দরসে হাদীস : সেই মুসলিম কে?
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: المُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ المُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ، وَالمُهَاجِرُ مَنْ هَجَرَ مَا نَهَى اللهُ عَنْهُ.
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘মুসলিম সে, যার হাত ও জিহŸ থেকে অপর মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে। আর মুহাজির সে, যে আল্লাহ যা কিছু নিষেধ করেছেন তা ত্যাগ করে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১০
এটি একটি বিখ্যাত হাদীস। ইমাম বুখারী রাহ. সহীহ বুখারীর ঈমান-অধ্যায়েও তা এনেছেন, রিকাক অধ্যায়েও এনেছেন। এই হাদীস শরীফে আমাদের জীবন যাপনের এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি উল্লেখিত হয়েছে। যে নীতি অবলম্বন করা হলে পার্থিব জীবনও শান্তিময় হবে, পরকালীন জীবনও শান্তিময় হবে।
কুরআন-সুন্নাহর জীবনাদর্শ
কুরআন-সুন্নাহর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা আমাদের যে আদর্শ দান করেছেন তা তাঁর ‘রব’ (পরওয়ারদেগার) ও ‘রাহীম’ (করুণাময়) নামেরই বহিঃপ্রকাশ। এই নীতি ও আদর্শের মাধ্যমে তিনি আমাদের শান্তির পথ প্রদর্শন করেছেন। পার্থিব শান্তি ও পরকালীন শান্তি। তিনি তাঁর বান্দাদের প্রভু ও পরওয়ারদেগার এবং তিনি অতি করুণাময়। তাঁর করুণা ও প্রতিপালনগুণের প্রকাশ যেমন আমাদের পার্থিব জীবনের যাবতীয় উপায়-উপকরণের সৃষ্টি ও সরবরাহের মাধ্যমে ঘটেছে তেমনি ঘটেছে আমাদের জীবন যাপনের নীতি ও আদর্শ দানের মাধ্যমে।
চিন্তা করলে বোঝা যাবে যে, যথার্থ মানব জীবনের জন্য দুটো বিষয়ই অতি জরুরি। খাদ্য ও পানীয় ছাড়া যেমন বেঁচে থাকা যায় না তেমনি নীতি ও আদর্শ ছাড়া বাঁচা মানবের বাঁচা হয় না। তাই দুটো বিষয়ই আমাদের প্রয়োজন আর দুটোই তাঁর রহমত, তাঁর রব গুণের প্রকাশ। তাঁর উভয় প্রকার দানের জন্য আমরা তাঁর শোকরগোযারি করি।
এই শোকরগোযারির কী সুন্দর নমুনাই না আছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেখানো দুআয়। খাবারের পর শোকরগোযারির যে দুআ হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে তার একটি এই-
الْحَمْدُ لِلهِ الَّذِي أَطْعَمَنَا وَسَقَانَا، وَجَعَلَنَا مُسْلِمِينَ.
সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদের খাইয়েছেন, পান করিয়েছেন এবং আমাদের মুসলিম বানিয়েছেন।’ -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৭৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৫০; জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৫৭
একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, এই দুআয় উভয় নিআমতের শোকরগোযারি একসাথে করা হয়েছে। খাদ্য-পানীয়ের জন্য আল্লাহর শোকরগোযারির সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা আমাদের যে জীবনাদর্শ দান করেছেন তারও শোকরগোযারি এ দুআয় করা হয়েছে।
জীবনোপকরণ ও জীবনাদর্শ দুটোই আল্লাহর দান। আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে যে জীবনাদর্শ এসেছে তার নাম ইসলাম। আর একমাত্র ইসলামই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য। ইসলাম ছাড়া আর কোনো ধর্ম আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
اِنَّ الدِّیْنَ عِنْدَ اللهِ الْاِسْلَام.
নিঃসন্দেহে ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৯
وَ مَنْ یَّبْتَغِ غَیْرَ الْاِسْلَامِ دِیْنًا فَلَنْ یُّقْبَلَ مِنْهُ وَ هُوَ فِی الْاٰخِرَةِ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ.
কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনই কবুল করা হবে না। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৮৫
ইসলামের মাধ্যমেই আমাদের জীবন সুস্থ-সুন্দর হতে পারে। সর্বাঙ্গসুন্দর হতে পারে। ইসলাম আমাদের জীবনের সকল অঙ্গনে সঠিক শিক্ষা দান করে। সঠিক আকীদা-বিশ্বাস; সঠিক ইবাদত ও উপাসনা, সঠিক লেনদেন, সঠিক আচার-আচরণ, জীবনের সকল ক্ষেত্রে সঠিক করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
ইসলামী জীবনাদর্শের প্রশস্ততা
কুরআন-সুন্নাহর নীতি ও বিধানগুলোকে যদি আমাদের জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ের শিরোনামে বিন্যস্ত করা হয়- আমাদের মনীষীরা তা বিন্যস্ত করেছেনও- তাহলে দেখা যাবে জীবনের প্রতিটি বিভাগে রয়েছে ইসলামের যথার্থ ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা। যেমন আকীদা-ব্যবস্থা, ইবাদত-ব্যবস্থা, লেনদেন-ব্যবস্থা, স্বভাব-চরিত্র-ব্যবস্থা ইত্যাদি। চিন্তাশীল পাঠক বুঝতেই পারছেন, ‘ব্যবস্থা’ বলতে বোঝানো হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের কুরআন-সুন্নাহর নীতি ও বিধানের সমষ্টিকে। প্রতিটি বিষয়ে ইসলামের নীতি ও বিধান এত পর্যাপ্ত ও যথেষ্ট যে, এই নীতি ও বিধানের সমষ্টিকে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা হিসেবে অভিহিত করা যায়।
এই সকল ব্যবস্থার মধ্যে স্বভাব-চরিত্র ও আচার-ব্যবহার বিষয়ক ব্যবস্থাটিও অতি গুরুত্বপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ একটি ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় আছে সকল উন্নত স্বভাব ও আচার-আচরণের শিক্ষা। আছে দুনিয়া-আখিরাত উভয় জাহানের কল্যাণ লাভের উপায়। আছে আল্লাহর হক্ব ও বান্দার হক্ব আদায়ের যথার্থ পথনির্দেশ। আছে কিয়ামত পর্যন্ত সকল শ্রেণির মানুষের মানবীয় উৎকর্ষ লাভের উপাদান। যার দ্বারা মানুষ পরিণত হয় উন্নত মানুষে এবং সে হয়ে ওঠে তার চারপাশের সকলের জন্য রহমত।
ইসলামের আখলাক-ব্যবস্থা যেমন মানুষের আন্তর্গত স্বভাব-চরিত্র নিয়ে আলোচনা করে তেমনি বাহ্যিক আচার-আচরণ নিয়েও আলোচনা করে। সুন্দর স্বভাব-চরিত্র ও পরিশীলিত আচার-আচরণের অধিকারী মানুষই সমাজের অন্য সবার জন্য প্রীতিকর হয়ে থাকে। আর তাই স্বভাব-চরিত্রের পরিশুদ্ধি ও আচার-ব্যবহারের পরিশীলনের শিক্ষা ইসলামে আছে অতি গভীর ও বিস্তৃতভাবে।
কুরআন-সুন্নাহর নসসমূহের প্রকারভেদ
আমরা যদি কুরআন-সুন্নাহর নসসমূহ পাঠ করি তাহলে দুধরনের নস দেখতে পাই : এক. যেসব আয়াত-হাদীসে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের নির্দিষ্ট শিক্ষা পাই। যেমন কারো সাথে সাক্ষাতের সময় সালাম করা, সালামের জবাব দেওয়া, হাঁচি দিলে আলহামদু লিল্লাহ বলা ইত্যাদি।
দুই. যে সব আয়াত-হাদীসে কর্ম ও আচরণের মূলনীতি পাই। যে মূলনীতি সামনে রেখে জীবনের অসংখ্য ক্ষেত্রে সঠিক করণীয় নির্ধারণ করা যায়। আমাদের আজকের উপস্থাপিত মোবারক হাদীসটি এই শ্রেণির একটি হাদীস, যা মুসলমানদের দ্বীনদারী ও সামষ্টিক জীবনের মূলনীতি।
হাদীস শরীফের বাণী ও শিক্ষা
এ হাদীসে দুটো বাক্য আছে :
প্রথম বাক্য :
المُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ المُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ.
মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে।
মানুষের সাথে মানুষের আচরণ প্রকাশিত হয় কথার দ্বারা বা কাজের দ্বারা। এ দুটির অনিষ্ট থেকে নিরাপদ হওয়া মানে ঐ ব্যক্তি থেকেই নিরাপদ হয়ে যাওয়া। সহীহ মুসলিমের ভাষ্যকার আল্লামা নববী রাহ. বলেন-
مَعْنَاهُ مَنْ لَمْ يُؤْذِ مُسْلِمًا بِقَوْلٍ وَلَا فِعْلٍ وَخَصَّ الْيَدَ بِالذِّكْرِ لِأَنَّ مُعْظَمَ الْأَفْعَالِ بِهَا، وَقَدْ جَاءَ الْقُرْآنُ الْعَزِيزُ بِإِضَافَةِ الِاكْتِسَابِ وَالْأَفْعَالِ إِلَيْهَا.
