দুআর হাকীকত এবং দুআর আনুষ্ঠানিকতা
وَ اِنْ یَّمْسَسْكَ اللهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهٗۤ اِلَّا هُوَ، وَ اِنْ یُّرِدْكَ بِخَیْرٍ فَلَا رَآدَّ لِفَضْلِهٖ، یُصِیْبُ بِهٖ مَنْ یَّشَآءُ مِنْ عِبَادِهٖ، وَ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِیْمُ.
আল্লাহ যদি তোমাকে কোনো অকল্যাণ দিয়ে আক্রান্ত করেন তাহলে তিনি ছাড়া তা দূর করার আর কেউ নেই। আর যদি তিনি তোমার কোনো কল্যাণ চান তবে তাঁর দয়া প্রতিহত করারও কেউ নেই। তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা কল্যাণ দান করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। -সূরা ইউনুস (১০) : ১০৭
এ ঘোষণা পবিত্র কুরআনের। প্রতিটি মুমিনই শাশ্বত এ বাণীতে বিশ্বাস করে। এ বিশ্বাস তার ঈমানের অংশ। সঙ্গত কারণেই যে কোনো আপদে-বিপদে মুমিন আল্লাহ তাআলারই শরণাপন্ন হয়। তাঁকেই ডাকে। তাঁর কাছেই দুআ করে। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিখিয়েছেন এভাবে-
إذا سألت فاسأل الله وإذا استعنت فاستعن بالله.
যখন তুমি কিছু প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহ্র কাছেই প্রার্থনা করবে; যখন সাহায্য চাইবে তখন আল্লাহ্র কাছেই সাহায্য চাইবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৫১৬
এজন্যে কোনো বিপদ এলেই, কোনো সংকট তৈরি হলেই মুমিন আল্লাহ তাআলার দরবারে দু’হাত তুলে দুআ করতে থাকে। তার বিশ্বাস- আল্লাহ ছাড়া তাকে বিপদ থেকে বাঁচানোর কেউ নেই, তার প্রয়োজন পূরণ করে দেয়ার মতো অন্য কেউ নেই।
বিপদে পড়লে আল্লাহকে ডাকা- এ তো আল্লাহ্র বিধান অমান্যকারী, কার্যত আল্লাহকে অস্বীকারকারী কাফেররাও করে। পবিত্র কুরআনে একটি উপমায় চিত্রিত করা হয়েছে কাফেরদের এ অবস্থা। লক্ষ করুন-
هُوَ الَّذِیْ یُسَیِّرُكُمْ فِی الْبَرِّ وَ الْبَحْرِ ؕ حَتّٰۤی اِذَا كُنْتُمْ فِی الْفُلْكِ ۚ وَ جَرَیْنَ بِهِمْ بِرِیْحٍ طَیِّبَةٍ وَّ فَرِحُوْا بِهَا جَآءَتْهَا رِیْحٌ عَاصِفٌ وَّ جَآءَهُمُ الْمَوْجُ مِنْ كُلِّ مَكَانٍ وَّ ظَنُّوْۤا اَنَّهُمْ اُحِیْطَ بِهِمْ ۙ دَعَوُا اللهَ مُخْلِصِیْنَ لَهُ الدِّیْنَ ۚ۬ لَىِٕنْ اَنْجَیْتَنَا مِنْ هٰذِهٖ لَنَكُوْنَنَّ مِنَ الشّٰكِرِیْنَ فَلَمَّاۤ اَنْجٰىهُمْ اِذَا هُمْ یَبْغُوْنَ فِی الْاَرْضِ بِغَیْرِ الْحَقِّ .
তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমাদেরকে জলেস্থলে ভ্রমণ করান এবং তোমরা যখন নৌকারোহী হও, এগুলো আরোহীদেরকে নিয়ে অনুকূল বাতাসে বয়ে যায় আর তারাও এতে আনন্দিত হয়, অতঃপর এক ঝড়ো বাতাস তাতে আঘাত হানে এবং সর্বদিক থেকে তরঙ্গ তাদের উপর আছড়ে পড়ে আর তারা মনে করে- তারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছে, তখন তারা আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে আল্লাহকে ডেকে বলে- ‘তুমি যদি আমাদেরকে এ থেকে উদ্ধার কর তবে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হব।’ অতঃপর তিনি যখনই তাদেরকে বিপদমুক্ত করেন তখনই তারা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে জুলুম করতে থাকে। -সূরা ইউনুস (১০) : ২২-২৩
আরেক আয়াতের বর্ণনা-
فَاِذَا رَكِبُوْا فِی الْفُلْكِ دَعَوُا اللّٰهَ مُخْلِصِیْنَ لَهُ الدِّیْنَ، فَلَمَّا نَجّٰىهُمْ اِلَی الْبَرِّ اِذَا هُمْ یُشْرِكُوْنَ، لِیَكْفُرُوْا بِمَاۤ اٰتَیْنٰهُمْ، وَ لِیَتَمَتَّعُوْا ۥ فَسَوْفَ یَعْلَمُوْنَ.
