বিদায় হজ্বের খুতবা : শাশ্বত মানবিক আদর্শের পয়গাম
ইসলামের মহান শিক্ষা নিয়ে পৃথিবীর বুকে আগমন করলেন আখেরী নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আপন কর্ম ও বক্তব্যের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে পেশ করে গেলেন একটি সর্বজনীন জীবনাদর্শ। মানুষের জীবনকে সুন্দর, সুশীতল আদর্শিক স্রোতে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে অকাতরে বিলিয়ে গেলেন পিতৃসুলভ স্নেহ-মমতা ও সৌহার্দ্য-ভালোবাসা। একজন মানুষকে ‘মানুষ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে, খোদার একজন বান্দাকে ‘বান্দা’র মহিমায় উদ্ভাসিত করতে তিনি উৎসর্গ করলেন তাঁর জীবনের প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি উচ্চারণ। হৃদয় দিয়ে মানুষকে ভালোবাসলেন। ভালোবাসা দিয়ে মানুষ গড়লেন।
দু’জন মানুষকে নবীজী দেখলেন, মানুষ হয়েও ওরা পরস্পরকে ঘৃণা করে, ওদের বুকে জ্বলে হিংসার আগুন, তখন স্নেহ-মমতা দিয়ে নবীজী তাদের হৃদয় জয় করলেন। হিংসার বদলে ওদের হৃদয়ে স্থাপিত হল সৌহার্দ্য। ঘৃণার বদলে নিবিড় ভালোবাসা।
নবীজী দেখলেন, শ্রেণী-বৈষম্যের নির্মম চিত্র ফুটে আছে মানুষের নিত্যকার আচরণে। ইসলামী ভ্রাতৃত্বের সবক শিখিয়ে নবীজী ওদের মাঝে সাম্যের ভিত গড়লেন। ওরা মানুষ হল। খোদার গোলামীর সুউচ্চ মাকামে অধিষ্ঠিত হল। ওরা মানুষকে মানুষের চোখ দিয়ে দেখতে শিখল। মুনিবের চোখে গোলাম- গোলাম নয়; মানুষের রূপ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হল। গোলামের চোখে মুনিব- শুধুই মুনিব নয়; মানুষ হিসাবে প্রতিভাত হল। একে অপরকে ভাই হিসাবে দেখতে শিখল। স্বামী ও স্ত্রী মনিব ভৃত্য নয়; পরস্পরের হৃদয়ে ওরা অটুট মানবিক বন্ধনে আবদ্ধ হল। নারী জাতি জানল, ওরাও পৃথিবীর বুকে একটি স্বতন্ত্র জাতি। ওদেরও আছে স্বকীয়তা। আছে স্বাতন্ত্র্য। পুরুষ জানল, নারী আল্লাহর এক অমূল্য নেয়ামত। শাসন নয়; ওদের সযত্ন লালনই পুরুষ জাতির নৈতিক কর্তব্য।
নবীজী শেখালেন, শোষণ নয়; অর্থের সুষম ব্যবহারই বিত্তশালীদের বিত্ত-বৈভবের দাবি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নবীজীর কাছ থেকে একটি সুন্দর ও সুষম অর্থব্যবস্থা পেয়ে ওরা কৃতার্থ হল।
এভাবেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে শিক্ষা দিতে থাকলেন। একসময় তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো উপস্থিত হল। নবীজী উম্মতের চিন্তায় পেরেশান হলেন। বিদায় হজ্বের সময় সাহাবায়ে কেরামের বিশাল জামাত তাঁর সাথে উপস্থিত। নবীজীর হাতে গড়া একদল মানুষ। তাঁর বার্তাগুলো যারা পৌঁছে দেবে পরবর্তীদের কাছে।
সাহাবায়ে কেরামের সেই বিশাল জামাতের সামনে আল্লাহর নবী ঘোষণা করলেন,
‘তোমরা আমার কথাগুলো শোন এবং উপলব্ধি কর।’ আখেরী পয়গাম্বর তাঁর আখেরী হজ্বে, সাহাবায়ে কেরামের বিশাল সমাবেশে ঘোষণা করলেন,
‘তোমরা যারা আমার কথাগুলো শুনলে তোমরা পরবর্তীদের কাছে তা পৌঁছে দিও।’
জীবনভর উম্মতের সামনে ইসলামের যে মহান আদর্শ উপস্থাপন করেছেন, বিদায়ের আগে একজন মুমূর্ষু পিতার ব্যাকুল হৃদয় নিয়ে নবীজী তারই সারাংশ উম্মতের সামনে পেশ করলেন।
নবীজীর কণ্ঠে উচ্চারিত হল,
‘জাহিলী যুগের যত রসম রেওয়াজ, শোন, (আজ থেকে) সব আমার পায়ের নিচে পদদলিত।’
আখেরী নবীর কণ্ঠে উচ্চারিত হল বিস্ময়কর এই ঘোষণা, সেই সাথে ইতিহাসের পাতায় সংযুক্ত হল ইসলামী আদর্শের বিরাট একটি অধ্যায়। আরব জাতির প্রধান বৈশিষ্ট্যই যেখানে ছিল প্রতিশোধ ও পাল্টা প্রতিশোধ, নিছক একটি ছুতো উপলক্ষ করে যাদের মাঝে চলত বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ হত্যা, জিঘাংসা, হিংসা ও প্রতিহিংসার বিভৎস প্রতিযোগিতা, সেই তাদেরই মধ্য সমাবেশে দাঁড়িয়ে আল্লাহর নবী ক্ষমা ও ঔদার্যের এমন বিশ্বজনীন সবক শেখাচ্ছেন।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ মহান শিক্ষাদানের অনেক অনেক বছর পর ইতিহাসের এক নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখী দাঁড়িয়ে আমরা উপলব্ধি করছি, তাঁর সেই মহান শিক্ষা তো এখনো আমাদের মাঝে সংরক্ষিত, এখনো রাসূলের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরা উচ্চারণ করি ক্ষমা ও ঔদার্যের চিরন্তন সেই বাণী, কিন্তু কর্মক্ষেত্রের রূঢ়
বাস্তবতায় আমরা তার ক্ষীণতম অস্তিত্বও কি টের পাই?
রাসূল শিখিয়েছিলেন, অতীত তিক্ততা ভুলে গিয়ে সুন্দর সৌহার্দ্যময় ভবিষ্যত গড়ে তোলার সর্বজনীন আদর্শ। অথচ আমরা জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে তিক্ততা, লোভ, ক্রোধ ও প্রতিহিংসার অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে জীবনের স্বার্থকতা অনুভব করি। রাসূলের এই শিক্ষা ছিল সর্বজনীন। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত পরিব্যপ্ত বিস্ময়কর যাদুকরী এক আদর্শ। কিন্তু অদ্ভূত ব্যাপার হল, আমরা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্রে অতীত তিক্ততার স্মৃতিকে আরো তিক্ত স্বরে তিক্তভাবে আলোচনা করে নিজেদের জীবনকে বিষময় করে তুলি এবং ভাবতে থাকি, এতেই বুঝি জীবনের স্বার্থকতা।
দু’জন ব্যক্তির মাঝে কোনো কালে ছিল প্রতিহিংসার সম্পর্ক। নবীজী শেখালেন, অতীতের হিংসাত্মক জীবনকে ভুলে গিয়ে প্রেম ও সোহার্দ্যময় জীবন গড়। দুটি পরিবারের মাঝে বছরের পর বছর ঝগড়া ও বিবাদের সম্পর্ক। রাসূল শিক্ষা দিলেন, ঝগড়া ও বিবাদের স্থলে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সুখময় বন্ধন গড়ে তোল। দুটি দেশের মাঝে কোনো কালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল, এক দেশের হাতে অপর দেশের জনগণ অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। রাসূল নির্দেশ দিলেন, ভুলে যাও অতীত। সুন্দর জীবন চাও তো আপন স্বকীয়তা বজায় রেখে অতীত তিক্ততার স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেল।
ঠিক এই মুহূর্তে মনে পড়ছে আমাদের কথা। ছত্রিশ বছর আগে একটি দেশের সাথে আমাদের যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধে আমাদের বিজয় হয়েছে। এখন আমাদের উচিত হল, অতীতের তিক্ততা ভুলে গিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মনিয়োগ করা। তা না করে যদি পরাজিত সেই দেশের কোনো ব্যক্তির তিক্ত অতীতকে স্মরণ করতে থাকি, ওদের প্রতি মানুষের ঘৃণা জন্মানোর কাজে মহত্ব অনুভব করতে থাকি, তাহলে বলতে হবে, রাসূলের আদর্শ চরমভাবে অবহেলিত হচ্ছে।
বিদায় হজ্বের খুতবায় আল্লাহর নবীর কণ্ঠে উচ্চারিত হল,
‘জাহিলিয়াতের সকল সুদ আজ বিলুপ্ত করা হল। সর্বপ্রথম আমি যে সুদ বিলুপ্ত করছি তা আমারই বংশের আববাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের সুদ।’
সমগ্র আরবে সুদী কারবারের জাল বিস্তৃত ছিল। যার ফলে আরবের গরীব জনগণ ও কৃষক শ্রেণী ইয়াহুদী মহাজন ও আরব পুঁজিপতিদের অর্থনৈতিক ফাঁসে চরমভাবে ফেঁসে গিয়েছিল। ক্রমবর্ধমান সেই সুদের যাঁতাকল থেকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবজাতিকে উদ্ধার করলেন। বিশ্ববাসীর সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, অর্থনৈতিক নিপীড়ন মানব সভ্যতার স্বচ্ছন্দ গতিকে ব্যাহত করে। শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও সুষম সমাজ-ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন সুদমুক্ত নিপীড়নমুক্ত অর্থব্যবস্থা। এর জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে সমাজের নেতৃস্থানীয় শ্রেণীকে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই নির্ভীক কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘সর্বপ্রথম আমি যে সুদ বিলীন করছি তা আমাদেরই আববাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের সুদ।’ তার সাথে যত লোকের সুদী লেনদেন হয়েছে, এখন থেকে তারা শুধু অর্থের মূল অংশ পরিশোধ করবে। সুদ পরিশোধ করবে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ অমোঘ ঘোষণা পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত বাণীরই নববী উচ্চারণ
‘আল্লাহপাক সুদকে মুছে দেন এবং সদকাকে বৃদ্ধি করেন।’
মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হল, স্থূল ও প্রকাশ্য ব্যাপারগুলোই তাকে বেশি আকর্ষণ করে। কোনো বিষয়ের গভীরতা, ফলাফল কিংবা চূড়ান্ত পরিণতির চিন্তা তাকে সাধারণত প্রভাবিত করে না। সুদনির্ভর লেনদেন এর একটি দৃষ্টান্ত। স্থূল দৃষ্টিতে একজন মানুষ এর সুফলই কেবল দেখে। গভীর দৃষ্টিতে লক্ষ করলে দেখা যাবে এর সুফল থেকে কুফলই বেশি। অর্থাৎ সুদের সুফল ও কুফল নির্ণয়ে প্রয়োজন কিছুটা গভীর ও সুক্ষ্ম চিন্তার। ইসলাম তাই অনেক বিষয়ের মতো এই বিষয়টি মানুষের একক চিন্তার উপর ছেড়ে না দিয়ে চূড়ান্ত কথা মানুষকে জানিয়ে দিয়েছে। কুরআন ঘোষণা দিয়েছে,
‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম।’
নারী ও পুরুষ। পৃথিবীর ভারসাম্য টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন উভয়ের সহাবস্থান। প্রয়োজন পরস্পরের প্রতি যথাযথ মর্যাদার অকুণ্ঠ প্রদর্শন। এর জন্য প্রয়োজন প্রত্যেককে নিজের দায়িত্ব ও অপরের অধিকার নিয়ে চিন্তা করার। পুরুষ চিন্তা করবে নারীর অধিকারের কথা। নারী চিন্তা করবে পুরুষের অধিকারের কথা। প্রত্যেকেই চিন্তা করবে অপরজনের ব্যাপারে তার উপর কী কী দায়িত্ব অর্পিত হয় এবং সে দায়িত্ব পালনে সে কতখানি সচেষ্ট। নারী ও পুরুষ প্রত্যেকেই যদি অপরের অধিকার ও নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয় তাহলে নারী ও পুরুষ কারোই অধিকার লংঘিত হবে না। আপন অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে শ্লোগান দিয়ে বেড়াতে হবে না। নারীর চেষ্টায় পুরুষের এবং পুরুষের চেষ্টায় নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। এটাই অধিকার প্রতিষ্ঠার সহজ ও যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতি। এটাই সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার বাস্তব প্রক্রিয়া। এজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্বের খুতবায় নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় পুরুষজাতিকে কঠোর ভাষায় সতর্ক করলেন,
‘নারীদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। কেননা তাদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহর নিকট প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আল্লাহর হুকুমেই তোমরা তাদেরকে সম্ভোগের বৈধতা লাভ করেছ।’
মৃত্যুর পূর্বে একজন পিতা সন্তানদেরকে তার জীবনের সমস্ত সঞ্চয় বুঝিয়ে দিয়ে যান। সন্তানদের মধ্যে যারা দুর্বল, তাদের ব্যাপারে সবলদেরকে খুব করে সতর্ক করেন। আখেরী নবীর আখেরী হজ্ব। সাহাবায়ে কেরামের এত বিশাল সমাবেশে এটাই তাঁর সর্বশেষ উপস্থিতি। কিছুদিন পরেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবেন। এমনই একটি মুহূর্তে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষ জাতিকে নারীর অধিকার সম্পর্কে সতর্ক করছেন, ‘তোমরা নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর।’
আল্লাহর নবী বুঝতে পেরেছিলেন, অতীতে যেমন ছিল, ভবিষ্যতেও তেমনি নারী জাতি বিভিন্নভাবে বঞ্চিত ও অবহেলিত হবে। নারীর অধিকার হরণের হাজারো পন্থা ও প্রক্রিয়া আবিষ্কৃত হবে। তাই পুরুষ জাতিকে লক্ষ করে আল্লাহর নবীর এ অন্তিম হুঁশিয়ারি- ‘তোমরা নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর।’
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণের পর সুদীর্ঘ চৌদ্দশ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। কিন্তু বর্তমান সময়, সমাজ ও বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে লক্ষ করলে বিস্ময় জাগে, আল্লাহর নবী কি তবে চৌদ্দশ বছর আগেই অবলোকন করতে পেরেছিলেন আমাদের আজকের সমাজের এই বিভীষিকাময় করুণ চিত্র! যেখানে প্রতিনিয়ত নারী জাতির অধিকার হরণের নিত্যনতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হচ্ছে। যেখানে নারী জাতিকে নারীত্বের মর্যাদা ও পবিত্র অবস্থান থেকে সুকৌশলে বহুদূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যেখানে ‘বুদ্ধি বাজারজাতকারী’ একটি শ্রেণী নারীকেই নারীর অধিকার হরণের হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করছে।
