দুআয়ে মাগফিরাতের আবেদন
গত দুয়েক মাসে আমরা আমাদের অনেক মুরব্বীকে হারিয়েছি। আল্লাহ তাআলা তাঁদের সবাইকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। আমাদেরকে সবরে জামীলের তাওফীক দান করুন। আমাদের মাঝে বড়দের যোগ্য উত্তরসূরী পয়দা করে দিন।
১. গত ৩ জুমাদাল উলা ১৪৪১ হি. মোতাবেক ৩১-১২-২০১৯ ঈ. রাতে কুমিল্লা কাসেমুল উলূমসহ বিভিন্ন মাদরাসার শায়খুল হাদীস উসতাযুল আসাতিযা হযরত মাওলানা আশরাফ আলী ছাহেব ইনতেকাল করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রতি রহম করুন।
তিনি অনেক বড় আলেম এবং বহু গুণ-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বুযুর্গ ছিলেন। অনেক বিষয়ে সালাফের নমুনা ছিলেন। তাঁর ইনতিকালে বহু অঙ্গনে অনেক বড় শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর জীবনী, কীর্তি ও অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত কিতাব হওয়া উচিত।
কয়েক বছর আগে ‘তারবিয়াতুল মুআল্লিমীন’ শীর্ষক এক মজলিসে হযরত রাহ.-এর বয়ান শোনার সুযোগ হয়। পুরো বয়ানই হাসিল করার মত। তবে সেদিন তাঁর কাছে একটি পংক্তি শুনেছিলাম, যা অনেক শিক্ষণীয়। যদি সে অনুযায়ী আমল করতে পারতাম! তিনি বলেন-
حرص قانع نیست صائب ورنہ اسباب معاش
ہرچہ مادر کار داریم اکثر درکار نيست
صائب হল কবির তাখাল্লুস। শোনার সময় এ শব্দের উচ্চারণ নিয়ে আমার সন্দেহ ছিল। পরবর্তীতে হযরতের ছেলে মৌলভী শোআইবের মাধ্যমে হযরতের কাছ থেকে উচ্চারণ ঠিক করে নিয়েছি। আল্লাহ তাআলা তাকে জাযায়ে খায়ের দান করুন। হযরতকেও জাযায়ে খায়ের দান করুন এবং জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন।
২. গত ৮ জুমাদাল উলা ১৪৪১ হি. মোতাবেক ০৫-০১-২০২০ ঈ. রোববার দিনে আকাবিরের ‘ইয়াদগার’ শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী রাহ.-ও ইনতিকাল করেছেন। তাঁর ইলমী মাকাম, কীর্তি ও অবদান সম্পর্কে তাঁর জামাতা মাওলানা তাহমীদুল মাওলা ও তাঁর যোগ্য শাগরিদগণ অবশ্যই লিখবেন।
প্রথমবার হযরতের খেদমতে হাযির হয়েছিলাম মাওলানা তাহমীদেরই মাধ্যমে। প্রথম সাক্ষাতে অনেক খুশি হয়েছিলাম এটা জেনে যে, অন্যান্য অনেক আকাবিরের সোহবতের সঙ্গে তিনি হযরত বানূরী রাহ.-এর সোহবতও লাভ করেছিলেন। ‘মাআরিফুস সুনান’ কিতাব প্রকাশিত হওয়ার আগে তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আলাদা আলাদা ছাপা হয়েছিল। সে সময় তিনি হযরতের সোহবতে ছিলেন এবং হযরতের কাজে সহযোগিতা করার সুযোগ তাঁর হয়েছিল। এও জেনেছিলাম যে, একসময় তিনি দারুল উলূম বরুড়ায় তাদরীসের খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। সে সময় তাঁর শাগরিদদের মধ্যে হযরত মাওলানা নূর হুসাইন কাসেমী দামাত বারাকাতুহুমও ছিলেন।
আল্লাহ তাআলা হযরতের মাদরাসা-মকতবসমূহকে কিয়ামত পর্যন্ত জীবন্ত রাখুন এবং উত্তরোত্তর উন্নতি দান করুন। তাঁর অন্যান্য সদকায়ে জারিয়াও কিয়ামত পর্যন্ত জারী রাখুন- আমীন।
মারকাযুদ দাওয়াহ্র জন্য তাঁর দুআ ও মুনাজাত স্মরণীয় হয়ে থাকবে ইনশাআল্লাহ।