হাদীসের অর্থ : (মুসলিম সে,) যে তার কথা বা কাজের দ্বারা কোনো মুসলিমকে কষ্ট দেয় না। হাদীসে হাতের উল্লেখের তাৎপর্য হচ্ছে, অধিকাংশ কর্ম এরই দ্বারা হয়ে থাকে। আর কুরআনে আযীযে মানুষের কর্মকে হাতের সাথেই সম্বন্ধ করা হয়েছে। এরও তাৎপর্য সেটিই, যা উপরে বলা হয়েছে। (শরহে মুসলিম নববী, হাদীস ৪০-এর আলোচনায়)
এই হাদীসের শিক্ষা, কামিল মুসলিম হতে হলে কথা ও কাজ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এমন কোনো অন্যায় কথা বলা যাবে না, যার দ্বারা কেউ কষ্ট পায়, তেমনি এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যা কারো কষ্টের কারণ হয়। এটি এমন এক মূলনীতি, যা আমাদের সামষ্টিক জীবনের অসংখ্য ক্ষেত্রে অনুসরণীয়। আর যে ক্ষেত্রেই এই মূলনীতি অনুসরণ করা হবে সেখানেই শান্তি ও রহমত আসবে।
আমরা যদি পারিবারিক জীবনে এই মূলনীতি অনুসরণ করি- ‘মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে’, তাহলে আমাদের পারিবারিক জীবন অনেক শান্তিময় হবে।
আমরা যদি আমাদের কর্মস্থলে এই মূলনীতি অনুসরণ করি- ‘মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে’, তাহলে আমাদের কর্মস্থল শান্তিময় হবে।
আমাদের লেনদেনের জন্য মূলনীতি- ‘মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে’।
আমাদের রাস্তা-ঘাটে চলাচলের মূলনীতি- ‘মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে’।
আমাদের পর্ব-উৎসবের ক্ষেত্রে মূলনীতি- ‘মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে’।
আমাদের আইন-আদালতের ক্ষেত্রে মূলনীতি- ‘মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে’।
আমাদের রাজনৈতিক সকল কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে মূলনীতি- ‘মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে’।
আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা, অধ্যয়ন-অধ্যাপনার ক্ষেত্রে মূলনীতি- ‘মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে’।
আমাদের সাহিত্য-সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মূলনীতি- ‘মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে’।
চিন্তা করলে দেখা যাবে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে এই মূলনীতি প্রযোজ্য এবং এই মূলনীতির অনুসরণ আমাদের কথা ও কাজে এনে দিতে পারে এক ভিন্ন মাত্রা। আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে নিয়ে যেতে পারে এক অনন্য উচ্চতায়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, বাবা-সন্তানের সম্পর্ক, শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক, কর্তা-কর্মচারীর সম্পর্ক, সঙ্গী-সহকর্মী সম্পর্ক, পাড়া-পড়শি সম্পর্ক, আত্মীয়-স্বজনের সম্পর্ক ইত্যাদি সকল সম্পর্কে এনে দিতে পারে আলাদা স্থিতি ও মাধুর্য। এই সবকিছু হতে পারে একটি মাত্র বাণীর স্মরণ ও অনুসরণের মাধ্যমে। আর তা হচ্ছে-
المُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ المُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ.
মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে।
দ্বিতীয় বাক্য :
হাদীসের দ্বিতীয় বাক্যটি হচ্ছে-
وَالمُهَاجِرُ مَنْ هَجَرَ مَا نَهَى اللهُ عَنْهُ.
‘মুহাজির সে, যে আল্লাহ যা কিছু নিষেধ করেছেন তা ত্যাগ করে।’ ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রাহ. এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন-
والهجرة عند الإطلاق في كتاب السنة إنما تنصرف إلى هجران بلد الشرك إلى دار الإسلام رغبة في تعلم الإسلام والعمل به، وإذا كان كذلك فأصل الهجرة : أن يهجر ما نهاه الله عنه من المعاصي، فيدخل في ذلك هجران بلد الشرك رغبة في دار الإسلام، وإلا فمجرد هجرة بلد الشرك مع الإصرار على المعاصي ليس بهجرة تامة كاملة، بل الهجرة التامة الكاملة: هجران ما نهى الله عنه، ومن جملة ذلك: هجران بلد الشرك مع القدرة عليه.
