নতুন হিজরী বর্ষ : কালের চক্রবালে জ্বলে চেতনার দীপ
সমাপ্ত হল ১৪২৭ হিজরী আর সূচনা হল নতুন হিজরী বর্ষ-১৪২৮। হিজরী বর্ষের সূচনা ও সমাপ্তি দু’টোই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যিলহজ্ব মাসের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে হিজরী বর্ষ সমাপ্ত হয় আর সূচনা হয় মহররম মাসের শুভ সূচনার মাধ্যমে। যিলহজ্ব মাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দু’টি ইবাদত- হজ্ব ও কুরবানী আদায় করা হয়। আর মহররম হচ্ছে কুরআনের ভাষায় ‘আরবাআতুন হুরুম’ অর্থাৎ চার সম্মানিত মাসের অন্যতম। এ হিসেবে হিজরী বর্ষ সূচনা ও সমাপ্তি উভয় দিক থেকেই অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ, মহিমান্বিত ও তাৎপর্যবহ।
হিজরত থেকে এ বর্ষ-গণনা আরম্ভ হওয়ায় একে হিজরী বর্ষ বলে। হিজরত ইসলামের ইতিহাসে; বরং পৃথিবীর ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করেছেন শুধু দ্বীনের খাতিরে, আল্লাহর আদেশে। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্য অবলম্বন করে দ্বীনের শিক্ষা ও আদর্শকে ধারণ করার জন্য আর তার প্রচার-প্রসার, বিজয় ও প্রতিষ্ঠার জন্য হিজরত করেছেন সাহাবায়ে কেরাম। এই হিজরতকারী সাহাবায়ে কেরামের পরিচিতি হচ্ছে- ‘মুহাজির’। আর যাঁরা তাঁদের গ্রহণ করেছেন পূর্ণ খুলূস ও আন্তরিকতার সঙ্গে তাদের পরিচিতি- ‘আনসার’। পবিত্র কুরআনে সূরা হাশরের ৮-৯ আয়াতে এক প্রসঙ্গে এই সৌভাগ্যবানদের গুণ ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখিত হয়েছে। যার তরজমা এই- ‘এ সম্পদ অভাবগ্রস্ত মুহাজিরগণের জন্য, যারা নিজেদের ঘরবাড়ি ও সম্পত্তি থেকে উৎখাত হয়েছে। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাহায্য করে। তারাই তো সত্যাশ্রয়ী।
‘আর যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে এই নগরীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ঈমানকে ধারণ করেছে। তারা মুহাজিরদের ভালোবাসে এবং মুহাজিরদেরকে যা দেওয়া হয়েছে তার জন্য অন্তরে আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে না। আর তাদেরকে নিজেদের উপর অগ্রাধিকার দেয় নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও। যাদের অন্তর কার্পণ্য থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে তারাই সফলকাম।’
হিজরী বর্ষের সূচনা-মাস মহররম। এ মাসের দশ তারিখকে আশুরা বলা হয়। পৃথিবীর বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এদিন সংঘটিত হয়েছে। হযরত মুসা আ. ও বনী ইসরাঈলকে আল্লাহ তাআলা ফেরাউনের কবল থেকে অলৌকিকভাবে মুক্ত করেছিলেন এবং ফেরাউনকে লোহিত সাগরে নিমজ্জিত করেছিলেন। এজন্য মদীনার ইয়াহুদীরা এদিন রোযা রাখত। মুসলিমদের জন্যও এদিন রোযা রাখা মুস্তাহাব সাব্যস্ত হয়েছে, তবে ইয়াহুদীদের সাদৃশ্য থেকে মুক্ত থাকার জন্য আগে বা পরে একদিন মিলিয়ে দু’দিন রোযা রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় দৌহিত্র ও সাহাবী হযরত হুসাইন রা. শাহাদাত বরণ করেন।
তাঁর শাহাদত ইসলামী ইতিহাসের অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ঘটনা, কিন্তু তার চেয়েও হৃদয়বিদারক বিষয় এই যে, একে কেন্দ্র করে একটি শ্রেণী বিভিন্ন শিরকী ও বিদআতী কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ইসলামবিরোধী কর্মকান্ড প্রতিরোধ করতে গিয়ে যে ব্যক্তিত্ব শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে অমর হয়েছেন তাঁর শাহাদাতকে কেন্দ্র করে ইসলামবিরোধী কর্মকান্ডের আসর জমিয়ে তোলা কতখানি ন্যক্কারজনক তা খুব সহজেই অনুমেয়।
এ অনৈসলামিক কর্মকান্ডে ন্যূনতম অংশগ্রহণ থেকেও বিরত থাকা এবং অন্যকেও বিরত রাখার চেষ্টা করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব।
দ্বীনী ইলম অর্জন করা, বিশ্বাস ও কর্মে দ্বীনকে ধারণ করা এবং জীবনের সকল অঙ্গনে দ্বীনের বিজয় ও প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক প্রয়াস গ্রহণ করা যেমন হিজরতের প্রেরণা তেমনি শাহাদাতে হুসাইনেরও প্রেরণা।
এ সত্যই আজ আমাদের ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে।