যিলক্বদ ১৪৩০   ||   নভেম্বর ২০০৯

এ সকল পণ্ডিত ...!

ইয়াছির কাজী

সম্প্রতি নিকাব প্রসঙ্গে শায়খুল আযহারের একটি বক্তব্য ও আচরণ অত্যন্ত নিন্দিত ও ধিকৃত হয়েছে। তাকে কলেজের ছাত্রীদের উদ্দেশে বক্তব্য দেওয়ার জন্য দাওয়াত করা হয়েছিল তিনি সেই সমাবেশে একজন নিকাব পরিহিতা ছাত্রীকে নিকাব খুলতে বাধ্য করেন। মেয়েটির বারংবার মিনতির পরও তিনি তাকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘নিকাব ইসলামের কোনো অংশ নয়। এটি একটি কালচার মাত্র।’ এরপর তিনি তার বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য বলেন, ‘আমি তোমার চেয়ে এবং যাদের থেকে তোমার জন্ম তাদের চেয়েও দ্বীন বেশি জানি।’ এভাবে ভীত ও সন্ত্রস-, নিজের শিক্ষক ও মিডিয়ার সামনে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের দ্বারা অপমানিত মেয়েটির পক্ষে যখন নিকাব খোলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকল না তখন ভদ্রলোক সন'ষ্ট হয়ে মেয়েটির প্রতি শেষ চাবুকটি বর্ষণ করলেন।

নিকাব খুলে ফেলার পর তিনি বললেন, ‘তুমি যদি একটুও সুন্দরী হতে, তাহলে তুমি কী করতে?’ দ্বীনি পিতা কীভাবে ষোড়শী কন্যার আত্মমর্যাদা গুড়িয়ে দিলেন-এটা সব শিক্ষকদের মনে রাখা উচিত। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যে ক’খানা হাদীস শুনেছি সে অনুযায়ী তো দেখা যায়, উম্মুল মু’মিনীনগণ নিজেরা নিকাবে অভ্যস- ছিলেন এবং সাহাবা-যুগে ব্যাপকভাবে তা অনুসরণ করা হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবারই হজ্ব করেছেন। তার পূর্বে মহিলাদের নির্দেশনা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, ইহ্রাম বাধা অবস্থায় তারা নিকাব পরিধান করবে না (সহীহ্ বুখারী)। বলাবাহুল্য, নিকাব পরিধানের প্রচলন না থাকলে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বিষয়ে সতর্ক করতেন না। এ ধরনের আরো কিছু হাদীসে আমাদের মত সর্বসাধারণের জন্য কি তাহলে বিভ্রানি-র কারণ রয়েছে? সুনানে আবু দাউদে আছে, আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) ইহ্রাম অবস্থায়ও তার মুখের সামনে কাপড় দিয়ে দিতেন যখন তাঁর সামনে দিয়ে সওয়ারীগণ অতিক্রম করতেন। আর এটা ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে থাকা অবস্থায় আম্মাজান বুঝেছিলেন যে, ইহরাম অবস্থাতেও নিকাব ব্যবহার না করার আদেশের অর্থ ছিল মুখমণ্ডলে কাপড় না লাগানো। অন্যথায় পর পুরুষের সামনে চেহারা আবৃত রাখার বিধান এ অবস্থায়ও কার্যকর।

রোমান প্রথার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিপথগামী কিছু ব্যক্তি বলতে চায়, সম্ভবত নিকাব ব্যবহার বিশেষভাবে উম্মুল মু’মিনীনদের জন্য ছিল। এ বিষয়ে আমাদের বিজ্ঞ মুফতীগণ বুঝিয়ে দিতে পারবেন। তবে ইমাম মালেক (রহ:)-এর ‘মুয়াত্তা’য় আম্মাজান হযরত আয়েশা (রা.)-এর মতো হযরত ফাতিমা বিনতে মুনযির (রা.)-এর ইহরাম অবস্থায় পর্দা করার ঘটনা বর্ণিত আছে, অথচ ফাতিমা বিনতে মুনযির উম্মুল মু’মিনীন ছিলেন না। আরেক বর্ণনায় রয়েছে যে, উম্মে খাল্লাদ (রা.) এক যুদ্ধের পর বেচায়েন হয়ে তার ছেলেকে খুঁজছিলেন। উপসি'ত সাহাবীগণ (রা.) আশ্চর্য হলেন যে, এরকম পেরেশানের অবস্থাতেও তিনি মুখমণ্ডল নিকাব দ্বারা আবৃত রাখার কথা ভোলেননি। একজন সাহাবী তাকে এ বিষয়ে কিছু বললেন। তখন সাহাবিয়া (রা.) যে জবাবটি দিয়েছিলেন, তা ছিল, ‘আমি আমার সন্তান হারালেও লজ্জা শরম হারাতে চাই না!’ সেই সাহাবিয়ার সৌভাগ্য যে, শায়খুল আযহার সেখানে উপসি'ত ছিলেন না। সম্ভবত তিনি সেখানে থাকলে বলতেন, লজ্জা শরমের বিধান কী, তা তারই ভালো জানা আছে! ইফক্-এর ঘটনায় আম্মাজান হযরত আয়েশা (রা.) কে সাফওয়ান বিন মুয়াত্তাল (রা.) চিনতে পেরেছিলেন কারণ, তিনি পর্দার আয়াত নাযিলের পূর্বে উম্মুল মু’মিনীনকে দেখেছিলেন। অন্য বর্ণনায়, উমর বিন খাত্তাব (রা.) হযরত সাফিয়া (রা.)-কে চিনতে পারার কারণ ছিল তাঁর হাঁটার ভঙ্গি উমর রা.-এর কাছে পরিচিত ছিল। এ দু’টি বর্ণনাই সহীহ্ বুখারীতে আছে। পর্দার আয়াত নাযিল হওয়ার পর নিকাবের প্রচলন না থাকলে পূর্বে দেখার প্রশ্ন কিংবা হাঁটার ভঙ্গি চেনা-এসব কথার কোনো অর্থ থাকে না।

কুরআনের আয়াত ও সহীহ হাদীস ছাড়াও ফিকহ্-এর গ্রন'সমূহে, যেমন, ইমাম নববী (রহ.)-এর মাজমু’, ইবনে কুদামা (রহ.)-এর মুগনী, ইবনে আবেদীন-এর রাদ্দুল মুহ্তার, ইবনে আবদুল বার-এর তামহীদ - এই সব গ্রনে' নিক্বাবের কথা রয়েছে। ফিকহ্-এর চার মাযহাবই শত শত বছর যাবত নিকাবের আলোচনা গুরুত্বের সাথে করেছে। এমনকি এই চার মাযহাবের বাইরে, যেমন, ইবনে হায্ম-এর আল-মুহাল্লাতে নিকাবের আলোচনা আছে। প্রশ্ন এই যে, ভদ্রলোক কি তাহলে ইসলামের বিরুদ্ধে এমন একটি ষড়যন্ত্র উন্মোচন করলেন, যাতে সাহাবা-যুগ থেকে নিয়ে শত শত বছর যাবৎ মুসলিম জাহানের সকল ভূখণ্ডের মুসলিম মনীষীরাও আক্রান- হয়ে গিয়েছিলেন? আর তিনিই তার দূরদর্শিতা দ্বারা তা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন? শুধু তাই নয়, এই ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করাকে তিনি এমন ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করেছেন যে, প্রকাশ্য সমাবেশে ওই নিকাব পরিহিতা মেয়েটিকে চরমভাবে অপদস- ও অপমানিত করাকেও তিনি ‘জায়েয’ মনে করলেন?!

ড. ইউসুফ আল কারযাভী, যিনি রক্ষণশীল চিন্তাধারার ব্যক্তি বলে পরিচিত নন, তার বক্তব্য এই যে, ‘যারা বলে যে, নিক্বাব নতুন সংযোজন বা নিষিদ্ধ তারা মুর্খ এবং এই কথা বলে তারা আল্লাহ্ তাআলার বিধানকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে।’ আমরা মনে করি, মিসর সরকারের কর্তব্য, এই ঐতিহ্যবাহী ইসলামী প্রতিষ্ঠানের ‘শায়খ’ পদে এমন ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া, যারা দ্বারা অন-ত আমাদের মেয়েরা ইসলামের সৌন্দর্য, উদারতা ও উত্তম আখলাক সম্পর্কে ধারণা পেতে পারে।

(ইংরেজী থেকে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ)

http://muslimmatters.org/2009/10/07/with-scholars-like-these/

 

advertisement