রজব ১৪৪১   ||   মার্চ ২০২০

কলিজার টুকরো সন্তান নিরাপদে থাক দুনিয়াতে ও আখেরাতে

উম্মে হাবীবা তামান্না

আমার সাথে আলকাউসারের পরিচয় সেই বুঝ হওয়ার পর থেকে। কিন্তু আলকাউসারের প্রকাশকাল এরও বেশ আগে। আগের অনেক সংখ্যার সাথেই আমার পরিচয় নেই। তাই আমি এবং আমার মতো যারা, তাদের জন্য আলকাউসারের ভলিউমগুলো খুব জরুরি এবং উপকারি। আমার কাছে আলকাউসার ২০১০-এর ভলিউম আছে। মাঝে মাঝে আমি পড়ি। তাতে পর্দানশীন পাতার একজন সম্মানিত লেখিকা শামীমা বিনতে নূরের লেখাগুলো আমার খুব ভালো লাগে। তাঁর প্রতিটি লেখার ভাষা ও উপস্থাপন যেমন সুন্দর, ভাবনাগুলোও হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

মুহতারামার সাথে চোখের দেখা তো কখনো হয়নি, কিন্তু তাঁর সুন্দর মনের ছোঁয়া পেয়েছি প্রতিটি লেখায়। আল্লাহ তাঁর মাঝে আরো অনেক অনেক বরকত দান করুন। তাঁকে সুন্দর ও শান্তিময় দীর্ঘস্থায়ী যিন্দেগী দান করুন, আমাদের জন্য আরো আরো লেখার তাওফীক দান করুন- আমীন।

তাঁর সুন্দর লেখাগুলোর একটি হচ্ছে ‘সন্তান যে কলিজার টুকরা তাই...’। সেখানে তিনি লিখেছিলেন-

“সন্তান মায়ের কাছেই গ্রহণ করে জীবনের প্রথম পাঠ। মায়ের ভাষাতেই শিশুর মুখে বোল ফোটে এবং পৃথিবীর সাথে পরিচয় ঘটে। মায়ের আচরণ থেকে সে জীবন-যাপনের নিয়ম শেখে। তাই বলা যায়, শিশু তার মায়ের কর্ম ও চেতনার দর্পণ। তাই সন্তান যখন উত্তম স্বভাব-চরিত্রের অধিকারী হয় তখন মায়ের অবদান ভোলা যায় না। পক্ষান্তরে সে যখন ভুল পথে চলে তখনও মা এর দায় এড়াতে পারেন না। কারণ মায়ের সান্নিধ্যই শিশুর ভবিষ্যত চলার পথ নির্ধারণ করেছে।”

এরপর লেখেন, “...আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে দুটি শিশু খেলা করত। ওরা ছিল ভাই-বোন। ছেলেটির পোশাক স্বাভাবিক, কিন্তু মেয়েটির পোশাক দেখে খুব কষ্ট হত। ছোট ছোট হাতা-কাটা জামা...।”

“আরেকটি মেয়ের কথা মনে পড়ছে। ওকে এমন একটি জামা পরানো হত, যা শিশুদের পোশাক হিসেবে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। খেলার সাথীরা এলে ও খুব লজ্জা পেত এবং দুই হাত দিয়ে জামার ওপরের অংশটা ঢেকে রাখত। ওর মা জোর করতেন জামাটা পরার জন্য। কিন্তু সে কোনোভাবেই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে পারত না। শেষে জামাটি ওদের কাজের মেয়েকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল।”

লেখাটির চিত্রের মতো কিছু চিত্র আমিও দেখেছি। এখনো দেখি; বরং এখন আরো বেশি। আগে তো তাও একরকম ছিল- ওসব পোশাক ছোট মেয়েরা পরত। বড় মেয়েরা ওসব অশালীন পোশাক পরতে সংকোচ বোধ করত। কিন্তু এখন? সংকোচ, লজ্জা, এজাতীয় শব্দগুলো যেন আমাদের অনেকের থেকে হারিয়েই গেছে। অহরহ এখন বড়রাও পরছে ওসব পোশাক।

কিন্তু এসবের জন্য দায়ী কে? ছোট্ট শিশুর কী দোষ! সে তো অশালীন পোশাক নিয়ে জন্মায়নি। এসবের প্রতি তার কোনো আকর্ষণও তো ছিল না।  সুতরাং মা-বাবা ও অভিভাবকরা কি এর দায় এড়াতে পারেন?

এইযে প্রায় অর্ধউলঙ্গ পোশাক পরা মেয়েটি, সে তো একদিন ছোট ছিল। তার নিষ্পাপ একটি মন ছিল। যে মন অশ্লীলতা, লজ্জাহীনতা ঘৃণা করত। কিন্তু মা তাকে এসব অশালীন ফ্যাশনেবল পোশাক পরাতেন। কোনো কোনো শিশু এসব পোশাক পরতে লজ্জা পেলে কোনো কোনো মা হয়ত বুঝাতেন, তুমি এখনো ছোট। বড় হলে তখন না হয় পরো না। এভাবে একপ্রকার তাকে বাধ্য করতেন। এখান থেকেই শুরু। এভাবেই নিষ্পাপ শিশুটির মনে অজান্তেই রোপিত হয় অশ্লীলতার বীজ।

এখন মা চাইলেও পারেন না তাকে সুপথে আনতে। অশ্লীলতার পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে। ছোটবেলায় বাসার পাশের একটি স্কুলে বেশ কিছু সময় পড়া হয়েছিল আমার। পুরো স্কুলে আমি ছাড়া আর হাতে গোনা দু-একজন মেয়ে ছিল, যাদের পা গোড়ালী পর্যন্ত ঢাকা থাকত। বাকি মেয়েদের সবারই হাঁটু থেকে গোড়ালী পর্যন্ত অনাবৃত থাকত। এই মেয়েদের কেউ আমাকে কখনো কিছু বলেনি; বরং এদের কয়েকজনের মা কেমন অবাক আর তাচ্ছিল্যের মিশেল দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলত, “তোমাদের কষ্ট হয় না! গরম লাগে না! তারপর একজন আরেকজনকে বলত, নাহ ভাবী! আমি পারব না। মেয়ে এখনো ছোট। এই বয়সেই এত গরমে পাজামা পরাতে পারব না। বড় হোক, দেখা যাবে!” কিন্তু আসলেই কি সন্তান কখনো বড় হয় মায়ের কাছে!

কিন্তু সঠিক আদর-ভালবাসা তো তখনই হবে, যখন আমাদের ভালবাসাটা আবেগতাড়িত না হয়ে বিবেক-সচেতন হবে। আমরা যদি সন্তানের সত্যিকারের হিতাকাক্সক্ষী হই, তাহলে তো চাইব- তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে নিরাপদে রাখতে। কিন্তু আলোচ্য বিষয়ে যে কাজটি আমরা কিছু মানুষ করছি, তা আখেরাতে তো অসম্ভব, দুনিয়াতে কি আমার সন্তানের নিরাপত্তা দেবে? সমাজ-বাস্তবতা কি একথার সাক্ষ্য নয়!

আসলে মায়েরা তো মমতাময়ী। তারা সবসময় সন্তানের আরাম-শান্তির কথাই ভাবেন। আর তাদের এই নিঃস্বার্থ ভাবনার প্রয়োগে কখনো কখনো ভুল করেন। এ তো গেল সন্তানের শারীরিক আরামের জন্য কিছু মায়ের অবিবেচক ভূমিকার চিত্র। সন্তানের মানসিক আরাম এবং শান্তির ক্ষেত্রেও কিছু মা ভুল ভাবনায় নিপতিত হন। একটা উদাহরণ দিই।

একজন উচ্চশিক্ষিত নারী। সম্পর্কে আমাদের আত্মীয় হন। স্বামী-সন্তানসহ বেশ কিছুদিন মালয়েশিয়ায়ও ছিলেন। একদিন তার সাথে বিভিন্ন কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, আমরা তো আসলে জন্মদিন পছন্দ করি না। জন্মদিন পালন করা যে নাজায়েয তাও জানি। কিন্তু ছেলের বন্ধু-বান্ধব, আশপাশের প্রতিবেশীদের বাচ্চাদের জন্মদিন পালন করা হয়। তো যখন সে এসব জানে, তখন তো তার মন খারাপ হয়; আব্বু-আম্মু আদর করে না আমাকে। আদর করলে তো আমার জন্মদিনেও মেহমানরা আসত, কেক কাটতাম, গিফট পেতাম। তাই ছেলের যেন মন খারাপ না হয়, সে যেন হীনম্মন্যতায় না ভোগে তাই কখনো ছোটখাটো অনুষ্ঠান করি বা কিছু রান্না করি, তাকে উইশ করি, গিফট দিই।

নিঃসন্দেহে এগুলো একজন মমতাময়ী মায়ের মমতার নিদর্শন। মা তো সন্তানের সামান্য মন খারাপও সহ্য করতে পারেন না। তাই সন্তানের মন খারাপ হবে দেখে তিনি এভাবে জন্মদিন পালন করেছেন। ভাবছেন এটা আর এমন কী। এখনো ছোট, বড় হলে তো করব না। কিন্তু সন্তানের জন্য তো পথ খুলে গেল। তার মনে তো কিছু একটা গেঁথে গেল। আর সন্তানের হীনম্মন্যতা দূর করার এবং মন খারাপ থেকে রক্ষা করার কি এটিই একমাত্র এলাজ! আর কোনো পথে সম্ভব নয়- তার খারাপ মন ভালো করার!

সন্তানকে যদি ভালো কোনো উপহার দেওয়া হয়, কোথাও ঘুরতে নেওয়া হয় এবং জন্মদিন পালনের হাকীকত বুঝানো হয়, বাবা! জন্মদিন পালন করা ভালো নয়। এটি মুসলিমের সংস্কৃতি নয়। বিধর্মীদের থেকে এ সংস্কৃতি মুসলিমের সমাজে প্রবেশ করেছে। এটি আল্লাহ পছন্দ করেন না। মুসলিম দিবস পালন করে না; মুসলিম প্রতিটি দিবসকে সুন্দর জীবন গঠনে এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনে ব্যয় করে। তখন সন্তান নিজ থেকেই বলবে, না আম্মু, আমরা জন্মদিন পালন করব না। আল্লাহ তাহলে নারাজ হবেন। তার বন্ধুদের জন্মদিন পালন করতে দেখলে হীনম্মন্যতায় ভুগা তো দূরের কথা, নিজেই তাদেরকে বুঝাবে, জন্মদিন পালন কোরো না; মুসলিমরা জন্মদিন পালন করে না।

কেউ হয়ত ভাববে, এটা অসম্ভব এবং কাল্পনিক, কিন্তু এটা সত্যই সম্ভব এবং বাস্তব। এমন অনেক শিশু আমাদের ঘরে এবং আমাদের চারপাশে আছে, যারা জন্মদিন পালন করাকে নিজেরা অপছন্দ করে এবং সমবয়সীদের এ থেকে বারণ করে।

আসলে শিশুরা তো নিষ্পাপ। ‘ফিতরাত’ তথা সত্য ও কল্যাণকে গ্রহণ করার স্বভাবের উপর তাদের সৃষ্টি। পাপের প্রতি ঘৃণা ও অনাগ্রহ তাদের ফিতরতেরই অংশ। আমাদের উচিত এই ‘ফিতরত’কে কাজে লাগিয়ে তাদেরকে গড়ে তোলা এবং ফিতরতের উপর আজীবন অটল রাখার চেষ্টা করা। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

كُلّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ، أَوْ يُنَصِّرَانِهِ، أَوْ يُمَجِّسَانِهِ ...

প্রত্যেক শিশু ফিতরাতের উপর অর্থাৎ ঈমান ও সত্য-ন্যায়ের যোগ্যতা নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। এরপর তার বাবা-মা তাকে ইহুদী বানায় অথবা নাসরানী বানায় অথবা অগ্নিপূজারী বানায়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৮৫

এ হাদীস সন্তানের প্রতি প্রতিটি মা-বাবার আচরণের বিষয়ে সতর্ক পদক্ষেপের বার্তা বহন করে। সন্তান ভালো বা খারাপ হওয়ার ক্ষেত্রে মা-বাবার ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

যাইহোক, সন্তানের এমন আরো অনেক শারীরিক এবং মানসিক ক্ষেত্রে আমরা ভুল চিন্তা এবং ভুল উদ্যোগ নিয়ে বসি। মায়েরা মমতাময়ী। তাদের অন্তরে শুধু সন্তান ছোট এবং কষ্ট হবে এই বিষয়টিই শয়তান বারবার সামনে আনতে থাকে। ফলে দেখা যায় নিজের অজান্তেই আমরা সন্তানকে এসব পথে বাড়িয়ে দিই। পরবর্তীতে আফসোস করি।

এই দু’দিনের দুনিয়াতে সন্তানের সামান্য কষ্ট আমরা সইতে পারছি না। চিরস্থায়ী আখেরাতে সন্তানকে জাহান্নামে জ¦লতে দেখলে কীভাবে সইব! শুধু কি তাই! যেই সন্তানের আরামের জন্য  এতকিছু, সেই সন্তানই তো কাল কিয়ামতের দিন কাঠগড়ায় দাঁড় কারিয়ে দিবে আমাদের। বলবে...!

তখন কেমন লাগবে মমতাময়ী মায়ের! আল্লাহ আমাদেরকে সহীহ বুঝ দান করুন এবং সন্তানকে আমাদের জন্য এবং আমাদেরকে সন্তানের জন্য কল্যাণের মাধ্যম বানান।

 

 

advertisement