৩. গত ২০ জুমাদাল উলা ১৪৪১ হি. মোতাবেক ১৭ জানুয়ারি ২০২০ ঈ. জুমাবার হিন্দুস্তানের প্রসিদ্ধ আলেম হযরত মাওলানা বুরহানুদ্দীন সাম্ভলী রাহ. ইনতিকাল করেন। তিনি হযরত শায়খুল ইসলাম মাদানী রাহ., মুহাদ্দিস ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী রাহ. ও কারী তৈয়ব রাহ.-এর শাগরিদ ছিলেন। ১৩৯০ হি. থেকে তিনি দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। শয্যাশায়ী হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি সেখানে খেদমত আঞ্জাম দেন। দিরাসাতে উলয়া ও ফিকহ-ফতোয়ার বিভাগসমূহ তাঁর খেদমতের মূল অঙ্গন ছিল।
১৪১৯ হিজরীর রমযানে নদওয়া ও রায়বেরেলীর সংক্ষিপ্ত সফরে হযরতের সঙ্গে আমার সালাম-মুসাফাহা হয়েছিল। কোনো ইলমী মাসআলা নিয়ে কখনো কখনো চিঠি-পত্রও আদান-প্রদান হয়েছিল।
মাসিক আলফুরকানের প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে প্রকাশিত আলফুরকানের বিশেষ সংখ্যায় হযরত সাম্ভলী রাহ.-এর যে প্রবন্ধ আছে, সেখানে আমীন আহসান ইসলাহী ছাহেব সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে। মাওলানা ইসলাহীর কিতাব-পত্র মুতালাআ করেন- এমন সকল আলেমের জন্য তা জানা থাকা জরুরি। মাওলানা বুরহানুদ্দীন সাম্ভলী রাহ.-এর কিতাবসমূহের মধ্যে ‘রুয়াতে হেলাল’ অনেক প্রসিদ্ধ কিতাব। উলামা-তলাবা এ থেকে ইসতিফাদা করে থাকেন।
৪. গত ২১ জুমাদাল উলা ১৪৪১ হি. (১৮ জানুয়ারি ২০২০ ঈ) শনিবার দিবাগত রাত হযরত মাওলানা আবদুস সাত্তার (সাবেক খতীব ডিএলআর জামে মসজিদ, তেজগাঁও) ইনতিকাল করেন। তিনি হযরত মাওলানা আবদুল মান্নান রাহ. (সাবেক মুহাদ্দিস, ফেনী আলিয়া)সহ একাধিক মাশায়েখের মুজায। তাঁর বয়ান অনেক আকর্ষণীয় ছিল। তিনি বয়ানে তাওহীদ, আল্লাহ্র প্রতি মহব্বত- এজাতীয় বিষয়ের আলোচনা বেশি করতেন।
যেহেতু একসময় তিনি মাদরাসা আরাবিয়া খেড়িহরের বার্ষিক জলসায় গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থিত হতেন এজন্য ছোট বেলায়ই তাঁকে দেখার সুযোগ হয়। তিনি আমাদেরকে ছোটবেলা থেকেই মহব্বত করতেন। আমাদের জন্য দুআ করতেন। জানাযায় শরীক হওয়ার জন্য হযরত মাওলানা মুফতী দিলাওয়ার হুসাইন দামাত বারাকাতুহুমের সঙ্গে মসজিদ প্রাঙ্গণে ছিলাম। কিন্তু যানজটের কারণে ঠিকসময় হাযির হতে পারিনি।
আল্লাহ তাআলা হযরতকে ভরপুর মাগফিরাত করুন। জান্নাতুল ফিরদাউসের সুউচ্চ মাকাম নসীব করুন- আমীন।
৫. গত ৮ জুমাদাল উলা রবিবার দিবাগত রাতে আমাদের আদীব হুজুরের মুহতারামা শাশুড়ির ইনতিকাল হয়ে গেছে। শুধু ইনতিকালের সংবাদ শুনলেই অধম জানাযায় হাযির হয়ে যেতাম। কিন্তু আদীব হুজুরের ইহসান- তিনি নিজে অধমকে ইনতিকালের সংবাদ দেন এবং জানাযায় হাজির হওয়ার দাওয়াত দেন। বেলা ১১টা বাজে মাদরাসা নূরিয়ার ময়দানে জানাযা হয়। জানাযায় এলাকার সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল অনেক। কারণ জানা গেল যে, আশপাশের এলাকার মাসতুরাতগণ মরহুমার খুব ভক্ত ছিলেন। তাঁর উত্তম আচরণে সকলেই মুগ্ধ ছিলেন। সবাই তাঁর দ্বারা কোনো না কোনোভাবে কমবেশি উপকৃত হয়েছেন। যার অনুভূতি মাসতুরাতদের ঘরের পুরুষদেরও ছিল। এজন্যই জানাযায় এত মানুষের সমাগম হয়েছিল।