অর্থাৎ হিজরত শব্দের সাধারণ ব্যবহার হচ্ছে ইসলামকে জানার ও সে অনুযায়ী চলার ইচ্ছায় শিরকের ভ‚খÐ ত্যাগ করে দারুল ইসলামে আসা। তাহলে দেখা যাচ্ছে হিযরতের মূলকথা হল আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে নিষিদ্ধ গুনাহ-পাপাচার ত্যাগ করা। বিষয়টি অনেক বিস্তৃত ও প্রশস্ত। এর প্রশস্ততার মধ্যে দারুল ইসলামে বসবাসের প্রেরণা নিয়ে শিরকের ভ‚খÐ ত্যাগ করাও একটি বিষয়। নতুবা গুনাহ-পাপাচার অব্যাহত রেখে শুধু শিরকের ভ‚মি ত্যাগ পূর্ণ ও যথার্থ হিজরত নয়। যথার্থ ও পূর্ণাঙ্গ হিজরত হচ্ছে, আল্লাহর নিষেধকৃত বিষয়াদি বর্জন করা। এর মধ্যে শিরকের ভ‚মি ত্যাগও রয়েছে। -ফাতহুল বারী, ইবনে রজব ১/৩১-৩২
আর তাই হাদীসের ভাষ্যকারগণ এ হাদীসের শিক্ষা আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন-
(নবী-যুগে মক্কা-বিজয়ের মাধ্যমে মদীনায়) হিজরতের ধারা সমাপ্ত হলে সাহাবীদের যারা ইতিপূর্বে হিজরত করতে পারেননি তারা হিজরতের মর্যাদা হাতছাড়া হওয়ার কারণে দুঃখিত হলেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জানান যে, প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ মুহাজির তো ঐ ব্যক্তি, যে আল্লাহর নিষেধকৃত বিষয়সমূহ ত্যাগ করে। (আর এর সুযোগ ও বিধান এখনও আছে।)
কেউ কেউ এ অর্থও করেছেন যে, এ বাক্যের দ্বারা মুহাজিরগণকে সচেতন করা হয়েছে, তারা যেন আল্লাহর নিষেধকৃত বিষয়াদি থেকে বেঁচে থাকার ব্যপারেও যতœবান হন। শুধু মদীনায় হিজরতের উপর সন্তষ্ট না থাকেন। (দ্র. শরহু সহীহিল বুখারী, ইবনে বাত্তাল ১/৬২-৬৩)
চিন্তা করলে বোঝা যাবে, উপরোক্ত দুটো বিষয়ই হাদীস শরীফের এ বাক্যের শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ যারা হিজরত করেছেন তাদের জন্য যেমন এ হাদীসে নির্দেশনা আছে, যারা হিজরত করেননি তাদের জন্যও আছে। উভয় শ্রেণির জন্যই একথা প্রযোজ্য যে, আগামী জীবনে আল্লাহর নিষেধকৃত সব রকমের বিষয় থেকে যতেœর সাথে বেঁেচ থাকতে হবে। আর এটিই হিজরতের মর্মবাণী।
হাদীস শরীফের এই বাণী আমাদের সচেতন করছে যে, দ্বীনদারী ও নেক আমলের ক্ষেত্রে মুমিনকে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। দ্বীনদারীর প্রাণসত্তা হচ্ছে আল্লাহ তাআলার আদেশ পালন করা, তাঁর নিষেধ করা বিষয় থেকে বেঁচে থাকা- একথাটা চেতনা ও স্মরণে জাগ্রত রাখতে হবে। দ্বীনদারীর বাহ্যিক সকল কাঠামোকে দ্বীনের এই মর্মবাণীর সাথে মিলিয়ে চিন্তা করতে হবে। তাই হাদীসের এ বাণী আমাদের জীবনের অনেক ক্ষেত্রে আমাদের জন্য চেতনা-উন্মেষক এক নীতি।
সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. যথার্থই বলেছেন-
هَذَا الْحَدِيثُ مِنْ جَوَامِعِ الْكَلِمِ الّتِي أُوتِيَهَا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ‘জাওয়ামিউল কালিম’ শ্রেণির বাণী প্রদত্ত হয়েছেন উপরোক্ত হাদীসটি তার অন্যতম। -ফাতহুল বারী ১১/৩১৯
‘জাওয়ামিল কালিম’ অর্থ ঐসব বাণী, যার শব্দ-বাক্য সুসংক্ষিপ্ত কিন্তু অর্থ-মর্ম অতি গভীর ও বিস্তৃত।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.