সুবহে সাদিক কখন শুরু?
প্রসঙ্গ আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান-৩
কিছু আপত্তি ও তার জবাব
সুবহে সাদিক কত ডিগ্রিতে শুরু হয়- ইতিপূর্বে আমরা মাসিক আলকাউসারে তিনটি পর্বে এর উপর দালীলিক আলোচনা পাঠ করেছি। (দ্র. শাবান-রমযান ১৪৪০ হি.; জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪১ হি. ও যিলকদ ১৪৪১ হি. সংখ্যা) এই আলোচনাগুলো থেকে আমাদের নিকট যেমন এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, ‘ফুকাহায়ে শরীয়ত’ ও ‘মাহিরীনে ফালাকিয়াত’-এর নিকট সুবহে সাদিক শুরু হয় ১৮ ডিগ্রিতে বা তার কিছু আগেই। যুগপরম্পরায় চলে আসা মুসলিম উম্মাহর আমল, মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মুশাহাদা ও বক্তব্য, বিভিন্ন ফতোয়া বিভাগ ও মুফতী বোর্ডের সিদ্ধান্ত ইত্যাদি দ্বারা এটি সুপ্রমাণিত এবং তাদের সবার নিকট স্বীকৃত। তেমনিভাবে এই আলোচনাগুলো থেকে এটিও প্রমাণিত হয়েছে যে, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানেও বিষয়টি এ রকমই। অর্থাৎ ১৮ ডিগ্রিতে দৃশ্যমান আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পরিভাষার অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট আর সুবহে সাদিক একই। কারণ এটি দিগন্তের উভয় দিকে বিস্তৃত আকারে প্রকাশিত হয়। পক্ষান্তরে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের আগ মুহূর্তে প্রকাশিত জোডিয়াকাল লাইট সুবহে কাযিব (False Dawn)। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বক্তব্যে এটিও স্বীকৃত ও সুপ্রমাণিত বিষয়।
অতএব মুসলিম উম্মাহ ও আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান উভয়েরই নিকট স্বীকৃত হল, সুবহে সাদিক (অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট) শুরু হয় ১৮ ডিগ্রিতে; এর পর নয়। আর সুবহে কাযিব (False Dawn) দেখা যায় ১৮ ডিগ্রিতে দৃশ্যমান সুবহে সাদিক বা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের আগে। কিন্তু মুসলিম উম্মাহ ও আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী সবার নিকট যা স্বীকৃত ও সুপ্রমাণিত আহসানুল ফাতাওয়াতে দাবি করা হয়েছে এর সম্পূর্ণ উল্টো। যার সপক্ষে তাতে সহীহ ও নির্ভরযোগ্য কোনো দলীল-প্রমাণ নেই। ১৮ ডিগ্রিতে সুবহে সাদিক না হওয়া; বরং তখন সুবহে কাযিব শুরু হওয়ার সপক্ষে আহসানুল ফাতাওয়াতে অনির্ভরযোগ্য ও ত্রুটিপূর্ণ অল্প কয়েকটি উদ্ধৃতি থাকলেও ১৮ ডিগ্রিতে দৃশ্যমান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সুবহে কাযিব হওয়ার সপক্ষে আহসানুল ফাতাওয়াতে একটি উদ্ধৃতিও নেই। তেমনি অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের আগ মুহূর্তে প্রকাশিত জোডিয়াকাল লাইট সুবহে কাযিব না হওয়ার সপক্ষেও তাতে একটি উদ্ধৃতিও নেই।
তবে জোডিয়াকাল লাইট সুবহে কাযিব না হওয়ার সপক্ষে তাতে কোনো দলীল-প্রমাণ না থাকলেও জোডিয়াকাল লাইট যে সুবহে কাযিব এ স্বীকৃত বিষয়টির উপর কয়েকটি অন্যায় আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে। আহসানুল ফাতাওয়াতে বলা হয়েছে-
مذكوره بالا روشنيوں ميں سے ايك روشنى زوڈيكل لائٹ کہلاتی ہے، اس سے متعلق جارج ايبل نے لکھا ہے كہ "اسے بعض اوقات صبح كاذب بھى کہا جاتا ہے"، مگر بوجوه ذيل اس روشنى كو اصطلاح شرع مىں صبح كاذب کہنا صحيح نہيں :
(১)يہ صبح صادق تك باقى نہيں رہتى۔
(২)يہ روشنى صبح صادق سے تين درجہ پہلے ظاہر ہونے كى بجائے بہت پہلے شروع ہوتى ہے، بلكہ تين درجہ سےبہت پہلے ختم ہو جاتى ہے۔
(৩)يہ روشنى سال بھر ميں صرف دو ماه تك نمودار ہوتى ہے۔
(আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৬০)
এখানে দাবি করা হয়েছে যে, কয়েকটি কারণে জোডিয়াকাল লাইটকে সুবহে কাযিব বলা সহীহ নয়-
১. এটি সুবহে সাদিক পর্যন্ত বাকি থাকে না।
২. এই আলো সুবহে সাদিকের তিন ডিগ্রি আগে প্রকাশ হয় না; বরং তিন ডিগ্রির অনেক আগে শুরু হয়ে তিন ডিগ্রির অনেক আগেই আবার নিঃশেষ হয়ে যায়।
৩. এই আলো বছরে কেবল দুই মাস দেখা যায়। (এসব কারণে এটি সুবহে কাযিব হতে পারে না।)
এ আপত্তিগুলোর কোনোটিই মূলত সঠিক নয়। এর প্রত্যেকটির জবাব সামনে তুলে ধরা হল।
জোডিয়াকাল লাইট কি কেবল দুই মাস দেখা যায়?
আহসানুল ফাতাওয়ার উক্ত বক্তব্যটির তিন নম্বরে বলা হয়েছে, জোডিয়াকাল লাইট পুরো বছরে কেবল দুই মাস দেখা যায়। অথচ এটি সুবহে কাযিব হলে পুরো বছরই দেখা যেত। যেহেতু এটি কেবল দুই মাস দেখা যায়; পুরো বছর দেখা যায় না, তাই এটি সুবহে কাযিব হতে পারে না। আহসানুল ফাতাওয়ার অন্যত্র এ বিষয়ে আরো বলা হয়েছে-
غرضيكہ زوڈيكل لائٹ كا اصطلاح شريعت سے كوئی تعلق نہیں، بلكہ قوس قزح كى طرح ايك انعكاسی روشنى ہے جو سال بھر ميں صرف دو ماه وسط اگست تا وسط اكتوبر ميں بعض مقامات پر نمودار ہوتى ہے۔
(আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৮০)
এখানে অতিরিক্ত আরো দাবি করা হয়েছে যে, জোডিয়াকাল লাইট বছরে কেবল দুই মাস দেখা যায়। তাও কেবল কোনো কোনো এলাকায়; সব জায়গায় নয়। আর দুই মাস হল, মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য অক্টোবর।
এটি আহসানুল ফাতাওয়ার আরেক বাস্তবতা বিরোধী দাবি, যার সপক্ষে আহসানুল ফাতাওয়াতে যেমনিভাবে কোনো দলীল-প্রমাণ দেওয়া হয়নি, শুধু একাধিকবার দাবিই করা হয়েছে, তেমনি কোনো জ্যোতির্বিজ্ঞানীও এমন কথা বলেননি। অ্যাস্ট্রোনমির কোনো বইয়ে বা কোনো জ্যোতির্বিজ্ঞানীর বক্তব্যে কোথাও এমন কথা পাবেন না যে, জোডিয়াকাল লাইট দুই মাস ছাড়া বাকি পুরো বছর দুনিয়ার কোথাও দেখা যায় না। বরং আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের নিকট জোডিয়াকাল লাইট একটি স্থায়ী বিষয়। বছরের প্রতিদিনই সন্ধ্যার টোয়াইলাটের পর এবং ভোরের টোয়াইলাইটের আগে এটি অস্তিত্বে আসে। এটি মূলত সূর্যেরই আলো। ইক্লিপটিক (সূর্যপথ)-এ বিদ্যমান interplanetary dust অর্থাৎ আন্তগ্রহ ধূলিকণায় প্রতিবিম্বিত হয়ে ইক্লিপটিক (সূর্যপথ) বরাবর আকাশে তা দৃশ্যমান হয়।
আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বক্তব্য অনুযায়ী ট্রপিক্স (tropics) তথা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল বা ক্রান্তি বলয়ের ভেতর অবস্থিত অঞ্চলগুলোতে জোডিয়াকাল লাইট সকাল-সন্ধ্যা উভয় বেলা সারা বছরই ভালোভাবে দেখা যায়। আর ট্রপিক্স বা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল হল, বিষুবরেখা (equator) থেকে ২৩.৫° উত্তর ও ২৩.৫° দক্ষিণ তথা কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তির ভেতর অবস্থিত অঞ্চল। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের নিকট এই অঞ্চলগুলোতে জোডিয়াকাল লাইট সারা বছরই ভালোভাবে দেখা যায়।
আর ট্রপিক্স থেকে উত্তর ও দক্ষিণে অবস্থিত temperate latitudes নাতিশীতল অক্ষাংশ অর্থাৎ কর্কটক্রান্তি (Tropic of Cancer) থেকে উত্তর এবং মকরক্রান্তি (Tropic of Capricorn) থেকে দক্ষিণে অবস্থিত অঞ্চলের ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য হল, জোডিয়াকাল লাইট সেখানে বছরে দুই মৌসুম-বসন্ত ও শরতে সবচেয়ে ভাল দেখা যায়। বসন্তকালে সন্ধ্যার পর এবং শরতে ভোর হওয়ার আগে। কেননা ঐ অঞ্চলগুলোতে ইক্লিপটিক এ দুই মৌসুমে দিগন্তের দিকে সর্বাধিক খাড়া থাকে।
এই temperate latitudes বা নাতিশীতল অক্ষাংশের ক্ষেত্রেও কোনো জ্যোতির্বিজ্ঞানী এভাবে বলেননি যে, সে অঞ্চলগুলোতে এ দুই মৌসুমের বাইরে জোডিয়াকাল লাইট একেবারে দেখাই যায় না। বরং এই অঞ্চলগুলোতে বাকি মৌসুমেও জোডিয়াকাল লাইট দেখা যাওয়া সম্ভব। অতএব জোডিয়াকাল লাইট বছরে কেবল দুই মাস দেখা যায়- একথা বলা সম্পূর্ণ বাস্তবতা বিরোধী।
এখানে দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় হল, আহসানুল ফাতাওয়াতে যে মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য অক্টোবরের কথা বলা হয়েছে- তাও যথাযথ নয়। temperate latitudes বা নাতিশীতল অক্ষাংশের ক্ষেত্রেও আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বক্তব্যে মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য অক্টোবরের কথা পাওয়া যায় না।
এ সংক্রান্ত আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কিছু বক্তব্য সামনে তুলে ধরা হল।
Encyclopedia of Astronomy and Astrophysics
Paul Murdin সম্পাদিত এনসাইক্লোপিডিয়া অব অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে উল্লেখ হয়েছে-
...it is visible at all times from the tropics. From temperate latitudes it is best seen about an hour and a half before sunrise in the fall or the same time after sunset in the spring, for at these times the ecliptic makes its greatest angle with the horizon.
অর্থাৎ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে জোডিয়াকাল লাইট সবসময়ই দেখা যায়। আর টেম্পারাট (নাতিশীতল) অক্ষাংশে এটি ভালোভাবে দেখা যায় শরতে সূর্যোদয়ের প্রায় দেড় ঘণ্টা আগে এবং বসন্তে সূর্যাস্তের একই সময় (প্রায় দেড় ঘণ্টা) পর।
দেখুন-
Encyclopedia of Astronomy and Astrophysics (Particle Physics and Astronomy Research Council, British National Space Centre).
The Penguin dictionary of astronomy
পেঙ্গুইন ডিকশনারী অব অ্যাস্ট্রোনমিতেও পুরো বিষয়টি উল্লেখ হয়েছে-
In the tropics, the Zodiacal Light may be seen throughout the year. In the middle latitudes, it is visible in the west at sunset during spring, and in the east before dawn in autumn, when the inclination of the ecliptic to the horizon is at maximum.
দেখুন-
The Penguin dictionary of astronomy, P. 237. Penguin books LTD 1966.
তাতে বলা হয়েছে, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে জোডিয়াকাল লাইট পুরো বছরজুড়েই দেখা যায়। আর মধ্য অক্ষাংশে (অর্থাৎ ট্রপিক থেকে উত্তর ও দক্ষিণের অঞ্চলে) এটি দেখা যায় বসন্তকালে সূর্যাস্তের পর পশ্চিমে এবং শরতে ভোর হওয়ার আগে পূর্ব দিকে। যখন ইক্লিপ্টিক দিগন্তের দিকে সর্বাধিক খাড়া থাকে।
Astronomy
Robert H. Baker ও Laurence W. Fredrick কর্তৃক রচিত Astronomy নামক বইটিতে এসেছেÑ
The faint triangular glow of the zodiacal light in the sky is best seen in middle northern latitudes in the west after nightfall in the spring and in the east before dawn in the autumn. In corresponding southern latitudes it is best seen after sunset in September and before sunrise in March. ...
Because the glow is almost symmetrical with respect to the ecliptic, it reaches a higher altitude and is easier to observe at those seasons when the ecliptic is most inclined to the horizon.
In the tropics, where the ecliptic is more nearly perpendicular to the horizon, the zodiacal light is visible throughout the year in both the evening and morning.
দেখুন-
Astronomy, Ninth Edition. p. 263. Published Van Nostrand Reinhold Company.
এখানেও সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপিত হয়েছে যে, জোডিয়াকাল লাইট মধ্য-উত্তর অক্ষাংশে বসন্তকালে সন্ধ্যার পর পশ্চিম দিকে এবং শরতে ভোর হওয়ার আগে পূর্ব দিকে ভালোভাবে দেখা যায়। তেমনি মধ্য-দক্ষিণ অক্ষাংশে এটি সেপ্টেম্বর মাসে সূর্যাস্তের পরে এবং মার্চ মাসে সূর্যোদয়ের আগে ভালোভাবে দেখা যায়। কারণ, জোডিয়াকাল লাইট ইক্লিপটিক বরাবর দৃশ্যমান হয়ে থাকে। আর ঐ অঞ্চলে এই মৌসুমগুলোতে ইক্লিপটিক দিগন্তের দিকে সর্বাধিক খাড়া থাকে। যার কারণে ঐ অঞ্চলগুলোতে এই মৌসুমে জোডিয়াকাল লাইট ভালোভাবে দেখা যায়। আর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে (tropics) ইক্লিপটিক যেহেতু দিগন্তের উপর খাড়াভাবেই থাকে, তাই এই অঞ্চলে জোডিয়াকাল লাইট সন্ধ্যা ও সকাল উভয় বেলা সারা বছরজুড়েই দেখা যাওয়া সম্ভব।
Philips Astronomy Encyclopedia
Sir Patrick Moore সম্পাদিত অ্যাস্ট্র্রোনমির এই এনসাইক্লোপিডিয়াটিতে
এসেছে-
it is best seen from temperate latitudes in the spring evening sky about 90 minutes after sunset, or in the autumn morning sky about 90 minutes before sunrise. At these times, the ecliptic is steeply inclined relative to the western or eastern horizon respectively. From lower latitudes –between the tropics and the equator– viewing conditions for the zodiacal light are favourable throughout the year.
দেখুন-
Philips Astronomy Encyclopedia. p.445
এখানেও স্পষ্টভাবে উল্লেখ হয়েছে, টেম্পারাট (নাতিশীতল) অক্ষাংশে এটি ভালোভাবে দেখা যায়- বসন্তে সন্ধ্যার আকাশে সূর্যাস্তের প্রায় ৯০ মিনিট পর, তেমনি শরতে ভোরের আকাশে সূর্যোদয়ের প্রায় ৯০ মিনিট আগে। আর নিম্নতর অক্ষাংশে (গ্রীষ্মমণ্ডল এবং নিরক্ষীয় অঞ্চলে) জোডিয়াকাল লাইট দেখার জন্য পরিস্থিতি সারা বছরই অনুকূল থাকে।
The Encyclopaedia Britannica
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় রয়েছে-
In the tropics, where the ecliptic is nearly perpendicular to the horizon, it may be seen after the end of twilight on every clear evening, and before twilight on every clear morning, unless blotted out by moon-light. ... At these hours the angle of the ecliptic with the horizon varies with the season. At the close of evening twilight the angle is greatest about three weeks before the vernal equinox. The months of February and March arc therefore best for theevening observations in the northern hemisphere, but the light can generally be seen from January until April. Similar favourable conditions prevail in the morning from September to November.
দেখুন-
The Encyclopaedia Britannica. vl. 28 p. 998 Eleventh Edition (1910–11).
এতেও আছে যে, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে জোডিয়াকাল লাইট প্রতিটি পরিষ্কার ভোরে ও প্রতিটি পরিষ্কার সন্ধ্যায় দেখা যায়। আর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের উত্তরে ভোর বেলা সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর- এ তিন মাসে এটি ভালো দেখা যায়।
Dictionary of Astronomy
John Daintith I William Gould সম্পাদিত অ্যাস্ট্রোনমির এই ডিকশনারিটিতে আরো স্পষ্ট ভাষায় এসেছে-
zodiacal light: A permanent phenomenon that can be seen as a faint glow, especially at tropical latitudes, on a clear moonless night in the west after sunset and in the east before sunrise.
দেখুন-
Dictionary of Astronomy. p.532. Edited by John Daintith, William Gould (The Facts On File Science Library New York. Fifth Edition)
তাতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, জোডিয়াকাল লাইট একটি স্থায়ী বিষয়, যা সূর্যাস্তের পরে পশ্চিমে এবং সূর্যোদয়ের আগে পূর্ব দিকে একটি পরিষ্কার চাঁদহীন রাতে, বিশেষত গ্রীষ্মীয় অক্ষাংশে (at tropical latitudes) একটি ম্লান আলোক হিসাবে দেখা যায়।
The Macmillan dictionary of astronomy
Valerie Illingworth সম্পাদিত অ্যাস্ট্রোনমির এই ডিকশনারিটিতেও একই কথা এসেছে। তাতেও উল্লেখ হয়েছে, জোডিয়াকাল লাইট একটি স্থায়ী বিষয়-
zodiacal light A permanent phenomenon that can be seen as a faint glow, especially at tropical latitudes, on a clear moonless night in the west after sunset and in the east before sunrise.
দেখুন-
The Macmillan dictionary of astronomy. p.424. Valerie Illingworth (Editor). 2nd edition (1985) Market House Books Ltd
Skylab’s Astronomy and Space Sciences
আমেরিকান মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসা (NASA)-এর সাইন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিকাল ইনফরমেশন ব্রাঞ্চ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত এই বইটিতে আছে-
the zodiacal light is best seen when the ecliptic plane is approximately perpen dicular to the horizon. In the Northern Hemisphere, the best times to view the zodiacal light are on clear, moon less nights after twilight in February and March and before dawn in September and October. In equatorial regions it is visible throughout the year.
দেখুন-
Skylab’s Astronomy and Space Sciences. p 35. Scientific and Technical Information Branch: National Aeronautics and Space Administration (NASA). Washington, D. C. 1979
বইটিতে উল্লেখ হয়েছে, উত্তর গোলার্ধে জোডিয়াকাল লাইট দেখার সবচেয়ে ভালো সময় ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে টোয়াইলাইট শেষ হওয়ার পর পরিষ্কার ও চাঁদহীন রাতে এবং সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে উধহি তথা ভোর হওয়ার আগে। আর নিরক্ষীয় অঞ্চলে এটি সারা বছর জুড়েই দৃশ্যমান থাকে।
A Skywatcher's Year
ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ঔবভভ কধহরঢ়ব রচিত এ বইটিতেও বিষয়টি পুরোপুরি উপস্থাপিত হয়েছে-
In the middle to tropical latitudes in the Northern Hemisphere, it is best seen in the west after nightfall in the spring, and in the east before dawn in the autumn. (In the Southern Hemisphere, that would correspond to 'in the west after nightfall in the southern autumn and in the east before dawn in the southern spring.)
In the tropics, where the ecliptic is more nearly perpendicular to the horizon, the zodiacal light is visible throughout the year in both the evening and the morning sky.
দেখুন-
A Skywatcher's Year. pp.36-37. By Jeff Kanipe. Cambridge University Press, First published 1999.
এখানে উল্লেখ হয়েছে যে, উত্তর গোলার্ধের মাঝামাঝি থেকে গ্রীষ্মীয় অক্ষাংশ পর্যন্ত এটি সবচেয়ে ভালো দেখা যায়- বসন্তে রাত শুরু হওয়ার পরই পশ্চিম দিকে এবং শরতে ভোর হওয়ার আগ মুহূর্তে পূর্ব দিকে। আর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে জোডিয়াকাল লাইট সন্ধ্যা ও সকালের আকাশ উভয় ক্ষেত্রেই সারা বছরই দেখা যায়।
Lights in the Sky
আন্তর্জাতিক প্রকাশনা কোম্পানী স্প্রিঙ্গার থেকে প্রকাশিত এই বইটিতেও আছে-
if you live in the tropics, always make an attempt to see it all year round just before dawn to make this another dawn glow.
দেখুন-
Lights in the Sky (Identifying and Understanding Astronomical and Meteorological Phenomena) pp.50. By Michael Maunder. Springer-Verlag London Limited 2007.
অর্থাৎ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে জোডিয়াকাল লাইট পুরো বছরই দেখা যায় উধহি তথা ভোরের ঠিক আগ মুহূর্তে।
The Astronomical Almanac
ইউএস নেভাল অবজারভেটরির ‘নটিক্যাল আলমানাক অফিস’ ও ব্রিটিশ রয়্যাল গ্রিনিচ অবজারভেটরির ‘এইচএম নটিক্যাল আলমানাক অফিস’ কর্তৃক যৌথভাবে প্রকাশিত বর্ষপঞ্জিমূলক এই বইটিতে আছে-
Zodiacal Light: a nebulous light seen in the east before twilight and in the west after twilight. It is triangular in shape along the ecliptic with the base on the horizon and its apex at varying altitudes. It is best seen in middle latitudes (see latitude, terrestrial) on spring evenings and autumn mornings.
দেখুন-
The Astronomical Almanac for the Year 2004 and Its Companion the Astronomical Almanac Online: Data for Astronomy, Space Sciences, Geodesy, Surveying, Navigation and Other Applications, p.m13. Issued by the Nautical Almanac Office: United States Naval Observatory & Her Majesty's Nautical Almanac Office.
এখানেও উল্লেখ হয়েছে যে, ত্রিভুজাকার এই আলো মধ্য অক্ষাংশে ভালভাবে দেখা যায় বসন্তের সন্ধ্যায় এবং শরতের সকালে।
Introduction to Astronomy
আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী, মিশিগান ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রফেসর Dean B. Mclaughlin (১৯০১-১৯৬৫ ঈ.) বলেন-
Because of the angle the ecliptic makes with the horizon, the zodiacal light is best seen in middle northern latitudes on early spring evenings or autumn mornings. The very best views of it are obtained in the tropics, preferably from a darkened ship in mid ocean, when it is a spectacular sight.
দেখুন-
Introduction to Astronomy, p. 217; by Dean B. Mclaughlin, The University of Michigan (Houghton Mifflin Company 1961)
অর্থাৎ উত্তর মধ্য অক্ষাংশে এটি ভালোভাবে দেখা যায়- সন্ধ্যায় বসন্তকালে এবং ভোরবেলা শরতে। আর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে (tropics) এটি সবচে ভাল দেখা যায়।
Oxford Dictionary of Astronomy
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত অ্যাস্ট্রোনমির এই ডিকশনারিটিতে আছে-
From temperate latitudes, the zodiacal light is best seen on spring evenings about 90 min after sunset, or in the autumn about 90 min before sunrise.
দেখুন-
Oxford Dictionary of Astronomy. p.522. Oxford University Press 1997.
এটিতে বলা হয়েছে যে, টেম্পারাট (নাতিশীতল) অক্ষাংশে এটি ভালোভাবে দেখা যায়- বসন্তে সন্ধ্যার আকাশে সূর্যাস্তের প্রায় ৯০ মিনিট পর, তেমনি শরতে ভোরের আকাশে সূর্যোদয়ের প্রায় ৯০ মিনিট আগে।
***
এ কয়টি উদ্ধৃতিই এখানে তুলে ধরা হল। এ থেকে স্পষ্ট যে, এ দাবিটি সম্পূর্ণ বাস্তবতা বিরোধী। জোডিয়াকাল লাইট বছরে কেবল দুই মাস দেখা যায়, তাও কেবল কোনো কোনো এলাকায়; আর দু’মাস হল মধ্য আগস্ট থেকে থেকে মধ্য অক্টোবর- এ কথাগুলোর কোনোটিরই প্রমাণ নেই।
সুবহে সাদিকের আগ মুহূর্তে আকাশ কি অন্ধকার থাকে না?
জোডিয়াকাল লাইট সুবহে কাযিব হওয়ার উপর আহসানুল ফাতাওয়ার আরেকটি আপত্তি হল-
يہ صبح صادق تك باقى نہیں رہتى۔
অর্থাৎ এটি সুবহে সাদিক পর্যন্ত বাকি থাকে না। (অতএব জোডিয়াকাল লাইট সুবহে কাযিব হতে পারে না।)
আহসানুল ফাতাওয়ার আরেক জায়গায় বলা হয়েছে-
ان اوقات ميں ايك وقت اسٹرونوميكل ٹوائيلايٹ کہلاتا ہے، اس وقت آفتاب افق سے اٹھاره درجہ نيچے ہوتا ہے، قديم وجديد ماہرين فلكيات اس پر متفق ہے كہ اسوقت سے قبل مكمل اندھيرا ہوتا ہے .. اس كے بعد متصل صبح كاذب شروع ہوتى ہے۔
(আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৬২)
এখানে বলা হয়েছে, প্রাচীন ও নতুন সব জ্যোতির্বিজ্ঞানী এব্যাপারে একমত যে, অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের আগে সম্পূর্ণ অন্ধকার থাকে। ...যার পর থেকে সুবহে কাযিব শুরু হয়।
এ কথাটিই আহসানুল ফাতাওয়ার আরেক জায়গায় এভাবে বলা হয়েছে-
مغربى ممالك كو صبح صادق سے كوئی سروكار نہ تھا ، لہذا انہوں نے بھی مكمل اندھيرے ميں ظاہر ہونے والى روشنى كى پہلی كرن (صبح كاذب) كے نقشے تيار كئے۔
অর্থাৎ পশ্চিমাদের ‘সুবহে সাদিক’-এর প্রয়োজন নেই। তাই তারা পরিপূর্ণ অন্ধকারে প্রকাশিত প্রথম আলোকরশ্মি (সুবহে কাযিব)-এর নকশা তৈরি করেছে। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৮৪)
আহসানুল ফাতাওয়ার এ বক্তব্যগুলোর খুলাসা এই যে, কোনো আলোকে সুবহে কাযিব তখনই বলা যাবে, যদি এটি সুবহে সাদিক পর্যন্ত দৃশ্যমান থাকে। সুবহে সাদিক পর্যন্ত যদি এটি দেখা না যায়; বরং এর আগেই নিঃশেষ হয়ে যায় তাহলে এটি সুবহে কাযিব হতে পারে না। অতএব জোডিয়াকাল লাইট যেহেতু সুবহে সাদিক পর্যন্ত বাকি থাকে না তাই এটি সুবহে কাযিব হতে পারে না। আর তাঁর ধারণা মতে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটই যেহেতু পরিপূর্ণ অন্ধকারে প্রকাশিত প্রথম আলোকরশ্মি তাই এটিই সুবহে কাযিব।
আহসানুল ফাতাওয়াতে একথাটিই বারবার বিভিন্ন জায়গায় জোরদার ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর দ্বারাই সাব্যস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, জোডিয়াকাল লাইট সুবহে কাযিব নয়; রবং অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটই সুবহে কাযিব। এ দাবির পক্ষে তাতে এ ছাড়া আর কোনো কিছু নেই।
এখন একটু ভেবে দেখুন, এখানে কীভাবে সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিবের পরিচয় এবং উভয়টি নির্ণয়ের মানদণ্ডই পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে! ভোরে দিগন্তের উপর দিকে লম্বালম্বি আকারে যদি কোনো আলো দেখা যায়, কিন্তু তা যদি সুবহে সাদিকের আগে নিঃশেষ হয়ে এরপর আকাশ অন্ধকার হয়ে যায় তবে এটি সুবহে কাযিব হতে পারে না! পক্ষান্তরে ভোর বেলা দিগন্তের উভয় দিকে প্রশস্ত আকারে কোনো আলো দেখা গেলেও যদি এই আলো দৃশ্যমান হওয়ার আগে আকাশ অন্ধকার থাকে তবে তা সুবহে সাদিক হতে পারে না; বরং সুবহে কাযিব হবে! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন!!
কুরআন-সুন্নাহ ও ফিকহ-ফতোয়ার কিতাবে কোথায় এ কথা আছে যে, সুবহে কাযিব সুবহে সাদিক পর্যন্ত বাকি থাকতে হবে? যদি এটি সুবহে সাদিকের আগে বিলীন হয়ে যায় তবে তা সুবহে কাযিব হবে না? পক্ষান্তরে সুবহে সাদিকের আগে যদি আকাশ অন্ধকার থাকে তবে এটি সুবহে সাদিক হবে না; বরং সুবহে কাযিব হবে? কেউ যদি দিগন্তের উভয় দিকে প্রশস্ত আলো দেখতে পায়, কিন্তু এর পূর্বে আকাশে কোনো আলো না দেখে তবে কি এটি সুবহে সাদিক হবে না? এমনকি সুবহে সাদিকের আগে প্রতিদিন সব জায়গায় সুবহে কাযিব দেখা যেতে হবে- এ কথাই বা কোথায় আছে?
এটি তো বরং শরীয়তের উসূল পরিবর্তনের শামীল। সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিবের পরিচয় এবং উভয়টি নির্ণয়ের মানদণ্ড হাদীস ও ফিকহে সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দেওয়া হয়েছে। সুবহে কাযিব হল রাতের শেষ অংশে দিগন্তের উপর দিকে লম্বালম্বিভাবে প্রকাশিত আলো। আর সুবহে সাদিক হল দিগন্তের উভয় দিকে প্রশস্ত আকারে দৃশ্যমান ভোরের আলো। শরীয়তে সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিব নির্ণয়ের একমাত্র মানদণ্ড এটিই।
এখন কেউ যদি ভোরের সময় দিগন্তের উভয় দিকে প্রশস্ত আকারে কোনো আলো দেখে, কিন্তু এর পূর্বে আকাশে কোনো আলো না দেখে, এমনকি সুবহে কাযিবও দেখতে না পায় তবুও এটি সুবহে সাদিকই। এক্ষেত্রে কারো একথা বলার অবকাশ নেই যে, যেহেতু ভোরের সময় এই আলোটিই প্রথম দেখা গেছে; এর আগে আকাশ অন্ধকার ছিল তাই এটি সুবহে কাযিব হবে; সুবহে সাদিক হবে না। পক্ষান্তরে ভোরের আগ মুহূর্তে কেউ যদি আকাশে উপরের দিকে লম্বালম্বি আকারে কোনো আলো দেখতে পায় কিন্তু এই আলো সুবহে সাদিক হওয়ার আগে বিলীন হয়ে যায় তবে এ কারণেও এই আলোকে সুবহে কাযিব না বলার কোনো সুযোগ নেই। বরং সুবহে সাদিকের আগে আকাশে উপরের দিকে লম্বালম্বি আকারে যে আলো দেখা যাবে হাদীসের বক্তব্য অনুযায়ী এটিই সুবহে কাযিব। চাই এটি সুবহে সাদিক পর্যন্ত বাকি থাকুক বা এর আগে বিলীন হয়ে যাক।
হাদীস ও ফিকহে বর্ণিত কেবল এই মানদণ্ডের ভিত্তিতেই যেমন নির্ধারণ হবে, ভোরের কোন্ আলো সুবহে সাদিক আর কোনটি সুবহে কাযিব, ঠিক এই মানদণ্ডেই নির্ণয় করা হবে, জোডিয়াকাল লাইট ও অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের কোন্টি সুবহে সাদিক এবং কোনটি সুবহে কাযিব। আর হাদীস ও ফিকহে বর্ণিত এই মানদণ্ডের ভিত্তিতেই ইতিপূর্বে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অসংখ্য সুস্পষ্ট উদ্ধৃতির মাধ্যমে প্রমাণ করা হয়েছে যে, জোডিয়াকাল লাইট ভোরে দিগন্তের উপর দিকে লম্বালম্বি আকারে দৃশ্যমান আলো। তাই এটি সুবহে কাযিব। আর অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট ভোর বেলা দিগন্তের উভয় দিকে প্রশস্ত আকারে প্রকাশিত আলো। তাই এটি সুবহে সাদিক। এতদসত্ত্বেও জোডিয়াকাল লাইট সুবহে সাদিক পর্যন্ত বাকি থাকে না এবং অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের আগে আকাশ অন্ধকার থাকে- এ অজুহাত দাঁড় করিয়ে জোডিয়াকাল লাইট সুবহে কাযিব না হওয়ার দাবি করা এবং অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটকে সুবহে কাযিব আখ্যা দেওয়া- শরীয়তের উসূল ও মূলনীতি পরিবর্তন ছাড়া আর কী হতে পারে?!
মোটকথা, সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিবের পরিচয় এবং উভয়টি নির্ণয়ের মানদণ্ড একটি স্বীকৃত বিষয়। কিন্তু সুবহে কাযিব কি সুবহে সাদিক পর্যন্ত বাকি থাকে, না তা সুবহে সাদিকের আগে বিলীন হয়ে যায়? অর্থাৎ সুবহে সাদিকের আগে আকাশ অন্ধকার থাকে কি থাকে না- এটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। শরীয়ত এটিকে সুবহে সাদিক-সুবহে কাযিব কোনোটিই নির্ণয়ের মানদণ্ড বানায়নি।
আহসানুল ফাতাওয়ার ১৫°-এ সুবহে সাদিকের বক্তব্যের উপর যখন প্রশ্ন এসেছে যে- তখন দিগন্ত খুব বেশি আলোকিত হয়ে যায়; যার দ্বারা বোঝা যায়, সুবহে সাদিক মূলত এর আরো আগেই হয়ে যায়। তখন তিনি নিজেই এ বলে এর জবাব দিয়েছেন যে, আলো বেশি হওয়া আর কম হওয়ার উপর শরীয়ত সুবহে সাদিকের ভিত্তি রাখেনি। বরং শরীয়তের দৃষ্টিতে সুবহে সাদিকের ভিত্তি হল, আলোটির প্রশস্ততা বেশি, নাকি এর দৈর্ঘ বেশি- এর উপর। প্রশস্ততা থেকে যদি দৈর্ঘ বেশি হয় তবে এটি সুবহে কাযিব। আর দৈর্ঘ থেকে প্রশস্ততা বেশি হলে এটি সুবহে সাদিক। শরীয়তের দৃষ্টিতে সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিব নির্ণয়ের ভিত্তি ও মাণদণ্ড এটি ছাড়া আর কিছু নয়। অতএব তখন আলোর পরিমাণ বেশি হয়ে গেল, না কম তাতে কিছু যায় আসে না। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৬১)
আহসানুল ফাতাওয়ার ১৫°-এ সুবহে সাদিকের বক্তব্যের উপর উত্থাপিত এ প্রশ্নের যে জবাব তাতে দেওয়া হয়েছে, ১৮° সুবহে সাদিকের উপর আহসানুল ফাতাওয়ার পক্ষ থেকে উত্থাপিত এ আপত্তিটিরও ঠিক একই জবাব।
এ তো গেল আহসানুল ফাতাওয়ার পক্ষ থেকে উত্থাপিত এই আপত্তির ব্যাপারে মৌলিক কথা।
দ্বিতীয়ত সুবহে সাদিকের আগে আকাশ অন্ধকার থাকে না- তাঁর এই দাবিটিই তো ফুকাহায়ে কেরামের বক্তব্য পরিপন্থী। ফকীহগণ বলেছেন, সুবহে সাদিকের আগে আকাশ অন্ধকার থাকে। অর্থাৎ সুবহে কাযিব দৃশ্যমান হওয়ার পর তা একসময় সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে আকাশ অন্ধকার হয়ে যায়। এর পর সুবহে সাদিক প্রকাশিত হয়। অতএব তাদের বক্তব্য অনুযায়ী সুবহে কাযিব সুবহে সাদিক পর্যন্ত বাকি থাকে- এ দাবিটিই ভুল।
আর শুধু ফকীহগণই নন মুফাসসির ও হাদীসের ব্যাখ্যাকারগণও বিষয়টি সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন।
প্রখ্যাত হানাফী ফকীহ ইমাম শামসুল আইম্মা সারাখসী রাহ. [৪৮৩ হি.] বলেন-
والفجر فجران: كاذب تسميه العرب ذنب السرحان، وهو البياض الذي يبدو في السماء طولا ويعقبه ظلام.
(আলমাবসূত, সারাখসী ১/১৪১)
অর্থাৎ সুবহে কাযিব হল, আকাশের দৈর্ঘ্যে লম্বালম্বিভাবে প্রকাশিত আলো। যার পর আকাশ আবার অন্ধকার হয়ে যায়।
ইমাম আলাউদ্দীন কাসানী রাহ. [৫৮৭ হি.] বলেন-
والتقييد بالفجر الثاني لأن الفجر الأول هو البياض المستطيل يبدو في ناحية من السماء، وهو المسمى ذنب السرحان عند العرب ثم ينكتم، ولهذا يسمى فجرا كاذبا؛ لأنه يبدو نوره ثم يخلف ويعقبه الظلام،... والفجر الثاني وهو المستطير المعترض في الأفق لا يزال يزداد نوره حتى تطلع الشمس. ...ولأن المستطيل ليل في الحقيقة لتعقب الظلام إياه.
(বাদায়েউস সানায়ে ১/১২২)
হেদায়া গ্রন্থাকার ইমাম মারগিনানী রাহ. [৫৯৩ হি.] বলেন-
ولا معتبر بالفجر الكاذب وهو البياض الذي يبدو طولا ثم يعقبه الظلام.
(আলহেদায়া ১/৪০)
এভাবে ফিকহে হানাফীর প্রায় সব কিতাবেই একথা উল্লেখ হয়েছে যে, সুবহে কাযিব প্রকাশ হওয়ার পর একসময় তা সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে আকাশ অন্ধকার হয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর সুবহে সাদিক প্রকাশিত হয়। নি¤েœ ফিকহে হানাফীর আরো কয়েকটি কিতাবের খণ্ড-পৃষ্ঠা উল্লেখ করা হল-
তুহফাতুল ফুকাহা, আলাউদ্দীন সামারকান্দী [৫৪২ হি.] ১/৯৯; ফাতাওয়া খানিয়া, কাযীখান [৫৯২ হি.] ১/৭২; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/৬৬; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া, ইলইনদারপাতী [৭৮৬ হি.] ২/৪; আলইখতিয়ার লিতা‘লীলিল মুখতার, মাওসিলী [৬৮৩ হি.] ১/৩৮; তাবয়ীনুল হাকায়েক, যাইলায়ী [৭৪৩ হি.] ১/৭৯; আলবেনায়া, বদরুদ্দীন আইনী [৮৫৫ হি.] ২/১৪; হালবাতুল মুজাল্লী, ইবনে আমীরে হাজ্জ [৮৭৯ হি.] ১/৬২৫; আলবাহরুর রায়েক, ইবনে নুজাইম [৯৭০ হি.] ১/২৫৭; ফাতহু বাবিল ইনায়া, মোল্লা আলী আলকারী [১০১৪ হি.] ১/১৮১; রদ্দুল মুহতার, ইবনে আবেদীন শামী [১২৫২ হি.] ১/৩৬৯
খোদ আবদুল আলী বিরজান্দী রাহ., আহসানুল ফাতাওয়াতে যার বক্তব্য থেকেই ১৫° সুবহে সাদিকের কথা গ্রহণ করা হয়েছে, তিনিও একথাই বলেছেন যে, সুবহে কাযিবের পর আকাশ পুরো অন্ধকার হয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর সুবহে সাদিক দেখা যায়। মুখতাসারুল বেকায়া (আননুকায়া)-এর ব্যাখ্যাগ্রন্থে তিনি বলেছেন-
فهذا النور الظاهر فوق الأفق يسمى الصبح الأول والصبح الكاذب، كأن ما يعقبه من الظلمة يكذبه، والفجر المستطيل، ثم إذا صارت الشمس أقرب انبسط النور وصار الأفق منيرا وهو الصبح الصادق.
(শরহু মুখতাসারিল বেকায়া, বিরজান্দী, মাখতূত : মাকতাবা নূর উসমানিয়া, তুরস্ক, মাখতূত নং ১৬৫৯, পাতা ২৯)
আর শুধু হানাফী ফকীহগণই নন, অন্যান্য মাযহাবের ফকীহগণও একই কথা বলে গেছেন। বলতে গেলে এ ব্যাপারে সব মাযহাবের ফকীহগণের ইজমা।
শাফেয়ী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফকীহ ইমাম নববী রাহ. [৬৭৬ হি.] বলেন-
فالفجر الأول يطلع مستطيلا نحو السماء كذنب السرحان وهو الذئب ثم يغيب ذلك ساعة ثم يطلع الفجر الثاني الصادق مستطيرا بالراء أي منتشرا عرضا في الأفق.
(আলমাজমূ শরহুল মুহাযযাব, নববী ৩/৪৪)
আরো দেখুন-
নেহায়াতুল মাতলাব, ইমামুল হারামাইন [৪৭৮ হি.] ২/২২; বাহরুল মাযহাব, রুয়ানী [৫০২ হি.] ১/৩৮৭; আলওয়াসীত ফিল মাযহাব, ইমাম গাযালী [৫০৫ হি.] ২/১৯; আলআযীয শরহুল ওয়াজীয, আবদুল কাদির রাফেয়ী [৬২৩ হি.] ১/৩৭৩; আসনাল মাতালিব, যাকারিয়া আলআনসারী [৬৯২ হি.] ১/১১৭; ফাতাওয়া ইবনুস সালাহ [৬৪৩ হি.] ১/২৪৭; উজালাতুল মুহতাজ ১/১৬৩; আলগায়াহ ফিখতিসারিন নেহায়াহ ২/১১
মালেকী ফকীহ আহমাদ দরদের রাহ. বলেন-
ثم يظهر بعده ظلام ثم يظهر الفجر الحقيقي.
