প্রাণের চেয়ে প্রিয়
এক
আচ্ছা, তোমাদেরকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে, ‘তুমি কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাস? ’ তখন তোমরা কী জবাব দিবে? কেউ হয়তো বলবে, মাকে বাবাকে, কেউ বলবে, ভাইকে, বোনকে, আবার কেউ হয়তো বলবে, অন্য কোনো আপনজনকে।
কিন্তু এ নিয়ে আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী বলেছেন জান? তিনি বলেছেন, ‘তোমরা কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না,যতক্ষণ পর্যন্ত আমাকে তোমাদের মার চেয়ে, বাবার চেয়ে, ভাইয়ের চেয়ে বোনের চেয়ে সকল মানুষের চেয়ে এমনকি নিজের প্রাণের চেয়ে বেশি ভালো না বাসবে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এই হাদীস বলছিলেন তখন হযরত উমর রা. কাছে ছিলেন। তিনি বললেন, নবীজী! আমি আপনাকে আমার মা-বাবার চেয়ে ভাই-বোনের চেয়ে এবং সব মানুষের চেয়ে বেশি ভালোবাসি। কিন্তু আমার প্রাণ আমার কাছে আপনার চেয়ে বেশি প্রিয়।’
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বললেন, নাহ! হল না। তুমি এখনও প্রকৃত মুমিন হতে পারনি। এ কথা শুনে হযরত উমর রা. খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। এখনও তিনি প্রকৃত মুমিন হতে পারেননি! প্রকৃত মুমিনই যদি হতে না পারলেন তবে এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কি আছে?
পরদিন তিনি আবার মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে হাজির হলেন এবং বললেন, ‘নবীজী, আপনি আমার কাছে আমার প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয়!’ শুনে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুশি হলেন। বললেন, ‘হাঁ, এখন তুমি প্রকৃত মুমিন হতে পেরেছ।’
প্রিয় কিশোর বন্ধুরা! এবার তোমরা বুঝতে পেরেছ তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি আমাদের কেমন ভালোবাসা থাকা উচিত।
চল, এখন আমরা এমনি দু’টি নবী-প্রেমের গল্প শুনি।
দুই
সারা মদীনায় উহুদ যুদ্ধের পরাজয়ের খবর ছড়িয়ে পড়েছে। ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়ে গেছে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও বেঁচে যাওয়া সাহাবায়ে কেরামের কাফেলা এখনও মদীনায় এসে পৌঁছাননি। মহিলা সাহাবীদের কেউ কেউ ব্যাকুল হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছেন। কখন কাফেলার দেখা মিলবে এই আশায় দূর-দিগন্তে দৃষ্টি মেলে আছেন। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো আছেনই এ ছাড়াও যুদ্ধে কারো বাবা গিয়েছেন, কারো ভাই গিয়েছেন, কারো স্বামী গিয়েছেন আবার কারো গিয়েছেন ছেলে। তাদের চিন্তায় তারা অস্থির হয়ে আছেন। এর মধ্যে একজন মহিলা সাহাবী উদ্ভ্রান্তের মতো উহুদ প্রান্তরের দিকে ছুটতে শুরু করলেন। পথে যাকেই পাচ্ছেন তাকেই জিজ্ঞাসা করছেন, ‘প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেমন আছেন? তিনি জীবিত আছেন তো?’
ছুটতে ছুটতে তিনি মদীনার শেষ সীমানায় উহুদ প্রান্তরের কাছাকাছি চলে এলেন। এখানে তিনি সাহাবীদের এক অগ্রগামী কাফেলার সাক্ষাত পেলেন। তারা মদীনার পথে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। সাহারিয়া দ্রুত পায়ে তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোনো সংবাদ জান? তিনি তোমার সাথে আছেন?
প্রত্যাশার ব্যাকুল দৃষ্টি মেলে তিনি তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
: ‘যুদ্ধে আপনার বাবা শহীদ হয়েছেন। বললেন এক সাহাবী।
: ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আমার নবীজী কেমন আছেন?’