তারা যখন নৌযানে আরোহণ করে তখন তারা বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে ডাকে। অতঃপর তিনি যখন তাদেরকে উদ্ধার করে স্থলে ভিড়িয়ে দেন, তখন তারা শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়ে! -সূরা আনকাবূত (২৯) : ৬৫-৬৬
তাই কেবলই বিপদের সময় আল্লাহকে ডাকা মুমিনদের কোনো বিশেষত্ব নয়। তারা তো সুখে-দুঃখে উৎসবে-সংকটে সর্বাবস্থায়ই আল্লাহকে ডাকে। যে কোনো কাজ করার সময় তারা আল্লাহ্র কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করে। সে কাজটি কঠিন মনে হলেও আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করে, এমনকি সহজ মনে হলেও আল্লাহকেই ডাকে। মুমিন বান্দার ফরিয়াদ তো এমন-
اللّهُمّ لاَ سَهْلَ إِلاَّ مَا جَعَلْتَهُ سَهْلا، وَأَنْتَ تَجْعَلُ الْحَزنَ سَهْلاً إِذَا شِئْتَ.
হে আল্লাহ! আপনি যা কিছু সহজ করে দেন তা ছাড়া তো সহজ আর কিছুই নেই। আপনি যখন ইচ্ছা করেন তখন দুঃখ-কষ্টকেও সহজ করে দেন।
তাই টাকা-পয়সা থেকে শুরু করে যাবতীয় উপায়-উপকরণ হাতে নিয়েও মুমিন বান্দার একটাই দুআ- আল্লাহ! আপনি সবকিছু সহজ করে দিন! আপনি না চাইলে কোনো কিছুই সহজ হতে পারে না। মোটকথা, ইহকালীন ও পরকালীন সুখ-শান্তির জন্যে, বিপদ থেকে মুক্তির জন্যে এবং সার্বিক কল্যাণের জন্যে মুমিন বান্দা আল্লাহর কাছে দুআ করে থাকে। দুআর আদেশ স্বয়ং আল্লাহর-
ادْعُوْنِیْۤ اَسْتَجِبْ لَكُمْ.
তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। -সূরা মুমিন (৪০) : ৬০
দুআ হচ্ছে বন্দেগি ও দাসত্ব প্রকাশের চূড়ান্ত মাধ্যম। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে গুণাবলিতে গুণান্বিত ছিলেন, এর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ হচ্ছে তাঁর গোলামি ও দাসত্ব। মানুষকে আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিই করেছেন তাঁর ইবাদত ও দাসত্ব করার জন্যে। আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি মানুষ ও জিন জাতিকে কেবল আমার ইবাদতের জন্যেই সৃষ্টি করেছি। -সূরা যারিয়াত (৫১) : ৫৬
সঙ্গত কারণেই যে যত বেশি আল্লাহ্র দাসত্ব করতে পারবে, তার ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার সৃষ্টির উদ্দেশ্য ততই পূর্ণতা পাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতকারী। মহান সৃষ্টিকর্তার দাসত্ব তিনিই সবচেয়ে বেশি পালন করেছেন। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন। সর্বশেষ নবী ও রাসূল ছিলেন। সকল নবী ও রাসূলের সর্দার ছিলেন। কিন্তু এত সব বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে জায়গায় জায়গায় তাঁকে স্বীয় বান্দা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যেমন, পুরো মানবজাতির মাঝে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ মেরাজের সম্মানে ভূষিত করেছিলেন। এক রাতে পবিত্র মক্কা নগরী থেকে বাইতুল মাকদিস নিয়ে যাওয়া, সেখান থেকে সপ্ত আকাশ পাড়ি দিয়ে যতদূর আল্লাহর ইচ্ছা নিয়ে যাওয়া এবং সবশেষে আবার সেই রাতেই নিজের ঘরে ফিরে আসা- এমন কোনো ঘটনা মানব ইতিহাসে একমাত্র তাঁর জীবনেই ঘটেছিল। অথচ আল্লাহ তাআলা এমন মহান ঘটনাটির বিবরণ দিচ্ছেন এভাবে-
سُبْحٰنَ الَّذِیْۤ اَسْرٰی بِعَبْدِهٖ لَیْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ اِلَی الْمَسْجِدِ الْاَقْصَا.
মহান সেই সত্তা যিনি তাঁর বান্দাকে রাতের বেলা মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসায় নিয়ে গেলেন...। -সূরা বনী ইসরাইল (১৭) : ১
এ থেকেই অনুমান করা যায়, মহান প্রভুর গোলামি ও দাসত্বের পূর্ণতার মধ্যেই নিহিত একজন মানুষের পরিপূর্ণ সফলতা।
নামায, রোযা হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি আমলের মধ্য দিয়ে মানুষ তার প্রভুর ইবাদত ও দাসত্ব করে থাকে। কিন্তু দাসত্বের পূর্ণ রূপ প্রকাশ পায় দুআর মধ্য দিয়েই। নিজের কোনো প্রয়োজনে কিংবা পরকালীন মুক্তির আশায় সে যখন প্রভুর সামনে হাত তুলে দুআ করে, কান্নাকাটি করতে থাকে, তখন তার ভেতর-বাহির সবটাই আল্লাহ্র গোলামিতে ডুবে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশিরভাগ সময়ই এ দুআর মধ্যে ডুবে থাকতেন। তাই বলা যায়, দুআ মুমিনের দাসত্ব ও গোলামিতে পূর্ণতা বিধান করে।
হাদীস শরীফে বলা হয়েছে-
الدّعَاءُ هُوَ الْعِبَادَةُ
দুআই ইবাদত। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৪৮১
অর্থাৎ নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাতের মতো দুআও একটি ইবাদত। তাই আল্লাহ্র কাছে কোনো কিছু চেয়ে দুআ করার পর সে দুআ কবুল হলে তো ভালো। কিন্তু যদি কবুল নাও হয়, তাহলেও এর সওয়াব পাওয়া যাবে। যেহেতু দুআ একটি স্বতন্ত্র ইবাদত। এর সওয়াব ও প্রতিদানের সঙ্গে তা কবুল হওয়া বা না হওয়ার কোনোই সম্পর্ক নেই।
দুআ তো কত উদ্দেশ্যেই হতে পারে! আল্লাহ্র বান্দা আল্লাহ্র কাছে তার কৃত গুনাহ থেকে ক্ষমা চেয়ে দুআ করতে পারে, তার সংকট ও পেরেশানি থেকে মুক্তি চেয়ে দুআ করতে পারে, তার ঋণ ও অসুস্থতা দূর করে দেয়ার জন্যে দুআ করতে পারে, যে কোনো বৈধ প্রয়োজন পূরণের জন্যেও দুআ করতে পারে। আল্লাহ্র দয়া ও অনুগ্রহ এতটাই উন্মুক্ত, হাদীসের ভাষ্য অনুসারে তিনি প্রতি রাতেই ডেকে ডেকে বলতে থাকেন- কে আছে প্রয়োজন প্রার্থনাকারী, কে আছে গুনাহ থেকে ক্ষমাপ্রার্থনাকারী...। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
فَإِذَا مَضَى ثُلُثُ اللَّيْلِ، أَوْ نِصْفُ اللَّيْلِ، نَزَلَ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا، فَقَالَ: هَلْ مِنْ سَائِلٍ فَأُعْطِيَهُ؟ هَلْ مِنْ مُسْتَغْفِرٍ فَأَغْفِرَ لَهُ؟ هَلْ مِنْ تَائِبٍ فَأَتُوبَ عَلَيْهِ؟ هَلْ مِنْ دَاعٍ فَأُجِيبَهُ؟
রাতের যখন এক তৃতীয়াংশ কিংবা অর্ধেক কেটে যায়, তখন আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে এসে বলতে থাকেন- কোনো প্রয়োজন প্রার্থনাকারী আছে কি, আমি তাকে দান করব; কোনো ক্ষমাপ্রার্থনাকারী আছে কি, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব; কোনো তওবাকারী আছে কি, আমি তার তওবা কবুল করব; দুআ করার মতো কেউ আছে কি, আমি তার দুআয় সাড়া দেব? -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৫৮৯
মুমিন বান্দা যখন আল্লাহকে ডাকে তখন সে সরাসরি আল্লাহ তাআলার সঙ্গেই কথা বলে। মহামহিম প্রভুর সঙ্গে একান্তে এ কথোপকথনের তৃপ্তিই আলাদা! দুআর মধ্য দিয়ে তাই আল্লাহ্র সঙ্গে বান্দার সেতুবন্ধন রচিত হয়। দুআর পর যদি প্রার্থিত বিষয় অর্জিত হয়ে যায় তাহলে তো হলোই, আর বাহ্যত যদি তা নাও হয় তবে পরম দয়াময় প্রভুর সঙ্গে আবারও একান্তে কথোপকথনের সুযোগ পাওয়া যাবে। ফলে দুআয় আসলেই ব্যর্থতা বলে কিছু নেই।
আল্লাহ তাআলার মহানুভবতা কি বর্ণনা করে শেষ করা যাবে! তাঁর কাছে যখন বান্দা প্রার্থনার ঝাঁপি মেলে ধরে, তিনি মোটেও বিরক্ত হন না। যে কেউ যত বেশি ইচ্ছা চাইতে পারে। তাঁর কাছে প্রার্থনা করায়ও কোনো সীমারেখা নেই, তাঁর দানেও কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। তিনি যে উল্টো ডাকতে থাকেন- প্রার্থনাকারী কেউ আছে কি, আমি তার প্রার্থনা কবুল করব! কেউ যদি কোনো মানুষের কাছে কিছু চায়, তাহলে সে বিরক্ত হয়, নাখোশ হয়। কিংবা প্রথম এক-দুই বার খুশিমনে দিলেও পরে তার অবস্থা পাল্টে যায়। কিন্তু আল্লাহ্র কাছে কিছু না চাইলে বরং তিনি অসন্তুষ্ট হন। বান্দা তাঁর কাছে প্রার্থনা করবে, চাইবে। আর তিনি বান্দার প্রার্থনা শুনবেন। সে প্রার্থনায় সাড়া দেবেন। এতেই তিনি সন্তুষ্ট। বরং তাঁর কাছে যে বান্দা যত বেশি চায় তার ওপর তিনি তত বেশি খুশি হন। হাদীস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
لَيْسَ شَيْءٌ أَكْرَمَ عَلَى اللهِ تَعَالَى مِنَ الدّعَاءِ.
আল্লাহর কাছে দুআর চেয়ে প্রিয় কোনো কিছু নেই। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৩৭০
আরেক হাদীসে আছে-
إِنّهُ مَنْ لَمْ يَسْأَلِ اللهَ يَغْضَبْ عَلَيْهِ.
যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে না, আল্লাহ তার ওপর অসন্তুষ্ট হন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৩৭৩
আরেকটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
سَلُوا اللهَ مِنْ فَضْلِهِ، فَإِنّ اللهَ عَزّ وَجَلّ يُحِبّ أَنْ يُسْأَلَ.
তোমরা আল্লাহ্র কাছে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করো। কেননা তিনি তাঁর কাছে কিছু চাওয়াকে পছন্দ করেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৭১
দুআ কবুলের ক্ষেত্রে যেমন কোনো সীমাবদ্ধতা নেই, দুআ করার মধ্যেও নেই কোনো সীমাবদ্ধতা। দুনিয়া-আখেরাতের বৈধ যে কোনো প্রয়োজনে যে কোনো সময় আল্লাহ তাআলার কাছে চাইতে কোনো বিধিনিষেধ নেই। এখানে আনুষ্ঠানিকতার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এর পরও কিছু কিছু সময় আছে এমন, যখন দুআ কবুলের সম্ভাবনা বেশি থাকে। যেমন ফরয নামাযের পর দুআ কবুলের কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। আযান-ইকামতের মধ্যবর্তী সময়েও দুআ কবুল হয়। এমন আরও অনেক সময় ও স্থান রয়েছে, যেখানে দুআ কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এ সময়গুলোতে অধিক পরিমাণে দুআয় মনোযোগী হওয়া উচিত।
দুআর মধ্য দিয়ে মুমিন বান্দার আল্লাহমুখী হওয়ার আরেকটি বিশেষ দিক হচ্ছে, এখানে তাকে কোনো মধ্যস্থতার চিন্তা করতে হয় না। সরাসরি আল্লাহর সঙ্গেই একান্তে সব কথা বলা যায়। যদি কখনো জামাতবদ্ধ হয়ে দুআ করা যায়, কোনো বুযুর্গ ব্যক্তির সঙ্গে একত্রে হাত ওঠানো যায়, তাহলে তো ভালো। কিন্তু দুআর জন্যে এর কোনোটিই জরুরি নয়।
তবে বর্তমানকালে আমরা দুআকে অনেকটাই আনুষ্ঠানিক বানিয়ে নিয়েছি। ফরয নামাযের পর যেসব মসজিদে দুআ করার রেওয়াজ চালু আছে, সেখানে দুআ তো হয়, কিন্তু অনেকাংশেই দেখা যায়, অনেকটা দায়সারা গোছের একটি রেওয়াজই পালন করা হয় মাত্র। আবার যেখানে জামাতবদ্ধ হয়ে দুআর রেওয়াজ নেই, সেখানে হয়ত কেউই দুআ করছে না! অথচ ইমাম সাহেবের সঙ্গেই দুআ করতে হবে-এমন তো কোনো কথা নেই। নামাযের সালাম ফেরানোর মধ্য দিয়েই ইমামতের বিধান শেষ হয়ে যায়। ইমাম সাহেব যদি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দুআ করেন, তবে তার সঙ্গে যেমন দুআ করা যেতে পারে, তার আগেও দুআ শুরু করা যেতে পারে, তিনি দুআ শেষ করার পরও দুআ চালিয়ে যাওয়াতে কোনো অসুবিধা নেই। আবার যেখানে নামাযের পর সম্মিলিতভাবে দুআর রেওয়াজ নেই, সেখানেও মুসল্লিগণ ব্যক্তিগতভাবে দুআয় মশগুল হতে পারেন। মনে রাখতে হবে, ফরয নামাযের পর দুআ কবুল হওয়ার বিশেষ ওয়াদা রয়েছে।
দুআর আরেকটি আনুষ্ঠানিকতা হচ্ছে বিভিন্ন বার্ষিকী এবং দিবসসমূহ। বাবা-মা কিংবা কোনো আপনজনের মৃত্যুবার্ষিকীতে দুআর আয়োজন করা হয়, কারও মৃত্যুর পর চল্লিশ কিংবা অন্য কোনো সংখ্যক দিনে দুআর আয়োজন করা হয়। কেউ যখন নতুন ঘর উদ্বোধন করবে, নতুন ব্যবসা নতুনভাবে শুরু করবে, তখন দুআর আয়োজন করে। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে নির্বাচনের সময় প্রার্থীদেরকেও মসজিদে মসজিদে গিয়ে, কিংবা কোনো বুযুর্গ ব্যক্তির কাছে গিয়ে অথবা প্রার্থীদের কাছেও ব্যাপকভাবে দুআ চাইতে দেখা যায়। এভাবে নানারকম আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই অনেকটা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে আমাদের দুআ। অথচ এর কোনোটির মধ্যেই দুআকে সীমাবদ্ধ করে রাখা মোটেও উচিত নয়। বাবা-মায়ের জন্যে দুআ তো স্বয়ং আল্লাহ তাআলা আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন-
رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّیٰنِیْ صَغِیْرًا.
হে আমার প্রভু! আপনি আমার বাবা-মায়ের ওপর রহম করুন, তারা ঠিক যেভাবে আমাকে ছোটবেলায় লালনপালন করেছে।
তাদের জন্যে এ দুআ আমাদের করে যেতে হবে সদা-সর্বদাই। আর যে কোনো প্রয়োজন সামনে আসে সেজন্যে প্রথমত আমাদের নিজেদেরই প্রথমে দুআয় মনোযোগী হওয়া উচিত। নিজের প্রয়োজনের কথা নিজে যতটা আবেগের সঙ্গে আল্লাহ তাআলার কাছে বলা যাবে, অন্য কাউকে দিয়ে কি আর ততটা হবে! এরপরও অন্যের কাছে প্রয়োজনে-সংকটে দুআ চাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এতে সীমাবদ্ধ থাকা মোটেও উচিত নয়। দুআর পরিপূর্ণ বরকত হাসিল করতে চাইলে আনুষ্ঠানিকতার এ সীমাবদ্ধতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দুআর হাকীকত বুঝার এবং বেশি বেশি দুআ করার মাধ্যমে আল্লাহ্র সাথে সম্পর্ক মজবুত করার তাওফীক দান করুন- আমীন।