যিলহজ্ব ১৪৪১   ||   আগস্ট ২০২০

‘কুরবানী ইসলামের শিআর : করোনার অজুহাতে এতে ছাড়ের সুযোগ নেই’

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

[করোনা মহামারির সময় কুরবানী করার প্রয়োজন রয়েছে কি না- এজাতীয় বিভিন্ন প্রশ্নের অবতারণা করছে অবুঝ ও বক্র বিভিন্ন মহল। সম্প্রতি এমন কিছু প্রশ্ন সামনে নিয়ে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর রঈস, মাসিক আলকাউসারের সম্পাদক মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ছাহেবের একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। এ সাক্ষাৎকারে তিনি করোনা মহামারির অজুহাতে কুরবানী স্থগিত রাখা, কুরবানীর বিকল্পপ্রস্তাব, ইবাদতের বিকল্পদাবিতে অহেতুক যুক্তিতর্ক ইত্যাদির জবাব দিয়েছেন এবং কুরবানী নিয়ে ফিকহী কিছু প্রশ্নেরও মীমাংসামূলক আলোচনা পেশ করেছেন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন, মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ]

 

আলকাউসার : বর্তমানে বিশ্বজুড়ে যে করোনা পরিস্থিতি চলছে- এর ওপর ভিত্তি করে একশ্রেণির লোকজন গণমাধ্যমে এমন বক্তব্য দিতে শুরু করেছেন যে, এ পরিস্থিতিতে ঈদুল আযহার কুরবানী করা উচিত নয়; বরং এ মহামারির সময় সংক্রমণ থেকে বাঁচতে কুরবানী থেকে বিরত থাকা উচিত। এ বিষয়ে ইসলামী শরীয়তের দিকনির্দেশনা আসলে কী?

মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ : কুরবানী ইসলামের শিআরসমূহের অন্যতম। শিআর বা শাআইর বলা হয়, ইসলামের মৌলিক নিদর্শনগুলোকে। দেখুন, ইসলামের তো কোনো বাহ্যিক অবয়ব নেই। ইসলাম প্রকাশ পায় তার নিদর্শনসমূহের মধ্য দিয়ে। মসজিদ, নামায, রোযা, রমযান, রমযানের  রোযা, দুই ঈদ, হজ্ব পালন, যাকাত প্রদান, কুরবানী করা- এজাতীয় মৌলিক নিদর্শন ও আলামতগুলোর মধ্য দিয়ে ইসলামের রূপ ও অবয়বটি প্রকাশ পায়। এই শিআরগুলোর অন্যতম হল, আলউযহিয়্যা তথা কুরবানী। কুরবানী এমন একটি ইবাদত যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরতের পর যখন থেকে কুরবানী করা শুরু করেন, তারপর থেকে আর কখনো বাদ দেননি। অর্থাৎ কোনো ঈদুল আযহার সময় কুরবানী না করে থাকেননি। যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশ দিনের অনেক ফযীলতের কথা হাদীস শরীফে আছে। যিলহজ্বের নবম তারিখের রোযার ফযীলত সম্পর্কে বলা হয়েছে, আগের এক বছর ও পরের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। কিন্তু যিলহজ্বের দশম তারিখ বা ইয়াওমুন নাহর সম্পর্কে বলা হয়েছে- এই দিনটিতে কুরবানী করার চেয়ে উত্তম আমল আর নেই।

কুরবানী বা উযহিয়্যা ইসলামের অন্যতম প্রতীক। কুরবানীর ইতিহাস সম্পর্কে যারা জানেন, তারা এর উৎসের ঘটনাটি সম্পর্কেও অবগত। আল্লাহ তাআলা তাঁর খলীল হযরত ইবরাহীম আ.-কে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁর ছেলেকে কুরবানী করার জন্য। তিনি তাঁর হুকুমের সামনে সমর্পিত হয়েছিলেন, সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছিলেন এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তখন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে কুরবানীর জন্য পশু যবেহ করার নির্দেশ আসে। সেখান থেকেই পশু কুরবানী করার বিধান এসেছে। এই কুরবানী অনেক গুরুত্বপূর্ণ আমল ও ইবাদত। এটি কোনো সাধারণ পর্যায়ের নফল আমল কিংবা সাধারণ পর্যায়ের সুন্নত আমল নয় যে, সুযোগ হলে পালন করলাম, মনে চাইল না- পালন করলাম না। কুরবানীর ইবাদতটি এমন নয়।

এই ঈদের নামই দেওয়া হয়েছে- ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদ। ইসলামের দুটি ঈদের প্রথমটি হচ্ছে ঈদুল ফিতর, যা রমযানের পর পহেলা শাওয়াল আদায় করা হয়। এটা এক দিন। আর দ্বিতীয়টি ঈদুল আযহা। ঈদুল আযহার সময়কাল তিন দিন। একে বলে, আইয়ামুল আযহা। কুরবানীর ঈদের জন্য এই তিন দিন মেয়াদ নির্ধারণেরও একটি হেকমত এটি যেপৃথিবীর সব অঞ্চলের মুসলমানরা যেন প্রথম দিন না পারলে দ্বিতীয় দিন, দ্বিতীয় দিন না পারলে তৃতীয় দিন হলেও কুরবানী আদায় করতে পারেন।  কুরবানী করতে পারার সুবিধার্থেই এই ঈদে দিনের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ থেকেও কুরবানীর আমলের গুরুত্ব বুঝে আসে।

প্রশ্ন : কুরবানী কিংবা বিভিন্ন ইবাদত সম্পর্কে যারা নিজেদের মতো করে মতামত দিয়ে থাকেন, আপনার দৃষ্টিতে তাদের এসব মতামতের ফলাফল বা সঙ্কটের রূপটি কেমন?

উত্তর : কুরবানী নিয়ে যারা ভিন্ন কথা বলতে চান কুরবানীর ইতিহাস, এর প্রাণ, এ ইবাদতের তাৎপর্য নিয়ে তাদের ভেবে দেখা উচিত। একইসঙ্গে সব ইবাদতের বিষয়েই তাদের গভীরভাবে জেনে-বুঝে কথা বলা উচিত। এ ধরনের উদ্ভট মতামত দিতে গিয়ে যারা ফরয নামায, রমযান-রোযা, যাকাত-হজ্ব নিয়ে কথা বলতে চান তাদের সতর্ক হওয়া উচিত। এসব ইবাদতের ক্ষেত্রে বিকল্প পথ দেখিয়ে দেওয়া চিন্তার ক্ষেত্রে একটা সর্বাত্মক নৈরাজ্য উসকে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে এবং করতে পারে। যেমন দেখুন, নামাযের ব্যাপারে কোনো বুদ্ধিজীবীযদি বলে দেন- নামাযের উদ্দেশ্য তো আল্লাহকে স্মরণ করা, তো এর জন্য কষ্ট করে মসজিদে গিয়ে পদ্ধতিগতভাবে সব বিধি-বিধান পালন করে নামায পড়ার কী দরকার! ঘরে বসে একটু ধ্যান করে নিলে অথবা এক-দু শ বার কিংবা এক-দুই হাজার বার আল্লাহর যিকির-তাসবীহ পড়ে নিলেই তো হয়- সেই বুদ্ধিজীবীর কথা আপনি কীভাবে নেবেন! তার এই কুমতামত কি গ্রহণ করা আপনার উচিত হবে? একইভাবে হজ্ব-ওমরা নিয়েও কারো কারো মতামত এমন থাকতে পারে- কষ্ট করে এত অর্থ খরচ করে মক্কায় যাওয়ার কী দরকার, টাকাটা গরিবদের মধ্যে দান করে দিলেই তো হয়। দুঃখজনক হল, হজ¦-ওমরা নিয়ে কেউ কেউ এমন কথা এখন বলেও থাকে। তো ইবাদত নিয়ে বুদ্ধিজীবীদেরএসব অন্তঃসারশূন্য ও নৈরাজ্যকর মতামতের কোনো মূল্য নেই। এবং তাদের এসব মতামতের পেছনে কোনো সুফল বা সদুদ্দেশ্যও নেই।