: ‘আপনার স্বামীও শহীদ হয়েছেন।’ বললেন, আরেক সাহাবী।
: ‘ইন্না লিল্লাহি ... নবীজী কেমন আছেন?’ তিনি বেঁচে আছেন তো?’’ ব্যাকুল আর্তস্বর সাহাবিয়ার।
: ‘আপনার ভাই শহীদ হয়েছেন।’
: ‘ইন্না লিল্লাহ ... আর আমার নবীজী?! তিনি কোথায় আছেন? তোমরা তাঁর কথা বল না? ‘ভারী শোনাল তাঁর কণ্ঠ।
: ‘যুদ্ধে আপনার ছেলেও শহীদ হয়েছেন’ কাফেলার মাঝখান থেকে বললেন আরেক সাহাবী।
কিন্তু আশ্চর্য! নবী-প্রেমিক মহিলা সাহাবী তাতে মোটেও ব্যাকুল হলেন না। পূর্বের মতোই স্বাভাবিক কণ্ঠে তিনি ‘ইন্না লিল্লাহ’ পড়ে বললেন, ‘আমার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেমন আছেন? তা কি তোমাদের কারও জানা নেই?’
: ‘তিনি আমাদের সাথে নেই, পেছনের কাফেলায় তিনি আসছেন।’ বললেন, সাহাবীরা।
তাদের চোখের তারায় বিস্ময়।
আবার ছুটতে শুরু করলেন সাহাবিয়া। তাঁর একটাই চিন্তা, কখন তিনি দেখতে পাবেন প্রাণের নবীকে! অবশেষে তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাফেলার দেখা পেলেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন দলের সবার মাঝখানে। সামনে পেছনে, ডানে বামে ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম। সাহাবিয়া তাদের সবার ভীড় ঠেলে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এগিয়ে গেলেন। তাঁকে জীবিত দেখতে পেয়ে তাঁর চোখ আনন্দের অশ্রুতে ভরে উঠল। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাওয়ার আনন্দে তিনি বাবা, ভাই, স্বামী ও ছেলে হারানোর ব্যথা ভুলে গেলেন। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ করে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক। আপনি জীবিত থাকতে আমার কাছে সব বিপদই তুচ্ছ।’
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার এই নিখাঁদ ভালোবাসায় মুগ্ধ হলেন। তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন আর সাহাবারা এক আকাশ শ্রদ্ধা ও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন স্বামীহারা, পিতৃহারা, ভাইহারা ও ছেলেহারা এই অসাধারণ নবীপ্রেমিক মহিলা সাহাবিয়ার দিকে।
তিন
মক্কা থেকে আট মাইল দূরে তানয়ীমের বিশাল মাঠটিতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। কেবল মানুষ আর মানুষ। হাজারো মানুষের ঢল নেমেছে সেখানে।
মাঠের ঠিক মাঝখানটায় উঁচু বেদির উপর একটি শূলকাঠ স্থাপন করা হয়েছে। কুরাইশ কাফেরদের হাতে বন্দী মহান সাহাবী হযরত খুবাইব ইবনে আদীকে আজ এখানে হত্যা করা হবে। তাঁর সেই হত্যার দৃশ্য দেখার জন্যই এরা সবাই সমবেত হয়েছে। সবার চোখে মুখে টানটান উত্তেজনা ও হিংস্রতা। কুরাইশ নেতারা হযরত খুবাইবকে নিয়ে এখনও এখানে এসে পৌঁছায়নি। ধীর আগ্রহ নিয়ে সবাই রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাত-পা বাঁধা শৃংখলিত খুবাইবকে নিয়ে আসা হল। মুহূর্তে সমবেত হাজারও জনতার দৃষ্টি তাকে ঘিরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আশ্চর্য! এখনই তাকে হত্যা করা হবে অথচ তাঁর চেহারায় ভয়, উদ্বেগ কিংবা ব্যাকুলতার চিহ্নমাত্র নেই। সম্পূর্ণ প্রশান্তচিত্তে হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় তিনি বসে আছেন। হত্যাকান্ড শুরু হওয়ার পূর্বমুহূর্তে তিনি লোকদের দিকে ফিরে বললেন, ‘তোমরা