কুরআনের খেদমতে নিবেদিতপ্রাণ মনীষী-৩
হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ.
২৮ রমযান ১৪৩৯ হিজরী। রাত দুইটা বাজে প্রায়। সাহরীর জন্য উঠব উঠব করছি, এমন সময় হযরত মাওলানা আবদুল বাসেত ছাহেব দা. বা.-এর ফোন। কান্নাভেজা ভারী কণ্ঠ-ঘুম থেকে উঠেছ বাবা?
: জী, এই উঠছি।
: তোমার নানাজীর তো ইনতিকাল হয়ে গেছে।
ঘুম জড়ানো আওয়াজেই পড়তে লাগলাম, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ইন্না লিল্লাহি... ঘরজুড়ে ডিম বাতির হালকা আলো। কল্পনায় কেমন যেন শূন্যতা। নানাজী চলেই গেলেন...। এই কিছুদিন আগে মাত্র কথা হয়েছে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এই বয়সে আপনার কি ইচ্ছা হয়- আপনার প্রতিষ্ঠানগুলো একটু ঘুরে দেখা, কিংবা...’ আমার কথা সমাপ্ত হওয়ার আগেই কথা শুরু করলেন, যেটা সাধারণত তাঁকে করতে দেখিনি। মনে হল, এ কথার উত্তর দিতে আর তর সইছে না। বললেন, ‘এখন আর কীসের ইচ্ছা। এখন তো শুধু ইনতেযার করছি। কখন ডাক আসে সেই ইনতেযার ছাড়া এখন আর কোনো ভাবনা নাই। কোনো ইচ্ছা নাই।’
একটু থেমে বললেন, ‘আমি তো এখন চলে যেতে চাই। এখন চলে গেলেই ভালো। কিন্তু আবুল বাশার (ছোট ছেলে) বলে, আব্বা! আপনে থাকলে আমাদের জন্য ভালো। দুআ করি, আমার জন্য হলেও আপনি আরো কিছুদিন থাকেন।’
আবার কিছুক্ষণ থেমে বললেন, ‘ইচ্ছার মধ্যে শুধু আরেকবার আল্লাহর ঘরটা দেখে আসতে পারলে ভালো লাগত। এছাড়া আর কোনো ইচ্ছা নাই।’
ব্যক্তি নানাজীর (নানা শ্বশুর) সঙ্গে আমার পরিচয় খুব অল্পদিনের। তবে তাঁর নামের সঙ্গে পরিচয় প্রায় দুই যুগ আগে। যদ্দুর মনে পড়ে, হিফযখানার বছরই প্রথম এই নাম দেখি। মক্তবে পড়ার সময় নাম খেয়াল করিনি। কিংবা বলা যায়, নাম খেয়াল করার মত বয়স ও অবস্থা তখন ছিল না। তখন শুধু পড়েছি। পড়েছি ‘নূরানী পদ্ধতি’র লাল ও সবুজ দুই খ- বইয়ের পড়াগুলোই।
***
নানাজী হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ.-এর পৈত্রিক বাড়ি চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি থানাধীন ইবরাহীমপুর (কৃষ্ণপুর) গ্রামে। এই গ্রামে ১৯৩৭ সালের ১০ অক্টোবর মৌলবী ওয়ালিউল্লাহ ছাহেব রাহ.-এর ঔরসে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ওয়ালিউল্লাহ ছাহেব রাহ. ইমামতি করতেন ঢাকা জেলার ধামরাই থানাধীন ‘বড় জেঠাই’ নামক গ্রামের এক মসজিদে। সেখানে সবাহী মক্তবও পরিচালনা করতেন তিনি। মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ. ছয় বছর বয়সে বাবার কাছে সেই মক্তবে পড়শোনা শুরু করেন। কুরআন শরীফ নাযেরা খতম করেন। সেইসাথে ‘বড় জেঠাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন।
১৯৪৭ সালে দশ বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারান। বাবার ইনতিকালের পর চাঁদপুরের ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা ‘জামিয়া আরাবিয়া কাসিমুল উলূম জাফরাবাদ’-এ ভর্তি হন। আপন চাচাত ভাই হযরত মাওলানা কারী বেলায়েত হুসাইন রাহ. তখন সেই মাদরাসার মুহতামিম। জামাতে নাহবেমীর পর্যন্ত ওখানেই চাচাত ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করেন। নাহবেমীরের বছর অত্যধিক মেহনত ও পরিশ্রমের কারণে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লে ছুটি নিয়ে বাড়িতে যান। এরপর পূর্ণ সুস্থ হতে হতে বছরখানেক সময় লেগে যায়।
১৯৫৫ সনে তাঁর এক ভাতিজা মাওলানা কারী সুলতান আহমাদ ছাহেব তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সুলতান ছাহেব পড়াশোনা করতেন তৎকালীন ঢাকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দ্বীনী প্রতিষ্ঠান ‘জামিয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ’-এ। সেখানে তিনি হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রাহ. (সদর ছাহেব হুযূর)-এর কাছে বালক রহমতুল্লাহকে পেশ করেন এবং তার পিতৃহারা পরিচয় তুলে ধরেন। সদর ছাহেব হুযূর রাহ. তাঁকে আপন সন্তানের মতো গ্রহণ করেন। তাঁর যাবতীয় দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন।
