শাওয়াল ১৪৪১   ||   জুন ২০২০

শিয়রে সারা রাত...

বিন কাসিম

মাদরাসার প্রাঙ্গণে চোখ জুড়ানো ফুল বাগান। একটুখানি বাতাস বইলেই ফুলগুলো হেলে দুলে নাচতে থাকে। পাখিদের গানে যেন তা আরো ছন্দ এনে দেয়। শিউলি, জবা, গাদা, বেলি, গোলাপ ও টগরগুলো রঙ-বেরঙের প্রজাপতিগুলোর সাথে মনে হয় কানে কানে গল্প করে। আর আগত মেহমানদের স্বাগত জানায় তারা পূর্ণ পাপড়ি মেলে মৌ মৌ ঘ্রাণ বিলিয়ে।

মাদরাসার দক্ষিণ দিকে সুবিশাল খেলার মাঠ। যেন কচি সবুজ ঘাসের নরম মখমল বিছানো তাতে। আসরের পর ছাত্ররা দলে দলে মাঠে নামে শরীর চর্চা এবং চিত্তবিনোদনের জন্য। উস্তাদজী এক কোণে চেয়ার পেতে বসে নেগরানী করেন।

ইমাদ সেই যে মাদরাসায় এসেছে আর বাড়িতে যায়নি। আম্মু আর ছোট্ট বোনটির কথা মনে পড়লেও বাড়ির জন্য তার মন কাঁদে না। উস্তাযদের আদর- স্নেহে, সুরে সুরে পড়ার আনন্দ, পরিপাটি পরিবেশ, সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা আর খেলার মাঠে সঙ্গীদের পেয়ে ইমাদ বাড়ির কথা ভুলেই গেছে বলা যায়। বিশেষ করে সময়ে সময়ে উস্তাদজী যখন বিভিন্ন ঘটনা শোনান সেই স্বাদ যেন জিভে লেগে থাকে তার। ইমাদ শুধু প্রহর গোনে উস্তাদজী আবার কবে গল্প শোনাবেন। সাহস করে আবদারও করতে পারে না। শুধু প্রতীক্ষায় থাকে গল্প শুনবে বলে। উস্তাদজীর গল্পগুলো যেমনি চমৎকার তেমনি শিক্ষণীয়। উস্তাদজী ছাত্রদেরকে কিছু করতে বলবেন, তাদেরকে নসীহত করবেন, তো আগে একটা গল্প শুনিয়ে দেন। ছাত্ররা তাতেই বুঝে নেয় উস্তাদজী আমাদেরকে এখন কী করতে বলছেন। তখন সেই কাজে তারা পাখির মত ঝাঁপিয়ে পড়ে।

প্রতিদিনের মত আজও বিকেলে ইমাদ তার বন্ধুদের সাথে মাঠে নেমেছে। হঠাৎ করে আকাশটা কালো হয়ে এল। উস্তাদজী সবাইকে পশ্চিম পাশে মসজিদে জড়ো করলেন। মুহূর্তেই নেমে এল অসম্ভব ঝড়। তুফানে সবকিছু তছনছ করে ফেলছে। সোঁ সোঁ বাতাসে লম্বা লম্বা সুপারি গাছগুলো হেলে পড়ছে। দ্রিম দ্রিম বজ্রপাতে পিলে চমকে উঠছে। বিদ্যুতের ঝলকানীতে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। উস্তাদজী বললেন- সবাই যিকির কর, আল্লাহর কাছে দুআ কর। আমাদের নবীজী হালকা বাতাস বইলেই আল্লাহর কাছে দুআ করতেন, নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন। (দ্রষ্টব্য : সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৩১৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩২৯৯)

কিছুক্ষণের মধ্যে পরিবেশ শান্ত হয়ে এল। মাঠে জাগায় জাগায় পানি জমে আছে। আকাশটা এখনও কালো। উস্তাদজী বললেন, এখন আর বের হওয়া দরকার নেই। আসো, আমরা একটা গল্প শুনি।

ইমাদ যেন এমন কিছুরই অপেক্ষা করছিল। সবাই উস্তাদজীর নিকট জড়ো হয়ে বসল। উস্তাদজী বলতে লাগলেন-

আজ থেকে অনেক আগের কথা। একবার তিন বন্ধু মিলে কোথাও যাচ্ছিল। নির্জন এলাকা। দুর্গম পাহাড়ি পথ। চলতে চলতে রাত হয়ে এসেছে। চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। আকাশের অবস্থাও সুবিধার না, শঙ্কাজনক। না, এই রাতে এভাবে চলা যায় না। রাতটুকু কাটাবার জন্য কোথাও আশ্রয় নিতে হবে। এরই মাঝে শুরু হল প্রচণ্ড ঝড়। ঝড়ে সবকিছু লণ্ড- ভণ্ড হয়ে যাওয়ার দশা। তারা দৌড়ে আশ্রয় নিল পাহাড়ের একটি গুহায়। যেই না আশ্রয় নিল পাহাড়ের গুহায় অমনি পাহাড়ের উপর থেকে গড়িয়ে পড়ল ইয়া বিরাট এক পাথর। পাথরটা গড়াতে গড়াতে থামল একেবারে সেই গুহার মুখে। এখন গুহার মুখ বন্ধ। বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। আগে পাথর সরাতে হবে, তবেই বের হওয়া যাবে। কিন্তু এত বড় পাথর কি আর গায়ে ঠেলে সরানো যায়!

ইমাদের বন্ধু আবিদ। বেশ কৌতূহলী। চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে উস্তাদজীর দিকে। তার চাহনীতে একরাশ প্রশ্ন। উস্তাদজী বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা। বললেন- তোমরা হয়ত ভাবছ, পাহাড়ের উপর এত বড় পাথর এল কোত্থেকে? হাঁ, পাহাড়ের উপর পাথর আসেনি; বরং সেটা পাথরেরই পাহাড়। তোমরা বাইতুল্লাহর সফরে গেলে দেখতে পাবে পাথরের পাহাড় কাকে বলে। আর একেকটা পাথর কত বিশাল বিশাল হতে পারে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সেই তাওফীক দান করুন এবং বারবার দান করুন।

সবাই সমস্বরে বলে উঠল- আমীন।

উস্তাদজী বলা শুরু করলেন- তো এই তিন বন্ধু এখন পাহাড়ের গুহায় আটকা। বের হওয়ার কোনো পথ নেই, ভিন্ন কোনো উপায়ও নেই। আল্লাহ তাআলার সাহায্য এখন তাদের একমাত্র ভরসা। আল্লাহ পাকের কুদরতী শক্তি ছাড়া এত বিশাল পাথর কোনোভাবেই সরানো সম্ভব নয়।

তারা পরামর্শ করল- দেখ, বিপদের এ মুহূর্তে একমাত্র আল্লাহ্ই ভরসা; তিনিই আমাদের উদ্ধার করবেন। এসো আমরা আল্লাহর দরবারে দুআ করি। আল্লাহর নিকট কান্নাকাটি করি। আমরা আমাদের জীবনের এমন কোনো নেক আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করি, যা একমাত্র তাঁর জন্যই করেছি। আল্লাহ পাক যদি এ ওসিলায় আমাদের রেহাই দেন! এভাবে তারা আল্লাহর কাছে দুআ করতে আরম্ভ করল।

সেই তিনজনের একজন ছিল রাখাল। সারাদিন মাঠে পশু চরাত। দিন শেষে দুধ সংগ্রহ করত। আর তা দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করত। বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী ও ছোট ছোট সন্তান-সন্ততি নিয়ে এভাবেই চলত তার সংসার। সকাল বেলা পশু নিয়ে মাঠে-বনে চলে যেত। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সেগুলো দোহন করত। তারপর সবাই মিলেমিশে তা পান করত। এভাবে সারাদিন ক্ষুধায় থাকার পর সন্ধ্যায় কয়েক ঢোক দুধ পান করে তারা রাতে ঘুমাতে যেত।

পেশায় রাখাল হলেও সে ছিল মা-বাবার আদর্শ সন্তান। ঘরে ফিরে আগে মা-বাবার খোঁজ নিত। দুধ দোহন করে আগে মা-বাবাকে পান করাত। তারপর যা থাকত তা বাচ্চাদের খাওয়াতো এবং নিজেরা খেত।

একদিন রাখাল দানাপানির খোঁজে পশুগুলো নিয়ে দূর এলাকায় চলে গেল। দিনশেষে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেল। এদিকে ঘরে সবাই উপোস। বুড়ো বাবা-মা অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছেন। বাচ্চারা ক্ষুধায় কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে।

রাখাল ঘরে এসে যথারীতি দুধ দোহন করল। দুধের পেয়ালা হাতে গেল মা-বাবার কাছে। দেখল, তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েছেন। এদিকে বাচ্চারাও ক্ষুধার যন্ত্রণায় কান্নাকাটি করছে। রাখাল দোটানায় পড়ে গেল। সে মনে মনে বলল- না, মা-বাবার আগে আমি কাউকে খেতে দিতে পারি না। কিন্তু তারা যে ঘুমিয়ে পড়েছেন! না, তাদেরকে ঘুম থেকে ডেকে তোলাও ঠিক হবে না। সে চিন্তায় পড়ে গেল- বাচ্চারাও তো ক্ষুধায় কাঁদছে! কী করা যায়?! 

রাখাল ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিল, সবার আগে আমি মা-বাবাকে খাওয়াব, তারপর অন্যরা। তবে তারা নিজ থেকে ঘুম থেকে  জেগে ওঠার আগে তাদেরকে ডেকেও তুলব না। আগে মা-বাবা তারপর অন্যরা।

সে পেয়ালা হাতে দাঁড়িয়ে রইল তাদের শিয়রে। চোখ খুললেই যেন খাবার কাছে পান। কিন্তু পুরো রাতে তাদের আর ঘুম ভাঙল না। এভাবেই ফজর হয়ে গেল, দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে। এতক্ষণে ঘুম ভাঙল তাঁদের। চোখ মেলে দেখেন, পুত্র শিয়রে দুধের পেয়ালা হাতে দাঁড়িয়ে...

বিপদের এই রাতে রাখালের মনে পড়ল সেই রাতের কথা, যেই রাতে সে দুধের পেয়ালা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল মা-বাবার শিয়রে; একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। বাচ্চাদের কান্নায় তারও মন কাঁদছিল। কিন্তু মা-বাবার আগে সে কাউকে দিতে পারেনি!

এসব মনে করে সে আল্লাহর দরবারে আকুতি জানিয়ে বলল-

اللّهُمّ إِنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ، فَفَرِّجْ عَنّا مَا نَحْنُ فِيهِ مِنْ هَذِهِ الصّخْرَةِ.

আয় আল্লাহ! সেই রাতের এই কাজটি যদি আমি তোমার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি, তবে (সে ওসিলায়) আজ এই বিপদ হতে তুমি আমাদের উদ্ধার কর। আমাদের সামনে থেকে পাথর সরিয়ে দাও। (অন্য বর্ণনায়) যাতে আমরা অন্ধকার এই গুহা থেকে আসমানের আলোর দেখা পাই।

আল্লাহর কী কুদরত! এভাবে দুআ করাতে সত্যি সত্যি গুহার মুখ থেকে সেই বিশাল পাথরটি সরে গেল। এখন ঠিকই আসমান দেখা যাচ্ছে। কিন্তু...! পাথর যতটুকু সরেছে তা দিয়ে একজন মানুষ কোনো রকম বের হবে- তা সম্ভব নয়।

উস্তাদজীর গল্প শুনতে শুনতে ইমাদের কলিজা যেন শুকিয়ে আসছিল। যখন শুনল, পাথর সরেছে। তার কলিজা যেন একটু পানি পেল। পরক্ষণেই যখন শুনলকিন্তু বের হওয়া সম্ভব নয়, তার মনটা আবার ধক্ করে উঠল।

আবিদ আক্ষেপ করে বলে উঠল- ইস্, তাহলে কি তারা বের হতে পারেনি?

উস্তাদজী বললেন- অবশেষে আল্লাহ তাআলা তাদের সবাইকেই সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন।

আবিদের প্রশ্ন- কীভাবে? উত্তর শোনার জন্য ইমাদও নড়েচড়ে বসল।

উস্তাদজী বললেন- বাকি দুজনও তাদের জীবনের ঘটে যাওয়া এমন কিছু আমল আল্লাহর সামনে পেশ করেছে। আল্লাহ তাআলা সেই ওসিলায় পাথর একটু একটু করে সরিয়ে দিয়েছেন। তৃতীয় ব্যক্তির দুআর পর আল্লাহর হুকুমে পাথর সম্পূর্ণ সরে গিয়েছে। এভাবে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন। নতুবা পাহাড়ের সেই গুহায়ই হত তাদের কবর। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ২২৭২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭৪৩)

আবিদ আবদারের সুরে বলল- উস্তাদজী! অন্য দুজনের ঘটনা কী ছিল?

উস্তাদজী মৃদু হেসে বললেন- হাঁ, অন্য দুজনের ঘটনাও অনেক সুন্দর, অনেক শিক্ষণীয়। সেগুলো আরেকদিন বলব, ইনশাআল্লাহ।

উস্তাদজীর গল্প শুনে ইমাদ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, এই রাখালের মত সেও মা-বাবার খেদমতে মন দেবে। মা-বাবার খেদমত করে আল্লাহকে খুশি করবে। আর আবিদ জোরেই বলে ফেলল, উস্তাদজী! আমিও এই রাখালের মত মা-বাবার খেদমত করব।

উস্তাদজী বললেন, হাঁ, তোমরা সবাই মা-বাবার খেদমত করবে। তাহলে আল্লাহ তাআলা তোমাদের প্রতি খুশি হবেন এবং চিরস্থায়ী সুখের জান্নাত দান করবেন।

 

 

advertisement