ফিরে আসার গল্প
মুসলমানদের সব ধরনের রচনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে কাদিয়ানীদের জন্য সত্যকে জানা সহজ হবে না
আমি জন্মসূত্রে একজন ফিলিস্তিনী। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের হাইফাতে১ এক কাদিয়ানী পরিবারে আমার জন্ম। দুর্ভাগ্যবশত আমার বাপ-দাদারা মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর স্বরূপ সম্পর্কে কোনো কিছু না জেনেই ১৯২৮ সালে কাদিয়ানী ধর্মমত গ্রহণ করে বসে। যা আমাদের দেশে ভারতীয় প্রচারকদের মাধ্যমে পৌঁছেছিল। আমার পূর্বপুরুষদেরকে একথা জানানো হয় যে, এটা ইসলামের সংস্কারে প্রেরিত আসমানী দাওয়াত। আর মির্যা গোলাম আহমদ-এর রূপে হযরত মাসীহে মাওউদ (প্রতিশ্রুত ঈসা আ.) এবং ইমাম মাহদীর আবির্ভাব হয়ে গিয়েছে।
আমিও এটাই বিশ্বাস করতাম যে, কাদিয়ানী মতাদর্শ-ই প্রকৃত ইসলাম এবং কাদিয়ানীরাই সত্যিকার মুসলমান। আর অন্য সবাই কাফের এবং ইসলাম থেকে খারিজ। আমরা কাদিয়ানী ধর্মমত সম্পর্কে শুধু কাদিয়ানী প-িতদের লিখিত রচনা পড়তাম। যার ফলে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, কাদিয়ানী হওয়ার কারণে আমি-ই হকের ওপর আছি। যারা মির্যা গোলাম আহমদ ‘মাসীহে মাওউদ’ ও ‘মাহদীয়ে মাওউদ’ -এর প্রতি ঈমান আনেনি, তারা মিথ্যার ওপর আছে। আমি কাদিয়ানী মতাদর্শ সম্পর্কে কাদিয়ানীদের বইপত্রই অধ্যয়ন করেছিলাম। মুসলমানরা এই ধর্মমত এবং মির্যা কাদিয়ানী সম্পর্কে যা লিখে রেখেছেন, তা আমার জানা ছিল না।
কাদিয়ানীদের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং পারস্পরিক সম্পর্কের আলোচনা শুরু করলে কথা দীর্ঘ হয়ে যাবে। এ বিষয়ে আমার ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে। সংক্ষেপে এটুকুই বলতে পারি যে, কাদিয়ানীরা এমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে বাস করে, যেখানে কারো কাছেই অন্যের স্বভাব-চরিত্র গোপন থাকে না। আমি নিজেকেও নিষ্পাপ-নির্দোষ মনে করি না।
যাইহোক, মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করার উদ্দেশ্যে আমি সুইডেন চলে যাই। সেখানে কাদিয়ানী জামাতের তৃতীয় খলিফা মির্যা নাসেরের সঙ্গে ১৯৭৮ সালে আমার দু’বার সাক্ষাৎ হয়। ঐ সময় খলিফার সঙ্গে সাক্ষাৎ আমার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল। খলিফার নৈকট্যপ্রাপ্তদের মধ্যে স্থান পেতে আমি সুইডেনের পাঠ চুকিয়ে সোজা কাদিয়ানে চলে আসি; যা কাদিয়ানী মতবাদের প্রথম হেডকোয়ার্টার এবং প্রতিষ্ঠাতা মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর জন্মভূমি।
১৯৭৯ সালে আমি কাদিয়ানী মুবাল্লিগ হওয়ার জন্য কাদিয়ানে পড়াশোনা আরম্ভ করি। খলিফা ও অন্যান্য দায়িত্বশীলরা আমার বিশেষ খেয়াল রাখত। কেননা, আমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম এবং কাদিয়ানী ধর্ম প্রতিষ্ঠার পর দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় বিদেশি ছাত্র ছিলাম, যে কাদিয়ানে এসে কাদিয়ানী ধর্মের তালীম হাসিল করছিল। আমি মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর আরবী রচনা ছাড়াও তার উর্দু রচনাবলি বোঝার জন্য উর্দু ভাষাও শিখতাম।
কাদিয়ানে আমার অবস্থানকাল ছিল প্রায় সাত মাস। ছয় মাস ‘বাইতুয্ যিয়াফা’য় (মেহমানখানায়)। এক মাস ‘গুরফাতুর রিয়াযায়’ (সাধনা-কক্ষে)। এটা সেই কক্ষ, যেখানে মির্যা কাদিয়ানী ছ’মাস একটানা রোযা অবস্থায় তার মনগড়া দাবি অনুযায়ী সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে!