তিনি লালবাগ গিয়েছিলেন বছরের শেষদিকে। তাই সে বছর নিয়মতান্ত্রিকভাবে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হয়নি। সেজন্য সদর ছাহেব হুযূর রাহ. তাকে নিজ দায়িত্বে রাখেন এবং ছোট এক টুকরো কাগজে কিছু লিখে দিয়ে বলেন, ভর্তি বিষয়ে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে এই কাগজ দেখিয়ে বলবে, তুমি আমার ছাত্র। এভাবে ভর্তি ছাড়াই সে বছর পড়াশোনার সুযোগ পান এবং বার্ষিক পরীক্ষায়ও অংশগ্রহণ করেন। পরীক্ষায় নতীজা খুব ভালো হয়। হযরত সদর ছাহেব হুযূর রাহ. নাযেম ছাহেবকে আগেই বলে দিয়েছিলেন, যেন বালক রহমতুল্লাহর নতীজা তাঁকে ভিন্নভাবে দেখানো হয়। নতীজা দেখে সদর ছাহেব হুযূর রাহ. খুব খুশি হন। তাকে ডেকে বলেন, ‘আরে! তুমি দেখি অনেক ভালো নম্বর পেয়েছ!’ পরের বছর এই নম্বরের ভিত্তিতেই তাকে হেদায়াতুন্নাহু জামাতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।
পরীক্ষার নতীজায় তিনি সবসময়ই খুব ভালো করতেন। শরহে বেকায়া থেকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত প্রায় নিয়মিতই তিনি নিজ শ্রেণিতে প্রথম হতেন। তালিবুল ইলমদের মাঝে তার তাকরারের (পাঠ পুনঃপর্যালোচনা) সমাদরও ছিল খুব। এছাড়া তলবে ইলমের যামানা থেকেই তিনি আসাতিযায়ে কেরামের নেক দুআ ও তাওয়াজ্জুহ লাভ করেছেন। কর্মজীবনেও সেই দুআ ও তাওয়াজ্জুহ অব্যাহত ছিল।
লালবাগে প্রায় দশ বছর পড়াশোনা করেন তিনি। এরপর ১৯৬৫ সনে মেধা তালিকায় ১ম স্থান অধিকার করে দাওরায়ে হাদীস পাশ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ২৪/২৫ বছর। এরপর ১৯৬৬ সনে সেখানেই এক বছর ‘উলূমে তাফসীর’ বিভাগে পড়াশোনা করেন।
সেখানে তাঁর আসাতিযায়ে কেরামের মধ্যে ছিলেন হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রাহ.-এর ভাগিনা আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রাহ., মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (সদর ছাহেব হুযূর) রাহ., হযরত মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুযূর রাহ., হযরত মাওলানা হেদায়েতুল্লাহ
ছাহেব (মুহাদ্দিস ছাহেব হুযূর) রাহ., মুফতী দীন মুহাম্মাদ খান রাহ., মুফতী আবদুল মুঈয ছাহেব রাহ., মাওলানা আবদুল কবীর ছাহেব রাহ., মাওলানা আবদুল মাজীদ ঢাকুবী হুযূর রাহ., হযরত মাওলানা সালাহুদ্দীন ছাহেব রাহ. ও শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আজিজুল হক ছাহেব রাহ. প্রমুখ দেশবিখ্যাত উলামায়ে কেরাম।
***
১৯৬৬ সনে নিয়মতান্ত্রিক পড়াশোনা সমাপ্ত হলে রমযান মাসে তিনি হযরত হাফেজ্জী হুযূর রাহ.-এর সঙ্গে ইতিকাফ করেন। (সে রমযান ছাড়াও তিনি হযরত হাফেজ্জী হুযূর রাহ.-এর সঙ্গে আরও অনেকবার ইতিকাফ করেছেন।) রমযানের পর হাফেজ্জী হুযূর রাহ. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘মাদরাসায়ে নূরিয়া’য় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। মাদরাসাটি তখন ছিল কাফিয়া জামাত পর্যন্ত। সেবছর তিনি প্রথম সাময়িক বা দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা পর্যন্ত কাফিয়া জামাতের সকল কিতাব একাই পড়ান। সেইসঙ্গে অন্যান্য জামাতেও দরস দেন। এরই মধ্যে হঠাৎ এক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় তিনি তাঁর উস্তায হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রাহ.-এর কাছে ফরিদপুরের (বর্তমান গোপালগঞ্জের) ‘গওহরডাঙ্গা মাদরাসা’য় চলে যান এবং সেখানে মুহাদ্দিস হিসাবে যোগদান করেন। গওহরডাঙ্গা গিয়ে তিনি তাঁর এই মুশফিক উস্তাযের শেষ জীবনকে খুব কাছে থেকে দেখতে পান। উস্তাযও তাঁকে খুব ¯েœহ ও শফকতের মধ্যে রাখেন। সেসময় উস্তাযের কাছে বিশেষ করে তাফসীর বিষয়ক বিভিন্ন কিতাবের দরস বা একান্ত ‘মুযাকারা’য় শরিক হন। উস্তাযের রচনা ও লেখালেখির ক্ষেত্রেও বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন। হযরত সদর ছাহেব হুযূর রাহ. তখন তাঁর খাবার দাবার ও যাবতীয় সুযোগ সুবিধার বিষয়ে খুব খেয়াল রাখতেন। এ প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব বলেন, ‘সদর ছাহেব হুযূর কখনো বাজারে গিয়ে নিজে পছন্দ করে কোনো জিনিস কিনে আনতেন। এরপর তার এক অংশ কারো মাধ্যমে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতেন। আরেক অংশ নিজের বাসায় পাঠাতেন।’
মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ. গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় যেসব কিতাবের দরস প্রদান করেন তন্মধ্যে রয়েছে- সুনানে আবু দাউদ, তাফসীরে বাইযাবী, হেদায়া, শরহে তাহযীব, কাফিয়া ইত্যাদি।
১৯৬৯ সনে সদর ছাহেব হুযূর রাহ.-এর ইনতিকালের পর তিনি ‘খুলনা আলিয়া’য় মুহাদ্দিস হিসাবে যোগদান করেন। দুই বছর সেখানে খেদমত করার পর দেশে যুদ্ধ শুরু হয়। একপর্যায়ে পরিবেশ খুব অস্বাভাবিক হয়ে পড়লে তিনি তাঁর শ্বশুরের সাথে খুলনার ‘হেলাতলা’য় তাবলীগের মারকায মসজিদে ইমামতি করেন। সঙ্গে ছোট্ট পরিসরে কাপড়ের ব্যবসাও করেন।
১৯৭২ সালের দিকে দেশের পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে তিনি ফরিদপুরের একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। দু’বছর শিক্ষকতার পর নোয়াখালীর পরানপুর এলাকার একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা ও পাশে একটি মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৭৫ সালের শুরুর দিকে একদিন তাঁর চাচাত ভাই ও উস্তায, নূরানী পদ্ধতির আবিষ্কারক হযরত মাওলানা কারী বেলায়েত হুসাইন রাহ. তাঁকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘আপনাদের মতো যোগ্য লোকেরা এদিক সেদিক থাকলে আমার এই নূরানী ট্রেনিং চালাবে কে?’ একথায় তিনি খুবই প্রভাবিত হন। ফলে আগের সব পরিকল্পনা বাতিল করে হযরত মাওলানা বেলায়েত ছাহেব রাহ. থেকে নূরানী ট্রেনিং গ্রহণ করেন। এরপর বেশ কয়েক মাস তাঁর সঙ্গে কাজ করার এক পর্যায়ে নোয়াখালীর মুজাহিদপুর ট্রেনিং সেন্টারে তাকে প্রথম প্রশিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব দেন। সেই থেকে বাকি জীবন তিনি এই খেদমতের মধ্যেই অতিবাহিত করেন।
***
দরসে নেযামীর শিক্ষকতা ছেড়ে নূরানীর খেদমতে আত্মনিয়োগ করা এবং বাকি জীবন এ খেদমতের মাঝেই নিজেকে ব্যস্ত রাখা যেমন সৌভাগ্যের তেমনি মুজাহাদার বিষয়। বিশেষ করে প্রথম যুগে; যখন মানুষ এই মেহনতকে খুবই হালকা মনে করত এবং এর প্রতি অনাগ্রহ প্রকাশ করত। সে সময় মানুষের মাঝে এর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা এবং লোকজনকে তাতে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ ছিল। উপরন্তু বয়স্কদেরকে পড়ানো স্বতন্ত্র মুজাহাদার বিষয়। আল্লাহর মেহেরবানীতে আপন চাচাত ভাইয়ের নির্দেশনায় তিনি এই কষ্ট-মুজাহাদা করার তাওফীক লাভ করেন। যার বিবরণ এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে ধরা অসম্ভব।
এই খেদমতকে ব্যাপক থেকে ব্যাপক করার লক্ষ্যে তিনি সারা দেশের বিভিন্ন মাদরাসায় যান এবং মুআল্লিম ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে অনেক শিক্ষক গড়ে তোলেন। সেইসাথে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ট্রেনিং সেন্টার চালু করেন। এতে সারাদেশে এই ট্রেনিংয়ের প্রতি মানুষের কৌতূহল ও আগ্রহ বাড়তে থাকে। দলে দলে মানুষ ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করে উপকৃত হয়। একসময় দেশের বড় বড় উলামায়ে কেরামও এর জোর সমর্থন করেন। মসজিদে মাহফিলে এর উপকারিতা বর্ণনা করেন। ফলে আম খাস সব মহলেই এর খ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।
