ইয়েমেনে একশত বিশ দিন (৩)
দেওয়ান মুহাম্মাদ আজিজুল ইসলাম
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
প্রাসঙ্গিকভাবেই এখানে পুরুষদের পোশাকের বর্ণনা দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। ছোট-বড় সবাই খুব নকশাদার সেলাইবিহীন লুঙ্গি পড়ে, হজ্বের এহরাম বাঁধার সময় যেভাবে লুঙ্গি পড়তে হয় সেভাবে। কোমরে একটি চওড়া, নকশাদার ও অধিকাংশ সময়ই দামী একটা বেল্ট পড়ে। বেল্টের সঙ্গে থাকে খাপসহ খঞ্জর। জন্মের পরপরই ছেলেদের জন্য এই খঞ্জর কেনা হয় এবং তারা সারা জীবন এই খাপসহ খঞ্জর বহন করে। কোনো কোনো খঞ্জরের খাপের দাম শুনে অবাক হয়েছি। একজনের বেল্টের সঙ্গে একটা নকশাদার খাপ দেখলাম, যার দাম ৪,০০০/-রিয়েল, বেল্ট ও খঞ্জরের দামসহ ৮,০০০/- ইয়েমেনি রিয়েল। শুনলাম লক্ষাধিক টাকার সেটও আছে। এটা তাদের কাছে মর্যাদার প্রতীক এবং দারুণ গর্বের বস্তু।
লম্বা ঝুলের জামা বা জোব্বা খুব কম। প্রায় লোকই লুঙ্গির উপর ফুলসার্ট এবং তার উপর কোট গায়ে দিয়ে থাকে। হুদাইদার গরমের মধ্যেও এর ব্যতিক্রম দেখিনি। তবে তবলীগের সাথীদের মধ্যে পূর্বের মতই জোব্বা চালু আছে এবং ইদানীং মাদ্রাসাগুলিতেও এর উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দামী পোশাকও এরা সাধারণভাবেই পরে এবং বালুর উপর নির্দ্বিধায় বসে পড়ে।
এদের প্রধান খাদ্য যোরা। আমাদের দেশের জোয়ারের এদেশী সংস্করণ। ভুট্টা গাছের মতই তরতাজা মোটা গাছের মাথায় এক থোকা জোয়ার, বা যোরা। কাঁচা অবস্থায় সবুজ থাকে, পাকলে হালকা বেগুনি রং ধারণ করে। গাছসহ ফসল জাগ দিয়ে মাড়াই করা হয়, এরপর যাঁতায় পিষে ময়দা করতে হয়। সেই ময়দা বাড়ির তন্দুরের মধ্যে ছেঁকে রুটি ও পিঠা বানানো হয়।
বিকেলে গাশ্তে বের হলাম। কয়েক জায়গায় গাশ্ত করার পর রাহবার আমাদেরকে নিয়ে গেলেন প্রাচীরঘেরা একটি বড় বাড়ির ভেতর। ঘরের মধ্যে আটটা দড়ির খাটলা (কোমর সমান উঁচু খাটিয়া)। প্রত্যেকটার উপর দুই-তিনটা বালিশ এবং কেউ চোখ বন্ধ করে শুয়ে কেউ হেলান দিয়ে বসে ঐ সবুজ পাতা (কাদ) মুখে পুরে বুঁদ হয়ে আছে। প্রত্যেকের মুখের এক পাশ টেনিস বলের মতো উঁচু হয়ে আছে। আমরা ভেতরে যেতেই একটি অদ্ভুৎ অবস্থার সৃষ্টি হল। চমকে উঠে সবার একেবারে থতমত অবস্থা। মাছুম বাচ্চার মতো অবাক চোখে তারা আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। রাহবার সবার সাথে হাত মেলালেন এবং কুশল বিনিময় করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভেড়ার ঘরে আগুন লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। সবাই উঠে এসে একসঙ্গে “কাইফাল হাল” বলে মুসাফাহা করতে লাগল এবং হাতে অথবা কাঁধে চুমু দিতে লাগল। বিত্তশালীরা নিজেদের ঘরে কাদের নেশা বিস্তারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে অথচ বাধা দেওয়ার কেউ নেই। বেশি কষ্ট লেগেছিল যখন হুদাইদা থেকে এজতেমার মাঠে আসার সময় চৌকিরক্ষীদের গালও টেনিস বলের মত উঁচু হয়ে থাকতে দেখি।