আমাকে জানানো হয় যে, মির্যার ঘর হলো ‘শাআইরুল্লাহ’ বা আল্লাহর নিদর্শন(?)। এখানে অবস্থান করলে অনেক বরকত লাভ হয়। মির্যার ঘরে ‘বাইতুয যিকির’, ‘বাইতুল ফিকির’, ‘বাইতুদ দুআ’ এবং ‘মসজিদে মুবারক’ ইত্যাদি বিভিন্ন শিরোনাম বিশিষ্ট কক্ষ রয়েছে।
বাইত মানে একটি স্বতন্ত্র কক্ষ। ‘বাইতুদ দুআ’ ছোটখাটো একটি কক্ষ। এটি মির্যা দুআর জন্য নির্ধারণ করেছিল। ‘বাইতুল ফিকির’ আরেকটি কক্ষ, যা সে ফিকির অর্থাৎ রচনা ও লেখালেখির জন্য নির্দিষ্ট করেছিল। আর ‘বাইতুয যিকির’ নামের কামরাটি সে যিকিরের কাজে ব্যবহার করত। এর আরেক নাম ‘মসজিদে মুবারক’। এ কামরার দরজায় লেখা আছে- ومن دخله كان آمنا (‘যে তাতে প্রবেশ করে, সে নিরাপদ হয়ে যায়।’)২
কামরাটির ভেতরের অংশের দেয়ালে উৎকীর্ণ আছে- بشارة تلقاها النبيون (‘নবীগণ যে সুসংবাদ লাভ করেছেন।’) মসজিদ সংলগ্ন একটি কক্ষের নাম- إيه الحبر الأحمر (‘হে রক্তিম কালি, জ্ঞানী বা আনন্দ!’)। আরেকটি কক্ষ আছে ‘হাকীকাতুল ওহী’ নামে। এছাড়া আরো বিভিন্ন কক্ষ রয়েছে।
কাদিয়ানে পড়াশোনার এ সংক্ষিপ্ত সময় কাটিয়ে আমি হাইফাতে ফিরে যাই। যেন অন্যান্য কাদিয়ানী মুবাল্লিগদের সহযোগিতা করতে পারি। এক বছর অতিবাহিত হলে আমাকে আবার কাদিয়ানে যেতে হয়। প্রথমত কাদিয়ানী মেয়েকে বিয়ে উপলক্ষ্যে। দ্বিতীয়ত বার্ষিক জলসায় অংশগ্রহণ করতে। যা মির্যার অসিয়ত অনুযায়ী প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
পুনরায় হাইফাতে প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৮৪ সনে আমাকে ‘খুদ্দামে আহমদিয়া’ সংগঠনের আর আমার স্ত্রীকে ‘লাজনায়ে ইমাউল্লাহ’-এর প্রধান নিযুক্ত করা হয়। ১৯৮৫ সনে চতুর্থ খলিফা মির্যা তাহের আমাকে ‘কাদিয়ানী মুবাশি^র’ নিযুক্ত করে এবং ল-নে খেলাফতের নতুন মারকাযে ডেকে নেয়।
১৯৮৬ সালের শুরুর দিকে আমার ল-ন পৌঁছার পরপরই খলীফা প্রথমবারের মতো নিজ জামাতের মধ্যে আরবি শাখার ভিত্তি স্থাপন করে আমাকে এর ডাইরেক্টর নিয্ক্তু করে। ১৯৮৮ সালে খলিফা আমাকে তার বয়ান ও খোৎবাসমূহ আরবীতে অনুবাদের কাজে নিয়োজিত করে এবং আরবি ভাষায় একটি মাসিক পত্রিকা বের করার দায়িত্ব আমার ওপর অর্পণ করে।
এসব দায়িত্বের পাশাপাশি আমি তাবলীগ এবং অধ্যাপনার কাজেও ব্যস্ত থাকি। যেমন, ব্রিটেনে আগত মুবাল্লিগদের উদ্দেশে লেকচার দেয়া, বৃটেনে বসবাসরত মুসলমানদেরকে কাদিয়ানী ধর্মের দাওয়াত দিতে তাবলীগী জলসার আয়োজন করা ইত্যাদি।
এসকল মজলিসে আমি মুসলমান আলেম-উলামা ও তালিবে ইলমদের সঙ্গে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর দাবিসমূহের সত্যতার বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক করেছি। ফলে আমার অন্তরে এমন কিছু প্রশ্ন জেগেছে, যদ্দরুন মির্যা গোলাম আহমদের ব্যক্তিত্ব ও দাওয়াত সম্পর্কে আমি ব্যক্তিগতভাবে অধ্যয়নের প্রয়োজন অনুভব করেছি। এটা আমার কাদিয়ানী-ধর্ম ত্যাগ করার প্রধান সূত্র ছিল।
আরেকটি কারণ ছিল আমার একান্ত অভিজ্ঞতা এবং কাদিয়ানীদের সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনার পর্যবেক্ষণ। খলীফা এবং মুবাল্লিগদের সমন্বয়ে পরিচালিত এ কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করে আমি নিশ্চিত হয়ে যাই যে, কাদিয়ানিবাদ হক থেকে অনেক দূরের একটি পথভ্রষ্ট দল। পরিচালনার ক্ষেত্রে আমার কাজের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সাথে সাথে কাদিয়ানী বিশ্বাস ও রীতি-নীতি সম্পর্কে আমার সন্দেহ-সংশয়ও বাড়তে থাকে।
১৯৮৮ সালের জুনে কাদিয়ানী বিরোধীদের প্রতি মির্যা তাহেরের ‘মুবাহালার আহ্বান’ও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তখন থেকে আমি অপেক্ষায় ছিলাম যে, কাদিয়ানী ধর্মের সত্যতার পক্ষে কোনো আসমানি নিদর্শনের প্রকাশ ঘটবে। একপর্যায়ে খলিফা প্রথম নিদর্শন প্রকাশিত হওয়ার ঘোষণা দেন। সেটা ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউল হকের শাহাদাতের ঘটনা।
পাকিস্তানের এ রাষ্ট্রপতি যদিও মুবাহালার আহ্বান গ্রহণ করেননি এবং এর প্রতি কোনো গুরুত্ব দেননি; কিন্তু তারপরও কাদিয়ানীরা (তাদের ধারণা অনুযায়ী) তার শাহাদাতকে আসমানী নিদর্শন বলে মনে করত। যেসকল মুসলমান আলেম-উলামা মুবাহালার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন এবং বিশ্ববাসীর সামনে কাদিয়ানী মতবাদের গোমরাহি উন্মোচন করেছিলেন, তারা দিব্যি সুস্থ ও নিরাপদ জীবন যাপন করছিলেন।
কাদিয়ানীদের এ আচরণে আমি অবাক হয়ে যাই। আমি আরো আশ্চর্য হই যখন দেখি যে, খলিফা তাহের এ ‘আসমানি নিদর্শন’ প্রকাশের আনন্দে টেলফোর্ড- যেখানে আমি থাকতাম- কাদিয়ানীদের মাঝে বিতরণের জন্য মিষ্টি প্রেরণ করে।
সেদিন থেকে এ মুবাহালা চ্যালেঞ্জের আসল কারণ সম্পর্কে আমার অনুসন্ধান শুরু হয় যে, আসলেই কি এটা কোনো মুবাহালা, না শুধুই ঢঙ? আল্লাহর কাছে দুআ করলাম-
اللّهُمّ أَرِنَا الْحَقّ حَقّا وَارْزُقْنَا اتِّبَاعَهُ وَأَرِنَا الْبَاطِلَ بَاطِلًا وَارْزُقْنَا اجْتِنَابَهُ.