একটি যুগ ছিল যাকে বলে জাহিলী যুগ কিংবা বর্বরতার যুগ, সে যুগে নারীর অধিকার হরণের জন্য পুরুষরাই যথেষ্ট ছিল। অদ্ভূত লাগে যখন দেখি শিক্ষা ও প্রগতির এই যুগে স্বয়ং নারীই নারীর অধিকার হরণের লক্ষ্যে মাঠে-ময়দানে শ্লোগান দিচ্ছে।
দায়িত্ব ও অধিকার এই দুই শব্দের ব্যাখ্যা ইসলাম যেমন পেশ করেছিল, আজ চৌদ্দশ বছর পর এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী উন্নতি, প্রগতি ও নারী-স্বাধীনতার মিষ্টিমধুর শিরোনাম দিয়ে এই দুই শব্দের এক অদ্ভূত হাস্যকর ব্যাখ্যা পেশ করছে। নারীকে নিয়ে সমাজের সুবিধাবাদী লোকগুলো কতভাবেই না খেলে আসছে। পুরুষের দায়িত্ব ছিল, সারাদিন শ্রম ব্যয় করে অর্থ উপার্জন করে ঘরে স্ত্রী বাচ্চাদের অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা করা। অপর দিকে নারীর অধিকার ছিল অন্ন-বস্ত্রের দায়িত্ব স্বামীর উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা। বর্তমান সমাজের সুবিধাবাদী পুরুষ শ্রেণী নারীকে ঘরের ভিতরের দায়িত্ব তো দিয়েছেই সাথে জীবিকা উপার্জনের গুরু দায়িত্বও তার উপর ন্যস্ত করেছে এবং অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে এই দায়িত্বের নাম দিয়েছে ‘অধিকার’। নারীকে বুঝিয়েছে দোকানদারী করা তোমার অধিকার। দোকানে বসে ক্রেতাদের মনোরঞ্জনের জন্য নারীত্বের মর্যাদাকে পদদলিত করা তোমার অধিকার। যেটা ছিল পুরুষের দায়িত্ব, নারীর কাঁধে সওয়ার হয়ে তারই নাম হয়ে গেল অধিকার!
অতীতে নারী জাতি যতটুকু অবহেলিত ছিল, বর্তমানে মিষ্টি মধুর শ্লোগানের ঘেরাটোপে পড়ে নারীত্ব আরো চরম ও শোচনীয়ভাবে পদপিষ্ট হচ্ছে। আল্লাহর নবী হয়ত এসব দৃশ্য তখনই অবলোকন করতে পেরেছিলেন। তাই তো নবীজীর কণ্ঠে এমনই ব্যথা, এমনই দরদ-
‘শোন আমার উম্মতের পুরুষ শ্রেণী। নারীদের সাথে উত্তম আচরণের ব্যাপারে আমার উপদেশ গ্রহণ কর।’
‘শোন, নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর।’ নারীদের নিয়ে নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠো না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একথাই বলতে চেয়েছেন, দেখ, ওরাও মানুষ, তোমরাও মানুষ। মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি অমানুষের মত আচরণ করো না। শোন, শোন, যদি আল্লাহর ভয় তোমাদের মধ্যে থাকে তবে খুব সতর্ক থাক। ওদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর।
***
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোটা বিশ্ববাসীর জন্য শান্তি ও মুক্তির বাণী নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর মুক্তির বাণী একটি শ্রেণী, একটি গোষ্ঠী, একটি ভাষা বা একটি ভূখন্ডের সীমানায় সীমাবদ্ধ ছিল না। জাতি, গোষ্ঠী, দেশ ও ভূখন্ডের সীমানা ছাড়িয়ে তাঁর দাওয়াতের আবেদন গোটা মানবসভ্যতার বিশাল বিস্তৃত অঙ্গনে পরিব্যাপ্ত ছিল।
বিদায় হজ্বের খুতবায় মানবতার নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একেক উচ্চারণে অনন্ত বিশালত্বের সরব অস্তিত্ব অনুভব করছিলেন তাঁর সামনে উপস্থিত লক্ষাধিক সাহাবী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্বোধন করেছিলেন উপস্থিত ব্যক্তিদের, কিন্তু তাঁর দৃষ্টি ছিল বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। তাঁর মানসপটে ভেসে উঠেছিল অনাগত পৃথিবীর অগণিত বনী আদম। তিনি দেখছিলেন, তিনি যাদের সামনে কথা বলছেন তাদের পর যুগে যুগে পৃথিবীতে জন্ম নিবে অসংখ্য মানুষ। ওদেরও প্রয়োজন একটি আদর্শের। ওদেরও প্রয়োজন শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। ওরাও পৃথিবীর আলো বাতাসে জাগবে একটি সুন্দর, সমৃদ্ধ ও সাম্য-ভ্রাতৃত্বের সমাজ গড়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে।
তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিকে যেমনি উপস্থিত ব্যক্তিদের হুকুম করলেন আমার দাওয়াত পরবর্তীদের কাছে পৌঁছে দাও, সেই সাথে সম্বোধন ও শব্দ নির্বাচনেও তিনি গ্রহণ করলেন একটি অনন্য শৈলী। রাসূল সম্বোধন করতে পারতেন, ‘হে আমার সাহাবীরা! সম্বোধন করতে পারতেন উপস্থিত ব্যক্তিগণ!
শব্দ ও মর্মের যথার্থতা তাতে সামান্য ব্যাহত হত না। কিন্তু শুনুন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিদায় হজ্বের খুতবার অমর সম্বোধন। তিনি বলেছেন,
কেয়ামত পর্যন্ত আগত সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে তিনি শব্দের এ বিশালত্বে কেমন আপন করে নিলেন। তাই এত বছর পর, অমর উচ্চারণের এতকাল পরও আমরা ক্ষণে ক্ষণে জীবনের পদে পদে তাঁর কণ্ঠ নিঃসৃত সেই সম্বোধনের অদৃশ্য অথচ জীবন্ত অস্তিত্ব অনুভব করি।
‘হে মানুষ! আহ! কী বিপুল আবেদন ছোট্ট এই ডাকটির মধ্যে লুকিয়ে আছে! মনে হয়, এই তো বললেন। সাহাবায়ে কেরাম রাসূলের মুখে ডাক শুনলেন, হে মানুষ! তারা পুলক শিহরণে অভিভূত হলেন। রাসূল আমাদের ডেকে ডেকে স্নেহ, ভালোবাসা. দরদ ও উৎকণ্ঠা মাখা সুরে কী মধুর সম্ভাষণ করলেন।
সাহাবায়ে কেরাম দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। পরবর্তীদের কানে পৌঁছল নবীজীর এ অমর সম্ভাষণ। তারাও তাঁদের বক্ষে গর্ব ও আনন্দের মৃদু আলোড়ন অনুভব করল।
‘হে মানুষ!’ রাসূল যেন তাদেরকেই সম্বোধন করছেন। যুগে যুগে যাদের কানে পৌঁছেছে এ সম্ভাষণ, তারাই পুলকিত হয়েছে। তারাই ভেবেছে, রাসূল তাদের সম্বোধন করেছেন। সকল যুগের সকল মানুষের কল্যাণেই নিবেদিত ছিল বিদায়ী খুতবা। তাই খুতবার সম্বোধনে শব্দের সংক্ষিপ্ত অবয়বের মাঝে লুকিয়ে ছিল বিশাল ব্যাপকতার এমন বিপুল ঐশ্বর্য।
‘হে মানুষ! হে মানবজাতি! হে মানবকুল!!’
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবেই একটি মাত্র সম্ভাষণে কেয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মানুষকে সম্বোধন করলেন। তিনি বললেন,
‘তোমাদের পরস্পরের জান ও মাল পরস্পরের জন্য হারাম। যেমন হারাম-আজকের এই দিনটি। যেমন হারাম বর্তমান এই মাসটি।’
ইসলাম মানবতার ধর্ম। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলামের নবী তাই বিদায়ী খুতবায় বিশ্ববাসীকে সে কথারই অন্তিম ঘোষণা দিচ্ছেন। নবীজীর কণ্ঠে তাই উচ্চারিত হচ্ছে বিশ্বশান্তির বিস্ময়কর যাদুকরী নির্দেশনা। বিপুল বিস্ময় নিয়ে মানুষ সেদিন তাঁর কণ্ঠে শুনছিল মানুষ হিসাবে মানুষের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা। রাসূল বলছিলেন, আর সাহাবায়ে কেরাম অনুভব করছিলেন, ব্যক্তি, পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধানের জন্য তাঁর অন্তরের উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতা। আল্লাহর নবী আল্লাহর কাছে ফিরে যাবেন। তাই পৃথিবীর মানুষগুলোর প্রতি তাঁর হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা স্নেহ, ভালোবাসা, দরদ ও উৎকণ্ঠার এমন উথলে উঠা উচ্ছ্বাস। এ সংক্ষিপ্ত সফরে পৃথিবীর মানুষকে যা দিবেন বলে এসেছিলেন, দিয়েছেন, জীবনের তেইশটি বছর ওদের হৃদয়-রাজ্যে বাস করেছেন, এখন তাঁর ডাক এসেছে। সফরের শেষ সময়টাতে তাই তিনি উৎকণ্ঠিত, আমার চলে যাওয়ার পর না জানি ওরা কেমন পরিস্থিতির মুখোমুখী হয়। ওদেরকে কে তখন উদ্ধার করবে। কে ওদের হাত ধরে স্নেহ দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে সোজা পথ দেখাবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওদেরকে এমন এক আদর্শের সবক শেখালেন যা যুগ পরম্পরায় সকল দেশের সকল মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তার মৌলিক ও একমাত্র নির্দেশক হিসাবে কাজ করবে। রাসূল চলে যাবেন, তাঁর সে শিক্ষা যত দিন সজীব থাকবে, পৃথিবীর ভারসাম্য ঠিক থাকবে। মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দের সম্পর্ক সৃষ্টি হবে। জান ও মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
রাসূল বুঝেছিলেন, যুগে যুগে বহু মানুষ শান্তির অন্বেষায় হন্যে হয়ে ছুটবে। বহু মানুষ শান্তির আহবান নিয়ে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হবে। কিন্তু দুনিয়া ও আখিরাতের শান্তি লাভের জন্য আসমানী হিদায়াতের কোনো বিকল্প নেই। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্ববাসীর সামনে এই আসমানী নির্দেশনা উপস্থাপন করেছেন। বিদায় হজ্বের খুতবায় শান্তি প্রতিষ্ঠার এমন এক জীবন্ত নির্দেশনা পেশ করেছেন, পৃথিবীর মানুষ যতদিন সে নির্দেশনা অনুসরণ করবে, পৃথিবীর আকাশে শান্তির সুবাতাস বইবে। প্রতিটি মানুষ নিরাপদে জীবন যাপন করবে। জানের উপর আশঙ্কা থাকবে না। মালের উপর আশঙ্কা থাকবে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোঝালেন, শুধু আইন নয়, শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সতর্কতা ও অপরের অধিকার সচেতনতা। রাসূল বোঝালেন, শুধুই বিধান নয়, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়তে প্রয়োজন প্রতিটি ব্যক্তির ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও একাগ্রতা। প্রত্যেকে সজাগ থাকবে, তার কোনো আচরণে যেন অন্যের জান ও মালের ক্ষতি না করে। কেননা অন্যের হক্ব বিনষ্ট করাকে আল্লাহ হারাম করেছেন। সবার মাঝে যদি অপরের শান্তি ও কল্যাণের চিন্তা কার্যকর থাকে তবে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ সহজ থেকে সহজতর হবে। এ কথাটিই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে বললেন, ‘তোমাদের জান ও মাল তোমাদের জন্য হারাম।’ অর্থাৎ কারো জানের ক্ষতি করা, মালের ক্ষতি করার কোনো প্রকার বৈধতা তোমাদের নেই।
বিদায় হজ্বের পর আজ অনেক অনেক বছর কেটে গেছে। রাসূল আমাদের মাঝে নেই। যুগের পর যুগ পাড়ি দিয়ে রাসূলের সেই শিক্ষা পূর্ণ আবেগ ও আবেদন নিয়ে এখনো আমাদের মাঝে বিরাজমান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিখিয়েছিলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমত ব্যক্তির মন-মানসকে প্রস্ত্তত করতে হবে। পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি ও সৌহার্দের সম্পর্ক সৃষ্টি করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন মানুষে মানুষে ভাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। প্রয়োজন পরস্পরের প্রতি ক্ষমা ও ত্যাগের মনোভাব সৃষ্টি করা।
আজ থেকে বহু বছর আগে পৃথিবীর মানুষের জন্য শান্তি ও সাম্যের বাণী প্রচার করে গিয়েছিলেন মানব ও মানবতার নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি হয়ত বুঝেছিলেন, কোনো এককালে পৃথিবীর মানুষ এমন এক সময় অতিবাহিত করবে, যখন অনাচার ও অবিচারগুলো ন্যায়-নীতি ও সুবিচারের পোশাক গায়ে চড়িয়ে গবীবের সম্পদের উপর নির্মমভাবে চড়াও হবে। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন, একদিন পৃথিবীর মানুষ ন্যায়-অন্যায়ের পরিচয় ভুলে যাবে। ন্যায়কে মনে করবে অন্যায়, আর অন্যায়কে ভূষিত করবে ন্যায়ের পরিচয়ে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব কিছুই হয়ত টের পেয়েছিলেন, নয়ত বিদায় হজ্বের খুতবায় কেন এমন জলদগম্ভীর কণ্ঠের কঠিন ঘোষণা। মক্কার পবিত্র ভূখন্ডে লক্ষাধিক সাহাবীর সামনে দাঁড়িয়ে কেন তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হবে এমন উদ্বেগ-মাখা সতর্কবাণী, ‘পবিত্র এই মক্কা নগরীতে এবং পবিত্র এই মাসে যেমন তোমাদের জন্য হত্যা হানাহানি হারাম, জেনে রাখ হে মানবজাতি! কেয়ামত পর্যন্ত যতদিন পৃথিবীর বুকে মানুষের অস্তিত্ব থাকবে, পরস্পরের জান ও মালের উপর কোনো প্রকার অবৈধ হস্তক্ষেপ তেমনি তোমাদের জন্য হারাম।’
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্বের খুতবায় আরো যে বিষয়ের উপর চূড়ান্ত জোর দিয়েছেন তা হল মানুষের জানের নিরাপত্তা। একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অর্থ হল সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা। এ নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক সজাগ দায়িত্ববোধ। একজন মানুষের প্রাণসংহার বা তার উপর কোনোরূপ শারীরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে ইসলামে যেরূপ হুঁশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে তেমনটি কম বিষয়েই উচ্চারিত হয়েছে। বিদায় হজ্বের খুতবায় হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেসব আয়াত ও হাদীসেরই চূড়ান্ত বক্তব্য এভাবে পেশ করেছেন, আজকের এই দিন, এই মাস এবং এই শহর তোমাদের নিকট যেরূপ পবিত্র ও সম্মানের যোগ্য তোমাদের জান ও মালও তোমাদের পরস্পরের কাছে তেমনি পবিত্র ও সম্মানের যোগ্য।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিদায় হজ্বের কথাগুলো আজ এত বছর পরও কেমন জীবন্ত মনে হয়! মনে হয় যেন নবীজীর কথাগুলো চৌদ্দশ বছর পরের এই আমরা, আমাদের সমাজ এবং এই পরিবর্তিত সভ্যতাকে কেন্দ্র করেই উচ্চারিত। শত শত বছর আগে সুদূর আরবের কোনো এক সাজানো শোভিত মরুদ্যানে দাঁড়িয়ে চিরন্তন অমর কণ্ঠে এই আমাদেরকেই যেন তিনি সভ্যতার সবক শিখিয়েছিলেন। সময়ের গায়ে ভর করে রাসূলের কথাগুলো আজ আমাদের বিবেকের বদ্ধ দুয়ারে করাঘাত করছে। আমাদের নিথর মনুষ্যত্বে জাগরণ তোলার আহবান জানাচ্ছে।
আমাদের কত যুক্তি-তর্ক, কত আলোচনা পর্যালোচনা নবীজীর বাণীর সামনে সব কেমন নির্জীব মনে হয়। আমরা আলোচনা করি শান্তির জন্য, সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তার জন্য। সাধনা করি, শ্রম ব্যয় করি, গবেষণার পিছনে যুগের পর যুগ কাটিয়ে দেই, সমাধান বের হয়েও হতে চায় না। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি বাণীর মাঝেই লুকায়িত আছে এতসব সমস্যার অবাক করা সমাধান।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানের নিরাপত্তার জন্য মানুষের মনকে প্রস্ত্তত করার চেষ্টা করেছেন। মানুষে মানুষে শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন। মানুষকে শিখিয়েছেন মানুষকে সম্মান করতে। রাজাকে শিখিয়েছেন প্রজার সম্মান। প্রজাকে শিখিয়েছেন রাজার মর্যাদা। কর্তাকে শিখিয়েছেন অধীনের সম্মান। অধীনকে সবক দিয়েছেন কর্তার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের। প্রতিটি ব্যক্তির অন্তরে পরস্পরের প্রতি মর্যাদা ও সম্মানবোধ জাগ্রত করেছেন। রাসূল তাই বলেছিলেন, তোমাদের পরস্পরের জান ও মাল পরস্পরের জন্য হারাম।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এমনই সংক্ষিপ্ত বক্তব্য, অথচ ভাব ও মর্মের কেমন বিশাল সমাবেশ ঘটেছে এর মাঝে।
জানের নিরাপত্তা। বহু মানুষের মুখে আমরা এ শব্দটি শুনি এবং শোনামাত্রই একটি অর্থ আমাদের মনে জাগ্রত হয়। জান মানে আত্মা। জান মানে প্রাণ। জানের নিরাপত্তা দেওয়ার অর্থ হল, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা না করা। এ পর্যন্তই যেন এ শব্দের পরিধি। অথচ ছোট্ট এ শব্দের মাঝে লুকিয়ে আছে ভাব ও মর্মের বিস্ময়কর একটি জগত। পৃথিবীর বুকে বিচরণকারী মানবশ্রেণীর যত সদস্য রয়েছে, ক্ষুদ্র এ শব্দের গভীর অভ্যন্তরে তাদের প্রত্যেকের জন্য লুকিয়ে আছে যুগান্তকারী নির্দেশ। তুমি যে শ্রেণীর হও, যে পেশারই হও, সামাজিক যে স্তরেই তোমার অবস্থান হোক, তোমার যতটুকু শক্তি আছে সামর্থ্য আছে, সেই শক্তি ও সামর্থের সামান্য পরিমাণও যেন কারো জানের জন্য হুমকি না হয়ে দাঁড়ায়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের পরস্পরের জান ও মাল তোমাদের উপর হারাম।’ এই ‘তোমাদের’ শব্দের মাঝে সমাজের কোনো একটি শ্রেণী সীমাবদ্ধ নয়। উম্মতের প্রতিটি সদস্যই এর অন্তর্ভুক্ত। সংক্ষিপ্ত শব্দের এমন ব্যাপকতার মধ্য দিয়ে রাসূল যেন একে একে প্রতিটি শ্রেণীকে সম্বোধন করেছেন।
দাবি করতে ইচ্ছে হয়, রাসূলকে ভালোবাসি। মনে চায় বলি, দ্বীনের প্রতি আমি পরম অনুরাগী, কিন্তু বলতে গেলে বিবেকের কাছে বাঁধা পাই। লজ্জা হয়। অপরাধবোধে জর্জরিত হই। কোন মুখে বলি, রাসূলের আদর্শই উত্তম আদর্শ! তাঁর দর্শনই জীবনের শ্রেষ্ঠ দর্শন! যখন সুযোগ আসে শোষণের, ভুলে যাই তখন রাসূলের আদর্শের কথা। বিস্মৃত হই তাঁর জীবনদর্শন ও চিন্তার কথা!
