স্বাধীনতার মাস : স্বাধীন মানুষের চাওয়া-পাওয়া
স্বাধীনতা আমাদের অতি প্রিয়। স্বাধীনতার স্মৃতি আমাদের মনে আনন্দের অনুভূতি তৈরি করে। আশা ও প্রত্যাশার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। মানুষ তাই মুক্তিকামী। পরাধীনতা তার কাছে অবাঞ্ছিত। পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ মানুষের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, বঞ্চিত হয় ন্যায্য অধিকার থেকে। ঝুঁকির মুখে পড়ে যায় তার স্বাভাবিক চাওয়া-পাওয়া। পক্ষান্তরে মুক্ত-স্বাধীন মানুষ তার ন্যায্য অধিকার ও স্বাভাবিক বিকাশের প্রত্যাশা করতে পারে, জীবনের অতি মূল্যবান সম্পদসমূহের সুরক্ষার বিষয়ে নির্ভয় হতে পারে। স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তাই এত কাম্য, এত বাঞ্ছিত।
এইটুকু বিষয় খুব সহজেই বোধগম্য এবং আমাদের বর্তমান সময়ে বহুল চর্চিত, তবে যে প্রশ্নটি সাধারণত আলোচিত নয়, কিন্তু উপরোক্ত ভূমিকাগুলোর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, সেই অতি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গগুলো কী, যার সুরক্ষা নিশ্চিত হতেই হবে, যা ছাড়া কোনো জীবনকে মুক্ত-স্বাধীন জীবন বলা যায় না।
এ প্রশ্নের যথার্থ জবাব পেতে হলে আমাদের ফিরে আসতে হবে ইসলামের কাছে। কারণ একমাত্র ইসলামই মানবজীবনের অগ্রগণ্য ও অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেছে। না, শুধু চিহ্নিতই করেনি; বরং এমন এক জীবন-ব্যবস্থা দান করেছে, যা মানবজীবনের সেই অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর বিকাশ ও সুরক্ষাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত।
নিশ্চয়ই জীবন বৈচিত্র্যময়। অসংখ্য এর ক্ষেত্র। অসীম এর চাহিদা। নিত্যপরিবর্তনশীল এর রুচি-অভিরুচি, অবস্থা ও পরিস্থিতি। কিন্তু এই বৈচিত্র্য, বিভিন্নতা ও গতিশীলতার মধ্যেও মানব-সত্তা ও মানব-সমাজের কিছু পরিচয়, বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োজন স্থির, শাশ্বত ও মৌলিক। বস্তুত এই মৌলিক প্রয়োজনের ‘সূর্য’কে কেন্দ্র করেই সদা আবর্তিত মানবজীবনের বিপুল বিস্তৃত চাহিদা ও প্রয়োজনের ‘সৌরজগৎ’। সহজ-সরল আটপৌরে ভাষায় জীবন ও সমাজের সেই অগ্রগণ্য ও অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো হচ্ছে-
এক. দ্বীন-ঈমানের সুরক্ষা।
দুই. প্রাণের সুরক্ষা।
তিন. বংশ-পরিচয়ের সুরক্ষা।
চার. সম্পদের সুরক্ষা।
পাঁচ. বুদ্ধি-বিবেকের সুরক্ষা।
গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যাবে, মানবজীবনের অতি প্রয়োজনীয় অসংখ্য বিষয় এই পাঁচ শিরোনামেরই বিভিন্ন উপশিরোনামমাত্র। যে কোনো আদর্শ সমাজে এই বিষয়গুলোর বিদ্যমানতা নিশ্চিত হতেই হবে।
এই পাঁচ বিষয়ের মধ্যেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দ্বীন ও ঈমানের সুরক্ষা। দ্বীনের বিস্তৃতি ও প্রভাববলয় সম্পর্কে সচেতন যে কারো কাছেই স্পষ্ট যে, দ্বীনদারি ও ঈমানদারি এমন এক বিষয়, যার উপস্থিতি অবশিষ্ট চার বিষয়ের উপস্থিতিকে নিশ্চিত করে। আর এর অনুপস্থিতি অন্যগুলোর অনুপস্থিতিকেও অনিবার্য করে তোলে।
রাষ্ট্রের সকল বিধান ও ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হতে হবে, নাগরিক-সমাজের দ্বীন-ঈমানের রক্ষণাবেক্ষণ, সহীহ আকীদা-বিশ্বাসের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা, ভ্রান্ত আকীদা ও বিভ্রান্ত দর্শন ও মতবাদের খ-ন ও প্রতিরোধ, ইবাদত-বন্দেগী থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, আয়-ব্যয়, আচার-আচরণ, স্বভাব-চরিত্র, পর্ব-উৎসব ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে দ্বীনী আদর্শের বিস্তার ও প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি-অনাচারের সুযোগ রহিত করা। যাতে সঠিক বিশ্বাস ও নীতি-নৈতিকতার নির্মল পরিবেশে নাগরিকেরা জীবনযাপন করতে পারেন, ভবিষ্যত-প্রজন্মও নির্মল আলো-বাতাস থেকে আদর্শিক পুষ্টি গ্রহণ করে আদর্শ জীবন গঠনে সফল হতে পারে।
