তাঁরা আমাদের পূর্বসুরী
কোনো স্বার্থ হাসিলের জন্য নয়, শুধু দ্বীন ও ঈমানের খাতিরে যাদেরকে অবর্ণনীয় কষ্ট-ক্লেশ সইতে হয়েছে তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য হলেন সাহাবায়ে কেরাম। ইসলামের প্রথম দিকে কাফেরদের হাতে তাঁরা কঠিনভাবে নিগৃহীত হয়েছিলেন। ইসলামের প্রথম শহীদ হযরত সুমাইয়া রা.-এর নাম এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সুমাইয়্যা রা. ছিলেন আম্মার রা.-এর পুণ্যবতী জননী। এ পরিবারটি একদম ইসলামের প্রথম দিকেই মুসলমান হয়েছিলেন এবং যথারীতি গোটা পরিবারকেই কাফেরদের অবর্ণনীয় অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু ঈমান তাদের হৃদয়ে এত গভীরভাবে স্থান করে নিয়েছিল যে, শত অত্যাচারেও তাতে কোনোরূপ দুর্বলতা সৃষ্টি হয়নি।
একদিন হযরত সুমাইয়্যা রা.কে কাফেররা মরুভূমি তপ্ত বালুতে শায়িত করে রেখেছিল। নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার এই দুরবস্থা দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হৃদয় বিগলিত হল এবং তাকে লক্ষ করে বললেন, ‘ধৈয্যধারণ কর, তোমার নিবাস হবে জান্নাতে।’
আবু জাহল এই সাহাবিয়াকে লক্ষ করে বর্শা নিক্ষেপ করে এবং তিনি শাহাদত বরণ করেন। তিনিই হলেন ইসলামের প্রথম শহীদ।
শুধু দুর্বল নারীগণই নন, ইসলাম গ্রহণের অপরাধে অভিজাত ঘরানার নারীরাও বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর ইসলাম গ্রহণের আগে তাঁর বোন ফাতিমা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। উমর রা. যখন ভগ্নি ও ভগ্নিপতির ইসলাম গ্রহণের সংবাদ শুনলেন, তখন তাদের উভয়কে প্রচন্ড প্রহার করলেন। এসময় বোন ফাতিমা অত্যন্ত দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘ভাই! তোমার যা ইচ্ছা করতে পার, আমরা ঈমান এনেছি- এই হল শেষ কথা।’ বোনের এই অনমনীয়তা উমরের দৃঢ়তার ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। পরিশেষে আল্লাহ তাঁকে ইসলামের সম্মান দান করলেন।
শাহাদাতের তামান্না
সাহাবায়ে কেরামের দৃষ্টিতে শাহাদাত ছিল অমরত্বের সূচনা। সেই পবিত্র ও লয়হীন জীবনের জন্য তাঁরা লালায়িত ছিলেন।
উম্মে ওয়ারাকা বিনতে নওফেল একজন সাহাবিয়া। বদর যুদ্ধের সময় তিনি এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আবেদন করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে জিহাদে শামিল হওয়ার অনুমতি দিন, আমি আহতদের সেবা-শুশ্রূষা করব, হয়ত আল্লাহ তাআলা আমাকেও শাহাদাতের সৌভাগ্য নসীব করবেন।’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘তুমি তোমার ঘরেই অবস্থান কর, আল্লাহ তোমাকে সেখানেই শাহাদাত দান করবেন।’
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছিল। উম্মে ওয়ারাকা একজন দাস ও একজন দাসীকে ‘মুদাববার’ বানিয়েছিলেন। অর্থাৎ তারা তাঁর মৃত্যুর পর আযাদ হয়ে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। উম্মে ওয়ারাকা এদের হাতেই শাহাদাত বরণ করেন।
প্রিয়জনদের জন্যও তারা শাহাদাতের তামান্না অন্তরে পোষণ করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে ছাবিত রা. মহামারীতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে দেখতে গেলেন। সে সময় তাঁর শেষ মুহূর্ত সন্নিকটে এসে গিয়েছিল। পরিবারের লোকজন কান্নাকাটি করছিলেন। তাঁর কন্যা কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, আমার আশা ছিল যে, আপনি জিহাদের ময়দানে শাহাদাত লাভ করবেন, আপনি তো জিহাদের সকল প্রস্ত্ততিই সম্পন্ন করেছিলেন। তার একথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সে তার নিয়তের ছওয়াব পেয়ে গেছে।’ -সুনানে আবু দাউদ
ঈমানের দৃঢ়তা
ইসলামী আকীদা সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে এরূপ বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, তা তাদের সত্ত্বার অংশে পরিণত হয়েছিল। চরম নির্যাতনের মাধ্যমেও তাঁদেরকে তাঁদের বিশ্বাস থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি। কাফেরদের কঠিন নির্যাতনের মুখে হযরত বিলাল রা.-এর ‘আহাদ’ ‘আহাদ’ উচ্চারণকে সাহাবায়ে কেরামের আকীদাগত দৃঢ়তার প্রতীক মনে করা যেতে পারে। এ ধরনের দৃষ্টান্ত অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের জীবনীতেও রয়েছে।
উম্মে শরীক রা. যখন ইসলাম গ্রহণ করলেন তখন তার আত্মীয়-স্বজন তাকে মরুভূমিতে রৌদ্রে দাঁড় করিয়ে রাখল এবং তার শরীরকে আরও উত্তপ্ত করার জন্য মধু মিশ্রিত রুটি খেতে দিল। পিপাসায় অস্থির হয়ে গেলেও তাকে একফোঁটা পানি দেওয়া হল না। এভাবে তিন দিন অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর তিনি যখন মৃতপ্রায় হয়ে পড়লেন তখন তারা তাকে বলতে লাগল, তুমি যে ধর্ম গ্রহণ করেছ তা পরিত্যাগ কর। কিন্তু তিনি তখন এতই আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন যে, তাদের কথা বুঝতেই পারছিলেন না। তারা তখন আসমানের দিকে আঙুল তুলে ইঙ্গিত করল। তিনি বুঝতে পারলেন যে, তাওহীদ অস্বীকার করতে বলা হচ্ছে। তিনি তখন বললেন, খোদার কসম, আমি এই আকীদার উপরই বিদ্যমান রয়েছি। -তবাকাতে ইবনে সা’দ
আবু তালহা রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন বিশিষ্ট সাহাবী ছিলেন। তাঁর স্ত্রী হলেন বিশিষ্ট সাহাবিয়া উম্মে সুলাইম রা.। উম্মে সুলাইম আবু ত্বালহা রা.-এর আগে ইসলাম গ্রহণ করেন। তখনও তাদের মধ্যে বিয়ে হয়নি। আবু ত্বালহা যখন তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন তখন উম্মে সুলাইম বললেন, হে আবু ত্বালহা! বলুন তো আপনি যে জিনিসের পূজা করেন তা কি ভূমি থেকে উৎপন্ন হয়নি? আবু ত্বালহা বললেন, হাঁ আমরা বৃক্ষ পূজা করি। আর তা তো ভূমি থেকেই উৎপন্ন হয়েছে? উম্মে সুলাইম বললেন, এমন জিনিস যা ভূমি থেকে উৎপন্ন হল তার সামনে শির নত করতে কি আপনার লজ্জা বোধ হয় না? উম্মে সুলাইমের কথায় আবু ত্বালহার মনে বৃক্ষপূজার অসারতা যেন উন্মোচিত হয়ে গেল। পরিশেষে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের আগ পর্যন্ত উম্মে সুলাইম তার বিবাহের প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। -ইসাবা