(আশশারহুল কাবীর ২/১)
আরো দেখুন-
আযযাখীরা, ইমাম কারাফী [৬৮৪ হি.] ২/১৯; মিনাহুল জালীল ১/১৮২; আলফাওয়াকিহুদ দানী ১/১৬৫; হাশিয়াতুল আদাবী আলা কেফায়াতিত তালিব ১/২৪২; আসহালুল মাদারিক ১/১৫৩
হাম্বলী ফকীহ শামসুদ্দীন যারকাশী রাহ. [৭৭২ হি.] বলেন-
والفجر الأول هو الفجر المستطيل، الذي يبدو معترضا كذنب السرحان، ثم تعقبه الظلمة، ومن ثم سمي الفجر الكاذب.
(শরহুয যারকাশী আলা মুখতাসারিল খিরাকী ১/৪৮০)
আরো দেখুন-
আলফুরু‘, ইবনুল মুফলিহ [৭৬৯ হি.] ১/৪৩৩; আলমুবদি ১/৩০৬; শরহু মুনতাহাল ইরাদাত ১/১৪৩; কাশশাফুল কিনা‘ ১/২৫৫; শরহুল উমদা, ইবনে তাইমিয়া, পৃ. ১৮৩
এ তো গেল চার মাযহাবের ফকীহগণের বক্তব্য। তাফসীরুল কুরআনের গ্রন্থগুলোতেও একই কথা উল্লেখ হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন-
وَ كُلُوْا وَ اشْرَبُوْا حَتّٰی یَتَبَیَّنَ لَكُمُ الْخَیْطُ الْاَبْیَضُ مِنَ الْخَیْطِ الْاَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ.
আর তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ না কাল রেখা থেকে ফজরের সাদা রেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রতিভাত হয়। -সূরা বাকারা (২) ১৮৭
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنّمَا ذَلِكَ سَوَادُ اللّيْلِ وَبَيَاضُ النّهَارِ.
অর্থাৎ উক্ত আয়াতে কাল রেখা ও সাদা রেখা দ্বারা উদ্দেশ্য হল, রাতের অন্ধকার ও দিনের শুভ্রতা। (সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯১৬)
আরেক বর্ণনায় এসেছে, আদি ইবনে হাকিম রা. বলেন, যখন-
وَ كُلُوْا وَ اشْرَبُوْا حَتّٰی یَتَبَیَّنَ لَكُمُ الْخَیْطُ الْاَبْیَضُ مِنَ الْخَیْطِ الْاَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ.
-এ আয়াত নাযিল হয় তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنّمَا ذَلِكَ بَيَاضُ النّهَارِ مِنْ سَوَادِ اللّيْلِ.
অর্থাৎ কাল রেখা থেকে সাদা রেখা প্রকাশ হওয়ার অর্থ হল, রাতের অন্ধকার থেকে দিনের শুভ্রতা প্রকাশ হওয়া। (জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯৭০)
এই আয়াত ও এর ব্যাখ্যায় বর্ণিত হাদীসগুলো থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, ফজরের সাদা রেখা তথা সুবহে সাদিক প্রকাশিত হয় রাতের অন্ধকার থেকে।
আর মুফাসসিরগণ বিষয়টি আরো স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন -
আবুল মুযাফ্ফার সামআনী রাহ. [৪৮৯ হি.] পূর্বোক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেন-
أحدهما فجر مستطيل كذنب السرحان، يطلع صاعدا، ثم يغيب، ويغلب الظلام، وهو الفجر الكاذب. والثاني بعده: فجر مستطير، ينتشر في الأفق سريعا.
(তাফসীরুল কুরআন, সামআনী ১/১৮৯)
আরো দেখুন-
মাআলিমুত তানযীল, বাগাবী রাহ. [৫১০ হি.] ১/২৩১; মাফাতীহুল গায়েব, ফখরুদ্দীন রাযী রাহ. [৬০৬ হি.] ১৩/৭৫; নযমুদ দুরার, বুরহানুদ্দীন আলবিকায়ী রাহ. [৮৫৫ হি.] ৭/২০০; তাফসীরে খাযিন ১/১১৭
হাদীসের ব্যাখ্যাগ্রন্থগুলোতেও বিষয়টি এভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে। দেখুন-
ফয়যুল কাদীর, মুনাভী ৪/৪৬২; মিনহাতুল বারী শরহু সাহীহিল বুখারী ২/৩৩৯; আততাওযীহ লিশারহিল জামিইস সাহীহ ৬/২৫৩; শরহু সুনানি আবী দাউদ, ইবনে রাসলান ৩/১০২; আসসিরাজুল মুনীর আযীযি ৩/৩৯৩; মিরকাতুল মাফাতীহ ২/১৭৫; মিরআতুল মাফাতীহ ২/৩৮৩
মুসলিম ফালাকীগণের বক্তব্যও এরকমই। তারাও বলেছেন, সুবহে কাযিব একসময় বিলীন হয়ে যায়। এরপর সুবহে সাদিক শুরু হয়।
জগদ্বিখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনে শাতির রাহ. (৭০৪-৭৭৭ হি./১৩০৪-১৩৭৫ ঈ.)। জ্যোতির্বিজ্ঞানে যার আবিষ্কার অনেক। তিনি একাধারে অনেক বছর সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিব পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি বলেছেন-
الباب السابع والسبعون من المائة الثانية في معرفة وقت الصبح: ويدخل وقتها بطلوع الفجر الصادق المعترض ضوؤه دون الفجر الكاذب الذي ضوؤه مستطيلًا، ثم ينمحي أثره.
‘দুইশ সাতাত্তর নম্বর অধ্যায়, সুবহের ওয়াক্ত সম্পর্কে : এর সময় শুরু হয় সুবহে সাদিক উদয়ের দ্বারা, যার আলো ডানে-বামে প্রশস্ত থাকে। সুবহে কাযিবের সময় থেকে নয়, যার আলো উপরের দিকে লম্বা হয়, অতঃপর তা বিলুপ্ত হয়ে যায়।’
দেখুন-
النفع العام في العمل بالربع التام ص ২৪৭، مطبعة دار الكتب والوثائق القومية، تحقيق ودراسة: أسامة فتحي إمام.
তার এ বক্তব্য থেকেও স্পষ্ট যে, সুবহে সাদিক শুরু হওয়ার আগে সুবহে কাযিবের আলো বিলুপ্ত হয়ে যায়। এরপর সুবহে সাদিক শুরু হয়।
আর কোনো কোনো বিজ্ঞানী তো বলেছেন, সুবহে কাযিব যখন দৃশ্যমান থাকে তখনই দিগন্ত অন্ধকার থাকে।
যেমন, সপ্তম হিজরী শতাব্দীর জগদ্বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী নাসীরুদ্দীন তূসী [৫৯৭-৬৭২ হি./১২০১-১২৭৪ঈ.]। সুবহে কাযিব সম্পর্কে তিনি বলেছেন-
فإذن أول ما يرى نور الشمس يرى فوق الأفق الخط المستقيم منطبق على الطبع المذكور، ويكون ما يقرب من الأفق بعد مظلما، فلذلك يسمى ذلك النور بالصبح الأول والصبح الكاذب. أما تسميته بالأول فظاهر، وأما تسميته بالكاذب فلكون الأفق مظلما أي لو كان يصدق أنه نور الشمس لكان المنير وما يلي الشمس دون ما يبعد منه.
দেখুন-
التذكرة في الهيئة، مخطوط المكتبة البريطانية، الرقم:২৩৩৯৪، ق ৪৯.
এখানে তিনি বলেছেন, সুবহে কাযিব যখন দেখা যায় তখনই দিগন্ত অন্ধকার থাকে। কেননা সুবহে কাযিবের আলো দ্বারা দিগন্ত ও তার কাছাকাছি অংশ আলোকিত হয় না। বরং এর আলো এর থেকে আরো উপরে দৃশ্যমান হয়ে থাকে। এজন্যই এটিকে সুবহে কাযিব বলা হয়।
ফালাকিয়াতের প্রসিদ্ধ কিতাব কাযী যাদাহ [৮৪০ হি.]কৃত শরহে চিগমিনী। তাতেও আছে যে, দিগন্ত তখন অন্ধকার থাকে। এর অনেক্ষণ পর সুবহে সাদিক প্রকাশিত হয়। তাতে আছে-
فالبياض المستطيل المستدق الظاهر فوق الأفق أولا يسمى بالصبح الكاذب، كأن كون الأفق بعد مظلما يكذب كونه نور الشمس. والمستطير المستنبط في الأفق بعده بزمان يسمى بالصبح الصادق.
দেখুন-
شرح ملخص الجغميني في الهيئة، مخطوط مكتبة قطر الوطنية، الرقم: ৯৫৪৫، الورق ৭৮.
মোটকথা, সুবহে কাযিব সুবহে সাদিক পর্যন্ত বাকি থাকে এবং সুবহে সাদিকের আগে আকাশ অন্ধকার থাকে না- এ উভয় কথাই সকল মাযহাবের ফুকাহায়ে কেরাম, মুফাসসিরীনে কেরাম ও হাদীস ব্যাখ্যাকারগণের সুস্পষ্ট বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত।
অতএব শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিব নির্ণয়ের মানদণ্ডকে উপেক্ষা করে যে অজুহাতের উপর ভিত্তি করে তিনি জোডিয়াকাল লাইটকে সুবহে কাযিব নয় বলেছেন এবং অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটকে সুবহে কাযিব আখ্যা দিয়েছেন ফোকাহায়ে কেরাম ও উলামায়ে উম্মতের এসব বক্তব্যের আলোকে সে ভিত্তিই গলত সাব্যস্ত হল। আর আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের আলোকে তাঁর মূল বক্তব্যটাই যে অমূলক, তা তো আগেই স্পষ্ট করা হয়েছে।
মোটকথা, হাদীস শরীফ, তাফসীরুল কুরআন, শুরুহুল হাদীস ও ফিকহ-ফতোয়ার কিতাবসমূহে সুবহে কাযিবের যে পরিচয় বর্ণিত হয়েছে, জোডিয়াকাল লাইটের সাথে এর অমিল নেই। তেমনি এ কিতাবগুলোতে সুবহে সাদিকের যে পরিচয় উল্লেখিত হয়েছে, অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের সাথেও এর কোনোরকম অসামঞ্জস্য নেই।
তাই অমূলক অজুহাত দাঁড় করিয়ে জোডিয়াকাল লাইটকে সুবহে কাযিব নয় বলা এবং অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটকে সুবহে কাযিব বানিয়ে দেওয়া বিকৃতির শামিল।
***
আহসানুল ফাতাওয়ার অন্যত্র বলা হয়েছে-
خوب سمجھ ليں كہ اصطلاح شريعت ميں ابتداء صبح ميں افق سے كافی بلندى پر نمودار ہونے والى مستطيل روشنى كو صبح كاذب كہا جاتا ہے، پھر يہی روشنى جب نيچے اتر كر عرضا پھلتی ہے اور طول سے عرض زياده ہوجاتا ہے اور اس ميں كچھ سرخى كى جھلك آجاتى ہے تو اسے صبح صادق کہا جاتاہے۔
অর্থাৎ ভালোভাবে বুঝে নাও, দিগন্তের অনেকটা উপরে লম্বালম্বি আকারে প্রকাশিত আলোকে শরীয়তের পরিভাষায় সুবহে কাযিব বলা হয়। অতঃপর এই আলোটিই যখন নিচে নেমে প্রশস্ত হয়ে যায় এবং এর উচ্চতা থেকে প্রশস্ততা বেড়ে যায় এবং তাতে কিছু লালিমাও এসে যায় তখন এটিকে সুবহে সাদিক বলা হয়। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৭৯)
অর্থাৎ তাঁর দাবি অনুযায়ী এখানে আলো মূলত একটিই। প্রথমে এটি আকাশের উপর লম্বালম্বি আকারে থাকে। এরপর এটিই নিচে নেমে প্রশস্ত হয়ে যায়। প্রথম অংশের নাম সুবহে কাযিব আর পরের অংশের নাম সুবহে সাদিক।
বিষয়টি তিনি এখানে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, সুবহে কাযিবের আলোটিই এক সময় প্রশস্ত হয়ে সুবহে সাদিকে পরিণত হয়ে যায়- এর সপক্ষে কোনো উদ্ধৃতি তাতে নেই। বরং এ কথাটি সকল ফুকাহায়ে কেরাম ও উলামায়ে উম্মতের সুস্পষ্ট বক্তব্যের খেলাফ। যার কিছু বিবরণ পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। আহসানুল ফাতাওয়াতে এ কথাটি বলার পরপরই অনেকগুলো কিতাবের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে। কিন্তু এর কোনোটিতেই একথা নেই যে, সুবহে কাযিবের আলোই প্রশস্ত হয়ে সুবহে সাদিকে পরিণত হয়ে যায়।
অবশ্য এ উদ্ধৃতিগুলোর মধ্যে তিনটি উদ্ধৃতি এমন, যা পূর্বে বর্ণিত ফুকাহায়ে কেরাম, উলামায়ে উম্মত ও মুসলিম ফালাকীগণের বক্তব্যের সম্পূর্ণ খেলাফ।
এর একটি হল, আততাসরীহ কিতাবের হাশিয়ার উদ্ধৃতি। আততাসরীহ কিতাবের বক্তব্য হল-
قال في التصريح: فيرى الضوء مرتفعا عن الأفق مستطيلا، ويرى ما بينه وبين الأفق مظلما، وهو الصبح الكاذب؛ لكذبه في الإخبار عن قرب الشمس؛ لأن الأفق بعد مظلم.
সুবহে কাযিবের ব্যাপারে তূসী ও কাযীদাহ যা বলেছেন একই কথা আততাসরীহ কিতাবের এ বক্তব্যটিতে উল্লেখ হয়েছে। অর্থাৎ সুবহে কাযিবের আলো দিগন্তের উপরে দৃশ্যমান হয় এবং দিগন্ত তখনও অন্ধকারই থাকে।
আততাসরীহ কিতাবের এ বক্তব্যটি উদ্ধৃত করার পর এর হাশিয়া থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে যে-
وفي الحاشية: (قوله لكذبه) واندفع به ما قيل: سمي بذلك لأنه يعقبه ظلمة يكذبه، فإنه إذا طلع الصبح الثاني انعدم ضوء الصبح الأول، وجه الاندفاع أنه لا يعقبه ظلمة، بل يخفى عن البصر لضعفه وغلبة الضوء الشديد الطارئ عليه، كما يخفى ضياء المشاعل والكواكب في ضوء الشمس.
