হা দী সে র আ লো কে ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। যার চরিত্রকে হাদীস শরীফে কুরআনের বাস্তব রূপ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ক্ষমা, সহিষ্ণুতা ও উদারতার ক্ষেত্রে তাঁর কাছাকাছি কোনো দৃষ্টান্ত এ ধরিত্রি কোনো যুগে জন্ম দিতে পারেনি। যাঁর মুবারক জীবনের পুরোটাই ছিল ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার সফেদ চাদরে আবৃত।
ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার নববী দৃষ্টিকোণ
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুদীর্ঘ সোহবতপ্রাপ্ত চাচাত ভাই হযরত আলী রা. তাঁর মহান চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা. মন্দের বদলা মন্দের দ্বারা নিতেন না; বরং ক্ষমা ও মার্জনা করতেন। তিনি কখনো কারো ওপর হাত তুলেননি একমাত্র জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ ছাড়া। কখনো কোনো খাদেম কিংবা মহিলার উপর হাত উঠাননি। কোনো প্রকার জুলুমের প্রতিশোধ নিতে কেউ তাঁকে কখনো দেখেনি, যতক্ষণ না কেউ আল্লাহর নির্ধারিত হুদূদ বা সীমারেখা লংঘন করেছে। যখন আল্লাহর কোনো হুকুম লংঘিত হত তখন তিনি সবচেয়ে বেশি ক্রোধান্বিত হতেন। -শামায়েলে তিরমিযী; আস্সীরাতুন্নববিয়্যাহ- সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী, পৃষ্ঠা : ৩৪৩
ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার ফযীলত
সমাজ-বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পছন্দ করতেন না; বরং সামাজিক সম্প্রীতির স্বার্থে সকল প্রকার দুঃখ-কষ্ট মাথা পেতে গ্রহণ করাকেই শ্রেয় মনে করতেন। তিনি ইরশাদ করেন- ‘যে মুসলমান মানুষের সাথে মিলে থাকে এবং তাদের কষ্ট ও আঘাত সহ্য করে সে ঐ ব্যক্তি থেকে অধিক শ্রেয় যে কারো সাথে মিলে না এবং কারো কষ্ট সহ্য করে না।’ -তিরমিযী; মিশকাত ২/৪৩২
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, ‘দানে কোনোদিন ধন কমে না; ক্ষমার কারণে আল্লাহ কেবল মর্যদাই বৃদ্ধি করেন। আর যে আল্লাহর জন্য বিনয়ী হয় আল্লাহ তার সম্মান অবশ্যই বৃদ্ধি করে দেন। -মুসলিম; তিরমিযী ২/২৩
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত আরেকটি রেওয়ায়াতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহিষ্ণুতার মর্যাদা তুলে ধরে বলেন, ‘হযরত মুসা আ. আল্লাহ তাআলাকে জিজ্ঞেস করেন, হে রব! তোমার নিকট কোন বান্দা বেশি মহিমান্বিত? জবাবে আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা করে দেয়।’ -মিশকাত ২/৪৩৪
সহনশীলতার নববী প্রশিক্ষণ
নবীজীর সহনশীলতার বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর খাদেম হযরত আনাস রা. বলেন, আমি দশ বছর ধরে আল্লাহর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) খেদমত করেছি। তিনি আমার কোনো আচরণে বিরক্ত হয়ে কখনো উহ্ বলেননি এবং কখনো বলেননি যে, অমুক কাজ কেন করলে? অমুক কাজ কেন করলে না? -মুসলিম, কিতাবুল ফাযাইল ২/২৫৩
হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, একবার এক বেদুঈন মসজিদে পেশাব করে দিল। লোকেরা তা দেখে তেড়ে এল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তাকে ছেড়ে দাও এবং এক বালতি পানি ঢেলে স্থানটি ধুয়ে দাও। মনে রেখ, তোমাদেরকে সহজ-সাধ্যকারী হিসেবে পাঠানো হয়েছে, কাঠিন্য সৃষ্টিকারী হিসেবে নয়। -বুখারী, কিতাবুল উযূ, ১/৩৫
উম্মতকে তিনি নসীহত করে বলেন, ‘যে তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার সাথে তুমি মিলে যাও, যে তোমার ওপর জুলুম করে তাকে ক্ষমা করে দাও, যে মন্দ আচরণ করে, তার সাথে সদাচরণ কর।’
এমনি আরো অসংখ্য হাদীস রয়েছে। সবগুলো অধ্যয়ন করলে মোটামুটি যে কথাগুলো বের হয় তা হচ্ছে : সহনশীলতা তিক্ত হলেও এর ফল সুমিষ্ট, সহনশীলরা যেমন আল্লাহর প্রিয়পাত্র তেমনি মানুষেরও প্রিয়প্রাত্র। সহনশীলতা একজন পূর্ণাঙ্গ মুমিনের জীবনের উপাদান। মানুষ যখন সহনশীল হয় তখন আল্লাহর ফেরেশতাগণ তাদের পক্ষে সুপারিশ করেন।
অসহিষ্ণুতা পরিহারের নির্দেশ
ইসলাম সহিষ্ণুতা ও সহমর্মিতাবিরোধী সকল প্রকার হিংসাত্মক ও অসৌজন্যমূলক আচার-আচরণ পরিহার করার উদাত্ত আহবান জানায়। হাদীস শরীফের ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা মন্দ ধারণা থেকে বেঁচে থাক। কেননা, তা জঘন্য মিথ্যা। তোমরা একে অন্যের ছিদ্রান্বেষণ করবে না, একে অন্যের দোষ খুঁজে বেড়াবে না, প্রতারণা করবে না, পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ রাখবে না, একে অন্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাবে না; বরং আল্লাহর বান্দা হিসেবে সকলে ভাই ভাইয়ে পরিণত হবে। -বুখারী ২/৮৯৬
বস্ত্তত অন্যকে সহ্য করতে পারাই সবচেয়ে বড় বীরত্ব। আদর্শের শক্তিই সবচেয়ে বড় শক্তি। এ শক্তি যতদিন পর্যন্ত মুসলমানদের মাঝে ছিল ততদিন তারা ছিল উন্নত শির। তাদের মধ্যে ছিল না কোনো প্রকার অন্তর্দ্বন্দ্ব, অহমিকা, একগুঁয়েমি ও বাড়াবাড়ি। চলমান বিশ্বের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিশোধ ও হিংসার যে দাবানল ঘূর্ণিবেগে ছুটছে তা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র পথ হচ্ছে- ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার রজ্জু শক্তভাবে ধারণ করা।
অমুসলিমদের সাথে সহিষ্ণুতা
অমুসলিমদের সাথে সহিষ্ণুতা ও উদারতার বিষয়টি ইসলামী ইতিহাসের এক উজ্জ্বলতম অধ্যায়। মুসলিম জাতির পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধের ওপর ইসলাম যেমনিভাবে গুরুত্বারোপ করে তেমনি অমুসলিমদের সাথে উঠা-বসার ক্ষেত্রেও ক্ষমা ও মহানুভবতার আহবান জানায়। ইসলামী খিলাফাতের অধীনে বসবাসকারী অমুসলিমদের সাথে ইসলামী শাসকগণ যে ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বকালের বিশ্ববাসীর জন্য ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার মূর্তআদর্শ। চরম থেকে চরমতর শত্রুদের সঙ্গেও তিনি যে সহনশীলতা প্রদর্শন করেছেন তা রীতিমত ইসলাম বিদ্বেষীদেরকেও হতচকিত করে দিয়েছিল। ঈমানী প্রাণ সঞ্চার করেছিল বহু অমুসলিমের অন্তরে।
সহিষ্ণুতার কয়েকটি দৃষ্টান্ত
১. যখন মুনাফিক-সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলূলকে কবরে নামানো হয় তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে গমন করে তাকে কবর থেকে বের করার নির্দেশ দেন। এরপর তার লাশ স্বীয় হাটুর ওপর রাখেন, মুবারক মুখের পবিত্র থুথু তার শরীরে দেন এবং নিজের পরিধেয় জামা তাকে পরিয়ে দাফন করেন। (বুখারী, কিতাবুল জানাইয ১/১৮২)
২. যায়েদ নামের এক ইয়াহুদী পাদ্রী মহানবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাথে একটি অগ্রিম কেনা-বেচা করল। নির্ধারিত সময়ের ২/৩ দিন পূর্বেই সে এসে মাল পরিশোধের দাবি করল। এমনকি চাদর মুবারক টেনে নবীজীর সঙ্গে বেআদবী করল। বিকৃত চেহারায় রূঢ় কণ্ঠে নবীজীর দিকে তাকিয়ে বলল, হে মুহাম্মাদ! আমি তোমাকে চিনি। তোমরা আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর, বড় টালবাহানাকারী।’ সেখানে উপস্থিত ছিলেন হযরত উমর ফারুক রা.। নবীজীর সাথে লোকটির এ অশিষ্ট আচরণ দেখে তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে তাকে ধমক দিলেন। কিন্তু রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মুখে ছিল হাসি। তিনি উমর রা.কে বললেন, উমর! আমি ও এ ব্যক্তি তোমার থেকে অন্যরূপ আচরণ পাবার হকদার ছিলাম। দরকার তো ছিল তুমি আমাকে সত্বর তার প্রাপ্য আদায় করার পরামর্শ দিতে আর তাকে কথায় ও আচরণে নম্রতা অবলম্বনের তাগিদ দিবে। এরপর তিনি উমর রা.কে প্রাপ্য পরিশোধের নির্দেশ দেন। এবং তাকে আরো ২০ সা বেশি দিতে বলেন, যা ছিল উমর রা. কৃর্তক লোকটিকে ধমক দেওয়ার বদলা। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর এ সহিষ্ণু আচরণ লোকটির ইসলাম গ্রহণের কারণ হয়। যাওয়ার পথে যায়েদ উমর রা.কে বললেন, হে উমর! আমি হচ্ছি ইয়াহুদী-পন্ডিত যায়েদ ইবনে সানা। আসলে লেনদেন আমার উদ্দেশ্য ছিল না, বরং মহানবীর ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা পরীক্ষা করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। কারণ শেষ নবীর অন্যতম গুণ হবে এই যে, তাঁর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা ক্রোধের ওপর প্রবল থাকবে, যতই রূঢ় আচরণ করা হবে তার ক্ষমা ততই বৃদ্ধি পাবে। অতএব ওমর! আমি যা চেয়েছি তা পেয়ে গেছি। এরপর তিনি নবীজী সা. এর হাতে খালেছভাবে ঈমান আনেন এবং তাঁর অঢেল সম্পদের অর্ধেক উম্মতের জন্য দান করে দেন। -মুসনাদে আহমদ, ৩/১৫৩, আখলাকুন্নাবী পৃ. ১২৪
৩. নজদ-অভিমুখী এক অভিযানের সময় পথিমধ্যে দ্বিপ্রহর হলে সাহাবীগণ একটি বিস্তীর্ণ বাগানের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি বাবুল বৃক্ষের ছায়ায় আরাম করছিলেন। তাঁর তলোয়ার বৃক্ষের ডালে ঝুলানো ছিল। এমন সময় এক বেদুঈন-কাফের তলোয়ারটি টেনে নামাল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুম থেকে জেগে দেখেন তাঁর শিয়রে এ দুশমন তরবারী হাতে দাঁড়িয়ে আছে এবং বলছে, আমার হাত থেকে তোমাকে এখন কে বাঁচাবে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে ওঠেন- ‘আল্লাহ!’ একথা শুনে তার আত্মা প্রকম্পিত হয়ে ওঠল। সে তলোয়ার কোষবন্ধ করে বসে পড়ল। নবীজী তাকে কোন শাস্তিই দিলেন না বরং ক্ষমা করে দিলেন। -বুখারী, কিতাবুল মাগাযী, ২/৫৯৩
৪. আববাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন নাজরানের চাদর পরিহিত ছিলেন। যার
প্রান্তদেশ ছিল মোটা। পথে এক বেদুঈনের সাথে দেখা হতেই সে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাদর ধরে জোরে টান দিল, যার ফলে তাঁর গলায় দাগ পড়ে গেল। এরপর সে বলল, আল্লাহর যে মাল আপনার কাছে রয়েছে তা আমাকে দেওয়ার হুকুম দিন। করুণার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন এবং প্রার্থিত বস্ত্ত দেওয়ার জন্য বললেন। -বুখারী, কিতাবুল জিহাদ
ক্ষমতার ওপর ক্ষমার প্রাধান্য
মক্কার সুদীর্ঘ ১৩ বছর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণের ওপর যে লোমহর্ষক, অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল, ক্ষমতা লাভ করার পরও এর কোনো প্রতিশোধ মুসলমানরা নেননি, এমনকি কখনো কাউকে বদদুআও করেনি।
নবুওয়াতের ১০ম বছর তায়েফবাসীর হাতে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন মানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাহাড়-সমূহের ফেরেশতা কর্তৃক অত্যাচারী তায়েফবাসীকে পিষে মেরে ফেলার আবেদন করা হলে তা নাকচ করে দিয়ে রহমতের নবী বলেছিলেন, আশা করি এদের বংশধরদের মধ্যে কেউ লা-শরীক আল্লাহর ইবাদাতগুজার হবে। -যাদুল মা‘আদ, ১/৩০২
মুসলিম জাতি যখন সেরা শক্তি
মুসলিম জাতি যখন বিশ্বের সকল শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে সেরা শক্তিতে পরিণত, তখনো সহনশীলতা ও ক্ষমার বিধান থেকে একটুও সরে যায়নি। বরং বিজয়ের বিস্তৃতির সাথে সাথে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর রহমতের বিস্তৃতিও ব্যাপকতর হয়েছিল। যার ফলে আল্লাহ তাআলাও তার নুসরত ও রহমতের বারিধারা মুষলধারে বর্ষণ করতে শুরু করেন।
ঐতিহাসিক হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় মুলসমানগণ মোকাবেলায় সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও ইসলামের স্বার্থে বাহ্যত অবমাননাকর সন্ধি মাথা পেতে মেনে নিয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তাআলা একে সুস্পষ্ট বিজয় হিসেবে কবুল করেন।
ইসলামবিদ্বেষী শত্রুদের কেন্দ্রীয় ঘাঁটি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাতৃভূমি পবিত্র শহর মক্কা যেদিন মুসলমানরা জয় করেছিল সেদিন চিহ্নিত জালিমরা এদিক ওদিক ছুটছিল। তারা মসজিদুল হারামে দলে দলে জমায়েত হতে লাগল। সকলে কাতারবন্দী হয়ে নিজেদের শেষ পরিণতির ক্ষণ গুণছিল। এ শোচনীয় পরাজয়ের লাঞ্ছণা ও অবমাননার গ্লানিতে তারা ন্যুব্জ হয়ে পড়েছিল। এমনি সময়ে রহমতের নবী সেখানে প্রবেশ করেন। হারাম শরীফের দরজার কপাটে দাঁড়িয়ে তিনি সে রায়ই ঘোষণা করেন যা ইউসুফ আ. তাঁর ভাইদের ব্যাপারে ঘোষণা করেছিলেন। বলেছেন, ‘তোমাদের বিরুদ্ধে আজ কোনো অভিযোগ নেই। যাও, তোমরা মুক্ত।’
যুদ্ধ-সম্রাট আবু সুফিয়ানের যখন শুভবুদ্ধির উদ্রেক হল তখন তিনিও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে আত্মসমর্পণ করলেন। নবীজী তাকে শুধু ক্ষমাই করলেন না, ঘোষণা করলেন, যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে তারাও নিরাপদ। রাসূলের এ মহানুভবতা আবু সুফিয়ানের হিংসাকে চিরতরে বিনাশ করে দেয়। তিনি খালেস মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। -আসসীরাতুন্নবিয়্যাহ পৃ. ৩৪৯; যাদুল মা‘আদ, ১/৪২১
আজ শান্তি ও দয়া প্রদর্শনের দিন
আনসার প্রধান সা’দ ইবনে উবাদা রা. শত্রুদের বিপন্ন অবস্থা দেখে বিজয় আনন্দে বলে ওঠেছিলেন, ‘আজ প্রচন্ড লড়াইয়ের দিন, আজ কাবার সীমানায় সব কিছু বৈধ হবে, আজ আল্লাহ তাআলা কুরাইশদের অপমান করেছেন।’ সা’দের এ কঠোর ঘোষণা নবীজী সা. এক দারুণ শিল্পীত ভঙ্গিতে খন্ডন করে ক্ষমার বাণী শোনালেন। ঘোষণা করলেন, ‘আজ তো পরম দয়া ও ক্ষমা প্রদর্শনের দিন, আজ আল্লাহ তাআলা কুরাইশদের সম্মানিত করবেন এবং কাবার মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন। -আসসীরাতুন্নবিয়্যাহ পৃ. ৩৫২
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কাবাসীদের মাঝে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিয়ে বললেন, আজ শুধু তারাই বঞ্চিত হবে যারা নিজেরাই নিরাপত্তা লাভে ইচ্ছুক নয় এবং যারা নিজেদের জীবন নিয়ে বিতৃষ্ণ। ব্যাপক নিরাপত্তার ঘোষণা দিয়ে নবী বলেন, যে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ, যে আপন ঘরের দরজা বন্ধ করবে সে নিরাপদ, যে আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সেও নিরাপদ। -সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪০৯
ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার প্রত্যক্ষ ফল
এ ক্ষমা প্রদর্শনের ফল এ দাঁড়াল যে, ইসলামী রাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ শত্রুদের হাত থেকে নিরাপদ হয়ে গেল। শত্রু বন্ধুতে পরিণত হল। অসংযমী পরহেযগার হয়ে গেল। বাঁধার সকল প্রাচীর ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল। আল্লাহ তাআলা তাঁর নুসরাতের সকল দ্বার উন্মোচন করে দিলেন। দলে দলে মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে শুরু করল।
এ মহানুভবতার বদৌলতেই মূলত মুসলিমবিরোধী সকল কার্যক্রমে নেতৃত্ব দান করা আবু সুফিয়ান রা., নবীজী প্রিয় চাচার সাথে পশুসুলভ আচরণ করা তার স্ত্রী হিন্দা রা., চাচার হত্যাকারী ওয়াহশী রা., আবু জেহেলের ছেলে ইকরামা রা. প্রমুখ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলামকে আঁকড়ে ধরতে উৎসাহ পেয়েছিলেন। মুসলমানদের সে সোনালী অতীত আবারও ফিরে পেতে হলে ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার গুণে মুসলমানদের গুণান্বিত হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। #