হে আল্লাহ! আমাদেরকে সত্যকে সত্য হিসেবে দেখান এবং তা অনুসরণের তাওফীক দিন। আর বাতিলকে বাতিল হিসেবে দেখান এবং তা বর্জনের তাওফীক দিন!
আমি দশই জুনের মুবাহালার ঘোষণা এবং ঐ সময়টি নির্ধারণের নেপথ্যের কারণ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করলাম। মির্যা তাহের আহমদ মুবাহালা ঘোষণার আনুমানিক বছরখানেক পূর্বে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তিনি প্যারিসে একটি স্বপ্ন দেখেছেন। যাতে বলা হয়েছে, ঋৎরফধু ঃযব ১০ঃয (দশ তারিখ জুমার দিন।)
সেই থেকে কাদিয়ানীরা দশ তারিখ বিশিষ্ট প্রত্যেক জুমার দিন কোনো বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকে। অবশেষে খলিফা ১০ জুন ১৯৮৮ ঈ. জুমার দিন এ ইংরেজি স্বপ্ন পূরণ করতে মুবাহালার আহ্বান জানান। এটা ছিল আমার চিন্তা-ভাবনার একটি দিক।
অপরদিকে আমি বিশ্বব্যাপী কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরীণ অবস্থার প্রতি নজর দিলাম। ১৯৮৯ সালে এ ধর্ম প্রতিষ্ঠার শতবার্ষিকী ছিল। আমি লক্ষ্য করলাম, জামাত তার শতবর্ষের কর্মকাণ্ডের ফলাফল গোপন করার জন্য নতুন নতুন ঘোষণা দিতে ব্যস্ত। এর ফলে আমার নিকট কাদিয়ানিবাদের ধোঁকাবাজি, ভ্রষ্টতা ও গোমরাহির বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ রইল না। খলিফা এবং জামাতের একান্ত প্রচেষ্টা ছিল, পরিচিত-অপরিচিত প্রত্যেকের সামনে নিজেদের শতবর্ষের গৌরবগাঁথা তুলে ধরা। এ অবস্থায় আসল স্বরূপ বোঝা কঠিন থাকল না। কারণ, আমি কাদিয়ানী জামাতের ভেতর ও বাহিরের অবস্থা সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ ওয়াকিবহাল ছিলাম।
এবার আমি কাদিয়ানী ধর্মমতকে ভিন্ন এক দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করলাম। আমি মির্যা কাদিয়ানীর এতদিনকার স্বীকৃত দাবিগুলো যাচাই করলাম। তার সম্পর্কে মুসলিম আলেমদের রচনাবলি অধ্যয়ন করলাম। এতে আমার দৃষ্টিতে এমন কিছু বিষয় ধরা পড়ল, যা এতদিন আমার অজানা ছিল। অথবা মনে করুন, জানার চেষ্টাই করিনি কখনো। কাদিয়ানী ধর্মমতের প্রতি আমার মানসিক ও আত্মিক দূরত্বের সূচনা তখনই হয়ে যায়। যেসব সমস্যা আমার দৃষ্টিতে ধরা পড়ে, তার কয়েকটি ছিল এই-
১. খাঁটি মির্যাঈ ও কাদিয়ানী হওয়ার জন্য নিজ আয়ের ৬.২৫ শতাংশ (অর্থাৎ ১৬ভাগের একভাগ) কাদিয়ানী জামাতকে প্রদান করা আবশ্যক।
২. মাকবারাতুল জান্নাহ বা বেহেশতী মাকবারায়৩ স্থান পেতে হলে আয়ের ন্যূনতম দশ শতাংশ আদায় করা আবশ্যক।
৩. মির্যা কাদিয়ানীর ষাটের অধিক বয়সে ১৭ বছরের এক কিশোরীকে বিয়ে করতে জিদ ধরা এবং একথা বলা যে, ‘এটা আল্লাহর হুকুম ও ইচ্ছা’। আর তারপর ঐ কিশোরী কর্তৃক প্রত্যাখ্যানের পর বিয়ে করতে না পারায় কাদিয়ানীর এ ওজর পেশ করা যে, এ অবস্থায় ভবিষ্যদ্বাণীটির অর্ধেক পুরো হয়ে গেছে।৪
৪. এ জামাত প্রতিষ্ঠার এক শতাব্দী পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এর অভ্যন্তরীণ পরিবেশ অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলায় জর্জরিত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, যখন এরা নিজেদের সংশোধনেই ব্যর্থ, তখন এরা বিশ্ববাসীর কী ইসলাহ করবে?
৫. নিরানব্বই শতাংশ কাদিয়ানী এমন, যারা পূর্বে মুসলমান ছিল। পরে ইসলাম ত্যাগ করে কাদিয়ানী হয়েছে। মির্যা কাদিয়ানী তার মাসীহ ও মাহদী দাবি সত্ত্বেও অমুসলিমদেরকে তো ইসলামে দাখিল করতে পারেইনি; উল্টো মুসলমানদেরকেই ইসলাম থেকে বের করে নিজ উম্মত তৈরি করে নিয়েছে।
এগুলো আমার সংশয় ও আপত্তির কিছু নমুনামাত্র। তাছাড়া আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সীরাতের সঙ্গে মির্যা কাদিয়ানীর জীবনীকে তুলনা করে দিন-রাতের পার্থক্য দেখতে পাই। ফলে আমি কাদিয়ানী ধর্মমত ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করার দৃঢ় সংকল্প করি। ১৯৮৯ সনের জুনে আমি আমার পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করে তাদেরকে আমার ইসলামগ্রহণের সুসংবাদ শোনাই।
১৭ জুলাই ১৯৮৯ ঈ. আমি স্ত্রী-সন্তানসহ মারকাযুল আহমদিয়াতে আমার পূর্বের বাসা ছেড়ে অন্য একটি বাসায় স্থানান্তরিত হই। আমি প্রথমে যে কাজটি করেছি তা হল, নিকটস্থ মসজিদে গিয়ে ২১ জুলাই ৮৯ঈ. দিন জুমার খুতবার পর কাদিয়ানী ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ এবং ইসলামগ্রহণের ঘোষণা দিই। তারপর কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দেখা করে তাদেরকে কাদিয়ানী ধর্মমত সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা ও অধ্যয়নের বিষয়ে বিস্তারিত জানাই।
আল্লাহর শোকর, আমার স্ত্রী, পুত্র, কয়েকজন আত্মীয় ও বন্ধু কাদিয়ানী-ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। সুইডেনের কাদিয়ানী জামাতের প্রধান মুহতারাম আহমদ মাহমুদ, হাইফাতে আমার ভাই সালেহ আওদা সপরিবারে এবং মরক্কো ও আলজেরিয়ার আরো কিছু বন্ধুও কাদিয়ানী ধর্মমত ত্যাগ করে ইসলাম কবুল করেন।
فالحمد لله رب العالمين، اللهم زد وبارك.
কাদিয়ানী জামাতের কিছু বিশ্বাস যেমন- হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম তাঁর সম্মানিত মাতা হযরত মারইয়াম-এর সঙ্গে কাশ্মিরে হিজরত করে চলে এসেছিলেন। সেখানে একশ বিশ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর কবরও সেখানে বিদ্যমান৫ । আরো যেমন- হযরত ঈসা আ.-এর মাসীল (সমকক্ষ ও সদৃশ) হল মির্যা গোলাম আহমদ। যার উপাধিও মাসীহে মাওউদ (প্রতিশ্রুত মাসীহ)৬ । -ইত্যাদি যদিও আমার কাদিয়ানিবাদ ত্যাগ করার কারণ হয়নি; কিন্তু মির্যার ধর্মবিশ্বাসের স্বরূপ জানার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহায়ক হয়েছে।
সত্যি কথা বলতে ইসলামগ্রহণ আসলে বাহ্যিকভাবে কোনো সূত্রের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং এটা আল্লাহ তাআলার তাওফীক। ‘আর আল্লাহ যাকে হেদায়েত দানের ইচ্ছা করেন, তার হৃদয়কে ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।’ [সূরা আনআম (৬) : ১২৫] হাঁ, কোনো ব্যক্তির জন্য সত্য উদ্ঘাটন সহজ করে দেয়াটাও হেদায়েতেরই অংশ। আমার উপর আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করেছেন বিধায় মির্যা কাদিয়ানীর স্বরূপ আমার পক্ষে জানা সহজ করে দিয়েছেন। মির্যা কাদিয়ানী- যাকে আমি ‘নবী’ এবং ‘ওহীপ্রাপ্ত রসূল’ মনে করতাম- তার সকল কথা আমার জন্য হক ছিল। সেসব অমান্য করার কোনো অবকাশই আমার ছিল না।
আমি একটিবারও তার এধরনের দাবি যাচাই করিনি। যেমন, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম কাশ্মিরের শ্রীনগরে দাফন হয়েছেন অথবা আল্লাহ কাদিয়ানীকে এ সম্বোধন করেছেন-
>اسمع ولدي! أنت مني بمنزلة توحيدي وتفريدي<
(অর্থ : শোনো আমার পুত্র! তুমি আমার নিকট আমার তাওহীদ ও একত্ববাদের পর্যায়ের।)৭
একজন নিষ্ঠাবান কাদিয়ানী অথবা যার মানসিক গঠন কাদিয়ানী পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়েছে, সে অভিশপ্ত মির্যাকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শ্রেষ্ঠ না মনে করলেও কমপক্ষে তাকে নবীজী থেকে নিচু ভাবতে রাজি নয় (নাউযুবিল্লাহ)। মির্যা গোলাম আহমদ তার ‘খোৎবায়ে ইলহামিয়া’ গ্রন্থে লিখেছে-
অর্থ : ‘আমাদের নবীর রূহানিয়াত ও আধ্যাত্মিকতা পঞ্চম সহস্রাব্দে (আলফে খামেস) তার সংক্ষিপ্ত গুণাবলিসহ আবির্ভূত হয়। ঐ সময় তার চূড়ান্ত উন্নতি সাধন হয়নি। পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ হয়েছে এবং এ রূহানিয়াত ষষ্ঠ সহস্রাব্দের (আলফে সাদেস) শেষদিকে অর্থাৎ, এখন প্রকাশিত হয়েছে। যাতে তার পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ হয় এবং তার নূরের বিজয় নিশ্চিত হয়। সুতরাং আমিই সেই প্রতিশ্রুত প্রকাশস্থল ও সেই নূর। ঈমান আনো। কাফের হয়ো না।...
