হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী রাহ.
সংকল্পদৃঢ় জীবন যেমন
ইমাম গাযালী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। মূল নাম মুহাম্মাদ। উপনাম আবু হামীদ। উপাধি হুজ্জাতুল ইসলাম।
৪৫০ হিজরী মুতাবেক ১০৫৮ সালে খোরাসানের ত‚স নগরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন কাপড় বিক্রেতা। দুই ছেলেকে ছোট রেখে তিনি মারা যান। মৃত্যুর সময় তার এক বন্ধুকে অসিয়ত করে বলেন, আমার অর্থ-সম্পদ যা আছে তোমার হাতে দিয়ে গেলাম। ছেলে দুটিকে হস্তলিপি শিখিও। আমার খুব স্বপ্ন ছিল এটা শেখার। হল না। ছেলেদের দিয়ে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চাই।
বাবার মৃত্যুর পর সেই বন্ধুই ছেলেদের তত্ত্বাবধান করেন। বন্ধু ছিলেন খুবই গরিব। তার রেখে যাওয়া সম্পদ ফুরিয়ে গেলে তিনি বলেন, জানো তো আমি সম্পদহীন মানুষ। তোমাদের জন্য বরাদ্দ অর্থগুলো এই শেষ হল। এখন কী করা? ভাবছি, কোনো মাদরাসায় চলে যাও। ইলম শিখো। খাবারের ব্যবস্থাও আশা করি হয়ে যাবে। দুই ভাই চলে গেলেন মাদরাসায়। এখান থেকেই শুরু হল তাদের নতুন জীবন। খুলে গেল সৌভাগ্যের প্রশস্ত দরজা। -তাবাকাতুশ শাফিইয়্যাতিল কুবরা, খ. ৬, পৃ. ১৯৩-৯৪; সিয়ারু আলামিন নুবালা, খ. ১৪, পৃ. ৩২৮
ইমাম গাযালী রাহ. ছোটবেলা ত‚স নগরেই পড়াশোনা করেন। ফিকহের পাঠ গ্রহণ করেন ইমাম আহমাদ আররাযাকানী রাহ.-এর কাছে। এরপর জুরযান সফর করেন। সেখানে ইমাম আবু নসর আলইসমাঈলী রাহ.-এর কাছে পড়েন। তাঁর কাছ থেকে অনেক বিষয় নোট করেন। এরপর ফিরে আসেন ত‚সে। পথিমধ্যে ঘটে তাঁর জীবনের সেই অবিস্মরণীয় ঘটনাটি।
ইমাম গাযালী রাহ. বলেন, ‘ডাকাতদল আমাদের উপর হামলা করল। তারা আমার কাছে যা ছিল সব নিয়ে গেল। আমি তাদের পিছু নিলাম। ডাকাত সর্দার আমাকে ধমকে বলল, হতভাগা! পিছু হটো। নয়তো মারা পড়বে।
আমি অনুনয় করে বললাম, দোহাই খোদার! শুধু আমার নোট খাতাগুলো ফিরিয়ে দাও। তা তোমাদের কোনোই কাজে আসবে না।
সে বলল, খাতা আবার কী?
বললাম, ঐ যে থলির মধ্যে আছে। ওগুলোর ইলম হাসিল করার জন্যই এই দীর্ঘ সফর।
সর্দার হেসে উঠল। বলল, এই খাতা নিয়ে গেলে যদি তোমার ইলম চলে যায় তাহলে কী ইলম হাসিল করলে?