***
১৯৭৭ সালের কথা। কিশোরগঞ্জের হাজী মুফিজুদ্দীন ছাহেবসহ কয়েকজন দ্বীনদার লোক হযরত মাওলানা কারী বেলায়েত ছাহেব রাহ.-এর কাছে নূরানী ট্রেনিংয়ের জন্য অভিজ্ঞ একজন মুআল্লিমের আবেদন করেন। হযরত বেলায়েত ছাহেব রাহ. তাঁর প্রিয় ছাত্র মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেবকে নির্বাচন করেন। তিনি কিশোরগঞ্জে মেহনত শুরু করলে বহু মানুষ তাঁর কাছে অল্প সময়েই সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন পড়তে শেখে। এতে দূর-দূরান্ত থেকে আরও অনেক লোকজন আসতে থাকে এবং খুব উৎসাহের সঙ্গে ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করে। তখন (১৯৭৭ সালে) হাজী মুফিজুদ্দীন সাহেবের দানকৃত জায়গায় শোলাকিয়া মাঠের পূর্ব-উত্তর পাশের্^ ‘মাদরাসায়ে নূরিয়া বাগে জান্নাত’ নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। অল্পদিনেই চারদিকে এই মাদরাসার সুনাম-সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সেসময় হযরত হাফেজ্জী হুযূর রাহ.সহ ‘হারদুঈ হযরত’ মাওলানা শাহ আবরারুল হক ছাহেব রাহ.ও সেখানে আগমন করেন এবং মাদরাসার বিস্তারিত হালাত দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন।
হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব তখন সেই মাদরাসা পরিচালনার সাথে সাথে কিশোরগঞ্জ শহরের ঐতিহ্যবাহী শহীদী মসজিদ ও অন্যান্য মসজিদেও ট্রেনিং করান। সেইসঙ্গে ‘শাহাবুদ্দীন ভূঁইয়া মসজিদ’-এ নিয়মিত কুরআনের তাফসীর করেন।
এভাবে দীর্ঘ পাঁচ বছর সেখানে খেদমত করার পর কিছু দুঃখজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে তিনি আবার ঢাকায় চলে আসেন। তখন রামপুরা সালামবাগ জামে মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেইসঙ্গে নূরানী পদ্ধতিতে কুরআন শিক্ষার মেহনতও অব্যাহত রাখেন। ধীরে ধীরে মসজিদটি কুরআন শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।
এভাবে ঢাকায় কিছুদিন অবস্থানের পর কিশোরগঞ্জের তারাপাশা (বয়লা) এলাকার হাজী মুতিউর রহমান ছাহেবসহ কয়েকজন দ্বীনদার লোক মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেবকে পুনরায় কিশোরগঞ্জে যাওয়ার জোর আবেদন করেন। প্রথমে তিনি সম্মত না হলেও তাদের বারংবার আবেদনের ফলে একপর্যায়ে রাজি হন এবং পুনরায় কিশোরগঞ্জ যান। তখন হাজী মুতিউর রহমান ছাহেব নতুন মাদরাসা প্রতিষ্ঠার জন্য সাড়ে ৫২ শতাংশ জায়গা দান করেন। সেখানে ১৯৮৩ সালের ১লা জানুয়ারি হযরত মাওলানা কারী বেলায়েত ছাহেব রাহ.-এর উপস্থিতিতে একটি নতুন মাদরাসার ভিত্তিপ্রস্তর করা হয়। পরের মাসে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে সেখানে সবক উদ্বোধন হয়। সবক উদ্বোধনের কিছুদিনের মধ্যেই (১৯৮৩ সালের ১৭ এপ্রিল) হযরত হাফেজ্জী হুযূর রাহ. সেখানে তাশরীফ নিয়ে যান। সে বছরের বার্ষিক মাহফিলে (১৯৮৩ সালের ২২ ডিসেম্বর) হযরত হাফেজ্জী হুযূর রাহ. দ্বিতীয়বার তাশরীফ নেন। তখন এ মাদরাসার নাম ছিল ‘নূরানী মাদরাসা ও ট্রেনিং সেন্টার’। হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ.-এর ইখলাস, দুআ-মুনাজাত ও কঠোর মেহনত-পরিশ্রমের বদৌলতে কয়েক বছরেই এর সুনাম-সুখ্যাতি দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সব বয়সের মানুষ এখানে এসে কুরআন শেখার মেহনতে শরিক হন।
***
এভাবে যখন ‘নূরানী’ সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে এবং সমাজে এর বহুমুখী ফায়েদা পরিলক্ষিত হয় তখন মুরব্বিগণ এর জন্য স্বতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠানের খুব প্রয়োজন অনুভব করেন। হযরত হাফিজ্জী হুযূর রাহ. কারী বেলায়েত ছাহেব রাহ.-কে ঢাকায় একটি কেন্দ্র স্থাপনের পরামর্শ দেন।
১৯৮০ সালের দিকে হাজী সিরাজুদ্দৌলা ও হাজী আবুল কাশেম প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের সহায়তায় কেন্দ্রের জন্য মোহাম্মদপুরে একটি জায়গা মিলে যায়। হযরত মাওলানা কারী বেলায়েত ছাহেব রাহ. সেখানে নূরানীর কেন্দ্র ও প্রশিক্ষণ সেন্টারের কাজ শুরু করেন।
কয়েক বছর পর বয়স্ক কোর্সের ছাত্র হন ইঞ্জিনিয়ার হাজী আবদুল মালেক ছাহেব রাহ.। নূরানীর প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যার অবদান অনেক। তিনি তখন প্রাথমিকভাবে কিছু সম্পত্তি ওয়াকফ করেন। তন্মধ্যে ছিল ১২১ নং নিউ এয়ারপোর্ট রোডের বহুতল বিশিষ্ট ফিরোজা কমপ্লেক্সের ৩য় তলা (যা প্রায় ৯ হাজার স্কয়ার ফিট)। তাতে ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪ সালে ‘নূরানী তালীমুল কোরআন ওয়াকফ এস্টেট’ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান মুরব্বি হন হযরত মাওলানা কারী বেলায়েত হুসাইন ছাহেব রাহ.। কিন্তু ১৯৮৬/৮৭ সালের দিকে মুতাওয়াল্লী ও কমিটির সাথে কিছু প্রসঙ্গে দূরত্ব তৈরি হলে তিনি ‘ওয়াকফ এস্টেট’ থেকে চলে যান। তখন সবার পরামর্শক্রমে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব অর্পণ করা হয় মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ.-এর উপর।
হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ. তখন ‘ওয়াকফ এস্টেট’-এর শিরোনামে ব্যাপক কাজের উদ্যোগ নেন। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বয়স্ক লোকদেরকে কুরআন শেখানো বা নূরানী ট্রেনিং করানো, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন মাদরাসা, মসজিদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ট্রেনিং করানো, বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী মুয়াল্লিমদের মাধ্যমে বিস্তৃত পরিসরে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি কাজে তাঁর পুরো সময়, মেধা ও শ্রম ব্যয় করেন। সেইসঙ্গে শেষরাতের দীর্ঘ নামায ও মুনাজাতে আল্লাহ তাআলার কাছে এই মেহনত কবুল হওয়ার জন্য খুব দুআ করেন। তখন নূরানী পদ্ধতিতে কুরআন শিক্ষা বিষয়ে দুই খ-ের একটি কিতাবও লেখেন, যা পরবর্তীতে খুব মকবুলিয়্যাত ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। এ কিতাবের মাধ্যমে শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের অসংখ্য মানুষ বিশুদ্ধরূপে কুরআন মাজীদ শেখার ক্ষেত্রে সহযোগিতা লাভ করে।
সেসময় তিনি খুলনা, সিলেটের কাজীর বাজার মাদরাসা, দিনাজপুরের হিলি, রংপুরের জুমাপাড়া এবং বগুড়ার জামীল মাদরাসাসহ দেশের বহু প্রখ্যাত জায়গায়, বহু মাদরাসায় শত শত মানুষকে ট্রেনিং করান। ময়মনসিংহ শহরের ঐতিহ্যবাহী ‘বড় মসজিদে’ যখন ট্রেনিং করান তখন মসজিদের ইমাম ও খতীব বিশিষ্ট বুযুর্গ আলেমেদ্বীন হযরত মাওলানা ফয়যুর রহমান ছাহেব রাহ.ও তাতে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৯ সালে যখন চট্টগ্রামের নানুপুর মাদরাসায় ট্রেনিং করান তখন নানুপুরের পীর ছাহেব হযরত মাওলানা শাহ সুলতান আহমদ নানুপুরী রাহ. তাঁকে ‘রঈসুল মুআল্লিমীন’ উপাধি দেন। ১৯৯০-৯৪ সাল পর্যন্ত চার বছর প্রতি রমযানে তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় ট্রেনিং করান। এছাড়া বি.বাড়িয়ার দ্বীনী প্রাণকেন্দ্র জামিয়া ইউনুসিয়ায়ও তিনি এই খেদমত আঞ্জাম দেন। এরপর ভারতের মুর্শিদাবাদ এবং সেখানের আরো কিছু অঞ্চলে ট্রেনিং করান। এভাবে দীর্ঘ ২৭/২৮ বছর ‘ওয়াকফ এস্টেট’-এ প্রধান প্রশিক্ষক ও মহাপরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এরই মধ্যে (২০০২ সালে) ওয়াকফ এস্টেটের মুতাওয়াল্লি হাজী আবদুল মালেক ছাহেব ইনতিকাল করেন। তখন পরবর্তী মুতাওয়াল্লি হন হাজী সাহেবের ছেলে ড. আবদুল কাইয়ুম ছাহেব। এভাবেই কার্যক্রম চলছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে এক পর্যায়ে হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব ওয়াকফ এস্টেট থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করেন এবং অনাকাক্সিক্ষত এ পরিস্থিতির জন্য খুবই মর্মাহত হন।
অবশ্য জীবনের শেষদিকে (২০১৬ সালের ১৫ জানুয়ারি) ওয়াকফ এস্টেটের আদলে ‘বাংলাদেশ নূরানী তালীমুল কুরআন’ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তোলেন। বর্তমানে সেটি মুহাম্মাদপুরের ঢাকা উদ্যানে অবস্থিত।
ওদিকে কিশোরগঞ্জের তারাপাশায় (১৯৮৩ সালে) ‘নূরানী মাদরাসা ও ট্রেনিং সেন্টার’ নামে যে প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তুলেছিলেন, ২০০৫ সালে তাঁর ছোট ছেলে মাওলানা আবুল বাশার ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমকে সেই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে নিযুক্ত করেন। এরপর ২০১১ সালে মাদরাসাটি ‘জামিয়া নূরানিয়া তারাপাশা’ নামে বড় মাদরাসার রূপ লাভ করে। ২০১৫ সালে তাতে দাওরায়ে হাদীসের উদ্বোধন হয়। শেষ বয়সে হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ. সেখানে সহীহ বুখারীর কিছু অংশের দরস প্রদান করেন।
***
চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানাধীন ‘উজানী’ নামক গ্রামের অধিবাসী প্রখ্যাত বুযুর্গ হযরত মাওলানা কারী ইবরাহীম ছাহেব রাহ.-এর খলীফা ছিলেন কারী সবর আলী ছাহেব রাহ.। তাঁর ছেলে মাওলানা কারী সফিউল্লাহ ছাহেব রাহ.। যিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়ায় দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। সেখানে নাহু-সরফের ইমাম হিসাবেও খ্যাতি লাভ করেছেন। তাঁর দ্বিতীয় মেয়ে মুহতারামা মুবাশশিরা খাতুনের সঙ্গে ১৯৬৭ সালে হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেবের বিয়ের আকদ সম্পন্ন হয়।
***
হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ. ছিলেন তিন ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। বড় এক বোন। এরপর তিনি ও তাঁর ছোট ভাই। বড় বোনের ইনতিকাল হয়ে গেছে। ছোট ভাই হাফেয আলী আসগর ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম বর্তমানে চাঁদপুরের একটি নূরানী হিফযখানা মাদরাসার যিম্মাদার এবং বেশ কয়েকটি মাদরাসার মুরব্বী হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে হায়াতে তায়্যিবা তাবীলা নসীব করুন- আমীন।
মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ. ছোটবেলা থেকেই মায়ের খেদমতের ব্যাপারে খুব যতœশীল ছিলেন। বাড়িতে গেলে নিজ হাতে মায়ের কাপড় ধুয়ে দিতেন। অসুস্থ হলে মন দিয়ে সেবা করতেন। মায়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি একটি ঘটনা প্রায়ই শোনাতেন।
তখন ১৯৭৫ সাল। সারাদেশে দুর্ভিক্ষ চলছে। তিনি ছিলেন নোয়াখালী জেলার মুজাহিদপুর মাদরাসায় ‘নূরানী মুআল্লিম ট্রেনিং’-এর খেদমতে।
তিনি বলেন, অভাব-অনটনের কথা চিন্তা করে সেসময় আমি আম্মার জন্য চাল কিনে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। বাড়িতে পৌঁছার পর আমাকে দেখে আম্মা চিৎকার করে বলে উঠলেন, আল্লাহ! তুমি আমার কথা শুনেছ। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে মা? বললেন, আজকের দিন গেল, আমার ঘরের কেউ এক লোকমা ভাত মুখে দিতে পারেনি। আমি আল্লাহর কাছে দুআ করেছি, আল্লাহ যেন তোমাকে ভালো রাখেন। আলহামদু লিল্লাহ, তুমি যে ভালো আছ আল্লাহ আমাকে দেখিয়ে দিলেন।
পারিবারিক সংকটের আরেকটি ঘটনা শোনান তিনি। তখন তাঁর আম্মাসহ পরিবারের সবাই না খেয়ে আছেন। খাবারের কোনো ব্যবস্থাও হচ্ছিল না। হঠাৎ তিনি বললেন, হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে নিজের জন্য কিছু চাচ্ছি না বলে কি তুমি আমার অবস্থা দেখছ না? রাতে তাহাজ্জুদের পর খুব কান্নাকাটি করলেন। সকালে বাইরে হাঁটছিলেন। হঠাৎ এক আগন্তুক তাঁর হাতে কিছু হাদিয়া পেশ করে চলে গেল। তা দিয়ে খাবারসহ অন্যান্য প্রয়োজনও পুরা হল।
ছোটবেলা থেকেই মা-বাবা তাঁকে বিশেষভাবে তারবিয়ত করেছেন। আল্লাহর ভয় ও ভালবাসা এবং আল্লাহ তাআলার কাছে জীবনের সকল বিষয় সোপর্দ করা, তাঁর প্রতি আস্থা ও ভরসা রাখা ইত্যাদি শিক্ষা দিয়েছেন। এ শিক্ষার মজবুত প্রভাব পড়েছিল তাঁর কোমল হৃদয়ে। ছোট্ট একটি ঘটনা থেকে তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। ঘটনাটি ১৯৪৯ সালের। দক্ষিণবঙ্গে এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল তখন। হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ.-এর বয়স মাত্র বারো বছর। ঝড় শুরু হল রাতে। তাঁদের থাকার ঘরটি ছিল খুবই দুর্বল। তীব্র বাতাসে একটু নড়াচড়াও করছিল। তাই মা বললেন, চল বাবা! আমরা অমুকের ঘরে চলে যাই। তিনি বললেন, আম্মা! আল্লাহ তাআলা বাঁচালে আমাদেরকে এখানেই বাঁচাবেন। মৃত্যুর হুকুম হলে যেখানেই যাব বেঁচে থাকতে পারব না। বাচ্চা বালকের এই কথায় মা অবাক হলেন। তবু পীড়াপীড়ি করলেন, অন্য ঘরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু ছেলের সংকল্প দেখে অগত্যা বড় মেয়ে ও ছোট ছেলেকে নিয়ে তিনি অন্য ঘরে চলে গেলেন। বালক রহমতুল্লাহ দাঁড়িয়ে গেলেন জায়নামাযে। সকালে দেখা গেল আশপাশের বহু ঘরবাড়ি ভেঙ্গে গেছে। গাছপালা উপড়ে গেছে। কিন্তু বালক রহমতুল্লাহর ঘরের কিছুই হয়নি। ঝড়ে যেটুকু বাঁকা হয়েছিল, বাতাসে সেটুকুও সোজা হয়ে গেছে। তখন প্রতিবেশী অনেকেই তাঁর ঘরে আশ্রয় নিল।