এখানে বলা হয়েছে, আততাসরীহের এ বক্তব্য দ্বারা একথা প্রত্যাখ্যান হয়ে যায় যে, সুবহে কাযিবের পর আকাশ অন্ধকার হয়ে যায়। কারণ, সুবহে কাযিবের পর আকাশ অন্ধকার হয়ে যায় না। বরং এই আলোটি হাল্কা হওয়ার কারণে এবং এর উপর তীব্র আলো প্রকাশ হওয়ায় এই আলো তখন নযরে পড়ে না। সূর্যের আলোতে যেমন মশাল ও নক্ষত্রের আলো অদৃশ্য হয়ে যায়।
প্রায় একই কথা তুহফায়ে শাহী কিতাবের বরাতে মা লা-বুদ্দা মিনহুর হাশিয়া থেকে উল্লেখ করেছেন।
তৃতীয় আরেকটি উদ্ধৃতি শাফেয়ী মাযাহাবের কিতাব তুহফাতুল মুহতাজের। উক্ত কিতাব থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে-
ونقل الأصبحي إبراهيم أن بعضهم ذكر أنه يذهب بعد طلوعه ويعود مكانه ليلا، وأن أبا جعفر البصري بعد أن عرفه بأنه عند بقاء ساعتين يطلع مستطيلا إلى نحو ربع السماء، كأنه عمود، وربما لم ير إذا كان الجو كدرا صيفا، أعلاه دقيق، وأسفله واسع، وتحته سواد، ثم بياض، ثم يظهر ضوء يغشي ذلك كله، ثم يعترض : رده بأنه رصده نحو خمسين سنة، فلم يره غاب، وإنما ينحدر ليلتقي مع المعترض في السواد، ويصيران فجرا واحدا، وزعم غيبته ثم عوده وهم، أو رآه يختلف باختلاف الفصول فظنه يذهب.
এ বক্তব্যগুলো সম্পর্কে আমাদের কথা হল-
১. প্রথমত, এ তিনটি উদ্ধৃতি যে ফুকাহায়ে কেরাম, উলামায়ে উম্মত ও মুসলিম ফালাকীগণ সবার বক্তব্যের খেলাফ বিচ্ছিন্ন একটি কথা- তা তো স্পষ্ট। ফিকহে হানাফীর প্রায় সব কিতাবেই একথা আছে যে, সুবহে কাযিবের পর আকাশ অন্ধকার হয়ে যায়। অন্য তিন মাযহাবের কিতাবেও ব্যাপকভাবে এ কথাই আছে। তাফসীরুল কুরআন ও শুরুহুল হাদীসের কিতাবেও এমন অনেক বক্তব্য রয়েছে। খোদ আবদুল আলী বিরজান্দী রাহ., যার বক্তব্যই আহসানুল ফাতাওয়ার ১৫° সুবহে সাদিকের মূল ভিত্তি, তিনিও বলেছেন, সুবহে কাযিবের পর আকাশ অন্ধকার হয়ে যায়। মুসলিম ফালাকীগণও বলেছেন, সুবহে কাযিবের সময়ই দিগন্ত অন্ধকার থাকে। এতসব বক্তব্যের বিপরীতে এ দু-তিনটি বিচ্ছিন্ন কথা কী মূল্য রাখে? এবং সুবহে সাদিকের আগে আকাশ অন্ধকার থাকার সপক্ষে এত অসংখ্য উদ্ধৃতি থাকা সত্তে¡ও সেগুলো উল্লেখ না করে খুঁজে খুঁজে এই দু-তিনটি বিচ্ছিন্ন বক্তব্য তুলে ধরার পেছনে কী উদ্দেশ্য?!
২. দ্বিতীয়ত, আহসানুল ফাতাওয়ার উদ্ধৃত এই বক্তব্যগুলোই অসঙ্গতিপূর্ণ ও সামঞ্জস্যহীন। কারণ-
ক) মূল কিতাবের বক্তব্য থেকে টীকার উক্ত কথাটি ইস্তেমবাতই ভুল। কেননা আততাসরীহ কিতাবে বলা হয়েছে, সুবহে কাযিব যখন দৃশ্যমান থাকে তখনই দিগন্ত অন্ধকার থাকে। কিন্তু এ কথার উপর ভিত্তি করে টীকায় যা বলা হয়েছে, তা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। টীকায় বলা হয়েছে, সুবহে কাযিবের শেষ দিকে নাকি আরো তীব্র আলো প্রকাশিত হয়। যার কারণে এর পর এই আলো আর নযরে পড়ে না। অতএব মূল কিতাবের বক্তব্য থেকে টীকার উক্ত কথা ইস্তেমবাত করাই যখন বেঠিক, সুতরাং এর দ্বারা সুবহে কাযিবের পর আকাশ অন্ধকার হয়ে যাওয়ার বক্তব্যটি প্রত্যাখ্যান হওয়ার দাবিটাও সম্পূর্ণ অমূলক।
খ) টীকার কথা الضوء الشديد তীব্র আলো দ্বারা সুবহে সাদিকই উদ্দেশ্য হওয়ার কথা। অর্থাৎ সুবহে কাযিবের আলোর উপর সুবহে সাদিকের তীব্র আলো প্রকাশ হওয়ার কারণে এর পর সুবহে কাযিব আর দেখা যায় না। যদিও বাস্তবে তা বিদ্যমান থাকে।
এখানে সুবহে সাদিকের আলোকে الضوء الشديد তীব্র আলো আখ্যা দেওয়াটাও একটি অসঙ্গতি। কেননা সুবহে সাদিকের আলো তো একেবারে হালকা ও ক্ষীণ আকারে প্রকাশ হয়। যাকে কুরআনে الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ সাদা রেখা বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। এটি তীব্র আলো হয় কীভাবে?!
গ) টীকার বক্তব্য থেকে এটি স্পষ্ট যে, সুবহে কাযিবের আলো সুবহে সাদিক প্রকাশ হওয়ার পরও বাকি থাকে। কিন্তু সুবহে সাদিকের আলোর কারণে এর পর তা নযরে পড়ে না। এ দাবিটি দলীল বিরোধী এবং বাস্তবতাও তা খণ্ডন করে। প্রশ্ন হল, সুবহে সাদিকের আলোর কারণে সুবহে কাযিবের আলো দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে তারা এর পর এটি দেখলেন কীভাবে?!
ঘ) আততাসরীহের টীকায় যা বলা হয়েছে এবং মা লা-বুদ্দা মিনহুর হাশিয়াতে তুহফায়ে শাহীর বরাতে যা উল্লেখ করা হয়েছে, উভয় কথা একই এবং উভয়টির সূত্রও এক। আততাসরীহের এ টীকার লেখক হলেন, মাওলানা আবুল ফযল হাফীযুল্লাহ। যার ইন্তেকাল ১৩৬২ হিজরীতে। তিনি ফালাকিয়াতের মাহের কোনো ব্যক্তি নন। আর তুহফায়ে শাহীর লেখকের ইন্তেকাল ১০৫০ হিজরীতে। তাদের উভয়ই বিরজান্দীর রাহ. (৯৩৫ হি.)-এর পরের মানুষ। আসল কথা হল, উভয় কিতাবই ফনের ‘মাসাদিরে আসলিয়্যা’ ও ‘হুজ্জত’ পর্যায়ের কিতাব নয়। আর তাদের বক্তব্য যে ফুকাহায়ে কেরাম ও উলামায়ে উম্মতের বক্তব্যের খেলাফ- তা তো পূর্বেই তুলে ধরা হয়েছে।
বাকি থাকল তুহফাতুল মুহতাজ থেকে উদ্ধৃত ইবারতের প্রসঙ্গ। এ সম্পর্কে আগামী কোনো কিস্তিতে বিস্তারিত আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ। এখন সংক্ষেপে কিছু কথা উল্লেখ করা হল। তা হল, উক্ত কিতাবে আল্লামা ইবনে হাজার হাইতামী রাহ. (৯৭৪ হি.) এ বিষয়ে আরো লম্বা আলোচন করেছেন। কিন্তু আহসানুল ফাতাওয়াতে আগ-পর অনেক কিছু বাদ দিয়ে এর ইবারত উদ্ধৃত করা হয়েছে। এমনকি এর যেটুকু ইবারত আহসানুল ফাতাওয়াতে আনা হয়েছে তাও পরিপূর্ণ উল্লেখ করা হয়নি। বরং এর ভেতর নিজের মতের খেলাফ যে কথাগুলো রয়েছে, তা বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আহসানুল ফাতাওয়াতে ইবারতটি এভাবে শুরু করা হয়েছে-
ونقل الأصبحي إبراهيم أن بعضهم ذكر أنه يذهب بعد طلوعه ويعود مكانه ليلا، وأن أبا جعفر البصري بعد ...
অথচ তুহফাতুল মুহতাজে ইবারতটি আছে এভাবে-
ونقل الأصبحي إبراهيم أن بعضهم ذكر أنه يذهب بعد طلوعه ويعود مكانه ليلا، وهذا البعض كثيرون من أئمتنا كما مر، وأن أبا جعفر البصري بعد...
(তুহফাতুল মুহতাজ ১/৪২৮)
কিন্তু আহসানুল ফাতাওয়াতে এর মাঝ থেকে وهذا البعض كثيرون من أئمتنا كما مر কথাটুকু বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
৩. তৃতীয় কথা, এ বক্তব্যগুলো যেমনই হোক, আহসানুল ফাতাওয়ার পূর্বোক্ত কথা এর কোনোটিতেই নেই। কেননা আতাসরীহের হাশিয়াতে বলা হয়েছে, সুবহে সাদিকের পরও সুবহে কাযিবের আলো বাকি থাকে। তবে তা এর পর আর নযরে পড়ে না। অথচ আহসানুল ফাতাওয়াতে বলা হয়েছে, সুবহে কাযিবের আলোটিই এক সময় প্রশস্ত হয়ে সুবহে সাদিকে পরিণত হয়ে যায়। অতএব এ উদ্ধৃতিগুলোও আহসানুল ফাতাওয়ার উক্ত কথার দলীল হয় কীভাবে?!
৪. চতুর্থ কথা, যা পূর্বেও বলা হয়েছে এবং এক্ষেত্রে এটিই মূল কথা। তা হল, সুবহে সাদিকের আগ মুহূর্তে আকাশ অন্ধকার থাকে, নাকি সুবহে কাযিবের আলো এর সাথে মিলিত থাকে- এটি ভিন্ন প্রসঙ্গ; স্বতন্ত্র একটি বিষয়। সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিবের পরিচয় এবং উভয়টি নির্ণয়ের মানদণ্ডের উপর এর কোনো প্রভাব পড়ে না। সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিবের পরিচয় ও উভয়টি নির্ণয়ের মানদণ্ড হাদীস ও ফিকহ দ্বারা সুনির্ধারিত এবং সবার নিকটই স্বীকৃত। সুবহে সাদিকের আগ মুহূর্তে আকাশ অন্ধকার থাকে কি থাকে না- এই কয়টি বিচ্ছিন্ন উদ্ধৃতির কারণে বিষয়টিকে যদি মতভেদপূর্ণ ধরেও নেওয়া হয় (যদিও বিষয়টি কখনো এমন নয়) তথাপি সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিবের পরিচয় এবং উভয়টি নির্ণয়ের মানদণ্ড তাদের সবার নিকটই স্বীকৃত। এতে তাদের কারোই ভিন্নমত নেই। এই স্বীকৃত পরিচয় ও মানদণ্ডের ভিত্তিতেই প্রমাণিত যে, জোডিয়াকাল লাইট সুবহে কাযিব এবং অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সুবহে সাদিক- এর উপর উক্ত বিতর্ক কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না।
তাছাড়া কোনো স্বীকৃত বিষয়কে বিতর্কিত জিনিস দ্বারা সমাধান করা যায় না। বরং বিতর্কিত বিষয়ের সমাধান খুঁজতে হয় স্বীকৃত বিষয়ের আলোকে। অতএব আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে যদি এটি স্বীকৃত হয় যে, অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের আগে আকাশ পুরোপুরি অন্ধকার থাকে তাহলে তাদের নিকট এর চেয়ে আরো বেশি স্বীকৃত বিষয় হল, জোডিয়াকাল লাইট দেখা যায় অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের আগ মুহূর্তে। এ দুই বক্তব্য মিলালে ফলাফল এই বেরিয়ে আসে যে, দুটির মাঝে কিছু সময় দিগন্ত অন্ধকার থাকে। আর এ কথাই বলে গেছেন সকল ফুকাহায়ে কেরাম ও অসংখ্য উলামায়ে উম্মত যে, সুবহে কাযিবের পর কিছু সময়ের জন্য দিগন্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। অতএব এ প্রসঙ্গেও তাদের বক্তব্যের সাথে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বক্তব্যের কোনো অসামঞ্জস্য নেই।
জোডিয়াকাল লাইট দ্বারা কাদের বিভ্রান্তি হয়েছে?
আহসানুল ফাতাওয়াতে এই উদ্ধৃতিগুলো উল্লেখের পর বলা হয়েছে-
عبارات بالا سے ثابت ہوا كہ جن حضرات نے صبح کاذب کے بعد پھر مكمل اندھیرا ہو جانے كا قول كيا ہے انہيں زوڈيكل لائٹ يا كہكشاں سے مغالطہ ہوا ہے، یا ان کا مقصد یہ ہے کہ صبح صادق کی روشنی میں صبح کاذب غائب ہوجانے کی وجہ سے وہاں اندھیرا نظر آتا ہے۔
অর্থাৎ উপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলো থেকে এটি প্রমাণিত যে, যারা সুবহে কাযিবের পর পুনরায় অন্ধকার হয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন, তাদের জোডিয়াকাল লাইট বাكهكشاں গ্যালাক্সি (ছায়াপথ) দ্বারা বিভ্রান্তি হয়েছে।১ অথবা তাদের উদ্দেশ্য, সুবহে সাদিকের আলোতে সুবহে কাযিব অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কারণে তখন অন্ধকার দেখা যায়। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৮১)
দেখুন, এক্ষেত্রে ফুকাহায়ে কেরাম, মুফাসসির ও মুহাদ্দিসগণের মতামতকে উপেক্ষা করে বিচ্ছিন্ন এই দু-তিনটি উদ্ধৃতির আশ্রয় নিয়ে উল্টো ওইসব ফুকাহায়ে কেরাম, মুফাসসির, মুহাদ্দিসগণের দিকেই কীভাবে বিভ্রান্তির সম্বন্ধ করে দেওয়া হল! অথচ উচিত ছিল, এই বিচ্ছিন্ন ও অসঙ্গতিপূর্ণ বক্তব্যগুলো গ্রহণ না করে সবার নিকট স্বীকৃত মতটিই গ্রহণ করা।
আর কীসের ভিত্তিতে তাদের দিকে বিভ্রান্তির সম্বন্ধ করা হয়েছে- এর ব্যাখ্যায় গেলে তো আরো কঠিন। আমরা এই লেখাতে কিছু আগেই পড়ে এসেছি, চার মাযহাবেরই ফুকাহায়ে কেরাম ও অসংখ্য মুফাসসির-মুহাদ্দিস বলেছেন যে, সুবহে কাযিবের পর আকাশ পুরো অন্ধকার হয়ে যায়। আমাদের সহজ ও তড়িৎ অনুসন্ধানে এ কথা আমাদের মাযহাবে সর্বপ্রথম বলেছেন, শামসুল আইম্মা সারাখসী রাহ.। তাঁর ইন্তেকাল ৪৮৩ হিজরীতে। এই শতাব্দীর অন্যান্য মাযহাবের ফুকাহা, মুফাসসিরীন থেকেও এই বক্তব্য পাওয়া যায়। এরপর থেকে তো প্রতি যুগেই প্রত্যেক মাযহাবের অসংখ্য ফকীহ ও মুফাসসির-মুহাদ্দিস এ কথা বলে গেছেন। আর জোডিয়াকাল লাইট হল সম্পূর্ণ পশ্চিমা আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইংরেজি একটি পরিভাষা। তাহলে আহসানুল ফাতাওয়ার এ বক্তব্যের সোজা অর্থ দাঁড়ায়, অন্তত পঞ্চম হিজরী শতাব্দী থেকে নিয়ে পরবর্তী যুগের চার মাযহাবেরই ওইসমস্ত ফকীহ মুফাসসির-মুহাদ্দিসগণ আধুনিক অ্যাস্ট্রোনমির জোডিয়াকাল লাইট দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে একথা বলেছেন।! এ ছাড়া আর কী অর্থ হতে পারে এ কথার?!
কেউ বলতে পারেন, জোডিয়াকাল লাইটের পরিভাষা ইংরেজি বা নতুন হলেও এর মিসদাক ও উদ্দিষ্ট বিষয়বস্তু তো আর নতুন নয়। এর মিসদাকই আহসানুল ফাতাওয়ার উদ্দেশ্য। আমাদের প্রশ্ন, তাহলে জোডিয়াকাল লাইটের সেই মিসদাকটা কী? আমাদের নিকট জোডিয়াকাল লাইটের মিসদাক সুবহে কাযিব। এই মিসদাক তো আহসানুল ফাতাওয়ার নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। তাহলে এর অন্য মিসদাকটা কী? যার দ্বারা অসংখ্য ফকীহ ও মুফাসসির-মুহাদ্দিস বিভ্রান্ত হয়েছেন? আহসানুল ফাতাওয়ার কোথাও এর বিবরণ নেই কেন?
দ্বিতীয়ত, আহসানুল ফাতাওয়ার উদ্ধৃত ইবারতগুলোর কোনোটিতেও জোডিয়াকাল লাইট বা আরবীতে এর সমার্থক কোনো নাম- কোনো কিছুই নেই। كهكشاں এর আরবি সমার্থক শব্দ المجرة যেমন দু-একটি কিতাবে আছে, কিন্তু জোডিয়াকাল লাইট বোঝায় (সুবহে কাযিব ছাড়া) এমন কোনো শব্দ এই ইবারতগুলোর কোনোটিতেই নেই। তারপরও কীসের ভিত্তিতে বলে দেওয়া হল, ‘উপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলো থেকে এটি প্রমাণিত যে, যারা এমনটি বলেছেন তাদের জোডিয়াকাল লাইট বা গ্যালাক্সি দ্বারা বিভ্রান্তি হয়েছে’?!
তিনি তো বরং সুনির্ধারিতভাবে একজনের নাম নিয়েই বলছেন যে-
خلیل کی طرح بعض دیگرحضرات کو بھی زوڈيكل لائٹ اور كہكشاں کو صبح كاذب سمجھنے كا مغالطہ لگا ہے جس پر اہل تحقیق نے تردید فرمائی ہے چنانچہ علامہ حطاب مالکی فرماتے ہیں قال في الذخيرة... ۔
অর্থাৎ খলীলের মত অন্যান্যদেরও জোডিয়াকাল লাইট ও গ্যালাক্সিকে সুবহে কাযিব বোঝার ব্যাপারে বিভ্রান্তি হয়েছে। মুহাক্কিক আলেমগণ যার রদ করেছেন। যেমন আল্লাম হাত্তাব মালেকী রাহ. বলেছেন, যখীরা কিতাবে আছে,...। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৮০)
এই খলীল হলেন ইমামুল লুগাহ খলীল ইবনে আহমাদ আলফারাহিদী রাহ.। যার ইন্তেকাল ১৭০ হিজরীতে। তাঁরও নাকি জোডিয়াকাল লাইট ও গ্যালাক্সিকে সুবহে কাযিব বোঝার ব্যাপারে বিভ্রান্তি হয়েছে!
আর খলীল রাহ.-এর বিভ্রান্তির বিষয়টি তিনি গ্রহণ করেছেন তাবয়ীনুল হাকায়েক থেকে। আহসানুল ফাতাওয়াতে এর আগের পৃষ্ঠায় তাবয়ীনুল হাকায়েকের এই ইবারত তিনি উল্লেখ করেছেন-
وما روي عن الخليل أنه قال راعيت البياض بمكة شرفها الله تعالى ليلة فما ذهب إلا بعد نصف الليل محمول على بياض الجو وذلك يغيب آخر الليل، وأما بياض الشفق وهو رقيق الحمرة فلا يتأخر عنها إلا قليلا قدر ما يتأخر طلوع الحمرة عن البياض في الفجر.
(তাবয়ীনুল হাকায়েক ১/৮১)
অর্থাৎ খলীল রাহ. থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি সন্ধার পর মধ্যরাত পর্যন্ত আকাশে শুভ্র আলো দেখেছেন।
এই শুভ্র আলো কীসের- এর বিবরণ তাঁর বক্তব্যে নেই। এটি যে শাফাকে আবয়ায তা তো বলেন-ই নাই। এজন্যই তাবয়ীনুল হাকায়েকে যাইলায়ী রাহ. তার এ কথার ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, এটি بياض الجو আকাশের শুভ্রতা। শাফাকে আবয়ায নয়।
খলীল রাহ. একথা চার মাযহাবেরই কিতাব এবং লুগাতের বিভিন্ন কিতাবেও বর্ণিত হয়েছে। কোথাও খলীল রাহ.-এর বিভ্রান্তি হওয়ার কথা বলা হয়নি। যাইলায়ী রাহ. নিজেও এমন কোনো কথা বলেননি। তাঁর বিভ্রান্তি হওয়ার কথা তারা বলবেনই বা কীভাবে? তিনি তো স্পষ্টভাবে বলেননি, এটি কীসের শুভ্রতা। এক্ষেত্রে শুধু আহসানুল ফাতাওয়াই একক যে, তাতে খলীল রাহ.-এর বিভ্রান্তি চিহ্নিত হয়েছে! আর তাঁর বিভ্রান্তি হয়েছে আবার জোডিয়াকাল লাইট ও গ্যালাক্সি দ্বারা!! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!
দেখুন, নিজের বাস্তবতা বিরোধী ও ভিত্তিহীন দাবির বিপরীতে যাদের বক্তব্যই সামনে আসছে তাদের সবার দিকে একের পর এক কীভাবে বিভ্রান্তির সম্বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। চাই তারা নিজের যুগের আকাবির পর্যায়ের হোন বা পূর্বের যুগের ফুকাহা, মুফাসসির ও মুহাদ্দিসগণের বড় জামাতই হোক না কেন। নিজের যুগের আকাবির ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পর্কে বলেছেন, জর্জ ও. অ্যাবেল (George O. Abell)-এর বক্তব্য থেকে বিভ্রান্তির শিকার হয়ে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটকে তারা সুবহে সাদিক মনে করেছেন। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৭৮)
তাদের সম্পর্কে এও বলেছেন যে, তারা না বুঝেই কেবল পশ্চিমাদের অনুসরণ করে ১৮º -এ সুবহে সাদিক হওয়ার কথা বলছেন। পুরাতন সব নামাযের সময়সূচি ব্রিটেনের গ্রিনিচ রয়েল অবজারভেটরি থেকে প্রকাশিত নটিক্যাল আলমানাক (Nautical Almanac) থেকে প্রস্তুতকৃত; যা মূলত সুবহে কাযিবের সময়, সুবহে সাদিকের নয়। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৮৪)
আর এখানে এসে বলছেন, পূর্বের যুগের ফুকাহা, মুফাসসির ও মুহাদ্দিসগণসহ যারাই সুবহে কাযিবের পর আকাশ অন্ধকার হয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন তারা জোডিয়াকাল লাইট ও গ্যালাক্সি দ্বারা বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। এভাবে আগের যুগের ও বর্তমানের সবাই বিভ্রান্তির শিকার! শুধু আহসানুল ফাতাওয়াতে যা আছে তা-ই সঠিক!!
যারা সুবহে কাযিবের পর আকাশ অন্ধকার হয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন তাদের এ বক্তব্যের ব্যাপারে তিনি আরেকটি কথা বলেছেন-
یا ان کا مقصد یہ ہے کہ صبح صادق کی روشنی میں صبح کاذب غائب ہوجانے کی وجہ سے وہاں اندھیرا نظر آتا ہے۔
‘অথবা তাদের একথার উদ্দেশ্য, সুবহে সাদিকের আলোতে সুবহে কাযিব অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কারণে ওখানে অন্ধকার দেখা যায়।’ (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৮১)
এ কথার কী যে ব্যাখ্যা- আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন! সুবহে সাদিকের আলোর তীব্রতার কারণে সুবহে কাযিবের আলোই যখন অদৃশ্য হয়ে যায় তাহলে আকাশে সুবহে সাদিকের এই তীব্র আলো থাকার পরও সেখানে আবার অন্ধকার দেখা যায় কীভাবে?! তাছাড়া ফকীহগণও সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, আকাশ অন্ধকার থাকে সুবহে সাদিক প্রকাশ হওয়ার আগে। অর্থাৎ সুবহে কাযিব এক সময় বিলীন হয়ে আকাশ অন্ধকার হয়ে যায়। কিছু সময় এ অবস্থায় অতিবাহিত হয়। এর কিছুক্ষণ পর সুবহে সাদিক প্রকাশ হয়। তাঁদের এই বক্তব্যের সাথে আহসানুল ফাতাওয়ার দাড় করানো এ ব্যাখ্যার মিল কোন্ দিক থেকে?
সূর্যোদয়ের আগে কি জমিনে সূর্যের আলো পড়ে?
আরেকটি বিষয়। আহসানুল ফাতাওয়াতে এই আলোচনারই এক জায়গায় বলা হয়েছে-
اور ১৫ زير افق سےقبل شعاع شمس كا زمين پر قطعا ظہور نہيں ہوتا، اسلئے يہ صبح كاذب ہے۔
অর্থাৎ ১৫° -এর আগে জমিনে সূর্যের কিরণ মোটেই প্রকাশ হয় না। এজন্যই এটি সুবহে কাযিব। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৮০)
আমরা জানি, আহসানুল ফাতাওয়ার দাবি হল সুবহে সাদিক হয় ১৫° -এ। তাহলে প্রশ্ন, সুবহে সাদিকের পরিচয়ে কোথায় একথা আছে যে, তখন জমিনেও সূর্যের কিরণ প্রকাশ হয়? হাদীসে তো এর পরিচয়ে এসেছে, الفَجْرُ المُسْتَطِيرُ فِي الأُفُقِ অর্থাৎ দিগন্তের উভয় দিকে বিস্তৃত ফজরের আলো। ফুকাহায়ে কেরাম ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণও একথাই বলেন যে, এর আলো দেখা যায় দিগন্তে। দ্বিতীয়ত, একথা স্পষ্ট ও চাক্ষুষ বাস্তবতার বহির্ভূতও। কেননা জমিনে সূর্যের কিরণ পড়ে তো সূর্যোদয়ের পর। এর আগে জমিনে সূর্যের কিরণ পড়ে না। এটি যে কেউ বোঝে ও স্বচক্ষে দেখতে পায়। অতএব ১৫° -এর আগে কেন, সূর্যোদয়ের ১° আগেও জমিনে সূর্যের কিরণ দৃশ্যমান হয় না। তৃতীয়ত, এটিকে সুবহে কাযিব বলার কারণ এটি- এটিও কী রকম কথা? ফিকহ ও ফালাকিয়াতের কিতাবে এটিকে সুবেহ কাযিব নামকরণের কারণ স্পষ্টভাবেই উল্লেখ আছে। কিন্তু এই কিতাবগুলোতে কোথায় আছে এমন কথা? আর এমন স্পষ্ট ভুল থাকতে পারেও কীভাবে?!
দেখুন, এখানে এক কথায়ই কতগুলো বাস্তবতা বিরোধী দাবি করা হয়েছে। কিন্তু কথা হল, নিজের বক্তব্য প্রমাণের জন্য এমন স্পষ্ট চাক্ষুষ বাস্তবতা বিরোধী দাবিরও কী প্রয়োজন ছিল?! ‘
সুবহে কাযিব কি সুবহে সাদিকের তিন ডিগ্রি আগে শুরু হয়?
জোডিয়াকাল লাইট সুবহে কাযিব হওয়ার উপর আহসানুল ফাতাওয়ার তৃতীয় আরেকটি আপত্তি হল-
يہ روشنى صبح صادق سے تين درجہ پہلے ظاہر ہونے كى بجائے بہت پہلے شروع ہوتى ہے، بلكہ تين درجہ سےبہت پہلے ختم ہو جاتى ہے۔
অর্থাৎ এই আলো সুবহে সাদিকের তিন ডিগ্রি আগে প্রকাশ হয় না; বরং তিন ডিগ্রির অনেক আগে শুরু হয়ে তিন ডিগ্রির অনেক আগেই আবার নিঃশেষ হয়ে যায়। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৬০)
আহসানুল ফাতাওয়ার এই পৃষ্ঠায়ই আরো বলা হয়েছে-
فقہ اور فلكيات ميں يہ وضاحت بھی ہے كہ صبح صادق سے صرف تين درجہ پہلےصبح كاذب نظر آتى ہے۔
ফিকহ ও ফালাকিয়াত শাস্ত্রে এটিও স্পষ্টভাবে আছে যে, সুবহে সাদিকের মাত্র তিন ডিগ্রি আগে সুবহে কাযিব দৃশ্যমান হয়। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৬০)
আহসানুল ফাতাওয়ার একথা থেকে যে কারো মনে হবে, ফিকহ ও ফালাকিয়াতের সব কিতাবে না হলেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কিতাবে তো অবশ্যই এই বক্তব্য আছে। অথচ এখানে উদ্ধৃতি মাত্র একটিই। কেবল রদ্দুল মুহতারের উদ্ধৃতি। আলী দাগিস্তানী রাহ.-এর ‘রিসালাতুল আসতারলাব’-এর উপর খলীল কামেলী রাহ. (১২০৭ হি.)-এর টীকা থেকে রদ্দুল মুহতারে এমন একটি কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আহসানুল ফাতাওয়ার ফিকহ ও ফালাকিয়াত দ্বারা এই একটি উদ্ধৃতিই উদ্দেশ্য।
যাহোক, এখানে তিনি বলতে চেয়েছেন, জোডিয়াকাল লাইট যেহেতু সুবহে সাদিকের তিন ডিগ্রি আগে প্রকাশ হয় না; বরং তিন ডিগ্রির অনেক আগে নিঃশেষ হয়ে যায়। তাই এটি সুবহে কাযিব হতে পারে না।
একথাটি একদিক থেকে যেমন বাস্তবতা বিরোধী, তেমনিভাবে ফিকহ ও শরীয়তের বিধিবিধানের দিক থেকে বিষয়টি আপত্তিকরও। আপত্তিকর এজন্য যে, এ কথার অর্থ তো এই দাঁড়ায় যে, সুবহে কাযিব সুবহে সাদিকের তিন ডিগ্রি আগে প্রকাশ হওয়া জরুরি; নতুবা তা সুবহে কাযিব হবে না; যদিও তাতে হাদীস ও ফিকহের কিতাবে বর্ণিত সুবহে কাযিবের পরিচয় পুরোপুরি পাওয়া যায়। অথচ ফিকহ ও ফতোয়ার দৃষ্টিতে এমন কথা কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ শরয়ী মানদণ্ড সাব্যস্ত হওয়ার পর অন্য কোনো অজুহাতে তা উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই।
আর জোডিয়াকাল লাইট সুবহে সাদিকের অনেক আগে নিঃশেষ হয়ে যায়- একথা যে বাস্তবতা বিরোধী; শাস্ত্রজ্ঞদের বরাতে তার অসংখ্য উদ্ধৃতি তো পূর্বে তুলে ধরা হয়েছেই।
বাকি থাকল খলীল কামেলী রাহ. (১২০৭ হি.)-এর বক্তব্য। তিনি যে বলেছেন, সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিবের মধ্যে তিন ডিগ্রি ব্যবধান- এর কী হাকীকত? ১৫° -এর সপক্ষে আহসানুল ফাতাওয়ার উদ্ধৃত বক্তব্যগুলোর উপর সামনে যখন আলোচনা করা হবে তখন খলীল কামেলি রাহ.-এর বক্তব্যটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ। এখানে সংক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি কথা উল্লেখ করা হল।
এ ব্যাপারে মৌলিক কথা হল, খলীল কামেলি রাহ.-এর এ বক্তব্যেরও ভিত্তি বিরজান্দি রাহ.-এর কথাই। বিরজান্দী রাহ.-এর বক্তব্য থেকেই তিনি একথা গ্রহণ করেছেন। বিরজান্দী রাহ.-এর বক্তব্যে আছে, সুবহে কাযিব ১৮ ডিগ্রিতে এবং সুবহে সাদিক ১৫ ডিগ্রিতে হয়। এখান থেকেই খলীল কামেলি রাহ. বলে দিয়েছেন, সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিবের মধ্যে তিন ডিগ্রি ব্যবধান। আর বিরজান্দী রাহ.-এর বক্তব্য যে তাসামূহপূর্ণ তা তো পূর্বের আলোচনাগুলো থেকেই সুস্পষ্ট। সামনে এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।
এ ব্যাপারে বিরজান্দী রাহ.-এর বক্তব্যই যেহেতু সহীহ নয় অতএব এর উপর নির্ভরকৃত খলীল কামেলী রাহ.-এর কথাটিও যে সহীহ হতে পারে না- তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
মোটকথা ১৮ ডিগ্রিতে সুবহে কাযিব হওয়ার কথাটি যেমন ভুল; কোনো ফালাকী বা জ্যোতির্বিজ্ঞানী এমন কথা বলেননি। ঠিক তেমনিভাবে সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিবের মধ্যে তিন ডিগ্রি ব্যবধানের কথাটিও ভুল; কোনো ফালাকী বা জ্যোতির্বিজ্ঞানী থেকে এমন কোনো বক্তব্য নেই। বরং কোনো ফালাকী বা জ্যোতির্বিজ্ঞানী সুবহে কাযিবকে ডিগ্রি দ্বারা নির্ধারণই করেননি। তাদের কারো বক্তব্যে এ কথা পাবেন না যে, সুবহে কাযিব এত ডিগ্রিতে শুরু হয়। তাছাড়া এ কথাটি মুশাহাদারও খেলাফ। কেননা মুশাহাদার মাধ্যমে সুবহে কাযিব সুবহে সাদিকের ১০° আগে প্রকাশ হতেও দেখা গেছে। তাছাড়া বিভিন্ন অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টারের বক্তব্যেও আছে যে, সুবহে কাযিব সুবহে সাদিকের অনেক আগেও দেখা যায়। যার কিছু বিবরণ সামনের শিরোনামের অধীনে আসছে ইনশাআল্লাহ।
সুবহে কাযিব কত ডিগ্রিতে শুরু হয়?
কেউ কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, ১৮ ডিগ্রিতে সুবহে সাদিক হলে সুবহে কাযিব কত ডিগ্রিতে হয়? তাদের কাছে প্রশ্ন, সুবহে কাযিব কত ডিগ্রিতে হয়- তা জানার প্রয়োজনটা কী? তা জানা না গেলে সমস্যাও বা কী? সুবহে সাদিক নির্ণয়ের বিষয়টি কি সুবহে কাযিব কত ডিগ্রিতে হয়- তা নির্ধারণের উপর নির্ভরশীল? বা সুবহে কাযিব কত ডিগ্রিতে হয়- তা নির্ধারণ করা না হলে সুবহে সাদিকের বিষয়টিতে কোনো প্রকার সংশয়-সন্দেহ থেকে যাবে? বিধানাবলীর সম্পর্ক তো কেবল সুবহে সাদিকের সাথেই সম্পৃক্ত। সুবহে কাযিবের সাথে কোনো বিধানের সম্পর্ক নেই। কুরআন ও হাদীসে সুবহে কাযিবের প্রসঙ্গ এসেছে মূলত সুবহে সাদিকের পরিচয় প্রদানের জন্য যে, এটি সুবহে সাদিক; ওটি নয়। সুবহে সাদিক নির্ণয়ে যেন কেউ এর দ্বারা বিভ্রান্ত না হয়- কেবল এজন্যই সুবহে কাযিবের প্রসঙ্গ এসেছে। এখন যখন সুবহে সাদিক ডিগ্রির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়ে গেল এরপর তো সুবহে কাযিব দ্বারা বিভ্রান্ত হওয়ার আর অবকাশই থাকেনি। তারপরও প্রশ্ন কেন যে, সুবহে কাযিব কত ডিগ্রিতে হয়?!
তাছাড়া সুবহে কাযিব কত ডিগ্রিতে শুরু হয়- এভাবে প্রশ্ন উত্থাপনটাই গোড়া থেকে ভুল। কারণ, সুবহে সাদিকের সাথে বিভ্রান্তি হতে পারে সুবহে কাযিবের শেষ অংশের দ্বারা; শুরু অংশের দ্বারা নয়। অতএব সুবহে কাযিব কখন শুরু হয়- এ প্রশ্নই অবান্তর। আর এক্ষেত্রে বাস্তবতা হল, মুসলিম-অমুসলিম, পূর্ব যুগের বা বর্তমানের কোনো বিজ্ঞানীই সুবহে কাযিবকে ডিগ্রি দ্বারা নির্ধারণ করেননি। মুসলিম বিজ্ঞানীগণ বলেছেন, সুবহে সাদিক হয় ১৮/১৯ ডিগ্রিতে। কিন্তু সুবহে কাযিব কত ডিগ্রিতে হয়- তা কেউই বলেননি। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সবাই বলেন, অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট হয় ১৮ ডিগ্রিতে। কিন্তু জোডিয়াকাল লাইট এত ডিগ্রিতে দেখা যায়- এমন কেউই বলেননি। তারা কী বলেছেন- পূর্বে আমরা দেখেছি। ‘সূর্যোদয়ের প্রায় ৯০ মিনিট আগে’ বা ‘৮০ থেকে ১২০ মিনিটের ভেতর’; ‘Dawn তথা ভোর বা ফজর হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে’; ‘১৮° -এর আগে’; ‘অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের পূর্বে’; ‘সুবহে সাদিক বা true dawn -এর পূর্বে’ ইত্যাদি। এভাবেই তারা সুবহে কাযিব ও জোডিয়াকাল লাইট দেখা যাওয়ার সময় উপস্থাপন করে থাকেন।
বাস্তবতা হল, সুবহে কাযিবের বিষয়টি এমন যে, তা সুনির্ধারিত ডিগ্রির দ্বারা নির্ধারণ করাই সম্ভব নয়। মুশাহাদার মাধ্যমেও দেখা গেছে, সুবহে কাযিব ১৮° -এর আগে বিভিন্ন দিন বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ পায়। এমনকি সুবহে সাদিকের ১০°/১১° আগেও কখনো কখনো সুবহে কাযিব মুশাহাদা করার প্রমাণ আছে।
১৯৭৩ সালের ১৮ আগস্ট প্রফেসর আব্দুল লতীফসহ ৫ জন পাকিস্তানের এক এলাকায় সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিব পর্যবেক্ষণ (observation) করেন। সেদিন ঐ স্থানে ১৮° অনুযায়ী সুবহে সাদিকের সময় ছিল ৪ : ৪০ মিনিটে। তারা এই সময়েই সুবহে সাদিক দেখেছেন। কিন্ত সুবহে কাযিব দেখেছেন ৪টা বাজারও কিছু আগে। তাহলে ১৮° -এর ৪০ মিনিটেরও আগে তারা সুবহে কাযিব দেখেছেন। ডিগ্রির হিসাব অনুযায়ী যা ২৮° থেকেও বেশি হয়। (সুবহে সাদিক ওয়া সুবহে কাযিব, প্রফেসর আব্দুল লতীফ, পৃ. ৮০-৮১)
ইয়েমেনের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. আব্দুল হক সুলতান। ২৪-১১-২০০৩ তারিখে তিনি কয়েকজনকে নিয়ে সানআ থেকে পূর্ব দিকে ৩০ কি.মি. দূরে অবস্থিত বনি হাশীশ এলাকায় সুবহে সাদিক পর্যবেক্ষণের জন্য গমন করেন। ওই দিন তারা ৪ : ০১ মিনিটে সুবহে কাযিব দেখতে পান। হিসাব করে দেখা গেছে তখন সূর্য দিগন্তের ২৯. ৫° ডিগ্রি নিচে ছিল। (Sun Apparent Motion and Salat Times. al-Irshaad Vol. 8, p.10; إشكاليات فلكية وفقهية حول تحديد مواقت الصلاة، محمد شوكت عودة، ص ২৪)
বিভিন্ন অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টারের বক্তব্যেও আছে যে, সুবহে কাযিব সুবহে সাদিকের অনেক আগেও প্রকাশ হয়। যেমন মুসলিম বিশ্বের ১৭ জন বিজ্ঞানীর স্বাক্ষর সম্বলিত ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সেন্টারের বক্তব্যে পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে। তারা বলেছেন-
فالفجر الكاذب ظاهرة فلكية معروفة عند المسلمين وعند غيرهم وهو يظهر قبل الزاوية ১৯ بكثير. وقد علم ذلك بالرصد المستفيض سواء من قبل المسلمين أو غير المسلمين المهتمين بالظواهر الفلكية بشكل عام.
অর্থাৎ মুসলিম ও অমুসলিম বিজ্ঞানীদের ব্যাপক মুশাহাদা তথা চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণ (ড়নংবৎাধঃরড়হ) দ্বারা এটি প্রমাণিত যে, সুবহে কাযিব ১৯ ডিগ্রির অনেক আগে দেখা যায়।
দেখুন-
https://www.astronomycenter.net/fajer.html
জর্ডানের আম্মানে অবস্থিত আরব লীগের অধীনস্ত আরবের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান الاتحاد العربي لعلوم الفضاء والفلك Arab Union for Astronomy And space Sciences। তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি বক্তব্যে আছে-
ضوء البروج يزين سماء الوطن العربي:
تعتبر الفترة الحالية من سبتمبر والأشهر المقبلة أوقاتا مناسبة لرصد ضوء البروج أو "الفجر الكاذب" بسماء الوطن العربي وكامل النصف الشمالي من الكرة الأرضية نظرا لأن دائرة البروج تقع تقريبا بشكل مستقيم بالنسبة للأفق الشرقي. ... ضوء البروج هرمي الشكل له لون "الحليب" يشاهد باتجاه الأفق الشرقي قبيل ظهور الفجر الصادق بحوالي ساعة أو نحو ذلك.
দেখুন-
http://auass.com /ضوء-البروج-يزين-سماء-الوطن-العربي/
এই বক্তব্যটিতেও স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ হয়েছে, জোডিয়াকাল লাইটই (ضوء البروج) সুবহে কাযিব এবং এটি প্রকাশ হয় সুবহে সাদিক শুরু হওয়ার পূর্বে ঘণ্টা খানেকের ভেতর।
আমেরিকার টেক্সাসে অবস্থিত একটি প্রতিষ্ঠান আর্থস্কাই (earthsky)। যা নিয়মিত মহাকাশ, মহাজগৎ, বিশ্ব ও প্রকৃতি সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করে। তাদের ওয়েবসাইটেও আছে-
How can I see the zodiacal light?
...In autumn, the zodiacal light can be seen in the hour before true dawn begins. Or, in spring, it can be seen for up to an hour after all traces of evening twilight leave the sky.
দেখুন-
https://earthsky.org/astronomy-essentials/everything-you-need-to-know-zodiacal-light-or-false-dawn
এখানেও স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ হয়েছে, শরতে true dawn (সুবহে সাদিক) হওয়ার আগে এক ঘণ্টার ভেতর জোডিয়াকাল লাইট দেখা যায়। তেমনি বসন্তে গোধূলির টোয়াইলাইটের চিহ্ন আকাশ ছেড়ে যাওয়ার পরে এক ঘণ্টা অবধি এটি দৃশ্যমান থাকে।
১৪৩২ হিজরীর দিকে সৌদি আরবের কাসীম বিশ্ববিদ্যালয় (جامعة قصيم)-এর ফিকহ ও ভূগোল অনুষদের প্রায় ১০ দশজন শিক্ষকের সমন্বয়ে গঠিত একটি জামাত সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিব মুশাহাদা তথা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এই মুশাহাদার মাধ্যমে সুবহে সাদিকের ব্যাপারে তারা সঠিক সিদ্ধান্তে উপণীত হতে না পারলেও সুবহে কাযিব সম্পর্কে তারা যে বক্তব্য প্রদান করেছেন এ ব্যাপারে তা-ই চূড়ান্ত কথা। তারা বলেছেন-
وفي الواقع ومن خلال الرصد الميداني تبين لنا أن الفجر الكاذب الذي هو كذنب السرحان يختلف وقت ظهوره من فصل لآخر بل من شهر لآخر ولا نستطيع أن نضبطه بدرجة قوسية فلكية معينة.
অর্থাৎ বাস্তবতা ও মাঠ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, মৌসুম ভেদে, এমনকি এক মাস থেকে অন্য মাসে সুবহে কাযিব ভিন্ন ভিন্ন সময় প্রকাশিত হয়। তা প্রকাশের সময় সর্বদা এক থাকে না। তাই নির্দিষ্ট একটি ডিগ্রি দ্বারা এটি নির্ণয় করা সম্ভব নয়।
দেখুন-
تحديد وقت دخول صلاة الفجر عمليا بمنطقة القصيم، ص ২১.
তাদের নিকট প্রশ্ন
শেষে তাদের নিকট একটি প্রশ্ন, আপনাদের কথা অনুযায়ী অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট যদি সুবহে কাযিবই হয় তাহলে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের নিকট সুবহে সাদিকের নাম কী? ১৫° -এ দৃশ্যমান আলোর নাম, পরিচয় বা এ সংক্রান্ত কোনো আলোচনা কি আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে পাওয়া যায়? অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সুবহে কাযিব হলে তাদের আলোচনায় সুবহে সাদিক গেল কোথায়? তারা তো টোয়াইলাইটকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। একটি শুরু হয় ১৮° -এ; আরেকটি ১২° -এ; অপরটি ৬° -এ। ১৫° -এর কোনো ভাগ নেই কেন? অথচ সুবহে কাযিবের পর প্রথমে সুবহে সদিকের ভাগ থাকার কথা। কেননা উভয়টি কাছাকাছি সময়ের হওয়া সত্তে¡ও দু’টির আলোর ধরন ভিন্ন। কেউ বলতে পারেন, তাদের তো সুবহে সাদিক আর সুবহে কাযিব কোনোটির দরকার নেই। অতএব তাদের বক্তব্যে এটি থাকবে কেন? কথা হল, সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিব এই পরিভাষার তাদের দরকার নেই- তা ঠিক। কিন্তু তাই বলে এ দুটির যে মিসদাক, অর্থাৎ সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিবের মত দু’ধরনের আলো- এ সম্পর্কে তারা অবগতই থাকবেন না- এটি তো হতে পারে না। কারণ, তাদের কাজই তো মহাকাশ গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ। এটিই তাদের দরকার।
আচ্ছা, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সুবহে সাদিকের প্রয়োজন না থাকায় আপনাদের ধারণা মতে তারা এটি নিয়ে কোনো আলোচনা না করলে তারা যে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট নিয়ে আলোচনা করেছেন তাদের এর প্রতি বিশেষ কী প্রয়োজন ছিল? আমাদের যেমন নামাযের ওয়াক্তের জন্য সুবহে সাদিক দরকার। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের উপাসনাগত বা জাগতিক কোন্ কাজের জন্য অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাটের প্রয়োজন? টোয়াইলাইটকে তারা তিন ভাগ করেছেন; এই ভাগেরও কী প্রয়োজন ছিল তাদের? এই তিন প্রকারের টোয়াইলাইটের কোন্টির সাথে তাদের কোন্ প্রয়োজন সম্পৃক্ত? মহাকাশ গবেষণা ও অবজারভেশন এবং এর উপস্থাপন ছাড়া এর সাথে তাদের আর কোন্ কাজের সম্পর্ক রয়েছে?
আহসানুল ফাতাওয়াতেও বলা হয়েছে-
مغربى ممالك كو صبح صادق سے كوئی سروكار نہ تھا، لہذا انہوں نےبھی مكمل اندھيرے ميں ظاہر ہونے والى روشنى كى پہلى كرن (صبح كاذب) كے نقشے تيار كئے۔
অর্থাৎ পশ্চিমাদের সুবহে সাদিকের প্রয়োজন নেই। তাই তারা পরিপূর্ণ অন্ধকারে প্রকাশিত প্রথম আলোকরশ্মি (সুবহে কাযিব)-এর নকশা তৈরি করেছেন। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৮৪)
‘পশ্চিমাদের সুবহে সাদিকের প্রয়োজন নেই’! তাহলে তাদের সুবহে কাযিবের কী প্রয়োজন দেখা দিয়েছে?! সুবহে কাযিবের সাথে তাদের উপাসনাগত বা জাগতিক কোন্ কাজের সম্পর্ক আছে যে, তারা শুধু এটি নিয়ে আলোচনা করছেন?!
আসলে আমাদের প্রয়োজন আর তাদের প্রয়োজন এক নয়, কিন্তু প্রয়োজন তাদেরও আছে। তো যে প্রয়োজনে তারা সুবহে কাযিব নিয়ে আলোচনা গবেষণা করেছেন সেই প্রয়োজনেই সুবহে সাদিক নিয়ে আলোচনা গবেষণা করেছেন। হাঁ, তাদের পরিভাষা ভিন্ন। আমাদের সুবহে কাযিব তাদের ভাষায় জোডিয়াকাল লাইট, আর আমাদের সুবহে সাদিক তাদের ভাষায় অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট। আহসানুল ফাতাওয়ায় যেমন মুসলিম বিজ্ঞানীদের সুবহে সাদিককে সুবহে কাযিব বানিয়ে দেওয়া হয়েছে তেমনি আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট (সুবহে সাদিক)-কে সুবহে কাযিব বানিয়ে দেওয়া হয়েছে!!
সারকথা
এককথায় আহসানুল ফাতাওয়ার এই পুরো আলোচনাটি অসংখ্য বাস্তবতা বিরোধী দাবি, স্বীকৃত বিষয়ের বিপরীত দাবি, দলীলের খেলাফ দাবি এবং সহীহ, দলীলনির্ভর ও স্বীকৃত বিষয়কে ভুল আখ্যা দেওয়া এবং শায বা বিচ্ছিন্ন কয়েকটি উদ্ধৃতির এক সমষ্টি। সহীহ যা উদ্ধৃতি আছে, এর কোনোটিই তাঁর দলীল হয় না। ব্যস বাস্তবতা বিরোধী ও দলীলের খেলাফ একের পর এক অসংখ্য দাবিই যেন এর একেকটি দলীল! যেমন-
১. আহসানুল ফাতাওয়াতে দাবি করা হয়েছে, সুবহে সাদিক হয় ১৫° -এ। এর আগের সময়টি সুবহে কাযিবের। অথচ সুবহে সাদিক হয় ১৮° -এ। এটি আমালে মুতাওয়ারাস, ফুকাহায়ে কেরাম ও মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণের বক্তব্য ও অসংখ্য মুশাহাদা দ্বারা প্রমাণিত। ১৫° -এর আগে সুবহে সাদিক না হওয়া সপক্ষে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণ নেই।
২. আহসানুল ফাতাওয়াতে দাবি করা হয়েছে, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের জোডিয়াকাল লাইট সুবহে কাযিব নয়; বরং ১৮° -এ প্রকাশিত অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সুবহে কাযিব। অথচ আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বক্তব্য অনুযায়ী জোডিয়াকাল লাইট হল সুবহে কাযিব এবং অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সুবহে সাদিক। এটি স্বীকৃত বিষয়। এর উল্টো অর্থাৎ জোডিয়াকাল লাইট সুবহে কাযিব না হওয়ার এবং অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সুবহে কাযিব হওয়ার সপক্ষে একটি প্রমাণও নেই।
৩. আহসানুল ফাতাওয়াতে দাবি করা হয়েছে, জোডিয়াকাল লাইট বছরে কেবল দুই মাস দেখা যায়। তাও কেবল কোনো কোনো জায়গায়। অথচ জোডিয়াকাল লাইট সারা বছরই দেখা যায়। এটিই স্বীকৃত ও বাস্তবসম্মত। বছরে দুই মাস ছাড়া আর এটি দেখা যায় না- এর কোনো প্রমাণ নেই।
৪. আহসানুল ফাতাওয়াতে দাবি করা হয়েছে, সুবহে কাযিব সুবহে সাদিকের সাথে মিলিত থাকা আবশ্যক; নতুবা এটি সুবহে কাযিব হবে না। অথচ কুরআন-হাদীস, ফিকহ-ফতোয়া ও ফালাকিয়াতের কোথাও এমন কথা নেই। বরং ফিকহ-ফতোয়া, তাফসীরুল কুরআন, শুরুহুল হাদীসের কিতাবসমূহে সুস্পষ্ট আছে যে, সুবহে কাযিব ও সুবহে সাদিকের মাঝে কিছু সময় আকাশ অন্ধকার থাকে। এ সমস্ত ফুকাহায়ে কেরাম, মুফাস্সির ও হাদীসবিশারদগণের ব্যাপারে উল্টো বলা হয়েছে, তারা জোডিয়াকাল লাইট ও গ্যালাক্সি দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে এমনটি বলেছেন।
সুবহে সাদিক বিষয়ে আহসানুল ফাতাওয়ার পুরো আলোচনার মূল বিষয়বস্তুই এ কয়টি দাবি। যেগুলোর হালত এই। সাথে প্রাসঙ্গিক এমন আরো অমূলক ও বাস্তবতা বিরোধী বিভিন্ন বিষয় তো আছেই। ব্যস, আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করার মালিক। পরবর্তীদের দায়িত্ব, কারো শুযূয ও যাল্লাত গ্রহণ করা থেকে বেঁচে থাকা। আর তা প্রচার করা তো আরো বড় অন্যায়। শুযূয তাসামুহের কারণে হোক বা ইচ্ছা করে, সর্বাবস্থায় তা পরিহারযোগ্য।
اللهم أرنا الحق حقاً وارزقنا اتباعه، وأرنا الباطل باطلاً وارزقنا اجتنابه.
هذا، وصلى الله تعالى وسلم وبارك على سيدنا محمد خاتم الأنباء والمرسلين، وعلى آله وصحبه أجمعين، والحمد لله رب العالمين.
বি. দ্র.
সুবহে সাদিক বিষয়ক এ লেখাটির প্রথম কিস্তি ছেপেছে শাবান-রমযান ১৪৪০ হি./এপ্রিল-মে ২০১৯ সংখ্যায়। যাতে মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বক্তব্য এবং বিভিন্ন ফতোয়া বিভাগ ও মুফতী বোর্ডের সিদ্ধান্ত ইত্যাদির বরাতে দেখানো হয়েছে যে, সুবহে সাদিক শুরু হয় ১৮/১৯ ডিগ্রিতে। দ্বিতীয় কিস্তি প্রকাশিত হয়েছে জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪১ হি./ফেব্রæয়ারি ২০২০ সংখ্যায়। তাতে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের অসংখ্য উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে যে, জোডিয়াকাল লাইট আর সুবহে কাযিব একই। আর তৃতীয় কিস্তি প্রকাশিত হয়েছে বিগত (যিলকদ ১৪৪১ হি./জুলাই ২০২০ ঈ.) সংখ্যায়। তাতেও আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনেক তত্ত¡-প্রমাণ উদ্ধৃত করে সাব্যস্ত করা হয়েছে যে, অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটই সুবহে সাদিক। এটিকে সুবহে কাযিব আখ্যা দেওয়া বিকৃতির শামিল।
আর এ সংখ্যায় জোডিয়াকাল লাইট সুবহে কাযিব নয়; বরং অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সুবহে কাযিব- আহসানুল ফাতাওয়ার এ দুটি অমূলক কথা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে হাওয়ালাগুলো ব্যবহার করা হয়েছে এগুলোর দালীলিক পর্যালোচনা করা হয়েছে। প্রবন্ধটি এখানেই শেষ হয়নি। বাকি কিস্তিগুলো কয়েক মাস পর ছাপা হবে ইনশাআল্লাহ। আগ্রহী পাঠকদের কাছে আবারো অনুরোধ থাকল, আমাদের উপস্থাপিত আলোচনার কোনো অংশে কারো কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে তারা যেন লিখে পাঠান। আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।
উল্লেখ্য, পূর্বে প্রকাশিত কিস্তিগুলোর কোনো বিষয়ে এপর্যন্ত আমাদের কাছে দলীলভিত্তিক কোনো মন্তব্য পৌঁছেনি।