শিশুর ভুবনে
‘শিশুর সফল শিক্ষক তিনি যিনি নিজেও শিশু হতে পারেন এবং শিশুর ভুবনে প্রবেশ করে তার সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন। এ শিক্ষা আমরা নানাজীর কাছ থেকে পেয়েছি। আর অভিজ্ঞতায়ও দেখেছি, আদর-সোহাগের মাধ্যমে ও খেলাধুলার পরিবেশ বলা কোনো কথা শিশু-মন যেভাবে গ্রহণ করে তা অন্যভাবে হাজার উপদেশ-বাক্যের মাধ্যমেও গ্রহণ করানো যায় না।’
নানাজী (শায়খ আলী তানতাবী) শিশুদের সম্পর্কে অত্যন্ত স্নেহশীল ও সচেতন ছিলেন। আমরা যখন তাঁর কক্ষে যেতাম তিনি আমাদের হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাতেন এবং হাতের কাজ ছেড়ে আমাদের নিয়ে মশগুল হয়ে যেতেন। আমরা গিয়ে তাঁর কোলে বসতাম এবং তাঁকে গল্প শোনাতাম! অত্যন্ত মনোযোগী হয়ে শ্রোতার মতো তিনি আমাদের গল্প শুনতেন এবং গল্পের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতেন। আনন্দের প্রসঙ্গ আসলে শিশুর মতো আনন্দ প্রকাশ করতেন, বিস্ময়ের প্রসঙ্গে বিস্ময়, আর দুঃখের প্রসঙ্গে যেন সত্যি সত্যিই দুঃখ পেতেন!
কখনো যদি দেখতেন, আমাদের মন ভার হয়ে আছে তাহলে এমন নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করতেন যে, আমাদের মন আনন্দে ভরে উঠত। কখনো তাঁর বিছানায় তৈরি হত বালিশের খেলাঘর, কখনো বা পকেট থেকে বা দেরাজ থেকে বেরুত মজাদার কোনো কিছু। কখনো অন্য কোনো আনন্দের বিষয়।
একবার আমার ছোট বোন- তার বয়স তখন পাঁচ- দাবা খেলবে বলে বায়না ধরল। কিন্তু বড়রা কেউ তার সঙ্গে মিছেমিছি খেলে সময় ‘নষ্ট’ করতে রাজি হচ্ছিল না। নানাজী তা বুঝতে পেরে অত্যন্ত মনোযোগী দাবাড়ুর মতো তার সঙ্গে দাবা খেলায় মগ্ন হয়ে গেলেন!
আর একদিনের কথা। কেন যেন আমাদের কারো মন ভালো নেই। নানাজী হঠাৎ এমন এক খেলা উদ্ভাবন করলেন, যা মনে পড়লে এই প্রায় পঁচিশ বছর পরও আনন্দের রেশ অনুভব করি। তিনি বললেন, চল আজ আমরা সবাই বেড়াতে যাব। রাস্তায় এসে কোন দিকে যাওয়া যায় তা নির্ধারণ করার জন্য একটি নিয়ম ঠিক করা হল। তা হচ্ছে, যে আমাদের সবার ছোট সেই সবার আগে ঠিক করবে আমরা কোন রাস্তা দিয়ে যাব। আমরা চললাম। সে রাস্তা শেষ হওয়ার পর মোড়ে এসে এবার যে তার বড় তার নির্বাচনের পালা। এরপর তৃতীয়জনের। এভাবে প্রতি রাস্তার মোড়ে একেক জনের সুযোগ এল। আমরা আনন্দের সঙ্গে পথ চলতে লাগলাম। নানাজী ছিলেন আমাদের গাইড। তিনি আমাদের পথ চিনিয়ে দিচ্ছিলেন। আর দৃঢ় ও সুন্দরভাবে হাঁটার কৌশল শিখিয়ে দিচ্ছিলেন। তাঁর সতর্ক দৃষ্টি ছিল কেউ যেন পেছনে পড়ে না যায়। তিনি আমাদের সুন্দর সুন্দর গল্প বলছিলেন, যা ওই পথের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট। গল্পগুলো পথের নিশানা আমাদের স্মৃতিতে গেঁথে দিচ্ছিল।
এভাবে চলতে চলতে আমরা পৌঁছলাম নদীর তীরে। কিনারা থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে ব্যাঙগুলো নদীর পানিতে পড়ছিল। আর তাদের মোটা গলার বেসুরো ডাকে ওই মনোরম স্থানের নিরবতা ভঙ্গ হচ্ছিল। আমরা এখানে কিছুক্ষণ আনন্দ করলাম। এরপর ফেরার সময় নানাজী একটি গাড়ি ভাড়া করলেন এবং আমরা সবাই প্রফুল্লচিত্তে বাড়িতে ফিরে এলাম।
এই সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে নানাজীর ব্যয় হয়েছিল বড়জোর দু থেকে তিন ঘণ্টা কিন্তু দু’দশকেরও বেশি সময় পর আজও এটি আমাদের একটি আনন্দের স্মৃতি, একটি মধুর অনুভূতি এবং শিশুদের মনে আনন্দ যোগাবার একটি আদর্শ দৃষ্টান্ত।