সফর ১৪৪২   ||   অক্টোবর ২০২০

বন্ধুর জন্য...

মুহাম্মাদ আলফাতিহ

সালিমের সাথে আমার পুরনো কী একটা খিটিমিটি আছে, তাই একটু দূরে সিনান ভাইয়ের পাশে টুপ করে বসে পড়লাম। এমন সময় সালিম এসে গলা বাজিয়ে বলতে লাগল, ‘পেয়েছি, পেয়েছি, হা-হা সিনান ভাই! পত্রিকায় সুন্দর একটা গল্প পেয়েছি

সিনান ভাই চোখে-মুখে একরাশ বিরক্তি ফুটিয়ে বলল, ‘গল্প পেয়েছিস মানে? আর পেলেই  এতো লাফালাফির কী হল শুনি’! সালিম কথার পিঠে কথা ঠেকিয়ে বলল, ‘লাফালাফি করব না মানে? লেখকের নাম শুনলে তুমিও খুশিতে ছাগলছানার মতো ড্যাংড্যাং করে লাফাবে

-কে, শুনি!

-কে আবার, আমাদের এই শাবীব। আমার পিঠে একটা খোঁচা মেরে বলল সালিম। শুনে আমি কিছুই জানি না-এমন একটা ভাব করে বললাম, আ-আমিসিনান ভাই বড় বড় চোখ করে বলল, ‘শাবীব তুমি গল্প লেখ? আমাকে তো কোনোদিন  বলনি’!

-আমি মাথা চুলকে আমতা আমতা করে বললাম, ‘না-মানে...

-না নাআবার কী অ্যা? বলে সিনান ভাই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দে দেখি পত্রিকাটাবলেই ছোঁ মেরে মেলে ধরল চোখের সামনে।

-সবাই একসাথে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘সিনান ভাই একটু জোরেই পড় না, আমরাও শুনি। সিনান ভাই বসতে বসতে ঠোঁট উল্টে বলল, ‘অ-আচ্ছা, ‘ওয়াকিদীর ঘটনা’! আমি বললাম, ওয়াকিদী কে সিনান ভাই’?

-আরে, গল্প লিখেছ, ওয়াকিদী কে সেটাই জান না!

-আমি বললাম, না-মানে, আমি শুধু...।

-কথা কেড়ে নিয়ে সিনান ভাই বলল, নাও নাও হয়েছে, শোনো, ওয়াকিদীর পরিচয়টাই আগে বলি, কী বল তোমরা? সবাই একঝাক পাখি-ছানার মতো চ্যাঁ চ্যাঁ করে বলল, হাঁ হাঁ, তাই করেন সিনান ভাই!।

সিনান ভাই শুরু  করল-

ওয়াকিদীর পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ। বাবার নাম উমর। দাদার নাম ওয়াকিদ। এই দাদার নাম ধরেই তিনি ওয়াকিদী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। জন্ম মদীনায়। ১৩০ হিজরী সনে। প্রসিদ্ধ ছিলেন একজন ঐতিহাসিক হিসেবে। ইতিহাস লিখে বিশ্বকে চিরঋণী করে গেছেন যে কজন ইতিহাসবিৎ, ইনি তাদেরই একজন। সীরাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবা-তাবেয়ীদের জীবনী ছিল তার লেখার প্রিয় বিষয়। রাসূলের বীরত্বগাঁথা অভিযান নিয়ে লেখা তাঁর মাগাযীনামে কিতাবটি বেশ সাড়া জাগানো গ্রন্থ।

তিনি প্রথম প্রথম মদীনায় গমের ব্যবসা করতেন। কিন্তু সে ব্যবসায় বড় রকমের মার খেয়ে চলে আসেন বাগদাদে। বাগদাদ তখন ইসলামী খেলাফতের রাজধানী। খলীফা হারুনুর রশীদ বাগদাদের পূর্বাঞ্চলে কাজীর (বিচারপতি) পদে তাকে নিয়োগ দেন। এরপর খলীফা মামুনুর রশীদ তাকে  কাজীর দায়িত্ব দেন।

তবে তিনি লেখালেখির জগতে ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার দুজন গোলাম ছিল, যাদের কাজই ছিল দিন-রাত পাণ্ডুলিপি তৈরি করা। জানা যায়, ওয়াকিদীর মৃত্যুর সময় তার বাড়ি থেকে এত্তো কিতাব পাওয়া গিয়েছিল, যা বহন করতেই প্রয়োজন হতো রীতিমত প্রায় বারোশটি বাহন।