কুসংস্কার-মুক্ততা
ইসলামের আগমনের পূর্বে আরবের অধিবাসীরা বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কারে নিমজ্জিত ছিল। তারা মূর্তিপূজারী ছিল এবং হাতে গড়া মূর্তি সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের কল্যাণ-অকল্যাণের অলীক ধারণা পোষণ করত। ইসলামের তাওহীদের বিশ্বাসের বদৌলতে সাহাবায়ে কেরাম এসব কুসংস্কার থেকে পূর্ণরূপে পবিত্র ছিলেন।
হযরত যিন্নীরা রা. একজন সাহাবিয়া ছিলেন। যেসব নারী একদম প্রথমদিকে ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন তিনিও তাদের অন্যতম ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের অপরাধে তাকেও কাফেরদের বহু অত্যাচার সইতে হয়েছিল। পরিশেষে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. তাকে খরীদ করে আযাদ করেন।
জীবনের এক পর্যায়ে তাঁর দৃষ্টি শক্তি লোপ পেয়েছিল। কাফেররা তখন বলতে লাগল, ‘লাত ও ওজ্জা তাকে অন্ধ বানিয়ে দিয়েছে।’ হযরত যিন্নীরা রা. বললেন, ‘খোদার ঘরের কসম, ওরা মিথ্যা বলেছে। লাত-ওজ্জার তো কল্যাণ-অকল্যাণের কোনোই ক্ষমতা নেই। তাঁর এই বক্তব্যের পর তাঁর দৃষ্টিশক্তি পুনরায় ফিরে এসেছিল।’ -আলইসাবাহ ৭/৬৬৪-৬৬৫
লজ্জাশীলতার কথা
সূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘লজ্জাশীলতা ঈমানের অঙ্গ আর লজ্জাশীল লোকেরা জান্নাতে স্থান লাভ করবে। নির্লজ্জতা হলো পাপ আর এ ধরনের লোকদের স্থান হবে জাহান্নাম।’ -মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১০১৩৪
হাদীস শরীফের মর্ম হল, ইসলাম লজ্জাশীলতা, শূচিতা, পবিত্রতা, আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্ভ্রমবোধের ধর্ম।
ইসলাম মানবসভ্যতাকে উত্তম শূচিতার এমন মানদন্ড উপহার দিয়েছে যার কোনো নযীর নেই। ইসলাম এটা মোটেই বরদাশত করে না যে, মানুষ এবং চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা ওলট-পালট হয়ে যাবে এবং উভয়ে এক সমান্তরালে নেমে আসবে। এ কারণে ফিতরাত মুসলমানকে লজ্জাশীল বানিয়েছে, নির্লজ্জ হওয়ার সুযোগ দেয়নি। বিপরীত লিঙ্গের ক্ষেত্রে- যেখানে পরস্পর আকর্ষণ রয়েছে সেখানে- উভয়ের চালচলনে একটি সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। মনের চাহিদা এবং অন্তরের কামনার প্রতি লক্ষ রেখে লজ্জাশীলতার প্রচলন ঘটানো হয়েছে এবং এটাকে ঈমানের অংশ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। লজ্জা মূলত ঐ স্বভাবগত অবস্থার নাম, যা মানুষকে অন্যায় ও পাপাচার থেকে বিরত রাখে। লজ্জা তো ঐ শক্তির নাম, যা পাপকাজ ও পাপের স্থানে মানুষের মাথা ঝুকিয়ে দেয়। তার যবানকে রাখে সংযত অশ্লীল ও নিষিদ্ধ বাক্য বিনিময় থেকে। হাতকে রাখে বিরত অবৈধ কাজ ও অবৈধ হস্তক্ষেপ থেকে। এই লজ্জাই সুন্দরী নারীকে পর্দার আবরণে আচ্ছাদিত করে রাখে। দৃষ্টিকে করে সংযত। অন্তরের অন্তস্থলকে ‘নূরে তাজাল্লী’ দ্বারা আলোকিত করে এবং নির্লজ্জতার সম্ভাব্য সকল উপকরণকে ‘খাওফে খোদা’ বা আল্লাহ ভীতি দ্বারা দূরীভূত করে।
কিন্তু অনেক মানুষ যারা জাগতিক শিক্ষায় অভিজ্ঞ হলেও ধর্মীয় শিক্ষাশূন্য হওয়ায়- পশ্চিমা বিশ্ব, ইহুদী-নাসারা, হিন্দু, বদদ্বীন এবং ধর্মবিদ্বেষীদের দেখাদেখি বরং তাদের প্ররোচণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলমানদেরকেও নির্লজ্জতার সাগরে নিমজ্জিত করতে চায়। এসব লোকের সামনে পর্দা ও লজ্জাশীলতার কথা বলা হলে কুরআন-হাদীসের সুস্পষ্ট দলীল-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তারা বেপরোয়া কণ্ঠে বলে দেয় এগুলো মোল্লা, মৌলবীদের বানানো কথা। নারীদেরকে বেপর্দা অবস্থায় বাজারে ঘুরানো, ক্লাব- হোটেলে নাচানোকে তারা উন্নতি ও প্রগতি হিসেবে আখ্যায়িত করে।
নারী হচ্ছে নাযুক ও কোমল শ্রেণী। সুতরাং এদের সামনে যখন লজ্জাশীলতার বিরুদ্ধে শ্লোগান দেওয়া হয় এবং পর্দাকে মোল্লাদের আবিষ্কার, প্রগতির পথে বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তখন ইউরোপীয় এই দর্শনের সামনে মাথা নত করে নির্লজ্জতার চাদর পরিধান করে ঘরের ‘চেরাগ’ নারীরা বাইরে বেরিয়ে আসে। তাদেরকে শত শত কামুক পুরুষের প্রদর্শনীর বস্ত্ততে পরিণত করা হয়।
উল্লিখিত হাদীসে লজ্জাশীলতার মর্যাদা, এর শুভ পরিণাম এবং প্রতিদান হিসেবে জান্নাত লাভের কথা বলা হয়েছে, যাতে সত্যিকার অর্থেই মুমিন নারীর জন্য সম্মান নিহীত রয়েছে। কিন্তু কী অবস্থা হবে ঐসব নারীর যাদেরকে শুধুমাত্র প্রগতির দোহাই দিয়ে ইসলামের দুশমনেরা পাপিষ্ঠা বানিয়ে ছেড়েছে। ভাগ্য বঞ্চিত এসব নারীর উন্নতি ও প্রগতির প্রকৃত অর্থই জানা নেই। উম্মতজননী হযরত আয়িশার রাযি.-এর উত্তরসূরীরা বেপর্দা ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসে বাজারে-পার্কে, দফতর ও অফিস-আদালতে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার চেষ্টা করে তাহলে এতে তাদের কিসের উন্নতি, কিসের অগ্রগতি? এর মাধ্যমে কি মনুষ্যত্বের উন্মেষ ঘটে? আত্মমর্যাদা ও সম্ভ্রমবোধের বিকাশ ঘটে? নারীর মর্যাদা- সম্মান বেড়ে যায়? কখনও নয়, বরং এসবই সুস্পষ্ট নির্লজ্জতা এবং এ সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছে- এদের ঠিাকানা জাহান্নাম। এসব নারীদের হাশর-মাঠে আম্মাজান হযরত আয়িশার রাযি. সাথে আত্মার সম্পর্ক থাকবে না। নবীয়ে রহমাত কি দয়ার হাত বুলাবেন তাদের মাথায়? তাদের ব্যাপারে শুধু এতটুকুই বলা যায়-‘জাহান্নামের আগুন সহ্য করার ব্যাপারে তারা কত দুঃসাহসী।’
[উর্দু খাওয়াতীন কা ইসলাম অবলম্বনে
আবু বকর সিরাজী]