সর্দার খাতা ফেরত দেওয়ার আদেশ দিল।
ইমাম গাযালী রাহ. বলেন, আল্লাহ তাআলা আমাকে ইলমের পথে দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্যই ডাকাতের মুখোমুখি করেছেন। ফলে ত‚সে ফিরে টানা তিন বছর মগ্ন হয়ে পড়াশোনা করলাম। খাতাগুলো সব মুখস্থ করে ফেললাম। তখন মনে হল ডাকাত এবার সব নিয়ে গেলেও ইলম নিতে পারবে না।’ -তাবাকাতুশ শাফিইয়্যাতিল কুবরা, খ. ৬, পৃ. ১৯৫
এরপর ইমাম গাযালী রাহ. আরো ইলম হাসিলের জন্য নিশাপুর সফর করেন। সেখানে ইমামুল হারামাইন আবুল মাআলী আলজুয়াইনী রাহ.-এর সান্নিধ্য গ্রহণ করেন। তাঁর কাছে দীর্ঘ অধ্যাবসায়ের পর ফিকহ শাস্ত্রে পাÐিত্য অর্জন করেন। আকাইদ, উসূল, মানতেক, হেকমত, ফালসাফা ও তর্কশাস্ত্রেও গভীর জ্ঞান লাভ করেন। একসময় এইসব শাস্ত্রেই তিনি কালজয়ী গ্রন্থ রচনা করেন। এই উস্তায যতদিন বেঁচে ছিলেন তিনি তার সান্নিধ্যেই ছিলেন। -তাবাকাতুশ শাফিইয়্যাতিল কুবরা, খ. ৬, পৃ. ১৯৬
তিনি ছিলেন প্রখর মেধার অধিকারী। দ্রæত মুখস্থ ও আত্মস্থকারী। সূ² থেকে সূ² ভাব-মর্ম উদ্ধার ও অনুধাবনে পারদর্শী। ইলম ও প্রজ্ঞায় বিশেষ রুচি ও দৃষ্টিসম্পন্ন। বিচক্ষণ ও অপ্রতিদ্ব›দ্বী তার্কিক। উস্তায ইমামুল হারামাইন তাঁর সম্পর্কে বলেন, ‘গাযালী তো গভীর সাগর।’ -প্রাগুক্ত
৪৭৮ হিজরীতে ইমামুল হারামাইন রাহ.-এর ইনতিকালের পর তিনি নিশাপুর ত্যাগ করেন। তখন ‘আসকারে’ গিয়ে উজির নিযামুল মুলকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উজির তাঁকে সসম্মানে গ্রহণ করেন। একপর্যায়ে তাঁর যোগ্যতা ও প্রতিভা দেখে বিখ্যাত নিযামিয়া মাদরাসার দায়িত্ব তাঁর হাতে অর্পণ করেন। তিনি সেখানে শিক্ষকতা শুরু করলে ইরাক ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় তাঁর যোগ্যতা ও দক্ষতার ব্যাপক খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এমন গ্রহণযোগ্যতা ও খ্যাতির একপর্যায়ে এসে তিনি ইখলাসহীন লৌকিকতার ভয় করেন। তাই সবকিছু ছেড়ে মক্কায় চলে যান। -ওয়াফায়াতুল আ‘য়ান, খ. ৪, পৃ. ৫৯
নিযামিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতাকালে তাঁর দরসে হাজির হত সেকালের বড় বড় উলামা ও ফুকাহা। ফলে তিনি উসতাযুল উলামা হিসাবে মানুষের হৃদয়ে স্থান পেয়ে যান। খ্যাতি লাভ করেন ‘ইমামুল ইরাক’ নামে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৫-৩৬ বছর। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন ছুটে আসে তাঁর কাছে। তাঁর বাণী ও বক্তব্য সংরক্ষণ করে। তাঁকে মর্যাদার উপমা বানিয়ে পেশ করে। তিনি হয়ে উঠেন তাদের প্রবাদ পুরুষ। অঢেল সম্পদও লুটিয়ে পড়ে তাঁর পায়ে। এতে চিন্তিত হয়ে পড়েন তিনি। একসময় জীবন-চিত্র বদলে ফেলার দৃঢ় সংকল্প করেন। সেই বর্ণনা দিয়েছেন তিনি নিজেই। তাঁর ভাষায়-
‘একসময় আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল, তাকওয়া পরহেযগারি আর প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া আখেরাতের সফলতা অসম্ভব। সেজন্য মূল কাজ হল দুনিয়ার মোহ দূর করা। ধোঁকার এ জগৎ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। সেইসাথে চিরস্থায়ী আখিরাতের অভিমুখী হওয়া। পূর্ণ হিম্মত ও প্রত্যয় নিয়ে আল্লাহ তাআলার প্রতি মনোযোগী হওয়া। এটা সম্ভব হবে- যদি সম্মান, সম্পদ ও ঐশ্বর্য উপেক্ষা করা যায়। সকল ব্যস্ততা ও সম্পর্ক ছিন্ন করা যায়।
এসব ভেবে আমি আমার নিজের দিকে তাকালাম। দেখলাম, নানা সূত্র-সম্পর্কে আমি জড়িয়ে আছি। বিভিন্ন আকর্ষণ ও আগ্রহে ডুবে আছি। আমলের দিকে তাকালাম; দেখলাম, শিক্ষকতাই এখন আমার সর্বোত্তম আমল। অথচ আখেরাতে কাজে আসার মতো কোনো জ্ঞানচর্চায় আমি নেই। নিয়তের কথা ভাবলাম। দেখলাম, তা একমাত্র আল্লাহর জন্য নিবেদিত নয়; বরং এর প্রেরণা ও চালিকাশক্তি হল মর্যাদা ও খ্যাতির আকাক্সক্ষা। এসব দেখে নিশ্চিত হলাম, আমি খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছি। যদি আমার অবস্থা শোধরাতে না পারি সত্বর জাহান্নামে গিয়ে পড়ব।
বেশ কিছুদিন এসব ভাবনায় কেটে গেল। দেখলাম, এখনো আমার ইচ্ছাশক্তি কাজে লাগানোর সুযোগ আছে। তাই একবার প্রতিজ্ঞা করি- সবকিছু ফেলে বাগদাদ ছেড়ে চলে যাব। পরে আবার সে প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেলি। যেন এক পা এগোই এক পা পিছাই। সকালে আখেরাতের ভাবনায় আগ্রহ পেলে সন্ধ্যায় প্রবৃত্তি হানা দেয়। আবার সব নিস্তেজ হয়ে যায়। পার্থিব চাহিদা নানা শৃঙ্খলে বেঁধে এদিকে টানে আর ঈমানের ঘোষক বলে যাত্রা কর, এখনই যাত্রা কর। বলে, জীবন তো আর অল্প বাকি; সামনে সফর বহু দীর্ঘ। তুমি যে ইলম-আমলে মগ্ন আছ সে তো কেবলই লৌকিকতা আর প্রতারণা। সুতরাং আখেরাতের প্রস্তুতি এখন যদি না নাও কখন নেবে? এই সূত্র-সম্পর্ক যদি এখনও না ছাড়ো কখন ছাড়বে?
এভাবে একসময় আমার ইচ্ছা প্রবল হয়। সবকিছু ছেড়ে চলে যাবার সংকল্প দৃঢ় হয়। আবার শয়তান বলে, এসব কেবলই হেঁয়ালিপনা। তা মানতে যেয়ো না, সাবধান! এ অবস্থা শীঘ্রই কেটে যাবে। যদি এসব ধারণা করে এই খ্যাতি ও সম্মান ছেড়ে যাও, পদমর্যাদা রেখে যাও, নিরাপদ ভক্তি-ভালবাসা ত্যাগ কর, তাহলে হয়ত আবার কখনো মন ঘুরে যাবে, তখন এসব ফিরে পেতে চাইলেও তা সহজ হবে না।
একটানা প্রায় ছয় মাস দুনিয়ার টান আর পরকালের আগ্রহের মাঝে দুলতে থাকলাম। একপর্যায়ে বিষয়টি আর আমার ইচ্ছাধীন থাকল না। বাধ্যবাধকতার পর্যায়ে চলে গেল। কারণ, আল্লাহ তাআলা আমাকে তখন বাকরুদ্ধ করে দিলেন। ফলে দরস করাতেও পারলাম না। একবার খুব চেষ্টা করলাম কিছু মানুষের মন খুশি করার জন্য একটা দরস করব। কিন্তু আমার জিহŸা কোনো শব্দই উচ্চারণ করতে পারল না। এই বাকরুদ্ধতা তখন আমার অন্তরে এমন যন্ত্রণা সৃষ্টি করল যে, খাবারের স্বাদ ও হজমশক্তি নষ্ট হয়ে গেল। একফোঁটা পানিও গলা দিয়ে নামছে না। এক লোকমা খাবারও হজম হচ্ছে না।...
অবশেষে যখন আমি আমার অক্ষমতা উপলব্ধি করতে পারলাম আর আমার ইচ্ছাশক্তি বলতে কিছুই থাকল না, তখন উপায় অবলম্বনহীন নিতান্ত অসহায়ের মতো আল্লাহ তাআলার আশ্রয় নিলাম। তিনি সাড়া দিলেন। আমার জন্য সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া সহজ করে দিলেন। তখন মনে মনে শামে চলে যাওয়ার সংকল্প করেও মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার কথা প্রকাশ করলাম। কারণ, ভয় ছিল যে, খলীফা ও বন্ধু-বান্ধব আমার শামে বসবাসের কথা জেনে যাবে। তখন আরও সূ² অনেক কৌশল অবলম্বন করলাম, যেন বাগদাদ ছেড়ে গেলে আর ফিরে আসতে না হয়। তবুও আমি ইরাকের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিবর্গের সমালোচনার পাত্র হলাম।’ -আলমুনকিয মিনাদ্ দলাল, পৃ. ৬৬-৬৭
এভাবে ইমাম গাযালী রাহ. বাগদাদ ছেড়ে চলে গেলেন। সেটা ছিল ৪৮৮ হিজরীর ঘটনা। তিনি প্রথমে মক্কায় গিয়ে হজ্ব করেন। এরপর চলে যান শামে। কিছুদিন থাকেন বাইতুল মাকদিসে, কিছুদিন দামেশকের মসজিদে। এভাবে প্রায় দশ বছর কেটে যায়।
এই দীর্ঘ সময়ে তিনি নির্জন-নিরালায় আধ্যাত্মিক সাধনা ও মোজাহাদা, ইবাদত ও যিকিরে মগ্ন থাকেন। এরপর ফিরে আসেন ত‚সে। লেখালেখি ও কিতাব রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। সে সময়ই তিনি অসাধারণ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। একসময় আবার তাঁকে নিশাপুরে যেতে হয়। পাঠদানের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয় সেই নিযামিয়া মাদরাসায়।
এটা ছিল ৪৯৯ হিজরীর ঘটনা। এর কিছুদিন পরই তিনি অপারাগতা প্রকাশ করে আবার ফিরে আসেন জন্মভ‚মি ত‚সে। সেখানে একটি মাদরাসা ও খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি ভক্ত ও মুরিদদের মাঝে আত্মশুদ্ধির মেহনত করেন। এসময় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল কুরআনুল কারীমের তিলাওয়াত আর হাদীসে নববীর মুতালাআ। বাকি জীবন এরই মধ্যে নিমগ্ন থাকেন।
৫০৫ হিজরীর ১৪ জুমাদাল উখরা সোমবারে তূস নগর থেকেই তিনি পরপারের সফরে রওয়ানা হন।
তাঁর সেরা রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে, ফিকহ শাস্ত্রে- আলবাসীত, আলওয়াসীত, আলওয়াজীয ও আলখোলাসা। উসূল শাস্ত্রে- আলমানখূল, আলমুসতাসফা ও তাহযীবুল উসূল। দর্শন শাস্ত্রে- মাকাসিদুল ফালাসিফা, তাহাফুতুল ফালাসিফা ও অন্যান্য। আকাইদ শাস্ত্রে- কাওয়াইদুল আকাইদ আলইকতিসাদ ফিল ই‘তিকাদ ও অন্যান্য। তাসাওউফ শাস্ত্রে- ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন, মিনহাজুল আবিদীন, বিদায়াতুল হিদায়া ও অন্যান্য। এছাড়াও মিশকাতুল আনওয়ার, কীমিয়াউস সাআদাত, আলমুনকিয মিনাদ্ দলাল ও আয়্যুহাল ওয়ালাদসহ বহু কিতাব।