মেরী ইলমী ও মুতালাআতী যিন্দেগী
তালেবে ইলম যিন্দেগির একেবারে গোড়ার দিকে, যখন আমার উর্দূ ভাষার প্রাথমিক পড়াশোনা চলছিল, তখন যে কিতাব স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহে অধ্যয়ন করেছি আর গভীরভাবে আলোড়িত হয়েছি তা হচ্ছে কাযী সুলায়মান মানসূরপূরীকৃত ‘রাহমাতুলিল আলামীন’-এর প্রথম খন্ড। ওই সময়ের অনুভূতি আমি কখনো ভুলব না। আমার স্পষ্ট মনে আছে- আরও কিছু কিতাবের সাথে যখন ওই কিতাবের দু’টি খন্ড ভিপিযোগে রায়বেরেলী পৌঁছল, কিন্তু তা ওঠানোর মতো অর্থ সে সময় ছিল না, তখন আমি মজবুর হয়ে কাঁদতে শুরু করি। অবশেষে টাকার ব্যবস্থা হয়েছিল এবং কিতাবটি আমার হাতে পৌঁছেছিল।
কিতাবটি বার বার পড়েছি। একাধিক স্থানে এবং একাধিক বার এমন হয়েছে যে, হৃদয়ের অবাধ্য আবেগ আর চোখের তপ্ত অশ্রু বাঁধার সকল বাঁধ পাবিত করেছে। বিশেষ কিছু স্থানের অসাধারণ প্রভাব সর্বদাই অনুভব করেছি।
ইসলামের প্রথম যুগের ঘটনাবলি, হযরত মুসআব ইবনে উমায়ের [রা.]-এর ইসলামপূর্ব বিলাসী জীবন আর ইসলামউত্তর ত্যাগ-তিতিক্ষা; রাসূলুলাহ সালালাহু আলাইহি ওয়াসালামের মদীনায় আগমন আর আনসারীদের আনন্দ-উদ্দীপনা, ত্যাগ ও কুরবানী, মুহাজিরগণের সঙ্গে তাদের দ্বীনী মুহাববত; রাসূলুলাহ সালালাহু আলাইহি ওয়াসালামের ওফাত এবং এ সময়ের বিভিন্ন ঘটনা যখনই পড়েছি হৃদয় মথিত ও আলোড়িত হয়েছে।
তখন আমি চলতে ফিরতেও এ কিতাব পড়তাম এবং অন্যদের পড়ে শোনাতাম। আর কিশোর-মনে ওই পবিত্র জীবনের সবুজ তামান্না পলবিত হয়ে উঠত।
কাযী সুলায়মান ছাহেবের মর্তবা আলাহ বুলন্দ করুন। তিনি যদি এ জগতে থাকতেন তাহলে তাঁর কাছে গিয়ে নিবেদন করতাম, জনাব, আপনার কিতাবের আমার উপর অনেক বড় অনুগ্রহ- এ কিতাব আমাকে পরিচিত করেছে চির নবীন প্রেরণার উৎস ‘হুবেব নবী’ সালালাহু আলাইহি ওয়াসালামের সঙ্গে, যা ছাড়া এ জগৎ-সংসার শুষ্ক প্রাণহীন তৃণখন্ডের চেয়ে বেশি কিছু নয়।
در خرمن كائنات كرديم نگاہ # يك دانہ محبت است باقى ہمہ كاہ
এর কিছুকাল পর হাতে এল মাওলানা শিবলী মরহুম-এর কিতাব ‘আলফারূক’। কানপুর মাতবা নামী থেকে প্রকাশিত। এ কিতাবও বার বার পড়েছি। ইরাকের বিভিন্ন যুদ্ধে- বুয়াইব, জিস্র, কাদিসিয়্যা প্রভৃতি রণাঙ্গণে মুসলিম মুজাহিদীনের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের যে চিত্র মাওলানা অঙ্কন করেছেন তার সহজ-সাবলীল ছোট ছোট বাক্যে, তা বোধ করি, ইরানী কবি ফেরদৌসী শাহনামা কাব্যের পংক্তিমালায় কঠিন কঠিন শব্দ আর রূপকথার আতিশয্য দিয়েও অঙ্কন করতে সক্ষম হননি।
