সফর ১৪২৯   ||   ফেব্রুয়ারি ২০০৮

বাইতুল্লাহর মুসাফির-৬

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

মদীনা শহর থেকেই দেখা যায় অহুদ পাহাড়। আমাকে যখন বলা হলো, ঐ যে দূরে পাহাড় দেখছো, সেটাই জাবালে অহুদ! তখন মুহূর্তের মাঝে আমার সমগ্র দেহে যেন বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে গেল! আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম আমার পেয়ারা নবীর প্রিয় জাবালে অহুদের দিকে।

এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে, সীরাতের কিতাবে যেদিন প্রথম পড়েছিলাম জাবালে অহুদের প্রতি আল্লাহর নবীর ভালোবাসা এবং আল্লাহর নবীর প্রতি জাবালে অহুদের ভালোবাসার কথা, সেদিন আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। পাহাড় নবীকে ভালোবাসে আর নবী পাহাড়কে ভালোবাসেন! কোন্ ভালবাসা! কেমন ভালোবাসা! কী রহস্য এ ভালোবাসার! সেদিন থেকে আমিও ভালোবাসতে শুরু করেছি জাবালে অহুদকে। কল্পনার চেখে দেখতে চেয়েছি জাবালে অহুদের সৌন্দর্যমহিমা।

সফরে যাওয়ার পথে এবং মদীনায় ফেরার পথে আল্লাহর নবী জাবালে অহুদ অতিক্রম করছেন, আর মুহববতের নযরে ফিরে ফিরে দেখেছেন এবং বলেছেন- أحد يحبنا ونحبه এ পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও তাকে ভালোবাসি। অহুদের যুদ্ধে আহত হয়ে আল্লাহর নবী এ পাহাড়েই আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং [আল্লাহর হুকুমে] পাহাড় তাঁর প্রিয় নবীকে রক্ষা করেছিলো। মুসলিম বাহিনীর চরম বিপর্যস্ত অবস্থায়ও কাফিরদের সাহস হয়নি পাহাড়ে চড়াও হয়ে হামলা করার। ইয়া জাবালে অহুদ! আমি তোমাকে ভালোবাসি, কারণ তুমি আল্লাহর নবীকে ভালোবেসেছো! চিরজীবন আমি তোমাকে ভালোবাসবো, কারণ আল্লাহর নবী তোমাকে ভালোবেসেছেন!

হায় আফসোস! মদীনায় হাযির হয়েও জাবালে অহুদের কাছে আমার যাওয়া হবে না। খুব কাছে থেকে, জাবালে অহুদের ছায়ায় দাঁড়িয়ে শহীদানে অহুদের যিয়ারত নছীব হবে না! কেন এমন হলো! তাকদীর কেন মুখ ফিরিয়ে নিল!

আযানের সামান্য সময় বাকি! মাওলানা হামিদুল্লাহ ছাহেব ফজরের আগেই বলে দিয়েছেন, আসরের পর বিদায় যিয়ারত করে বাবে জিবরীলের সামনে আমরা পরস্পরের ইনতিযার করবো।

বিদায় যিয়ারত কথাটা ভাবতে বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলো, কিন্তু কিসমতের লেখা তো অস্বীকার করার উপায় নেই! আছরের পর বিষণ্ণ হৃদয়ে বিদায় যিয়ারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম হাজারো আশিকানের মিছিলে শামিল হয়ে। সবার মুখে একই উচ্চারণ! সামনে, পেছনে, ডানে, বামে শুধু দুরূদের সুমধুর গুঞ্জন! ... ... ...

উম্মতের মিছিল নবীর রওযার উদ্দেশ্যে! উম্মতের হাজিরা নবীর পাক দরবারে! কী পবিত্র, মধুর ও মর্মস্পর্শী দৃশ্য! হৃদয়ের পরতে পরতে ভাবের কী অদ্ভুত তরঙ্গদোলা! নবীর রওযার পানে উম্মতের এ মিছিল সুদীর্ঘ চৌদ্দশ বছরের। এ মিছিল ছাহাবা তাবেঈনের, তাবয়ে তাবেঈনের এবং ওলামায়ে ছালেহীনের। এ মিছিল ইমাম মালিক, ইমাম আবু হানীফার। এ মিছিল হাসান বাছরী, সুফয়ান ছাওরী ও মুসলিম-বুখারীর। এ মিছিল আব্দুল কাদের জীলানী ও জোনায়েদ বোগদাদীর! একজন গোনাহগার বান্দাকে যখন আল্লাহ তাআলা চৌদ্দশ বছরের এই নূরানী মিছিলে শামিল করে দেন তখন বান্দার অন্তরে মাগফিরাতের এবং কবুলিয়াতের আশা জাগ্রত হবে এটাই তো স্বাভাবিক! আমারও অন্তরে আশা জাগ্রত হলো। হোক না শুধু এক দিনের জন্য, নবীর রাওযায় আল্লাহ যখন হাজির করেছেন তখন ইনশাআল্লাহ নবীর শাফাআতও তিনি নছীব করবেন। আল্লাহর প্রতি এটা আমার সুধারণা। আর আল্লাহ স্বয়ং বলেছেন, বান্দার সুধারণা তিনি কবুল করে থাকেন।

নূরের মিছিল ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো এবং আমাকেও এগিয়ে নিলো। আমি রাওযা শরীফের মোকামে দাঁড়ালাম, আদবের সাথে, অবনত দৃষ্টিতে। হৃদয়ের স্পন্দন যেন থেমে গেল। বিগলিত হৃদয় যেন চোখের অশ্রু হয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়লো। পাপের পঙ্কিলতায় ডুবন্ত এক উম্মতি বিদায়ের সময় অনুতাপের দুফোঁটা অশ্রু ছাড়া আর কী পেশ করতে পারে নবীর দরবারে! আমি গোনাহগার বান্দা যদি দাঁড়িয়ে থাকি তাহলে তো নেক বান্দাদের সালাম নিবেদনে বিঘ্ন ঘটবে, অথচ হয়ত তাদেরই উছিলায় কবুল হবে আমারও সালাম! তাই বুকের কান্না বুকে চেপে রেখে তাড়াতাড়ি সরে এলাম। বাবে জিবরীল দিয়ে বের হয়ে একটু দূরে সরে এসে দাঁড়ালাম। এখান থেকে সবুজ গম্বুজ দেখা যায়। গম্বুজের সবুজ যেন বিদায়ের বেদনায় বিক্ষত হৃদয়কে সান্ত্বানার শীতল পরশ বুলিয়ে দিলো। আমি যেন এই বার্তা পেলাম। দুঃখ কেন করো, যেখানেই থাকো, নবীর দরবারে দুরূদের হাদিয়া পাঠাতে থেকো, ফিরিশতারা তোমার সালাম পৌঁছে দেবে রাওযা শরীফে। দুরূদের হাদিয়া তোমার জন্য আলোকিত করে দেবে মদীনার পথ, তুমি আসবে, আবার আসবে, বারবার আসবে। দুরূদই হবে তোমার বিরহী হৃদয়ের সান্ত্বনা এবং মদীনায় ফিরে আসার পাথেয়।

অনেক্ষণ পর মাওলানা হামীদুল্লাহ ছাহেবকে দেখতে পেলাম। বিদায় যিয়ারত শেষে বের হয়ে আসছেন। হুহু করে কাঁদছেন তখনো। কাঁদো উম্মতি, কাঁদো! আরো কাঁদো! রহমতের নবীর দরবারে যত পারো অশ্রুর পুঁজি সঞ্চয় করে রাখো। হয়তো আখেরাতে এ অশ্রু তোমার কাছে ফিরে আসবে রহমতের নবীর শাফাআত হয়ে।

বিদায়ের অশ্রুভেজা দৃষ্টি আবার নিবদ্ধ হলো সবুজ গম্বুজের প্রতি। বিদায় হে সবুজ গম্বুজ! বিদায়! তবে শুধু চোখের দৃষ্টি থেকে, হৃদয়ের দৃষ্টি থেকে নয়। হে আল্লাহ! তুমি রহমান, রাহীম, তোমার করুণা ও রহমতের কাছে মিনতি হে আল্লাহ! এ যেন শেষ বিদায় না হয়; আবার যেন আসা হয় সোনার মদীনায় নবীর দরবারে দুরূদ ও সালামের নাযরানা নিয়ে! অবার যেন পাই এ সবুজের সান্নিধ্য!

রওয়ানা হলাম যেখান থেকে বাস ছাড়বে সেখানের উদ্দেশ্যে। একটা কথা বলা হয়নি, এখনো মদীনার খেজুর খাওয়া হয়নি। সাধ্যের ভিতরে সামান্য কিছু খেজুর নিলাম, ইফতারের সময় নিজের মুখে দেবো এবং দেশে প্রিয়জনদের মুখে তুলে দেবো, সোনার মদীনার হাদিয়া! আমাদের নবীজী খেজুর চিবিয়ে শিশুর মুখে দিতেন। কল্পনায় যেন দেখতে পেলাম মদীনার শিশুদের সেই সৌভাগ্যের দৃশ্য! সেই দৃশ্যের সঙ্গে সাদৃশ্য গ্রহণের জন্য আমিও তা করবো! মদীনার খেজুর চিবিয়ে আমার ছোট মেয়ের মুখে দেবো।

বাস যাত্রা শুরু করলো; সবুজ গম্বুজ তখনো চোখের দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হলো না, কিন্তু আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেলো; তবু তাকিয়ে থাকলাম ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে আসা সবুজের প্রতি। একসময় সবুজ গম্বুজ দেখা গেলো না, কিন্তু মিনারগুলো দেখা গেলো আরো দূর থেকে। এক সময় তাও অদৃশ্য হয়ে গেলো চোখের দৃষ্টি থেকে। হৃদয়ের গভীরে সবুজ সুন্দর একটি স্বপ্ন ছিলো; আল্লাহর ইচ্ছায় সে স্বপ্ন পূর্ণ হলো, আল্লাহর ইচ্ছায় আবার তা স্বপ্ন হয়ে গেলো। স্বপ্ন দেখো, স্বপ্ন লালন করো, স্বপ্নের বেদনা বহন করো এবং স্বপ্নের পূর্ণতার জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুণো- এরই নাম জীবন। আমি আবার স্বপ্ন দেখা শুরু করবো। শুরু হবে আমার স্বপ্নের জীবন এবং জীবনের স্বপ্ন। আমি জানি না, কবে পূর্ণ হবে এ স্বপ্ন! হবে তো! স্বপ্নের জন্ম এবং স্বপ্নের মৃত্যু সবই তো আল্লাহর ইচ্ছায়! হে আল্লাহ, আমার মৃত্যু হোক, আমার স্বপ্নের যেন মৃত্যু না হয়!

মদীনা থেকে আমার এ যাত্রা যদি হতো দেশের উদ্দেশ্যে তাহলে জানি না মনের অবস্থা কী হতো! বিচ্ছেদ-বেদনা কত গভীর হতো! কিন্তু এখানে বেদনার সঙ্গে ছিলো সান্ত্বনা। কারণ মদীনার মুসাফির আবার হলো মক্কার মুসাফির। আবার আমি ইহরামের লিবাস ধারণ করবো এবং আল্লাহর ঘর দেখবো! আবার আমি আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করবো এবং সাফা-মারওয়ার সাঈ করবো! প্রাণভরে আবার আমি পান করবো যামযামের সুশীতল পানি!

গত রাতে মদীনার প্রবেশ করার সময় বুঝতে পারিনি কখন কোবার মসজিদ অতিক্রম করেছি, বরং আমার জানাও ছিল না যে, কোবার মসজিদের নিকট দিয়েই গাড়ীর পথ। এবার দেখতে পেলাম মসজিদে কোবা। শুধু দেখতেই পেলাম, আর বুকের ভিতর বেদনা অনুভব করলাম। দেখেও দেখতে না পারা, এ যে না দেখার চেয়েও বেদনার। হিজরতের সময় মদীনায় প্রবেশের পূর্বে এখানে আল্লাহর নবী অবস্থান করেছেন তের দিন। ছাহাবা কেরামের সঙ্গে নিজে শ্রম দিয়ে তিনি কোবার মসজিদ নির্মাণ করেছেন। সীরাতের পাতা থেকে খন্ড খন্ড অনেক চিত্র, অনেক দৃশ্য একে একে মনের পর্দায় উদিত হতে লাগলো, কিন্তু ততক্ষণে গাড়ী চলে গেছে অনেক দূর। কিছুক্ষণ পর পিছনে ফিরে ফিরেও মসজিদে কোবা আর দেখা গেলো না, তবে ক্ষণিক দেখার যুগপৎ আনন্দ ও বেদনা আমার সঙ্গী হয়ে থাকলো অনেক্ষণ।

মদীনা থেকে কিছু দূরে যুল হোলায়ফা। সেখানে বাস থামলো ইহরাম ধারণ করার জন্য। আমরা মদীনা শরীফে আছরের আগে মসজিদুন্নববী থেকেই ইহরাম ধারণ করেছিলাম। আমার খুব ভালো লেগেছিলো ইহরামের লিবাসে নবীজীর রাওযায় বিদায় সালাম আরয করতে। এ অনুভব আমাকে অনেক তৃপ্তি দান করেছিলো যে, আমি যেন...! না, সব কথা বলতে নেই, না মুখে, না কলমে।

যুল-হোলায়ফা থেকে বাস রওয়ানা হলো। অর্থাৎ আমরা হারামের মীকাতে প্রবেশ করলাম। দিনের ক্লান্ত সূর্য ধীরে ধীরে অস্ত যাচ্ছে। এ সূর্য প্রতিদিন উদিত হয় এবং অস্ত যায়। প্রতিদিন সে দেখতে পায় মদীনার পথে এগিয়ে চলা কাফেলা। তাদের মুখমন্ডলের উদ্ভাসই বলে দেয় তাদের স্বপ্নের পূর্ণতার আনন্দের কথা। একইভাবে এ সূর্য প্রতিদিন দেখতে পায় মদীনা থেকে বিদায়ের কাফেলা। তাদের মুখমন্ডলের বিষণ্ণতাই বলে দেয় তাদের স্বপ্নের উদ্যানের ঝরে যাওয়া ফুলের কথা। সূর্যের উদায়াস্তের মতই সুদীর্ঘ চৌদ্দশ বছর ধরে চলছে নবী-প্রেমিকদের মিলন-বিচ্ছেদের এ আনন্দ-বেদনা। আজকের অস্তগামী সূর্য সাক্ষী হয়ে থাকলো সুদূর বাংলাদেশের এক অধম উম্মতির বিচ্ছেদকাতর চোখের কয়েক ফোঁটা অশ্রুর।

সূর্য অস্ত গেলো। মদীনা এখান থেকে দূরে, তবে মদীনার খেজুর ছিলো আমাদের কাছে। সেই খেজুর দিয়ে ইফতার হলো! গতকালের মত আজও ইফতারের অন্তরঙ্গতা বেশ উপভোগ্য হলো। তবে আজ আমরা যেমন শরীক হয়েছিলাম তেমনি শরীক করার সুযোগও পেয়েছিলাম।

মদীনায় মসজিদে নববীর ইফতার দেখার এবং শরীক হওয়ার সুযোগ হলো না, তবে শুনে এলাম অনেক কিছু। মদীনার ভাগ্যবান লোকেরা আছরের পর থেকেই মসজীদে নববীতে ইফতারের দীর্ঘ দীর্ঘ দস্তরখান বিছাতে শুরু করেন এবং সকাতর অনুনয়ের সঙ্গে দস্তরখানে রোযাদারদের ডেকে আনেন। দস্তরখানে দস্তরখানে যেন মধুর এক প্রতিযোগিতা। ছোট ছোট শিশুরা হাত ধরে ধরে দস্তরখানে রোযাদারদের এনে বসিয়ে বড়দের থেকে পুরস্কার গ্রহণ করে। তাদেরও মাঝে চলে আরো মধুর প্রতিযোগিতা। দশ বছর পর নিজের চোখে দেখছিলাম সেসব দৃশ্য। দেখে ধন্য হয়েছিলাম। দশ বার বছরের সেই বালক দুটি এখন নিশ্চয় যুবক! ওদের কথা এখনো ভুলিনি। কোন দিন ভুলতে পারবো না। আমাকে ওরা দুদিক থেকে পাকড়াও করেছিলো মসজিদে নববীর দরজায়। নিতে নিতে নিয়ে গিয়েছিলো অনেক দূরে ওদের বাবার দস্তরখানে। মাঝখানে অন্য অনেক দস্তরখানে বসাবার চেষ্টা করা হয়েছিলো। কিন্তু আমার পাহারাদার দুজন ছিলো খুব সতর্ক। যে টানে তাকেই বিনম্র দৃঢ়তার সঙ্গে বলে দেয়- দয়া করে ছাড়ুন, ইনি তো আমাদের মেহমান। আর আরব শায়খ এমন সমাদর করে আমাকে বসালেন যেন আমি তার রক্তের ভাই, কিংবা আরো বেশী। এবার শুরু হলো দুভাইয়ের বিবাদ। প্রত্যেকের দাবী, সে-ই আমাকে পথ দেখিয়ে এনেছে, সুতরাং পুরস্কার তার প্রাপ্য। পিতা অবশ্য খুশী করলেন দুজনকেই। এ রকম দৃশ্য ছিলো রমযানের প্রতিদিন এবং মসজিদে নববী জুড়ে বিছানো প্রতিটি দস্তরখানে। হবে না কেন! আল্লাহ যে তাদেরকে দিয়েছেন মদীনার দিল এবং দুনিয়ার মাল! ইফতারের সময় মদীনার খেজুর আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলো আরো অনেক মধুর স্মৃতি। নামাযের পর বাস আবার যাত্রা করলো মক্কার পথে, বাইতুল্লাহর উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যার আলো-আধারিতে অন্যরকম এক ভাবময় পরিবেশ ছিলো। হৃদয়ের গভীরে অদ্ভুত এক তন্ময়তা ছিলো। পথের দুদিকে কখনো মরুভূমি, কখনো পর্বতশ্রেণী, কখনো খুব কাছে, কখনো দূরদিগন্তে। আরবের হিজাযের এ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যি অপূর্ব! কারণ এখানে প্রকৃতির সৌন্দর্য চক্ষু অবলোকন করে এবং হৃদয় অনুভব করে, তারপর আত্মার গভীরে তা প্রবেশ করে। প্রকৃতি, হৃদয় ও আত্মা এখানে একাকার হয়ে যায়। লাববাইক আল্লাহুম্মা ল্লাববাইক- এই সুমধুর তালবিয়া-ধ্বনির মাঝেই আমাদের পথ অতিক্রম হলো। মধ্য রাতে আমরা মক্কার আলো দেখতে পেলাম। চৌদ্দশ বছর আগে এত দূর থেকে কি দেখা যেতো মক্কার আলো! বিদ্যুতের আলো না হলেও তখনো জ্বলতো আলো! এবং আমার বিশ্বাস, মক্কা-মদীনার আলো সব সময় উজ্জ্বল ছিলো। বাস থেকেই আমরা শুনতে পেলাম কিয়ামুল্লায়লের আযান। আমরা তো আর সে যুগের মানুষ নই, যাদের দিনে ছিলো উদ্যম, রাতে ছিলো উদ্দীপনা! আমরা হলাম এযুগের মানুষ। আমাদের দেহে ছিলো পথের ক্লান্তি এবং সফরের অবসন্নতা। তাই বাস থেকে নেমে হারামের বাইরে পথের উপরই শুয়ে পড়লাম। আমরা একা নই, আরো অনেকে এবং অনেক দেশের। মক্কার ধূলোবালিতে মিসকীনের মত পড়ে থাকতে পেরে নিজেকে বড় ধনি ও সৌভাগ্যবান মনে হলো। এ ধূলিশয্যা তো মখমলের কোমল শয্যার চেয়ে অনেক অনেক প্রিয়। সেহরীর আগে তাওয়াফ করলাম এবং সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে  যামযামের পাড়ে দাঁড়ালাম। এখানে এসে যখনই দাঁড়াই আমি যেন অন্য মানুষ হয়ে যাই। ভিতরে খুব ইচ্ছে জাগে নিষ্পাপ একটি জীবন অর্জনের, ঠিক শিশুর মত। আমি যেন শুধু মানুষের শুভ কামনা করি, আমি যেন কাউকে ঈর্ষা না করি। যামযাম যেন এই শিক্ষাই দেয়, শিশুর মত নিষ্পাপ হও, পবিত্র জীবন অর্জন করো এবং মানুষের শুভ কামনা কর। যামযাম পান করলাম, প্রাণ জুড়োলো, দেহ সতেজ হলো এবং হৃদয় সজীব হলো। আজকের ফজর ইমামুল হারামের প্রায় পিছনে পড়ার সৌভাগ্য হলো। মসজিদের কাতার হয় লম্বা, হারামের কাতার হলো গোল, কাবা শরীফকে ঘিরে চারদিকে। প্রথম কাতারের বৃত্ত ছোট, পরবর্তী কাতারগুলো ক্রমসম্প্রসারিত। যেন বাইতুল্লাহ থেকে নূরের একটি তরঙ্গ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ইমাম কাবা শরীফের যেকোন দিকে দাঁড়াতে পারেন। তবে সাধারণত ইমামের মুছল্লা বিছানো হয় হাতীমে। সেদিন হঠাৎ করে মুছল্লা বিছানো হলো হাজারে আসওয়াদের দিকে। তাওয়াফ শেষ করে আমি তখন মুলতাযামের সান্নিধ্য লাভের জন্য ব্যাকুল। ফলে একান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে ইমামুল হারামের ঠিক পিছনে দ্বিতীয় কি তৃতীয় কাতারে দাঁড়িয়ে গেলাম। প্রথম কাতারে যাওয়ার চেষ্টা করা যেতো, কিন্তু তাতে মনোমালিন্য হওয়ার আশঙ্কা ছিলো, তাহলে তো সব বরবাদ! তাই সে লোভ সম্বরণ করলাম। তবে আল্লাহ তার গোনাহগার বান্দাকে খুশী করে দিলেন ইমামুল হারামের সঙ্গে মুসাফাহার সুযোগ করে দিয়ে। সেদিন সারাটা দিন এজন্য খুব আনন্দে কেটেছিলো। বারবার বুকে নিজের হাতের স্পর্শ গ্রহণ করছিলাম। আল্লাহর ঘরের যিনি ইমাম, এ হাত তো স্পর্শ করেছে তাঁর পবিত্র হাত! পরবর্তীতে অবশ্য হযরত হাফেজ্জী হুজুরের ওছীলায় ইমামুল হারামের সঙ্গে মুছাফাহার সুযোগ হয়েছে একাধিক, দেশে এবং পবিত্র ভূমিতে। কিন্তু সেদিনের সৌভাগ্য-অনুভূতি ছিলো অন্য রকম! হয়ত এজন্য যে, হারানোর বেদনায় আমি তখন বড় কাতর ছিলাম। সহায়-সম্বলহীন একজন মুসাফির যেকোন অবলম্বন থেকে একটু সান্ত্বনা লাভ করতে চাইবে এটাইতো স্বাভাবিক! ফজরের পর ছাফা-মারওয়ার সাঈ করলাম। একই আমল, ছাফা থেকে অবতরণ, দূরের মারওয়ায় আরোহণ এবং আসা ও যাওয়ার পথে সবুজ সীমানায় দৌড়। এভাবে ছাফা থেকে শুরু হয়ে মারওয়া গিয়ে সাত চক্কর সমাপ্ত।

একই আমল, কিন্তু নতুন ইহরামের পর যতবারই তুমি ছাফা-মারওয়ার সাঈ করবে, যতবারই তুমি সবুজের সীমানায় দৌড়ে পার হবে, মনে হবে জীবনে এই প্রথম। এখানে প্রতিদিন প্রথম দিন। নতুন অনুভব-অনুভূতি, নতুন চেতনা, নতুন উপলব্ধি এবং নতুন নতুন রহস্যের উদ্ভাস! একইভাবে প্রতিটি তাওয়াফে তুমি লাভ করবে নতুন নতুন অনুভব-অনুভূতি, নতুন নতুন চেতনা ও উপলব্ধি। হৃদয় তোমার সমৃদ্ধ হবে নতুন নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞানে। বাইতুল্লাহর পঁচিশ বছরের পড়শী এক ভাগ্যবান ব্যক্তি আমাকে বলেছেন- যতবার হজ্জ করি, ওমরা করি, সাঈ ও তাওয়াফ করি, আরাফা-মুযদালিফায় ওকূফ করি, জামারায় রামি করির প্রতিবারই যেন ভিন্ন স্বাদ ও সুবাস অনুভব করি। প্রতিবারই মনে হয়, এমন তো আগে হয়নি! এমন তো আগে বুঝিনি! ইফতারের পর আমরা তিনজন জিদ্দা রওয়ানা হলাম আমাদের দুজনের টিকিট ও ফ্লাইট নিশ্চিত করার জন্য। তখন জিদ্দায় বাংলাদেশের নিজস্ব অফিস ছিলো না। এরিয়ান ট্রাভেলস ছিলো বিমানের প্রতিনিধি। জিদ্দায় তাদের অফিস আমাদের দেশের বিমানের প্রধান কার্যালয়ের চেয়ে বড়, যেমন আকারে-আয়তনে, তেমনি জাঁকজমক ও সাজসজ্জায়। কোথায় কার সাথে কথা বলবো, বুঝতে না পেরে বোকার মত দাঁড়িয়ে ছিলাম। আরবী নামে তারা যা বলে সেটা আর যা হোক আরবী নয়, আর আমাদের বিশুদ্ধ আরবী তাদের কাছে একটা বিস্ময়! সে বড় অদ্ভুত অবস্থা। মধ্যযুগের কবি মুতানাববী দোভাষীর কথা বলেছেন, পাকিস্তানের এক ভদ্রলোক দোভাষী হয়ে আমাদের উদ্ধার করলেন। কাজ অবশ্য হয়ে গেলো অল্প সময়ে এবং কোমল পানীয়ের কোমল আপ্যায়নসহ।

এবার বলবো একটি শিক্ষালাভের ঘটনা। শিক্ষক হলেন এক বেদুঈন টেক্সিচালক, যিনি আমাদেরকে জিদ্দা থেকে মক্কা আনা-নেয়া করেছেন। নাম, জাবির আবদুল কারীম আব্দুস সামাদ। শিক্ষক বলতেই তার নামটা এখনো স্পষ্ট মনে আছে। নিজের, বাবার এবং দাদার, এই তিন নাম না বলে সাধারণত কোন আরব ক্ষান্ত হতে চায় না। বাবার নাম তো অবশ্যই বলবে, জিজ্ঞাসা করলে দাদার পরেও কয়েক সিঁড়ি বলতে পারে দশ বছরের আরবশিশুও। এক সময় তো উট-ঘোড়ারও বংশ-পরিচয় ছিল আরবদের গর্ব। আমাদের দেশে বিয়ের পর মেয়েরা স্বামীর নাম ও পদবী গ্রহণ করে। কিন্তু আরবনারী এখনো নিজের নামের সাথে বাবার নাম ও আপন গোত্র-পরিচয় ধারণ করে। জাবিরের বস্তি হোদাইবিয়া অঞ্চলে। তার দাদা ছিলেন জাম্মাল- উট চালক। মক্কা থেকে মদীনায় হাজীদের কাফেলা আনা-নেওয়া করতেন। ত্রিশ-চল্লিশটি উট ছিলো তার। জাবির বেশ গর্বের সাথে বললো, দাদার কাফেলা বেদুঈন দস্যুদের হাতে কখনো লুণ্ঠিত হয়নি, একবার ছাড়া এবং সেবার তিনি ও তার দুভাই প্রাণ দিয়ে হাজীদের জানমাল রক্ষা করেছিলেন। আমার জিজ্ঞাসার জবাবে পঁচিশ বছরের যুবক জাবির বেশ গর্বের সাথে শুনিয়েছিলো সে কাহিনী। পূর্বপুরুষের এমন সৌর্যবীর্যে গর্ব করা অবশ্যই সাজে। তো শিক্ষাটা কী পেলাম! যাওয়ার পথে আমাদের পিপাসা পেয়েছিলো। গাড়ী থামিয়ে আমরা তিনজনের জন্য তিনটি ঠান্ডা কোমল পানীয় কিনলাম। মনেই পড়েনি যে, গাড়ীতে আমরা চারজন ছিলাম। ফেরার পথে আমাদের গাড়ীর চালক জাবির আব্দুল কারীম আব্দুস সামাদ গাড়ী থামিয়েকোমল পানীয়র চারটি বোতল এনেছিলো। তিনজন ভুলে গিয়েছিলো একজনের কথা, অথচ একজনের মনে ছিলো তিনজনের কথা। এ ঘটনা এখনো মনে হলে যুগপৎ লজ্জা ও কৃতজ্ঞতায় এতটুকুন হয়ে যাই। এ শিক্ষা আমি আমার জীবনে মনে রাখার চেষ্টা করেছি।

সবার সঙ্গে একই রকম ঘটনা ঘটবে, তা জরুরী নয়। তবে আমাদের সাথে তা ঘটেছিলো। এমনকি জাবির একরকম জোর করে আমাদের জিদ্দা শহর ঘুড়িয়ে দেখিয়েছিলো। তার একটি মন্তব্য এখনো মনে পড়ে, মৃদু হেসে সে বলেছিলো, এটা তোমার বিশুদ্ধ আরবী ভাষার পুরস্কার! বিপরীত অভিজ্ঞতাও যে কখনো হয়নি তা নয়। তবে এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে যে, সব আলখেল্লার ভেতরে আরব বাস করে না। কারণ এক সময় বিভিন্ন দেশের ফেরারী খুনের আসামীরা নিরাপদ ভেবে আরব দেশে পাড়ি জমাতো। এখন তাদের সন্তান ও তস্যসন্তানরা মাতৃভাষা ভুলে যাওয়া রীতিমত আরব। জিদ্দা শহরকে মনে হলো রূপকথার শহর। আলিশান সব ইমারত। বহুতল মানে একেবারেই বহুতল। প্রতিটির ডিজাইন ও নকশা ভিন্ন। যেন একটিকে অপরটির ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা! ইট-পাথরের চেয়ে কাঁচের ব্যবহার বেশী। যেন একেকটি শিশ মহল! আর আলোকসজ্জার তো কোন তুলনাই নেই। চারিদিকে চলছে ব্যাপক এক নির্মাণ কর্মযজ্ঞ। উটের যুগের এবং মরুভূমির আরবদের এখন খুঁজে পাওয়া সত্যি দুষ্কর! এক জায়গায় দেখা গেলো বিরাট দিঘির মত মাটি খোঁড়া হয়েছে। জাবির জানালো, হিন্দুস্তান থেকে মাটি এনে ভরাট করে এখানে উদ্যান তৈরী করা হবে! বোঝা গেলো, মরুভূমির কোলে প্রতিপালিত রুক্ষ কঠিন আরবরা এখন কোমল হওয়ার চেষ্টা করছে। দুশমনও তাদেরকে নরম লোকমার মত গিলতে শুরু  করেছে। এটাই স্বাভাবিক, আর ইতিহাসে অস্বাভাবিক ঘটনা খুব কমই ঘটে। জিদ্দাকে বলা হয় লোহিত সাগরের কন্যা। বিরাট শহর। বিরাট বললে কমই বলা হয়। কত বিরাট তা কল্পনাও করা সম্ভব নয়। পাঁচতারা হোটেল সংখ্যায় বিশ পঁচিশের কম হবে না। সেগুলোর ভিতরের চিত্র বেদুঈন যুবক জাবির বারবার আস্তাগফিরুল্লাহ বলে যা তুলে ধরলো তা সত্যি সত্যি আস্তাগফিরুল্লাহ। ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন শ্রেণীর নারী-পুরুষের আগমন এখানে পিছনের যে কোন সময়ের চেয়ে ভয়াবহ রকমের বেশী। তাদের মাধ্যমে অর্থনৈতিক শোষণ যেমন চলছে তেমনি চলছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। ফলে বিশেষ করে যুবক শ্রেণী বিপথগামী হয়ে পড়ছে খুব দ্রুত, যার কিছু চিন্হ লোহিত সাগরের পাড়ে বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্রে আমাদেরও নযরে এসেছে। এটা খুবই বেদনাদায়ক বিষয়, কিন্তু ঢল যখন ধেয়ে আসে তখন তা রোধ করার উপায় কী!

আজ আটাশে রামাযান। বলতে কলজে ফেটে যায়, তবু এটাই তিক্ত বাস্তব যে, মক্কা শরীফে আজ আমাদের শেষ দিন। কে জানতো, এমনই হবে আমার কিসমত! সফর তো শুরু হয়েছিল চার মাসের নিয়তে। হযরত হাফেজ্জী হুজুর তো আমাদের পাঠিয়েছিলেন মুকাদ্দামাতুল জায়শরূপে। তিনি তো চেয়েছিলেন, আমরা হজ্জ পর্যন্ত অবস্থান করবো। তিনি হজ্জের সফরে আসবেন এবং আমরা তাঁর সঙ্গে হজ্জ আদায় করবো। জীবনের প্রথম হজ্জ হযরত হাফেজ্জী হুজুরের ছোহবতে, কল্পনা করা যায় এমন সৌভাগ্যের কথা! কিন্তু ললাটের প্রশস্ততা যদি হয় অল্প তাহলে কার দোষ! আমার তখন মনে হয়েছে, আমীরে সফরের ফায়ছালা মেনে নেওয়াই সমীচীন। কী বলবো এটাকে? নিজের কিসমত? না নিজের হাতে নিজের কিসমতের বরবাদি? এখন যারা যিন্দেগির সফর শুরু করছে, জোড় হাত করে তাদের বলি, মুরুববীর আদেশ-উপদেশের নিজস্ব ব্যাখ্যা বের করো না এবং নিজস্ব বুদ্ধি-বিবেচনা প্রয়োগ করতে যেয়ো না। ক্ষতি যদি হয় হোক মুরুববীর কথা অনুসরণ করে। কারণ নিজের বুদ্ধির লাভও লাভ নয়। আমি শুধু বলতে পারবো, কিন্তু বেলতলায় যাওয়া তো আর রোধ করতে পারবো না। নিজের বেলায় যখন পারিনি! সময় সত্যি সত্যি একেবারে শেষ হয়ে এলো। আছরের আগেই বিদায় তাওয়াফ সম্পন্ন করতে হবে। তাওয়াফ করলাম সর্বস্ব হারানোর বেদনা নিয়ে। মুলতাযামে এসে অশ্রু আর বাঁধ মানলো না। প্রাণভরে কাঁদলাম। এ কান্না ছিলো সেই দুর্ভাগা মুসাফিরের, মরুভূমিতে যার ফুরিয়ে গেছে পাথেয়, হারিয়ে গেছে সওয়ারির উট! এখন কান্নাই তো তার সম্বল! বাঁচার একমাত্র উপায়! অশ্রুবর্ষণই এখন তার জন্য আনতে পারে রহমতের বৃষ্টিবর্ষণ। বান্দার অক্ষমতাকে মাফ করো হে আল্লাহ! আমি কী করবো হে আল্লাহ, আমার সমনে যে কোন উপায় নেই। তোমার নারাযি থেকে হেফাযত করো হে আল্লাহ! আমাকে আবার ডাক দিও হে আল্লাহ! আবার যেন আসতে পারি তোমার ঘরে, তোমার হাবীবের রাওযা শরীফে। এ স্বপ্নভঙ্গের পর আবার যেন স্বপ্ন দেখি। ভাঙ্গা বুকে আবার যেন স্বপ্নের বেদনা লালন করি! আবার যেন পূর্ণ হয় আমার স্বপ্ন! আবার যেন কাছে পাই কালো গিলাফের ছায়া এবং সবুজ গম্বুজের স্নিগ্ধতা! মুনাজাতের পর বুকটা যেন অনেক হালকা হলো। হৃদয়ের গভীরে যেন এ আশ্বাস ও বিশ্বাস জাগ্রত হলো যে, আমার আল্লাহ আমাকে আবার আনবেন। ইনশাআল্লাহ আমি আবার আসবো, আল্লাহর ঘর আবার তাওয়াফ করবো, যামযামের পাড়ে আবার দাঁড়াবো, ছাফা-মারওয়ার মাঝে আবার সাঈ করবো। মিনা-আরাফায় ইনশাআল্লাহ আমি হাযির হবো। লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক বলে আমি ইহরামুল হজ্জের সাজ ধারণ করবো। কবে? কীভাবে? তা জানি না। আমি শুধু জানি, মেহেরবান আল্লাহ তাঁর বান্দাকে নিরাশ করেন না, কখনো না। বান্দার অযোগ্যতা, বান্দার গান্দেগি ও অপবিত্রতা তাঁর রহমতের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, কখনো না। আল্লাহর ঘরের দিকে বারবার তাকিয়ে তাকিয়ে, আফসোস করে করে, চোখের পানি ফেলে ফেলে ধীর পদক্ষেপে মাতাফ থেকে বিদায় হলাম। হারাম শরীফে আছরের জামাআতে শেষ নামায আদায় করলাম। আর দাঁড়িয়ে থাকার সুযোগ নেই; আর বিলম্ব করার উপায় নেই। বিচ্ছেদ-কাতর দৃষ্টিতে শেষ বারের মত বাইতুল্লাহকে দেখলাম। বিদায় হে বাইতুল্লাহ! এক মজবূর মুসাফিরের অক্ষম বিদায়! আবার ফিরে আসার স্বপ্ন দেখে বিদায়! হে আল্লাহর ঘর! আল্লাহর কাছে তুমিও সুপারিশ করো আমার জন্য। দুদিনের জন্য হলেও তো আমি তোমার পড়শী ছিলাম!

মক্কা শরীফে এসে যে দোকানে ব্রিফকেস আমানত রেখেছিলাম, তিনি এ কদিন অত্যন্ত সৌজন্যের পরিচয় দিয়েছেন। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবং শোকর আদায় করে ব্রিফকেস নিলাম। তিনি জানতেন, আমি হজ্জের নিয়তে এসেছি। বিদায়ের কথা শুনে তিনি তাজ্জব বনে গেলেন। উৎকণ্ঠার সঙ্গে কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। কী বলবো! নিজের অজান্তেই চোখে পানি এসে গেলো। শুধু বললাম-

(তোমরা যা চাও তা নয়, বরং আল্লাহ যা চান তাই হয়।) তিনি বললেন, ছাদাকাল্লাহুল আযীম- আল্লাহর কালাম চিরসত্য।

ঐ বান্দাকে আল্লাহ উত্তম বিনিময় দান করুন। তিনি সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ইনশাআল্লাহ তুমি আবার আসবে। আল্লাহ তোমাকে সাহায্য করুন।

আমার চেপে রাখা কান্না তখন বাঁধ ভেঙ্গে বের হয়ে এলো। তিনি আমার কাঁধে কোমলভাবে হাত রেখে নীরব সমবেদনা জানালেন। জীবনে এমন মুহূর্তও আসে যখন সামান্য একটু নীরব সমবেদনা অনেক বড় অবলম্বনের কাজ দেয়। জীবনে অনেক কিছু পাওয়া যায়, এই সমবেদনাটুকু খুব কম পাওয়া যায়। এইটুকু যদি কখনো কারো কাছে পাও, কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাকে স্মরণ করো।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement