জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪১   ||   ফেব্রুয়ারি ২০২০

বাং লা ভা ষা

আবু সাফফানা

বাংলাভাষা : উদ্যাপনে ও বাস্তব জীবনে

ভাষা মানবজাতির উপর আল্লাহপ্রদত্ত অনেক বড় একটি নিআমত। ভাষার মাধ্যমে মানুষ লাভ করেছে প্রাণীজগৎ থেকে স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদা। মানুষের বহমান জীবনধারা, সভ্যতা-সংস্কৃতি, আনন্দ-বেদনা, আবেগ-অনুভূতির সাবলীল প্রকাশ ঘটে ভাষার মাধ্যমে।

মানুষ জন্মের পর সর্বপ্রথম চেনে তার মাকে। কথা শিখতে থাকে মায়ের মুখ থেকে, মায়ের যে ভাষা সেটাই হচ্ছে মাতৃভাষা। ফলে মাতৃভাষার সাথে মানুষের নাড়ির সম্পর্ক ও হৃদয়ের বন্ধন।

আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ভাষা। ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস। নানা আয়োজনে উদ্যাপিত হয় ২১ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এতটুকুতেই দায় শেষ? হৈ-হুল্লোড়ে দিনটি পার করার নামই কি তবে ভাষার প্রতি ভালবাসা! দেখার বিষয় হচ্ছে, আমাদের বাস্তব জীবনে বাংলাভাষা কতটুকু গুরুত্ব পাচ্ছে।

আমাদের  দৈনন্দিন জীবনে বাংলাভাষার প্রতি যতটুকু না ভালবাসা ফুটে ওঠে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার চেয়ে অনেক বেশি প্রকাশ পায় অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের ভাব। বিশেষ করে শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত হিসেবে যারা সমাজে পরিচিত ভাষার সাথে তাদের অনেকের আচরণ ও উচ্চারণ উদ্বেগজনক।

ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের মাত্রা যে হারে বাড়ছে তাতে বাংলা ভাষা নিতান্তই অসহায় হয়ে পড়ছে। নতুন প্রজন্মের মাঝে ইংরেজি ভাষা ধীরে ধীরে আগ্রাসী আধিপত্য বিস্তার করছে। ইংরেজি ভাষার প্রতি অতি উৎসাহ মাতৃভাষা বাংলাকে পিছে ঠেলে দিচ্ছে বা গুরত্বহীন ঠাওরাচ্ছে। ইংরেজিতে দুকলম লিখতে বা বলতে পারলে মনে পুলক জাগে। ভেতরে অনুভব হয় গৌরব ও আভিজাত্য। বাংলাভাষী হয়ে ইংরেজি না জানাকে যতটুকু লজ্জার মনে করা হয় বাংলা না জানাকে তার দশ ভাগের এক ভাগও লজ্জার মনে করা হয় না। ফলে একটি শ্রেণির মাঝে মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা কিংবা উদাসীনতা দিনদিন বেড়েই চলেছে।

দেশের আদালতগুলোতে এখনো রায় লেখা হয় ইংরেজি ভাষায়। কিন্তু যে দেশের অধিকাংশ লোক পড়ে বুঝার মত ইংরেজি জানে না তারা শত শত পৃষ্ঠার রায়গুলো বুঝবে কিভাবে?

আর মিডিয়াগুলোতে বিশেষ করে প্রাইভেট রেডিও চ্যানেলগুলোয়  ইংরেজি-বাংলা মিশানো উদ্ভট উচ্চারণের বাক্যালাপ শুনে রীতিমত আঁতকে উঠতে হয়। একটা বাংলা শব্দের উপর পাঁচটা ইংরেজি শব্দ জুড়ে দিয়ে ভাষার যে রূপটা তারা গঠন করেন- তা না বাংলা না ইংরেজি। কেউ কেউ একে রস করে হিজড়া ভাষা বলে থাকেন।

আসলে এগুলো হচ্ছে ঔপনিবেশিক শাসনে সৃষ্ট দাস-মানসিকতা। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ইংরেজরা এদেশ শাসন করেছিল। তাদের রাজ ভাষা ছিল ইংরেজি। আমরা এখনও ঔপনিবেশিক রাজ ভাষা বা তাদের চিন্তানৈতিক গোলামী ও তার প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারিনি। আমাদের পায়ে এখনও ঔপনিবেশিক প্রভাবের শেকল ঝন ঝন করে বাজে। এগুলো সেই ঝন ঝন আওয়াজের প্রতিচিত্র। সে বাজনায় আমরা মুগ্ধ বলে এদেশের সবখানে তার আগ্রাসী বিচরণ।

মিডিয়ার এই জগাখিচুরি ভাষার আগ্রাসনের প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের উপর, বিশেষ করে তথাকথিত মডার্ন তরুণ-তরুণীদের উপর। তাই বাংলার কাঁধে ইংরেজি ঝুলিয়ে কথা বলার প্রবণতা বাড়ছে। নিতান্ত অশিক্ষিতদের মুখেও তাই শোনা যায়- ‘আরে কইছ না, জ্যামে পইড়া মিনিমাম দুই ঘণ্টা লছ’, ‘হেইটা আমার নলেজে আছে’, ‘বিষয়টা নিয়া টেনশন ফিল করতাছি’- জাতীয় বাক্য। বিভিন্ন বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড ও দোকানের নামের দিকে তাকালেও দেখা যায় বিচিত্র উদ্ভট শব্দের বাহার।

আসলে আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা নিম্নমুখী বলে মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে শেখা,  লেখা ও বলায় চরম অবহেলার প্রকাশ ঘটে। এখানে ইংরেজি শেখার প্রতি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে না। বর্তমান বিশে^র চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণের জন্য একদল লোক ইংরেজিও শিখবে। তবে সেটা মাতৃভাষাকে অবহেলা করে নয়। একজন বলেছেন, ‘জীর্ণ কুটিরে ছিন্ন বস্ত্রে বসবাসরত গর্ভধারিণীকে অবহেলা করে ধনী শাশুড়িকে নিয়ে মেতে থাকা আর যাই হোক কোনো সুস্থ মানুষের কাজ হতে পারে না। ঠিক তেমনি মানুষের কাজ হতে পারে না- মাতৃভাষাকে অবহেলা করে অন্যের ভাষা নিয়ে উল্লাস করা।’

শুদ্ধ বাংলার চর্চা শুধু বাংলা সাহিত্যের শ্রেণীকক্ষ পর্যন্ত সীমিত করে রাখলে চলবে না, বরং সকল বিদ্যালয়, বিশ্বা বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক মাদরাসাগুলোর উলামা-তলাবা, সরকারী-বেসরকারী দপ্তরের কার্য্যক্রম, বক্তৃতা-বিবৃতিসহ সকল কাজে -কর্মে ভেজাল মুক্ত বাংলার চর্চা হলেই কেবল মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা হবে।

 

 

advertisement