হাদীস ও আছারের আলোকে রোযার মাসায়েল
রোযার গুরুত্বপূর্ণ মাসাইল আলকাউসারে একাধিকবার লেখা হয়েছে। প্রথমবার লেখা হয়েছিল ফিকহ ও ফতোয়ার নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহের উদ্ধৃতিতে। একবার হাদীস ও আছারের কিতাবাদির হাওয়ালাও যোগ করা হয়েছে। এবার এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে যে, মাসআলা উল্লেখ করার পর অধিকাংশ মাসআলার সাথে কোনো না কোনো দলীল কিতাবুল্লাহ, সুন্নতে রাসূলুল্লাহ, আছারে সাহাবা, কিংবা অন্তত তাবেয়ী ইমামগণের ফতোয়া থেকে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও এই প্রবন্ধে সকল মাসআলা আলোচিত হয়নি তবুও এই প্রয়াস দ্বারা ইনশাআল্লাহ নিম্নোক্ত সুফলগুলো পাওয়া যাবে।
১. সাধারণ পাঠকগণ আশ্বস্তি লাভ করবেন যে, ফিকহে হানাফীর মুফতা বিহী মাসায়েল দলীলভিত্তিক, যদিও সাধারণ পাঠকের সুবিধার্থে ফিকহের প্রাথমিক পর্যায়ের কিতাবপত্রে দলীল উল্লেখ করা হয় না।
২. সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ঐ সব বন্ধুদের আগ্রহকে কিছুটা বিবেচনা করা যারা কেবলমাত্র দলীলসহ মাসায়েল জানতে চান যদিও তাদের এই চিন্তাধারা পুরোপুরি সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ দলীলের আলোকে সকল মাসআলা বোঝা তাদের জন্য সহজ নয়। এর জন্য তো উসূলুল ফিকহ ও কাওয়াইদুল ফিকহ-এর ইলম অপরিহার্য তদ্রূপ দলীলের ভাষা সম্পর্কেও যথেষ্ট পাণ্ডিত্য প্রয়োজন।
৩. তালিবে ইলমদের মাঝে এই ধারা সৃষ্টি হওয়া আবশ্যক যে, তারা শামী ও আলমগীরীর মাসায়েল আহকামুল কুরআন, সীরাত ও সুন্নাহ, হাদীস ও আছার এবং ফিকহুস সালাফের কিতাবসমূহের সাথে তুলনা করে পাঠ করবেন। যাতে ফিকহে মুদাল্লাল ও ফিকহে মুকারানের সাথে তাদের মুনাসাবাত তৈরি হয়।
والتوفيق من الله، وحسبنا الله ونعم الوكيل. -তত্ত্বাবধায়ক
মাসআলা : সুস্থমস্তিষ্ক বালিগ মুসলিমের উপর-অসুস্থ ও মুসাফির না হলে-রমযানের রোযা রাখা ফরয। আল্লাহ তাআলা বলেন-
يا ايها الذين آمنوا كتب عليكم الصيام كما كتب على الذين من قبلكم لعلكم تتقون. اياما معدودت، فمن كان منكم مريضا او على سفر فعدة من ايام اخر وعلى الذين يطيقونه فدية طعام مسكين، فمن تطوع خيرا فهو خير له، وان تصوموا خير لكم ان كنتم تعلمون. شهر رمضان الذى انزل في القرآن هدى للناس وبينت من الهدى والفرقان، فمن شهد منكم الشهر فليصمه، ومن كان مريضا او على سفر فعدة من ايام اخر يريد الله بكم اليسر ولا يريد بكم العسر، ولتكملوا العدة ولتكبروا الله على ما هدكم ولعلكم تشكرون.
(তরজমা) হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের প্রতি ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমাদের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টি হয়। গণা-গুনতি কয়েক দিন রোযা রাখতে হবে। তারপরও যদি তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে, তবে অন্য সময়ে সে সমান সংখ্যা পূরণ করবে। যারা এর শক্তি রাখে তারা একজন মিসকীনকে খাবার খাইয়ে (রোযার) ফিদয়া আদায় করতে পারবে। এছাড়া কেউ যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো পুণ্যের কাজ করে, তবে তার পক্ষে তা শ্রেয়। আর তোমাদের যদি সমঝ থাকে, তবে রোযা রাখাই তোমাদের জন্য বেশি ভালো। রমযান মাস-যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা আদ্যোপান্ত হিদায়াত এবং এমন সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি সম্বলিত, যা সঠিক পথ দেখায় এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেয়। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এ মাস পাবে সে যেন এ সময় অবশ্যই রোযা রাখে। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে, তবে অন্য সময় সে সমান সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ সেটাই করতে চান। তোমাদের জন্য জটিলতা সৃষ্টি করতে চান না, যাতে তোমরা রোযার সংখ্যা পূরণ করে নাও এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যে পথ দেখিয়েছেন, সেজন্য আল্লাহর তাকবীর পাঠ কর এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।-সূরা বাকারা : ১৮৩-১৮৫
মাসআলা : শাবানের ২৯ তারিখ দিবাগত সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলে পরদিন থেকে রোযা রাখতে হবে। নতুবা শাবানের ৩০ দিন পূর্ণ করার পর রোযা রাখা শুরু করবে।
عن ابن عمر رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه ذكر رمضان فقال : لا تصوموا حتى تروا الهلال، ولا تفطروا حتى تروه.
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (রমযানের) চাঁদ না দেখা পর্যন্ত রোযা রাখবে না এবং (শাওয়ালের) চাঁদ না দেখা পর্যন্ত রোযা রাখা বন্ধ করবে না।-সহীহ মুসলিম ১/৩৪৭
অন্য হাদীসে আছে, ‘(শাবানের ২৯ দিন পূর্ণ করার পর) তোমরা যদি রমযানের চাঁদ না দেখ তাহলে শাবান মাস ৩০ দিন পূর্ণ করবে।’-মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক হাদীস : ৭৩০১
মাসআলা : আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে রোযা শুরুর জন্য এমন একজন ব্যক্তির চাঁদ দেখাই যথেষ্ট হবে, যার দ্বীনদার হওয়া প্রমাণিত কিংবা অন্তত বাহ্যিকভাবে দ্বীনদার।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘একজন মরুবাসী ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট (রমযানের) চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কি একথার সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন সকলকে রোযা রাখার নির্দেশ দিলেন।’-মুসতাদরাকে হাকিম ১/৪২৪; সুনানে আবু দাউদ ২৩৩৩; সুনানে নাসায়ী ২৪২২; ইবনে আবী শায়বা ৯৫৫৭
মাসআলা : আকাশ পরিষ্কার থাকলে একজনের খবর যথেষ্ট নয়; বরং এত লোকের খবর প্রয়োজন, যার দ্বারা প্রবল বিশ্বাস জন্মে যে, চাঁদ দেখা গেছে। কেননা, যে বিষয়ে অনেকের আগ্রহ ও সংশ্লিষ্টতা থাকে তাতে দু’ একজনের খবরের উপর নির্ভর করা যায় না। নিম্নোক্ত হাদীসে এই মূলনীতি পাওয়া যায়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আসরের নামাযে দু’ রাকাতের পর সালাম ফেরালেন। তখন যুলইয়াদাইন রা. বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! নামায কি দু’ রাকাত করা হয়েছে, না আপনি ভুলে গেছেন?’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন শুধু যুলইয়াদাইন রা.-এর কথার উপর নির্ভর না করে অন্যান্য সাহাবীদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, ‘যুলইয়াদাইন কি ঠিক বলেছে? ... ’ -সহীহ বুখারী ১/২১২
মাসআলা : কোনো ব্যক্তি একাকী চাঁদ দেখেছে, কিন্তু তার সাক্ষ্য গৃহিত হয়নি, এক্ষেত্রে তার জন্য ব্যক্তিগতভাবে রোযা রাখা জরুরি নয়। এক ব্যক্তি হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর নিকট এসে বলল, ‘আমি রযমানের চাঁদ দেখেছি।’ উমর রা. জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার সাথে অন্য কেউ কি দেখেছে?’ লোকটি বলল, ‘না, আমি একাই দেখেছি।’ উমর রা. বললেন, ‘তুমি এখন কী করবে?’ লোকটি বলল, ‘(আমি একা রোযা রাখব না) সবাই যখন রোযা রাখবে আমিও তখন রোযা রাখব।’ উমর রা. তাকে বাহবা দিয়ে বললেন, ‘তুমি তো বড় ফিকহ ও প্রজ্ঞার অধিকারী।’-মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/১৬৮; আলমুহাল্লা ৪/৩৭৮
মাসআলা : শাবান মাসের ২৯ ও ৩০ তারিখে রোযা রাখবে না; না রমযানের নিয়তে না নফলের নিয়তে। অবশ্য যে পূর্ব থেকেই কোনো নির্দিষ্ট দিবসে (যথা সোম ও মঙ্গলবার) নফল রোযা রেখে আসছে, আর ঘটনাক্রমে শাবানের ২৯ ও ৩০ তারিখে ঐ দিন পড়েছে তার জন্য এই তারিখেও নফল রোযা রাখা জায়েয।
عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم أن يتعجل شهر رمضان بصوم يوم أو يومين إلا رجل كان يصوم صوما فيأتي ذلك على صومه.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন তোমরা রমযান মাসের একদিন বা দুই দিন পূর্ব থেকে রোযা রেখো না। তবে কারো যদি পূর্ব থেকেই নির্দিষ্ট কোনো দিন রোযা রাখার অভ্যাস থাকে তাহলে সে ঐ দিন রোযা রাখতে পারে।’-সহীহ বুখারী ১/১৫৬, হাদীস : ১৯১৪; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/১৫৮, হাদীস : ৭৩১৫; জামে তিরমিযী ২/৩২
নিয়ত
মাসআলা : রোযার নিয়ত করা ফরয। নিয়ত অর্থ সংকল্প। যেমন মনে মনে এ সংকল্প করবে, আমি আল্লাহর সন'ষ্টির উদ্দেশ্যে আগামী কালের রোযা রাখছি। মুখে বলা জরুরি নয়। হাদীস শরীফে আছে, ‘সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।’- সহীহ বুখারী ১/২
মাসআলা : ফরয রোযার নিয়ত রাত বাকি থাকতেই করা উত্তম। উম্মুল মুমিনীন হাফসা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
من لم يجمع الصيام قبل الفجر فلا صيام له.
যে ব্যক্তি ফজরের আগে রোযা রাখার নিয়ত করবে না তার রোযা (পূর্ণাঙ্গ) হবে না।-সুনানে আবু দাউদ ১/৩৩৩
মাসআলা : রাতে নিয়ত করতে না পারলে দিনে সূর্য ঢলার আগে নিয়ত করলেও রোযা হয়ে যাবে। সালামা ইবনুল আকওয়া রা. বলেন, (আশুরার রোযা যখন ফরয ছিল তখন) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আসলাম’ গোত্রের একজন ব্যক্তিকে ঘোষণা করতে বললেন, ‘যে সকাল থেকে কিছু খায়নি সে বাকি দিন রোযা রাখবে। আর যে খেয়েছে সেও বাকি দিন রোযা রাখবে। কারণ আজ আশুরা-দিবস।’-সহীহ বুখারী ২০০৭
আবদুল করীম জাযারী বলেন, কিছু লোক সকালে চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দিল। তখন উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ. বললেন, ‘যে ব্যক্তি (ইতিমধ্যে কিছু) খেয়েছে সে বাকি দিন খাওয়া থেকে বিরত থাকবে। আর যে খায়নি সে বাকি দিন রোযা রাখবে।’-মুহাল্লা ৪/২৯৩
মাসআলা : পুরো রমযানের জন্য একত্রে নিয়ত করা যথেষ্ট নয়; বরং প্রত্যেক রোযার নিয়ত পৃথক পৃথকভাবে করতে হবে। কারণ প্রতিটি রোযা ভিন্ন ভিন্ন আমল (ইবাদত)। আর প্রতিটি আমলের জন্যই নিয়ত করা জরুরি। হাদীস শরীফে আছে, ‘সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।’-সহীহ বুখারী ১/২;
আরো দেখুন : আলমুহাল্লা ৪/২৮৫
মাসআলা : রাতে রোযার নিয়ত করলেও সুবহে সাদিক পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী-মিলনের অবকাশ থাকে। এতে নিয়তের কোনো ক্ষতি হবে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
احل لكم ليلة الصيام الرفث الى نسائكم
তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে রমযানের রাতে স্বীয় স্ত্রীর সাথে প্রবৃত্ত হওয়া।-সূরা বাকারা : ১৮৭
মাসআলা : নিয়তের সময় শুরু হয় পূর্বের দিনের সূর্যাস্তের পর থেকে। যেমন-মঙ্গলবারের রোযার নিয়ত সোমবার দিবাগত রাত তথা সূর্যাস্তের পর থেকে করা যায় সোমবার সূর্যাস্তের পূর্বে সঙ্গলবারের রোযার নিয়ত করা যথেষ্ট নয়। কেননা, হাদীস শরীফে রাতে নিয়ত করার কথা বলা হয়েছে।
সাহরী
মাসআলা : সাহরী খাওয়া সুন্নত। পেট ভরে খাওয়া জরুরি নয়, এক ঢোক পানি পান করলেও সাহরীর সুন্নত আদায় হবে। হাদীস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
تسحروا فإن في السحور بركة
‘তোমরা সাহরী খাও। কেননা, সাহরীতে বরকত রয়েছে।’-সহীহ মুসলিম ১/৩৫০
অন্য হাদীসে বলা হয়েছে, ‘সাহরী খাওয়া বরকতপূর্ণ কাজ। সুতরাং তোমরা তা পরিত্যাগ করো না। এক ঢোক পানি দিয়ে হলেও সাহরী কর। কারণ যারা সাহরী খায় আল্লাহ তাআলা তাদের উপর রহমত বর্ষণ করেন এবং তাঁর ফেরেশতারা তাদের জন্য রহমতের দুআ করেন।’ -মুসনাদে আহমদ ৩/১২; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ৯০১০; সহীহ ইবনে হিব্বান ৩৪৭৬
মাসআলা : সুবহে সাদিকের কাছাকাছি সময় সাহরী খাওয়া মুস্তাহাব। তবে এত দেরি করা মাকরূহ যে, সুবহে সাদিক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবেন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
ِإنا معاشر الأنبياء أمرنا أن نعجل فطرنا وأن نؤخر سحورنا. قال الهيثمي : رجاله رجال الصحيح.
‘সকল নবীকে (সময় হয়ে গেলে দেরি না করে) তাড়াতাড়ি ইফতার করতে আদেশ করা হয়েছে এবং সাহরী বিলম্বে খেতে বলা হয়েছে।’ -আলমুজামুল আওসাত ২/৫২৬; মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/৩৬৮
আমর ইবনে মায়মুন আলআওদী বলেন, ‘সাহাবায়ে কেরাম দ্রুত ইফতার করতেন আর বিলম্বে সাহরী খেতেন।’-মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক হাদীস : ৭৫৯১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা হাদীস : ৯০২৫
মাসআলা : দেরি না করে সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করা মুস্তাহাব। হাদীস শরীফে আছে,
لا يزال الناس بخير ما عجلوا الفطر.
যতদিন মানুষ দেরি না করে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করবে ততদিন তারা কল্যাণের উপর থাকবে।-সহীহ বুখারী ১/২৬৩
মাসআলা : মাগরিবের নামায পড়ার আগে ইফতার করে নিবে, যেন সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করার সওয়াব পাওয়া যায়। হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাগরিবের নামায পড়ার আগে তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তাজা খেজুর না পেলে শুকনা খেজুর দ্বারা, তাও না পেলে এক ঢোক পানি দ্বারা ইফতার করতেন।’-সুনানে তিরমিযী হাদীস : ৬৯২
মাসআলা : খেজুর দ্বারা ইফতার করা মুস্তাহাব। খেজুর না পেলে পানি দ্বারা ইফতার শুরু করবে।
من وجد تمرا فليفطر عليه ومن لا يفطر على ماء فإن الماء طهور
আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যার কাছে খেজুর আছে সে খেজুর দ্বারা ইফতার করবে। খেজুর না পেলে পানি দ্বারা ইফতার করবে। কেননা পানি হল পবিত্র।’ -সুনানে তিরমিযী হাদীস : ৬৯০
আরো দেখুন : মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৭৫৮৬
রোযা ভঙ্গের কারণসমূহ
যেসব কারণে কাযা ও কাফফারা উভয়টি জরুরি
মাসআলা : রমযানে রোযা রেখে দিনে স্ত্রী সহবাস করলে বীর্যপাত না হলেও স্বামী-স্ত্রী উভয়ের উপর কাযা ও কাফফারা জরুরি হবে। একটি দীর্ঘ হাদীসে আছে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বলল, আমি রোযা রেখে স্ত্রী সহবাস করেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উপর কাফফারা আবশ্যক করেছিলেন। দেখুন : সহীহ বুখারী ৬৭০৯; জামে তিরমিযী ৭২৪; মুসান্নাফ আবদুর রযযাক ৭৪৫৭; মুসনাদে আহমদ ২/২৪১
মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ ব্যক্তিকে (যে স্ত্রীসহবাসে লিপ্ত হয়েছিল) কাফফারা আদায়ের সাথে কাযা আদায়েরও আদেশ করেছিলেন।-মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৭৪৬১
বিখ্যাত তাবেয়ী আতা রাহ. বলেন, ‘স্বামী-স্ত্রী যখন মিলিত হয় তখন তাদের রোযা ভেঙ্গে যায়।’ প্রাগুক্ত ৭৪৬৭
মাসআলা : রোযা রেখে কোনো প্রকার শরীয়তসম্মত ওযর ছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করলে কাযা ও কাফফারা উভয়টি জরুরি হবে। এক ব্যক্তি রমযানে রোযা রেখে (ইচ্ছাকৃতভাবে) পানাহার করল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আদেশ করলেন, যেন একটি দাস আযাদ করে বা দুই মাস রোযা রাখে বা ষাট মিসকীনকে খানা খাওয়ায়।-সুনানে দারাকুতনী ২/১৯১
ইমাম যুহরী রাহ. বলেন, ‘রমযানে রোযা রেখে যে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করবে তার হুকুম ইচ্ছাকৃতভাবে দিনে সহবাসকারীর অনুরূপ।’ অর্থাৎ তাকে কাযা ও কাফফারা উভয়টি আদায় করতে হবে।-মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক, হাদীস : ৭৪৬৮
মাসআলা : বিড়ি-সিগারেট, হুক্কা পান করলেও রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা ও কাফফারা উভয়টি জরুরি হবে। এই মাসআলার দলীল বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন : ঝাজরু আরবাবির রায়্যান আন শুরবিদ দুখান; তারবীহুল জানান বিতাশরীহি হুকমি শুরবিদ দুখান, আল্লামা আবদুল হাই লাখনোবী রাহ.
মাসআলা : সুবহে সাদিক হয়ে গেছে জানা সত্ত্বেও আযান শোনা যায়নি বা এখনো ভালোভাবে আলো ছড়ায়নি এ ধরনের ভিত্তিহীন অজুহাতে খানাপিনা করা বা স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হওয়া হারাম। এতে রোযা সহীহ হবে না। আর যদি রোযার নিয়ত করার পর কেউ এমনটি করে থাকে তাহলে কাযা-কাফফারা দু’ টোই জরুরি হবে।-সূরা বাকারা : ১৮৭; মাআরিফুল কুরআন ১/৪৫৪-৪৫৫
কাফফারা আদায়ের নিয়ম
মাসআলা : একটি রোযার জন্য দুই মাস ধারাবাহিকভাবে রোযা রাখতে হবে। অসুস্থতার কারণে ধারাবাহিকতা ছুটে গেলে পুনরায় নতুন করে রোযা রাখতে হবে। পেছনের রোযাগুলো কাফফারার রোযা হিসাবে ধর্তব্য হবে না। তবে মহিলাদের হায়েযের কারণে ধারাবাহিকতা নষ্ট হলে অসুবিধা নেই। ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন, ‘যার উপর কাফফারা হিসাবে দুই মাস ধারাবাহিকভাবে রোযা রাখা জরুরি সে যদি মাঝে অসুস্থ হওয়ার কারণে রোযা ভেঙ্গে দেয় তাহলে নতুন করে রোযা রাখা শুরু করবে।’-আলমুহাল্লা ৪/৩৩১
যেসব কারণে শুধু কাযা করতে হয়
মাসআলা : অযু বা গোসলের সময় রোযার কথা স্মরণ থাকা অবস্থায় অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভেতর পানি চলে গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। লাকিত ইবনে সাবিরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
بالغ في الاستنشاق إلا أن تكون صائما
‘তোমরা (অযু-গোসলে) ভালোভাবে নাকে পানি দাও তবে রোযা অবস্থায় নয়।’-সুনানে আবু দাউদ হাদীস : ২৩৬৩ সুনানে তিরমিযী হাদীস : ৭৮৫
সুফিয়ান সাওরী রাহ.-এর অভিমত হল, ‘রোযা অবস্থায় কুলি করতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভেতর পানি চলে গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং তা কাযা করতে হবে। অযু ফরয নামাযের জন্য হোক বা নফল নামাযের জন্য।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস : ৭৩৮০
আরো দেখুন : ইবনে আবী শাইবা ৯৮৪৪-৯৮৪৭
মাসআলা : হস্তমৈথুনে বীর্যপাত হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। আর এটা যে ভয়াবহ গুনাহের কাজ তা বলাই বাহুল্য।
* মহিলাদের সমকামিতায় (যা হারাম) শুক্রক্ষরণ ঘটলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। হাদীস শরীফে কামেচ্ছা চরিতার্থ থেকে বিরত থাকাকে রোযার অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ঐ সত্ত্বার কসম, যার হাতে আমার জান। রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহ তাআলার নিকট মেশকের চেয়েও বেশি প্রিয় (আল্লাহ তাআলা বলেন) রোযাদার আমার জন্য পানাহার করা থেকে এবং কামোচ্ছা চরিতার্থ করা থেকে বিরত থাকে।-সহীহ বুখারী ১/২৫৪
মাসআলা : রোযা অবস্থায় হায়েয বা নেফাস শুরু হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। পরে তা কাযা করতে হবে।
عن الحسن في المرأة أصبحت حائضا فطهرت بعد طلوع الفجر، قال : لا تأكل بقية يومها
যে হায়েযা মহিলা সুবহে সাদিকের পর পবিত্র হয়েছে তার সম্পর্কে হাসান বসরী রাহ. বলেন, সে অবশিষ্ট দিন আহার করা থেকে বিরত থাকবে। (অর্থাৎ রোযার মর্যাদা রক্ষার্থে সাদৃশ্য অবলম্বন করবে)।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, হাদীস : ৯৪৩২
عن إبرايهم : في الحائض تطهر فلا تأكل شيئا ـ كراهة أن تشبه المشركين إلى الليل
ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.ও বলেছেন, সে আহার করা থেকে বিরত থাকবে যাতে (রমযানের দিবসে পানাহারের কারণে) অমুসলিমদের সাথে সাদৃশ্য সৃষ্টি না হয়।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, হাদীস : ৯৪৩৪
মাসআলা : মাথার এমন যখমে ওষুধ লাগালে রোযা ভেঙ্গে যাবে, যা দিয়ে ওষুধ মস্তিষ্কে চলে যায়। বিশেষ প্রয়োজনে এমন স্থানে ওষুধ লাগাতে হলে পরে সে রোযা কাযা করে নিতে হবে।
* পেটের এমন ক্ষতে ওষুধ লাগালে রোযা ভেঙ্গে যাবে, যা দিয়ে ওষুধ পেটের ভেতর চলে যায়। বিশেষ প্রয়োজনে এমন ক্ষতে ওষুধ লাগালে পরে সে রোযার কাযা করে নিতে হবে।
* নাকে ওষুধ বা পানি দিলে তা যদি খাদ্যনালিতে চলে যায় তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা করতে হবে।
* গুহ্যদেশের ভেতর ওষুধ বা পানি ইত্যাদি গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত,
ذكر عنده الوضوء من الطعام، قال الأعمش مرة والحجامة للصائم فقال إنما الوضوء مما يخرج وليس مما يدخل، وإنما الفطر مما دخل وليس مما خرج.
শরীর থেকে (কোনো কিছু) বের হলে অযু করতে হয়, প্রবেশ করলে নয়। পক্ষান্তরে রোযা এর উল্টো। রোযার ক্ষেত্রে (কোনো কিছু শরীরে) প্রবেশ করলে রোযা ভেঙ্গে যায়, বের হলে নয় (তবে বীর্যপাতের প্রসঙ্গটি ভিন্ন)।-সুনানে কুবরা, বায়হাকী ৪/২৬১
মাসআলা : সুবহে সাদিকের পর সাহরীর সময় আছে ভেবে পানাহার বা স্ত্রীসঙ্গম করলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। তেমনি ইফতারির সময় হয়ে গেছে ভেবে সূর্যাস্তের পূর্বে ইফতার করে নিলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে।
মাসআলা : রোযার কথা ভুলে গিয়ে পানাহার করল অতঃপর রোযা নষ্ট হয়ে গেছে ভেবে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করল তাহলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে এবং কাযা করা জরুরি হবে।
* বমি হওয়ার কারণে রোযা নষ্ট হয়ে গেছে মনে করে রোযা ভেঙ্গে ফেললে কাযা করতে হবে। আউন রাহ. থেকে বর্ণিত, মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন রাত্র বাকি আছে ভেবে সাহরী খেলেন। তারপর জানতে পারলেন, তিনি সুবহে সাদিকের পর সাহরী করেছেন তখন তিনি বললেন, ‘আমি আজ রোযাদার নই।’ (অর্থাৎ আমাকে এ রোযার কাযা করতে হবে)।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/১৪৯
আলী ইবনে হানযালা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি রোযার মাসে ওমর রা.-এর নিকট ছিলেন। তার নিকট পানীয় পেশ করা হল। উপস্থিতদের কেউ কেউ সূর্য ডুবে গেছে ভেবে তা পান করে ফেলল। এরপর মুয়াযযিন আওয়াজ দিল, হে আমীরুল মুমিনীন! সূর্য এখনো ডুবেনি। তখন ওমর রা. বললেন, ‘যারা ইফতারি করে ফেলেছে তারা একটি রোযা কাযা করবে। আর যারা ইফতারি করেনি তারা সূর্যাস্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/১৫০
যেসব কারণে রোযা ভাঙ্গে না
এমন কিছু কাজ আছে, যার দ্বারা রোযার কোনো ক্ষতি হয় না। অথচ অনেকে এগুলোকে রোযাভঙ্গের কারণ মনে করে। ফলে এমন কোনো কাজ হয়ে গেলে রোযা ভেঙ্গে গেছে মনে করে ইচ্ছাকৃত পানাহার করে। পক্ষান্তরে কেউ কেউ এসব কাজ পরিহার করতে গিয়ে অনাবশ্যক কষ্ট ভোগ করে। সুতরাং এসব বিষয়েও সকল রোযাদার অবগত হওয়া জরুরি।
মাসআলা : কোনো রোযাদার রোযার কথা ভুলে গিয়ে পানাহার করলে তার রোযা নষ্ট হবে না। তবে রোযা স্মরণ হওয়ামাত্রই পানাহার ছেড়ে দিতে হবে। হাদীস শরীফে এসেছে-
من نسي وهو صائم فأكل أو شرب فليتم صومه، فإنما أطعمه الله وسقاه
যে ব্যক্তি ভুলে আহার করল বা পান করল সে যেন তার রোযা পূর্ণ করে। কারণ আল্লাহই তাকে পানাহার করিয়েছেন।-সহীহ মুসলিম ১/২০২
মাসআলা : চোখে ওষুধ-সুরমা ইত্যাদি লাগালে রোযার কোনো ক্ষতি হয় না। হযরত আনাস রা. রোযা অবস্থায় সুরমা ব্যবহার করতেন।-সুনানে আবু দাউদ ১/৩২৩
মাসআলা : রাত্রে স্ত্রীসহবাস করলে বা স্বপ্নদোষ হলে সুবহে সাদিকের আগে গোসল করতে না পারলেও রোযার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে কোনো ওযর ছাড়া, বিশেষত রোযার হালতে দীর্ঘ সময় অপবিত্র থাকা অনুচিত। হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, কখনো কখনো গোসল ফরয অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সকাল হত। অতঃপর তিনি গোসল করে রোযা পূর্ণ করতেন।
মাসআলা : বীর্যপাত ঘটা বা সহবাসে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে স্ত্রীকে চুমু খাওয়া জায়েয। এতে রোযার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে তরুণদের যেহেতু এ আশঙ্কা থাকে তাই তাদের বেঁচে থাকা উচিত। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটে ছিলাম। ইতিমধ্যে একজন যুবক এল এবং প্রশ্ন করল, আল্লাহর রাসূল! আমি কি রোযা অবস্থায় চুম্বন করতে পারি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না। এরপর এক বৃদ্ধ এল এবং একই প্রশ্ন করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হাঁ। আমরা তখন অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি জানি, তোমরা কেন একে অপরের দিকে তাকাচ্ছ। শোন, বৃদ্ধ ব্যক্তি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।-মুসনাদে আহমদ ২/১৮০, ২৫০
হযরত আবু মিজলায রাহ. বলেন, ইবনে আব্বাস রা.-এর নিকট এক বৃদ্ধ রোযা অবস্থায় চুমু খাওয়ার মাসআলা জিজ্ঞাসা করল। তিনি তাকে অনুমতি দিলেন। অতঃপর এক যুবক এসে একই মাসআলা জিজ্ঞাসা করলে তিনি তাকে নিষেধ করলেন।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/১৮৫
মাসআলা : অনিচ্ছাকৃত বমি হলে (এমনকি মুখ ভরে হলেও) রোযা ভাঙ্গবে না। তেমনি বমি মুখে এসে নিজে নিজেই ভেতরে চলে গেলেও রোযা ভাঙ্গবে না।
من ذرعه القيء فليس عليه قضاء. رواه الترمذي وقال : حديث حسن
অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো ব্যক্তির বমি হলে তার রোযা কাযা করতে হবে না।-জামে তিরমিযী ১/১৫৩, হাদীস : ৭২০
মাসআলা : শরীর বা মাথায় তেল ব্যবহার করলে রোযা ভাঙ্গবে না। হযরত কাতাদাহ রা. বলেন, ‘রোযাদারের তেল ব্যবহার করা উচিত, যাতে রোযার কারণে সৃষ্ট ফ্যাকাশে বর্ণ দূর হয়ে যায়।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/৩১৩
মাসআলা : শুধু যৌন চিন্তার কারণে বীর্যপাত হলে রোযা ভাঙ্গবে না। তবে এ কথা বলাই বাহুল্য যে, সব ধরনের কুচিন্তা তো এমনিতেই গুনাহ আর রোযার হালতে তো তা আরো বড় অপরাধ।
* কামভাবের সাথে কোনো মহিলার দিকে তাকানোর ফলে কোনো ক্রিয়া-কর্ম ছাড়াই বীর্যপাত হলে রোযা ভাঙ্গবে না। তবে রোযা অবস্থায় স্ত্রীর দিকেও এমন দৃষ্টি দেওয়া অনুচিত। আর অপাত্রে কু-দৃষ্টি তো কবীরা গুনাহ। যা রোযা অবস্থায় আরো ভয়াবহ। এতে রোযাদার রোযার ফযীলত ও বরকত থেকে মাহরূম হয়ে যায়। হযরত জাবির ইবনে যায়েদকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীর দিকে কামভাবের সাথে তাকিয়েছে। ফলে তার বীর্যপাত ঘটেছে তার রোযা কি ভেঙ্গে গেছে? তিনি বললেন, ‘না। সে রোযা পূর্ণ করবে।’-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬-২৫৯
আরো দেখুন : সহীহ বুখারী ১/২৫৮
মাসআলা : মশা-মাছি, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি অনিচ্ছাকৃত পেটের ভেতর ঢুকে গেলেও রোযা ভাঙ্গবে না।
* ধোঁয়া বা ধুলোবালি অনিচ্ছাকৃতভাবে গলা বা পেটের ভেতর ঢুকে গেলে রোযা ভাঙ্গবে না। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘কারো গলায় মাছি ঢুকে গেলে রোযা ভাঙ্গবে না।’-মুাসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/৩৪৯
মাসআলা : স্বপ্নদোষ হলে রোযা ভাঙ্গে না। হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ ভরে বমি হল। তিনি তখন বললেন-
ثلاث لا يفطرن الصائم : القيء والحجامة والحلم.
তিনটি বস্তু রোযাভঙ্গের কারণ নয় : বমি, শিঙ্গা লাগানো ও স্বপ্নদোষ।-সুনানে কুবরা বাইহাকী ৪/২৬৪
মাসআলা : চোখের দু’ এক ফোটা পানি মুখে চলে গেলে রোযার ক্ষতি হয় না। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘রোযা অবস্থায় সিরকা অথবা অন্য কোনো বস্তুর স্বাদ গ্রহণ করলে যদি তা গলার ভেতর না যায় তাহলে রোযা ভাঙ্গে না।’-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/২০২
মাসআলা : সুস্থ অবস্থায় রোযার নিয়ত করার পর যদি অজ্ঞান, অচেতন বা পাগল হয়ে যায় তাহলে রোযা নষ্ট হবে না। হযরত নাফে রাহ. বলেন, হযরত ইবনে ওমর রা. নফল রোযা অবস্থায় বেহুশ হয়ে যেতেন কিন্তু এ কারণে রোযা ভেঙ্গে ফেলতেন না।-সুনানে কুবরা বাইহাকী ৪/২৩৫
যাদের জন্য রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে
يا ايها الذين آمنوا كتب عليكم الصيام كما كتب على الذين من قبلكم لعلكم تتقون. اياما معدودت، فمن كان منكم مريضا او على سفر فعدة من ايام اخر وعلى الذين يطيقونه فدية طعام مسكين، فمن تطوع خيرا فهو خير له، وان تصوموا خير لكم ان كنتم تعلمون. شهر رمضان الذى انزل في القرآن هدى للناس وبينت من الهدى والفرقان، فمن شهد منكم الشهر فليصمه، ومن كان مريضا او على سفر فعدة من ايام اخر يريد الله بكم اليسر ولا يريد بكم العسر، ولتكملوا العدة ولتكبروا الله على ما هدكم ولعلكم تشكرون.
(তরজমা) হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের প্রতি ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমাদের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টি হয়। গণা-গুনতি কয়েক দিন রোযা রাখতে হবে। তারপরও যদি তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে, তবে অন্য সময়ে সে সমান সংখ্যা পূরণ করবে। যারা এর শক্তি রাখে তারা একজন মিসকীনকে খাবার খাইয়ে (রোযার) ফিদয়া আদায় করতে পারবে। এছাড়া কেউ যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো পুণ্যের কাজ করে, তবে তার পক্ষে তা শ্রেয়। আর তোমাদের যদি সমঝ থাকে, তবে রোযা রাখাই তোমাদের জন্য বেশি ভালো। রমযান মাস-যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা আদ্যোপান্ত হিদায়াত এবং এমন সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি সম্বলিত, যা সঠিক পথ দেখায় এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেয়। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এ মাস পাবে সে যেন এ সময় অবশ্যই রোযা রাখে। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে, তবে অন্য সময় সে সমান সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ সেটাই করতে চান। তোমাদের জন্য জটিলতা সৃষ্টি করতে চান না, যাতে তোমরা রোযার সংখ্যা পূরণ করে নাও এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যে পথ দেখিয়েছেন, সেজন্য আল্লাহর তাকবীর পাঠ কর এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।-সূরা বাকারা : ১৮৩-১৮৫
১. মুসাফির
মাসআলা : মুসাফিরের জন্য সফরের হালতে রোযা না রাখার সুযোগ রয়েছে। তবে অস্বাভাবিক কষ্ট না হলে রোযা রাখাই উত্তম। আর অস্বাভাবিক কষ্ট হলে রোযা রাখা মাকরূহ। এ অবস্থায় রোযা না রেখে পরে তা কাযা করে নিবে। আছিম রাহ. বলেন, হযরত আনাস রা.কে সফরকালে রোযা রাখার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, ‘যে রোযা রাখবে না সে অবকাশ গ্রহণ করল। আর যে রোযা রাখল সে উত্তম কাজ করল।’-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/১৩২
মাসআলা : সফরের হালতে নিয়ত করে রোযা রাখা শুরু করলে তা আর ভাঙ্গা জায়েয নয়। কেউ ভেঙ্গে ফেললে গুনাহগার হবে। তবে কাফফারা আসবে না। শুধু কাযাই যথেষ্ট। হযরত আনাস রা. বলেন, ‘কেউ রোযা রেখে সফরে বের হলে রোযা ভাঙ্গবে না। তবে যদি পিপাসার কারণে প্রাণের আশঙ্কা হয় তাহলে রোযা ভাঙ্গতে পারবে, পরে তা কাযা করবে।
মাসআলা : মুসাফির সফরের কারণে রোযা রাখেনি, কিন্তু দিন শেষ হওয়ার আগেই মুকীম হয়ে গেল। তাহলে দিনের অবশিষ্ট সময় রমযানের মর্যাদা রক্ষার্থে পানাহার থেকে বিরত থাকবে। তবে পরবর্তী সময়ে এ রোযার কাযা অবশ্যই করতে হবে। ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন, যে মুসাফির রমযানের দিনে (সফরের হালতে) খানা খেয়েছে সে মুকীম হয়ে গেলে দিনের বাকি অংশ পানাহার থেকে বিরত থাকবে।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/২২১
মাসআলা : রমযানের দিনে হায়েয-নেফাস থেকে পবিত্র হলে অবশিষ্ট দিন রমযানের মর্যাদা রক্ষার্থে পানাহার থেকে বিরত থাকা জরুরি। তবে উক্ত ওযরে ছুটে যাওয়া রোযাগুলোর সাথে এ দিনের রোযাও কাযা করবে। হযরত হাসান রা. বলেন, ‘সোবহে সাদিকের পর যে হায়েয থেকে পবিত্র হয়েছে সে দিনে বাকি অংশে পানাহার করবে না।’ (প্রাগুক্ত)
২. অসুস' ব্যক্তি
মাসআলা : রোযার কারণে যে রোগ বৃদ্ধি পায় বা রোগ-ভোগ দীর্ঘ হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে সে রোগে রোযা ভাঙ্গার অবকাশ আছে। উল্লেখ্য, আশঙ্কা যদি সুস্পষ্ট হয় তাহলে তো কথা নেই। নতুবা একজন অভিজ্ঞ ও দ্বীনদার চিকিৎসকের মতামতের প্রয়োজন হবে।
৩. গর্ভবতী
মাসআলা : রোযা রাখার কারণে গর্ভবতী মহিলা নিজের বা তার সন্তানের প্রাণহানী বা মারাত্মক স্বাস্থ্যহানীর প্রবল আশঙ্কা হলে তার জন্য রোযা না রাখা বা ভাঙ্গা জায়েয। তবে পরে কাযা করে নিবে।
৪. দুগ্ধদানকারিনী
মাসআলা : রোযার কারণে সন্তান দুধ না পেয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারে এমন আশঙ্কা হলে দুগ্ধদানকারীনীও আপাতত রোযা ভাঙ্গতে পারবে এবং পরে কাযা করে নিবে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
إن الله وضع عن المسافر الصوم وشطر الصلاة وعن الحامل والمرض. رواه الترمذي وقال : هذا حديث حسن.
আল্লাহ তাআলা মুসাফিরের জন্য রোযার হুকুম শিথিল করেছেন এবং নামায কমিয়ে দিয়েছেন। আর গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিনীর জন্যও রোযার হুকুম শিথিল করেছেন।-জামে তিরমিযী ১/১৫২
৫. দুর্বল বৃদ্ধ ব্যক্তি
মাসআলা : যে বৃদ্ধ বা অসুস্থ ব্যক্তির রোযা রাখার সামর্থ্য নেই এবং পরবর্তীতে কাযা করতে পারবে এমন সম্ভাবনাও নেই এমন ব্যক্তি রোযার পরিবর্তে ফিদয়া প্রদান করবে।-সূরা বাকারা : ১৮৪
বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত ছাবেত বুনানী রাহ. বলেন, হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. যখন বার্ধক্যের কারণে রোযা রাখতে সক্ষম ছিলেন না তখন তিনি রোযা না রেখে (ফিদইয়া) খাবার দান করতেন।-মুসান্নাফ আবদুর রাযযযাক হাদীস : ৭৫৭০
উক্ত মাসআলা হযরত ইবনে আব্বাস রা., উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা., আতা রাহ., সায়ীদ ইবনে যুবাইর রাহ., হাসান বসরী রাহ., মুজাহিদ রাহ., সায়ীদ ইবনে মুসাইয়াব রাহ. থেকে বর্ণিত আছে।-মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/২২০-২২৪
ইকরামা রাহ. বলেন, ‘‘আমার মা প্রচণ্ড তৃষ্ণা-রোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং রোযা রাখতে সক্ষম ছিলেন না। তাঁর সম্পর্কে আমি তাউস রাহ.কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, ‘প্রতি দিনের পরিবর্তে মিসকীনকে এক মুদ (আধুনিক হিসাবে ১ কেজি ৬৩৬ গ্রাম) পরিমাণ গম প্রদান করবে’।’’-আবদুর রাযযাক হাদীস : ৭৫৮১
মাসআলা : যাদের জন্য রোযার পরিবর্তে ফিদইয়া দেওয়ার অনুমতি রয়েছে তারা রমযানের শুরুতেই পুরো মাসের ফিদইয়া দিয়ে দিতে পারবে।-আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৭
মাসআলা : উপরোক্ত দুই শ্রেণীর মানুষ ছাড়া (অর্থাৎ দুর্বল বৃদ্ধ ও এমন অসুস্থ ব্যক্তি যার ভবিষ্যতে রোযার শক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।) আরো যাদের জন্যে রোযা ভাঙ্গা জায়েয আছে, যেমন-মুসাফির, গর্ভবতী ও শিশুকে স্তন্যদানকারিনী) তারা রোযা না রাখলে রোযার ফিদইয়া দিবে না; বরং পরে কাযা করবে। আর ওযরের হালতে মৃত্যুবরণ করলে কাযা ও ফিদয়া প্রদানের অসিয়ত উভয় দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি পাবে। অবশ্য ওযরের হালত শেষ হওয়ার পর, অর্থাৎ মুসাফির মুকীম হওয়ার পর, গর্ভবতী নারীর সন্তান ভূমিষ্ট হওয়া ও স্রাব বন্ধ হওয়ার পর এবং স্তন্যদানকারিনী স্তন্যদান বন্ধ করার পর যদি মৃত্যুবরণ করে তাহলে ওযর শেষে যে কয়দিন সময় পেয়েছে সে কয়দিনের কাযা যিম্মায় আসবে। কাযা না করলে উক্ত দিনগুলির ফিদয়া প্রদানের অসিয়ত করে যেতে হবে।-আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৩-৪২৪; কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মাদীনাহ ১/২৫৫
মাসআলা : ছুটে যাওয়া রোযার কাযা সম্ভব না হলে মৃত্যুর পূর্বে ফিদয়া দেওয়ার অসিয়ত করে যাওয়া জরুরি। অসিয়ত না করে গেলে ওয়ারিশরা যদি মৃতের পক্ষ থেকে ফিদয়া দেয় তবে আশা করা যায় যে, আল্লাহ তাআলা তা কবুল করবেন। তবে অসিয়ত না করা অবস্থায় মিরাসের সম্পদ থেকে ফিদয়া দিতে হলে সকল ওয়ারিস বালেগ হওয়া জরুরি এবং সকলের স্বতঃস্ফূর্ত অনুমতি জরুরি। তবে মিরাস বণ্টনের পর কেউ স্বেচ্ছায় নিজের অংশ থেকে ফিদয়া আদায় করতে চাইলে কোনো অসুবিধা নেই।
রোযা মাকরূহ হওয়ার কারণসমূহ
মাসআলা : কুলি করার সময় গড়গড়া করা এবং নাকে পানি দেওয়ার সময় উপরের দিকে পানি পৌঁছানো মাকরূহ। হযরত লাকিত ইবনে সবিরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
بالغ في الاستنشاق إلا أن تكون صائما
‘নাকে পানি দেওয়ার সময় ভালোভাবে নাকে পানি দাও, তবে রোযাদার হলে নয়।-জামে তিরমিযী হাদীস: ৭৬৬; সুনানে আবু দাউদ ১/৩২২; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ৯৮৪৪
মাসআলা : এমন কাজ করা মাকরূহ, যার দ্বারা রোযাদার নিতান্তই দুর্বল হয়ে পড়ে। যেমন শিঙ্গা লাগানো। মাসআলা : রোযা অবস্থায় শরীর থেকে রক্ত বের হলে বা ইনজেকশন ইত্যাদি দ্বারা রক্ত বের করলে রোযা ভাঙ্গবে না। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে এ পরিমাণ রক্ত বের করা মাকরূহ, যার দ্বারা রোযাদার খুব দুর্বল হয়ে যায়। সাবেত আলবুনানী রাহ. বলেন, হযরত আনাস রা. কে জিজ্ঞাসা করা হল রোযার হালতে শিঙ্গা লাগানোকে কি আপনারা মাকরূহ মনে করতেন? তিনি বলেন, ‘না। তবে এ কারণে দুর্বল হয়ে পড়লে তা মাকরূহ হবে।’-সহীহ বুখারী হাদীস ১৯৪০
মাসআলা : রোযার হালতে গীবত করলে, গালি-গালাজ করলে, টিভি-সিনেমা ইত্যাদি দেখলে, গান-বাদ্য শ্রবণ করলে এবং যে কোনো বড় ধরনের গুনাহে লিপ্ত হলে রোযা মাকরূহ হয়ে যায়। আর এ কাজগুলো যে সর্বাবস্থায় হারাম তা তো বলাই বাহুল্য। একটি হাদীসে কুদসীতে আছে, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
اذا كان يوم صوم احدكم فلا يرفث ولا يصخب
‘তোমাদের কেউ যখন রোযা রাখে তখন সে যেন অশালীন কথাবার্তা না বলে ও হৈ চৈ না করে।-সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯০৪;
সুনানে আবু দাউদের রেওয়ায়েতে এ শব্দ রয়েছে, ‘রোযাদার যেন কোনো অন্যায়-অপরাধে লিপ্ত না হয়।’ হাদীস : ৩৩৬৩ (১/৩২২)
হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা-প্রতারণা ও গুনাহর কাজ ত্যাগ করে না আললাহ তাআলার নিকট তার পানাহার থেকে বিরত থাকার কোনো মূল্য নেই।’-বুখারী, হাদীস ১৯০৩; সুনানে আবু দাউদ হাদীস : ৩৩৬২ (১/৩২২)
যেসব কাজ রোযাদারের জন্য মাকরূহ নয়
মাসআলা : রোযার হালতে প্রয়োজনে জিহ্বা দ্বারা কোনো কিছুর স্বাদ নেওয়া বা প্রয়োজনে বাচ্চাদের জন্য খাদ্য চিবানো মাকরূহ নয়। তবে সতর্ক থাকতে হবে, যেন স্বাদ গলার ভেতরে চলে না যায়। রোযাদার মহিলা তার বাচ্চার জন্য খাদ্য চিবানোকে ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. দোষের বিষয় মনে করতেন না।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/২০৭
মাসআলা : রোযাদারের জন্য সুরমা লাগানো বা সুগন্ধি ব্যবহার করা মাকরূহ নয়। আতা রাহ. বলেন, ‘রোযাদারের জন্য সুরমা ব্যবহার করাতে দোষ নেই।’-প্রাগুক্ত ৪/২০৮
মাসআলা : রোযা অবস্থায় টুথ পাউডার ইত্যাদি ছাড়া শুধু মিসওয়াক ব্যবহার করা মাকরূহ নয়। এতে রোযার কোনো ক্ষতি হয় না; বরং অন্য সময়ের মতো রোযার হালতেও মিসওয়াক করা সুন্নত। হযরত আমির ইবনে রবীয়া রা. বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি রোযার হালতে অসংখ্যবার মিসওয়াক করতে দেখেছি।-সহীহ বুখারী ১/২৫৯; আবদুর রাযযাক ৪/২০০
মাসআলা : রোযা অবস্থায় বিকেলে এমনকি ইফতারের পূর্বেও মিসওয়াক করা মাকরূহ নয়। বরং অন্য সময়ের মতোই সুন্নত। হাসান রাহ.কে রোযা অবস্থায় দিনের শেষে মিসওয়াক করার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘রোযা অবস্থায় দিনের শেষে মিসওয়াক করতে কোনো অসুবিধা নেই। মিসওয়াক পবিত্রতার মাধ্যম। অতএব দিনের শুরুতে এবং শেষেও মিসওয়াক করো।’-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/২০২
ইবরাহীম রাহ. বলেন, ‘রোযা অবস্থায় দিনের শুরু ও শেষে মিসওয়াক করতে কোনো অসুবিধা নেই।’-প্রাগুক্ত ৪/২০৩
মাসআলা : গাছের কাঁচা ডাল দ্বারা বা পানিতে ভেজানো ডাল দ্বারা মিসওয়াক করা মাকরূহ নয়; বরং জায়েয। উরওয়া রাহ. রোযা অবস্থায় তাজা মিসওয়াক ব্যবহার করে মিসওয়াকের সুন্নত আদায় করতেন।-প্রাগুক্ত ৪/২০২
মুজাহিদ রাহ. রোযা অবস্থায় তাজা মিসওয়াক ব্যবহার করাকে দোষের মনে করতেন না।
সুফিয়ান সাওরী রাহ. থেকেও অনুরূপ মত বর্ণিত আছে।-প্রাগুক্ত ৪/২০২
[প্রবন্ধটি তৈরি করেছেন : মারকাযুদ দাওয়াহর আততাখাসসুস ফিলফিকহি ওয়াল ইফতা তৃতীয় বর্ষের তালিবুল ইলমগণ।]