সফর ১৪২৯   ||   ফেব্রুয়ারি ২০০৮

মেরী ইলমী আওর মুতালাআতী যিন্দেগী

মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান নদভী রহ.

আমাদের খান্দানে একদা বসন্ত ছিল। এ খান্দানের পূর্বপুরুষরা হেমন্তকালেও জগৎবাসীকে বসন্তের পয়গাম শুনিয়েছিলেন। ঋতুর পালা বদলে যখন বসন্ত বিদায় নিল তখন এ খান্দানেও এল শুষ্কতা ও খরতাপ। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই নওজওয়ানদের চেয়ে বৃদ্ধদের এবং পুরুষের চেয়ে নারীদেরকেই দ্বীনদারিতে অগ্রসর দেখেছি।

ওয়ালিদ ছাহেব মাওলানা হাকীম সাইয়েদ আব্দুল হাই ১৯২৩ খৃস্টাব্দের প্রথম দিকে ইন্তেকাল করেন। আমার বয়স ছিল তখন দশ বছর। বড় ভাই ড. হাকীম মৌলভী সাইয়েদ আব্দুল আলী ছাহেব লখনৌতে মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত আর আমি আম্মার কাছে রায়বেরেলীতে। ভাইজানের নির্দেশনা মোতাবেক বড়দের কাছে ফার্সী কিতাবাদি পড়ি এবং ভাইজানের কাছে লখনৌতে আসা-যাওয়া করি।

আমাদের খান্দানের দস্ত্তর ছিল, প্রায় প্রত্যহ, বিশেষত যখন কোনো বিপদাপদের কারণে সান্ত্বনার আশ্রয় প্রয়োজন হত তখন মা-খালারা কোনো ঘরে এসে জড়ো হতেন এবং খান্দানের এক বুযুর্গ সাইয়েদ আব্দুর রাযযাক কালামী (মৃত ১৩৩৪ হিজরী/১৯১৬ঈ.) কৃত ফুতূহুশ শাম-এর কাব্যানুবাদ পাঠ করতেন।

সাইয়েদ আব্দুর রাযযাক কালামী মরহুম ছিলেন হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ রহ.-এর ভাগিনা, মুনশী সাইয়েদ হামীদুদ্দীন সাহেবের পৌত্র এবং তাঁর সহোদর সাইয়েদ আব্দুর রহমান সাহেবের দৌহিত্র। ওয়াকিদী কৃত ফুতূহুশ শাম গ্রন্থটি কালামী সাহেব পঁচিশ হাজার পংক্তিতে কাব্যানুবাদ করেছিলেন। গ্রন্থের বিষয়বস্ত্তর সঙ্গে ছিল তার স্বভাবজাত আকর্ষণ। আর জিহাদী জযবা ও ঈমানী জোশ ছিল ওই সীনার উত্তরাধিকার, যা একসময় গোটা হিন্দুস্তানে তাপ বিতরণ করেছিল। তাই তাঁর পংক্তিগুলোতে ছিল জোশ ও জযবার স্বতঃস্ফূর্ততা আর ভাষা ও কাব্যের প্রাঞ্জলতা। হযরত খালিদ ইবনুল ওলীদ রা.-এর সাথে তাঁর হৃদয়ের বন্ধন ছিল। বহুবার স্বপ্নে তাঁর জিয়ারত হয়েছে। এজন্য তাঁর প্রসঙ্গ এলে তিনি আবেগাপ্লুত হতেন এবং তাঁর পংক্তিগুলোতে ছড়িয়ে যেত নতুন প্রাণময়তা।

আমার বড় খালা সাইয়েদা ছালেহা মরহুমা হাফেজা ছিলেন। তিনি এই কাব্য-গ্রন্থ পাঠ করতেন অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ও মনভেজানো স্বরে আর বারবার পড়ার কারণে পংক্তিগুলো তার আয়ত্বে এসে গিয়েছিল। সাধারণত আসরের পর এই মজলিস হত। পরিবারের শিশুরাও কখনো খেলতে খেলতে, কখনো বা কোনো খবর নিয়ে মায়েদের কাছে আসত আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কবিতা শুনত। কখনোবা মজলিসে শামিল হত। কখনো মায়েরা নিজেদের কাছে বসিয়ে কবিতা শোনার সুযোগ দিতেন। এরপর যখন ভালো লেগে যেত তখন তারা খেলাধুলা ছেড়েও এই মজলিসে শামিল হত।

খালাম্মা পংক্তিগুলো পাঠ করতেন সহজভাবে, কিন্তু তাতে থাকত দরদ ও প্রভাব। গোটা মজলিসে জিহাদের আবহ সৃষ্টি হত আর অন্তর ব্যাকুল হয়ে উঠত।

হযরত খালিদ ইবনুল ওলীদ, হযরত যিরার, হযরত খাওলা এবং অন্যান্য মুজাহিদীনের বাহাদুরী ও জানবাযীর দস্তান যখন পংক্তির পর পংক্তিতে উন্মোচিত হত তখন সেই ক্ষুদ্র মজলিসে বয়ে যেত আনন্দ ও উদ্দীপনার লহরী। আবার যখন রণাঙ্গনে কোন মুসলিম বাহিনী অবরুদ্ধ হয়ে পড়ত কিংবা কোনো বীর মুজাহিদ শহীদ হয়ে যেতেন তখন মাহফিল পরিণত হত অশ্রুর মাহফিলে। সেই অশ্রু-ঝড়ে বর্ষার ছাঁট এসে আমাদের শিশু-হৃদয়ের নরম ভূমিকে সিক্ত করে দিত। ফুতূহুশ শাম-এর ওই যিন্দা মাহফিলগুলো এই প্রভাব সৃষ্টি করেছিল যে, এরপর যত নতুন গবেষণা আর ইসলামী জিহাদকে কেবল দিফাহী বা প্রতিরোধ যুদ্ধে সীমাবদ্ধ দেখানোর যত প্রয়াশ চোখে পড়েছে তাতে মুজাহিদ ফী সাবীলিল্লাহর মাহাত্ম্য ও মুহাববতে বিন্দুমাত্র চিড় ধরেনি। খোদার রাহে জীবন-দানের কীমত ও ফজীলত সম্পর্কেও কোনো বিভ্রান্তি সৃষ্ঠি হয়নি। বস্ত্তত রক্তের লাল হরফে যে বাণী লিখিত হয় আর শৈশবে যে অশ্রুজলে যা অভিষিক্ত হয় সে বাণী আরাম কেদারায় বসে কালো কালির আচর দিয়ে কখনো কেটে দেওয়া যায় না।

اتاني هواها قبل ان أعرف الهوى فصادف قلبا خاليا فتمكنا

দ্বিতীয় প্রভাব এই হয়েছিল যে, তাকদীরের লিখনে যে কওম ও মাযহাব কেয়ামত পর্যন্ত ইসলামের প্রতিপক্ষ বলে সাব্যস্ত হয়েছে আর যাদের প্রতিনিধিত্বের ক্রুশ ভাগ্য-বিধাতা বর্তমান ইউরোপের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন তাদের সম্পর্কে সৃষ্টি হয়েছিল প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব। পরবর্তী জীবনে কোনো ভূখন্ডের স্থানীয় সমস্যা ও সুবিধার চিন্তা সে মনোভাবকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়নি।

সে সময় অভিজাত ঘরানাগুলোতে মুসাদ্দাসে হালী ব্যাপকভাবে পঠিত হত। এর পংক্তিগুলো তখন অনেকেরই কণ্ঠস্থ ছিল। ওয়াজ ও বক্তৃতা-মাহফিলে তা পাঠ করা হত, প্রবন্ধে-নিবন্ধে উদ্ধৃত হত। আমি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে এ গ্রন্থ অনেকবার পাঠ করেছি। আর সে সময়ের বক্তৃতা-প্রশিক্ষণ মজলিসগুলোতে এবং রচনা প্রতিযোগিতার প্রবন্ধগুলোতে বারবার উদ্ধৃত করেছি। এর একটি বড় অংশ আমার মুখস্থ ছিল।  দিল-দিমাগে এ গ্রন্থ গভীর ছাপ এঁকে দিয়েছিল। এটা গ্রন্থেরই বিশেষ অনুগ্রহ যে, পশ্চিমা গবেষকদের ওই সব রচনা-গবেষণা মন-মানসে কোনো অশুভ প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে যেগুলোতে তারা জাহেলিয়াতের গুণকীর্তন করে থাকে। সুনীতির কোনো কণিকাও যদি কোথাও পতিত থাকে, যা যেকোন অধঃপতিত জাতির মধ্যে খুঁজলে পাওয়া যায় তবে তারা তাকে এমন পর্বত-প্রমাণ করে উপস্থিত করে, যেন সে জাতির নৈতিক বিপ্লব সমাসন্ন ছিল। আর আগ্নেয়গিরি উৎক্ষিপ্ত হওয়ার আগ মুহূর্তে আগুনের একটি ফুলকি গিরিমুখে রেখে দেওয়া হয়েছিল! আরব জাতির জীবন ও চরিত্রে ইসলাম যে বিপ্লব সাধন করেছিল তার পেছনে কার্যকর আসমানী ইরাদা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুজিযানা অবদানের গুরুত্বকে খাটো করার এটা হল পশ্চিমা ষড়যন্ত্র। কিন্তু এই সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রও মাওলানা হালীর ওই সহজ-সরল ছোট ছোট পংক্তির মাটির বাঁধকে ভাসিয়ে নিতে পারেনি, যে পংক্তিগুলোতে মাওলানা অঙ্কন করেছেন জাহেলিয়াতের চিত্র আর তার নৈতিক অবক্ষয়ের চেহারা-ছবি। তদ্রুপ সেই সব গোত্র-পূজারী আরব লেখকের প্রবন্ধ-নিবন্ধও কোনো প্রভাব সৃষ্টি করেনি যারা জাতীয়তার নেশায় কখনো কখনো জাহেলিয়াতের পক্ষেও ওকালাতি করেন আর সে যুগের মাহাত্ম্য  প্রমাণে আতিশয্যের আশ্রয় গ্রহণ করেন।

আমাদের ঘরের পরিবেশে দ্বীনদারী ও সাহিত্যানুরাগ দুটোই ছিল। এর কারণ ছিলেন আমার দাদা মৌলভী সাইয়েদ ফখরুদ্দীন খেয়ালী ছাহেব এবং আমার ওয়ালিদ ছাহেব, যিনি বড় আলেম ও আরবী লেখক হওয়ার পাশাপাশি উর্দূ ভাষার সুসাহিত্যিক ও সাহিত্য-সমালোচক ছিলেন। একদম শৈশব থেকেই গদ্য ও পদ্য সাহিত্য আমাদের পড়াশোনার মধ্যে এসে যেত। মাওলানা হালী, ডেপুটি নাযীর আহমদ, রাশেদ খায়রীর অনেক রচনা আমি ওই বয়সে পড়ে ফেলেছিলাম। সে সময়ে উর্দূ সাহিত্যের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল মৌলভী ইসমাঈল মিরাঠী কৃত কামাকে উর্দূ সাওয়াদে উর্দূ এবং সাফীনায়ে উর্দূ। হিন্দুস্তানের শিক্ষাবোর্ড এরচেয়ে উত্তম গ্রন্থ আজও তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। সাফীনায়ে উর্দূর প্রভাব আজও দিল-দেমাগে অনুভব করি। প্রায় অর্ধশতাব্দী অতিবাহিত হওয়ার পর এবং চিন্তা ও রুচির অনেকগুলো মানযিল অতিক্রম করার পর আজও যদি সে কিতাব হাতে পাই (দুখঃজনকভাবে কিতাবটি দুর্লভ হয়ে গেছে) তবে মনে হয় সব কাজ ছেড়ে তাতেই মশগুল হয়ে পড়ব এবং কিছু সময়ের জন্য হলেও শৈশবে ফিরে যাবো। অন্তত যে কবিতা ও নিবন্ধগুলো ভালো লেগেছিল, মৌলভী যফর আলী খানের কবিতা রাজা দশরত কী কাহানী এবং হায়দ্রাবাদের তুফান সম্পর্কে তার কবিতা ও নামুরাদ নদী সাইয়েদ সাজ্জাদ হায়দার ইয়ালদারেম-এর নিবন্ধ মুয কো মেরে দোসতোঁ ছে বাঁচাও আবার একবার না পড়ে হাত থেকে কিতাব রাখা কঠিন হবে। এই অধ্যয়নের ফলে ভাষা ও সাহিত্যের রুচি ও মিষ্টতা জীবনের সকল পর্যায়ে সঙ্গ দিয়েছে এবং মৌলভীসুলভ শুষ্কতা সৃষ্টি হওয়া থেকে লেখালেখিকে রক্ষা করেছে। আমার মতে শৈশব-কৈশোরে বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষী লেখকদের রচনাবলী অধ্যয়ন করা অত্যন্ত ফলদায়ক ও একটা পর্যায় পর্যন্ত জরুরি। এটা না হলে নতুন প্রজন্ম ও নতুন যুগের সাথে সম্পর্ক অটুট থাকে না এবং দাওয়াত ও তালকীনের ক্ষেত্রে পুরোপুরি সফল হওয়া যায় না।

(চলবে, ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement