ইসলামের বিধান, রাষ্ট্রীয় আইন এবং মুসলমানদের করণীয়
গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় মুসলিম কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অফিস চলাকালীন তিন ওয়াক্ত নামায অফিস নির্ধারিত নামাযকক্ষে জামাতের সঙ্গে পড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল এবং এ বিষয়ে নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল। গত ফেব্রæয়ারি মাসের ১৬ তারিখ প্রভাবশালী একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বাংলা পোর্টালে নেতিবাচকভাবে এ খবরটি প্রথমে প্রকাশ করা হয়। এরপর ওই খবরটিকে অনুসরণ করে আরো বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মচারীদের জন্য নামায কেন বাধ্যতামূলক করা হলÑ এমন একটি প্রশ্নবোধক ভঙ্গি নিয়ে খবর প্রকাশ করা হয়।
দেখা গেছে, মুসলিম কর্মচারীদের জন্য অফিস কর্তৃক কার্যসময়ের মধ্যে নামাযের এই ব্যবস্থাপনার উদ্যোগকে ‘বাধ্যতামূলক’ ভাষা দেওয়া এবং এজাতীয় বাধ্যতামূলক করাকে ‘দেশীয় আইন ও সংবিধান-বিরোধী’ বলার চেষ্টাও করা হয়েছে। তৈরি করা পরিস্থিতির চাপ অনুভব করে এক দিন পর ওই পোশাক কারখানা কর্মচারীদের জামাতে নামায পড়া বিষয়ক নোটিশটি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।
ইসলামের অন্যতম প্রধান রুকনÑনামায পড়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনা ও নির্দেশনার বিষয়টিকে ‘আইন ও সংবিধান-বিরোধী’ বলে আক্রমণ করা এবং পরবর্তী সময়ে এ ধরনের কল্যাণকর উদ্যোগ থেকে একটি কারখানাকে পিছিয়ে আসতে বাধ্য করার মতো এ বিষয়টি নিয়ে এখানে কয়েকটি কথা পেশ করার চেষ্টা করব। প্রথমে আমরা দেখতে চেষ্টা করবÑ কথায় কথায় কোনো একটি বিষয়কে সংবিধান-বিরোধী বলার যে বাছবিচারহীন একটি প্রবণতা দেশের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের মুখে উচ্চারিত হতে দেখা যায়Ñ এর প্রকৃত রূপটি আসলে কী? জরুরি ধর্মীয় ইবাদতের বিষয়ে মুসলিমদের জন্য কোনো নির্দেশনা জারির ঘটনা কি আসলেই সংবিধান-বিরোধী? নাকি এজাতীয় দাবি ও উচ্চারণই বাস্তবতা ও যুক্তির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ? এরপর এ বিষয়ের সংশ্লিষ্ট আরো কয়েকটি কথা তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ।
। এক।
এ বিষয়ে প্রথম কথাটি হল, সংবিধানের মৌলিক আইনের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় ও শাখাগত বিষয়ের জন্য প্রণীত আইনগুলোর মাঝে কখনো কোনো বিরোধ দেখা দিলে সব দেশেই মূল আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করার একটি নীতি স্বীকৃত রয়েছে। এটাকে বলা হয় আইন ও বিধির সামঞ্জস্য বিধান। দুটো হাদীসের বাহ্যিক বক্তব্যে পারস্পরিক বৈপরিত্য লক্ষ করা গেলে মূল বক্তব্যটিকে অনুসরণ করে দুটি বক্তব্যের মাঝে সামঞ্জস্য বিধান করা হয়। এটাকে ইসলামী উলূমের ভাষায় বলা হয়, তাতবীক। এ বিষয়টি সব দেশে এবং সব আইন-কানুনের ক্ষেত্রেই স্বীকৃত। ঠিক তেমনি যে কোনো দেশের সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা সম্পর্কিত কিছু নীতিমালা থাকে। সেই নীতিমালার আলোকে বিভিন্ন ক্ষেত্র ও বিভাগে রাষ্ট্রকে আরো বহু বিধিনিষেধ প্রণয়ন করতে হয়। অনেকসময় ওই মূলনীতির আওতার মধ্যে থেকেই বহু প্রতিষ্ঠানও বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করে থাকে। তখন মূলনীতি ও শাখাগত বিধিনিষেধের মধ্যে সামঞ্জস্য করে নেওয়া হয়। এজন্যই কোনো শাখাগত বিধিনিষেধের শিরোনাম দেখেই হুট করে ‘সংবিধান-বিরোধী’ বা ‘সংবিধানে নেই’ বলে দেওয়া সঠিক নয়। সংবিধানের মূলনীতিতে সব শাখাগত বিধিনিষেধের বিবরণ থাকে না।
কোনো প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নির্দেশনা, ব্যবহার ও বিধিনিষেধের নমুনা দেখেই একথা বলে দেওয়া যায় না যে, এটা রাষ্ট্রীয় আইনে নেই কিংবা এটা সংবিধানপরিপন্থী।
বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথাও আছে, ধর্মীয় স্বাধীনতার কথাও আছে। স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার অধিকারের কথাও আছে। ইসলামে কালেমার পর সবচেয়ে বড় ইবাদত নামায। যথাসময় নামায পড়তে হয়। ইসলামে জামাতের সাথে নামায পড়ার নির্দেশনা রয়েছে এবং নামায পড়ার জন্য এটাই সর্বোত্তম পন্থা। তাই একটা কারখানার মুসলিম কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য জামাতের সাথে নামায পড়ার এই নির্দেশনা ও ব্যবস্থাপনাকে এদেশের সংবিধান অনুযায়ীই ‘সংবিধান-বিরোধী’ বলা যায় না। সংবিধানের মূলনীতির সাথে মুসলমানদের জন্য নামায পড়ার নির্দেশনাকে ‘সংবিধান-বিরোধী’ দাবি করাটা কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না।
এজাতীয় ঘটনার বর্ণনা ও খবরের ভাষায় আরেকটি শব্দ ব্যবহার করা হয়Ñ ‘বাধ্যতামূলক’ করা বা ‘বাধ্য করা’; নেতিবাচকভাবেই এ শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, মুসলমানদের জন্য নামায পড়ার বিষয়টি কোনো প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ‘বাধ্যতামূলক’ করা বা ‘নির্দেশনা’ দেওয়া কি আসলেই ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বাধ্য করা? এটা কি এ যুগের কোনো মানুষ বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আরোপিত ‘বাধ্য-বাধকতা’ নাকি বিধানটি পালন করা মুসলমানদের উপর আগে থেকেই ফরয ও বাধ্যতামূলক? এ যুগের কোনো প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অধীনস্তদের জন্য নামায পড়ার নির্দেশনা জারি করার অর্থ হচ্ছে, মুসলমানদের জন্য আল্লাহ তাআলা কর্তৃক ফরযকৃত বিধানটি পালন করতে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করা। ধর্মীয়ভাবে অবশ্যপালনীয় বিধানটি পালন করতে সুযোগ দেওয়া ও সহযোগিতা করা। অথচ অনেকেই এ বিষয়টি বুঝতে চান না।
কয়েক বছর আগে সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বাতিল করে যখন ধর্মনিরপেক্ষতা বহাল করা হল, তার কিছু দিনের মধ্যেই একটি খবর চোখে পড়েছিল। খবরটি ছিল এমনÑ ‘আলিয়া মাদরাসায় প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রীদের বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না।’ এটাও ছিল ওইজাতীয় প্রান্তিকতামূলক একটি ঘটনার ফল। মূলত মুসলমানদের জন্য যে বিষয়গুলো শরীয়ত কর্তৃক পালন করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, সে বিষয়গুলো পালনে এ যুগের কোনো প্রতিষ্ঠান তার আওতাধীন বা অধীনস্তদের জন্য ‘বাধ্যতামূলক’ করার অর্থ হল, আগে থেকেই বাধ্যতামূলক বিষয়টি পালনে ব্যবস্থাপনাগত সহযোগিতা করা; এটা নতুন করে আরোপ করা কোনো বাধ্যবাধকতা নয়। সংবিধানে নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতার পাশাপাশি ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ধর্মচর্চার স্বাধীনতা বিষয়ক মূলনীতিগুলোকে সামঞ্জস্য করে নিলে এ বিষয়ে যারা ধর্মপালনে প্রাতিষ্ঠানিক নির্দেশনার বিষয়ে সংবিধানকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করে থাকেন, আশা করি তাদের ভুল দূর হবে।
। দুই।
ধর্মপালনে প্রতিষ্ঠানিক কোনো নির্দেশনার বিরুদ্ধে সংবিধানকে টেনে আনা সম্পর্কে আমাদের দ্বিতীয় কথাটি হল, মুসলমানদের জন্য অবশ্য-পালনীয় ধর্মীয় বিধান এবং সংবিধানের কোনো নীতির মধ্যে যদি বিরোধ তৈরি হয় বা তৈরি করা হয় তখন মুসলিম নাগরিকদের মতামত থেকে তাদের ‘প্রাধান্য’ বেছে নিতে দিন। যেমন, আমরা ধরে নিলাম, দেশের কোনো প্রতিষ্ঠান ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য এমন কোনো নীতি বা বিধি চালু করল, যেটা ইসলামী আইন ও শরীয়তেরই বিষয়, আবার অপরদিকে কেউ কেউ মতামত দিলেন যে, ওই নীতি বা বিধিটি সংবিধান-বিরোধী, তখন রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের করণীয় হল, নাগরিকদের জিজ্ঞাসা করা যে, তারা কী করতে চান। এটা প্রায় বিদিত যে, এজাতীয় পরিস্থিতিতে মুসলিম নাগরিকরদের মত ও ভাষ্য হবে ইসলামী বিধি বহাল রাখা হোক এবং সংবিধান সংশোধন করা হোক। তারা এমন বলবেন না যে, শরীয়তের ওই আইন বা বিধিটি বন্ধ বা স্থগিত করা হোক, যেমনটি বলার অধিকার আসলে কারো নেই। অপরদিকে সংবিধান কোনো অমোঘ বিষয় নয়। এটা অনেকবার সংশোধন হয়েছে। নাগরিকদের চাওয়া-পাওয়া বা প্রাধান্য নির্ণয়ের সুবিধার প্রয়োজনে সংবিধান ভবিষ্যতেও সংশোধন করা যেতে পারে।
এ বিষয়ে আমরা স্মরণ করতে পারি যে, ২০০১ সালে উচ্চ আদলতে সুয়োমুটো (স্বপ্রণোদিত) একটি রায় দেওয়া হল যে, দেশে সবরকম ফতোয়া নিষিদ্ধ। এটি ছিল ইসলামী বিধি-বিধানের কার্যকারিতা নিয়ে এক আশ্চর্যরকম ছেলেখেলাপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পাল্টা আপিল করা হয়। এরপর প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের আদালতে ফতোয়ার ‘বৈধতা’ ঘোষণা করে রায় দেওয়া হয় এবং সেখানে কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। সেসব শর্তের একটি হল, ফতোয়ার সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের আইনের বিরুদ্ধে যেতে পারবে না। সেই রায়ের আরেকটি ভাষ্য এরকম; যথাযথ কর্তৃপক্ষ ফতোয়া দিতে পারবে।
এখানে একটি বিষয় দেখুন, কয়েকদিন আগে আলেচিত ক্যাসিনো (জুয়া)-বিরোধী অভিযানের পর ওই ক্যাসিনোর যন্ত্রপাতি জব্দ করা নিয়ে হাইকোর্ট একটি রায় দেয়। সেই রায়টি ছিল ক্যাসিনো বা জুয়ার যন্ত্রপাতি রাষ্ট্রকর্তৃক জব্দ করে নেওয়া উচিত। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত ছিল, ক্যাসিনো ক্লাবগুলোর কাছে তাদের জুয়া খেলার যন্ত্রপাতি ফিরিয়ে দেওয়া হোক। আপিল বিভাগের এই সিদ্ধান্ত তো একটি আইনের পর্যায়ভুক্ত। আপিল বিভাগের এই সিদ্ধান্তের পর এখন যদি দেশের কোনো ফতোয়া বিভাগের কাছে কেউ ক্যাসিনোর যন্ত্রপাতির বৈধতা-অবৈধতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করে, তখন কি কোনো মুফতী বা ফিক্হবিদের সুযোগ আছেÑ এই ক্যাসিনো কার্যক্রমকে জায়েয বলে ঘোষণা দেয়ার? আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তে তো ক্যাসিনোর যন্ত্রপাতি ক্লাবগুলোর কাছে ফেরত দেওয়ার কথা বলে এটাকে এক ধরনের বৈধতা দেওয়া হয়েছে! কিন্তু ইসলামী বিধিমালা অনুযায়ী, ফিকহ-ফতোয়ার স্বাভাবিক ধারা অনুযায়ী ক্যাসিনো কিংবা কোনো রকম জুয়াকে বৈধ বলার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, কোনো মুফতী, কোনো ফিক্হবিদ কোনো আদালতের রায়ের দিকে তাকিয়ে ফতোয়া দিতে পারেন না। আল্লাহ তাআলা ও আল্লাহ্র রাসূলের বিধান প্রকাশ করার ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় আইন কিংবা কোনো রাষ্ট্রের কোনো কোর্টের রায়ের কারণে মূল বিষয়টিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার কোনো অবকাশ কি কারো আছে?
