সফর ১৪২৯   ||   ফেব্রুয়ারি ২০০৮

ইসলামী ফৌজদারী আইন কি মধ্যযুগীয় বর্বর আইন?

ইসহাক ওবায়দী

প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস ফ্যাকাল্টির পূর্বপাশে হচ্ছে ঐতিহাসিক মধুর ক্যান্টিন, বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরী ও মসজিদ। তার উত্তর পাশে হচ্ছে আইবিএ ভবন। আর্টস ফ্যাকাল্টির পশ্চিম পাশ ঘেঁষে যে রাস্তাটি আন্তর্জাতিক হোস্টেল ও সূর্যসেন হলের দিকে এগিয়ে গেছে, তাতে সামান্য উত্তর দিকে গেলেই ডান পাশে ছিল নি.পা.র ট্রেনিং ক্যাম্প। সরকারি অফিসারদে জন্য পি.এস.সি বা বি.সি.এস কোর্সের যে ব্যবস্থা রয়েছে, তাতে বিভিন্ন বিষয়ে ট্রেনিং দেওয়ার জন্যই মনে হয় এই নি.পা.র অস্তিত্ব। একদিন পড়ন্ত বেলায় এখানে আপরাধ আইন শিরোনামে একটি সেমিনারের আয়োজন ছিল। পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন মিডিয়া থেকে সাংবাদিক বন্ধুরা যেমন এসেছেন, রেডিও বাংলাদেশ থেকেও আমাকে পাঠানো হয়েছে রেডিও নিউজরিলে সেমিনারটি কভারেজ দেওয়ার জন্য। সেমিনারের এক পর্যায়ে প্রধান অথিতির ভাষণ দিতে উঠলেন প্রধান সাংবাদিক অবজার্ভার সম্পাদক শ্রদ্ধেয় আবদুস সালাম সাহেব। তিনি তাঁর বক্তব্যে অপরাধ আইন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এক পর্যায়ে ইসলামী আইনে চোরের হাত কাটা ও ব্যাভিচারীর শাস্তি ১০০টি বেত্রাঘাত বা পাথর মেরে তাকে হত্যার যে বিধানের কথা রয়েছে, তা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তাকে মধ্যযুগীয় বর্বর আইন বলে উল্লেখ করেন। তাঁর মন্তব্য শোনামাত্র আমার মধ্যে দারুণ এক প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হয়ে যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমরা যারা সাংবাদিক গ্যালারিতে বসা ছিলাম, তারা তো আর সেমিনারের বক্তা ব্যক্তি নই যে, স্টেজে উঠে তার প্রতিবাদ করতে পারি। আমাদের কাজ শুধু বক্তাদের বক্তব্য, বিশেষ করে প্রধান অতিথিসহ নামী দামী ব্যক্তিদের বক্তব্যকে নিজ নিজ মিডিয়া থেকে প্রচার করা মাত্র। তাই কোন মতে রাগ হজম করে বসে থাকলাম। আল্লাহর কি মহিমা, প্রধান অথিতির ভাষণের পর সেমিনার কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হল, গ্যালারী থেকে কারো কোনো বক্তব্য থাকলে স্লিপ দিতে পারেন, তাকে সুযোগ দেওয়া হবে। এবার ভাবলাম আমরা তো কোনো সাধারণ গ্যালারী বা শ্রোতামন্ডলীর কেউ নই, স্লিপ দিয়ে কথা বলতে গেলে আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কোনো রকম সমস্যা করে কি না? এসব জল্পনা-কল্পনা করতে করতে এক সময় সাহস করে স্লিপ দিয়েই ফেললাম। মঞ্চে ডাকা হলে আমি সবিনয়ে প্রধান অতিথি শ্রদ্ধেয় আবদুস সালাম সাহেবের অনেক সাহসী পদক্ষেপ ও তাঁর কৃতিত্বের কথা প্রশংসার সাথে তুলে ধরলাম। তারপর বললাম, ইসলামী আইনে যে চোরের হাত কাটা বা হত্যার বদলে হত্যাকারীকে হত্যা করার কথা অথবা ব্যাভিচারের ব্যাপারে পাথর মেরে হত্যা করার মত বিধানের ব্যবস্থা রয়েছে এটাকে কিছুতেই বর্বর আইন বলা সমীচীন হবে না। কারণ ইসলাম এই সমস্ত কঠোর বিধানের মাধ্যমে ঐ সমস্ত অপরাধের মূলোৎপাটন করতেই বেশী আগ্রহী। উপরন্ত একজনের হত্যার মাধ্যমে শাস্তির বিধানে অনেক মানব সন্তানের জীবন রক্ষাই তার মূল উদ্দেশ্য। পবিত্র কোরআনে হত্যার বদলে হত্যার বিধান ঘোষণা করতে গিয়ে মহান আল্লাহ পাক একথাটাই স্পষ্ট করে বলেছেন। হত্যার বদলে হত্যার বিধানে রয়েছে জীবন রক্ষার বিধান হে জ্ঞানী ব্যক্তিরা।

একজন চোরের যদি হাত কেটে দেওয়া হয়, তাহলে হাত কাটা যাওয়ার ভয়ে চুরির অপরাধটাই সমাজ থেকে উঠে যাবে। একজনের হত্যার শাস্তি হত্যা হওয়ার কারণে হত্যা হওয়ার ভয়ে সমাজ থেকে হত্যার মত জঘন্য অপরাধ চিরতরে খতম হয়ে যেতে বাধ্য। আর এটা শুধু ইসলামের সোনালী যুগে হয়েছে তা নয়; বরং এখনো বর্তমান সৌদী আরবে ফৌজদারী আইনে এসব কোরআনী আইন অনেকটা কার্যকর থাকায় তার সুফল কী হয়েছে তা লক্ষ করুন। সেখানে একজন বিচারপতিকে প্রশ্ন করা হয়েছে যে, আপনার হাতে কোনো চোরের হাত কাটার বিধান বাস্তবায়ন হয়েছে কি না? তিনি উত্তরে বললেন, আমার ২২ বছরের চাকুরী জীবনে চুরির কোনো মামলাই আমার কোর্টে আসেনি।

তাহলে বোঝা যায়, হাত কাটার বিধানটি বলবৎ থাকায় চুরি করার অপরাধটা অনেক কমে গেছে। যার ফলে চুরির কেসই কোর্টে আসে না। তদ্রূপ একজনকে হত্যার বদলে হত্যার বিধানটি বলবৎ থাকলে, হত্যা হওয়ার ভয়েই খুন-খারাবী কমে যেতে বাধ্য। এমতাবস্থায় একজনকে শাস্তিস্বরূপ হত্যা করার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে শত শত মানব হত্যা তাতে বন্ধ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাজেই ইসলামের এসকল ফৌজদারী আইনকে মধ্যযুগীয় বর্বর আইন বলা কিছুতেই উচিত নয়। আমাদের শ্রদ্ধেয় আবদুস সালাম সাহেব তাঁর কথাটি প্রত্যাহার করলেই মনে হয় ভালো হয়।

আমি এসব বলে নেমে আসার পর আবদুস সালাম সাহেবকে দেখলাম, তিনি আবার মাইকের সামনে দাঁড়ালেন এবং সবিনয়ে তাঁর কথাটি তিনি প্রত্যাহার করে নিলেন। এ ঘটনা থেকে আমি অনুভব করলাম, আজকের বুদ্ধিজীবী ও প্রগতিশীলদের সাথে আমাদের হক্কানী আলেমদের দূরত্বের কারণে এবং আমাদের জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে ইসলামী শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকার ফলে আধুনিক শিক্ষিত সমাজের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা সৃষ্টি হতে পারছে না। ইসলামের সব যৌক্তিক বিধানগুলো যদি আমরা তাদের কাছে সুন্দরভাবে পেশ করতে পারতাম এবং তার সাথে যথাযথ ব্যাখ্যা প্রদানে যদি আমরা এগিয়ে আসতাম তাহলে মনে হয় এই দূরত্ব অনেকটা কমে আসত।

এসব বুদ্ধিজীবী ও প্রগতিশীলদের মধ্যে দুধরনের লোক রয়েছেন। কিছু আছেন, যাঁরা ইসলামী জ্ঞান চর্চা না করার কারণে এবং ইসলামকে সঠিকভাবে না জানার কারণে অথবা ইসলাম সম্পর্কে ষড়যন্ত্রকারীদের কাছ থেকে ভুল ব্যাখ্যা শোনার কারণে ইসলামের বিরোধিতা করে থাকেন। আর কিছু আছেন, যাঁরা জ্ঞানপাপী। তারা ইসলামের বিধানের সৌন্দর্য ও তার কল্যাণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন, এতে যে মানব সমাজের শুধু কল্যাণই নিহিত আছে তাও তারা ভালো করে জানেন। কিন্তু তারপরও বলগাহীনভাবে জীবন-যাপন সম্ভব নয় বলে এবং নিজের খায়েশ মোতাবেক চলতে না পারার ভয়ে মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তারা ইসলামী বিধানের বিরোধিতা করে থাকেন। ইসলামী বিধানের সৌন্দর্য ও কল্যাণ সম্পর্কে আমাদের ব্যাপক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পরও এই দ্বিতীয় প্রকারের জ্ঞানপাপীরা হয়তো পথে আসবে না। কিন্তু প্রথম প্রকারের বুদ্ধিজীবীরা অবশ্যই ইসলামকে জানা ও বোঝার কারণে ইসলামের সৌন্দর্যকে গ্রহণ করে নেবেন অনায়াসেই। আজ পৃথিবীর কোথাও নিরাপত্তা নেই। নেই কোথাও একটু নিরাপদ স্থান। দিনে-দুপুরে হাজার হাজার মানুষের মাঝে হাইজ্যাক-ছিনতাই ও রাহাজানী হরদম চলছে। সামান্য তুচ্ছ বিষয় নিয়েও একজন আরেকজনকে হত্যা করে ফেলছে। এসব হতে পারছে কেন? ইসলামী ফৌজদারী আইন কোথাও যথাযথভাবে কার্যকর নেই বলেই। সবক্ষেত্রে ইসলামী বিধানের বাস্তবায়ন মনে হয় এই মুহূর্তে বিশ্বের কোনো দেশেই নেই। তবে ইসলামী ফৌজদারী আইনের কিছুটা প্রয়োগ থাকায় সৌদী আরবে গিয়ে দেখে আসুন- সামাজিক নিরাপত্তা তুলনামুলকভাবে অন্য সব দেশ থেকে একটু বেশি আছে। আবার কোথাও যদি সামান্যভাবে কিছু বিধান থেকেও থাকে, তার যথাযথ প্রয়োগ নেই বললেই চলে, যেমন হত্যার বদলে হত্যার বিধান আমাদের দেশে আইনগতভাবে বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা পালনে বিভিন্ন কারণে যথেষ্ট অবহেলা থাকার ফলে প্রতিদিন হত্যার পর হত্যা হয়েই চলেছে। নিরীহ মানুষ খুনীদের হাতে এখন জিম্মির মতো অবস্থায় রয়েছে। যদি হত্যার বদলে হত্যার বিধানটি সকল ক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় তড়িৎ প্রয়োগের ব্যবস্থা করা যেত তাহলে আমার পূর্ণ বিশ্বাস হত্যার হার এ পর্যায়ে আর থাকতে পারত না। ইসলামের কোনো বিধানই কল্যাণবিহীন নয়। কোনোটা ব্যক্তিগত কল্যাণে আবার কোনটা রাষ্ট্রীয় কল্যাণের কাজে যথেষ্ট উপকারী। এক সময় ছিল ইসলামী বিধানের এ সকল জাগতিক কল্যাণ মানুষ স্বচক্ষে দেখার ফলে অমুসলিম দেশ পর্যন্ত স্বেচ্ছায় মুসলমানদের ডেকে এনে তাদের শাসন-ক্ষমতা হাতে নেওয়ার আহবান জানিয়েছে। এসব কথা শুধু কল্পকাহিনী নয়, রীতিমতো ইতিহাস সৃষ্টি করা ঘটনা। আর আজ ঐ সমস্ত বিধানের প্রায়োগিক কল্যাণ দেখা তো দূরের কথা, কল্যাণের কথাগুলোও আমরা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হচ্ছি না। ইসলামী অনুশাসনের সৌন্দর্য শিক্ষিত অশিক্ষিত, দ্বীনদার ও আধুনিক সর্বস্তরের মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে পারছি না। আমাদের উপস্থাপন সুন্দর হয় না। তাই যারা আজ ইসলামী বিধানের বিরোধিতা করে বসে এবং বলে চৌদ্দশ বছর আগে উটের যুগের বিধান আজ বিংশ শতাব্দীতে রকেট-কম্পিউটার ও মোবাইলের যুগে অচল। তারা পরীক্ষামূলকভাবে তা বাস্তবায়ন করে হলেও দেখতে পারেন।#

 

 

advertisement