তওবা-ইস্তেগফার : আমাদের মুক্তির রাজপথ
বছরের সেরা রাত যে শবে কদর, এ কথা তো সবারই জানা। শুধুই কি সারা বছরের সেরা রাত, এ রাত সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ঘোষণা-এ রাত হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এমন মহিমান্বিত রাতে পড়ার জন্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট একটি দুআ শিখিয়ে দেয়ার আবদার করেছিলেন উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দিকা রা.। আয়েশা সিদ্দিকা রা. ছিলেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। একবারের ঘটনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক যুদ্ধের সেনাপতি হিসেবে হযরত আমর ইবনে আস রা.-কে মনোনীত করলেন। তিনি তখন ভেবেছিলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হয়তো তাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। এ ভাবনা থেকেই জিজ্ঞেসই করেন-আপনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ কে? নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, আয়েশা। এরপর সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, পুরুষের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় কে? নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, আয়েশার বাবা (আবু বকর)। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, এরপর কে? নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তর, উমর। এভাবে তিনি অনেকের নাম বললেন। আমর ইবনে আস রা. বলেন, একসময় আমি প্রশ্ন করা বন্ধ করে দিলাম, আমার আশঙ্কা হল, আমার নাম আবার সবার শেষে বলেন কি না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৩৫৮
কথা হল, যিনি ঘরে-বাইরের সকলের চেয়ে নবীজীর কাছে সর্বাধিক প্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি হযরত আয়েশা রা., আমাদের জননী। এমন প্রিয় মানুষ তাঁর নিকট বললেন বছরের সর্বাধিক ফযীলতপূর্ণ রাতে পড়ার জন্যে একটি দুআ শিখিয়ে দিতে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সে রাতে পড়ার জন্যে এ দুআ শিখিয়ে দিলেন-
اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي.
হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আপনি মহা ক্ষমাশীল, আপনি ক্ষমা করতে ভালবাসেন। সুতরাং আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিন। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৮৫০
ইস্তেগফার অর্থাৎ আল্লাহর কাছে নিজের গোনাহের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করার গুরুত্ব ও ফযীলত প্রমাণ করার জন্যে এ একটি হাদীসই যদি থাকত, তবুও যথেষ্ট ছিল-রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সর্বাধিক প্রিয় মানুষটিকে বছরের সবচেয়ে মহিমান্বিত রাতে পড়ার জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করার দুআ শিখিয়ে দিয়েছেন! এ ইস্তেগফারই আমাদের দুনিয়া-আখেরাতের মুক্তির রাজপথ।
এবারে সায়্যিদুনা আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর কথা বলি। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছায়ার মতো ঘনিষ্ঠ ছিল তাঁর জীবন। নবুওত লাভের পর নবীজীর দাওয়াতে ঘরের বাইরে সর্বপ্রথম যিনি ঈমান এনেছিলেন তিনি আবু বকর রা.। জীবনের কঠিনতম সংকটের মুহূর্তে, যখন তিনি আল্লাহর হুকুমে মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করছিলেন, কুরাইশ কাফেররা তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলার জন্যে তাঁর ঘর ঘেরাও করেছিল আর তিনি আল্লাহর কুদরতে কাফেরদের বেষ্টনী ভেদ করে সবার অলক্ষে বেরিয়ে পড়েছিলেন নতুন গন্তব্যে, সে কঠিন মুহূর্তে তাঁর সঙ্গী একমাত্র আবু বকর রা.-ই। তিনি আবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বাধিক প্রিয় স্ত্রী এবং সর্বাধিক প্রিয় মানুষ হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা.-এর বাবা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন বলেছিলেন, আমি যদি কাউকে ‘খলীল’ বা অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম, তবে আবু বকরকেই গ্রহণ করতাম। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৬৭
উপরে বর্ণিত হযরত আমর ইবনে আস রা.-এর ঘটনায় বলা হয়েছে-পুরুষের মধ্যে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা.-ই ছিলেন নবীজীর সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি। ঘরে-বাইরের সহচর সুখ-দুঃখের অংশীদার আবু বকর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, নামাযে পড়ার জন্যে একটি দুআ আমাকে শিখিয়ে দিন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে শিখিয়ে দিলেন -
اللَّهُمَّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي ظُلْمًا كَثِيرًا، وَلاَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلاَّ أَنْتَ، فَاغْفِرْ لِي مَغْفِرَةً مِنْ عِنْدِكَ، وَارْحَمْنِي، إِنَّكَ أَنْتَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ.
হে আল্লাহ! আমি তো আমার নিজের ওপর অনেক জুলুম করেছি। আপনি ছাড়া গোনাহ মাফ করার কেউ নেই। তাই আপনি আপনার পক্ষ থেকে আমাকে ক্ষমা করে দিন আর আমাকে অনুগ্রহ করুন। নিশ্চয়ই আপনিই কেবল মহা ক্ষমাশীল, মহা দয়ালু। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৮৩৪
দুআটি আমরা নামাযের শেষ বৈঠকে ‘দুআয়ে মাছুর’ হিসেবে নিয়মিত পড়ে থাকি। এখানেও লক্ষ করার বিষয়, নামাযের শেষ বৈঠকে, দুআ কবুলের মুহূর্তে পড়ার জন্যে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর মতো ঘনিষ্ঠ সহচর যখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে একটি দুআ শিখিয়ে দেয়ার আবদার করছেন, তখন তিনি তাকে ক্ষমাপ্রার্থনার এ দুআটি শিখিয়ে দিলেন। আমরা আরও পিছনে ফিরে যাই। আমাদের সকলের বাবা ও মা সায়্যিদুনা আদম আলাইহিস সালাম ও তাঁর সঙ্গিনী হাওয়া রা.-কে আল্লাহ তাআলা যখন জান্নাত থেকে দুনিয়ায় নামিয়ে দিলেন, তখন যে দুআর বরকতে আল্লাহ তাআলা তাদের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন, তাও ছিল এই ইস্তেগফার বা ক্ষমাপ্রার্থনার দুআ-
رَبَّنَا ظَلَمْنَاۤ اَنْفُسَنَا وَ اِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَ تَرْحَمْنَا لَنَكُوْنَنَّ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ.
হে আমাদের প্রভু! আমরা তো আমাদের নিজেদের ওপর জুলুম করেছি। আপনি যদি আমাদের ক্ষমা না করেন, আমাদেরকে দয়া না করেন তবে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ব! -সূরা আরাফ (৭) : ২৩
এর বেশ পরে, তাদেরই এক সন্তান, সম্মানিত নবী সায়্যিদুনা ইউনুস আলাইহিস সালাম পড়েছিলেন এক কল্পনাতীত কঠিন সংকটে। গভীর সাগরে এক মাছ, সে মাছের পেটের ভেতর নবী ইউনুস আলাইহিস সালাম! কয়েক স্তরের এ অন্ধকার থেকে যে দুআর বরকতে তিনি বেরিয়ে আসেন, তাও ছিল ইস্তেগফার বা ক্ষমাপ্রার্থনা। তিনি দুআ করেছিলেন-
لَاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنْتَ سُبْحٰنَكَ اِنِّیْ كُنْتُ مِنَ الظّٰلِمِیْنَ.
(হে আল্লাহ!) আপনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আপনি সকল ত্রæটি থেকে পবিত্র। নিশ্চয় আমি অপরাধী। -সূরা আম্বিয়া (২১) : ৮৭
ইস্তেগফার আমাদের পরকালকে যেমন সমৃদ্ধ করতে পারে, আমাদের দুনিয়ার জীবনকেও সুন্দর করতে পারে। ক্ষমাপ্রার্থনা কেবলই পাপ থেকে মুক্তি নয়, ক্ষমাপ্রার্থনা আমাদের সংকট ও বিপদাপদ থেকেও মুক্তির হাতিয়ার। সহজ কথা, আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা চেয়ে কেউ যদি নিজের পাপগুলো ক্ষমা করিয়ে নিতে পারে, চোখের পানি ফেলে কেউ যদি ক্ষমাপ্রাপ্ত হতে পারে, তবে স্বাভাবিকভাবেই সে আল্লাহর প্রিয় বান্দায় পরিণত হবে। আর আল্লাহর প্রিয় বান্দা যারা, তাঁর রহমত ও দয়া তাদেরকে দুনিয়া-আখেরাত সর্বত্র ঘিরে রাখবেই। তা-ই যদি হয়, তবে আর ভাবনা কীসের! প্রয়োজন কেবলই গোনাহের অভিশাপ থেকে মুক্তির।
ইস্তেগফারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটি শব্দ-তওবা। শব্দদুটি প্রায় সমার্থক। ইস্তেগফার অর্থ কৃত গোনাহের জন্যে আল্লাহর কাছে অনুতাপ ও অনুশোচনার সঙ্গে ক্ষমা প্রার্থনা করা, আর তওবা অর্থ ফিরে আসা, পাপের পথ ছেড়ে পুণ্যের পথে ফিরে আসা, আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে আনুগত্যের দিকে ফিরে আসা, ভুল পথ ছেড়ে মহান প্রতিপালকের দিকে ফিরে আসা। এ তওবা-ইস্তেগফার একজন মুমিনের বড় গুণ। গোনাহের অভিশাপ থেকে নিজেকে পবিত্র করার হাতিয়ার। মানবীয় দুর্বলতার কারণেই আমরা শিকার হই শয়তানের কুমন্ত্রণার। আর তখন বিভিন্ন গোনাহের কাজে জড়িয়ে পড়ি। সে গোনাহ থেকে মুক্তির পথই হচ্ছে তওবা ও ইস্তেগফার। ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায়, মানুষ কোনো পাপে লিপ্ত হওয়ার পর যদি সে তার ভুল বুঝতে পারে এবং এজন্যে সে কায়মনোবাক্যে মহান প্রভুর কাছে অনুতপ্ত হয়, তাহলে সে গোনাহ যত বড়ই হোক না কেন, তা ক্ষমা করে দেওয়া হয়। পবিত্র কুরআনের আহ্বান কতটা সরল, দেখুন-
قُلْ یٰعِبَادِیَ الَّذِیْنَ اَسْرَفُوْا عَلٰۤی اَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوْا مِنْ رَّحْمَةِ اللّٰهِ اِنَّ اللّٰهَ یَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِیْعًا اِنَّهٗ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِیْمُ.
(হে নবী,) তুমি বলে দাও, হে আমার বান্দারা! তোমরা যারা নিজেদের ওপর অবিচার করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ সমুদয় পাপ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি তো মহা ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়ালু। -সূরা যুমার (৩৯) : ৫৩
তওবা করলে আল্লাহ তাআলা কি শুধু আমাদের গোনাহগুলো ক্ষমা করে দেন? এতটুকু হলেই তো যথেষ্ট ছিল। অবাধ্য গোলাম যদি ক্ষমা চেয়ে অবাধ্যতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারে, তবেই তো যথেষ্ট। কিন্তু তওবাকারী বান্দাদের প্রতি আল্লাহ তাআলার রহমত আরও অনেক ব্যাপক। কয়েকটি বড় পাপের বর্ণনা দেয়ার পর তিনি ঘোষণা করেছেন-
یُضٰعَفْ لَهُ الْعَذَابُ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ وَ یَخْلُدْ فِیْهٖ مُهَانًا، اِلَّا مَنْ تَابَ وَ اٰمَنَ وَ عَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا فَاُولٰٓىِٕكَ یُبَدِّلُ اللّٰهُ سَیِّاٰتِهِمْ حَسَنٰتٍ ، وَ كَانَ اللّٰهُ غَفُوْرًا رَّحِیْمًا.
...(এ সকল পাপে যে জড়াবে) কিয়ামতের দিন তার শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে এবং সেখানে সে স্থায়ী হবে হীন অবস্থায়। তবে তারা নয়, যারা তওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে। আল্লাহ তাদের পাপরাশিকে পুণ্য দিয়ে পাল্টে দেবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৬৯-৭০
তবে তওবার এ প্রতিদান তাদের ভাগ্যেই জুটবে, যারা তওবা করবে খাঁটি মনে। অতীতের গোনাহের জন্যে অনুতপ্ত হয়ে ভবিষ্যতে সে অন্যায় আর কখনো না করার জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবে। এর পাশাপাশি কৃত অপরাধের দায়মুক্তির চেষ্টা করবে। বান্দার হক সংশ্লিষ্ট হলে তা আদায় করতে হবে কিংবা তার কাছ থেকে ক্ষমা করিয়ে নেবে। আর যদি আল্লাহর হক সংশ্লিষ্ট হয় তবে সম্ভব হলে কাযা আদায় করবে। এমন যে করতে পারে তার তওবাই আল্লাহর নিকট গৃহীত হয় এবং তাঁর ক্ষমার বর্ষণে সিক্ত হয়। এমন তওবার পুরস্কারের কথা আল্লাহ জানিয়েছেন এভাবে-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا تُوْبُوْۤا اِلَی اللّٰهِ تَوْبَةً نَّصُوْحًا، عَسٰی رَبُّكُمْ اَنْ یُّكَفِّرَ عَنْكُمْ سَیِّاٰتِكُمْ وَ یُدْخِلَكُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهٰرُ.
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা করো-বিশুদ্ধ তওবা। আশা করা যায়, তোমাদের প্রভু তোমাদের পাপগুলো মুছে দেবেন এবং তোমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার পাদদেশে নদীসমূহ বয়ে যায়। -সূরা তাহরীম (৬৬) : ৮
কথা থেকে যায়, প্রথমবার যেমন শয়তানের প্ররোচনায় গোনাহ হয়ে গেল, তেমন তো পরে আবারও হতে পারে। তা হোক, যখনই কেউ গোনাহে জড়াবে, তখনই যদি আবার সে গোনাহের জন্যে অনুতপ্ত হয়, আবারো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়-এ কাজ আর কখনো করবে না, তবে প্রতিবারই আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করবেন। আমরা তাঁর গোলাম, বান্দা, তিনি আমাদের প্রভু, আমাদের প্রতিপালক। দুনিয়াতে কোনো কর্মচারী বা ভৃত্য যদি তার মনিবের কোনো আদেশ অমান্য করে এসে আকুতিভরে ক্ষমা চায়, তাহলে মনিব তাকে ক্ষমা করে। কিন্তু এক-দুইবার ক্ষমা করার পরও যদি আবার একই অন্যায় সে করে তখন মানুষ তার কর্মচারীকে ক্ষমা করতে পারে না। মানুষ তো কোনো দিক দিয়েই অসীম নয়। তার শক্তি ও সামর্থ্য সীমিত, তার ক্ষমার গুণও সীমিত, সীমিত তার সহনশীলতা ও ধৈর্যের ক্ষমতাও। অথচ আল্লাহ তাআলা অসীম দয়া ও শক্তির অধিকারী। পাপ যত বড় হোক, যত বেশি হোক, তাঁর রহমত ও অনুগ্রহ দয়া ও ক্ষমার তুলনায় তা মোটেও বড় নয়। বান্দা যখন তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে হাত বাড়ায়, তিনি তাতে অত্যন্ত খুশি হন। হাদীস শরীফে একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে এভাবে- এক লোক নির্জন মরুভূমিতে সফরে বের হয়েছে। তার সঙ্গে রয়েছে তার বাহন উট এবং সে উটের উপরই তার খাবার-পানি। সফরের এক পর্যায়ে সে উট থেকে নীচে নেমে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম থেকে জেগে দেখে, তার উটটি তাকে রেখে চলে গেছে। মরুভূমির গরমে তার প্রচÐ তৃষ্ণা পেল। কিন্তু উত্তপ্ত মরুভূমিতে তৃষ্ণা মেটাবার কিংবা সেখান থেকে ফিরে আসার অথবা পায়ে হেঁটে কোনো লোকালয়ে চলে যাওয়ার কোনো পথ তার সামনে ছিল না। মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষাই তখন একমাত্র পথ। নিরাশ মনে সে ভাবল, যেখানে ঘুমিয়েছিলাম, সেখানেই আবার ঘুমিয়ে পড়ি! এমনি এক মুহূর্তে তার হারিয়ে যাওয়া উটটি ফিরে এল। উটটি পেয়ে যেন সে মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে এল। খুশির আতিশয্যে দিশেহারা হয়ে সে বলে উঠল, হে আল্লাহ! আমি তোমার রব আর তুমি আমার বান্দা! রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কোনো বান্দা যখন আল্লাহর কাছে তওবা করে, তখন তিনি তার তওবায় মরুভূমিতে উট হারিয়ে ফিরে পাওয়া এ ব্যক্তিটির চেয়েও বেশি খুশি হন। ( দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭৪৭)
তওবা-ইস্তেগফার কেবল যে গোনাহ থেকে মুক্ত হওয়ার মাধ্যম এমন নয়, এর মাধ্যমে বান্দার আত্মিক উন্নতিও সাধিত হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
يَا أَيّهَا النّاسُ تُوبُوا إِلَى اللهِ فَإِنِّى أَتُوبُ فِى الْيَوْمِ إِلَيْهِ مِائَةَ مَرّةٍ.
হে লোক সকল! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো। আমি তো তাঁর কাছে দৈনিক একশ বার তওবা করি। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭০২
গোনাহ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র হওয়া সত্তে¡ও তিনি প্রতিদিন এত বেশি পরিমাণে মহান প্রভুর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। অথচ তিনি যে গোনাহ থেকে মুক্ত ছিলেন, তা তো বলাবাহুল্য।
আর আল্লাহ তাআলার কাছে নিজের গোনাহের কারণে ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্যে জানাশোনা কোনো গোনাহ হতে হবে- তা নয়। নিজেদের অজান্তে কত গোনাহে আমরা জড়াই- কে জানে! নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে ক্ষমাপ্রার্থনার একটি দুআ শিখিয়েছেন এভাবে-
...فَاغْفِرْ لِيْ مَا قَدَّمْتُ وَمَا أَخَّرْتُ وَأَسْرَرْتُ وَأَعْلَنْتُ وَمَا أَنْتَ أَعْلَمُ بِهِ مِنِّيْ
... আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন (আমার সকল গোনাহ), যা আমি আগে করেছি, যা পরে করেছি, যা গোপনে করেছি, যা প্রকাশ্যে করেছি এবং যে গোনাহ সম্পর্কে আপনি আমার চেয়ে বেশি অবহিত। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৪৪২
ক্ষমা চাইতে হবে এভাবেই- জানা-অজানা, ছোট-বড়, গোপন-প্রকাশ্য সকল গোনাহ থেকে। এভাবে তওবা করলে আল্লাহ গোনাহ মাফ করবেন, গোনাহ যদি কখনো না থাকে তবে তখন এতে আত্মিক উন্নতি সাধিত হবে।
এর পাশাপাশি দুনিয়ার নানা সময়ের নানামুখী বিপদ থেকে মুক্তির জন্যেও আমাদেরকে এ তওবা-ইস্তেগফার করতে হবে- এটাই নবীদের শিক্ষা। স্বাভাবিক কথা, পবিত্র কুরআনের বর্ণনানুসারে দুনিয়ার বিপদাপদ যেহেতু আমাদেরই কৃতকর্মের ফল, তাই এসব থেকে মুক্তি পেতে হলে অন্যায় কাজগুলোকে তো ক্ষমা করিয়ে নিতে হবেই-
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِی الْبَرِّ وَ الْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ اَیْدِی النَّاسِ لِیُذِیْقَهُمْ بَعْضَ الَّذِیْ عَمِلُوْا لَعَلَّهُمْ یَرْجِعُوْنَ.
মানুষের কৃতকর্মের কারণেই জলে-স্থলে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে, যেন তাদেরকে তাদের কোনো কোনো কাজের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান, যেন তারা ফিরে আসে। -সূরা রূম (৩০) : ৪১
চির শ্বাশ্বত এ বাণী বর্তমান সময়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। সারা পৃথিবী এখন ছোট অদৃশ্য এক ভাইরাসের জন্যে অস্থির। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যুর সংখ্যা। হাজার ছাড়িয়ে লাখ, লাখ ছাড়িয়ে এখন কোটিতে। সন্দেহ নেই, এ আমাদেরই কৃতকর্মের ফল। করোনাভাইরাসের এ মহামারিসহ অন্য যাবতীয় বিপদ থেকে মুক্তির জন্যে আমাদেরকে তওবা-ইস্তেগফারের আশ্রয় নিতেই হবে।
সবশেষে ইস্তেগফার আমাদের দুনিয়ার জীবনকে কতটা সমৃদ্ধ করতে পারে, পবিত্র কুরআনে বর্ণিত এর একটি নমুনা উল্লেখ করছি-
اسْتَغْفِرُوْا رَبَّكُمْ اِنَّهٗ كَانَ غَفَّارًا، یُّرْسِلِ السَّمَآءَ عَلَیْكُمْ مِّدْرَارًا، وَّ یُمْدِدْكُمْ بِاَمْوَالٍ وَّ بَنِیْنَ وَ یَجْعَلْ لَّكُمْ جَنّٰتٍ وَّ یَجْعَلْ لَّكُمْ اَنْهٰرًا.
তোমরা তোমাদের প্রভুর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই তিনি মহাক্ষমাশীল। (ক্ষমাপ্রার্থনা করলে) তিনি তোমাদের ওপর মুষলধারায় বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। তোমাদেরকে তিনি ধনসম্পদ ও সন্তানাদি দিয়ে সমৃদ্ধ করবেন। তোমাদের জন্যে তিনি বিভিন্ন রকমের বাগান ও অনেক নদ-নদী সৃষ্টি করে দেবেন। সূরা নূহ (৭১) : ১০-১২