কি শেষবারের মতো আমার একটি ইচ্ছা রক্ষা করবে? আমাকে দু’রাকাত নামায পড়তে দেবে? লোকগুলোর পাষাণ মনে যেন খানিকটা দয়ার সঞ্চার হল। বলল, ঠিক আছে পড়ে নাও। ভীড়ের মধ্যেই হযরত খুবাইব কেবলামুখী হয়ে নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। কী অনুপম তন্ময়তা তাঁর সে নামাযে! ভক্তি, আবেগ ও ভালোবাসার সব মাধুরী মিশিয়ে জীবনের শেষ দুই রাকাত নামায শেষ করে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। এবার তাঁকে হত্যা করার পালা। চারপাশে অনেক মানুষ আগে থেকেই অস্ত্র হাতে প্রস্ত্তত হয়েছিল। এবার তারা তার উপর আঘাত শুরু করল। তবে তা একবারে নয়। তলোয়ার বর্শা ও বিভিন্ন অস্ত্রের ফলা দিয়ে হযরত খুবাইবের জীবিত দেহ থেকে একটার পর একটা গোশতের টুকরা কেটে নিতে লাগল। উহ! কী যে মর্মান্তিক আর কী যে নিষ্ঠুর সে দৃশ্য! প্রতিটি আয়াতের সাথে সাথে দরদর করে তাজা রক্তের ধারা বয়ে চলেছে...। হযরত খুবাইব যন্ত্রণায় ছটফট করছেন...।
পাষাণ হৃদয় কাফেরদের মনে তবুও একটু দয়ার সঞ্চার হচ্ছে না। এ নিমর্ম দৃশ্য দেখে বরং তারা নাচছে গাইছে ও আনন্দ করছে। তাদের নিষ্ঠুর মনে খুশীর ঢেউ বয়ে যাচ্ছে।
আঘাতে আঘাতে হযরত খুবাইব ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়ছিলেন। শরীর থেকে বয়ে চলছিল অবিরাম রক্তের ধারা। এ অবস্থায়ই ভীড়ের মাঝখান থেকে কেউ একজন তাকে লক্ষ করে বলল, ‘খুবাইব! তোমার স্থানে যদি মুহাম্মদ সা.কে হত্যা করা হয় এবং তোমাকে মুক্তি দেওয়া হয় তবে কি তুমি তা পছন্দ করবে?’ মুহূর্তে হযরত খুবাইব গর্জে উঠলেন। তাঁর অর্ধমৃত দেহে যেন প্রাণ ফিরে এল। ‘আল্লাহর কসম! আমি আমার পরিবার-পরিজনের সাথে সুখে-শান্তিতে থাকি আর আমার নবীজী সা.-এর পায়ে একটি কাঁটা বিঁধুক তাও আমি কখনও সহ্য করব না।’
সমবেত জনতা মৃত্যু-পথ-যাত্রী হযরত খুবাইবের মুখে এ কথা শুনে বিপুল বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। তাদের মুখে কোনো কথা ফুটল না।
তারপর অমর নবীপ্রেমিক হযরত খুবাইব শহীদ হয়ে গেলেন। তাঁর দেহ নিথর হয়ে গেল। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি নবীপ্রেমের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেলেন।
প্রিয় কিশোর পাঠক বন্ধুরা! চল আমরাও উপরের দুটি গল্প থেকে নবীপ্রেমের সবক গ্রহণ করি। হযরত খুবাইবের মতো, সেই মহিলা সাহাবিয়ার মতো, হযরত উমরের মতো আমরাও হয়ে উঠতে পারি অনন্য সাধারণ নবীপ্রেমিক যেন সবকিছু হারানোর মুহূর্তেও আমরা প্রিয় নবীজী সা.-এর নাম নিতে পারি এবং তাঁর ভালোবাসার স্বাক্ষর রেখে যেতে পারি।
শিশুদের মহানবী
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো সফর থেকে ফিরতেন তখন সবাই আনন্দিত হয়ে যেত। এই আনন্দ শিশুদের স্পর্শ করত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও শিশুদেরকে স্নেহ করতেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে জা’ফর বলেন- ‘একবার নবীজী সফর থেকে ফিরে আসছিলেন তিনি ছিলেন বাহনে সওয়ার। তাঁর ইস্তেকবালের জন্য আমিও হাজির হয়েছি। নবীজী আমাকে আদর করে তার সওয়ারীর সামনে বসিয়ে নিলেন। এরপর হাসান কিংবা হুসাইনও দৌঁড়ে এল। নবীজী তাকে তাঁর পিছনে বসালেন। এভাবে আমরা তিনজন এক সওয়ারীতে মদীনায় প্রবেশ করলাম।’
-যাদুল মা’আদ ২/৩৮