বর্ণবাদ : যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলন কী বার্তা দেয়?
গত ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটায় জর্জ ফ্লয়েড নামক একজন কৃষ্ণাঙ্গের মৃত্যুর পর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বর্ণবাদ-বিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশ হেফাজতে ৪৬ বছর বয়সী এই ব্যক্তির মৃত্যু হয়। মিডিয়ায় পরিবেশিত সংবাদে জানা যায় যে, তাকে ঘাড়ে হাঁটু চাপা দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছিল। এ ঘটনা বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় সৃষ্টি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ-শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি সর্বজনবিদিত। সারা পৃথিবীতে মানবাধিকারের পুলিশি দায়িত্ব পালনরত যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের অন্ধকার কত গভীর তা চিন্তা করলেও শিহরিত হতে হয়।
শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারের অমানবিক নির্যাতনে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ভিডিওটি যেদিন ভাইরাল হয় সেদিনই আরেকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যার বিষয়বস্তু ছিল, একজন শ্বেতাঙ্গ নারীর পোষা কুকুর নিয়ে সামান্য বিতর্কের জের ধরে পুলিশ ডাকার এবং এ কারণে এক কৃষ্ণাঙ্গের উপর পুলিশের চড়াও হওয়ার ঘটনা।
মনে পড়ে যায়, পাঠ্যপুস্তকের সেই মাস্টার মশাইয়ের ঘটনা, যিনি তার ছাত্রদের অংক-বিদ্যায় পারদশির্তার পরীক্ষা নিয়েছিলেন এই প্রশ্ন করে যে, ‘মাস্টার মশাই ও তার পরিবারের সব সদস্য মিলে ইংরেজ ইনস্পেক্টর সাহেবের কুকুরের কয় পায়ের সমান?’
গল্পটা সবারই জানা আছে, বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই। ‘গ্রেট-আমেরিকায়’ হোয়াইট-সুপ্রিমেসির ন্যক্কারজনক ঘটনাগুলোর প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগে যে, আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গদের পোষা কুকুরগুলো যে অধিকার পায় একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে ওইটুকু অধিকার পেতেও আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে?
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উৎকর্ষের চরম শিখরে পৌঁছে যাওয়ার পরও চিন্তা ও কর্মের এই দৈন্য কেন-তা কি ভেবে দেখার মতো বিষয় নয়?
স্বভাব ও মানসিকতায় কেন এই দীনতা? মানুষ হয়েও কেন মনুষ্যত্বের অবমাননা? একি নিজেরই অবমাননা নয়? সত্যিই, এইসকল ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, শুধু বস্তুগত উৎকর্ষ ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতির দ্বারা মানুষের জীবন ও স্বভাবের উন্নতি হয় না। এর জন্যে প্রয়োজন সত্যিকারের আদর্শ। মানবের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যে শিক্ষা ও আদর্শ এসেছে তার লালন ও অনুসরণের মাধ্যমেই মানুষের মনুষ্যত্ব বিকশিত হতে পারে।
মানবতার সৌভাগ্য যে, আল্লাহ তাআলা ইসলামের মাধ্যমে সেই শিক্ষা ও আদর্শকে সংরক্ষণ করেছেন। যে শিক্ষা যুগে যুগে মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধন করেছে, মানুষের মাঝে ঘুমিয়ে থাকা মানবতাকে জাগ্রত করেছে। ইসলামের অনন্য বৈশিষ্ট্য এই যে, নিখুঁত ও যথার্থ নীতি-আদর্শের পাশাপাশি সেই নীতি-আদর্শের প্রয়োগ ও সুফলও মুসলিম জাহানে যুগে যুগে দেখা গেছে।
কুরআনে কারীম যেমন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছে যে, মানবসমাজে জাতি-গোষ্ঠীর বৈচিত্র্য শুধু পারস্পরিক পরিচিতির জন্য; আল্লাহর কাছে সে-ই বেশি মর্যাদাবান, যে বেশি মুত্তাকী। তেমনি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এই কুরআনী শিক্ষাকে বাস্তব জীবনে বাস্তবায়িত করে গেছেন।
জীবনব্যাপী যে শিক্ষা তিনি তাঁর সাহাবীদের দিয়েছেন, বিদায় হজ্বে ভাষণে তা আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এই বলে-
يَا أَيّهَا النّاسُ، أَلَا إِنّ رَبّكُمْ وَاحِدٌ، وَإِن أَبَاكُمْ وَاحِدٌ، أَلَا لَا فَضْلَ لِعَرَبِيٍّ عَلَى عَجَمِيٍّ ، وَلَا لِعَجَمِيٍّ عَلَى عَرَبِيٍّ، وَلَا أَحْمَرَ عَلَى أَسْوَدَ، وَلَا أَسْوَدَ عَلَى أَحْمَرَ، إِلّا بِالتّقْوَى.
হে লোকসকল! সাবধান! তোমাদের রব একজন, তোমাদের বাবাও একজন। সাবধান! কোনো আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই কোনো অনারবের উপর, কোনো অনারবেরও শ্রেষ্ঠত্ব নেই কোনো আরবের উপর, কোনো লাল চামড়ার মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নেই কালো চামড়ার মানুষের উপর, কোনো কালো চামড়ার মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নেই লাল চামড়ার মানুষের উপর। শ্রেষ্ঠত্ব শুধু তাকওয়ার দ্বারা। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৪৮৯
কুরআন-সুন্নাহর এই শিক্ষার সুফল এভাবে প্রকাশিত হয়েছিল যে, সাদা-কালোর পার্থক্য মানুষ ভুলেই গিয়েছিল। গাত্রবর্ণের নয়, মুসলিম-সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্বভাব ও কর্মের শ্রেষ্ঠত্ব। ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছে আরবের সম্ভ্রান্ত কুরাইশ গোত্রের অভিজাত ব্যক্তি, মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর রা.-এর সেই উক্তি-
أَبُو بَكْرٍ سَيِّدُنَا، وَأَعْتَقَ سَيِّدَنَا يَعْنِي بِلاَلًا.
আবু বকর আমাদের ‘সায়্যিদ’, তিনি আযাদ করেছেন আমাদের ‘সায়্যিদ’কে; অর্থাৎ বেলাল রা.-কে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৭৫৪
হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. হযরত বেলাল রা.-কে আযাদ করেছিলেন। হযরত বিলাল রা. ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি, উপরন্তু আযাদকৃত দাস। অথচ তিনি সম্বোধিত হয়েছেন ‘সায়্যিদুনা’ বিশেষণে।
মুসলিম উম্মাহর শত অবক্ষয়ের পরও সেই সোনালী যুগের আদর্শিক দ্যুতি এখনও জ্বলে জোনাকির মতো। বর্তমান সময়ের ‘উন্নত’ রাষ্ট্রগুলোতে যখন বর্ণবাদের অন্ধকার ছেয়ে আছে সেই সময় মুসলিম বাবা-মা কত আনন্দের সাথে আদরের সন্তানের নাম রাখেন ‘বিলাল’। তাদের চিন্তার ত্রিসীমানাতেও আসে না, এ নামটি একজন কৃষ্ণাঙ্গের নাম। এভাবেই ইসলাম আমাদের অস্থিমজ্জায় কতকিছু যে মিশিয়ে দিয়েছে তা আমরা আলাদাভাবে উপলব্ধি করি না।
আমাদের উপলব্ধি করা উচিত। চারপাশের শত কদর্যতার মধ্যেও শুধু মুসলিম-পরিবারে জন্মগ্রহণ ও মুসলিম সমাজে বিচরণের ফলে ছিটেফোঁটা যে আদর্শিক দ্যুতিতে এখনও আমাদের জীবন দ্যুতিময় তা আমাদের উপলব্ধি করা উচিত। তাহলে হয়ত সেই পূর্ণ আদর্শের দিকে প্রত্যাবর্তনের আকাক্সক্ষা আবার আমাদের মনে জাগতে পারে।
সত্যিকথা এই যে, ঐ আদর্শের দিকে প্রত্যাবর্তন ছাড়া বিশ্ববাসীর মুক্তির আর কোনো পথ নেই।