আলফারূক-এর জীবন্ত বাক্যমালা হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করত ধারালো তরবারীর মতো। রচনাটির ঘটনা-অংশের প্রভাব এখনো দিল-দেমাগে অনুভব করি। তবে একথাও বলি- খিলাফত-ব্যবস্থা সম্পর্কে মাওলানা যে আলোচনা করেছেন তা বোঝার যোগ্যতা সে সময় ছিল না, আর এখন তাতে কোনোরূপ আগ্রহ বোধ করি না বা তার কোন প্রভাবও গ্রহণ করিনি।
তাঁর দ্বিতীয় রচনা, যা সে সময় পড়েছি- ‘সফরনামায়ে রোম, মিসর ও শাম।’ এ দুটো রচনাই আমাদের পলীর সংক্ষিপ্ত কুতুবখানায় বিদ্যমান ছিল। শেষোক্ত রচনা আমার জ্ঞানের পরিধি অনেক বিস্তৃত করেছে। আর হয়তো এ কিতাবের পৃষ্ঠা থেকেই অঙ্কুরিত হয়েছিল কিশোর-মনে মুসলিমজাহান-ভ্রমণের অভিলাষ, যা পূরণ হয়েছে অনেক বছর পরে।
কিছু দিন পর হাতে পেলাম মাওলানার জীবনীমূলক রচনা- ‘আলগাযালী’, ‘সাওয়ানেহে মাওলানা রূম’ ‘আলমামূন’ ইত্যাদি। সম্ভবত সে সময় থেকেই আমার অনুভূতি- জীবনী রচনায় এরচেয়ে উত্তম শৈলী আধুনিক উর্দূ ভাষায় আর নেই। ফলে অবচেতনভাবেই তা অনুসৃত হয়েছে আমার রচনা- তারীখে দাওয়াত ওয়া আযীমত এবং অন্যান্য জীবনী-গ্রন্থে।
দুঃখের বিষয় এই যে, মাওলানার ‘শে‘রুল আজম’ পড়ার সুযোগ হয়েছে অনেক পরে। আমি মনে করি, এটি এ বিষয়ে অতুলনীয় রচনা এবং মাওলানার জীবন্ত কীর্তি। এ গ্রন্থের অধ্যয়ন বিলম্বিত হওয়ার পেছনে দায়ী সম্ভবত আমার ফার্সী ভাষার দুর্বলতা।
মুহতারাম চাচাজান সাইয়েদ তলহা হাসানী ছাহেব এমএ লাহোর ওরিয়েন্টাল কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে ‘আবে হায়াত’ সম্পর্কে জানতে পারি। এ গ্রন্থের বিভিন্ন অংশের আলোচনা শুনেছি এবং নিজেও তা বার বার পড়েছি। ফলে সাহিত্য-জগতের সাথে স্থাপিত হয়েছিল সহজ-স্বাভাবিক সম্পর্ক। উর্দূ ভাষার বহু কবি ও কবিতা, সাহিত্যিক ও সাহিত্যকর্মের সাথে স্মৃতির এমন সহজ পরিচয় গড়ে উঠেছিল যেমন শৈশবের বিভিন্ন ঘটনা স্মৃতির ফলকে খোদিত হয়ে যায়। ফলে কখনো এ বিষয়গুলো স্মৃতিতে চাপ সৃষ্টি করেনি।
‘গুলে রা‘না’ ছিল গৃহের সম্পদ। এ গ্রন্থ এতবার পড়েছি এবং উর্দূ কাব্য-সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে এতদূর জানাশোনা হয়েছিল যে, এ বিষয়ে আলোচনা করার এবং মজলিসী আলোচনায় অংশ নেওয়ার সাহস ও যোগ্যতা অর্জিত হয়েছিল।
আমার আপন মামাতো ভাই মৌলভী সাইয়েদ আবুল খায়ের বার্ক লখনৌর প্রমিত উর্দূ বলতেন এবং লিখতেন। লখনৌর পরিভাষা এবং ভাষাগত সৌন্দর্য ও বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে তাকে ‘সনদ’ গণ্য করা হত। প্রথম দিকে রচনা দেখাতেন শাম্স লাখনোভীকে। এরপর আগা ছাকিব কিশিল্বাশ লাখনোবীর শীষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাকেই অনুকরণ করেন।
তার সাহচর্যে ভাষার রুচি এবং সাহিত্য-বিচারের যোগ্যতা অর্জিত হয়েছে। তার অনুজ সাইয়েদ হাবীবুর রহমান ছিলেন জামিয়া মিলিয়ার ছাত্র। উর্দূ ভাষার কবি-সাহিত্যিকদের সম্পর্কে তারও বিশেষ আগ্রহ ছিল। তার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, নবীনদের সাথে প্রবীণদের কবিতা আলোচনা করতেন। মুমিন, গালিব, যাওক আর লাখনৌর কবিদের মধ্যে আতিশ ও আমীর মীনায়ী ছিলেন তার পছন্দের তালিকায়। ফলে এঁদের কবিতা শুনতে ও তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে আমরা অভ্যস্থ হয়ে উঠেছিলাম।
এ সময় ‘উধ’ অঞ্চলে মুশায়ারার [কাব্যযুদ্ধ] বেশ প্রচলন ছিল। আমাদের ক্ষুদ্র পলীতেও কয়েকটি মুশায়ারা হয়েছে। অন্যদের দেখাদেখি আমিও কিছু পংক্তি ছন্দবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু, আলাহ জাযায়ে খায়ের দান করুন বড় ভাইজানকে, তিনি অত্যন্ত কঠোরভাবে এ ধারায় বাঁধ সেধেছিলেন। ফলে এ অর্থহীন কর্ম আর সামনে অগ্রসর হয়নি।
রায়বেরেলীতে এক প্রিয়জনের কিছু ব্যক্তিগত সংগ্রহ ছিল। সেখানে পেয়েছি মৌলভী মুহাম্মাদ হুসাইন আযাদের ‘নায় রঙ্গে খায়াল’। আযাদের গদ্য ছন্দময় গদ্যের সুন্দর নমুনা। উর্দূ সাহিত্যের প্রাথমিক চর্চায় তার গদ্যশৈলীর অনেক প্রভাব গ্রহণ করেছি। ‘আবে হায়াত’ ও ‘নায় রঙ্গে খায়াল’-এর অনুকরণে বহু পৃষ্ঠা মসিলিপ্ত করেছি। প্রতিভার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এতে বেশ সুফল অনুভূত হয়েছে।
ওই বয়সটা ছিল সকল মুদ্রিত বস্ত্ত পাঠের বয়স। এ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে আমিও সব ধরনের বস্ত্ত পাঠ করেছি। শারার মরহুম ও রতননাথ সরশার-এর কিছু রচনাও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। অভিজ্ঞজনেরা বলেন, পঠিত বস্ত্ত সম্পূর্ণ বিস্মৃত হলেও তার কিছু না কিছু ছাপ মন-মানসে থেকে যায়। তাই এ দাবি করা সঙ্গত নয় যে, ওই রচনাগুলো দৃষ্টির সীমানা অতিক্রম করে ভেতরে প্রবেশ করেনি। তবে এখন সেগুলোর বিশেষ কোনো প্রভাব মনে পড়ছে না।
প্রবন্ধ-সাহিত্যে প্রথম রাহবর ওয়ালিদ মরহুমের ‘ইয়াদে আয়্যাম’। রচনাটি মার্জিত ভাষার একটি মনোরম দৃষ্টান্ত। এতে ইতিহাসের ভাব-গাম্ভীর্য ভাষার লালিত্যের সাথে এক মোহনায় মিলিত হয়েছে। আমার বিবেচনায় বিষয়টি ‘গুলে রা‘না’র রচয়িতা আর নওয়াব সদর ইয়ার জঙ্গ মাওলানা হাবীবুর রহমান খান শেরওয়ানীর গদ্যশৈলীর যৌথ সম্পদ। এর অনুকরণে আমার প্রথম প্রবন্ধ- যদ্দূর মনে পড়ে- ‘আন্দালুস’ সম্পর্কে ছিল।
[চলবে, ইনশাআলাহ]