রবিউল আউয়াল ১৪২৯   ||   মার্চ ২০০৮

ছাত্রদের প্রতি বাইতে উম্মে হানী থেকে

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

বাইতে উম্মে হানী [রহ.] অনেক আগেই মসজিদে হারামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। হজ্ব-ওমরার মৌসুমে সেখানে আকাবির ও মাশায়েখের অবস্থান লক্ষ করা যায়। বিগত সফরে সেখানে একজন ছাহেবে দিল বুযুর্গকে বারবার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, যাঁকে আল­াহ তালীম ও তারবিয়তের বিশেষ যোগ্যতা দান করেছেন। একদিন ফজরের পর দেখি, তিনি ফোনে তাঁর এমন শাগরিদদের খোঁজখবর নিচ্ছেন, যারা খেদমতের অঙ্গনে প্রবেশ করেছে। তাদেরকে কিছু মূল্যবান নসীহতও করছিলেন। আমি তখনই কিছু নসীহত লিপিবদ্ধ করেছি। আর এখন তা পেশ করছি আমার তালেবে ইলম ভাইদের জন্য-

১. সর্বদা নিজের দায়িত্ব আদায়ে সচেষ্ট থাকবে। অন্যের যে হক তোমার উপর রয়েছে সেগুলো আদায় করে যাওয়াই হচ্ছে প্রথম কাজ। নিজের হক উসুল করতে সচেষ্ট হওয়া ঝগড়া-বিবাদ ও মনোমালিন্য সৃষ্টি করে। যদ্দূর সম্ভব এ থেকে বেঁচে থাকা উত্তম।

২. ইলম ও আমল উভয় ক্ষেত্রে সমান গুরুত্বের সাথে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা কর। আমলের ক্ষেত্রে যেন কোনো গাফিলতি না হয় সেদিকে সযত্ন দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখ।

৩. আখলাক সুন্দর করার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দাও। রাসূলুল­াহ সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­ামের আখলাকের আলোকে নিজ আখলাক দুরস্ত করার চেষ্টা কর।

৪. সর্বদা তালেবে ইলম হয়ে থাক। কখনো নিজেকে মুয়ালি­ মনে করবে না। এটা যদি করতে পার তাহলে আল­াহ তাআলা একদিন তোমাকে মুয়ালি­মের আসনে অধিষ্ঠিত করবেন। আর যদি তোমার মনে এ ধারণা এসে থাকে যে, মুয়ালি­ হয়ে গিয়েছি, তাহলে বিশ্বাস কর, এখনো তোমার মধ্যে পূর্ণতা আসেনি।

৫. তালেবে ইলমের জন্য তালেবে ইলম হয়ে মেহনত কর। [আশা করি এই বাক্যটি নিয়ে ভাববে]।

৬. সর্বদা সুধারণা পোষণের অভ্যাস গড়ে তোল। মন্দ ধারণা থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকবে, বিশেষত আসাতেযা ও বড়দের সম্পর্কে।

আমলের গুরুত্ব নির্ণিত হয় শুধু সওয়াবের বিবেচনায় নয়, উপকারিতা ও ফলাফলের বিচারেও।

উপরের প্রতিটি নসীহত অতি মূল্যবান, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো যদি ব্যাখ্যা-বিশে­ষণের সাথে আলোচনা করা হয় তবে প্রত্যেকটির জন্য আলাদা প্রবন্ধ প্রয়োজন হবে। এ আলোচনায় আমি শুধু দ্বিতীয় ও তৃতীয় নসীহতের উপর কিছু কথা পেশ করছি।

দ্বিতীয় নসীহতটি ছিল- ইলম ও আমল উভয় ক্ষেত্রে সমান গুরুত্বের সাথে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা কর। আমলের ক্ষেত্রে যেন কোনো গাফিলতি না হয় সেদিকে সযত্ন দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখ।