দশ বছর বয়সেই তাঁর বাবার ইনতিকাল হয়ে যাওয়ায় তিনি বাবার খেদমত করার তেমন সুযোগ পাননি। তাই বাবার জন্য খুব দুআ করতেন। বাবার জান্নাত নসীব ও দারাজাত বুলন্দির উদ্দেশ্যে দান-সদকা, ঈসালে সওয়াব করতেন।
হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ.-এর মুহসিন উস্তাযগণের মধ্যে ছিলেন, মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রাহ., হযরত মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুযূর রাহ. ও মাওলানা কারী বেলায়েত হুসাইন রাহ.। দরস ও একান্ত আলোচনায় তিনি তাঁদের অনেক স্মৃতিচারণা করতেন। তাঁদের ইহসানের শোকর আদায় করতেন। তাঁদের দারাজাত বুলন্দির জন্য দুআ করতেন। সংক্ষেপে তাঁদের দুয়েকটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা হল-
মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ. যখন লালবাগ মাদরাসায় আসেন তখন ছিল প্রচ- শীতের মৌসুম। তাই সদর ছাহেব হুযূর রাহ. তাঁকে একটি শীতের চাদর দিয়েছিলেন।
ওদিকে মাদরাসায় তখনও মাতবাখ (বোর্ডিং) ব্যবস্থা চালু হয়নি। তালিবুল ইলমরা সবাই জায়গিরে খাবার খেত। সে হিসাবে বেশ দূরে (ওয়াশপুরে) মাওলানা রহমতুল্লাহ সাহেবের একটি জায়গির হয়। তবে বেশিদিন সে জায়গির টিকে থাকেনি। জায়গির বাতিল হওয়ার পর লালবাগ মসজিদের মুআযযিন সাহেবের কথায় তার সঙ্গে কিছুদিন খাবার খান। কিন্তু মুআযযিন সাহেবের এক ছেলেসহ তিনজন মানুষ একজনের খাবার খাওয়া কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল। এতে লজ্জায় পড়ে মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব বাড়িতে চলে যান। কিছুদিন পর বাড়ি থেকে এলে যোহরের নামাযের আগে ওযুখানায় হযরত হাফেজ্জী হুযূর তাকে দেখে বলেন, ‘তুমি রহমতুল্লাহ না? কোথায় থাকো? কতদিন হল দেখি না! শুনেছি তোমার জায়গির নেই। নামাযের পর তুমি কামরায় দেখা করবে।’
তখন হযরত হাফেজ্জী হুযূর ও সদর ছাহেব হুযূর রাহ. একত্রে খাবার খেতেন। মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব সেখানে দেখা করতে গেলে হাফেজ্জী হুযূর রাহ. সদর ছাহেব হুযূরের সঙ্গে পরামর্শ করে বলেন, ‘আজ থেকে তুমি আমাদের খাবার আনবে এবং আমাদের সঙ্গেই খাবে। আমাদের দুজনের কাছেই তোমার জায়গির।’ এভাবেই তখন এই মহান দুই উস্তাযের খেদমত করার সুযোগ হয়ে যায়। সেই সূত্রে তাঁদের আদর-¯েœহও পেতে শুরু করেন।
তাছাড়া হযরত সদর ছাহেব হুযূর রাহ. তাঁকে খুব মহব্বত করতেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে সাহায্য করতেন এবং আপন ছেলের মতোই আদর করতেন। তাই মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ. তাঁর স্মৃতিচারণা করতে গেলে প্রায়ই আবেগাপ্লুত হয়ে বলতেন, ‘সদর ছাহেব রাহ. আমাকে বে-ইন্তেহা মহব্বত করতেন। তাঁর কাছে আমি এতো স্নেহ-মমতা পেয়েছি, সম্ভবত আমার মা-বাবার কাছ থেকেও অতটা পাইনি।’
তবে তিনি স্বভাব লাজুকতা ও শারাফতের কারণে অতি প্রয়োজন কিংবা সংকটের কথাও কারো কাছে সহজে বলতেন না। দেখা যেত, দীর্ঘদিন ধরে কোনো একটা জিনিসের কষ্ট করে যাচ্ছেন, খুব সহজেই জিনিসটির ব্যবস্থা হওয়া সম্ভব। কিন্তু তিনি কারো কাছে তা প্রকাশ করছেন না। নীরবেই কষ্ট করছেন। একবার ছাত্রজীবনে অত্যধিক মেহনতের কারণে শরীর খুব দুর্বল হয়ে পড়লে অবস্থা দেখে হযরত মাওলানা কারী বেলায়েত ছাহেব রাহ. তাঁকে দুধ খাওয়ার জন্য পাঁচ টাকা দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুহাম্মা আবদুল মালেক সাহেব দামাত বারাকাতুহুমের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি একবার বলেন, ‘ছাত্রজীবনে একবার মাওলানা বেলায়েত সাহেব আমাকে পাঁচ টাকা দিয়েছিলেন। আজও আমি সেই কথা ভুলিনি।’