প্রশ্ন : আমাদের সমাজে একশ্রেণির লোক ইসলামের বিভিন্ন আর্থিক ইবাদত সম্পর্কে বিকল্পকিছু করার বুদ্ধিজীবী মতামতও যুক্তিতর্ক তুলে ধরে থাকেন। এবার কুরবানী না করে বিকল্প কিছু করার প্রস্তাবও তারা দিচ্ছেন নানা রকম যুক্তিতর্কের মাধ্যমে । এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

উত্তর : কুরবানী না করে অন্য খাতে টাকা খরচ করার এজাতীয় উদ্ভট বিকল্প প্রস্তাবআমরা শুধু এবছরই দেখছি না, প্রায় প্রতি বছরই এজাতীয় আওয়াজ শোনা যায়। অথচ এজাতীয় প্রস্তাব উত্থাপনকারীদেরকে সংকটগ্রস্ত মুসলমানদের নিয়ে কখনো কথা বলতে দেখা যায় না। ব্যক্তিগত জীবনে ইসলাম পালনেও তাদের অনেকের কোনো আগ্রহ বা অনুশীলনের নজির পাওয়া যায় না। কিন্তু দেখবেন, কুরবানী নিয়ে বুদ্ধিজীবী মতামতদিতে এরাই চলে আসেন গণমাধ্যমে। তাদের চরিত্র ও বক্তব্যে এসব বিষয় মিলিয়ে দেখলে এদের উদ্দেশ্য ও মতামতের ফাঁকটা ধরতে পারবেন। এসব প্রস্তাব ও যুক্তিতর্কের অবতারণার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষকে দ্বীন থেকে, ইসলামের শিআর থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার গভীর একটা পাঁয়তারা। তবে এসব পাঁয়তারা চালিয়ে তারা অতীতে সফল হয়নি, ভবিষ্যতেও ইনশাআল্লাহ সফল হতে পারবে না। এসব মতলবী যুক্তিতর্কের পরেও শিআরে ইসলাম ঠিক থাকবে। কোনো রকম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যুক্তিতর্কে বিশ্বাস করে এসব ইবাদতে মুসলমানরা কোনো ছাড় দেবেন না ইনশাআল্লাহ।

কোনো ব্যক্তির প্রতি বিশেষ কোনো মনোযোগ দিয়ে নয়, সাধারণভাবেই বলতে চাই যে, যারা এমন মনে করেন যে, হজ্বের বিকল্প হিসেবে টাকা দান করে দেওয়া যায়, কুরবানীর বিকল্প হিসেবে গরিব মানুষকে অর্থ দান করে দেওয়া যায়, তারা দ্বীনী বিষয়ে নিতান্তই মূর্খতা থেকে এমন ভাবনা ভেবে থাকেন এবং এজাতীয় কথা বলে থাকেন। তারা জানেন না- কুরবানী বা উযহিয়্যার হাকীকত ও প্রাণ কী? কুরবানীর শিক্ষার যে প্রাণ, তা সাধারণ স্তরের জ্ঞান ও চিন্তার ঊর্ধ্বের একটি বিষয়। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার নির্দেশে ইবরাহীম আ. তাঁর সন্তানকে যবেহ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। এমন কাজ কে কার হুকুমে করতে পারে! বাহ্যিক চিন্তাশক্তির ঊর্ধ্বের একটি বিষয়। খালেক আল্লাহর হুকুমের সামনে আনুগত্য প্রকাশ করেছেন ইবরাহীম আ.। কোনো কিন্তু, কেন, কীভাবে- এজাতীয় প্রশ্নের মধ্যে তিনি পড়েননি, বরং আল্লাহ তাআলার হুকুমের সামনে একনিষ্ঠতার সঙ্গে আত্মসমর্পণ করেছেন। ছেলে ইসমাঈল আ.-ও ছিলেন নিবেদিত বান্দা ও ধৈর্যের পাহাড়। তিনিও কুরবানী হওয়ার জন্য নিজেকে পেশ করেছেন; আল্লাহ তাআলার পরীক্ষায় তাঁরা উত্তীর্ণ হয়েছেন। পরে কুরবানীর জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে পশু বরাদ্দ হয়েছে। এখন আমাদের জন্য সহজ হয়েছে কুরবানীর আমল। নিজের বা নিজের সন্তানের জীবন বিলিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে পশু কুরবানী করতে পারছি। কুরবানী করার পক্ষের সত্য ও সঠিক যুক্তি অনেক। দ্বীনী যুক্তি ও প্রেরণা রয়েছে। অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে, রয়েছে বিভিন্ন যৌক্তিক বিশ্লেষণ। কেউ কেউ অবশ্য বাহ্যিক-সামাজিক অন্য যুক্তিগুলোর কথা এরই মধ্যে গণমাধ্যমে বলেছেন। আমি তাদেরকে মোবারকবাদ জানাই। তবে আমি বলব, কুরবানীর পক্ষে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য যুক্তিগুলোর প্রসঙ্গ পরের ব্যাপার, প্রধান বিষয় হচ্ছে, আমার খালেক-স্রষ্টা আল্লাহ তাআলার নির্দেশ মান্য করা। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَ انْحَرْ

...সুতরাং তুমি তোমার রবের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর। -সূরা কাউসার (১০৮) : ২

মুফাসসিরীনে কেরাম বলেছেন, এই আয়াতের মর্ম হচ্ছে, ‘ঈদের নামায পড়ুন এবং কুরবানী করুন।আমাদের নবী, ইনসানিয়াতের রাহবার হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে কুরবানী করেছেন, মানুষকে কুরবানী করতে নির্দেশ দিয়েছেন।

আমাদের জন্য কুরবানীর বিধান, প্রেরণা ও প্রাণের এসব ইতিহাস ও প্রেক্ষাপটই যথেষ্ট। আরোপিত কটতর্কের দিকে মনোযোগ দেওয়ার কোনো আগ্রহ আমাদের নেই। আমাদের দ্বীন ও শরীয়তের অনুসারী বড় বড় ব্যক্তিত্বের মাঝে যুক্তি-তর্ক ও ফালসাফার যোগ্যতা ছিল অনেক বেশি, এখনকার যুক্তি ও তর্কবিদেরা তাদের ধারেকাছেও যেতে পারবে না, কিন্তু দ্বীনের বরেণ্য সেই মনীষীরা কুরবানীর বিকল্পপ্রস্তাবনার যুক্তি-তর্কে যাননি এবং প্রয়োজনও মনে করেননি। কারণ, তারা জানতেন, শরীয়তের মেযাজ কী। তারা জানতেন আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের নির্দেশের মহত্ব কী। এজন্য আমার অনুরোধ, কুরবানীসহ বিভিন্ন ইবাদতের বিকল্পপ্রস্তাব যারা করতে চান, তারা এসব প্রস্তাব করা থেকে বিরত হোন। প্রতি বছর হজ্ব -কুরবানী নিয়ে আপনাদের এসব উদ্ভট চিৎকারে মানুষ কান দেয় নাদেবেও না। আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই যে, কুরবানীর  ক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার কথা, তাঁর প্রিয় রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ও আমলকেই মুসলমানরা অনুসরণ করবেন, অন্য কোনো কূটযুক্তিতে তারা কান দেবেন না। কুরবানী-হজ্ব ইত্যাদি ইবাদতের অর্থ গরিবের মাঝে দান করে দেওয়ার বিকল্পপ্রস্তাব না দিয়ে তারা বরং ইসলামে দানের যে স্বতন্ত্র বিধান রয়েছে, সেটার ওপর আমল করুন। কুরবানী বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা না করে সেই নফল দান তাদের করতে দেখা যায় না কেন? বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে বিত্তবানের হার দ্রুত বর্ধনশীল, এমনকি সাম্প্রতিক প্রচার পাওয়া আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী তা বিশ্বের অন্য যে কোনো রাষ্ট্রের চেয়ে ঊর্ধ্বগামী। আবার অপর দিকে বলা হচ্ছে, নতুন করে দেড় কোটি লোক গরিব হয়ে যাচ্ছে। তো এই বিত্তবানদের কিছু অর্থ গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দিলেই  তো দারিদ্র্য সংকটের সমাধান হওয়ার কথা। মানুষের কুরবানী আটকে দেয়ার প্রস্তাব করার প্রয়োজন কী! দেশের অসংখ্য মিলিয়নার-বিলিয়নারদের কিছু টাকা দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দিলেই তো দারিদ্র্য সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে। যেসব বিত্তবানের প্রচারযন্ত্রে বসে কুরবানী না করে কুরবানীর টাকা গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার বুদ্ধিজীবীসুলভপরামর্শ বিতরণ করা হয়- এসব প্রচারযন্ত্রের মালিকদের টাকার ভাণ্ডার থেকে কত টাকা গরিবদের দান করা হয়- এসব প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের মনে মনে ঘুরছে।

কুরবানী কিংবা অন্য কোনো  ইবাদতের অর্থ গরিবদের খাতে দেওয়ার প্রস্তাবনার প্রয়োজন নেই, ইসলামের বিধানেই যাকাত-সদাকাসহ সাধারণ দানের বহু খাত বরাদ্দ আছে, নির্দেশনাও আছে। বিত্তবান নাগরিকদের উদ্যোগে এবং রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্য থেকে সেসব খাতে দান করতে হবে। ইসলামী অনুশাসন যথাযথভাবে অনুসরণ করলে গরিবকে সহযোগিতা করার যেসব উৎস ও খাত রয়েছে তারা সে সম্পর্কে জানতে পারবে। আমাদের পাঠকরা জেনে থাকবেন, বাজেট আলোচনার সময়ও আমরা বলেছি, ইসলামে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য আলাদা খাত বরাদ্দ আছে, এর জন্য কুরবানীর খাতের টাকার দিকে চোখ দেওয়ার দরকার নেই। ইসলামী অনুশাসন নিয়ে পড়াশোনা করলে এবং তা অনুশীলন করার আগ্রহ থাকলে ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতামূলক অনেক নির্দেশনা পাওয়া যাবে। খালেকের হুকুমের সামনে কোনো যুক্তিতর্ক ছাড়া মাখলুকের আত্মসমপর্ণের সবক দেয় কুরবানী। কুরবানীর এ প্রাণ ও তাৎপর্যের সামনে অন্য কোনো যুক্তিতর্কের কোনো অবস্থান থাকতে পারে না।

প্রশ্ন : বর্তমানে কেউ কেউ এমনও আছেন, যারা করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে সতর্কতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ভাবনা থেকেই এবছর কুরবানী না করার কথা ভাবছেন অথবা বলছেন; তাদের এই ভাবনা নিয়ে আপনি কিছু বলবেন? বর্তমান পরিস্থিতিতে কি কুরবানীর ক্ষেত্রে কোনো শিথিলতার সুযোগ রয়েছে?

উত্তর : এক্ষেত্রে বলতে চাই, বর্তমান পরিস্থিতিতেও সুন্দরভাবে কুরবানী আদায় করা সম্ভব এবং বর্তমান পরিস্থিতিতেও কুরবানীর হুকুম বহাল আছে। দেশের উলামায়ে কেরামও এ কথাগুলো বলেছেন। ঢাকা মোহাম্মাদপুরে একটি এপার্টমেন্ট এলাকায় কুরবানী এবং কুরবানীর উযহিয়্যাহ (প্রাণী) প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার খবর আসার পর তার প্রতিবাদ করে উলামায়ে কেরাম স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, এ পরিস্থিতিতেও কুরবানীর হুকুম মুসলমানদের ওপর বহাল আছে। আমিও মনে করি, উলামায়ে কেরামের এই মতামত ও অবস্থান যথাযথ।

একটি ব্যাপার দেখুন, গোটা পৃথিবীতেই কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রা এখন সচল। কঠোর লকডাউনে মানুষ কিছুদিন আবদ্ধ ছিল। এখন সবকিছুই অনেকটাই স্বাভাবিকভাবে চলছে। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের মধ্যে নানা কারণে তাকে চলতে হবে, হচ্ছেও তাই। যার অঢেল সম্পদ আছে অথবা যারা অতিরিক্ত ভীতি বা আতঙ্কে ভুগছে, তারা হয়ত ঘরবন্দি সময় পার করছে। কিন্তু এখন বেশিরভাগ মানুষ নিজ নিজ কাজে সক্রিয়। মহামারি থেকে শিক্ষাও নিতে হবে, আল্লাহ্মুখী হতে হবে এবং হালাল জীবন-জীবিকার কাজেও যুক্ত হতে হবে। এখন সেটাই হচ্ছে। ভয়ে-আতঙ্কে বিভিন্ন দেশে যারা কঠোর লকডাউন দিয়েছিল তারাও স্বাভাবিক জীবনে চলে এসেছে। রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তবুও জীবনযাত্রা থেমে নেই। কিন্তু জীবনযাত্রার এই স্বাভাবিক ধারার মধ্যেও ধর্মীয় বিষয়ে এসে অতি সতর্কতা ও আতঙ্কের কথাগুলো বেশি বলা হচ্ছে। এ নিয়ে অনেক হাস্যকর ঘটনাও ঘটছে। ইস্তেফতা-ইফতার দায়িত্বে থাকার কারণে আমাদের কাছে মানুষের বিভিন্ন চিত্র ও প্রশ্ন আসে।

এমন কথা প্রায়ই শোনা যাচ্ছে যে, বাজারে যাচ্ছে ভিড় করে, হোটেলে বসে খাওয়া-দাওয়া করছে মানুষের সঙ্গে মিলে মিশে, কিন্তু মসজিদে এসে তিন ফিট দূরত্বে দাঁড়ানো নিয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করছে; কেউ কাছে এসে দাঁড়ালে রেগে যাচ্ছে। এমনটা ঘটছে ধর্মীয় বিষয়ে অতিরিক্ত ভীতি ছড়িয়ে দেওয়ার কারণে। এ চিত্রটি অনেকটা ডায়াবেটিসের রোগীর  পেটভরে মিষ্টি খাওয়ার পর চায়ে চিনি না দেওয়ার ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বনের মত হয়ে গেছে। এরকমই বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন এলাকায়, বিভিন্ন এপার্টমেন্টে দেখা গেছে, মসজিদে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছে। নিয়মিত জামাতে নামায আদায়কারী অনেক মানুষ কান্নাকাটি পর্যন্ত করেছে। এভাবে কুরবানীর ক্ষেত্রেও নানারকম নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ধর্মীয় বিষয়ে এভাবে বাধাদান ন্যক্কারজনক ও ধৃষ্টতাপূর্ণ কাজ। যিনি মসজিদে যেতে চাচ্ছেন, যিনি কুরবানী করতে চাচ্ছেন, তাকে তা করতে দিন। আপনার ভয় ও শঙ্কা বেশি থাকলে আপনি তার সঙ্গে মিশবেন না, তার বাসায় যাবেন না, তার থেকে দূরত্ব রক্ষা করে চলবেন। তাকে বাধা দেবেন কেন?

এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও যেহেতু সবকিছু সচল, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত চালু, সুতরাং স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কুরবানী করুন। এটা খুব ভালোভাবেই সম্ভব। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং শরীয়তের গণ্ডির মধ্যে থেকে সতর্কতা অবলম্বনে ইসলামের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। কুরবানী স্বাস্থ্যবিধি মেনে আদায় করা সম্ভব। কুরবানীর সময় গায়ে গায়ে লেগে থাকার তো দরকার নেই। জবাইয়ের সময় তিন-চারজন লোকের সহায়তার দরকার হয়। প্রয়োজনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক পরে তারা কাজে সহায়তা করুক। এরপর থাকে গোশত বানানোর কাজ। সেটাও স্বাস্থ্যবিধি মেনে করা সম্ভব। লকডাউনের পর থেকে গোশত বানানো, বিক্রি ও কেনা কি বন্ধ ছিল? করোনার ভয়ে গরু-ছাগল যবেহ বা এসবের গোশত কেনাবেচা তো বন্ধ হয়নি। ঐ বিতর্ক উত্থাপনকারীগণ কি এ কয়মাস গোশত খাওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। তখন তো তারা এগুলোর প্রসেসের সাথে জড়িতদের বিষয়ে চিন্তা করেননি। এখন কুরবানীর সময় এ নিয়ে অতিরিক্ত সতর্কতা ও ভীতির কথা কেন বলা হচ্ছে? এতদিন যদি এসব ক্ষেত্রে সংক্রমণের ভয় কাজ না করে থাকে, এখন কেন করবে?

হাঁ, স্বাস্থ্যবিধি মানা ও উদাসীন না থাকার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা যেতে পারে। তারপরও যাদের অসুস্থতা আছে, কিংবা যারা অতিরিক্ত আতঙ্কিত তারা নিজের বাসায় না করেও তো অন্য কোনো ব্যবস্থাপনায় কুরবানী করতে পারেন। দূর থেকে বিভিন্ন সংস্থা, দ্বীনী প্রতিষ্ঠান, গরিব আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে কুরবানী করিয়ে নিতে পারেন। তবে দূর থেকে এভাবে কুরবানী করানোর কথাটা সবার জন্য বলছি না, এটাকে ব্যাপক পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করা ঠিক নয়; এ পদ্ধতি শুধু তাদের জন্য, যারা বেশি আতঙ্কিত। তারা চাইলে দূর থেকেও কুরবানী করিয়ে নিতে পারেন।

স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলে সবকিছু আগের মতো করে চললেও কুরবানী এবং ইবাদতের ক্ষেত্রে নানারকম নিয়ন্ত্রণ এসে যুক্ত হতে দেখা যাচ্ছে। খবরে এসেছে, পশুর হাটের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাস্তাঘাট আটকে পশুর হাট করা উচিত নয়; স্বাভাবিক সময়েও নয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে হাটের সংখ্যা না কমিয়ে বড় বড় মহল্লাগুলোর বিভিন্ন মাঠে নির্দিষ্টসংখ্যক পশু নিয়ে হাট বসালে বেশি ভালো হত। হাটে ভিড় কম হত, দূর থেকে হাটে যাওয়া-আসা করা লাগত না।

ঈদুল ফিতরের নামাযের ক্ষেত্রেও যে ব্যবস্থাপনার কথা এসেছে, এবারের ঈদেও সেটি এসেছে। সবাইকে মসজিদে গিয়ে ঈদের নামায পড়তে হবে; মাঠে পড়া যাবে না। অথচ ঈদের মাঠ খোলা রাখলে বেশি ভালো হত। কারণ, মসজিদগুলোতে প্রবেশ ও ওঠা-নামার সময় ভিড় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যেটা মাঠে থাকে না। মাঠ থাকে অধিকতর ফাঁকা। সেখানে চারদিক থেকে ভিড় করা ছাড়াই মানুষ সমবেত হতে পারত। বাহ্যিকভাবে যতটুকু বোঝা যায়, করোনা পরিস্থিতিতে ঈদের নামাযের জন্য ঈদের মাঠগুলো উন্মুক্ত রাখলে সেটাই বেশি উপযোগী হত। মসজিদেও মুসল্লির চাপ কমত।

আর কেউ কেউ কুরবানীর সময় কুরবানী-পরবর্তী পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে কথা বলছেন। এটা ইসলামেরই প্রেরণা। অন্য সবকিছুর সাথে নিজের আঙিনাও পরিচ্ছন্ন রাখা। কুরবানী যারা করবেন সবারই নৈতিক ও দ্বীনী দায়িত্ব- কুরবানীর পর যার যার স্থান পরিচ্ছন্ন করে ফেলা। এক্ষেত্রে সমাজপতি ও সরকারের দায়িত্বশীলেরাও বড় ভমিকা রাখতে পারেন। মানুষকে বারবার সচেতন করা ও দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু কোনো অজুহাতেই কুরবানী বন্ধ রাখা বা স্থগিত রাখার চিন্তা করার সুযোগ নেই।

প্রশ্ন : কেউ কেউ মনে করেন, এই মহামারি ও সংকটের সময়ে কুরবানী না করে টাকাটা দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিলে তাদের উপকার হত, দারিদ্র্য কমত। এ বিষয়ে আপনার কোনো বক্তব্য?

উত্তর : এ প্রশ্নের উত্তর আগেই চলে এসেছে। তারপরও বলছি, কুরবানীর টাকা বিলিয়ে দিলেই কি দারিদ্র্যের সংকট দূর হয়ে যাবে? ভেবে দেখা দরকার, কুরবানীর টাকা কি এ সংকটের সমাধান, নাকি দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলামের যে স্বতন্ত্র দিকনির্দেশনা রয়েছে- সেই পদ্ধতিতে কাজ করা প্রয়োজন। লকডাউন শুরু হওয়ার পর অনেকেই এজাতীয় সেবার উদ্যোগ নিয়েছেন। বহু মানুষ সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছেন; যদিও দেশের দরিদ্র মানুষের অনুপাতে এ সাহায্যের পরিমাণ খুবই কম ছিল। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ও নাগরিক পর্যায়ে আরো বড় পরিসরে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। কিন্তু ইবাদতের (কুরবানীর) অর্থতো সেক্ষেত্রে বিকল্প হতে পারে না। বরং দারিদ্র্য বিমোচনে শরীয়তের যে নীতি, ইসলামী অর্থনীতির যে নির্দেশনা এবং আকস্মিক দারিদ্র্য ও দুর্যোগ নেমে এলে শরীয়ত সেক্ষেত্রে যেসব পদক্ষেপ নিতে বলে- সেই নীতি অনুসরণ করতে হবে।

প্রশ্ন :  দেশের বাইরে থেকে একজন চিকিৎসক দাবি করেছেন, দেশের মানুষ এখন যুদ্ধ পরিস্থিতিরমধ্যে আছেন। তার প্রশ্ন, যুদ্ধের সময় কি ইসলাম কুরবানীর কথা বলে?

উত্তর : এ প্রশ্নটি আসলে উত্তর দেওয়ার মতোই নয়। করোনার সাথে যুদ্ধের কথা হয়ত তিনি বলছেন। একটি মহামারির সাথে এসব শব্দ তারা ব্যবহার করেন কীভাবে? যারা এমন শব্দ ব্যবহার করেন, তাদের সৈন্য-সামন্ত কত রয়েছে! তিনি যে দেশে বসবাস করেনওইসব শক্তিধর দেশগুলোই তো ব্যর্থতা স্বীকার করে বসে আছে। আগেও এমন সব শব্দ অনেকে ব্যবহার করেছেন, আশা করি তারা এখন লজ্জিত হয়েছেন।

এটা কি যুদ্ধ, নাকি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আসা একটা মহা পরীক্ষা বা শাস্তি? আমরা তো সেরকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সে পরিস্থিতির মধ্যে দ্বীনী ও দুনিয়াবি দৃষ্টিকোণ থেকে কী কী করণীয়- সেটা হল দেখার বিষয়। মূল কথা হল, এজাতীয় পরিস্থিতিতে কুরবানীর ক্ষেত্রে ছাড় নেই। অপরদিকে যেসব ক্ষেত্রে অসামর্থ্যের ব্যাপার আছে, বড় সমস্যা বা প্রতিকলতা আছে, সেখানে কিন্তু শরীয়তের পক্ষ থেকে কোনো চাপ বা বাধ্য-বাধকতা নেই। যেমন, আপনি ধনাঢ্য ব্যক্তি, কিন্তু আছেন সফরে, সেক্ষেত্রে আপনার ওপর কুরবানীর হুকুম পালন করা আবশ্যকীয় নয়। আর্থিক সামর্থ্য থাকার পরও আপনার অসুবিধার দিক শরীয়ত বিবেচনা করে। এজন্যই বলছি, ইসলামী শরীয়তের কোনো বিধান ও ইবাদতের ব্যাপারে এজাতীয় বুদ্ধিজীবীসুলভমন্তব্য ও মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং আমাদের দায়িত্ব হল, কুরআন ও হাদীস আমাদের যে নির্দেশনা দেয়, সেই নির্দেশনা মেনে চলা।

প্রশ্ন : সংকটকালে কুরবানীর গোশত বণ্টনে বিশেষ কোনো নিয়ম বা বিধি অনুসরণের বিষয় আছে কি?

উত্তর : হাদীস শরীফে দেখা যায়, একবার তিন দিনের বেশি গোশত সংরক্ষণ করতে নিষেধ করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সংরক্ষণ না করার সে হুকুম রহিত করা হয়েছে। কুরবানীর গোশতের ক্ষেত্রে এটা হল শরীয়তের সাধারণ নির্দেশনা। কিন্তু সমাজে দারিদ্র্যের মাত্রা বেশি হলে, সংকট বিরাজ করলে আমরা আগের ওই হাদীস, যেখানে তিন দিনের বেশি গোশত সংরক্ষণ করতে নিষেধ করা হয়েছে, সেই হাদীসের মর্মের দিকে লক্ষ্য রেখে বলতে পারি, কুরবানীদাতাদের জন্য উচিত, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের প্রতিবেশী, নিকটস্থ আত্মীয়-স্বজন যারা কুরবানী দিতে পারছেন না, তাদের প্রতি লক্ষ রাখা এবং অধিক পরিমাণে কুরবানীর গোশতের হাদিয়া বা তাদের অংশ তাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া। তবে এক্ষেত্রেও বিষয়টিকে ওয়াজিব না বলে উৎসাহমূলক বলতে হবে।

প্রশ্ন : কুরবানীর সাথে দেশের অর্থনীতির সম্পর্ক কতটুকু? কুরবানী আমাদের অর্থনীতিতে কতটা প্রভাব রাখে বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর : বলার অপেক্ষা রাখে না, কুরবানীর সাথে আমাদের দেশের অর্থনীতির একটি বড় ও বিশাল অংকের সম্পর্ক রয়েছে। যারা কুরবানীর বিকল্পপ্রস্তাব করছেন, তারা এ বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন বলে মনে হয় না। কুরবানীর আগেই পত্র-পত্রিকায় পরিসংখ্যান এসেছে যে, গোটা দেশে খামারীরা যতসংখ্যক গরু এবার পালন করে বাজারে তোলার উপযোগী করেছেন, সে সংখ্যাটা কুরবানীর জন্য বিরাজমান চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি। এর সঙ্গে লাখ লাখ দরিদ্র খামারীর আয় ও সঞ্চয়ের বিষয় জড়িত। এবার কুরবানী না করার প্রস্তাব যারা দিয়েছেন, তারা এই লাখ লাখ দরিদ্র খামারী পরিবারগুলির জন্য কি কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন? খামারীদের মধ্যে এমন অনেকেই রয়েছেন, যারা ২/৩ টি গরু পুরো পরিবার মিলে লালন পালন করে বড় করেন- এই কুরবানীর মৌসুমে বিক্রির জন্য। কুরবানী স্থগিত করে দিলে তাদের কী ব্যবস্থা হবে! এজন্য এটা পরিষ্কার যে, কুরবানীর সঙ্গে দেশের অর্থনীতির একটা বিশাল সম্পর্ক বিদ্যমান। এছাড়া চামড়া ও চামড়াশিল্পের সাথে জড়িত লক্ষ লক্ষ লোকের জীবিকার বিষয়টি তো রয়েছেই। দেশের প্রখ্যাত চিকিৎসক ডাক্তার এবিএম আব্দুল্লাহ্ও তার এক নিবন্ধে কুরবানীর বিধান পালন এবং এর সাথে দেশের অর্থনীতির সম্পর্ক নিয়ে ইতিবাচক কথা বলেছেন। তাকে মোবারকবাদ জানাই। তবে আমরা মনে করি, কুরবানীর ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান ও মূল বিবেচনার বিষয় হচ্ছে, খালেকের হুকুমের সামনে বান্দার আত্মসমর্পণের চেতনা এবং শরীয়তের এক শিআর ও নির্দেশনা মান্য করার প্রেরণা। অর্থনীতির প্রসঙ্গটি এই প্রেরণার অনুগামী; এই প্রেরণার সঙ্গে যুক্ত- পরবর্তী পর্যায়ের বিষয়।

প্রশ্ন : কুরবানী নিজেরা না করে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে করানোর কোনো সুযোগ আছে কি? ওইসব সংস্থা অনেকসময় গোশত গরিবদের মাঝে বিতরণ করে দেয়, অনেকসময় কিছু অংশ কুরবানীদাতার কাছেও পৌঁছে দেয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে এমন সংস্থার সাহয্যে কুরবানী করা যাবে কি?

উত্তর : এ পদ্ধতি বিভিন্ন বিত্তবান রাষ্ট্রে চালু আছে। সেখানে ব্যাপকভাবে যার যার বাসায় কুরবানী করার বা পশু যবেহ করার সুযোগ নেই। মুসলমান কসাইদের সহযোগিতায় অথবা বিভিন্ন সংস্থা বা গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সেসব দেশের মুসলমানরা কুরবানী করেন। সেখানে যেহেতু নিজের আয়ত্বে স্বাধীনভাবে কুরবানী করার অবকাশ নেই, সেসব দেশে তো এভাবে চলবে। কিন্তু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে এজাতীয় ব্যবস্থাপনা থাকলেও সেটার ব্যাপক চর্চা বা অনুশীলন হওয়া উচিত নয়। কিছু সংস্থা থাকুক, যারা নিজেরা পারিবারিক আয়োজনে পারছেন না, নিজেদের ব্যবস্থাপনা নেই, তারা ওই সংস্থার সাহায্যে কুরবানী করবেন। তবে এজাতীয় ব্যবস্থাপনা মুসলিম দেশগুলোতে ব্যাপক হওয়া উচিত নয় বলে মনে করি। কুরবানী শিআরে ইসলাম। এই কুরবানী গোপনে আদায় করে দিলে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে, কিন্তু শিআরে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে বলে মনে করা যায় না। আল্লাহ তাআলার মেহমানদারি (যিয়াফত) হচ্ছে কুরবানী। এই চিন্তা-চেতনা ধারণ করেই যুগযুগ ধরে মুসলমানরা যেভাবে কুরবানী করে এসেছেন, সেভাবেই কুরবানী করতে হবে। বিশেষ কোনো অপারগতা বা বর্তমান পরিস্থিতির সংকট, ভীতি ইত্যাদি কারণ ছাড়া সংস্থার মাধ্যমে কুরবানী করার পদ্ধতিকে ব্যাপক না করা এবং এ পদ্ধতিটি স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ না করা চাই। প্রয়োজনে করলে অসুবিধা নেই। আর প্রবাসীরা সংস্থার মাধ্যমেও কুরবানী করতে পারেন, দেশেও টাকা পাঠিয়ে কুরবানী করতে পারেন।

তবে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে কুরবানী করার ক্ষেত্রে সতর্কতার কিছু বিষয় যেন সবার বিবেচনায় থাকে। প্রথমত, সংস্থাটি এবং সংস্থাটির পরিচালকদের সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। তারা ইসলামের বিধি-বিধান সম্পর্কে অবগত কি না? কুরবানীর মাসায়েল সম্পর্কে অবগত কি না? একইসঙ্গে তারা কুরবানীর মর্ম এবং কুরবানীর প্রতিটি ধাপ সম্পর্কে দ্বীনীভাবে সচেতন কি না। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, সংস্থার মাধ্যমে অনেক কুরবানী হয় শরিকানার ভিত্তিতে। এক ভাগের টাকা আপনি দিলেন, এমন আরো ছয় ভাগের টাকা ছয়জন দেবেন, যাদের সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন না। এখন পরিস্থিতি যদি এমন হয়, ওই একই পশুতে এমন কিছু মানুষের অংশিদারিত্ব থাকে, যাদের কুরবানীর নিয়ত নেই (যেমন, গোশতের জন্য শরীক হওয়া) তাহলে ওই পশুর অন্যান্য অংশিদার কারো কুরবানী কবুল হবে না। সংস্থার মাধ্যমে শরিকানা কুরবানীর ক্ষেত্রে এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এজন্যই আমরা বিশেষ অপারগতা তৈরি না হলে ও দায়ে না ঠেকলে সংস্থার মাধ্যমে কুরবানী না করতেই উৎসাহিত করার পক্ষে।

আরেকটি ব্যাপার হল, কুরবানী ও যাকাত- এ দুটি ইবাদতের ক্ষেত্রে সম্প্রতি এমন কিছু সংস্থাকেও উদ্যোগী হয়ে কাজ করতে দেখা যায়, যাদের কর্মকর্তাদের দ্বীন-ধর্মের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই, ইসলামের বিধান ও মেযাজ সম্পর্কে যারা অজ্ঞ, এমনকি তাদের ব্যক্তিগত জীবন অনুশীলনেও ইসলামের উপস্থিতি নেই। এসব সংস্থার মাধ্যমে কুরবানী করানো, যাকাত আদায় করা ঝুঁকিপূর্ণ। শোনা যায়, এমন কোনো কোনো সংস্থার কর্মকর্তাদের মধ্যে অমুসলিমও রয়েছে। এজাতীয় দ্বীনী কর্মকাণ্ডে মানবিকতার কথা বলে তারা যুক্ত হয়ে থাকে। আমি বলব, ইসলামের সঙ্গে বাস্তবে সম্পর্কহীন এমনসব সংস্থার মাধ্যমে কোনো ইবাদত পালনের ব্যাপারে মুসলমানদের সতর্ক থাকা দরকার। দ্বীন ও আস্থার সম্পর্ক যাদের সঙ্গে রয়েছে দরকার হয়ে গেলে তাদের সেবা নিন। আর কুরবানীসহ বিভিন্ন আর্থিক আমল প্রধানত নিজ উদ্যোগে পালন করার চেষ্টা করুন।

প্রশ্ন : সংকটময় পরিস্থিতির সুযোগে কেউ কেউ কুরবানী সম্পর্কিত ফিকহী মতবিরোধপূর্ণ কিছু মাসআলার প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে  আসছেন। তারা বলছেন, কোনো কোনো মাযহাবের দৃষ্টিতে কুরবানী করা ওয়াজিব নয়, সুন্নত; হানাফী মাযহাবে শুধু ওয়াজিব। এ বিষয়ে কিছু বলবেন কি?

উত্তর : সাধারণভাবে মতবিরোধপূর্ণ ফিকহী বিষয়ের প্রচার করা আমরা সমীচীন মনে করি না। কারণ, একটি দেশে সাধারণত একটি ফিকহের অনুসরণ করা হয়ে থাকে এবং হাদীস অনুসরণের ক্ষেত্রে একটি ফিকহের ব্যাখ্যা অনুসৃত হয়ে থাকে। ইবনে তাইমিয়া রাহ. থেকে নিয়ে সাম্প্রতিককালের আরব আলেম শায়েখ উছাইমীন পর্যন্ত বহু ফকীহ ও মুহাদ্দিস ফিকহী এই ভিন্নতাকে সহনশীলতার সঙ্গে গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। ফিকহের প্রত্যেক ইমামই গ্রহণীয় ও বরণীয়। ফিকহী মাযহাবগুলো মূলত সুন্নাহ-এর تنوع তথা বিভিন্নতাকেই প্রকাশ করে। একটি দেশে একটি ফিকহ চালু থাকা অবস্থায় আরেকটি ফিকহ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টাটা শোভনীয় নয়। যে দেশে মালেকী বা শাফেয়ী ফিকহ অনুযায়ী মানুষ যুগ যুগ  থেকে আমল করে আসছে সেখানে কোনো হানাফী আলেম গিয়ে নিজ মাযহাব চালু করার চেষ্টা করা বা তাদের আমলের বিপরীত অন্য সুন্নাহর প্রচার শুরু করা কিছুতেই যৌক্তিক হতে পারে না। সব ফিকহ্-ই শাখাগত বিষয়ে কিছু ভিন্নতাসহ ইসলামের গোড়া পর্যন্ত মানুষকে নিয়ে যায় এবং এর সবই ইসলামের সঠিক পথ। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে কোনো কোনো আরব দেশের পৃষ্ঠপোষকতা ও কারো কারো মতে পেট্রোডলারেরপ্রভাবে বিভিন্ন মুসলিম দেশে প্রচলিত ফিকহের বিরুদ্ধাচরণে একদল লোক মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার কাজ করতে চেষ্টা করছেন। এতে শরীয়াহ অনুসরণে নানারকম বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। সম্প্রতি তাদের জোর কিছু কমলেও একদম বন্ধ হয়ে যায়নি। তারাই কুরবানী ওয়াজিব, নাকি সুন্নত- এজাতীয় বিতর্ক সামনে নিয়ে আসতে চাচ্ছেন।

এখানে একটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে, ওয়াজিব এবং সুন্নতের স্তর নির্ধারণ নিয়েও বিভিন্ন মাযহাবে ভিন্নতা আছে। কোনো কোনো মাযহাবে ফরযের পর ওয়াজিবের স্তরই নেই, পরের স্তরটি হচ্ছে সুন্নত। কোনো কোনো মাযহাবে (হানাফী মাযহাব) ফরযের পর ওয়াজিবের স্তর তারপর সুন্নতের স্তর। কিন্তু যেসব মাযহাবে ওয়াজিবের স্তরটি নেই তারাও গুরুত্বপূর্ণ সুন্নতগুলোর ক্ষেত্রে আমল করেন ওয়াজিবের মতই। এর একটি উদাহরণ হল, বিতিরের নামায। এই বিতিরের নামায হানাফী মাযহাবে ওয়াজিব। কিন্তু যেসব মাযহাবে সুন্নত, তাদের ক্ষেত্রেও এটা সাধারণ সুন্নত নয়, বিতির ছুটে গেলে তাদের ফিকহ অনুযায়ীও কাযা করতে হয়। অথচ সাধারণ সুন্নত ছুটে গেলে কাযা করতে হয় না। তার অর্থ হল, বিতিরের নামায তাদের কাছে সুন্নত হলেও সাধারণ সুন্নত নয়। গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। আর সফর অবস্থায় সুন্নত না পড়লেও চলে, কিন্তু বিতিরের নামাযকে যারা সুন্নত বলেন, তারাও বলেন, সফর অবস্থায় বিতিরের নামায ছাড়া যাবে না। দেখুন, শিরোনাম বা পরিভাষা দুটি হলেও আমলের ক্ষেত্রে কাছাকাছি। যারা ওয়াজিব বলছেন এবং যারা সুন্নত বলছেন- আমলের ক্ষেত্রে উভয়েই প্রায় একই রকম গুরুত্ব দিচ্ছেন। এজন্য এসব বিষয়ে ফিকহী মতবিরোধ নিয়ে কথা বলতে গেলে ফিকহ-ফুকাহায়ে কেরামের নীতি ও কর্মপন্থা, উসূল ও জওয়াবিত সম্পর্কে আরা ভালোভাবে পড়াশোনা করে নেওয়া দরকার। শুধু শিরোনামের ভিন্নতা দেখেই স্তর ও আমলের ভিন্নতা নিয়ে কথা বলতে থাকা এবং কোনো একটি বিষয় প্রমাণ করার চেষ্টায় লিপ্ত হওয়া সমীচীন নয়।

কুরবানী করার বিষয়টিকে কোনো কোনো ফিকহে সুন্নতে মুআক্কাদা বলা হয়েছে। কোনো কোনো ফিকহে (ফিকহে হানাফী) ওয়াজিব বলা হয়েছে। কিন্তু আমলের ক্ষেত্রে যারা সুন্নত বলেছেন, তারাও গুরুত্বের ক্ষেত্রে অনেক জোর আরোপ করেছেন। কুরবানীর গুরুত্ব এবং মাসাইলের প্রতিটি ধাপ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনাও করেছেন। আর যদি দলীল দেখেন তাহলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে আপনার কাছে। হাদীসে স্পষ্ট বলা হয়েছে-

مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةٌ، وَلَمْ يُضَحِّ، فَلَا يَقْربَنّ مُصَلّانَا.

সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।-সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১২৩; সুনানে দারাকুতনী, হাদীস ৪৭৪৩ [হাদীসটি মারফ‚’ মাউকউভয়ভাবে বর্ণিত হয়েছে। প্রখ্যাত হাদীসবিষারদ যফর আহমাদ উসমানী রাহ.-সহ বহু মুহাদ্দিস উভয় বর্ণনাকেই সহীহবলেছেন। আর হাদীসের শব্দ ও মর্ম  দেখেও তা মারফ‚’ বলেই মত প্রকাশ করেছেন। (দ্র. ইলাউস সুনান, খ. ১৭, পৃ. ২১২-২২৫)]

হাদীসের ভাষায় কুরবানী না করার ক্ষেত্রে স্পষ্ট ধমকি ও সতর্কবাণী সে ক্ষেত্রেই দেওয়া হয়- যদি আমলটি আবশ্যকীয় হয়। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় কুরবানী শুরু করার পর একবারও বাদ দেননি। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন-

أَقَامَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِالمَدِينَةِ عَشْرَ سِنِينَ يُضَحِّي كُلّ سَنَةٍ.

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার দশ বছরের প্রতি বছরই কুরবানী করেছেন।-জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫০৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৪৯৫

ফিকহের পরিভাষায় নবীজীর এমন নিয়মিত করা আমল সম্পর্কে বলা হয়-

مواظبة النبي صلى الله عليه وسلم

(রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিয়মিত আমল) এই নিয়মিত আমল- এটাও আমলটি ওয়াজিব হওয়ার বা আবশ্যকীয় হওয়ার আলামত। সুনানে তিরমিযীসহ হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস রয়েছে কুরবানী সম্পর্কিত। এক ব্যক্তি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা.-কে জিজ্ঞাসা করলেন-

أَوَاجِبَةٌ هِيَ؟ فَقَالَ: ضَحّى رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ وَالمُسْلِمُونَ، فَأَعَادَهَا عَلَيْهِ، فَقَالَ: أَتَعْقِلُ؟ ضَحّى رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ وَالمُسْلِمُونَ.

কুরবানী কি আবশ্যকীয় আমল? তিনি উত্তর দিলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুসলমানরা কুরবানী করেছেন। লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করলে তিনি এবার বললেন, তুমি কি কিছু অনুধাবন করতে পারছ- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুসলমানরা কুরবানী করেছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫০৬

এখানে দেখা যাচ্ছে, প্রশ্নকারী যে ভাষায় প্রশ্ন করেছেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. অন্য ভাষায় তার উত্তর দিলেন। তিনি নবীজী এবং মুসলমানদের আমলের কথা বললেন। প্রশ্নকারী তখন প্রশ্নটি দ্বিতীয় বার করলেন। তখন ইবনে উমর রা. রাগত ভাষায় বললেন-

أَتَعْقِلُ؟

তুমি কি কিছু অনুধাবন করতে পারছ? তিনি আবার আগের উত্তর দিলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুসলমানরা কুরবানী করে এসেছেন। এখানে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। (ওয়াজিব বা সুন্নত- নাম যাই হোক) কুরবানী মুসলমানদের মাঝে সুন্নতে মুতাওয়ারাছা (নিয়মিত হয়ে আসা আমল) এটা দ্বীনের একটি শিআর। সেজন্যই এই আমলের ক্ষেত্রে এ প্রশ্ন  অবান্তর যে, এটি ওয়াজিব, নাকি ওয়াজিব নয়- তোমার করণীয় তুমি পালন কর। আমরাও সেকথাই বলি।

ওয়াজিব-সুন্নত নাম যা-ই দেন, কুরবানী থেকে পালিয়ে থাকার সুযোগ নেই। ফুকাহায়ে কেরাম পরিভাষা কী ব্যবহার করেছেন, তার চেয়ে বড় ব্যাপার হল মুসলমানদের আমল এবং আমলের توارث বা পরম্পরা দেখা। মাযহাবী পরিভাষার বিতর্কে না গিয়ে আমরা কুরবানীর ক্ষেত্রে সব যুগে মুসলমানদের আমল দেখলে বুঝতে পারব যে, কুরবানী আবশ্যকীয় একটি আমল এবং ইসলামী শরীয়তের একটি শিআর।

প্রশ্ন : ফিকহী আরেকটি প্রশ্নও কেউ কেউ উঠিয়ে থাকেন যে, কুরবানী কি এক পরিবার থেকে একটি, নাকি এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে একটি? এক পরিবার থেকে একটি কুরবানীর কথা বলে তারা হাদীসের একটি ভাষ্যকেও উদ্ধৃত করে থাকেন। এ বিষয়ে কিছু বলবেন?

উত্তর : কুরবানী নিয়ে মৌলিক বিষয়ে আমরা এখানে কথা বলছি। ফিকহী বিতর্কে না যাওয়ারই ইচ্ছা ছিল আমার। প্রশ্ন সামনে চলে আসায় বলতে হচ্ছে যে, যারা এক পরিবারের পক্ষ থেকে এক কুরবানীর কথা বলেন, তারা কুরবানীর সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি বাক্য উদ্ধৃত করে থাকেন যে, একটি কুরবানী দিয়ে রাসূল বলেছেন যে-

مِنْ مُحَمّدٍ وَآلِ مُحَمّدٍ

(এটি মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে এবং মুহাম্মাদের পরিবারের পক্ষ থেকে)

আসলে এই হাদীসের মধ্যেই এধরনের বক্তব্যের জবাব রয়েছে। কোনো কোনো রেওয়ায়েতে রয়েছে-

هَذَا عَنِّي وَعَمّنْ لَمْ يُضَحِّ مِنْ أُمّتِي

এটি আমার এবং আমার উম্মতের যারা কুরবানী করেনি, তাদের পক্ষে থেকে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৮১০; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫২১

পরিবার ও ব্যক্তির বিষয়টি আমাদের দেশের পরিবারগুলোর চিত্র থেকেও বোঝা যায়। সাধারণত একটি পরিবারে প্রধান যিনি উপার্জনক্ষম থাকেন, তিনি থাকেন একজন। অন্যদের ওপর সাধারণত কুরবানী ওয়াজিব হয় না। যেসব মাযহাবে ব্যক্তির ওপর কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার কথা বলা হয়েছে, তারা হয়ত এ চিত্রটির কথাই বলেন। আর হাদীসের শব্দ-

مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةٌ

 এখানে মানশব্দের অর্থ ব্যক্তি, পরিবার নয়। একইসঙ্গে وَلَمْ يُضَحِّ শব্দের মধ্যেও একক ব্যক্তির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সুতরাং দলীলের বিবেচনায় এটা বোঝা যায়, সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর কুরবানী ওয়াজিব। এক পরিবারে একাধিকজন সামর্থ্যবান হলে সবার ওপরই কুরবানী ওয়াজিব।

এখানে উল্লেখ্য, বিভিন্ন সহীহ হাদীসে একটি গরু ও উট সাতজনের পক্ষ থেকে  কুরবানী করার যে বর্ণনাগুলো এসেছে, তাও কুরবানী পরিবারকেন্দ্রিক ওয়াজিব না হয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ বহন করে। দ্বীনী প্রায় প্রত্যেক আমলই ব্যক্তির উপর স্বতন্ত্রভাবে পালনীয়।

আর কোনো কোনো সাহাবী কর্তৃক কুরবানী না করার যে কথা পাওয়া যায়- তার বিভিন্ন ব্যাখ্যাই হতে পারে। ঐ বছর তাদের সামর্থ্য থাকা-না থাকার বিষয়টিও বিবেচ্য। কিন্তু সহীহ হাদীসগুলো এবং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রতি বছর কুরবানী করার বিষয়টি চিন্তা করলেই কুরবানীর গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে যাবে।

যাহোক, আমরা মাযহাবকেন্দ্রিক বিতর্কে এখানে যেতে চাইনি, কিন্তু কেউ হাদীস থেকে এবিষয়ের দলীলগুলো সবিস্তারে পড়লে তা অনুধাবন করতে পারেন। এখানে এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ নেই। এখানে কুরবানী করা-না করার যুক্তির প্রেক্ষাপটে মৌলিক কিছু আলোচনা তুলে ধরাই উদ্দেশ্য। এ বিষয়গুলোতে দীর্ঘ আলোচনার জন্য উপযোগী হল বিষয়ভিত্তিক ফিকহী আলোচনা ও দরস। আর الفقه المدلل তথা দলীলভিত্তিক  ফিকহের কিতাবগুলোতে এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আগে থেকেই আছে।

প্রশ্ন : কুরবানী সম্পর্কে বিভিন্ন সময় যেসব নতুন নতুন কথা ওঠানো হয়, কুরবানী করার আবশ্যকীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, সীমিত করার কথা বলা হয় এবং নিজ উদ্যোগে না করে সংস্থার মাধ্যমে কুরবানী করার আহŸান জানানো হয়- এসব পরিস্থিতিতে সাধারণ মুসলমানদের করণীয় কী?

উত্তর : এসব ক্ষেত্রে মুসলমানদের কাজ হল, দ্বীন ও দ্বীনী বিধান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। যারা যত বেশি দ্বীন ও দ্বীনের মেযাজ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবেন তারা ততই এজাতীয় তর্ক ও বিভ্রান্তিকে অগ্রাহ্য করার সামর্থ্য অর্জন করতে পারবেন। তারা সতর্কও থাকতে পারবেন। একটি বিষয় বোঝা দরকার যে-

إِنّ هَذَا الْعِلْمَ دِينٌ، فَانْظُرُوا عَمّنْ تَأْخُذُونَ دِينَكُمْ.

[এই জ্ঞান হচ্ছে দ্বীন, তাই তোমরা লক্ষ রাখো- এই দ্বীন তোমরা কার কাছ থেকে গ্রহণ করছ। -সহীহ মুসলিম, মুকাদ্দিমা, অধ্যায় : আলইসনাদু মিনাদ্দীন, ইবনে সীরীন রাহ.-এর বক্তব্য]

দ্বীনী বিষয়ে যে ব্যক্তি নতুন কোনো মন্তব্য করছে, দেখতে হবে- এই অধিকার তার আছে কি না? তার যথার্থ জ্ঞান আছে কি না? দেখা যাচ্ছে, এজাতীয় দ্বীনী বিষয়ে টকশোর আলোচনায় একজন আলেমের পাশে বসে সাধারণ শিক্ষিত একজনও মতামত দিচ্ছেন। দ্বীনী বিষয়ে কি এভাবে মতামত দেওয়া যায়? এসব অসঙ্গতি বুঝতে হবে। ঠিক একইভাবে যারা সুন্নাহর تنوع বা বৈচিত্র্য এবং ফিকহের ভিন্নতার কারণ না বুঝে একটার বিরোধিতা করে, আরেকটা চাপিয়ে দিচ্ছেন- তাদেরও উচিত আদাবুল ইখতিলাফ, আদাবুল ইলম ও দাওয়াহর তরীকা সম্পর্কে সচেতন হওয়া। একটি সমাজে একটি সুন্নাহর প্রচলন রয়েছে, সেখানে আদব লঙ্ঘন করে অপর একটি সুন্নাহ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করার মধ্য দিয়েই বিশৃঙ্খলার পথ তৈরি হচ্ছে। এ ব্যাপারে সাধারণ মুসলমানরা যত সচেতন হবেন, ব্যাপক দ্বীনী পড়াশোনার মাধ্যমে ইসলাম ও শরীয়াহ-এর মর্ম যত বেশি অনুধাবন করবেন বিশৃঙ্খলা তৈরির পথ তত ছোট হয়ে আসবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বিভ্রান্তি থেকে বেঁচে থেকে দ্বীনের ওপর চলার তাওফীক দান করুন।

প্রশ্ন : প্রাসঙ্গিক কারণে অন্য একটি প্রশ্ন করতে চাচ্ছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী মায়্যেতের জানাযার নামায ও কাফন-দাফন নিয়ে বিভিন্ন রকম বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার খবর এসেছে। এ সম্পর্কে আপনি কিছু বলবেন?

উত্তর : আজকের প্রসঙ্গ ছিল করোনা পরিস্থিতিতে কুরবানী বিষয়ে উত্থাপিত যুক্তিতর্ক ও করণীয় নিয়ে। তারপরও যেহেতু এ বিষয়ে প্রশ্ন এসেছে, কয়েকটি কথা বলছি। শুরু থেকে এ নিয়ে অতিরিক্ত আতঙ্কজনক কথাবার্তা বলা হয়েছে। একারণে নানারকম অমানবিক আচরণ ও জুলুমের ঘটনাও ঘটেছে। সংক্রমণের দোহাই দিয়ে শ্রীলঙ্কায় জোরপূর্বক মুসলমানের লাশ পুড়িয়ে ফেলার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। সংক্রমণের কথা বলে সেখানে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের আচরণ করা হয়েছে মুসলমানদের সাথে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একেক সময় বিপরীতমুখী বিভিন্ন কথা বলেছে। পানি ঘোলা করা হয়েছে। সংক্রমণের ভয় ছড়িয়ে দিয়ে মায়্যেতের গোসল, জানাযার নামায এবং দাফনের ক্ষেত্রে অমানবিক বহু পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। কেউ কেউ আবার এসব পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক ফতোয়াদেওয়ার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মিসরের কোনো কোনো আলেমের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন এবং আতংকের এই পরিস্থিতিকে আরো বেগবান করেছেন। এরকম ইনস্ট্যান্ট ফতোয়াদেওয়ার প্রবণতার সাথে ফিকহ-ফতোয়ার মেযাজের মিল নেই।

যারা তৎক্ষণাৎ মায়্যেতকে গোসল না দিয়ে স্প্রে করা/বিনা গোসলে জানাযা দেয়া ইত্যাদি মত দিয়েছেন তারা নিশ্চয় এখন লজ্জিত হচ্ছেন। কারণ এ বিষয়ে শুরুতে এত আতঙ্কের কথা বলা হলেও পরে কিন্তু স্বাস্থ্যবিদরাই বললেন, করোনা আক্রান্ত রোগী মারা গেলে ৩/৪ ঘণ্টা পর ওই দেহে করোনার জীবানু আর অবশিষ্ট থাকে না। তাহলে ছড়িয়ে দেওয়া এত আতঙ্ক, এত অমানবিকতা কী জন্য করা হল? এজন্যই উলামায়ে কেরাম নতুন পরিস্থিতি তৈরি হলে বুঝে-শুনে সময় নিয়ে উসূল ও নীতি অনুযায়ী তাহকীকের পর এসব বিষয়ে মত দিয়ে থাকেন। ইসলামে গুগল ফতোয়া’, নিয়ম-নীতি বহির্ভূত তাৎক্ষণিক ফতোয়ার সুযোগ নেই।

যাহোক মূল বিষয়ের ফিরে যাই। তা হল, করোনা পরিস্থিতিতেও  মুসলামন মায়্যেতকে যথাযথভাবে গোসল-কাফন ও জানাযা দিতে হবে। আর কুরবানীও আদায় করতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে।

কথার শেষে দেশের বিত্তবান মুসলিমদেরকে আরেকটি অনুরোধ করতে চাই। তারা যেন দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকাগুলোতে এবং বিশেষত বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোতে (যদি সম্ভব হয়) ব্যাপকভাবে নফল কুরবানীর আয়োজন করেন। অন্তত তাদের জন্য কুরবানীর গোশত প্রেরণ করেন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সাহায্য নিয়েও এগিয়ে আসেন।

শুধু ফরয-ওয়াজিব সদকা নয়; বরং এধরনের পরিস্থিতিতে সামর্থ্যবানদেরকে নফল দান করার প্রতিও কুরআন-সুন্নাহ্য় উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।  

 

 

 

advertisement