এক জ্যোতির্ময় তারকা
হযরত মুআবিয়া [রা.]। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় সাহাবীগণের মুবারক কাফেলার এক মহান ব্যক্তিত্ব। যার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রাণভরে এ দুআ করেছিলেন- ‘হে আল্লাহ! তাকে পথপ্রাপ্ত ও পথ-প্রদর্শক করে দিন এবং তার মাধ্যমে মানুষকে হেদায়েত দান করুন।’ তিনি ইসলামী ইতিহাসের প্রথম নৌবহর প্রতিষ্ঠার অনন্য গৌরবের অধিকারী। এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুসংবাদ হল- ‘আমার উম্মতের যে প্রথম সৈন্যদলটি নৌ অভিযানে অংশ নেবে তাদের জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে।’ হযরত ওমর [রা.] তাঁর সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন- ‘যে কুরাইশী যুবক চরম ক্রোধের মুহূর্তেও হাসতে পারে, যার হাত থেকে স্বেচ্ছায় না দিলে কিছু ছিনিয়ে আনা অসম্ভব এবং যার শিরস্ত্রাণ পেতে হলে পায়ে লুটিয়ে পড়া ছাড়া উপায় নেই।’ অর্থাৎ সহনশীলতা,সাহসিকতা ও আত্মসম্মানবোধে এ যুবক অতুলনীয়। হযরত মুআবিয়া [রা.] নিজেও বলতেন- ‘ক্রোধ হজম করায় আমি যে স্বাদ পাই, তা অন্য কিছুতেই নেই।’ তিনি ছিলেন স্মিত, স্নিগ্ধ স্বভাবের অধিকারী।
নবীজীর সুন্নত হিসেবে মাঝে মাঝে নির্দোষ কৌতুকও তিনি করতেন। একবার এক স্বপ্নবিলাসী ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে বলল, আমি একটা ঘর বানাচ্ছি, আমাকে সাহায্য করুন। আপাতত কাঠ তৈরির জন্য বার হাজার গাছ দান করুন। হযরত মুআবিয়া [রা.] জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় বানাচ্ছ? লোকটি বলল, বসরায়। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তা তোমার ঘরটির দৈর্ঘ-প্রস্থ কত? সে বলল, দু’মাইল তো হবে। হযরত মুআবিয়া [রা.] হেসে বললেন, তাহলে আমার ঘর বসরা না বলে বল গোটা বসরায় আমার ঘরে।’
হযরত আলী [রা.]-এর মর্মান্তিক শাহাদাতের পর তাঁর শাসনকালই ছিল ইসলামের সোনালী ইতিহাসের উজ্জ্বলতম যুগ। তিনি তাঁর শাসন নীতি প্রসঙ্গে বলেছেন, যেখানে চাবুকে কাজ হয় সেখানে আমি তলোয়ার বের করি না। তেমনি যেখানে মুখের কথায় কাজ হয় সেখানে চাবুক বের করি না। কারো সাথে সামান্য পরিমাণ সম্পর্ক থাকলেও তা আমি ছিন্ন হতে দেই না। মানুষ যখন টেনে ধরে তখন আমি ঢিল দিয়ে বসি, আর ওরা যখন ঢিল দেয় তখন আমি টেনে ধরি।
হযরত মুআবিয়া [রা.]-এর সুন্দর চরিত্রের অসংখ্য ঘটনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়। একবার হযরত আলী [রা.]-এর সাথে তাঁর রাজনৈতিক কিছু ব্যাপার নিয়ে মতদ্বন্দ্ব হলে এক পর্যায়ে তা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের রূপ নিল। মুসলিম উম্মাহর এ দুঃখজনক পরিস্থিতির সুযোগে রোমসম্রাট অতি সংগোপনে যুদ্ধ প্রস্ত্ততিতে মেতে ওঠে। সংবাদ পেয়ে হযরত মুআবিয়া [রা.] রোম সম্রাটকে চরম হুঁশিয়ারি দিয়ে লিখেছিলেন- আমি জানতে পেরেছি, তুমি আমাদের সীমান্তে সৈন্য প্রেরণের মতলব অাঁটছ । কিন্তু শুনে রাখ, তখন আমি মুহূর্ত বিলম্ব না করে আমার ভাইয়ের সাথে সন্ধিতে উপনীত হব এরপর তোমার বিরুদ্ধে যে বাহিনী তিনি পাঠাবেন তার প্রথম কাতারে শামিল হয়ে আমি কনষ্টান্টিনোপলকে ছাই-ভষ্মে পরিণত করে ছাড়ব। সুতরাং পত্র-পাঠ-অন্তে বিলকুল ভালমানুষ বনে যাও। সত্যিই রোম সম্রাট পত্র পাঠান্তে সে মতলব ত্যাগ করেছিল। কেননা সে বুঝতে পেরেছিল কুফরের মোকাবেলায় এ জাতি এখনো একদেহ, একপ্রাণ।
এই সেই মুআবিয়া [রা.] যাকে সাহাবা-সমালোচকরা সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করেন। কিন্তু তাদের একটা কথা জেনে রাখা উচিত, আজকের মুসলিম উম্মাহ যদি মুআবিয়া [রা.]এর চরিত্রে চরিত্রবান হতে পারত তাহলে তারা এত লাঞ্ছিত হত না। হযরত বারী বিন নাফে [রহ.] বলেন, হযরত মুআবিয়া [রা.] হলেন রাসূল-সাহাবীদের রক্ষাকারী আবরণ। এ আবরণ কেউ ছিন্ন করলে অন্যদের বেলায়ও সে দুঃসাহসী হয়ে উঠবে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক [রহ.]কে যখন জিজ্ঞাসা করা হল, ‘কে উত্তম? হযরত মুআবিয়া [রা.], না হযরত ওমর বিন আব্দুল আযীয [রহ.]?’ তখন তিনি সাফ জবাব দিলেন, মুআবিয়া [রা.]-এর নাকের ধুলিকণাও হযরত ওমর বিন আব্দুল আযীযের চেয়ে উত্তম। হযরত ইবরাহীম বিন মায়সারা [রহ.] বলেন, উমর বিন আব্দুল আযীয [রহ.]কে কোনদিন কারো গায়ে হাত তুলতে দেখিনি। তবে হযরত মুআবিয়া [রা.]-এর সমালোচনার অপরাধে এক ব্যক্তিকে চাবুক লাগাতে দেখেছি। #