প্রথম দিন মহব্বত, দ্বিতীয় দিন তাশকিল এবং শেষ দিন উসুল। তাই বাদ মাগরিব বয়ানের পর তাশকিল করা হল। তের জন সফরের জন্য নাম লেখাল। এর মধ্যে ছয় জন বিদেশ সফরের ইরাদা করল।
***
আজ শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি। বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমা শুরু হয়েছে। আমরা গত রাতে ইজতেমার কামিয়াবীর জন্য দোয়া করেছি। টঙ্গিতে আজ জনসমুদ্র। অথচ এবার আমরা কত দূরে। বারবার ঘুরে ফিরে সবার মুখে ঐ কথা।
নাস্তার পর অন্য মসজিদে যেতে হবে। সুতরাং আটটার মধ্যেই সব প্রস্তুত। গাড়ি এল। মাল-সামানা তোলা হল। এখানে একজন আছেন হাসান ভাই। রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন। দৈনিক মজুরী ৩,০০০/-(তিন হাজার) ইঃ রিয়েল। বাড়ির অবস্থা খুব ভালো। প্রায় তিন শ বিঘা জমির মালিক। তাঁর একটি কাজ খুব ভালো লাগল। তিনি প্রত্যেক দিন তিন ঘন্টা একটি বিরাট মটরের সাহায্যে পানি তুলে এলাকাবাসীকে দেন। তিন শ ফিট নিচে থেকে পানি ওঠে। দৈনিক তিন শ টাকার মত খরচ হয়। ফী সাবিলিল্লাহ। এবারও তার ভাইয়ের গাড়ি। তিনি মটরসাইকেলে নিজের কাজে চলে গেলেন। বলে গেলেন, ইনশাআল্লাহ প্রত্যেক দিন বিকালে আমাদের কাছে যাবেন এবং এশা পর্যন্ত থাকবেন। সত্যিই তিনি কথা রেখেছিলেন।
মরুভূমিতে ধুলা উড়িয়ে আমরা রওয়ানা হলাম। পথের মোড়ে একটি প্রাচীন দালানের ভগ্নাবশেষ দেখা গেল। বর্তমান কালের দোতলার চেয়েও উঁচু একদিকের দেয়াল এখনও দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত দূর্গ ছিল। শুনলাম, এর পাশেই কানাবেজ এর মার্কাজ। মসজিদ সংলগ্ন খুব পুরাতন একটা কবর আছে। নাম হাফি আল হিমা। জনশ্রুতি আছে যে, আসহাবে কাহাফের সেই সম্রাট দিকইয়ানুসের আমলে তৈরী এই সমাধিসৌধ। আর দালানটি নির্মাণ করেছিলেন তুর্কিরা।
এ গ্রামে ঘরবাড়িও পাথরের ব্লকের তৈরি। তবে বিভিন্ন জায়গায় পুরাতন বাংলা ইটের সঙ্গে পাথরের ব্লক দিয়ে সংস্কার করা কিছু বাড়িও দেখা গেল। সবগুলো দালানই বেশ উঁচু। বর্তমান দালানগুলোর চেয়ে তিন-চার হাত উঁচু কমপক্ষে। একটু এগোতেই মসজিদের দেখা পেলাম। অনেক বড় মসজিদ। বারান্দাতে দুই-তিন জন সাথী দাঁড়িয়ে আছেন। জুমার দিন, পুরা মসজিদ সাফাই করা হচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে আমরা মাল সামানা ঘরে তুলছি। এদিকেহ এক সাথী খাদেমকে বলে দিয়েছেন আমাদের গ্যাসের চুলা ষ্টোর রুমে তুলে রাখতে। আমরা যখন চুলার খোঁজ করছি, তিনি হেসে বললেন, চুলা আমাদের হেফাযতে রাখা আছে। চিন্তা করবেন না। এরপর আমির সাহেবকে বললেন, এ তিনদিন আপনারা আমার মেহমান। ইতিমধ্যে কয়েক প্যাকেট বিস্কুট ও দুই ফ্লাক্স চা এসে হাজির। একটায় শায়ে দাউদী বা দুধ চা, অন্যটাতে শায়ে সোলায়মানী বা লাল চা। সবাই বসে গেলাম। এখানে দুধ এত ভালো লাগে যে, আমিও লাল চার পরিবর্তে নিয়মিত দুধ চা খেতে আরম্ভ করেছি। ঘন দুধের মধ্যে হালকা চায়ের লিকার। মিষ্টি কম। বেশ ভালো লাগে।
পরে জানলাম, এই সাথী বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, তুরষ্ক ও আফ্রিকার একটা দেশে (সম্ভবত জিবুতি) সফর করেছেন। ছোটখাট হাসিখুশি মানুষ। তবে সব দিকেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। দুপুরে জুমার পর তার বাড়িতে গেলাম। অনেকগুলো দালানের সাথে অনেকটা খড়ের পালার মতো মাথা-উঁচু ও গোলমতো একটি ঘরে আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা। প্রায় বাড়িতেই এ ধরনের একটি করে ঘর দেখেছি। ভেবেছিলাম রান্নাঘর। এখন দেখছি, এগুলো বিশেষ ধরনের ঘর। কাঁটা জাতীয় গুল্ম দিয়ে ছাওয়া এইসব ঘরের ভেতরে পুরু করে এঁটেল মাটির প্রলেপ দেওয়া আছে। শুকানোর পরে তার উপর সম্ভবত আলকাতরা বা কালো রং দিয়ে আঁকিবুকি করা হয়েছে। আফ্রিকার আদিম অধিবাসীদের সংস্কৃতির একটা স্পষ্ট ছাপ বলে মনে হল। সাগরের ওপারেই আফ্রিকা। সুতরাং প্রাচীন আফ্রিকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জের হওয়া অসম্ভব নয়।
ঘরের ভেতরটা বেশ ঠাণ্ডা ও আরামদায়ক। এখন এখানের তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রির কিছু কমবেশি হতে পারে। শুনলাম, গরমে এই তাপমাত্রা ৪৯ ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠে। তখন বাইরে বের হওয়া যায় না। সে সময় এ ঘরগুলো বেশ কাজে লাগে।
মসজিদে ফিরে আসছি, হঠাৎ মাথার উপরে কয়েকটা পটকা ফুটল। আমাদের দেশে বাঁশের চলটার সঙ্গে বেঁধে হাওয়াই পটকা উপরে উঠিয়ে ফাটানো হয়। এখানে সে রকম না। কেমন করে যেন উপরে উঠে ফেটে যাচ্ছে এবং কয়েক রংয়ের ছোট ছোট হালকা আলোর ফুলকি দেখা যাচ্ছে। প্রাচীরের ভেতরে অন্য কিছু দেখা গেল না। স্থানীয় সাথীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কী? তিনি জানালেন, ঐ বাড়িতে আজ বিয়ে হচ্ছে। নামাযের পর বেশ কিছু মহিলা মসজিদের সামনের রাস্তা দিয়ে ঐ বাড়িতে ঢুকল। পরে বেরও হল। প্রাচীরের এপার থেকে আমরা কোনো হৈ চৈ তো দূরের কথা, কোনো কথাও শুনতে পেলাম না। না বললে বুঝতেও পারতাম না যে, ঐ বাড়িতে বিয়ের মতো একটি সামাজিক অনুষ্ঠান হচ্ছে।