আল্লাহর শোকর- তাঁর দাফন হাফেজ্জী হুজুর রাহ-এর মাকবারায় হয়েছে। সেটাও তাঁর শহীদ পুত্র হাফেয রহমাতুল্লাহ বিন আহমাদুল্লাহ বিন মুহাম্মাদুল্লাহ-এর পাশে। আল্লাহ তাআলা তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করুন। তাঁর নৈকট্যশীল বান্দীদের অন্তর্ভুক্ত করুন। মরহুমার আত্মীয়-স্বজনকে সবরে জামীলের তাওফীক দান করুন।
আল্লাহ তাআলার শোকর- জানাযায় গিয়ে আদীব হুজুর দামাত বারাকাতুহুমের দীর্ঘ সোহবত লাভ হয়েছে এবং অনেক কিছু শেখার ও শোনার সুযোগ হয়েছে। আল্লাহ তাআলা হুযুরকে এবং তাঁর পরিবারের সকলকে (যারা নিজেদের মাঝে মরহুমা ও হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর অনেক মহৎ গুণ ধারণ করেন) এই বান্দার পক্ষ থেকে জাযায়ে খায়ের দান করুন।
তাঁদেরকে শান্তি, নিরাপত্তা ও সুস্থতার সঙ্গে দীর্ঘ নেক হায়াত দান করুন- আমীন।
সম্মানিত পাঠকগণের নিকট এই পাঁচ হযরতসহ সকল মরহুম-মরহুমার জন্য দুআর দরখাস্ত করছি। এই অধমের জন্যও দুআর দরখাস্ত- আল্লাহ যেন বাকি জীবনের সঠিক ব্যবহারের তাওফীক দান করেন এবং উভয় জাহানের সফলতা দান করেন।
৬. লেখাটি শেষ হল মাত্র; খবর পেলাম- আজ ৩ জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪১, বুধবার বিকাল ৫টার পর চলে গেলেন মুজাহিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আতহার আলী রাহ.-এর ইয়াদগার হযরত মাওলানা আনওয়ার শাহ ছাহেব রাহ.। বা যওক ও পুর ওয়াক্বার ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই আলেমে দ্বীন বহুমুখী দ্বীনী খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন- কঠিন অসুস্থতায় শয্যাশায়ী হওয়ার আগ পর্যন্ত। কয়দিন আগে আমাদের কাছ থেকে তাঁর উসতায হযরত মাওলানা আশরাফ আলী রাহ. বিদায় নিয়ে গেলেন। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন। আল্লাহ হযরতের ভরপুর মাগফিরাত করেন। জান্নাতের আ‘লা মাকাম দান করেন। সংশ্লিষ্ট সবাইকে সবরে জামীলের তাওফীক দান করেন। জামিয়া ইমদাদিয়াসহ তাঁর খেদমতের সকল প্রতিষ্ঠান ও সকল অঙ্গনকে আল্লাহ তাআলা নিজ হেফাজতে রাখেন। আশা করি জামিয়া ইমদাদিয়া থেকে হযরতের বিস্তারিত জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হবে।
সর্বপ্রথম তাঁর বয়ান শুনি অনেক বছর আগে, যাত্রাবাড়ি মাদরাসায় মজলিসে দাওয়াতুল হকের বার্ষিক ইজতেমায়। কথা প্রসঙ্গে তাঁর খাস উস্তায হযরত মাওলানা ইউসুফ বানূরী রাহ.-এর উদ্ধৃতিতে বলেছিলেন- দাওরায়ে হাদীস আসলে দুই বছরবিশিষ্ট হওয়া দরকার। দেখা যাক, কবে অনেক বুযুর্গেরই লালিত এ স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। ব্যস, যেটাতে তালিবে ইলমদের কল্যাণ সেটাই হোক। হ
-বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
০৩ জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪১ হি.
২৯ জানুয়ারি ২০২০ ঈ.