***
হযরত সদর ছাহেব হুযূর ও হাফেজ্জী হুযূর রাহ.-এর জীবদ্দশায় তিনি তাঁর এই দুই উসতাযের সঙ্গেই ইসলাহে নফস বা আত্মশুদ্ধির বিষয়ে পরামর্শ করতেন এবং তাঁদের দিকনির্দেশনা গ্রহণ করতেন। এই দুই উস্তাযের ইনতিকালের পর হযরত থানবী রাহ.-এর সর্বশেষ খলীফা মুহিউস সুন্নাহ হযরত মাওলানা আবরারুল হক ছাহেব রাহ.-এর সঙ্গে সম্পর্ক কায়েম করেন।
হাফেজ্জী হুযূর রাহ.-এর বিশিষ্ট খলীফা, লালবাগ জামিয়ার মুহাদ্দিস এবং হযরত মাওলানা আবদুল আযীয জনাবওয়ালা রাহ.-এর ছাহেবযাদা মাওলানা আবদুল কবীর ছাহেব রাহ. তাঁকে খেলাফত প্রদান করেন।
১৯৯৬ ও ১৯৯৮ সালে দু’বার তিনি বাইতুল্লাহর উদ্দেশ্যে সফর করেন এবং হজ্ব আদায় করেন। এক হজ্বের সফরে জান্নাতুল বাকীতে বসে একটি কিতাব লেখেন ‘ফাযায়েলে কোরআন’ নামে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সফরেই কিতাবটি হাতছাড়া হয়ে যায়। এছাড়াও তিনি আরো কয়েকটি কিতাব লেখেন। তন্মধ্যে রয়েছে- কালজয়ী কিতাব ‘পবিত্র কোরআন ও দ্বীন শিক্ষার নূরানী পদ্ধতি’ (দুই খণ্ড), নূরানী পদ্ধতিতে অল্পদিনে কোরআন শিক্ষা, নূরানী কায়দা, মাতৃজাতির মর্যাদা ইত্যাদি।
***
তাঁর তিন ছেলে ও চার মেয়ে। বড় ছেলে হযরত মাওলানা আবুল কাসেম ছাহেব দা. বা. ঢাকার বনানীতে একটি মাদরাসা ও ‘বাংলাদেশ নূরানী মিফতাহুল কুরআন ফাউন্ডেশন’-এর পরিচালক। মেঝো ছেলে আবুল হাসানাত অল্প বয়সেই ইনতিকাল করেন। ছোট ছেলে হযরত মাওলানা আবুল বাশার ছাহেব দা.বা. কিশোরগঞ্জের জামিয়া নূরানিয়া তারাপাশা ও ‘বাংলাদেশ নূরানী তা‘লীমুল কুরআন’-এর পরিচালক। চার মেয়ে সবাইকে তিনি আলেম খান্দানে এবং আলেম স্বামীর কাছে বিয়ে দেন। তিনি তাঁর ৩২ জন নাতি-নাতনি দেখে যান (বর্তমানে তারা ৩৬ জন)। তাদের বড়রা সবাই মাদরাসায় পড়াশোনা করছে। ছোটরা ঘরেই দ্বীনী পরিবেশে প্রতিপালিত হচ্ছে।
তাঁর স্ত্রী এখনো জীবিত। তিনিও স্বামীর মত কুরআনের একজন খাদেমা। ঘরেই মহিলাদের মাঝে কুরআনের খেদমত করেন।
আজীবন কুরআনের খেদমতে নিয়োজিত, বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এই মনীষী গত ২৮ রমযান ১৪৩৯ হিজরী/১৪ জুন ২০১৮ ঈসাব্দ, বৃহস্পতিবার রাত ১ টা ৩৮ মিনিটে প্রায় ৮১ বছর বয়সে নশ্বর এই দুনিয়া ছেড়ে আখিরাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান। সেদিনই বাদ যোহর কিশোরগঞ্জের জামিয়া নূরানিয়া তারাপাশা মাদরাসায় বিপুলসংখ্যক উলামা-তলাবার অংশগ্রহণে তাঁর নামাযে জানাযা আদায় করা হয়। মাদরাসা-মসজিদের পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়।
رحمه الله تعالى رحمة واسعة، وأدخله في فسيح جنانه. اللهم اكتبه عندك من المحسنين، واجعل كتابه في عليين، واخلفه في أهله في الغابرين، ولا تحرمنا أجره، ولا تفتنا بعده.
সূত্র : এই লেখা প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে মাওলানা মামুনুর রশীদ ছাহেব, যিনি হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ-এর কাছ থেকে দীর্ঘদিন আত্মকথা শুনে শুনে লিখেছেন, তার একটি পাণ্ডুলিপি থেকে। সেইসঙ্গে হযরতের বড় মেয়ের ঘরের নাতি মাওলানা ইবরাহীম ভাইয়ের একটি প্রবন্ধ থেকেও তথ্য নেওয়া হয়েছে। (প্রবন্ধটি পরবর্তীতে আরও পরিমার্জিতরূপে ‘খাদিমুল কুরআন হযরতুল আল্লাম মাওলানা কারী রহমতুল্লাহ রহ. : জীবন ও কর্ম’ শিরোনামে দ্বিমাসিক ‘রাবেতা’ পত্রিকার আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।) তাছাড়া ‘নূরানী তালীমুল কুরআন ওয়াকফ এস্টেট’-এর ‘গঠনতন্ত্র’, ‘বার্ষিক রিপোর্ট’ ও সংশ্লিষ্ট কিছু কাগজপত্রের সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু তথ্য হযরতের জীবদ্দশায় সরাসরি তাঁর কাছ থেকেও শোনা হয়েছে। হযরতের স্ত্রী এবং বিশেষভাবে ছোট ছেলে হযরত মাওলানা আবুল বাশার ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে অনেক তথ্য নেওয়া হয়েছে। লেখা প্রস্তুত করার পর হযরতের উভয় ছেলেকে দেখানো হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে বেশ কিছু সম্পাদনা ও তথ্য বর্ধিত করা হয়েছে। জাযাহুমুল্লাহু জামিআন আহসানাল জাযা।