এই মসজিদটি অনেক পুরানো। প্রায় পৌনে তিন হাত চওড়া দেয়াল। মাথার উপরে পুরানো আমলের দুইটা গোলাকার ঘোরানো গম্বুজ। একই নিয়মে চতুষ্কোণ দেয়ালকে চারদিক থেকে ছোট করে এনে গোল করা হয়েছে। দেয়াল ইটের না পাথরের তা উপরের পলেস্তরার জন্য দেখা গেল না। কংক্রিটের পিলার দিয়ে মসজিদকে অনেক বড় করা হয়েছে। জুমার নামাযে প্রায় দুই তিন শ মানুষ নামায পড়ল।
ঐ রাত্রে যে ঘটনা ঘটল তাতে বেশ ভয় পেলাম। প্রায় তিনটার কিছু পরে অজু-ঘরে ঢুকেছি, দেখি সাইফুল ভাই অন্ধের মতো হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে ঘরের মধ্য থেকে বাইরে যাবার রাস্তা খুঁজছেন। হাতের হারিকেন এগিয়ে দিলাম। তিনি না-না করে উঠলেন। চোখে আলো পড়লে দেখতে সমস্যা হয় তাই। সাইফুল ভাই এর চোখের সমস্যা আছে তা জানতাম, কিন্তু তা যে এত বেশি সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলাম। বললেন, আজকে প্রথম রাত তো, পরে সব কিছু মুখস্থ করে নিব। তখন আর অসুবিধা হবে না।
তিনি হাফিয ভাই হিসাবে বেশি পরিচিত। আমরা সমবয়সী। তিনি এককালে ভালো ফুটবল খেলতেন। পাকিস্তানের যুদ্ধকালীন সময়ে করাচির বন্দিশিবিরে যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছেন। খুবই ভালো মানুষ। তাকে নিয়ে অনেক সময়ই হাসি ঠাট্টা করা হয়। কিন্তু তিনি যে এত অসহায় তা কাউকে বুঝতেও দেননি। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আল্লাহ পাক তো আমাকেও এরকম অসহায় করে দিতে পারতেন। সে ক্ষেত্রে কি আমি এত মুজাহাদা করে এ রকম একটি কষ্টকর সফরে আসতে পারতাম? তার জন্য মনের ভেতর থেকে দোয়া বেরিয়ে এল।
দ্বিতীয় দিনও আমাদের দৈনন্দিন এজতেমায়ী আমল স্বাভাবিকভাবেই চলল। প্রত্যেক মসজিদে বয়স্ক ও শিশুদের প্রচুর উপস্থিতি।
এ অঞ্চলে ১২% রোজগার হয় জমি থেকে। বাকি রোজগারের জন্য লোকেরা কেউ গাড়ি ভাড়া খাটায় তবে বেশীর ভাগই সৌদি আরবে চাকুরী করে। ওদের টাকায় এদেশে ওদের আত্মীয় স্বজনদের সংসার চলে। এজন্যই সকালে; বরং বলা ভালো খুব ভোরে, কাল বোরখা ও তালপাতার তৈরি একধরনের হ্যাট (আমাদের গ্রামের মাথাইল এর মত) মাথায় দিয়ে মেয়েরা জমির দিকে যায় এবং মাগরিবের কিছু আগে কাঁধের ঝুড়িতে করে শস্য নিয়ে ঘরে ফিরে। এই মরুসদৃশ গাছ পালাহীন বিরান ভূমিতে ওরা দুপুরে কোথায় খায় এবং পানি কোথায় পায় বুঝতে পারলাম না। কোনো একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই আছে, যা আমি দেখিনি।
কাল সকালে অন্য মসজিদে যেতে হবে। রাতের মোযাকারা শেষে ঘুমুতে যাওয়ার সময় প্রাসঙ্গিকভাবে মনির ভাইয়ের মোষ জবাই করে গ্রামবাসীকে খাওয়ানোর কথা উঠে পড়ল। হঠাৎ কি মনে হল, জানতে চাইলাম যে, তিনি কেন এ কাজ করেছিলেন। উত্তরে যা বললেন তা অবিশ্বাস্য। তিনি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। পাবনা ও ঢাকায় বহু ডাক্তারকে দিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। বহুবার x-ray করার পরও প্রকৃত রোগ কেউ ধরতে পারেনি। ২০০০ সালের প্রথম দিকে একরাতে তার অবস্থা এতই খারাপ হল যে, তিনি মারা যাচ্ছেন মনে করে বিভিন্ন মসজিদ ও মারকাযে বিশেষ দোয়া হল। শেষ আশা মনে করে তার ছেলে এ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে হসপিটালে নিয়ে গেল। একজন ডাক্তার যেকোনো ভাবেই হোক বুঝলেন যে, তার পিত্তথলির নাড়ীর মধ্যে পাথর হয়েছে। মুখের মধ্যে পাইপের মতো যন্ত্রপাতি ঢুকিয়ে তিনি নালীর মধ্য থেকে পিত্তপাথর ভেঙ্গে বের করে আনলেন এবং মনির ভাই ভালো হয়ে এক মাস পর বাড়ি ফিরলেন। কিন্তু এক বৎসর পর আবার পূর্বের অবস্থা ফিরে আসে এবং তিনি আবারও ঢাকায় যেয়ে পিত্তপাথর ভাঙ্গিয়ে আনেন। কিন্তু তারপরও তার পেট প্রায় সব সময়ই ফুলে থাকত এবং দৈনিক একগাদা ওষুধ খেতে হত। পেটের উপর কোনো কাপড় রাখতে পারতেন না। পাবনা মারকাযে আসাও অনিয়মিত হয়ে গেল এবং বাইরে যাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল। খুবই সামান্য কিছু পাতলা খাবার অনেক বেছে খেতে হত।
অসুখ শুরুর প্রথম দিকেই তিনি একদিন স্বপ্নে দুইটা মহিষ দেখেছিলেন। একটা আরেকটাকে বলছিল, আমাদের সদকা করে দিলেই তিনি ভালো হয়ে যাবেন। এদিকে ইয়েমেনের সফর তখন সম্ভবত আর হবে না এমন পর্যায়ে চলে গেছে। সোয়াদ হবার পর প্রায় বছর ঘুরে আসছে, হঠাৎ তার ঐ স্বপ্নের কথা মনে পড়ল। তিনি তখন সফরের জন্য গচ্ছিত টাকা দিয়ে একটি বড় মহিষ কিনে সদকা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সবচেয়ে অবাক ঘটনা ঘটল যখন মহিষটি জবাই করা হয়। তিনি ক্লান্ত হয়ে ঘরে এসে শুয়েছেন, বাইরে মহিষ জবাই করার হৈ চৈ হচ্ছে। মহিষটা জবাই করার সঙ্গে সঙ্গে তার পেটের মধ্যে খুব জোরে মোচড় দিয়ে ওঠে এবং প্রচণ্ড শব্দে পেটের বাতাস বের হয়ে যায়। তারপর থেকে তিনি মোটামুটি সুস্থ।
আমরা সবাই অবাক বিস্ময়ে তার ঘটনা শুনছিলাম। প্রথম যখন কাকরাইলে আসি তখন তার কাছে প্রচুর ওষুধ ছিল। পেটটা তখনও উঁচু এবং পেটের উপরে লুঙ্গি ঢিলে করে পড়তেন। খেয়াল করে দেখলাম, পেট এখন প্রায় স্বাভাবিক এবং লুঙ্গিও পরে আছেন বেশ স্বাভাবিকভাবে। অনেকদিন হল আমাদের সঙ্গে সব ধরনের খাবারই খাচ্ছেন। প্রথম প্রথম তাকে অনেক ওষুধ খেতে দেখেছি, ইদানীং কোনো সময়ই তাকে ওষুধ খেতে দেখি না।
আমাদের এবারের গন্তব্য সামালী দ্বারে ফাহাম মসজিদ। সকালের নাস্তা শেষ করেই দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার-এর জন্য আমরা তৈরি। বাহনও এসে হাজির। সুতরাং মরুর ধুলা উড়িয়ে কারাভার যাত্রা হল শুরু।
সামালিতে আমাদের মসজিদের সঙ্গেই একটা মরু টিলা। একটু বাতাস হলেই বালু এসে মসজিদ ভরিয়ে দেয়। সুতরাং ঐ দিকের জানালা প্রায় সময় বন্ধ রাখতে হয়। স্থানীয় সাথী মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া ভাই মসজিদেই ছিলেন। খুবই পরিশ্রমী ও কোরবানি করা সাথী, মাস্তুরাতসহ চিল্লাও দিয়েছেন। দিন রাত দুই ছেলেসহ আমাদের খেদমতে থাকতেন। খাওয়ারও ব্যবস্থা তার বাড়িতেই। আমরা নিজেরা কোনো ভাবেই তাদের নিবৃত্ত করতে পারলাম না। এলাকার পুরা জামাত একমত হয়ে তাকে দায়িত্ব দিয়েছে এবং উনি তো হাসিমুখে পালন করছেন।
এখানে মুরুব্বীরা ছাড়া দশ পনরটি ছোটবড় ছেলে প্রায় সব সময়ই আমাদের সঙ্গ দিল। সুতরাং একটু পরপরই কেউ না কেউ এসে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে আমার কাছে কিছু জানতে বা বলতে চাইত।
মানুষের উপস্থিতি প্রতিটা বয়ানেই নজর কাড়ার মতো। কিছুক্ষণ পরপর কেউ এসে জিয়ারা করার জন্য ডাকে। মসজিদের সামনেই একটা ল্যান্ড রোভার গাড়ি দাড়িয়ে ছিল, মালিক সৌদি আরবে চাকরী করেন। নাম ইয়াছিন। প্রথম দিন তার কাছে গিয়ে কোন পাত্তাই পেলাম না। তিনি এসব একদম পছন্দ করেন না এবং তার মোটেই সময় নেই এ রকম বলে পত্রপাঠ বিদায় করলেন।
দ্বিতীয় দিন তিনি বাদ মাগরিব কিছু সময় বয়ানে বসলেন। তৃতীয় দিন বাদ এশা খুছুছি গাস্তে আবার তার কাছে গেলাম। কিছু কথা বললেন এবং বয়ান শুনেছেন তাও বললেন। সকালেও বসবেন বলে কথা দিলেন। সকালের যাত্রায় মোহাম্মদ আলী বুন ভাই তার গাড়িতে আমাদের লিফট দেবেন কথা ছিল, কিন্তু ইয়াছিন সাহেব আমাদের নাস্তার মধ্যেই এসে হাজির। তিনি আমাদের তার গাড়িতে লিফট দিতে চান। আমির সাহেব জানিয়ে দিলেন আমাদের জন্য গাড়ি আসবে একটু পরেই। তিনি নাস্তা করতে যেতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু আমির সাহেবের কথাশুনেই মত পাল্টিয়ে বললেন যে, নাস্তা তিনি ফিরে এসে করবেন, কিন্তু তিনিই আমাদের লিফট দেবেন। এই বলে নিজেই গাড়ি গেটে এনে দাঁড় করালেন। স্থানীয় সাথীদের সঙ্গে পরামর্শ করে শেষ পর্যন্ত এই গাড়িতে যাওয়াই ঠিক করা হল। মালসামানা তিনি নিজেই গাড়িতে গুছিয়ে রাখলেন এবং আমাদের নিয়ে মরুর পথ পাড়ি দিতে লাগলেন।
সুযোগ পেলেই সময় লাগাবেন বলে কথা দিলেন এবং পরবর্তীতে বাড়ি এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। পথ ছিল বেশ দীর্ঘ। বিভিন্ন গল্পের একপর্যায়ে আমাদের ওমরা করার আকাঙ্খার কথা তিনি শুনলেন। নিজে থেকেই বললেন, আমরা যদি রাজি থাকি এবং যাওয়ার তারিখ জানাই তাহলে তিনি নিজে এসে আমাদেরকে ওমরা করতে নিয়ে যাবেন। কথাবার্তার মাঝে মসজিদে পৌঁছে গেলাম। তিনি নিজ বাড়িতে ফিরে গেলেন।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)