আমলের ক্ষেত্রে মেহনতের প্রথম পর্যায় হল ফরজ-ওয়াজিবগুলো যত্নের সাথে আদায় করা। এগুলোতে ইখলাস পয়দা করা, রূহ পয়দা করা এবং সুন্নত মোতাবেক আদায় করতে সচেষ্ট হওয়া। আর দ্বিতীয় পর্যায় হল, সাধ্যমতো তেলাওয়াত, আযকার, আদইয়া এবং নাওয়াফেলের পাবন্দি জারি রাখা।

উপরোক্ত দুক্ষেত্রেই আমাদের গাফিলতি রয়েছে। ফরজ-ওয়াজিব ইবাদতে ইখলাস ও খুশু-খুযু সৃষ্টির বিষয়ে মনোযোগ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। আর তেলাওয়াত, আযকার-আদইয়া ও অন্যান্য নফল ইবাদতের ক্ষেত্রে আমাদের মানসিকতা- আল­াহ মাফ করুন- অনেকটাই নেতিবাচক। আমাদের ধারণা- এগুলো তো ফরজ-ওয়াজিব নয় আর এগুলো আদায় না করলে শাস্তিও নেই। এই নেতিবাচক চিন্তাধারা একজন মুমিনের পক্ষে শোভনীয় নয়। মুমিনের মানসিকতা ইতিবাচক হওয়া উচিত। একজন সচেতন মুমিনের ভাবনা এমন হয় যে, এসব আমলের মাধ্যমে আল­াহ তাআলা সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন এবং বিনিময়ে সওয়াব দান করে থাকেন। অতএব এসব বিষয়ে আমাকে যত্নবান হতে হবে।

এরচেয়ে বড় কথা এই যে, কোনো আমলের গুরুত্ব শুধু সওয়াবের বিবেচনায় হয় না; ওই আমলের উপকারিতা ও ফলাফলও এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব রাখে। নিছক আইনি দৃষ্টিভঙ্গি যদিও এই রায় দেয় যে, নাওয়াফেল, আযকার ও আদইয়া পরিত্যাগ করায় কোনো গোনাহ নেই। খুব বেশি হলে কিছু সওয়াব হাতছাড়া হবে। [একথাটাও সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। দেখুন, আলমুয়াফাকাত, শাতিবী খ. == পৃ. ==]

কিন্তু ভেবে দেখা প্রয়োজন যে, এ ধরনের নেতিবাচক মানসিকতার কারণে আমরা কত সওয়াব থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। সবচেয়ে বড় ক্ষতি এই হচ্ছে যে, এসব আমলের মাধ্যমে আমাদের ঈমান, আমল, ইলম, ফাহম এবং জীবন ও চরিত্রের ওপর যে উপকারী প্রভাব ছায়া বিস্তার করত তা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। তেমনিভাবে বিভিন্ন সময় ও অবস্থার দুআগুলোর উপর যদি আমাদের আমল না থাকে তাহলে আমরা একথা বলে নিজেদেরকে বুঝ দেই যে, এটা একটা মুস্তাহাব বিষয়, ছুটে গেলে গোনাহ নেই! কিন্তু চিন্তা করি না, এভাবে আমরা এই দুআগুলোর উপকারিতা থেকে বঞ্চিত হলাম।

এই দুআগুলো তাওহীদ, তাওয়াক্কুল, তাফভীয ও ইনাবাত ইলাল­াহ পয়দা করে। এগুলোর মাধ্যমে বান্দা আল­াহ তাআলার রহমত লাভ করে। এগুলো মাগফেরাত লাভ, হাজত পূরণ, বালা-মসিবত থেকে মুক্তি এবং দরজা বুলন্দির ওসীলা। এগুলোর মাধ্যমে অন্তরে আসে নূরানিয়ত, শোকরগোযারি এবং বিনয়-নম্রতা। আর এ বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জিত হলে সে কলব ইলমে ওহী ধারণ করার উপযুক্ততা লাভ করে। এই সকল উপকারিতা থেকে আমরা নিজেদের শুধু একথা বলে বঞ্চিত করে দিলাম যে, এগুলো হচ্ছে আদাব শ্রেণীর বিষয়। এগুলো পরিত্যাগ করায় গোনাহ নেই। ইলমে ওহীর একজন তালেবের মানসিকতা অবশ্যই এরচেয়ে অনেক বেশি উঁচু হওয়া প্রয়োজন।

সকাল-সন্ধ্যার তাসবীহাত, ইস্তেগফার ও দরূদ শরীফ সম্পর্কেও একই কথা। আর কুরআন মজীদ তেলাওয়াতের বিষয়টি তো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তেলাওয়াত থেকে গাফেল হওয়ার অর্থ হচ্ছে আল­াহ তাআলার সঙ্গে কথোপকথনের সৌভাগ্য সম্পর্কে গাফেল হওয়া, আর ওই ইলম থেকে গাফেল হওয়া যা হাসিল করার জন্য আমরা জীবন ওয়াক্ফ করেছি। আশ্চর্য নয় কি-  ইলম অন্বেষণ, এরপর প্রকৃত ইলম থেকেই গাফিলতি?

নফল নামায সম্পর্কেও এভাবে বিচার করা উচিত নয় যে, ইশরাক পড়লাম না তো ইশরাকের সওয়াব থেকে বঞ্চিত হলাম; বরং বিবেচনা করুন, ইশরাকের মাধ্যমে আল­াহর যে নৈকট্য অর্জিত হত, অন্তরে যে নূরানিয়ত সৃষ্টি হত ইলমে ওহীর জন্য আল­াহর রহমত বর্ষিত হত আর গোটা দিনের সমস্ত বিষয়ে আল­াহ তাআলার জিম্মাদারির ছায়া লাভ হত-এই সব বিষয় থেকে বঞ্চিত হলাম।

আমার দৃঢ় আস্থা রয়েছে, আমরা যদি এভাবে ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনায় অভ্যস্ত হই যা শরীয়তেরই তাকাযা, তাহলে ইনশাআল­াহ আমলের ক্ষেত্রে উপরোক্ত শিথিলতা থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে।

 

আখলাক দুরস্ত করা ফরজ না মুস্তাহাব

তৃতীয় নসীহত ছিল ইলসাহে আখলাক সম্পর্কে। এ বিষয়েও আমাদের অনেকের এই ধারণা রয়েছে যে, আখলাকের প্রশ্নটি হচ্ছে উত্তম-অনুত্তমের প্রশ্ন এবং এ পর্যন্তই হল এর গুরুত্বের পরিধি। এ ধারণা ঠিক নয়। আখলাকে যাহেরা [বাহ্যিক আচার-ব্যবহার] ও আখলাকে বাতেনা [অন্তর্জগতের বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা] দুটোই দুরস্ত করা ফরয। যার আখলাক দুরস্ত নয় সে কখনো হুকূকুল ইবাদ পূর্ণরূপে আদায় করতে সক্ষম হবে না। আর বিভিন্ন গোনাহর শিকার হবে। এজন্য ইসলাহে আখলাক হলে ভাল জাতীয় বিষয় নয়; বরং তা মাকাসিদে শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরয।

তালেবে ইলমদের জন্য তো ইসলাহে আখলাকের অপরিহার্যতা আরো অধিক। কেননা, যে ইলমের অন্বেষায় আমরা তালেবে ইলম তা অতি নাযুক ও আত্মাভিমানী। তাকে ধারণ করার উপযুক্ত গুণাবলি যার মধ্যে নেই, নবী করীম সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­ামের আখলাকে হাসানা ও সীরাতে তাইয়েবার ছায়া যার মধ্যে নেই তার নিকটে অবস্থান করতে এই ইলম আগ্রহী নয়।

কুরআনে মজীদের আয়াতে তহারাতে যাহেরার সাথে তহারাতে বাতেনার প্রতিও ইঙ্গিত রয়েছে। আর অভিজ্ঞতাও বলে যে, তহারাতে বাতেনা [অন্তরের পরিশুদ্ধি এবং কর্ম ও চরিত্রের সংশোধন] ছাড়া ইলমের রূহ- তাফাক্কুহ ফিদ্দীন ও রুসূখ ফিল ইলম হাসিল হয় না।

আল­াহ তাআলা আমাকে এবং আমাদের সবাইকে এই নসীহতগুলোর উপর আমল করার তাওফীক দিন। আমীন।#

 

 

advertisement