنَزِّلَ النَّاسَ مَنَازِلَهُمْ.
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের আদেশ করেছেন আমরা যেন মানুষকে তার উপযুক্ত মর্যাদা ও অবস্থান দেই। -মুকাদ্দিমা সহীহ মুসলিম
সমাজ-জীবনে এই নীতি অনুসৃত হলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা তৈরি হবে, আচার-আচরণে সংযম-সৌজন্যের বিস্তার ঘটবে, মেধা-মনন ও মানবীয় সদগুণসমূহ বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে এবং পরস্পর সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি তৈরি হবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মানীর মান রক্ষা করা এবং কথা-কাজ সবক্ষেত্রে সীমারেখা মেনে চলা একটি সভ্য-সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। সভ্য-ভদ্র, সুশীল-সজ্জন ব্যক্তিত্ব গঠনে এবং প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে মানবীয় সদগুণাবলীর চর্চা ও বিকাশের কোনো বিকল্প নেই। দম্ভ-অহংকার, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, অশ্লীলতা-অশালীনতা, সংকীণতা-সাম্প্রদায়িকতা, হিংসা-হাসাদ, হিংস্রতা পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি হীন ও বিধ্বংসী প্রবণতা থেকে মুক্ত হয়ে বিনয়-নম্রতা, সৌজন্য-শিষ্টাচার, ভদ্রতা-শালীনতা, উদারতা-সত্যবাদিতার মতো গুণাবলীর বিস্তার ছাড়া ব্যক্তি ও সমাজ কিছুতেই সভ্য-ভদ্র হতে পারে না।
বর্তমান রুগ্ণ পৃথিবী বারবার এ বার্তাই দিয়ে যাচ্ছে যে, পৃথিবী নামক এই গৃহের অধিবাসীদের সত্যিকারের মানুষ হতে হলে, মনুষ্যত্বের মর্যাদায় উপনীত হতে হলে, উন্নত মানবিকতার রৌদ্রালোকিত অঙ্গনে বিচরণ করতে হলে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে ইসলামের দিকে; ইসলামের নবী, মানবতার মহান শিক্ষক হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র শিক্ষা ও জীবনাদর্শের দিকে। আজকের মুমুর্ষূ-পৃথিবীর সুস্থতা ও রোগমুক্তির এছাড়া আর কোনো পথ নেই।