শাওয়াল ১৪৩০   ||   অক্টোবর ২০০৯

মোড়লঃ মানবাধিকারের উপদেশদাতাদের চেহারা দেখুন

খসরূ খান

মানবাধিকারের উপদেশ দুনিয়াব্যাপি বিলি বিতরণ করে বেড়ালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে মানবাধিকার কিভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে বহু রাখঢাক সত্ত্বেও তার ভয়াবহ কিছু চিত্র এখন মিডিয়াতে চলে আসছে। আমরা সেরকম দু’টি প্রতিবেদন হুবহু এখানে তুলে ধরছি। দু’টি প্রতিবেদনই মূলত গুয়ান-ানামোবে কারাগারে বন্দীদের সঙ্গে কৃত আচরণ সম্পর্কিত। প্রথমটি ছাপা হয়েছে দৈনিক প্রথম আলো ২৮ আগস্ট ’০৯ সংখ্যার ৯ম পৃষ্ঠায়। দ্বিতীয়টি ছাপা হয়েছে দৈনিক ইত্তেফাকের ২৮ আগস্ট ’০৯ সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায়। পাঠক! প্রতিবেদন দু’টি পড়-ন এবং বিশ্বমোড়লের চেহারার উন্মোচিত একটি অংশ দেখুন। প্রতিবেদন-১ সিআইএর বন্দী নির্যাতন টানা কয়েক দিন ঘুমাতে না দেওয়া, দেয়ালের সঙ্গে মাথা ঠোকানো, পানিতে ডুবিয়ে রাখা, যে ঘরে তাদের বন্দী করে রাখা হয়েছে, সেই ঘরে বাতাসের প্রবাহ বন্ধ করে শ্বাসকষ্ট দেওয়া, মুখমণ্ডলে অবিরাম চড় মারা-বন্দীদের ওপর এ রকম অসংখ্য অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস'া (সিআইএ)। ২০০১ সালে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর বুশ প্রশাসনের নির্দেশে সিআইএর কুখ্যাত সব কারাগারে আটক সন্দেহভাজন জঙ্গিদের স্বীকারোক্তি আদায়ে তাদের ওপর গা শিউরে ওঠার মতো এ রকম ভয়ানক নির্যাতন চালানো হয়েছে। গত সোমবার সিআইএর ইন্সপেক্টর জেনারেলের প্রকাশিত প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে এসব বর্বরোচিত নির্যাতনের চিত্র। ২০০৪ সালে তিনি ওই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিলেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিআইএর গোপন কারাগারগুলোয় জিজ্ঞাসাবাদের নামে বন্দীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। এ সময় বন্দীদের প্রায়ই উলঙ্গ করে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। তাদের ঘুমাতে দেওয়া হতো না। এতেও যদি স্বীকারোক্তি আদায় করা না যেত, সিআইএর কর্মকর্তারা তখন অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। মার্কিন লিগ্যাল কাউন্সিলের জ্যেষ্ঠ অ্যাটর্নি স্টিভেন ব্রাডবারি বলেন, নির্যাতন চালিয়ে বন্দীদের মধ্যে এমন ধারনার সৃষ্টি করা হত যে, সিআইএ কর্মকর্তাদের ওপর নির্ভর না করে তাদের উপায় নেই। বন্দীরা যে একেবারে অসহায় হয়ে পড়েছে-এমন একটা ধারণা তাদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হত। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদ করতেন বিভিন্ন বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ও সিআইএর কর্মকর্তারা। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তারা বন্দীদের মুখমণ্ডলে চড় মারতেন। তাদের এমন অস্বাভাবিক অবস'ায় দাঁড় করিয়ে রাখা হত যে তারা ঘুমাতে পারত না। টানা ১১ দিন বন্দীদের ঘুমাতে দেওয়া হত না। তাতেও কাজ না হলে গলায় দড়ি বেঁধে দেয়ালের সঙ্গে তাদের মাথা ঠোকর খাওয়ানো হত। সন্দেহভাজন কিছু শীর্ষস'ানীয় সন্ত্রাসীকে অন্ধকার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হত। তাদের ওই ঘরে টানা ১৮ ঘন্টা রাখা হত। তাতেও তারা কাবু না হলে তখন ওই অন্ধকার ঘরে বিষধর পোকামাকড় ছেড়ে দেওয়া হত। এসবের কোনো কিছুতেই কাজ না হলে তখন পানিতে ডুবিয়ে শাসি- দেওয়া হত। তাদের মুখ ও নাকে কাপড় জড়িয়ে তার ওপর পানি ঢেলে দেওয়া হত। সিআইএর কর্মকর্তারা বন্দীদের ঘরে ২০ থেকে ৪০ সেকেন্ডের জন্য বাতাসের প্রবাহ পর্যন- বন্ধ করে দিতেন। তাদের পানিতে ডুবিয়ে মারা এবং শ্বাসরোধ করে হত্যা করার ভয় দেখানোর জন্যই এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হত। পানিতে ডুবিয়ে নির্যাতনের সময় তিন থেকে চারবার শ্বাস নেওয়ার সুযোগ দিয়ে আবার তাদের পানিতে ডোবানো হত। এরকম চলত ২০ মিনিট ধরে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় পানিতে ডুবিয়ে তথ্য আদায়ের ক্ষেত্রে সিআইএর কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত আইনও লঙ্ঘন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে জিজ্ঞাসাবাদের সময় বন্দীর ওপর অল্প পানি ঢালার নিয়ম থাকলেও সিআইএ কর্মকর্তারা প্রচুর পরিমাণ ঢালতেন। এ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি নির্যাতন চালানো হয়েছে সন্দেহভাজন আলকায়েদার শীর্ষস'ানীয় তিন নেতার ওপর। এঁদেরই একজন হলেন খালিদ শেখ মুহাম্মাদ। তাঁর ওপর ১৮৩ বার পানি নির্যাতন চালানো হয়েছে। সিআইএর কর্মকর্তারা তাঁর সন-ানদের হুমকি দিতেন। তাঁকে শুনিয়ে বলা হত যে আরেক বন্দীর মাকে ধর্ষণ করা হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিআইএর কর্মকর্তারা ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন- নির্যাতনের সময় বন্দীদের মেরে ফেলার ভয় দেখাতেন। তাঁরা বন্দুক ও বৈদ্যুতিক ড্রিল মেশিন বন্দীদের কাছে নিয়ে হত্যার ভয় দেখাতেন। বন্দীদের শরীর শক্ত ব্রাশ দিয়ে ঘষতেন যতক্ষন না তার চামড়া ঘসে পড়ত। জিজ্ঞাসাবাদের সময় জ্ঞান না হারানো পর্যন- বন্দীদের গলা চেপে ধরে রাখতেন সিআইএর কর্মকর্তারা। এএফপি। প্রতিবেদন-২ সিআইএর বন্দী নির্যাতনের আরো অমানবিক চিত্র যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মামলা করবেন এক আফগান বন্দী যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস'া সিআইএ’র বন্দী নির্যাতনের যে সারমর্ম সমপ্রতি প্রকাশিত হয়েছে, পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা গেছে নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র ছিল আরো নিকৃষ্ট ও ভয়াবহ। মার্কিন গোয়েন্দারা সন্দেভাজন আলকায়েদা ও তালেবান বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় যেসব কৌশল ব্যবহার করেছেন তার কাছে মধ্যযুগীয় বর্বরতা তুচ্ছ মনে হতে পারে। অপরদিকে, সমপ্রতি এক আফগান বন্দী কিউবার গুয়ানতানামো কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন। মুহাম্মাদ জাওয়াদ নামের ওই আফগান তরুণের আইনজীবী জানিয়েছেন, যৌক্তিক পরিমাণ ক্ষতিপূরণ চেয়ে মার্কিন আদালতে মামলা করবেন তারা। পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, জাওয়াদকে ২০০২ সালে যখন মার্কিন সেনারা আটক করে তখন তার বয়স ছিল ১২ বছর। জাওয়াদ নিজে বলেছেন, আমি নিষ্পাপ শিশু ছিলাম যখন তারা আমাকে গ্রেফতার করে। তবে পেন্টাগন তার দাবি অস্বীকার করে বলেছে, তার হাড় স্ক্যান করে দেখা গেছে ওই সময় তার বয়স ছিল ১৭ বছর। তবে জাওয়াদ ক্ষতিপূরণ মামলা করতে অনড় অবস'ানে আছেন। গত সপ্তাহে তিনি গুয়ানতানামো থেকে ছাড়া পেয়ে আফগানিস-ানে ফিরে যান। খবর এএফপি ও বিবিসির। সিআইএর হাতে বন্দী জিজ্ঞাসাবাদের পূর্ণ কৌশলের বিবরণ প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা গেছে, বন্দীদের সঙ্গে যেসব অমানবিক আচরণ করা হয়েছে তাতে মার্কিন গোয়েন্দারা তাদের মানুষ বলে মনে করতেন এমন প্রমাণ মেলে না। সিআইএর একটি কৌশল ছিল বন্দীকে বসতে না দিয়ে অর্ধ উলঙ্গ হয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা। একজন মানুষের পক্ষে ঠায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না হলেও বন্দীরা তা করতে বাধ্য হতেন। বসে পড়লে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যেত। অনেককে আবার সব সময় হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে রাখা হত। একজন বন্দীকে টানা ১১ দিন ঘুমাতে দেওয়া হয়নি এমন ঘটনাও ঘটেছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা হওয়ার পর বুশ প্রশাসনের নেতৃত্বে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সময় এসব বন্দী নিগ্রহের ঘটনা ঘটে। এমনও দেখা গেছে, সিআইএ এসব বন্দীকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাইভেট সিকিউরিটি ফার্মকেও ব্যবহার করেছে। বন্দীকে চড়-থাপ্পড় মেরে মানসিক আঘাত করার কৌশল তারা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে। দিনের পর দিন থাপ্পড় খেতে খেতে অনেক বন্দী সাময়িকভাবে মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলতেন। এসব কৌশলেও মন না ভরলে গোয়েন্দারা বন্দীকে জামা পরিয়ে তার কলার ধরে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁকাতেন এবং পেছনে একটি দেয়ালে আছড়ে মারতেন। তাতেও কাজ না হলে হাত ও হাঁটু চেপে জড়োসড়ো অবস'ায় আলোবিহীন বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হত। এজাতীয় বাক্সের মধ্যে ১৮ সেকেন্ড কারো কাছে নরক মনে হলেও এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, কাউকে কাউকে ১৮ ঘন্টার আগে বের করা হয়নি। মুখে পানি ঢালার সময় আরো অমানবিক আচরণ করা হত। মাত্র তিন থেকে চার বার শ্বাস নিতে দিয়ে ২০ থেকে ৪০ সেকেন্ড নাকে-মুখে তীব্র বেগে পানি ছুঁড়ে দম বন্ধ করা হত। এরকম ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর গোটা বিশ্বে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। তবে বুশ আমলে সিআইএর জড়ো করা এই কলঙ্ক মুছতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামার প্রশাসন গত সোমবার এক ফৌজদারি তদন- শুরুর নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়া ভবিষ্যতে যাতে এসব অপকৌশল ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কারের নির্দেশ দিয়েছেন ওবামা।

 

advertisement