রজব ১৪৪১   ||   মার্চ ২০২০

কুরআনের বিকৃত অনুবাদের প্রদর্শনী করছে কাদিয়ানী সম্প্রদায় প্রসঙ্গ : বিভিন্ন ভাষায় কাদিয়ানীদের অনূদিত কুরআনে বিকৃতি

মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

কাদিয়ানী ধর্মমতের প্রতিষ্ঠাতা, নবুওতের মিথ্যা দাবিদার মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী জীবিতকালে কুরআনে কারীমের অসংখ্য আয়াতে বিকৃতি করে গেলেও পুরো কুরআনের অনুবাদ করতে পারেনি। কিন্তু তার মৃত্যুর পর তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে কাদিয়ানী সম্প্রদায় কুরআনের বিকৃত অনুবাদ এবং বিকৃত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ লিখতে আরম্ভ করে।

এক্ষেত্রে মির্যা কাদিয়ানীর পুত্র এবং কাদিয়ানীদের দ্বিতীয় খলিফা মির্যা বশীরুদ্দীন মাহমুদের ‘অবদান’ সবার শীর্ষে। তার রচিত উর্দু ভাষার ‘তাফসীরে কবীর’ এবং ‘তাফসীরে সগীর’ কাদিয়ানী ধর্মাবলম্বীদের নিকট মৌলিক গ্রন্থের মর্যাদা রাখে। আমাদের জানা মতে ‘তাফসীরে কাবীর’ তাদের মুআল্লিম কোর্সের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত।

মির্যা মাহমুদের ‘তাফসীরে সগীর’কে অবলম্বন করে কুরআন মাজীদের বিকৃত ইংরেজি অনুবাদ ও টীকা সংকলন করেছে কাদিয়ানীদের প্রবীণ মুরুব্বী মালিক গোলাম ফরিদ এবং মৌলভী শের আলী। যার হুবহু বাংলা অনুবাদ করে ঢাকার বকশী বাজার থেকে প্রকাশ করেছে এদেশীয় কাদিয়ানীদের প্রাক্তন ন্যাশনাল আমীর মৌলভী মোহাম্মাদ এবং মৌলভী আবদুল আযীয সাদেক। বলাবাহুল্য, এ সবগুলো অনুবাদই গত জানুয়ারি মাসে কাদিয়ানীরা সুন্দরবনে প্রদর্শন করেছে।

স্বভাবতই এ অনুবাদগুলোর প্রধান উৎস হচ্ছে মির্যা গোলাম আহমদের কথিত ওহী, ইলহাম, কাশ্ফ, অপব্যাখ্যা এবং উদ্ভট কথাবার্তা। মির্যা গোলাম আহমদ নিজে যেমন পুরো কুরআনে শুধু নিজেকে দেখতে পেত, তেমনি কাদিয়ানীরাও এসব অনুবাদে তাদের গুরুর চিন্তাধারা সাব্যস্ত করতেই চূড়ান্ত অপপ্রয়াস চালিয়েছে।

নামে তো সেগুলো ‘কুরআন মজীদ’, ‘দ্যা হোলি কুরআন’ এবং ‘তাফসীরে সগীর’; আয়াতও অবিকল সেগুলোই; কিন্তু ভেতরে ইসলামের পরিবর্তে কাদিয়ানী ধর্মের বিশ্বাস! আয়াতের অপব্যাখ্যা করে বলা হচ্ছে যে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরে নবুওতের দরজা বন্ধ নয়! আখেরি যামানায় হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরেকবার আগমন করেছেন গোলাম আহমদের ‘সত্তার মধ্যে’! আয়াতের বিকৃত অর্থ করে দাবি করা হচ্ছে যে, হযরত ঈসা আ. ইন্তেকাল করেছেন! তাঁর কবর কাশ্মীরে অবস্থিত।১ এখন এ উম্মতের মধ্য হতেই হযরত ঈসার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ এবং তাঁর রূপ ধারণ করে এক ব্যক্তির আবির্র্ভাব হবে; আর সে ব্যক্তি মির্যা গোলাম আহমদ!!২

কুরআনে আলোচিত কিয়ামতের বিবরণগুলোর অপব্যাখ্যা করে গোলাম আহমদের যুগের আধুনিক পদ্ধতিতে পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণ, বেশি বেশি বইপত্রের প্রসার, জীবজন্তুকে চিড়িয়াখানায় জড়ো করা, নদী থেকে পানি সেচ করে কৃষিকাজে ব্যবহার প্রভৃতি আধুনিক বিবর্তনের কথাও বসানো হয়েছে সরাসরি আয়াতের অনুবাদে এবং টীকায়! দেখে মনে হবে, যেন সবকিছুই মির্যা কাদিয়ানী এবং তার যুগকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। তার অভিশপ্ত আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করতেই যেন কুরআন নাযিল করা হয়েছে! (নাউযু বিল্লাহ)

এসব অনুবাদে কাদিয়ানীরা সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরামের মুজেযা এবং পূর্বযুগের অলৌকিক ঘটনাসমূহের আয়াতেও বিকৃতি করেছে।

এভাবে সমগ্র কুরআনের অনুবাদে কাদিয়ানী সম্প্রদায় বিকৃতির এমন পরিকল্পিত জাল বিছিয়ে দিয়েছে, যাকে ভেদ করে আসল কুরআন খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, কাদিয়ানী সম্প্রদায় সন্দেহাতীতভাবে অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও সরলমনা মুসলমানদের সামনে  নিজেদেরকে কুরআনের খাদেমরূপে জাহির করতে চায়। অথচ মুসলমানদের মাঝে এধরনের বিকৃত অনুবাদ প্রচার করার অপরাধে ইতিপূর্বে কোনো কোনো মুসলিম দেশে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এখনও আমাদের দেশে বিষয়টিকে যথাযথ উপলব্ধিই করা হচ্ছে না। এখানে বিভিন্ন ভাষায় কাদিয়ানীদের কৃত কুরআন অনুবাদ থেকে বিকৃতির কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হচ্ছে-

 

ক) হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরেও নবুওতের অবকাশ তৈরির উদ্দেশ্যে বিকৃতি

 

১. সূরা আহযাব, আয়াত ৪০       

مَا كَانَ مُحَمَّدٌ اَبَاۤ اَحَدٍ مِّنْ رِّجَالِكُمْ وَ لٰكِنْ رَّسُوْلَ اللهِ وَ خَاتَمَ النَّبِیّٖنَ وَ كَانَ اللهُ بِكُلِّ شَیْءٍ عَلِیْمًا.

আয়াতের প্রকৃত অনুবাদ৩  : মুহাম্মাদ তোমাদের কোনো পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহ্র রাসূল এবং শেষ নবী। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে জ্ঞাত।

 

কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের বিকৃতি

সূরা আহযাবের এ আয়াতের মধ্যে আল্লাহ তাআলা তাঁর  রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ‘খাতামুন্নাবীয়্যীন’ অর্থাৎ শেষনবী আখ্যায়িত করেছেন। অথচ কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের স্পর্ধা দেখুন, সেই একই আয়াতে এবং সেই একই শব্দ ‘খাতামুন্নাবীয়্যীন’-এর অপব্যাখ্যা করে তারা নবীজীর পরেও নবুওতের অবকাশ তৈরির ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। যাতে তাদের গুরু মির্যা কাদিয়ানীর নবুওত দাবির সুযোগ তৈরি হয়। দেখুন-

   

কাদিয়ানীদের উর্দু অনুবাদে বিকৃতি৪  :

نہ محمد تم میں سے کسی مرد کے باپ تھے نہ ہیں (نہ ہونگے) لیکن اللہ کے رسول ہیں بلکہ (اس سے بھی بڑھ کر) نبیوں کی مہر ہیں اور اللہ ہر ایک چیز سے خوب آگاہ ہے۔ -تفسیر صغیر از مرزا  بشیر الدین محمود  بن مرزا غلام احمد قادیانی

 

কাদিয়ানীদের বাংলা অনুবাদে বিকৃতি ৫ :  মুহাম্মাদ তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কাহারও পিতা নহে, কিন্তু সে আল্লাহর রসূল এবং নবীগণের মোহর; এবং আল্লাহ সকল বিষয়ে সর্বজ্ঞানী। -কুরআন মজীদ, (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা) পাঞ্জাবের কাদিয়ান থেকে প্রকাশিত সংস্করণ ২০০১ঈ.

 

কাদিয়ানীদের ইংরেজি অনুবাদে বিকৃতি :

Muhammad is not the father of your men, but he is the Messenger of Allah and Seal of the Prophets; -THE HOLY QUR’AN, Translated by Maulawi Sher Ali.

 

কাদিয়ানীদের উর্দু অনুবাদের টীকায় কৃত অপব্যাখ্যা ৬  :

یعنی آپ کی تصدیق کے بغیر اور آپ کی تعلیم کی شہادت کے بغیر کوئی شخص نبوت یا ولایت کے مقام تک نہیں پہنچ سکتا... یعنی ختم نبوت کے یہ معنے ہیں کہ محمد رسول اللہ صلی اللہ علیہ وسلم کا مقام سب نبیوں سے افضل ہے۔ تفسیر صغیر ، حاشیہ: ২

 

কাদিয়ানীদের বাংলা অনুবাদের টীকায় অপব্যাখ্যা  :

...অতএব, খাতামান্ নাবীঈন-এর অর্থ হইবে: নবীগণের মোহর, সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বতোভাবে পরিপূর্ণ নবী, নবীগণের সৌন্দর্য ও অলঙ্কার। গৌণ অর্থে নবীগণের শেষ। ...খাতামুন্নাবীঈন-এর অর্থ যদি শেষ নবী করা হয়, যাহার পরে আর কখনও কোনো নবী আসিবেন না, তাহা হইলে প্রসঙ্গের সহিত ইহার কোনো সঙ্গতি থাকে না এবং খাপছাড়া হইয়া পড়ে। ... কুরআন স্পষ্ট বলিয়াছে, নবী করীম (সা:)-এর পরেও উম্মতি নবী আসিবেন (৪ : ৭০; ৭:৩৬)। মহানবী (সা:) নিজের মনেও পরবর্তী কালে নবীর আগমন হইবে বলিয়া স্পষ্ট ধারণা রাখিতেন। -ঢাকার বকশী বাজার থেকে ১৯৮৯ সনে প্রকাশিত ‘কুরআন মজীদ’ (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা) টীকা নং- ২৩৫৯, পৃ. ৮৭৬

 

ইংরেজি অনুবাদের টীকায় অপব্যাখ্যা :

So the expression Khatamun-Nabiyyin  would mean, the Seal of the Prophets; the best and most perfect of the Prophets; the embellishment and ornament of the Prophets. Secondarily it means, the last of the Prophets... If the expression be taken to mean that he is the last of the Prophets and that no Prophet will come after him, then the verse would appear to be out of tune and to possess no relevance with the context.... the Qur’an clearly speaks of the advent of Prophets after the Holy Prophet (7 : 36). The Holy Prophet himself was clear in his mind as to the continuity of Prophethood after him.                                     

-THE HOLY QUR'AN P. 1222-1223, Commentary No. 2359 (ARABIC TEXT WITH ENGLISH TRANSLATION & SHORT COMMENTARY) Edited by Malik Ghulam Farid.

লক্ষ্য করুন : এখানে বিভিন্ন ভাষায় আয়াতটির অনুবাদ ও টীকায় কাদিয়ানীরা  ছয়টি দাবি করেছে-

এক. খাতামুন্নাবীঈন-এর অর্থ নবীগণের মোহর, সকল নবীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ, সর্বতোভাবে পরিপূর্ণ নবী, নবীগণের সৌন্দর্য ও অলঙ্কার।

দুই. ‘খাতামুন্নাবীয়্যীন’ শব্দের এক অর্থ ‘নবীগণের শেষ’ হলেও এ অর্থটি গৌণ। অর্থাৎ মুখ্য ও মৌলিক নয়।

তিন. ‘খাতামুন্নাবীঈন’-এর অর্থ ‘শেষনবী’ করা হলে আয়াতের প্রসঙ্গের সঙ্গে এটি খাপ খায় না।

চার. কুরআন স্পষ্ট বলেছে, নবীজীর পরেও উম্মতি নবী আসবে।

পাঁচ. নবীজী নিজেও পরবর্তীকালে নতুন নবীর আগমন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখতেন।

ছয়. নবুওতের স্তর পর্যন্ত পৌঁছাতে হলে নবীজীর সত্যায়ন অপরিহার্য।

বলাবাহুল্য, এসব ভিত্তিহীন দাবির মাধ্যমে কাদিয়ানীরা সরাসরি খতমে নবুওতের আকীদার অস্বীকার করেছে; যা পরিষ্কার কুফুরি। এসব অপব্যাখ্যা দ্বারা তাদের আসল উদ্দেশ্য, নিজেদের গুরু মির্যা গোলাম আহমদের নবুওত দাবির বৈধতা সৃষ্টি করা।

অথচ আলোচ্য আয়াতসহ কুরআনে কারীমের প্রায় একশ আয়াত, আল্লাহ্র রসূলের প্রায় একশ হাদীস, সাহাবা, তাবেঈনের অগণিত আসার ও ঘটনা এবং অসংখ্য আরবী অভিধানপ্রণেতাদের প্রমাণসিদ্ধ বক্তব্যের ভিত্তিতে সকল যুগের মুসলিম উম্মাহ এ ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ যে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাতামুন্নাবীয়্যীন-অর্থাৎ সর্বশেষ নবী; তাঁর পরে আর কাউকে কোনো ধরনের নবুওত প্রদান করা হবে না। (স্বয়ং মির্যা কাদিয়ানীর রচনায় এই আয়াতের বিকৃতি দেখুন প্রবন্ধের বিগত কিস্তিতে।)

 

২. সূরা নিসা, আয়াত ৬৯

وَ مَنْ یُّطعِ اللهَ وَ الرَّسُوْلَ فَاُولٰٓىِٕكَ مَعَ الَّذِیْنَ اَنْعَمَ اللهُ عَلَیْهِمْ مِّنَ النَّبِیّٖنَ وَ الصِّدِّیْقِیْنَ وَ الشُّهَدَآءِ وَ الصّٰلِحِیْنَ ۚ وَ حَسُنَ اُولٰٓىِٕكَ رَفِیْقًا.

আয়াতের প্রকৃত অনুবাদ : আর যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, তারা সেইসকল লোকদের সঙ্গে থাকবে, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন, অর্থাৎ নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও সালিহগণের সঙ্গে। আর কতই না উত্তম সঙ্গী তারা!

 আয়াতের প্রকৃত মর্ম : আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ পাক ঘোষণা করছেন যে, এ পৃথিবীতে আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের আনুগত্য করলে আখেরাতে নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ এবং নেককারগণের সঙ্গ নসীব হবে।

কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের বিকৃতি : কাদিয়ানী ধর্মমতের প্রবর্তক মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর দাবি হল, আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্যের মাধ্যমে নবী হওয়া যায়। (নাউযু বিল্লাহ) এ পথ ধরেই সে নিজেকে নবী দাবি করেছিল। তার অনুসারীরা এ কুফুরি আকীদাটিকে স্বয়ং কুরআন থেকে সাব্যস্ত করার হীন উদ্দেশ্যে আলোচ্য আয়াতে বিকৃতি করেছে। আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করলে (আখেরাতে) ‘নবীগণের সঙ্গে থাকবে’- একথার অর্থ তারা করেছে- আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করলে নবীগণের মধ্যে শামিল হবে!’ তাদের অনুবাদ ও টীকাগুলো দেখুন-

 

কাদিয়ানীদের উর্দু অনুবাদে বিকৃতি :

 اور جو( لوگ بھی)اللہ اور اس رسول کی اطاعت کریں گے وہ ان لوگوں میں شامل ہوں گے جن پر اللہ نے انعام کیا ہے یعنی انبیاء اور صدیقین اور شہداء اور صالحین (میں) اور یہ لوگ (بہت ہی) اچھے رفیق ہیں۔تفسیر صغیر

কাদিয়ানীদের বাংলা অনুবাদে বিকৃতি : এবং যাহারা আল্লাহ্ এবং এই রসূলের আনুগত্য করিবে তাহারা ঐসকল লোকদের মধ্যে শামিল হইবে যাহাদিগকে আল্লাহ পুরস্কার দান করিয়াছেন অর্থাৎ নবীগণ এবং সিদ্দীকগণ এবং শহীদগণ এবং সালেহ্গণের মধ্যে। এবং ইহারাই সঙ্গী হিসাবে উত্তম। -‘কুরআন মজীদ’,  (কাদিয়ান থেকে প্রকাশিত)

 

কাদিয়ানীদের ইংরেজি অনুবাদে বিকৃতি :

And whose obeyes Allah and this Messenger of his shall be among those on whom Allah has bestowed His blessings, namely, the Prophets, the Truthful, the Martyrs, and the Righteous. And excellent companions are these. -THE HOLY QUR'AN- Traanslated by Maulawi Sher Ali.

       

কাদিয়ানীদের উর্দু অনুবাদের টীকায় কৃত অপব্যাখ্যা :

قرآن کریم میں مع کا لفظ ہے جس کے معنی ساتھ کے ہیں مگر مع کے معنی من کے بھی ہوتے ہیں اور وہی معنے ہم نےیہاں کیے ہیں.... -تفسير صغير، ح :১

 

বাংলা অনুবাদের টীকায় অপব্যাখ্যা : এই আয়াতটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইহা ব্যক্ত করিতেছে যে, মুসলমানদের জন্য আধ্যাত্মিক উন্নতির সকল দরজা খোলা রহিয়াছে। চারিটি আধ্যাত্মিক পদ-মর্যাদা যথা নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সালেহ্- এই চারিটি আধ্যাত্মিক পদমর্যাদাই হযরত রাসূলে আকরাম সা.-এর অনুসরণের ফলে লাভ করা যায়। ...নবুওত দুই প্রকারের- সাধারণ ও বিশেষ। বিশেষ প্রকারের নবুওত, যাহা শরীয়তবাহী, তাহা অপ্রাপ্য অর্থাৎ উহা প্রাপ্তির পথ রুদ্ধ, কিন্তু সাধারণ নবুওত লাভের পথ উন্মুক্ত রহিয়াছে অর্থাৎ কেবল আঁ-হযরত (সা:)-এর পূর্ণ অনুকরণ এবং অনুসরণের মাধ্যমে শরীয়তবিহীন উম্মতি নবুওতের দ্বার উন্মুক্ত রহিয়াছে। -বকশী বাজার থেকে প্রকাশিত ‘কুরআন মজীদ’, টীকা নং- ৬২৯, পৃ. ১৯৭-১৯৮

 

ইংরেজি অনুবাদের টীকায় কৃত বিকৃতি :

The verse is important as it describes all the avenues of spiritual progress open to Muslims. All the four spiritual ranks—the Prophets; the Truthful; the Martyrs and the Righteous—can now be attained only by following the Holy Prophet... "Prophethood is of two kinds, general, and special. The special Prophethood, viz. the Law-bearing Prophethood, is now unattainable; but the general Prophethood continues to be attained." -THE HOLY QURAN, P 288, Commentory No : 629 ( Edited by Malik Ghulam Farid.)

 

লক্ষ্যণীয় : এখানে কাদিয়ানীরা তাদের অনুবাদ ও টীকাগুলোতে চারটি দাবি করেছে-

এক. যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে তারা নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সালিহীনদের মধ্যে শামিল হবে। অর্থাৎ নবীজীর আনুগত্যের মাধ্যমে নবুওত লাভ করে নবী হতে পারবে।

দুই. মুসলমানদের জন্য আধ্যাত্মিক উন্নতির সকল দরজা এমনকি নবী হওয়ার দরজাও খোলা।

তিন. বিশেষ প্রকারের অর্থাৎ শরীয়তবাহী নবুওত লাভের পথ বন্ধ। কিন্তু সাধারণ নবুওত অর্থাৎ শরীয়তবিহীন উম্মতি নবুওতের দরজা উন্মুক্ত।

চার. এই উম্মতি নবুওত কেবল নবীজীর পূর্ণ অনুসরণের মাধ্যমে লাভ করা যাবে।

জানাকথা, এই সবগুলোই কুফুরী বক্তব্য। ইসলামের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তাফসীরগ্রন্থসমূহে এ আয়াতের উদ্দেশ্য পরিষ্কার প্রেক্ষাপটসহ একাধিক সাহাবী এবং তাবেঈ থেকে বর্ণিত হয়েছে। নবুওত লাভের সঙ্গে তার দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। আর খতমে নবুওত বা আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পর নবুওতের দরজা বন্ধ হওয়ার বিষয়টি কুরআন ও সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মতের আলোকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত। কিন্তু কাদিয়ানীদের লক্ষ্য হচ্ছে, কুরআন দ্বারাই  নির্লজ্জভাবে নিজেদের কুফুরী বিশ্বাসের পক্ষে অবকাশ তৈরি করা।৭

 

৩. সূরা আ‘রাফ, আয়াত ৩৫

یٰبَنِیْۤ اٰدَمَ اِمَّا یَاْتِیَنَّكُمْ رُسُلٌ مِّنْكُمْ یَقُصُّوْنَ عَلَیْكُمْ اٰیٰتِیْ ۙ فَمَنِ اتَّقٰی وَ اَصْلَحَ فَلَا خَوْفٌ عَلَیْهِمْ وَ لَا هُمْ یَحْزَنُوْنَ.

আয়াতের প্রকৃত অনুবাদ : (মানুষকে সৃষ্টি করার সময়ই আল্লাহ তাআলা সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে,) হে বনী আদম! যদি তোমাদের কাছে তোমাদেরই মধ্য হতে কোনো রাসূল এসে আমার আয়াতসমূহ তোমাদেরকে পড়ে শোনায়, তবে তখন যারা তাকওয়া অবলম্বন করবে ও নিজেদের সংশোধন করবে, তাদের কোনও শংকা নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।

 কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের বিকৃতি : আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে নবীগণের আগমনের ধারা সম্পর্কে সমস্ত আদম সন্তানকে সম্বোধন করে বলেছেন, হে আদম সন্তান! যখনই তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য হতে কোনো রাসূল আগমন করবে, তখন যারা তাঁর প্রতি ঈমান এনে তাকওয়া অবলম্বন করবে, শিরক থেকে বেঁচে থাকবে, তাঁর অনুসরণ করে নিজেদের সংশোধন করবে, তাদের দুনিয়া ও আখিরাতে কোনো শংকা বা দুঃখ থাকবে না।

এই ফরমানের ভিত্তিতে আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর শুরু থেকে শেষনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত অগণিত নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। কিন্তু কাদিয়ানীরা তাদের গুরুর জন্য নবুওতের অবকাশ তৈরির উদ্দেশ্যে এ আয়াতের বিকৃত অর্থ করে সূক্ষ্মভাবে দাবি করতে চেয়েছে যে, এখান থেকে আল্লাহর রাসূলের পরও নবুওত জারি থাকা সাব্যস্ত হয়। তাদের উদ্ধৃতি লক্ষ্য করুন-

কাদিয়ানীদের বাংলা অনুবাদের টীকায় কৃত অপব্যাখ্যা : ইহা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, পূর্ববর্তী কতক আয়াতের ন্যায় (৭ : ২৭-২৮ ও ৩২) এই আয়াতেও ‘হে আদম সন্তানগণ’ এই সম্বোধন আঁ-হযরত (সা:)-এর যুগের লোকদিগের প্রতি এবং পরবর্তী বংশধরগণের প্রতি প্রযোজ্য, যাহারা এখনও জন্মগ্রহণ করে নাই; এই সম্বোধন সেইসকল লোকের প্রতি নহে, যাহারা দূর অতীতে বাস করিত এবং আদম (আ:)-এর অব্যবহিত পরে আসিয়াছিল। -বকশী বাজার থেকে প্রকাশিত ‘কুরআন মজীদ’, টীকা নং- ৯৭০, পৃ. ৩১৪

 

ইংরেজি অনুবাদের টীকায় কৃত অপব্যাখ্যা :

The point is worthy of special note that, like some preceding verses (e.g. 7:27, 28 & 32), the address in the words, O children of Adam, is to the people of the Holy Prophet’s time and to the generations that are yet to be born and not to the people who lived in the distant past and came immediately after Adam. -THE HOLY QURAN, P 448-449, Commentory No : 970 ( Edited by Malik Ghulam Farid.)

 

লক্ষ্য করুন, উপরিউক্ত টীকাগুলোতে কাদিয়ানীরা দুটি দাবি করেছে-

এক.  আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলার ‘হে আদম সন্তান’ সম্বোধনটি নবীজীর যুগের লোকদের প্রতি এবং পরবর্তী বংশধরদের প্রতি প্রযোজ্য, যারা এখনো দুনিয়াতে আসেনি। অর্থাৎ আয়াতের অর্থ হবে, ‘হে আদম সন্তান! তোমরা যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগের লোক, এবং যারা তার পরবর্তী বংশধর! তোমাদের কাছে যদি তোমাদেরই মধ্য হতে কোনো রাসূল এসে আমার আয়াতসমূহ তোমাদেরকে পড়ে শোনায়, তবে তখন যারা তাকওয়া অবলম্বন করবে...’। (অর্থাৎ এই বিকৃত অর্থ অনুযায়ী আল্লাহর রাসূল-এর পরবর্তী বংশধরদের মাঝেও নবী আসতে পারে।)

দুই. এই সম্বোধন সেইসকল লোকের প্রতি নয়, যারা দূর অতীতে বাস করত এবং আদম (আ:)-এর পরে দুনিয়াতে এসেছিল।

লক্ষ করুন, কাদিয়ানীরা আল্লাহ্র রাসূলের পরও নবুওতের অবকাশ তৈরির জন্য কত সূক্ষ্মভাবে আয়াতের বিকৃতি অর্থ করেছে। আসলে তাদের কুমতলব হচ্ছে, যেকোনো ছুতোয় খোদ কুরআন থেকেই আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরে নবুওত লাভের অবকাশ সৃষ্টি করা। যাতে তাদের গুরুর নবুওত দাবিকে বৈধতা দেওয়া সম্ভব হয়।

জানা থাকা উচিত, এটি কুরআন বিকৃতির এক জঘন্য স্পর্ধা। আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরে যে কোনো ধরনের নবুওত লাভের দরজা উন্মুক্ত থাকার বিশ্বাস সরাসরি কুফুরী বিশ্বাস। এমন কুফুরী বিশ্বাসকে খোদ কুরআন থেকেই সাব্যস্ত করার সুচতুর প্রচেষ্টা যে কোনো ইসলামবিদ্বেষী ষড়যন্ত্রকে হার মানায়।

 

৪. সূরা বাকারা, আয়াত ৪

وَ بِالْاٰخِرَةِ هُمْ یُوْقِنُوْنَ.

আয়াতের প্রকৃত অনুবাদ : আর আখেরাতের প্রতি তারা (মুত্তাকীগণ)  পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখে।

ইসলামী দৃষ্টিকোণ ও কাদিয়ানীদের বিকৃতি : আল্লাহ্র রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরে ওহীর ধারা বন্ধ হওয়ার বিষয়টি ইসলামের অন্যতম মৌলিক আকীদা। তাঁর পরে কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ্র পক্ষ থেকে কাউকে নবুওত প্রদান করা হবে না। তাই কোনো ওহীও নাযিল হবে না; কিন্তু মির্যা কাদিয়ানীর দাবি, তার ওপর প্রচুর পরিমাণে ওহী অবতীর্ণ হয়েছে। এ কুফুরী দাবিকে কুরআন দ্বারা প্রমাণ করার বাসনায় কাদিয়ানী সম্প্রদায় উল্লিখিত আয়াতে ‘আখিরাহ’ শব্দের বিকৃত অর্থ করে বলেছে, এখানে আল্লাহ তাআলা মির্যা সাহেবের উপর অবতীর্ণ ওহীর (?) আলোচনা করেছেন! তাদের উদ্ধৃতিগুলো দেখুন-

কাদিয়ানীদের উর্দু অনুবাদে বিকৃতি :

اور آئندہ ہونے والی (موعود باتوں) پر(بھی) یقین رکھتے ہیں۔تفسیر صغیر.

কাদিয়ানীদের বাংলা অনুবাদের টীকায় কৃত অপব্যাখ্যা : ‘আল আখেরাত’ অর্থ (ক) শেষ আবাস অর্থাৎ পরকাল, (খ) ইহা দ্বারা রসূল পাক (সাঃ)-এর পরবর্তী সময়ে যেসব ওহী-ইলহাম বা ঐশী বাণী অবতীর্ণ হইবে সেইগুলিকেও বুঝায়। এই দ্বিতীয় অর্থটি কুরআনের ৬২:৩,৪ আয়াতে আরও ব্যাখ্যা করা হইয়াছে, যেখানে কুরআন রসূলে পাক (সাঃ)-এর দ্বিতীয় বিকাশের সংবাদ প্রদান করিয়াছে। তাঁহার প্রথম বিকাশ ঘটিয়াছিল খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে যখন তাঁহার কাছে কুরআন নাযেল হইয়াছিল। তাঁহার দ্বিতীয় বিকাশের কথা ছিল আখেরী যামানাতে তাঁহার একজন বিশিষ্ট অনুসারী প্রতিভূর মাধ্যমে। এই দ্বিতীয় বিকাশের ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হইয়াছে প্রতিশ্রুত মাসীহ-মাহদীর মাধ্যমে।       -বকশী বাজার থেকে প্রকাশিত কুরআন মজীদ, টীকা নং-২৫, পৃ. ১৪

 

ইংরেজি অনুবাদের টীকায় কৃত অপব্যাখ্যা :

Al-Akhirah means, (a) the Last Abode, i.e. the next life; (b) it may also signify the revelation which is to follow. This second meaning of the word finds further exposition in 62:3, 4 where the Qur’an speaks of two advents of the Holy Prophet. His first advent took place among the Arabs in the 7th century of the Christian era when the Qur’an was revealed to him; and his second advent was to take place in the Latter Days in the person of one of his followers. This prophecy found its fulfilment in the person of Ahmad, the Promised Messiah and Founder of the Ahmadiyya Movement. -THE HOLY QURAN, P 20, Commentory No : 25 ( Edited by Malik Ghulam Farid.)

 

উল্লেখ্য- আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় কাদিয়ানীরা পাঁচটি দাবি করেছে-

এক. এখানে ‘আলআখিরাহ’ শব্দ দ্বারা রসূল সা.-এর পরবর্তী সময়ে যেসব ওহী-ইলহাম অবতীর্ণ হবে, সেগুলিকেও বুঝায়।

দুই. এ অর্থটি কুরআনের আরো আয়াতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

তিন. কুরআন রাসূলে পাক সা.-এর দ্বিতীয় বিকাশের সংবাদ প্রদান করেছে। (অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বিতীয়বার আগমন করবেন- এই সংবাদ)

চার. আল্লাহ্র রাসূলের প্রথম বিকাশ হয়েছিল খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে। আর দ্বিতীয় বিকাশের কথা ছিল আখেরী যামানাতে তাঁর একজন বিশিষ্ট অনুসারী ‘প্রতিভূর’ মাধ্যমে।

পাঁচ. আল্লাহ্র রাসূলের এই দ্বিতীয় বিকাশের ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়েছে প্রতিশ্রুত মাসীহ ও মাহদীর আগমনের মাধ্যমে।

(অর্থাৎ তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী মির্যা কাদিয়ানী- যাকে তারা স্বয়ং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ মনে করে- তার আগমনের মাধ্যমে।)

স্পষ্টকথা, এসবগুলোই কুফুরী আকীদা। সূরা বাকারার আলোচ্য আয়াতে মুত্তাকী লোকদের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হয়েছে যে, তারা আখিরাত তথা পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে। কিন্তু কাদিয়ানীরা বিকৃত করে এর অর্থ দাঁড় করিয়েছে ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে অবতীর্ণ ওহী-ইলহামের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে’। যা সম্পূর্ণ কুফরী বিশ্বাস। তাদের মতলব একটাই, যেকোনো উপায়ে কুরআন থেকে আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরে নবুওতের অবকাশ তৈরি করা। নির্লজ্জভাবে নিজেদের গুরুর কথিত নবুওতের বিশ্বাস আয়াতের মাঝে আরোপ করা, যা সরাসরি কুরআনের বিকৃতি।

 

খ) মির্যা কাদিয়ানীকে ‘আল্লাহ্র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দ্বিতীয় বিকাশ’ সাব্যস্ত করতে বিকৃতি

 

১. সূরা জুমুআ, আয়াত ৩

وَّ اٰخَرِیْنَ مِنْهُمْ لَمَّا یَلْحَقُوْا بِهِمْ  وَ هُوَ الْعَزِیْزُ الْحَكِیْمُ.

আয়াতের প্রকৃত অনুবাদ : এ রাসূল প্রেরিত হয়েছেন অন্য আরো লোকদের জন্য, যারা এখনো তাদের সাথে মিলিত হয়নি। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

আয়াতের প্রকৃত মর্ম : আলোচ্য আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন যুগের মানুষদের পাশাপাশি কিয়ামত পর্যন্ত আগত সমগ্র মানবজাতির জন্যও রাসূল। সকলের প্রতিই তিনি প্রেরিত হয়েছেন। সবার জন্যই তিনি কুরআনের ইলম নিয়ে আগমন করেছেন। -দেখুন, তাফসীরে ইবনে কাসীর ৮/১১৫; সংক্ষিপ্ত তফসীরে মাআরিফুল কুরআন, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান অনূদিত পৃ. ১৩৬৯

কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের বিকৃতি : মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর অনেক কুফুরী আকীদার একটি হল, আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দু’বার পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। একবার মক্কায় হযরত মুহাম্মাদের সত্তায়। দ্বিতীয়বার পাঞ্জাবের কাদিয়ানে মির্যা গোলাম আহমদের সত্তায়। এ প্রলাপের ভিত্তিতেই মির্যা কাদিয়ানী ‘হুবহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ’ হওয়ার দাবি করেছে। (নাউযুবিল্লাহ) বিষয়টি মির্যা কাদিয়ানীর উদ্ধৃতি থেকে গত কিস্তিতে আলোচনা করা হয়েছে।

কাদিয়ানীরা এই কুফুরী আকীদাকে কুরআন দ্বারা সাব্যস্ত করার জন্য সূরা জুমুআর এ আয়াতের মর্ম বিকৃত করে বলেছে যে, এর মধ্যে আল্লাহ তাআলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ‘দ্বিতীয় আগমন’ অর্থাৎ তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী মির্যা কাদিয়ানীর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। লক্ষ্য করুন-

কাদিয়ানীদের উর্দু অনুবাদে বিকৃতি :

 اور ان کے سوا ایک دوسری قوم میں بھی وہ اس کو بھیجے گا جو ابھی تک ان سے ملی نہیں اور وہ غالب (اور) حکمت والا ہے- تفسیر صغیر .

কাদিয়ানীদের বাংলা অনুবাদে বিকৃতি : এবং (তিনি তাহাকে আবির্ভূত করিবেন) তাহাদের মধ্য হইতে অন্য লোকের মধ্যেও, যাহারা এখন পর্যন্ত তাহাদের সঙ্গে মিলিত হয় নাই। এবং তিনি পরাক্রমশীল, পরম প্রজ্ঞাময়। -ভারতের কাদিয়ান থেকে প্রকাশিত ‘কুরআন মজীদ’।

 

কাদিয়ানীদের ইংরেজি অনুবাদে বিকৃতি:

And He will raise him among others of them who have not yet joined them. He is the Mighty, the Wise. -THE HOLY QURAN ( ARABIC TEXT WITH ENGLISH TRANSLATION & SHORT COMMENTARY)

 

কাদিয়ানীদের উর্দু অনুবাদের টীকায় কৃত অপব্যাখ্যা :

اس آیت میں اس حدیث کی طرف اشارہ ہے جس میں آتا ہے ...لو كان الإيمان بالثريا... اس میں مہدی معہود کی خبر ہے۔تفسیر صغیر. ح : ১

 

কাদিয়ানীদের বাংলা অনুবাদের টীকায় অপব্যাখ্যা : অথবা এই আয়াতটির তাৎপর্য ইহাও হইতে পারে যে, মহানবী সা: অন্য আরেক দল লোকের মধ্যে উত্থিত হইবেন, যাহারা তাহার সমসাময়িক অনুসারীদের সাথে মিলিত হয় নাই। এই আয়াতে শেষ যুগে প্রতিশ্রুত মাসীহরূপে মহানবী সা:-এর দ্বিতীয় আধ্যাত্মিক অভ্যুদয় ঘটিবে বলিয়া ভবিষ্যদ্বাণী রহিয়াছে। মহানবী সা: স্বয়ং এইরূপ ঘটার প্রতিশ্রুতি দিয়া গিয়াছেন। বিষয়টির উপর একটি প্রসিদ্ধ হাদিস রহিয়াছে।.... হুযুর আকরাম সা. সালমান ফারসীর উপর হাত রাখিয়া বলিলেন, ঈমান যদি সপ্তর্ষি ম-লেও উঠিয়া চলিয়া যায় তথাপি ইহাদের (পারস্য বংশীয়দের) এক ব্যক্তি নিশ্চয়ই তাহা ফিরাইয়া আনিবে।... মহানবী সা:-এর এই বর্ণনা হইতে বুঝা যায়, আয়াতটিতে যে ব্যক্তির আগমনের কথা বলা হইয়াছে, তিনি পারস্য বংশীয় হইবেন। আহমদীয়া জামাতের প্রতিষ্ঠাতা প্রতিশ্রুত মাসীহ পারস্য বংশীয় ছিলেন।... অতএব, দেখা যায় যে, কুরআন এবং হাদীস উভয়েই এই একই কথা ব্যক্ত করিতেছে যে, প্রতিশ্রুত মাসীহের সত্তার মধ্যেই মহানবী সা:-এর দ্বিতীয় আগমন সম্পন্ন হইবে।   -বকশী বাজার থেকে প্রকাশিত ‘কুরআন মজীদ’, টীকা নং- ৩০৪৬, পৃ. ১১৭০-১১৭১

 

কাদিয়ানীদের ইংরেজি টীকায় কৃত অপব্যাখ্যা :

....Or, the verse may signify that the Holy Prophet will be raised among another people who have not yet joined his immediate followers. The reference in the verse and in a well-known saying of the Holy Prophet is to the Second Advent of the Holy Prophet himself in the person of the Promised Messiah in the Latter Days.... the Holy Prophet put his hand on Salman and said, 'If Faith were to go up to the Pleiades, a man from these would, surely, find it' (Bukhari). This saying of the Holy Prophet shows that the verse applies to a man of Persian descent. The Promised Messiah, the Founder of the Ahmadiyya Movement, was of Persian descent.... Thus the Qur’an and the Hadith both agree that the present verse refers to the Second Advent of the Holy Prophet in the person of the Promised Messiah. -THE HOLY QURAN, P 1614, Commentory No : 3046 ( Edited by Malik Ghulam Farid.)

 

লক্ষ্য করুন : এখানে আয়াতের অনুবাদ ও টীকায় কাদিয়ানীদের ছয়টি দাবি ফুটে উঠেছে-

এক. এই আয়াতের অর্থ হল, মহানবী সা. পৃথিবীতে পুনরায় আগমন করবেন।

দুই. তাঁর এ আগমন শেষযুগে প্রতিশ্রুত মাসীহরূপে হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে।

তিন. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই তাঁর এই দ্বিতীয় আগমনের ওয়াদা দিয়েছেন।

চার. তাঁর এ দ্বিতীয় আগমন সম্পর্কে একটি প্রসিদ্ধ হাদীস রয়েছে যে, ‘ঈমান যদি সুরাইয়া তারকায়ও চলে যায়, তবে হযরত সালমান ফারসী রা.-এর গোত্রের লোকজন তা নিয়ে আসবে।’ -এ হাদীস থেকে (কাদিয়ানী বিশ্বাসমতে) বুঝা যায়, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পারস্য বংশীয় এক ব্যক্তির সত্তার মধ্যে আগমন করবেন।

পাঁচ. মির্যা গোলাম আহমদ পারস্য বংশীয় ছিল। বিধায় তার সত্তার মধ্যেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দ্বিতীয় আবির্ভাব ঘটেছে।

ছয়. এ বিষয়টি কুরআন এবং হাদীস উভয়টি দ্বারা প্রমাণিত।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এ সবই কুফুরী বিশ্বাস। ঈমান ভঙ্গের জন্য এর যে কোনো একটি বিশ্বাসই যথেষ্ট। এ জঘন্য বিশ্বাসগুলো প্রমাণ করার জন্য কাদিয়ানীরা আলোচ্য আয়াতের পাশাপাশি একটি হাদীসেরও অপব্যাখ্যা করে থাকে। সহীহ বুখারী (হাদীস ৪৮৯৭) ও সহীহ মুসলিমে (হাদীস ২৫৪৬) বর্ণিত ঐ হাদীসের উদ্দেশ্য হচ্ছে, হযরত সালমান ফারসী রা.-এর বংশধরগণ ইলম ও ঈমানের ব্যাপক প্রসার করবে, যা পরবর্তী যুগে পারস্যের মুসলিম মনীষীদের মাধ্যমে পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। এর সঙ্গে আল্লাহ্র রাসূলের দ্বিতীয় আবির্ভাবের কুফুরী বিশ্বাস অথবা প্রতিশ্রুত ঈসা আগমনের কানাকড়িও সম্পর্ক নেই।  এ আয়াতের বিকৃতি দেখুন স্বয়ং মির্যা কাদিয়ানীর রচনায়- আয়নায়ে কামালাতে ইসলাম, রূহানী খাযায়েন ৫/২২০; আইয়ামে সুলহ, রূহানী খাযায়েন ১৪/৩০৪; এক গলতি কা ইযালা, রূহানী খাযায়েন ১৮/২১২; তাতিম্মায়ে হাকীকাতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/৫০২

* আমরা গত কিস্তিতে আলোচনা করেছিলাম যে, মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী কুরআন ও সুন্নাহ্র সর্বত্রই কেবল নিজেকে দেখতে পেত। আলোচ্য হাদীসে বর্ণিত ‘পারস্য বংশীয়’ হওয়ার দাবিটিও তার একটি উদাহরণ। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, মির্যা কাদিয়ানী নিজেকে স্বয়ং হযরত সালমান ফারসীও দাবি করেছিল! (দেখুন, হাকীকাতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/৮১)

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একই ব্যক্তি সালমান ফারসী এবং তাঁর বংশধর কীভাবে হতে পারে?

শুরুর দিকে মির্যা গোলাম আহমদ নিজেকে সমরকন্দ থেকে ভারতে আগত ‘জমিদার মোগল বংশীয়’ বলে দাবি করেছিল। বলেছিল, বংশের পূর্বপুরুষদের এযাবৎ সংরক্ষিত নথিপত্রের দ্বারা প্রমাণ হয়, বাদশাহ বাবরের যুগে আমার পূর্বপুরুষরা সমরকন্দ থেকে হিজরত করে দিল্লি এসেছিলেন। (ইযালায়ে আওহাম, রূহানী খাযায়েন ৩/১৬০; কিতাবুল বারিয়্যাহ, রূহানী খাযায়েন ১৩/১৬২-১৬৩)

কিন্তু পরবর্তীতে যখন এ ফযীলতওয়ালা হাদীসটি নজরে এল, তখন বাপ-দাদার নথিপত্রের কথা ভুলে গিয়ে মির্যা দাবি করে বসলেন যে, এখানে তার সম্পর্কে ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ করা হয়েছে। এ মর্মে তার উপর নাকি আল্লাহ তাআলার ওহী অবতীর্ণ হয়েছে যে, তিনি পারস্য বংশীয়; মোগলীয় নন! ‘না জানি, কোন্ ভুলে মোগল বংশের কথা বিখ্যাত হয়ে গেছে!’ (হাকীকাতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/৮০-৮১)

এক জায়গায় বলেছেন, ‘হাঁ, আমার নিকট পারস্য বংশীয় হওয়ার জন্য খোদার ইলহাম ব্যতীত কোনো প্রমাণ নেই।’ (তোহফায়ে গোলড়বিয়া, রূহানী খাযায়েন ১৭/১১৬)

এদিকে আবার যখন তিনি হাদীসে দেখলেন, হযরত ইমাম মাহদী সাইয়েদ বংশের হবেন, হযরত ফাতেমা রা.-এর বংশধর হবেন, তখন এবার দাবি করলেন, আমি পৈত্রিকভাবে মোগল বংশের হলেও আমার কয়েকজন দাদী সাইয়েদ বংশের ছিলেন! পিতার দিক থেকে আমি পারস্য বংশীয়। তবে মায়ের দিক থেকে আমাকে ফাতেমী বলা হয়েছে! (যমীমায়ে বারাহীনে আহমদিয়া-৫, রূহানী খাযায়েন ২১/৩৬৩, ৩৬৪)

আবার যখন লক্ষ্য করলেন, হযরত মুহিউদ্দীন ইবনে আরাবি রাহ. ‘ফুসূসুল হিকাম’ গ্রন্থে লিখেছেন, খাতামুল খুলাফা বা শেষ খলিফা হবেন চীন বংশোদ্ভূত; তখন মির্যা সাহেবও দাবি করলেন, আমি চীনা বংশোদ্ভূত! এটা নিশ্চিত যে, আমার অধিকাংশ দাদী-নানীরা মোগল বংশের, চীনা বংশোদ্ভূত এবং চীনের অধিবাসী! (হাকীকাতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/২০৯)

কল্পনা করুন পাঠক! একই ব্যক্তি সালমান ফারসীও আবার তাঁর বংশধরও! বংশীয়ভাবে মোগলও, পারসীয়ও, সায়্যেদও, আবার চায়না পুরুষও! আল্লাহ তাআলা নাকি সবই তাকে আখ্যায়িত করেছেন! আবার একইসঙ্গে তিনি হযরত ঈসার রূপেও আবির্ভূত হয়েছেন এবং হযরত মাহদীর রূপেও! এমনকি আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও নাকি দ্বিতীয়বার (নাউযু বিল্লাহ) তাঁর সত্তায় আত্মপ্রকাশ করেছেন! কী জগাখিচুড়ি ব্যক্তিত্ব! কী বাহারি তার বংশ-পরিচয়! কী উদ্ভট তার দাবি ও চিন্তা!

 

২. সূরা সাফ্, আয়াত ৬

وَ اِذْ قَالَ عِیْسَی ابْنُ مَرْیَمَ یٰبَنِیْۤ اِسْرَآءِیْلَ اِنِّیْ رَسُوْلُ اللهِ اِلَیْكُمْ مُّصَدِّقًا لِّمَا بَیْنَ یَدَیَّ مِنَ التَّوْرٰىةِ وَ مُبَشِّرًۢا بِرَسُوْلٍ یَّاْتِیْ مِنْۢ بَعْدِی اسْمُهٗۤ اَحْمَدُ ؕ فَلَمَّا جَآءَهُمْ بِالْبَیِّنٰتِ قَالُوْا هٰذَا سِحْرٌ مُّبِیْنٌ.

আয়াতের অনুবাদ : আর স্মরণ কর, যখন মারইয়াম তনয় ঈসা বলেছিল, হে বনী ইসরাঈল! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহ্র প্রেরিত রাসূল, আমার পূর্ববর্তী তাওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রাসূলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন। তাঁর নাম আহমদ। অতঃপর যখন সে স্পষ্ট নিদর্শনাবলিসহ আগমন করল তখন তারা বলল, এ তো এক প্রকাশ্য জাদু।

আয়াতের মর্ম ও কাদিয়ানীদের বিকৃতি : আলোচ্য আয়াতে হযরত ঈসা আ.-এর একটি বক্তব্য বর্ণিত হয়েছে। যার মধ্যে তিনি তাঁর পরে ‘আহমদ’ নামের রাসূলের আগমনের সুসংবাদ দান করেছেন। হাদীস শরীফে আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি হলাম আহমদ’। (বুখারী, হাদীস ৩৫৩২, ৪৮৯৬; মুসলিম ২৩৫৪, ২৩৫৫; তাফসীরে ইবনে কাসীর ৮/১০৯)

পুরো উম্মতের অকাট্য বিশ্বাস এবং সকল মুফাসসিরগণের ঐক্যমতেও এ ‘আহমাদ’ শব্দ আল্লাহ্র রাসূল-এর শানেই ব্যবহৃত হয়েছে।

কিন্তু বিকৃতিপ্রবণ গুরুর বিকৃতিপ্রবণ অনুসারীরা এখানেও নিজেদের গুরুকে দেখতে পেয়েছে। তাদের মতে এখানে ‘আহমাদ’ দ্বারা মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীও উদ্দেশ্য। সামনে লক্ষ্য করুন-

 

কাদিয়ানীদের উর্দু অনুবাদের টীকায় কৃত অপব্যাখ্যা :

پس اس آیت میں رسول کریم صلی اللہ علیہ وسلم کی بلا واسطہ اور آپ کے ایک بروز کی جس کا ذکر اگلی سورۃ میں ہے بالواسطہ خبر دی گئی ہے۔ تفسیر صغیر ، ح : ا

 

কাদিয়ানীদের বাংলা অনুবাদের টীকায় কৃত অপব্যাখ্যা : ...অতএব এই আয়াতের ভবিষ্যদ্বাণীতে ব্যবহৃত ‘আহমদ’ শব্দটি মহানবী সা:-এর উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হইয়াছে। এই যুক্তিধারার অনুসিদ্ধান্ত হিসাবে আহমদিয়া জামাতের প্রতিষ্ঠাতা প্রতিশ্রুত মাসীহের উপরও এই ভবিষ্যদ্বাণী সমভাবে প্রযোজ্য। কেননা তাঁহাকেও আল্লাহ তাআলা ওহীর মাধ্যমে ‘আহমদ’ নামে অভিহিত করিয়াছেন (বারাহীনে আহমদিয়া) এবং তাঁহার আগমনের মাধ্যমে মহানবী সা:-এর দ্বিতীয় প্রকাশ বা দ্বিতীয় আগমনের বাস্তবায়ন ঘটিয়াছে। মহানবী সা:-এর দ্বিতীয় প্রকাশ বা অভ্যুদয়ের কথা সূরা জুমু‘আর তৃতীয় আয়াতে সূক্ষ্ম ও স্পষ্টভাবে বলা হইয়াছে। -বকশী বাজার থেকে প্রকাশিত ‘কুরআন মজীদ’, টীকা নং- ৩০৩৭ পৃ. ১১৬৭

 

কাদিয়ানীদের ইংরেজি অনুবাদের টীকায় কৃত অপব্যাখ্যা :

...Thus the prophecy mentioned in the verse applies to the Holy Prophet, but as a corollary it may also apply to the Promised Messiah, Founder of the Ahmadiyya Movement, because he has also been called Ahmad in Divine revelation (Barahin-e-Ahmadiyya) and because also in his person the Second Manifestation or Second Advent of the Holy Prophet took place. To this Second Manifestation of the Holy Prophet, the third verse of Surah Al-Jumu‘ah pointedly refers.-THE HOLY QURAN, P 1608, Commentory No : 3037 ( Edited by Malik Ghulam Farid.)

 

লক্ষ্য করুন- কাদিয়ানীরা এখানে স্পষ্টভাবে কয়েকটি কুফুরী দাবি করেছে-

এক. এ আয়াতে ব্যবহৃত ‘আহমাদ’ শব্দটি আহমদিয়া জামাতের প্রতিষ্ঠাতা অর্থাৎ কাদিয়ানী ধর্মমতের প্রবর্তক মির্যা গেলাম আহমদের উপরও সমভাবে প্রযোজ্য।

দুই. আল্লাহ তাআলা তাকেও ওহীর মাধ্যমে ‘আহমদ’ অভিহিত করেছেন।

তিন. তার আগমনের মাধ্যমে আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দ্বিতীয় প্রকাশ বা দ্বিতীয় আগমনের বাস্তবায়ন ঘটেছে।

বলা বাহুল্য, এগুলো সরাসরি কুরআনের বিকৃতি এবং মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থে হস্তক্ষেপের শামিল।

আলোচ্য আয়াতের বিকৃতি দেখুন স্বয়ং মির্যা গোলাম আহমদের রচনায়- ইযালায়ে আওহাম, রূহানী খাযায়েন ৩/৪৬৩; যমীমায়ে তোহফায়ে গোলড়বিয়া, রূহানী খাযায়েন ১৭/৬৮-৬৯

 

গ) মির্যা কাদিয়ানীকে ‘প্রতিশ্রুত ঈসা ও ঈসার সামঞ্জস্য’ সাব্যস্ত করতে বিকৃতি

 

১. সূরা যুখরুফ, আয়াত ৫৭

وَ لَمَّا ضُرِبَ ابْنُ مَرْیَمَ مَثَلًا اِذَا قَوْمُكَ مِنْهُ یَصِدُّوْنَ.

আয়াতের প্রকৃত অনুবাদ : যখন মারইয়াম-তনয়ের দৃষ্টান্ত উপস্থিত করা হয়, তখন তোমার সম্প্রদায় তাতে শোরগোল আরম্ভ করে দেয়।

 

আয়াতের শানে নুযূল : আলোচ্য আয়াতে মক্কার কাফেরদের হযরত ঈসা আ. সম্পর্কে একটি আপত্তি সম্বন্ধে আলোকপাত করা হয়েছে। সূরা আম্বিয়ার ৯৮নং আয়াতে কাফেরদেরকে বলা হয়েছে যে, ‘তোমরা এবং যা কিছুর তোমরা উপাসনা কর, সব জাহান্নামের ইন্ধন হবে।’ এর উপর আপত্তি করে কাফেররা বলেছিল, ‘খ্রিস্টানরা তো হযরত ঈসার উপাসনা করে, তাহলে কি তিনিও জাহান্নামের ইন্ধন হবেন?’ তাদের একথার জবাব দেওয়া হয়েছে সূরা যুখরূফের এই আয়াত থেকে। (দ্র. তাফসীরে ইবনে কাসীর ৭/২৩৩)

 

কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের বিকৃতি : মির্যা কাদিয়ানী এবং কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের বিশ্বাস হল, আল্লাহ্র নবী হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর কবর কাশ্মীরের শ্রীনগরে অবস্থিত। কুরআন ও হাদীসে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম-এর আগমন সম্পর্কিত যত ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, তার উদ্দেশ্য, হযরত ঈসার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে আখেরী যামানায় এ উম্মতের এক ব্যক্তির আগমন ঘটবে। আর যথারীতি সে ব্যক্তি তাদের দৃষ্টিতে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী! এ কুফুরী বিশ্বাসটিকে তারা সূরা যুখরুফের আলোচ্য আয়াতের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। সামনে লক্ষ্য করুন-

 

 

কাদিয়ানীদের টীকায় বিকৃত অনুবাদ : ...এই আয়াতের আরো একটি অর্থ রহিয়াছে। ইহা এই যে, যখন মহানবী সা.-এর উম্মতকে বলা হইবে যে, ঈসা আ.-এর সহিত সর্বতোভাবে সামঞ্জস্য রাখিয়া অনুরূপ এক মহামানব মুহাম্মদী উম্মতে আগমন করিবেন এবং ইসলামের পুনর্জাগরণ দ্বারা ইহার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করিবেন, তখন এই শুভ-বার্তা শুনিয়া তাহারা আনন্দিত হওয়ার পরিবর্তে কূট-তর্ক সৃষ্টি করিবে এবং অনর্থক উচ্চবাচ্য করিতে থাকিবে। এই দিক দিয়া দেখিলে, এই আয়াতে ঈসা আ.-এর দ্বিতীয় আগমনের কথা বলা হইয়াছে বলিয়া মনে হয়। -বকশী বাজার থেকে প্রকাশিত ‘কুরআন মজীদ’, টীকা নং- ২৬৮৩ পৃ. ১০১৭

 

কাদিয়ানীদের ইংরেজি অনুবাদের টীকায় কৃত অপব্যাখ্যা :

....the verse, besides the meaning given in the text, may also signify that when the people of the Holy Prophet—the Muslims—are told that another person, who would be like Jesus and would be his counterpart, would be raised from among them to regenerate them and restore their lost spiritual glory, instead of being glad over these good tidings, they raise a clamour. The verse may thus be taken as referring to the Second Coming of Jesus. -THE HOLY QURAN, P 1413, Commentory No : 2683 ( Edited by Malik Ghulam Farid.)

 

লক্ষ্যণীয় : কাদিয়ানীরা তাদের অনুবাদের টীকায় এ আয়াতের একটি উদ্দেশ্যমূলক অর্থ তৈরি করেছে। যার মধ্যে নিজেদের ধর্মবিশ্বাসের চারটি বিষয় তারা অন্তর্ভুক্ত করেছে-

এক. এ উম্মতের মধ্যে হযরত ঈসা আ.-এর সঙ্গে সর্বতোভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ একজন মহামানব আগমন করবেন।

দুই. তিনি আসবেন ইসলামের পুনর্জাগরণ করতে এবং ইসলামের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে।

তিন. তার আগমনের শুভ-বার্তা শুনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মতরা আনন্দিত না হয়ে কূটতর্ক করবে। অনর্থক উচ্চবাচ্য করবে।

চার. তার এ আগমন হবে ঈসা আ.-এর পুনরাগমন।  

বলাবহুল্য, এগুলোর সবই অসার প্রলাপ এবং ইসলামের মৌলিক আকীদার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আয়াতের প্রকৃত মর্ম আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি। যার মধ্যে এর কোনো প্রসঙ্গই নেই।

ইসলামের আকীদা হল, হযরত ঈসা আ.-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কেউ নয়; বরং স্বয়ং হযরত ঈসা আ.-ই সশরীরে আগমন করবেন। তিনি স্বয়ং কিয়ামতের পূর্বে আকাশ থেকে অবতরণ করে ইসলামের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করবেন। তাঁর আগমনে মুসলমানরা কোনো কূটতর্ক করবে না; বরং যারপরনাই খুশি হবে।

হযরত ঈসা আ.-এর অবতরণ সংক্রান্ত এ আকীদা মুতাওয়াতির হাদীস ও উম্মাহ্র ইজমার ভিত্তিতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত। কিন্তু কাদিয়ানীদের ভ্রান্ত ও কুফরী বিশ্বাস হল, হযরত ঈসা আ. ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে নাকি তাদের গোলাম আহমদ সাহেব আবির্ভূত হয়েছে! (নাউযুবিল্লাহ) এ মনগড়া কুফুরী বিশ্বাসকেই তারা হযরত ঈসা আ. সংক্রান্ত আয়াত এবং হাদীসসমূহে আরোপ করতে চায়।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement