হযরত মাওলানা আহমদ শফী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি
الحمد لله وسلام على عباده الذين اصطفى، وأشهد أن لا إله إلا الله وأشهد أن محمدا عبده ورسوله، أما بعد!
গত এক বছরে আরব-আজমের অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্বকে আমরা হারিয়েছি। কাছাকাছি সময়ে এদেশের অনেক বুযুর্গ আখেরাতের মুসাফির হয়ে গেছেন। প্রায় এক মাস হয়ে গেল হযরত রাহ.-এরও ইন্তেকাল হয়ে গেছে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
হযরতের সর্বপ্রথম যিয়ারত নসিব হয় ১৪০৭ হিজরীর (মোতাবেক ১৯৮৭) রমযানুল মুবারকে। তখন হযরত মাদরাসা আরাবিয়া খেড়িহরের মজলিশে শুরায় তাশরীফ এনেছিলেন। খেড়িহর মাদরাসা থেকে মুফতী ইউসুফ ছাহেব রাহ. এবং মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিসবাহ ছাহেব রাহ. ঢাকা চলে আসেন হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর জানাযায়। কিন্তু হযরত বিশেষ জরুরতে সরাসরি হাটহাজারী মাদরাসায় তাশরিফ নিয়ে যান।
এ অধমের সরাসরি হযরতের দরসে বসার সৌভাগ্য হয়নি, কিন্তু খেড়িহর মাদরাসার আমার অনেক উস্তাযই হযরতের শাগরিদ। আমার ওয়ালেদ ছাহেব রাহ. যখন হাটহাজারী মাদরাসায় পড়েন তখন হযরত কেবল নতুন উস্তায হয়েছেন।
মুরব্বীদের যামানায় দরসিয়াতের তারাক্কী উসূল মোতাবেক ধীর গতিতে হত। ফারেগ হলেই উপরের জামাতের কিতাবের দরসে বসিয়ে দেওয়ার নিয়ম তখন ছিল না। আমার উস্তাযদের মাঝে হযরত মাওলানা সিদ্দীকুর রহমান ছাহেব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (নাযেম ছাহেব হুযূর) বয়সে হযরতের বড়, কিন্তু হযরতের কাছে তিনি অনেক কিতাব পড়েছেন। খেড়িহর মাদরাসার বর্তমান নাযেম ছাহেব হযরত মাওলানা সিদ্দীকুর রহমান ছাহেব মুদ্দা যিল্লুহুল আলী হযরতের শাগরিদ। তিনি হযরতে কাছে মাইবুযী কিতাবটি পড়েছেন। আমার আরেক উস্তায হযরত মাওলানা ইলিয়াস ছাহেব মুদ্দা যিল্লুহুল আলীও (বর্তমান উস্তায, জামিয়া উসমানিয়া চাটখিল) হযরতের শাগরিদ। তিনি হযরতের কাছে মিশকাত আওয়াল এবং শামায়েলে তিরমিযী-এর দরস গ্রহণ করেছেন।
আমাদের কাছে হযরতের মূল পরিচয় ছিল, হযরত দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর মুর্দারিস হওয়ার পাশাপাশি একজন দায়ী, ওয়ায়েয ও আহলে বিদআতের বিরুদ্ধে মজবুত মুনাযির। বিভিন্ন ইলমী বিষয়ে উর্দু ভাষায় তাসনীফ-তালীফের মেযাজও ছিল হুযুরের। আমার সংগ্রহে হযরতের বেশ কয়েকটি কিতাব রয়েছে।
পরবর্তীতে হযরত দারুল উলূম মুঈনুল ইসলামের মুহতামিম হলেন। একপর্যায়ে শাইখুল হাদীসও হলেন। দূর থেকে শুনতাম, হযরতের ইহতিমামের যামানায় বিভিন্ন দিক থেকে মাদরাসার তারাক্কির কথা এবং নেজামের মধ্যে কিছু পরিমার্জনের কথা।
১৪২১ বা ১৪২২ হিজরীতে একবার হযরত রাহ. মারকাযুদ দাওয়াহ্য় তাশরীফ আনেন। জামিয়া রাহমানিয়া সাত মসজিদে কোনো মজলিসে এসেছিলেন। সেখান থেকে ফেরার সময় আমাদের এ সৌভাগ্য হয়। মারকায তখন মোহাম্মদপুর সাত মসজিদ রোড ও আসাদ এভিনিউ-এর কর্নারে। হযরত কষ্ট করে তিন তলায় উঠেছেন। কিছু সময় কুতুবখানা দেখেছেন। একটি কিতাব মুতালাআও করেছেন। যদ্দূর মনে পড়ে, হযরত মুখতাসার দুআ করে রওয়ানা হয়ে যান। জানি না, কেন হযরত এ অধমকে মহব্বত করতেন। একবার মোলাকাতে বলেছিলেন, আমি তো আপনার জন্য খুব দুআ করি। আসলে বড়দের দুআ-ই আমাদের সম্বল।
আজ থেকে সাত বছর আগে আল্লাহ তাআলা হযরতকে দ্বীনের মহত এক খেদমতের তাওফীক দিয়েছেন। তখন সত্যিই হযরত পুরো দেশবাসীর জন্য শাইখুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীনের ভূমিকা পালন করেছেন। হেফাজতে ইসলাম নামে সেই খাঁটি ঈমানী আন্দোলন চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। যে বা যাদের ষড়যন্ত্রে এবং যাদের নির্বুদ্ধিতা বা স্বার্থপরতার কারণে এই মহত আন্দোলন দুর্বল হয়ে গিয়েছে তাদের বিচার আল্লাহর হাওয়ালা করলাম। আল্লাহ তাআলা সব দেখেন এবং সব জানেন।
মনে রাখতে হবে, যে বিষয়গুলোর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে হযরত এই ঈমানী আন্দোলন করেছিলেন সেগুলো আজও তেমনই সত্য, যেমন আগে সত্য ছিল। প্রত্যেক মুমিনের উপর ঐ দাবিগুলো হক হওয়ার বিশ্বাস রাখা ফরয এবং প্রশাসনের উপর ফরয হল তা মেনে নেওয়া ও বাস্তবায়ন করা।
বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল :
* সংবিধানে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন এবং কুরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করা।
* আল্লাহ্, রাসূল ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস।
* শাহবাগ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা।
* ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।
* ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত (মুসলিমদের জন্য) ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা।
* সরকারিভাবে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।
* মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।
*রেডিও-টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাড়ি-টুপি ও ইসলামী কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসিঠাট্টা এবং নাটক-সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করা।
*পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারিগুলোর ধর্মান্তকরণসহ সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।
কোনো নাম বা বিশেষ আন্দোলন দুর্বল হয়ে যাওয়ার অর্থ এ নয় যে, তার আদর্শ ও উদ্দেশ্যও দুর্বল হয়ে গেছে। আদর্শ যদি হয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত, উদ্দেশ্য যদি হয় কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামী শরীয়ার বিধান বাস্তবায়ন তাহলে সেটা আবার দুর্বল হবে কীভাবে? সে তো প্রতিটি মুমিনের ঈমান এবং প্রত্যেক মুসলিম দেশগুলোর সকল মুসলিম শাসকের ঈমানও বটে।
যার সম্পর্ক যে দলের সাথে হোক, যে যেই দেশের নাগরিক হোক, শাসক হোক বা সাধারণ জনগণ হোক, যদি সে মুসলিম হয়, মুমিন হয় তাহলে তার দলের গঠনতন্ত্র এবং দেশের সংবিধান এসবকিছুর চেয়ে কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামী শরীয়া তার কাছে ঊর্ধ্বে। জাতীয় সভ্যতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিলেবাসভুক্ত বইসমূহ, দলীয় গঠনতন্ত্র এবং রাষ্ট্রীয় সংবিধানের মধ্যে কুরআন-সুন্নাহ বা ইসলামী শরীয়া-বিরোধী কিছু থাকলেও সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে সেটাকেই, যা কুরআন ও সুন্নাহ্য় আছে। এর বিপরীত কোনো কিছুর প্রতি তার বিশ্বাস থাকতে পারে না। মুমিন কোনো কিছুর হলফ করলে সেই হলফের মধ্যে মৌখিক ঘোষণা বা কমপক্ষে দিলের নিয়তে একথা ধর্তব্য থাকে যে, যা কিছু আল্লাহর বিধান ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ-বিরোধী তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই এবং তা আমার হলফের আওতামুক্ত।
যাইহোক, হযরতের এই ঈমানী আন্দোলন চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আল্লাহ তাআলা হযরতকে জাযায়ে খায়ের দান করুন।
প্রসঙ্গক্রমে একথাটিও বলে দেওয়া মুনাসিব মনে হচ্ছে যে, দারুল উলূম হাটহাজারী কওমের বহুত বড় দ্বীনী আমানত। তেমনিভাবে হেফাজতে ইসলামও মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ আমানত। এই উভয় আমানতের যথাযথ সংরক্ষণ জরুরি। তবে অধমের খেয়াল, উভয়ের নেযাম ও ইনতিযাম এবং কেন্দ্রীয় ব্যক্তিবর্গ ভিন্ন হওয়া উচিত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সকল দ্বীনী মাদরাসাকে হেফাজত করুন এবং কওমী মাদরাসাকে তার আদর্শ ও ঐতিহ্য এবং ইজ্জত ও আবরু বহাল করার তাওফীক দান করুন।
যদ্দূর জানতে পেরেছি, সুলূকের লাইনে ইজাযতপ্রাপ্ত হযরতের খলীফার সংখ্যাও অনেক। তাদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন, যারা এ অধমের সমবয়সী বা অধমের ছাত্রদের সমবয়সী; আমি তাদের খেদমতে শুধু একটি কথা আরজ করব। তা হল, দারুল উলূম শাহনগর চট্টগ্রাম-এর প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম হযরত মাওলানা ইউসুফ ছাহেব রাহ.-এর কথা; তিনি বলেছিলেন, খিলাফতনামা হল সুলূক ও তাসাউফের মকতবে দাখেলা নেওয়ার ফরম মাত্র। এর ফলাফল প্রকাশ পাবে কবরে ও হাশরে। কাজেই ভাই! এ ইজাযত ও খেলাফত যেন আমাদের মধ্যে নিজের ব্যাপারে কোনো ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি না করে। এটা যেন আমাদের মাঝে শায়েখিয়্যাত পয়দা না করে। সবসময় শরীয়ত ও সুন্নাহ্র পাবন্দী করি। আকীদা, মুআমালা ও মুআশারা দুরস্ত রাখি এবং আখেরাতের মুহাসাবার কথা স্মরণ করে দুনিয়াতে মুহাসাবার যিন্দেগী অবলম্বন করি। কিব্র, উজ্ব ও ছাহেবযাদেগী এবং মাশীখতের মেযাজ এবং ভাব-ভঙ্গি থেকে বেঁচে থাকি। ইজাযতের নিসবতকে কখনও আসাবিয়্যাত এবং গুরূরের কারণ না বানাই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করুন। হযরতকে জান্নাতুল ফিরদাউসের সুউচ্চ মাকাম দান করুন। হযরতের রেখে যাওয়া দ্বীনী খেদমতগুলো হেফাজত করুন, কবুল করুন- আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন।
-আরযগুযার
বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪২ হিজরী
জুমাবার