এজন্যই পরিস্থিতি যদি এমন হয়Ñ শরীয়তের বিধান এবং দেশীয় আইন সাংঘর্ষিক, তখন মুসলমানদের জন্য শরীয়তের আইন বা বিধিকে বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়াই যুক্তিযুক্ত এবং রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের এটাই করণীয়।
এজাতীয় বিরোধপূর্ণ অথবা সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির উদ্ভব হলে মুসলিম সর্বসাধারণ নাগরিকদের কর্তব্য হচ্ছে, রাষ্ট্র ও প্রশাসনের প্রতি এমন চাপ তৈরি করা, যেন ইসলামী বিধি-বিধান পালনে নাগরিকদের কেউ কোনো সমস্যা করতে না পারে। রাষ্ট্র যেন আইন ও বিধি-বিধান এমনভাবে তৈরি করে যে, কোনো কোর্ট বা অথরিটি ইসলামী বিধান পালনে সংকট সৃষ্টি হওয়ার মতো কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে না পারে। প্রয়োজনে রাষ্ট্রের আইন সংশোধন করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, তবুও রাষ্ট্রীয় আইন বা সংবিধানের দোহাই দিয়ে জরুরি দ্বীনী কোনো বিষয়কে আরোপিত ‘বাধ্যবাধকতা’ নাম দিয়ে সেই বিধান পালনের পথ রুদ্ধ করা যাবে না।
। তিন।
গাজীপুরের পোশাক কারখানায় কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের জন্য নামাযের নির্দেশনার বিষয়ে কেউ কেউ একটি অভিযোগ তোলার চেষ্টা করেন যে, ওই কারখানার নোটিশে তো কয়েক ওয়াক্ত নামাযে অনুপস্থিতির কারণে এক দিনের বেতন কর্তনের কথা বলা হয়েছিল। নামায না পড়লে বেতন কর্তনের এই নোটিশটি কি যুক্তিযুক্ত? এ ধরনের অভিযোগের উত্তরটা খুবই স্পষ্ট। ওই কারখানা তো অফিস সময়ের বাইরের সময়ের জন্য এই নিয়মটা করেনি, করেছে দাপ্তরিক সময়ের মধ্যেই। এর মানে হল, ওই সময়ে নামাযে না এলে শ্রমিক-কর্মচারীরা দাপ্তরিক কাজেই ব্যস্ত থাকত। কারখানার ব্যবস্থাপকরা তো বরং তাদের ডিউটির সময়ের মধ্যেই তাদেরকে আল্লাহ্র বিধান পালনের সুযোগ করে দিয়েছে। অফিস বা কার্যসময়ের মধ্যে রুটিন-কাজের পরিবর্তে নামায পড়ার সুযোগ করে দিয়ে কারখানা তো বরং উদারতা ও মহত্বের পরিচয় দিয়েছে।
বেতন কেটে নেওয়ার প্রসঙ্গটি নিয়ে যারা ভ্রæকুঞ্চন করতে চান তারা বরং আরেকভাবেও বিষয়টা নিয়ে ভাবতে পারেন। ধরুন, কোনো অফিস বা কারখানায় দাপ্তরিক সময়ের মধ্যেই একটি নিয়ম এমন জারি করল যে, এত এত মিনিট সময় কর্মকর্তা-শ্রমিকদের কনফারেন্স রুমে থাকতে হবে অথবা কবিতা আবৃত্তি করতে হবে, শরীর চর্চা-ব্যায়াম বা খেলাধুলা করতে হবে কিংবা গান গাইতে হবে। আর যথাসময়ে এই প্রোগ্রামে উপস্থিত না থাকলে আনুপাতিক হারে তার বেতন কাটা যাবে। এমন কোনো নিয়ম বা নির্দেশনা কোনো কারখানা থেকে এলে সেক্ষেত্রে কি ভ্রæকুঞ্চনকারীরা বিরক্তি প্রকাশ করতেন? তখনও কি একশ্রেণির গণমাধ্যম অধিকার হরণ বা ‘বাধ্যতামূলক’ করার কথা এভাবে লিখত? তখনও কি কেউ বলতেন, কারখানায় এভাবে কনফারেন্সে উপস্থিত হতে বা খেলাধুলা করতে বাধ্য করা সংবিধানে নেই?
আরেকটি ব্যাপার লক্ষণীয়। বলা হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষ দেশে কোনো কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় কোনো বিষয়ে ‘বাধ্যবাধকতা’ আরোপ করা যাবে না। নামায ও পর্দার বিষয়ে যারা এজাতীয় দাবি তোলার চেষ্টা করে থাকেন, তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে পারি, বিভিন্ন অফিস বা কারখানায় মালিকপক্ষ যে তার অধীনস্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের কাছ থেকে সততা রক্ষা, পূর্ণ সময় যথাযথভাবে কাজের নিয়মানুবর্তিতা, দায়িত্বের ব্যাপারে বিশ্বাস ও চুক্তি ভঙ্গ না করার কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও বাধ্যবাধকতা বজায় রাখেনÑ এসবও তো ইসলামের একদম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় নির্দেশনা। সততা, আমানত, চুক্তিরক্ষা, বিশ্বস্ততাÑ এসব রক্ষা তো ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান ও নির্দেশনা। তাহলে মালিকপক্ষের এজাতীয় ধর্মীয় নির্দেশনা পালনে শ্রমিকদের বাধ্য করার বিষয়ে কেউ কোনো আপত্তি তুলছেন না কেন? শ্রমিক-কর্মচারীরা তো বলতে পারেন, এগুলো তো ইসলাম ধর্মের ধর্মীয় নির্দেশনা, এসব নির্দেশনা মানতে আমাদের বাধ্য করা যাবে না।
অপরদিকে পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফে মাপে কম দেওয়া, পণ্যে ভেজাল মেশানোর বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারির কথা আছে। অথচ এজাতীয় ‘ধর্মীয় বিষয়’ লঙ্ঘন হলেও দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রের ভ্রাম্যমাণ আদালতসহ দেশীয় আইনে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, জরিমানা করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা তো এখানে আপত্তি করতে পারেন যে, আমাদেরকে মাপে কম দেওয়া, পণ্যে ভেজাল মেশানোর জন্য কোনোরকম শাস্তি দেওয়া অনুচিত। কারণ, এসবই একটি ধর্মÑ ইসলামের ধর্মীয় নির্দেশনার অন্তর্ভুক্ত। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মীয় এই নির্দেশনা ও নীতি মানতে রাষ্ট্র বা কোনো প্রতিষ্ঠান আমাদের বাধ্য করতে পারে না। অথচ বাস্তবে হচ্ছে কিন্তু এর উল্টোটা। এসব জায়গায় রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান ঠিকই কঠোর ভ‚মিকা পালন করছে এবং এব্যাপারে কোনো গণমাধ্যমই বাঁকা চোখে অন্য কিছু দেখতে পাচ্ছে না।
প্রশ্ন হল, নিয়মিত নামায পড়তে বলা, রোযার দিনে প্রকাশ্যে না খেতে বলা, কোনো প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের পর্দা করতে বলাÑ এগুলোকে ধর্মীয় নির্দেশনা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে, এসব বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যাবে না। তাহলে কি সততা, আমানতদারি, চুক্তি রক্ষা, যথাসময় ডিউটি পালন করতে বলাÑ ধর্মীয় নির্দেশনা নয়? মাপে কম দিতে, পণ্যে ভেজাল মেশাতে নিষেধ করা কি ধর্মীয় নির্দেশনা নয়? দেশের সংবিধান ও আইনে এসবের বাধ্যবাধকতার নির্দেশনা আসার প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ইসলাম এসব বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে এবং এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেও দেখিয়েছে। ধর্মীয় নির্দেশনার কারণে নামায পড়তে বাধ্য না করা গেলে তো ধর্মীয় নির্দেশনার কারণে মাপে কম না দিতেও বাধ্য করা যাবে না। দুটোই তো ধর্মীয় নির্দেশনার মধ্যে বিদ্যমান।
মূলত ইসলামের বিধান ও ইসলামের শিক্ষাকে বিভক্ত করার মূল কাজটি করেছে সেক্যুলারিজম। পশ্চিমের ইহুদী-খ্রিস্টান প্রভাবিত দেশগুলো থেকে এর আগমন। ওইসব দেশের রাহেব ও পাদরী তাদের ধর্মকে সংকুচিত ও বিকৃত করতে করতে চার্চে বা গীর্জায় নিয়ে আটকে ফেলেছে। ধর্মের আওতাকে সীমিত করে ‘ধর্মীয়’ কিছু অনুষ্ঠানের মধ্যেই নিজেদের ধর্মকে বেঁধে ফেলেছে। জাগতিক জীবনের ক্ষেত্রে এখন আর তাদের ধর্মীয় কোনো দিকনির্দেশনা নেই। এ কারণেই যেনতেনভাবে দুনিয়ার জীবন কাটলেও তাদের সে জীবন চর্চায় কোনো আপত্তি থাকে না। বেদনাদায়ক ব্যাপার হল, মুসলিমবিশে^র গোলামি মানসিকতার কিছু নেতা ও বুদ্ধিজীবী পশ্চিমা সমাজের ওই সংকুচিত ও খÐিত ধর্মচর্চার বিষয়টি মুসলিম দেশে দেশেও আমদানি করেছে। এরাই ধর্মীয় বিষয়গুলোকে বিভক্ত করেছে। এই গোলামি মনোবৃত্তির মুসলিম ব্যক্তিদের কাছে শুধু ইবাদতই হচ্ছে ধর্ম, জীবনের অন্য বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে তারা ধর্মের নির্দেশনা মানতে চায় না।
পক্ষান্তরে ইসলাম ইবাদত ও জীবনের সকল শাখা ও দিকসমূহের দিকনির্দেশক। ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রেতা-বিক্রেতা, মালিক-চাকুরে, চালক-যাত্রীÑ সবার আচরণই ইসলামী বিধি-বিধানের আওতাভুক্ত। যেমন মৌলিক ইবাদতের ক্ষেত্রে রয়েছে, তেমনি জীবনের সকল অঙ্গনের ক্ষেত্রেই ইসলামের দেওয়া أصول ও ضوابط (নীতি ও বিধি) রয়েছে। সেজন্যই কোনো কারণে জীবনের অন্যান্য বিষয়ে যখন ইসলামের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো আইন হয় তখন আর বলা হয় নাÑ এ আইনটি ধর্মীয় আইন। এ আইনটি মানতে বাধ্য করার মানে ধর্মীয় আইন মানতে বাধ্য করা। অথচ শুধু ইবাদত বা ইবাদত পালনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কোনো আইন বা বিধি তৈরি করলে বলা হয়Ñ ধর্মীয় বিষয়ে বাধ্য করা হচ্ছে।
নামাযসহ ইসলামী বিধি-বিধান যে কোনো অফিস, কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে কার্যকর করার প্রতিটি উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা মনে করি, এজাতীয় উদ্যোগকে উৎসাহিত করা দেশের নাগরিক ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আল্লাহ্র কোনো এক বা একাধিক বিধান পালনে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা যারা যে প্রতিষ্ঠানে করছেন তাদের সাধুবাদ-মোবারকবাদ জানানো উচিত। কেন এজাতীয় উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন ওঠানো হবে? একজন মানুষ দ্বীনদার হলে, নামাযী হলে এ সমাজের কারো কোনো ক্ষতি হবে কি? কোনো মুসলমান নামাযী হলে মুসলিম-অমুসলিম কোনো সমাজেরই কারো কোনো ক্ষতি তো নেই। একটি কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত নামায পড়ার ব্যবস্থাপনার কারণে ধরে নিলামÑ প্রতি দশজনের একজন নিয়মিত নামাযী হয়ে যাবেন। এতে কি এ সমাজ ও রাষ্ট্রের কারো কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে? তাহলে কেন অফিস-কারখানায় নামাযের নির্দেশনার খবর এলে আমাদের কোনো কোনো দায়িত্বশীল এমন অনভিপ্রেত উচ্চবাচ্য শুরু করেন? কেন তারা সংবিধানের দোহাই দিয়ে নামাযের নির্দেশনা বন্ধের ব্যবস্থা করেন? তাদের এসব ভুল চিৎকার ও আপত্তিকর ‘আপত্তি’ সমাজের জন্য কোন্ কল্যাণ বয়ে আনবে?
আমরা মনে করি, প্রত্যেক অফিস-কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে এমন আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা রাখা দরকার, যেন মুসলমান শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তারা যথাসময়ে নামায পড়ার সুযোগ পান। যেন ইসলাম পালনে কারো কোনো সমস্যায় পড়তে না হয়। নামাযের জন্য বিরতিসহ এমন ব্যবস্থাপনা যেন সব জায়গায় রাখা হয় যে, মানুষ প্রশান্তির সঙ্গে নামায ও অন্যান্য ইবাদত করতে পারে। এমনকি আমরা এ-ও বলি, ভিন্ন ধর্মের মানুষেরা যদি চায়, যথাসময়ে তাদের ধর্ম পালনেরও সুযোগ তাদের দেওয়া হোক।