তিনি অসাধারণ দানবীর ছিলেন। ছিলেন দুনিয়া বিমুখ। ফলে অভাব তাঁর পিছে সারাটা জীবন ছায়ার মতো লেগে ছিল।

তিনি ২০৭ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন।

[দ্রষ্টব্য : সিয়ারু আলামিন নুবালা, জীবনী : ১৭২]

সিনান ভাই বলল, এই হল তাঁর মোটামুটি পরিচয়। মিকদাদ ফট করে বলে উঠল,

-তাহলে এবার গল্পটা পড়ে ফেলেন।

সিনান ভাই শুরু  করল পড়া-

আকাশ ভেঙে অন্ধকার নেমেছে। কালো অন্ধকারে ডুবে আছে সারা বিশ্ব। টিম টিম করে জ¦লছে একটি আলতো আলোর প্রদীপ। ওয়াকিদীর জীর্ণঘরে । হয়তো সে আলোতে গভীরভাবে কিতাব পড়ছেন ওয়াকিদী। হঠাৎ স্ত্রীর ডাকে পড়ায় ছেদ পড়ে।

-হ্যাগো, শুনছ?

-কেন, হঠাৎ আবার কী হল? খানিকটা বিরক্তই হয় ওয়াকিদী।

-কী আর হবে, ঈদ তো এসে গেল। স্ত্রীর কণ্ঠে চাপা অভিমান।

বেলুন থেকে ফোঁস করে হাওয়া বের হয় যেমন, তেমনি করে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ওয়াকিদী বলল,

-সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তো?

-এই অভাবের সংসারে আমরা না হয় সবর করলাম, কিন্তু ছেলে-মেয়ে?

যখন ওরা প্রতিবেশী বাচ্চা-কাচ্চাদের সাথে ঈদগাহে যাবে, দেখবে বন্ধুরা সুন্দর সুন্দর পোশাক পরে এসেছে আর নিজেরা পরেছে দশ তালির জামা। এসব  ভেবে হৃদয়টা যে আমার দুমড়ে-মুচড়ে ফেটে যাচ্ছে। দেখ না কিছু একটা করা যায় কি না! স্ত্রীর ভেজা গলায় করুণ আবেদন।

স্ত্রীর কথা শুনে ওয়াকিদী কী করবে, ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। হাত যে তার একেবারেই শূন্য। যার এলোমেলো সাজবিহীন জীবনটাতে নিয়মিত দুবেলা খাবার জোটে না, উপোস-কাপোসে দিন কাটে। খাই-খরচার ব্যাপারে অত্যন্ত হুঁশ-জ্ঞান খরচ করে চালতে হয়। তার আবার নতুন জামা কিনে দেয়ার সামর্থ্য কোথায়?

ওয়াকিদী কেমন দিশেহারার মতো তাকায় স্ত্রীর দিকে। দেখতে পায় চকচকে কালো চোখে ছলছল করছে কষ্টের অশ্রুসে অশ্রু যেন হাজার হাজার সুচ হয়ে ফোটে ওয়াকিদীর বুকে। হঠাৎ তার মাথায়  বিদ্যুৎ খেলে যায়। ঝলমল করে ওঠে চোখ। মনে পড়ে প্রিয় দুই বন্ধুর কথা। তিন বন্ধু যেন একে অপরের প্রাণ। তার মধ্যে একজনের সাথে একটু বেশি। সে তাঁর একনম্বর বন্ধু।

-দেখি কী করা যায়। বলে খসখস শব্দ তুলে চটজলদি একটি চিঠি লিখে ফেলল সে। পরের দিন পাঠিয়ে দিল একনম্বর বন্ধুর ঠিকানায়।

কিছুদিন যেতে না যেতেই ওয়াকিদীর হাতে এলো সিলমারা একটি থলে। একনম্বর বন্ধু পাঠিয়েছে। খানিকটা বিস্ময় নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল ওয়াকিদী। ভেতরে ঝনঝন করছে রৌপ্যমুদ্রা। পাক্কা এক হাজার দিরহাম।  দেখে তো ওয়াকিদীর সারাটা দেহ-মনে কুলকুল করে বয়ে চলল খুশির স্রোতে। চোখের তারায় ঢেউ দিয়ে জেগে উঠল নতুন জামা গায়ে স্ত্রী-সন্তানের হাসিভরা মুখ। সে হাসিতে ছলকে বেরুচ্ছে ঈদের আনন্দ। ভেবে হৃদয়টা তার ঠাণ্ডা হয়ে গেল। বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে এল প্রশান্তির এক শীতল নিঃশ্বাস। যাক অবশেষে একটা ব্যবস্থা হল তাহলে। মনের অজান্তে মুখ ফুটে বেরিয়ে এল আলহামদু লিল্লাহ

কিছুক্ষণ পর হাতে এল আরেকটা চিঠি। দুইনম্বর বন্ধু পাঠিয়েছে। চিঠিটা পড়ে ওয়াকিদীর বুকটা হঠাৎ ছ্যাঁৎ করে উঠল। হাসি হাসি মুখের উজ্জ্বলতা কেমন দপ করে নিভে গেল। কপালে দেখা দিল বিন্দু বিন্দু ঘাম। ভাববার মতো একটা ব্যাপারই বটে। ওয়াকিদীর সংসারে দরিদ্রতা আষ্টেপৃষ্ঠে যেমন করে জাপটে ধরেছে। তারও একই অবস্থা; বরং আরো খারাপ। সেও সহযোগিতা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে।

ভীষণ দ্বেদ্বর মধ্যে পড়ে গেলেন ওয়াকিদী। একদিকে স্ত্রী-সন্তানের করুণ মুখ। অপরদিকে বিপদগ্রস্ত প্রিয় বন্ধুর আবেদন। কোন্ ডাকে সাড়া দেবে সে? মনের আদালতে চলে কিছুক্ষণ যুক্তিতর্কের লড়াই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিখাঁদ বন্ধুত্বের কাছে হেরে যায় সে। থেমে যায় সমস্ত যুক্তি। বন্ধুর কষ্টে মোচড় দিয়ে ওঠে মন। ভাবে, বন্ধুর জন্যে সুখদুঃখ, জয়-পরাজয় আর লাভ-ক্ষতি যে সমান দৃষ্টিতে দেখতে পারে না, তার কী অধিকার আছে বন্ধু হওয়ার। বন্ধু মানে তো সুখে-দুঃখে একে অপরের পাশে দাঁড়ানো। অবশেষে সেই থলেটাই পাঠিয়ে দিল সে বন্ধুর কাছে।

কিন্তু এখন স্ত্রীকে সে কী বলবে? সন্তানদেরই বা কী বলে সান্ত¦না দেবে? তারাও বা বিষয়টি কীভাবে নেবে। একঝাঁক দুশ্চিন্তা এসে ছায়া ফেলল তার চোখে-মুখে। মনের মাঝে শূন্যতা ফের খাঁখাঁ করে উঠল। পা টিপে টিপে বেরিয়ে গেল মসজিদে।

মসজিদেই তার বিকাল গড়াল। সন্ধ্যা এল। রাত নামল। মসজিদে এলে বড় ভালো লাগে। চিন্তা-টিন্তা কেন জানি তখন আর থাকে না। নিরিবিলি পরিবেশ। যতক্ষণ থাকে মনে কী এক অসাধারণ প্রশান্তি এসে ঘুম পাড়াতে চায়। ইচ্ছে হয় সব ছেড়েছুড়ে এখানেই পড়ে থাকতে। কিন্তু সেটা হয় না। পরিবার আছে। সংসার আছে। সেসব দেখাশোনাও একটা কেন কাজ।

ওয়াকিদী রাতটি মসজিদেই কাটিয়ে দিলেন। তাহাজ্জুদ আর দুআ-মুনাজাতে শরীর বেশ ক্লান্ত। সকালে বাড়ি ফিরে মাথা নিচু করে সোজা চলে গেল শোয়ার ঘরে। নিশ্চয় স্ত্রী এবার ঝগড়া বাঁধিয়ে একটা  প্রলয়কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবে! দেখা গেল তার কিছুই ঘটল না। বরং উল্টো সান্ত¡না দিল সে। দ¦ীনদার বুদ্ধিমতি স্ত্রী বলে কথা। নইলে কপালে যে আজ কী ছিল আল্লাহ মালুম। স্বামী-স্ত্রী দ্বীনদার হলে এই এক ফায়দা, সম্পদ না থাকলেও ঘরে শান্তি থাকে। সান্ত¡না থাকে।

এভাবেই দুশ্চিন্তায় কাটছিল দিন। হঠাৎ একদিন দরজায় ঠকঠক শব্দ। দরজা খুলে  চমকে ওঠে সে। মুহূর্তে চমকে যাওয়ার ভাবটা সামলে নিল ওয়াকিদী। সালাম দিয়ে চোখেমুখে একটা উচ্ছ্বাসের ভাব এনে বলল, ‘আরে দোস্ত! কেমন আছ? এসো এসো, ভেতরে এসো। পথে কোনো বিপদ-টিপদ হয়নি তো? মুসাফাহা-মুআনাকা সেরে একনম্বর বন্ধুর হাত ধরে ঘরে বসতে বসতে বলল ওয়াকিদী।

হঠাৎ তার চোখ পড়ে বন্ধুর হাতে থাকা থলের ওপর। মুহূর্তে তার প্রতিটি শিরা-উপশিরায় যেন হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে যায়। কী হল? ওয়াকিদী চোখ বড় বড় করে একবার বন্ধুর হাতের দিকে আরেকবার মুখের দিকে তাকায়। চোখ ঠিকরে বিস্ময় ঝরে পড়ছে তার। ওয়াকিদীকে এভাবে তাকাতে দেখে বন্ধু জিজ্ঞেস করল,

-দোস্ত, সত্য করে বল দেখিতোমাকে যে থলে পাঠিয়েছিলাম সেটা কী করেছ? এই রহস্য ভেদ করতেই আমাকে এত দূর আসতে হল।

ওয়াকিদী হঠাৎ এমন একটা প্রশ্নের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। এখন থতমত খেয়ে বলি কি বলি নাএমন একটা ভাব করতে লাগল। অবশেষে বলেই ফেলল এ পর্যন্ত যা ঘটেছে। এরপর বিস্ময়ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, দোস্ত, এ থলে তোমার কাছে এল কী করে?

বন্ধু কোনো উত্তর না দিয়ে  হঠাৎ যেন ভাবনার অতল-তলে ডুবে গেল। খানিকক্ষণ পর খুশি ও আবেগ মেশানো আশ্চর্য ধরনের একটা ভাব নিয়ে বলল, ‘ব্যাপারটা দেখছি তাহলে ভারি চমৎকার! আমরা তিন বন্ধু সবাই সবার জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছি। অপরের উপকারকেই বড় করে দেখেছি।

-মানে?

-মানে একেবারেই সোজা। আমি প্রথমে তোমাকে যে রৌপ্যমুদ্রা পাঠিয়েছিলাম, সেটাই ছিল আমার একমাত্র সম্পদ। কিন্তু  চিঠি পেয়ে নিজের ওপর তোমার প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে পুরোটাই পাঠিয়েছিলাম। অপর (দুইনম্বর) বন্ধুর চিঠি পেয়ে তুমিও তা-ই করেছ। আর সে-ও একইভাবে আমাকে পুরোটাই পাঠিয়েছে। কারণ আমার একমাত্র সম্পদ তোমাকে দিয়ে আমি একেবারেই খালিহাত। তাই তার কাছে সহযোগিতা চেয়ে চিঠি লিখেছিলাম। এভাবে ঘুরে ঘুরে আমার থলে আমার হাতেই চলে এসেছে।

বন্ধু থামল। দুজনেই চুপ। অনেকক্ষণ। দুজনেরই ঠোঁটজুড়ে হাসি, চোখজুড়ে জল।

সিনান ভাইয়ের গল্প পড়া শেষ হল। সবাই এতক্ষণ অন্য জগতে ছিল। কারো কারো চোখে পানি। বন্ধুর জন্য বন্ধুর ত্যাগের কাহিনী শুনে হতবাক।

তথ্যসূত্র :

১. সাফাহাত মিন সাবরিল উলামা, পৃ. ১৭৫-১৭৬ (তালীকসহ)

২. মুরুজুয যাহাব ওয়া মাআদিনুল জাওহার, মাসউদী খ. ৪, পৃ. ৩১

 

 

advertisement