স্বাধীন রাষ্ট্রের আরো কর্তব্য, জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা বিধানে সচেষ্ট হওয়া। রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান, সকল বিধান ও ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হবে, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ভীতি ও শঙ্কামুক্ত সমাজগঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। যে সমাজে কারো অন্যায় প্রাণহানী-সম্পদহানীর আশঙ্কা থাকবে না, স্বাধীনভাবে হালাল জীবিকা উপার্জনের পথ উন্মুক্ত থাকবে, হারাম ও অবৈধ উপার্জনের পথ বন্ধ থাকবে। কারো জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুতে হস্তক্ষেপের কঠিন দ- ও যথার্থ প্রয়োগ থাকবে। বলা বাহুল্য, যে সমাজের নীতি ও ব্যবস্থা এই লক্ষ্য-অজর্নের যত অনুকূল হবে সেই সমাজে ততই শান্তি ও নিরাপত্তা বিরাজ করবে।
স্বাধীন রাষ্ট্রের আরো কর্তব্য, নাগরিক-সমাজের বুদ্ধি-বিবেকের সুরক্ষা, নৈতিক ও চারিত্রিক সুস্থতা এবং পারিবারিক স্থিতি ও বন্ধন অটুট রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আর এ উদ্দেশ্যে মাদক, নারী-নির্যাতন, অশ্লীলতা-অনৈতিকতা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও সব রকমের বেহায়াপনা রোধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।
এরইসাথে নাগরিক-মানসে নির্মল ও পবিত্র জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি, সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের নীতি, কাঠামো ও সুফল সম্পর্কে জানা-শোনার বিস্তার, এর সহায়ক মতাদর্শসমূহের লালন ও পৃষ্ঠপোষকতা। আর অশ্লীল, অস্বাভাবিক, অস্থিরতাপূর্ণ জীবনের প্ররোচনাদায়ী পশ্চিমা দর্শন ও মতবাদসমূহের খ-ন ও প্রতিরোধ এবং শিক্ষা-সংস্কৃতি, সাহিত্য-সাংবাদিকতা, মিডিয়া ও গণমাধ্যমকে সুস্থ ঈমানদার জীবন গঠনের নিয়ামক ও সহায়ক হিসেবে বিকশিত ও প্রতিষ্ঠিত করাও স্বাধীন রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।
একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কাছে তার শান্তিকামী, কল্যাণ-প্রত্যাশী নাগরিকের এইটুকু প্রত্যাশা খুবই স্বাভাবিক। এইটুকু একটি মানব-সমাজের অপরিহার্য প্রয়োজন। এই প্রয়োজনটুকু পূরণ হওয়া ছাড়া নিজেদের ও ভবিষ্যত-প্রজন্মের সুস্থ-শালীন জীবনের স্বপ্ন অধরাই থেকে যেতে পারে। দ্বীন-ঈমানের সুরক্ষা, জান-মালের সুরক্ষা এবং বুদ্ধি ও বংশ-পরিচয়ের সুরক্ষা ছাড়া একজন মানুষ কীভাবে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের প্রত্যাশা করবে? কীভাবে শান্তি ও প্রশান্তির জীবন যাপন করবে? দুনিয়ার সাফল্য ও আখেরাতের মুক্তির প্রত্যাশী হবে? এই ন্যূনতম অপরিহার্য প্রয়োজনসমূহ পূরণের স্বাভাবিক নিশ্চয়তা ছাড়াও কি কোনো ব্যক্তি ও সমাজ মুক্ত-স্বাধীন অভিধায় অভিহিত হতে পারে?
আমাদের কর্তব্য, স্বাধীনতার মর্ম ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য গভীরভাবে উপলব্ধি করা এবং জীবনের বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেখা। দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, ইসলামের সুমহান শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে মুসলিম-অধ্যুষিত জনপদগুলোও আজ জীবনের মৌলিক চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কেও দিকভ্রান্ত! আমাদের প্রয়োজন, আবারো ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের দিকে ফিরে আসা। ইসলাম শেখায়, কী একজন মানুষকে চাইতে হয়। আরো শেখায়, সেই চাওয়াকে কীভাবে যথার্থ পন্থায় প্রাপ্তির শিরোনামে উন্নীত করতে হয়।
স্বাধীনতার মাস আমাদের জীবনে বয়ে আনুক মুক্তির বার্তা। আমাদের দৃষ্টি ও দৃষ্টিভঙ্গি আলোকিত হোক ঈমানের আলোক-আভায়। এই দেশ ও জাতির উপর বর্ষিত হোক পরম করুণাময়ের অশেষ করুণাধারা। আমীন।