সফর ১৪২৯   ||   ফেব্রুয়ারি ২০০৮

ছোট বাচ্চাদের মারধর করা উচিত নয়

মুহাম্মাদ আবু ইউসুফ

ছোট বাচ্চাদের শাসনের জন্য মৌখিক রাগ ও তাম্বীহ যথেষ্ট। বেত ও লাঠি দ্বারা মারপিঠ করা ছাড়াও তাদের অন্যভাবে শাসন করা যায়, যেমন পাঠশালায় বা মক্তব মাদরাসায় কোনো বাচ্চা দুষ্টুমী করলে তার শাস্তি হতে পারে দাঁড় করিয়ে রাখা; সকল ছাত্রের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা একটি বিরাট মানসিক শাস্তি। ছাত্রদের যার যত বয়স কম তার লজ্জা, অপমানবোধ ও অভিমান তত বেশি হয়ে থাকে। ফলে সব রকম শাসনের জন্য উস্তাদগণের চোখ রাঙ্গানী, ধমক, তাম্বীহ এবং দাঁড় করিয়ে রাখাই যথেষ্ট।

রাগের সময় মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। এজন্য কর্তব্য হল রাগের সময় কোনো ছাত্রকে শাস্তি না দেওয়া, শাসন না করা। শুধু ছাত্রকে কেন, ঘরের বিবি-বাচ্চা, অধিনস্ত লোকজন ও চাকর নওকরকেও শাস্তি না দেওয়া, শাসন না করা। রাগের সময় শাস্তি দিতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত হাজারো ক্ষেত্রে এক বা একাধিক পক্ষের জীবন পর্যন্ত বিনষ্ট হতে দেখা গেছে। এজন্য আরবীতে মাশহুর মাকুলা রয়েছে, রাগের শুরু উন্মাদনা ও শেষ অনুশোচনা।

বিজ্ঞজনেরা বলেন, রাগের সময় যা করবে তাই ভুল হবে। সীমা অতিক্রম করে ফেলার পর অনুশোচনা করে লাভ কি? যা হবার তা তো হয়েই গেছে। অভিজ্ঞতার দ্বারা দেখা যায় সাধারণত যাদের বয়স যত কম তাদের রাগ তত বেশি হয়ে থাকে। এ জন্য যে উস্তাদগণের বয়স কম, বিশেষ করে ৪০ (চল্লিশ) বছরের কম তাদেরকে খুব সতর্ক থাকতে হবে। যাতে তারা মনে ও শরীরে রাগ আসার শুরুতেই নিজেকে শামলে নিতে পারেন। অর্থাৎ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকতে হবে যে, রাগের বশবর্তী হয়ে কোনো একটা ছাত্রকে বেত্রাঘাত বা মারধর করা যাবে না। রাগ শান্ত হলে ধীরভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে যে অপরাধ কতটুকু, কী পরিমাণ, তার শাস্তি কী হওয়া উচিত, যা কিনা মারধর ও বেত ছাড়াই ব্যবস্থা করতে হবে।

শুধু মক্তব মাদরাসায় কেন বরং ঘরেও ছোট বাচ্চাদের কোনক্রমেই মারধর করা উচিত নয়। এমনভাবে বাচ্চাদের তালিম-তরবিয়ত করতে হবে, যাতে তাদেরকে মারধর করাই না লাগে এবং তারা আদব-আখলাকের সাথে শুরু থেকেই গড়ে উঠতে পারে। অথচ প্রথমে খেয়াল করা হয় না। অবহেলা করা হয়। ঢিল দেওয়া হয়। যার করণে বাচ্চারা বেআদব হয়ে ওঠে। পরে মারধর করা শুরু হয়। যার ফল ক্রমে ক্রমে খারাপের দিকে যেতে থাকে।

আলহামদুলিল্লাহ, ঢাকা ও দেশের অনেক ভাল ভাল মাদরাসায় এ ধরনের নিয়ম চালু রয়েছে। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেন আমরা ভুলে না যাই। সেটা হল, যে বাচ্চারা দ্বীনি ইলম অর্জনের জন্য মক্তব, মাদরাসায় পড়াশোনা করে তাদের বেশির ভাগ ছাত্র পিতামাতা, ভাই-বোন, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন সকলকে ছেড়ে একটু দূরের মাদরাসার ছাত্রাবাসে থাকতে হয়। ইলমে দ্বীন হাসিল করার এটা একটা বুনিয়াদী উসুল বা নিয়ম যে ঘরে বসে সাধারণত ইলমে দ্বীন হাসিল করা যায় না। অবশ্য ঘরের পরিবেশ যদি দ্বীন ও তরবিয়তের দিক থেকে মাদরাসার মতই হয় তাহলে সুফল আসা স্বাভাবিক। তবে এর দৃষ্টান্ত খুব বেশি নয়। যারা সন্তানদেরকে বাড়িতে রেখে বা বাড়ি-ঘরের কাছে রেখে ইলমে দ্বীন শিক্ষা দিতে চেষ্টা করছেন, তাদের প্রায় সকলেই ব্যর্থ মনোরথ হয়েছেন। যার ফলে বাধ্য হয়ে সন্তানদেরকে কম-বেশি দূরের মাদরাসায় রাখা লাগে। অনেক সময় কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ নয়, বরং একাধারে কয়েক মাস পর্যন্ত সন্তানদেরকে বাড়ি-ঘর থেকে, পিতা-মাতা থেকে দূরে থাকতে হয়। আপনজন ছেড়ে থাকাটাই ছোট বাচ্চাদের জন্য এক কঠিন ব্যাপার, তা ছাড়া বয়স যত অল্প থাকে এ কঠিনতা তত প্রকট হয়ে থাকে। যত ভাল মাদরাসাই হোক না কেন সেখানকার থাকা-খাওয়া কখনো বাড়ির থাকা-খাওয়ার মত হওয়া সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে যারা স্কুল-কলেজে জাগতিক বিদ্যাশিক্ষা করে তাদেরকে মাদরাসার ছাত্রদের ন্যায় কচি বয়সে সবকিছু ছেড়ে থাকতে হয় না। তারা পিতা-মাতার কাছেই বেশি সময় থাকে এবং অল্প সময় পাঠশালায় থাকে, ফলে সকলকে ছেড়ে থাকার মনোবেদনা তাদের আদৌ পোহাতে হয় না।

পাঠশালাতে তাদের পাঠের সময়টুকুও মাদরাসার ছাত্রদের সময়ের তুলনায় অনেক কম। তারা অনেক দিক থেকে আরাম-আয়েশ ও আনন্দের মধ্যে থাকে, তদুপরি তাদেরকে বড় আদর যত্নের সাথে বিদ্যাশিক্ষা দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে যারা ইলমে দ্বীন শিক্ষার জন্য অতি কচি বয়সে মাতা-পিতা, প্রিয়জনের আদর-যত্ন সবকিছু ছেড়ে দূর-দূরান্তের মাদরাসায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস একাধারে পড়ে থাকে তাদের কচি দেহের উপর বেত্রাঘাত পড়া কীভাবে যুক্তিসঙ্গত হতে পারে? যেখানে বেত্রাঘাত মোটেই না হওয়ার কথা, আদর-যত্ন বেশি হওয়ার কথা, সেখানে ঢালাও বেতের প্রচলন থাকা কি উচিত?

 

 

advertisement