দেড় হাজার বছর আগে রাসূল ইলাহী নির্দেশনায় নির্মাণ করেছিলেন একটি সমাজ- মনুষ্যত্ব ও ইনসানিয়াতের সমাজ। সেই সমাজের সামনে দাঁড়িয়ে দেড় হাজার বছর পরের এই আমাদেরকেই হয়ত তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। হয়ত তিনি বুঝেছিলেন, কালক্রমে পৃথিবীর মানুষ একটি সময় অতিক্রম করবে, যখন মনুষ্যত্বের মানবিক সংজ্ঞা হারিয়ে যাবে। মনুষ্যত্বের নতুন নতুন সংজ্ঞা তৈরি হবে। যে সংজ্ঞায় দুর্বলের কোনো স্থান থাকবে না। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন ব্যাপক ঘোষণা দিলেন,
তোমাদের প্রত্যেকের ব্যাপারে এই নির্দেশ, শাসক-শাসিত, ধনী-গরীব, তোমাদের পরস্পরের জান ও মাল তোমাদের জন্য হারাম।
বিদায় হজ্বের খুতবায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরো একটি বিস্ময়কর ঘোষণা-
‘হে লোকসকল! তোমাদের প্রতিপালক একজন। তোমাদের পিতা একজন। সবাই তোমরা আদম আ.-এর সন্তান। আর আদম আ.কে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।’
আল্লাহর নবীর যবানে ঘোষিত হল, ‘আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই অনারবের উপর। অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই আরবের উপর। কৃষ্ণাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব নেই শ্বেতাঙ্গের উপর, শ্বেতাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব নেই কৃষ্ণাঙ্গের উপর। তাকওয়াই হল শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি।’
আল্লাহর নবীর কণ্ঠে যখন ধ্বনিত হল সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের এমন কালজয়ী উচ্চারণ পৃথিবীর মানুষ অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করল, যুগ যুগ ধরে লালন করে আসা শ্রেণীবিন্যাস ও শ্রেণীবৈষম্যের ভিত কেমন করে কেঁপে উঠেছে।
তোমাদের পিতা তো একজন। সুতরাং সন্তানের পরিচয়ে কেউ কারো চেয়ে অগ্রসর নও। তোমাদের রব একজন। সুতরাং বান্দার পরিচয়ে কেউ কারো চেয়ে অগ্রগামী নও। মাটির মানুষ সবাই তো আদমের সন্তান। সুতরাং বংশের পরিচয়ে কেউ কারো চেয়ে অগ্রগণ্য নও।
আদম তো মাটিরই তৈরি। সুতরাং দেশ ও মাটির পরিচয়ে কেউ তো কারো চেয়ে শ্রেষ্ঠ নও। তাহলে কী নিয়ে তোমাদের গর্ব, কী নিয়ে তোমাদের শ্রেষ্ঠত্ববোধ! আরব আজমের বনী আদম, একই আদমের বংশধর হে মানবকুল! হে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গের দল। বংশের গৌরবে গর্বিত হে মানুষ! বর্ণের সৌন্দর্যে বিমোহিত হে মানব সম্প্রদায়! শোন, আজ আমার কণ্ঠে শুনে রাখ, শ্রেষ্ঠত্বের গৌরব তোমরা করতে পার। তবে তা বংশ দিয়ে নয়। বর্ণ দিয়ে নয়। মাটি ও ভৌগলিক অবস্থান দিয়ে নয়। আল্লাহর ভয় যার মধ্যে থাকবে, মানুষ তো সেই; হোক না বংশ-মর্যাদায় গর্ব করার মতো কিছু নেই। হোক না রং ও বর্ণের সৌন্দর্য তার কিছুমাত্র নেই। আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় তো সে-ই যার মধ্যে তাকওয়া প্রবল।
বিদায় হজ্বের খুতবায় আল্লাহর নবীর কণ্ঠে যেন মূর্ত হয়ে ফুটেছিল মহান স্রষ্টার সেই বাণী-
ভূষণ যদি ধরতে হয়, পোশাক যদি পরতে হয় বংশ ও বর্ণের ভূষণ নয়, তাকওয়ার পোশাক ধর। তাকওয়ার পোশাকই তো শ্রেষ্ঠ পোশাক।’
বিদায় হজ্বের খুতবায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক কথাই বলেছিলেন। সেদিন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুতবা যাঁরা শুনছিলেন, সন্দেহ নেই- অভূতপূর্ব এক নিবিষ্টতায় ডুবে গিয়েছিলেন। রাসূলের একেকটি বাণী উচ্চারিত হচ্ছিল আর তাঁদের হৃদয় মনে ক্ষণে ক্ষণে অনির্বচনীয় শিহরণ জাগছিল। রাসূল যখন ঘোষণা দিলেন, শোন-শোন, জাহিলিয়াতের যত রসম রেওয়াজ আছে, সব আমার পায়ের নিচে পদদলিত।’ গোটা দ্বীন ও শরীয়তের সারনির্যাস, মানুষ ও মানবতার কল্যাণ ও সমৃদ্ধির মূলকথা হিসাবে রাসূল ঘোষণা দিলেন, ‘জাহিলিয়াতকে বর্জন কর। জাহিলিয়াতকে বর্জন কর!!’
জীবনের আখেরী খুতবায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কিছু বলে গেছেন, আসুন, আমাদের জীবনকে সেই আলোকে সজ্জিত করি। জীবনের যত পথ ও আদর্শ আছে, সব কিছুকে বর্জন করে রাসূলের আদর্শের অমোঘ আবেদনে আত্মনিবেদিত হই। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন। #