জেনে রেখো, আমাদের নবী যেমন পঞ্চম সহস্রাব্দে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তেমনি ষষ্ঠ সহস্রাব্দের শেষভাগে প্রতিশ্রুত মাসীহ রূপে আবার আবির্ভূত হয়েছেন।... বরং সত্যি তো হল, তাঁর রূহানিয়াত ষষ্ঠ সহস্রাব্দের শেষভাগে অর্থাৎ বর্তমান সময়ে পূর্বের বছরগুলোর তুলনায় অধিক শক্তিশালী এবং পরিপূর্ণ।’ ৮
মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী জেনে নিয়েছিল যে, কীভাবে নিজের যুগের সাধারণ ধনী-গরীবদের থেকে পয়সা হাতিয়ে নেওয়া যায়। এমন এক যুগে এবং এমন এক দেশে- যেখানে অতিমাত্রায় মূর্খতা ছিল- সে ইসলাম ও ইসলামের রসূলের নাম ভাঙিয়ে অর্থ-উপার্জন শুরু করে।
কিন্তু এ ময়দানে সে একেবারে নিঃসঙ্গ ছিল না। নিজের জন্য সে এক বিশেষ উচ্চ আসন বাছাই করে তার দাবি অনুযায়ী একজন সাধারণ দ্বীনের দাঈ থেকে ধাপে ধাপে মুজাদ্দিদ, মাসীহ, যুগ-ইমাম এবং আরো উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে! তার সচ্ছল এবং নিবেদিত অনুসারীরা ইসলামের খাদেম মনে করে তার পক্ষ সমর্থন করে যায়। যারা তার মাসীহ, মাহদী, রসূল, যুগ ইমাম, মুহাম্মাদের সমকক্ষ ও সকল নবীর অবতার প্রভৃতি দাবির অভ্যন্তরে লুকায়িত বিষ সম্পর্কে উদাসীন ও অজ্ঞ ছিল।
সারকথা, মির্যা ইসলাম ধর্মের প্রশংসা ও গুণগান গেয়ে অনুসারীদের নিকট নিজ দাবি-দাওয়ার প্রাণঘাতী বিষকে ইসলামের আবরণে লুকানোর অপচেষ্টা করেছে। সে জানত, এছাড়া সাধারণ মুসলমানদেরকে লুট করা সম্ভব নয়।
এটা কাদিয়ানীদের দুর্ভাগ্য যে, তারা মির্যার ইসলামের প্রশংসায় রচিত কিছু কবিতা আর তার ‘কুখ্যাত ঐশী ওহী’ (যেমন,I Love You, أنت منى وأنا منك أنت من ماءنا أنت منى بمنزلة عرشي )-এর কারণে তার নবী, মাসীহ এবং মাহদী হওয়াকে বিশ্বাস করে নিয়েছে। পক্ষান্তরে আল্লাহর ফযলে অধিকাংশ মুসলমান তার এসব দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। অনেক খ্রিস্টানও তো ইসলাম, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর প্রশংসায় বই রচনা করেছে! কিন্তু মুসলমানরা শুধু হককেই গ্রহণ করেছে এবং বাতিলকে সর্বদা প্রত্যাখ্যান করেছে।
আমার কাদিয়ানী-ধর্ম ত্যাগ করার কারণ কাদিয়ানীদের বিশেষ কর্মপন্থা অথবা এটা নয় যে, এখানে ব্যাপকভাবে ইতর শ্রেণির লোকজন কাজ করে। বরং এদের মধ্যে ভালো মানুষও রয়েছে। কিন্তু আফসোসের বিষয় হল, তারা মির্যা কাদিয়ানীর দ্বারা প্রতারিত হয়েছে। ঐসব কাদিয়ানীর প্রতি অনুরোধ, তারা যেন কাদিয়ানী মতবাদ ও মির্যা কাদিয়ানী সম্পর্কে মুসলমানদের রচনা অধ্যয়ন করেন এবং আল্লাহ তাআলার নিকট হেদায়েত প্রার্থনা করেন। তিনিই হেদায়েতের মালিক। কাদিয়ানী বন্ধুদের অবগতির জন্য বলছি, খলিফা বা জামাতের মুরুব্বিদের আদেশ মেনে মুসলমানদের সব ধরনের রচনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে তাদের জন্য সত্যকে জানা সহজ হবে না।
আজো কাদিয়ানীরা নিজেদেরকে মুসলমান মনে করে। বরং তারা একমাত্র নিজেদেরকেই হকপন্থী আর বাকি সবাইকে বাতিলপন্থী মনে করে। তারা ইসলাম থেকে সরে গিয়ে নিজেদের একটি স্বতন্ত্র দলীয় পরিচয় তৈরি করেছে। যাকে তারা ‘আহমদিয়াত’ বা কারো কারো ভাষায় ‘প্রকৃত ইসলাম’ বলে।
তাই তাদের দৃষ্টিতে মুসলমানদের পিছনে কোনো কাদিয়ানীর নামায পড়া, মুসলমানের সঙ্গে কাদিয়ানী নারীর বিয়ে হওয়া এবং মুসলমানের জানাযার নামাযে অংশগ্রহণ করা গুনাহ, হারাম এবং গর্হিত কাজ। এর কারণ, তারা মুসলমানদেরকে মুসলমানই মনে করে না। তাদের দৃষ্টিতে যেসব মুসলমান মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর অনুসরণ করে না- তারা অ-আহমদী। অন্য শব্দে বললে ‘কাফের’।১০
ইতিমধ্যে মির্যা এবং কাদিয়ানী ধর্মের স্বরূপ বিশ্লেষণ করে অসংখ্য ইসলামী সংগঠন কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের ব্যাপারে ‘অমুসলিম’ হওয়ার ফতোয়া প্রদান করেছেন। এসব ফতোয়া কাদিয়ানিবাদের ভবিষ্যতের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। কেননা, মুসলিম বিশ্বসহ গোটা পৃথিবীর সম্মুখে কাদিয়ানী ধর্মের স্বরূপ উন্মোচনের ক্ষেত্রে এসকল ফতোয়ার বিরাট ভূমিকা রয়েছে।
এর ফলে কাদিয়ানী ধর্মের উন্নতি বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং তারা তাদের তাবলীগ ও প্রচারকর্ম ছেড়ে নিজেদের মুসলমানিত্ব প্রমাণ করার চেষ্টায় লেগে যায়। হায়! যদি তারা মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে ছেড়ে শুধু ইসলাম নিয়েই সন্তুষ্ট থাকত, তাহলে তাদের এ কষ্ট-সাধনের কোনো প্রয়োজনই হত না!
আমি মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করি না। আমি একসময় চিন্তা করতাম, সারা পৃথিবীর যত মুসলমান কালিমা পড়েন, কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করেন, নামায, রোযা, হজ¦ এবং যাকাত আদায় করেন- তারা কাদিয়ানীদের দৃষ্টিতে কাফের কেন?
মির্যা কাদিয়ানীর আসল রূপ উদ্দেশ্যমূলকভাবে এতদিন আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। মির্যা পরিবার এবং কাদিয়ানী নেতৃত্বের প্রতি সুধারণা ও শ্রদ্ধা-ভক্তির জগৎ বড় রঙিন ছিল। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন এবং কাছ থেকে
দেখার পর ভক্তির এ প্রাসাদ নড়বড়ে হয়ে যায়। অন্তর এ কথার সাক্ষ্য দেয় যে, যারা গোটা পৃথিবীর ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের দাবিদার, তাদের ব্যক্তিজীবন-ই এই মানদণ্ডে পুরোপুরি উত্তীর্ণ নয়।
ইসরাইল সরকারের সঙ্গে কাদিয়ানী জামাতের ‘হাইফা কেন্দ্রের’ বড় ঘনিষ্ঠ
সম্পর্ক। ইসরাইলি পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর মধ্যে শত শত কাদিয়ানী যুবক কাজ করে। হাইফার কাদিয়ানী কেন্দ্র ইসরাইল সরকারের তাবেদার। ‘ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনের’ সঙ্গে কাদিয়ানী কেন্দ্র এবং উপাসনালয়সমূহের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং একে শত্রু এবং বিরোধী পক্ষ গণ্য করা হয়। কাদিয়ানী মারকায ও উপাসনালয় নির্মাণে ইসরাইল সরকার আর্থিক অনুদানও সরবরাহ করে এবং সার্বিক সহায়তাও প্রদান করে।
১. হাইফা : জনসংখ্যার দিক থেকে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। এর বর্তমান জনসংখ্যা আনুমানিক তিন লাখ। খ্রিস্টান, কাদিয়ানী ও মুসলমানরা এখানে সংখ্যালঘু। এপ্রিল ১৯৪৮ সালে শহরটি ইসরাইল জোরপূর্বক দখল করে নেয়। -উইকিপিডিয়া
উল্লেখ্য, এটি কুরআনে কারীমের আয়াত থেকে চুরিকৃত একটি বাক্য। আল্লাহ তাআলা সূরা আলে ইমরানের ৯৭ নং আয়াতে পবিত্র কাবা শরীফ ও মাকামে ইবরাহীমের আলোচনা প্রসঙ্গে এটি উল্লেখ করেছেন।
৩. বেহেশতী মাকবারা- পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলার কাদিয়ানে মির্যা গোলাম আহমদ প্রতিষ্ঠিত কবরস্থানের নাম। কাদিয়ানী ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, এ কবরস্থানের প্রতিষ্ঠা আল্লাহর পক্ষ থেকে ইলহামের (?) মাধ্যমে হয়েছে। এ কবরস্থানেই কাদিয়ানী ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মির্যা গোলাম আহমদ তার পরিবারবর্গ ও গুরুত্বপূর্ণ অনুসারীদের সঙ্গে সমাধিস্থ রয়েছে।
কাদিয়ানীদের নিকট এ কবরস্থান অতিশয় মর্যাদাপূর্ণ। কারণ তাদের ধর্মগুরু বলে গিয়েছে-
صرف بہشتی ہی اس میں دفن کیا جائے گا۔
‘কেবল বেহেশতীরাই এতে সমাহিত হবেন।’ -আলঅসিয়ত, রূহানী খাযায়েন ২০/৩২১; আল্ ওসীয়্যত (বাংলা) পৃ. ৩৯
তাই এখানে দাফন হওয়ার জন্য কাদিয়ানীদের আগ্রহের শেষ নেই। তবে এখানে দাফন হতে চাইলে দলকে সম্পত্তির এক দশমাংশ অসিয়ত করে যেতে হয়। এ প্রথা মির্যা কাদিয়ানী শুরু করে গিয়েছে। কবরস্থানটি প্রতিষ্ঠার সময় মির্যা সাহেব তার এক ঘোষণায় লিখেছে-
‘সমগ্র জামাত থেকে এই কবরস্থানে শুধু তিনিই সমাহিত হবেন যিনি ওসীয়্যত করবেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পরিত্যক্ত সম্পদের দশমাংশ এই সিলসিলার নির্দেশক্রমে ইসলামের বিস্তার ও কুরআনের শিক্ষা প্রচারের উদ্দেশ্যে ব্যয় হবে।’ -আলঅসিয়ত, রূহানী খাযায়েন ২০/৩১৯; আল্ ওসীয়্যত (বাংলা) পৃ. ৩৬
আর যারা কাদিয়ান থেকে দূরদেশে বসবাস করে, সেসকল কাদিয়ানীর প্রতি মির্যার নির্দেশনা হচ্ছে-
‘প্রত্যেক ব্যক্তি যিনি কাদিয়ান থেকে দূরবর্তী দেশের অন্য কোন অংশে বসবাস করেন এবং উল্লিখিত শর্তগুলো যথাযথভাবে পালন করেন সেক্ষেত্রে তাঁর উত্তরাধিকারীরা মৃত্যুর পর তাঁর লাশ একটি সিন্দুকে রেখে কাদিয়ানে পৌঁছে দেবেন।’ -আলঅসিয়ত, রূহানী খাযায়েন ২০/৩২০; আল্ ওসীয়্যত (বাংলা) পৃ. ৩৮
তবে অভিজ্ঞ মুসলমানরা মনে করেন, সারা ভারতবর্ষে কবরকেন্দ্রিক রমরমা ব্যবসা লক্ষ্য করে মির্যা কাদিয়ানী এ কবরস্থান প্রতিষ্ঠা করেছে এবং গতানুগতিক কবর-ব্যবসায়ীদেরকে অতিক্রম করে সোজা বেহেশতী হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে এ ব্যবসা অঙ্গনেও কৃতিত্বের (!) স্বাক্ষর রেখেছে। হায়, এ যাবত কত হতভাগা না জানি সম্পত্তির এক দশমাংশের বিনিময়ে মির্যা কাদিয়ানীর কবরের প্রতিবেশী হয়েছে! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!
৪. এখানে মির্যা গোলাম আহমদের জীবনের একটি ঐতিহাসিক ও শিক্ষণীয় ঘটনা-প্রসঙ্গের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। একবার মির্যা কাদিয়ানী তার স্ত্রী-সম্বন্ধীয় জনৈক আত্মীয়ের এক সুন্দরী কিশোরী কন্যাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। ঘটনাচক্রে কিছুদিন পর মেয়েটির বাবা পারিবারিক একটি প্রয়োজনে মির্যা কাদিয়ানীর মুখাপেক্ষী হন। প্রথমদিকে মির্যা সাহেব এটা-সেটা বলে গড়িমসি করলেও শেষ পর্যায়ে বলে বসে যে, ‘খোদা তাআলার পক্ষ থেকে আমার প্রতি ইলহাম হয়েছে, তোমার এ কাজ এ শর্তে হতে পারে যে, তোমার মেয়েকে আমার কাছে বিয়ে দেবে।’
ঘটনার সূচনা এখান থেকেই। মেয়ের বাবা ব্যাধিজর্জর ও পঞ্চাশোর্ধ মির্যার কথা শুনে হতবাক হয়ে যায় এবং ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করে। মির্যা সাহেব বিভিন্নভাবে তাকে রাজি করানোর কসরত শুরু করে। খোদার আদেশ, কথিত ওহী-ইলহাম, রহমত-বরকত লাভের নানা সুসংবাদ, আত্মীয়-স্বজনকে চিঠি লিখে রাজি করানোর তাগিদ, মেয়েকে জমিজমা-সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ লিখে দেওয়ার প্রলোভন, মেয়ের ভাইকে পুলিশে চাকরি পাইয়ে দেয়ার আশ্বাস, মেয়ের বাবার কাছে কাকুতি-মিনতি- সব পথে হেঁটেও যখন মির্যা ব্যর্থ, তখন শুরু হয় খোদার আযাবের ভীতি প্রদর্শন। মেয়ের মামাকে ঘুষ দিয়ে হাত করার চেষ্টা। মেয়ের ফুফাতো বোন- যে মির্যার পুত্রবধু ছিল- তাকে জোরপূর্বক তালাক প্রদান। এমনকি নিজের প্রথম স্ত্রী- যে এঘটনায় মির্যার বিরোধী ছিল- তাকেও তালাক দিয়ে ফেলে!
মির্যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, এ মেয়ে তার বিবাহে আসবেই। এটা আল্লাহর অটল সিদ্ধান্ত। এতে কোনো পরিবর্তন হবে না। এটা তার সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের মাপকাঠি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই মেয়েটির অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। মির্যা ভবিষ্যদ্বাণী করে যে, তার স্বামী আড়াই বছরের মধ্যে মারা যাবেই এবং এ মেয়ে বিধবা হয়ে হলেও তার কাছে আসবে। বহু হুমকি ও ভবিষ্যদ্বাণী, বহু ইলহাম এবং ইশতেহার মির্যা এসবের পেছনে খরচ করে! কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। না মেয়ের স্বামী মারা গিয়েছে, আর না মির্যা সাহেবের সাধের বিয়ে হয়েছে! এভাবেই মনের দুঃখ মনে রেখে ঐ মেয়ে এবং তার স্বামীর জীবদ্দশাতেই মির্যা কাদিয়ানী ২৬ মে ১৯০৮ঈ. পৃথিবী ত্যাগ করে চলে যায়। মির্যা কাদিয়ানীর মিথ্যাবাদিতার স্বপক্ষে এটি একটি বিরাট ঘটনা।
মির্যা কাদিয়ানীর রচনায় এসংক্রান্ত দলিলাদি দেখুন, মাজমুআয়ে ইশতেহারাত [নতুন সংস্করণ] ১/১৩৬, ১৩৭, ৩৯৮-৩৯৯; আয়নায়ে কামালাতে ইসলাম, রূহানী খাযায়েন ৫/৫৭২; দাওয়াতে কওম, রূহানী খাযায়েন ১১/৬০; কারামাতুস সাদেকীন, রূহানী খাযায়েন ৭/১৬২
৫. এ বিষয়ে দেখুন, যমীমায়ে নুসরতুল হক, রূহানী খাযায়েন ২১/৪০১-৪০৪; আলহুদা, রূহানী খাযায়েন ১৮/৩৬০-৩৬১; কাশফুল গিতা, রূহানী খাযায়েন ১৪/২১০-২১১; কিশতিয়ে নূহ, রূহানী খাযায়েন ১৯/১৬-১৭; কিশতিয়ে নূহ [বাংলা] পৃ. ২৮, ২৯; হাশিয়ায়ে হাকীকাতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/১০৪; তাযকিরাতুশ শাহাদাতাইন, রূহানী খাযায়েন ২০/২৯
৬. দেখুন, ইযালায়ে আওহাম, রূহানী খাযায়েন ৩/১৯২; তাযকিরাহ [৪র্থ সংস্করণ] পৃ. ১৩৮, ১৪৯; হাশিয়ায়ে হাকীকাতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/৭৫
৭. আলহুদা, রূহানী খাযায়েন ১৮/৩৬০, ৩৬১; আলবুশরা ১/৪৯; আরবাঈন-২, রূহানী খাযায়েন ১৭/৩৮২.
৮. এ উদ্ধৃতির সারসংক্ষেপ হচ্ছে, মির্যা কাদিয়ানীর মতে পৃথিবী সৃষ্টির পঞ্চম হাজার বছর পর আল্লাহর রসূলের আবির্ভাব হয়েছিল। তখন নবীজির আধ্যাত্মিকতা পুরোপুরি প্রকাশিত হয়নি। সংক্ষিপ্ত গুণাবলিসহ প্রকাশিত হয়েছিল। নবীজির রূহানিয়াত তখন চূড়ান্ত উন্নতি লাভ করেনি। মির্যা কাদিয়ানীর দাবি, পৃথিবীর ৬ষ্ঠ হাজার বছরের শেষদিকে প্রতিশ্রুত মাসীহ-এর (অর্থাৎ তার দাবি অনুযায়ী তার নিজের) রূপ ধারণ করে নবীজি পুনরায় আবির্ভূত হয়েছেন। এসময় নবীজির সেই আধ্যাত্মিকতা পূর্ণাঙ্গ প্রকাশিত হয়েছে এবং এসময়ের এ রূহানিয়াত ও আধ্যাত্মিকতা আল্লাহর রসূলের সময়ের তুলনায় অধিক শক্তিশালী ও পরিপূর্ণ! (নাউযুবিল্লাহ!) দেখুন- খোতবায়ে ইলহামিয়া, রূহানী খাযায়েন ১৬/২৬৬-২৬৭, ২৭০-২৭২
দেখুন, তাযকিরাহ [৪র্থ সংস্করণ] ৫০; দাফেউল বালা, রূহানী খাযায়েন ১৮/২২৭; দাফেউল বালা [বাংলা] পৃ. ৮; আরবাঈন-২, রূহানী খাযায়েন ১৭/৩৮৫; হাকীকাতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/৮৯; হাকীকাতুল ওহী [বাংলা] পৃ. ৬৯-৭০
বিষয়টির প্রমাণের জন্য দেখুন মির্যা কাদিয়ানী রচিত-নুযূলুল মাসীহ, রূহানী খাযায়েন ১৮/৩৮২; হাকীকাতুল ওহী [উর্দু] রূহানী খাযায়েন ২২/১৬৭; হাকীকাতুল ওহী [বাংলা] পৃ. ১৩০; তাযকিরাহ পৃ. ৫১৯; ৪র্থ সংস্করণ, ২০০৪ ঈ.; মির্যাপুত্র বশীরুদ্দীন মাহমুদের বক্তব্য- আয়নায়ে সাদাকাত, আনওয়ারুল উলুম ৬/১১০
লেখক : সাবেক কাদিয়ানী মুবাশ্বির ও আরবি শাখার ডাইরেক্টর
ভাষান্তর ও টীকা : মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম