সুন্দরবনে কাদিয়ানীদের ‘বিরল কুরআন প্রদর্শনী’ : কুরআনের বিকৃত অনুবাদের প্রদর্শনী করছে কাদিয়ানী সম্প্রদায়
সম্প্রতি গত ১০ জানুয়ারি সুন্দরবনে বাংলাদেশের আহমদিয়া অ-মুসলিম সম্প্রদায় পবিত্র কুরআনের এক কথিত ‘বিরল প্রদর্শনী’র আয়োজন করে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার যতিন্দ্রনগরে চার দিনব্যাপী আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে তারা বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, হিন্দী, পশতু, চাইনিজ, জার্মানসহ মোট ৬৫টি ভাষায় নিজেদের অনূদিত কুরআন প্রদর্শন করে। তাদের নিজস্ব খবরের সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত তারা প্রায় ১০০টি ভাষায় সম্পূর্ণ কুরআন অনুবাদ সমাপ্ত করেছে, যা এখন প্রিন্টিং পর্যায়ে রয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, কোনো অমুসলিম সম্প্রদায় কর্তৃক পবিত্র কুরআনের অনুবাদ প্রকাশের নজির এটাই প্রথম নয়। ইতিপূর্বে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহু ধর্মের মানুষ কুরআনের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা সংকলন করেছে। হাজার বছর ধরে পৃথিবীর অগণিত বিধর্মী, নাস্তিক এমনকি ইসলামবিদ্বেষী গবেষকও গভীর মনোযোগসহ কুরআন গবেষণায় লিপ্ত রয়েছে।
বিশ্বাব্যাপী কুরআনের প্রতি অমুসলিমদের মনোনিবেশের কারণ বিভিন্ন। কারো উদ্দেশ্য, গবেষণা করে জাগতিক ডিগ্রি ও সুখ্যাতি অর্জন করা। নিজেদের মতো করে তত্ত্ব উদ্ঘাটন করা। কারো উদ্দেশ্য, মুসলিম উম্মাহ্র ঈমানী শক্তির সূত্র আবিষ্কার করে তাদের ক্ষতিসাধন করা। কারো ইচ্ছা, অধ্যয়ন করে আনন্দ আহরণ এবং সাহিত্যরস আস্বাদন করা। কারো উদ্দেশ্য থাকে, পুস্তক-ব্যবসা। কেউ হাজার বছরের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ঘেঁটে ইতিহাস উদ্ধারে প্রয়াসী। কারো মতলব, ইসলামের ভুল ধরা। আর কারো অভিসন্ধি, যেভাবেই হোক নিজ মতবাদকে সাব্যস্ত করা। প্রকৃত মুসলমানদের ন্যায় হেদায়েত অন্বেষণ এদের উদ্দেশ্য নয়।
কী উদ্দেশ্যে এই আয়োজন?
কিন্তু আহমদী তথা কাদিয়ানী সম্প্রদায়- যারা গোটা মুসলিম উম্মাহ্র কাছে সর্বসম্মতিক্রমে অমুসলিম ও কাফের- তাদের এধরনের উদ্যোগের কী রহস্য? বাংলাদেশী কাদিয়ানীদের প্রধান জনাব আবদুল আউয়াল খান চৌধুরি বলেছেন-
‘পবিত্র কুরআনের শিক্ষা পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যেই আহমদিয়া মুসলিম (?) জামাত বিভিন্ন ভাষায় পবিত্র কুরআনের অনুবাদ করে চলেছে।’
খবরে প্রকাশিত তথ্যমতে, কুরআনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে এবং বিশ্বব্যাপী কুরআনের প্রকৃত (!) জ্ঞান ছড়িয়ে দিতেই তারা এরূপ প্রয়াস গ্রহণ করেছেন।
স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে যে, কাদিয়ানী ধর্মাবলম্বীরা নিজ ধর্মের বাণী ও ধর্মীয় গ্রন্থের পরিবর্তে মুসলমানদের পবিত্র কুরআনের শিক্ষা প্রচারে কেন এত উদ্যোগী হলেন? সচেতন মুসলমানরা অবগত আছেন যে, কাদিয়ানী ধর্মমতের প্রতিষ্ঠাতা পাঞ্জাবের প্রয়াত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নবী দাবির পাশাপাশি নিজের উপর ‘বিপুল পরিমাণে ওহী অবতরণেরও’ দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন-
اور خدا کا کلام اس قدر مجھ پر نازل ہوا ہے کہ اگر وہ تمام لکھا جائے تو بیس جزو سے کم نہیں ہوگا۔
অর্থ : খোদার কালাম এত বিপুল পরিমাণে আমার উপর অবতীর্ণ হইয়াছে যে, যদি ঐগুলির সব কয়টি লেখা হয় তবে ২০ (বিশ) খণ্ডের চাইতে কম গ্রন্থ হইবে না।
দেখুন মির্যা কাদিয়ানী রচিত- হাকীকাতুল ওহী [উর্দু], রূহানী খাযায়েন ২২/৪০৭; হাকীকাতুল ওহী [বাংলা] পৃ. ৩৩১
আরো দেখুন, মির্যা কাদিয়ানীর বৃষ্টির ধারার ন্যায় ওহী অবতীর্ণ হওয়ার দাবি- হাকীকাতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/১৫৩; (বাংলা) হাকীকাতুল ওহী পৃ. ১১৭; এবং তেইশ বছর ক্রমাগত ওহী অবতরণের দাবি- হাকীকাতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/১৫৪; (বাংলা) হাকীকাতুল ওহী পৃ. ১১৮
* মির্যা কাদিয়ানীর এই রাশি রাশি দাবিকৃত ওহী কাদিয়ানী সম্প্রদায় ‘পরম যত্নে’ সংকলনও করেছে! মির্যা সাহেবের প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার ‘তাযকিরা’ গ্রন্থটি, যার মূল বইয়ের টাইটেল পৃষ্ঠার উপরে বড় বড় অক্ষরে পরিষ্কার লেখা রয়েছে-
تذکرہ یعنی ’وحی مقدس‘
তাযকিরাহ অর্থাৎ ‘পবিত্র ওহী’।
অর্থাৎ এ গ্রন্থ আদ্যোপান্ত মির্যা কাদিয়ানীর প্রতি অবতীর্ণ (?) তথাকথিত পবিত্র ওহীর সমষ্টি! যা স্বয়ং কাদিয়ানীরাই এখনো পর্যন্ত ছেপে যাচ্ছে। তো স্বধর্মের এতবড় ‘ওহীগ্রন্থ’ থাকতে কাদিয়ানীরা মুসলিমদের কুরআনী শিক্ষার প্রচারে কী উদ্দেশ্যে এমন উদ্যোগী হয়ে পড়েছেন?
* কাদিয়ানীদের দ্বিতীয় খলিফা মির্যাপুত্র বশীরুদ্দীন মাহমুদ সাহেব তো বলেছেন, আহমদিয়া জামাতের উপর তার পিতার এসব ‘কথিত ওহী’র উপর ঈমান আনা এবং সে মোতাবেক আমল করা ফরয। তার বক্তব্য দেখুন-
حضرت مسیح موعود علیہ السلام اپنی وحی اپنی جماعت کو سنانے پر مامور ہیں، جماعت احمدیہ کو اس وحی پر ایمان لانا اور اس پر عمل کرنا فرض ہے۔
অর্থ : হযরত মাসীহে মাওউদ আলাইহিস সালাম স্বীয় ওহী নিজ জামাতকে শোনাতে আদিষ্ট। আহমদিয়া জামাতের উপর এ ওহীর প্রতি ঈমান আনা এবং সে অনুযায়ী আমল করা ফরয। (কাদিয়ানীদের মুখপত্র উর্দু দৈনিক আলফযল, তারিখ : ৩-৪-১৯২৮ ঈ., পৃ. ৬, কলাম ৩)
* উপরোক্ত ‘তাযকিরা’ গ্রন্থটির মধ্যে মির্যা সাহেবের হরেক রকমের কথিত ওহীর রূপ দেখতে পাওয়া যায়। উর্দু, আরবী থেকে শুরু করে ফারসি, ইংরেজি এমনকি ইবরানি (হিব্রু) ভাষাতেও তিনি কথিত ওহী ও ইলহামের কসরত দেখিয়েছেন। (যদিও আরবীর কসরতগুলো দেখলে যে কোনো কুরআন তিলাওয়াতকারী মুসলমান ধরে ফেলবেন যে, এগুলো কুরআনের আয়াত কেটে কেটে তৈরি করা। ইংরেজিগুলোও হাস্যকর এবং ব্যাকরণিক ত্রুটিপূর্ণ। আর উর্দু-ফার্সীর কথিত ওহীগুলোকে রূপকথার ধাঁধাঁ, কল্পনা-বিলাস ও অলস মস্তিষ্কের ফসল বলে মনে হবে।)
এমন বৈচিত্র্যে ভরপুর (!) ওহীর দাবিদারের প্রতি ঈমান সত্ত্বেও কাদিয়ানীরা মুসলিমদের ওহীর কিতাব ৬৫ ভাষায় কষ্ট করে কী অভিসন্ধি নিয়ে অনুবাদ করলেন? তদুপরি প্রদর্শনীও করলেন মুসলমানদের সামনে?
* তাযকিরা গ্রন্থটি ছাড়াও তেইশ খ-ের রূহানী খাযায়েন, দুই খ-ের মাজমুআয়ে ইশতেহারাত মিলিয়ে কাদিয়ানী সাহেবের রচনাসমগ্র তেমন ছোটও নয়। এখনো এই বইগুলো যতেœর সঙ্গে ছাপা হয়। তাহলে নিজেদের ধর্মপ্রণেতার এত এত ধর্মগ্রন্থ ছেড়ে কাদিয়ানীরা আমাদের কুরআন শরীফ অনুবাদ করে কেন এরূপ তৎপরতা দেখাচ্ছেন?
* মির্যা কাদিয়ানীর দাবি অনুযায়ী তার কথিত ওহীর মধ্যে ধর্মীয় আদেশ-নিষেধ দুটোই রয়েছে। অর্থাৎ ইসলামী শরীয়ত থেকে তার দাবিকৃত শরীয়ত কোনো অংশে কম নয়! (নাউযুবিল্লাহ!) তিনি লিখেছেন-
ما سوا اسکے یہ بھی تو سمجھو کہ شریعت کیا چیز ہےجس نے اپنی وحی کے ذریعہ سے چند امر اور نہی بیان کئے اور اپنی امت کے لئے ایک قانون مقرر کیا وہی صاحب الشریعت ہو گیا۔ پس اس تعریف کے رو سے بھی ہمارے مخالف ملزم ہیں کیونکہ میری وحی میں امر بھی ہیں اور نہی بھی۔
অর্থ : তাছাড়া এটাও তো বোঝার চেষ্টা করো যে, শরীয়ত কী জিনিস! যে নিজ ওহীর মাধ্যমে কিছু আদেশ-নিষেধ বর্ণনা করে নিজ উম্মতের জন্য একটি আইন নির্ধারণ করেছে, সে-ই শরীয়তবাহী হয়ে গিয়েছে। সুতরাং এই সংজ্ঞার আলোকেও আমাদের প্রতিপক্ষ অভিযুক্ত। কারণ, আমার ওহীর মধ্যে আদেশও আছে, নিষেধও আছে। -আরবাঈন-৪, রূহানী খাযায়েন ১৭/৪৩৫
এখানেও একই প্রশ্ন- নিজেদের এরূপ ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ ওহী’ (?) ও ‘স্বতন্ত্র শরীয়ত’ (?) ছেড়ে আমাদের ওহীর গ্রন্থ- আলকুরআনের শিক্ষা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ কোন্ মতলবে? প্রশ্নটি সত্যি বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে।
ইহুদী, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, হিন্দু যে কেউ, যাদের বিশ্বাাস ও ধর্মগ্রন্থ আমাদের থেকে ভিন্ন, তারাও যদি এ ধরনের উদ্যোগ নিত, অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে কুরআনের শিক্ষা পৌঁছে দেয়ার কথা বলে ডজন-ডজন ভাষায় কুরআন অনুবাদে হাত দিত, তখনও মুসলমানদের স্বাভাবিক প্রশ্ন করার ও সংশয় পোষণের যথেষ্ট অবকাশ থাকত।
কাদিয়ানীরাও তাদের ন্যায় স্বতন্ত্র ধর্মাবলম্বী। মির্যা কাদিয়ানীর নবুওত দাবির বিষয়টি দালীলিকভাবে সুপ্রমাণিত। আহমদী তথা কাদিয়ানী সম্প্রদায় তাকে নবী, প্রতিশ্রুত ঈসা ও প্রতিশ্রুত মাহদীরূপে বিশ্বাস করে। নিষ্ঠাবান কাদিয়ানীরা মির্যা গোলাম আহমদের নামের সঙ্গে গুরুত্বের সঙ্গে ‘আলাইহিস সালাম’ দুআ পাঠ করে। (যা মূলত নবীদের নামের সঙ্গে পড়া হয়।) তার শিষ্যদের নামের সঙ্গে ‘রাযিআল্লাহু আনহু’ বলে এবং লেখেও। (যা সাধারণত নবীর সাহাবীদের ক্ষেত্রে বলা হয়।) তাদের মৌলিক গ্রন্থ থেকে শুরু করে সমকালীন বই-পুস্তক, ম্যাগাজিন এবং ওয়েবসাইটেও তাদের ধর্ম ভিন্ন হওয়ার ভূরিভূরি প্রমাণ বিদ্যমান। মির্যার স্ত্রীদেরকে তারা ‘উম্মুল মুমিনীন’ তথা মুমিনদের মা বলে মান্য করে। তাদের স্বতন্ত্র ধর্মীয় গ্রন্থের কথাও উপরে আলোচিত হল। এতকিছু সত্ত্বেও মুসলমানদের পবিত্র কুরআনের প্রতি তাদের এত উপচে পড়া দরদ দেখে স্বভাবতই আমাদের আশংকা প্রবল হচ্ছে।
আমাদের এই আশংকা মোটেও অমূলক নয়। স্বয়ং কাদিয়ানী ধর্মমতের প্রতিষ্ঠাতা মির্যা গোলাম আহমদ তার কুফুরী ধ্যান-ধারণা ও আকীদা-বিশ্বাসকে প্রমাণিত করার জন্য কুরআনে কারীমের অসংখ্য আয়াতে ভয়াবহ ধরনের বিকৃতির অপচেষ্টা করেছে। মনগড়া অপব্যাখ্যা করে কুরআনকে নিজের আবিষ্কৃত মতবাদের পক্ষে ঢালস্বরূপ ব্যবহার করতে চেয়েছে। যার ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ। এখানে প্রথমে আমরা মির্যা কাদিয়ানীর কুরআন বিকৃতির কিছু দৃষ্টান্ত আলোচনা করছি। এরপর কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত কুরআন থেকে বিকৃতিগুলো পর্যায়ক্রমে তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ।
মির্যা কাদিয়ানীর কুরআন বিকৃতির অপচেষ্টা : কিছু দৃষ্টান্ত
এক. সূরা আহযাব, আয়াত : ৪০
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ اَبَاۤ اَحَدٍ مِّنْ رِّجَالِكُمْ وَ لٰكِنْ رَّسُوْلَ اللهِ وَ خَاتَمَ النَّبِیّٖنَ ، وَ كَانَ اللهُ بِكُلِّ شَیْءٍ عَلِیْمًا.
তরজমা : মুহাম্মাদ তোমাদের কোনো পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহ্র রসূল এবং শেষ নবী। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে জ্ঞাত।১
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর হাবীব হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ‘খাতামুন্নাবীয়্যীন’ ঘোষণা দিয়েছেন। যার অর্থ সাহাবা, তাবেয়ীনসহ সকল যুগের মুসলিম উম্মাহ্র নিরবচ্ছিন্ন ও অকাট্য বিশ্বাাস অনুযায়ী ‘নবীগণের সর্বশেষ’। অর্থাৎ তাঁর পরে নতুন কাউকে নবুওত দান করা হবে না।
মির্যা কাদিয়ানীর বিকৃতি
কিন্তু মির্যা গোলাম আহমদ নিজে নবী দাবি করার সুযোগ তৈরির জন্য এ শব্দের অর্থ করেছে- ‘এমন মোহর, যা নবুওত দান করে এবং নবী তৈরি করে।’২ তার বক্তব্য লক্ষ্য করুন-
اللہ جل شانہ نے آنحضرت صلی اللہ علیہ وسلم کو صاحب خاتم بنایا۔ یعنی آپ کو افاضۂ کمال کے لئے مہر دی جو کسی اور نبی کو ہر گز نہیں دی گئی، اسی وجہ سے آپ کا نام خاتم النبیین ٹھہرا یعنی آپ کی پیروی کمالات نبوت بخشی ہے اور آپ کی توجۂ روحانی نبی تراش ہے۔
অর্থ: ‘মহা প্রতাপশালী আল্লাহ আঁ হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে খাতামের অধিকারী বানাইয়াছেন। অর্থাৎ তাঁহাকে পরিপূর্ণ আশিসের জন্য মোহর দেওয়া হয়, যাহা আর কোনো নবীকে কখনো দেওয়া হয় নাই। এই কারণেই তাঁহার নাম ‘খাতামুন্নাবীয়্যীন’ সাব্যস্ত করা হইয়াছে। অর্থাৎ তাঁহার পরিপূর্ণ অনুবর্তিতা নবুওত দান করে এবং তাঁহার আধ্যাত্মিক মনোনিবেশ নবী সৃষ্টিকারী হয়।’ দেখুন তার গ্রন্থ, হাশিয়ায়ে হাকীকাতুল ওহী [উর্দু], রূহানী খাযায়েন ২২/১০০; ‘হাকীকাতুল ওহী’ [বাংলা]-এর টীকা, পৃ. ৭৫
এ বিষয়টিকেই মির্যা সাহেব অন্যত্র আরেকটু খোলাসা করে বলেছেন-
پس یہ آیت کہ مَا كَانَ مُحَمَّدٌ اَبَاۤ اَحَدٍ مِّنْ رِّجَالِكُمْ وَ لٰكِنْ رَّسُوْلَ اللّٰهِ وَ خَاتَمَ النَّبِیّٖنَ اس کے معنی یہ ہیں کہ ليس محمد أبا أحد من رجال الدنيا ولكن هو أب لرجال الآخرة لأنه خاتم النبيين ولا سبيل إلى فيوض الله من غير توسطه. غرض میری نبوت اور رسالت باعتبار محمد اور احمد ہونے کے ہے نہ میرے نفس کے رو سے اور یہ نام بحیثیت فنا فی الرسول مجھے ملا لہذا خاتم النبیین کے مفہوم میں فرق نہ آیا۔
অর্থ : অতএব-
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ اَبَاۤ اَحَدٍ مِّنْ رِّجَالِكُمْ وَ لٰكِنْ رَّسُوْلَ اللّٰهِ وَ خَاتَمَ النَّبِیّٖنَ
আয়াতটির অর্থ হবে এরূপ- (মুহাম্মাদ এই মরলোকবাসীদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নন; তিনি অমরলোকবাসী পুরুষদের পিতা; কেননা তিনি ‘খাতামুন্নাবীঈন’। তাঁর সূত্র ব্যতীত আল্লাহ্র অনুগ্রহ পাবার আর কোনোই পথ নেই।) মোটকথা, আমি মুহাম্মাদ ও আহমদ সা. হওয়ার কারণে আমার নবুওত ও রেসালাত লাভ হয়েছে, স্বকীয়তায় নয়, ফানা ফির রসূল’ হয়ে অর্থাৎ রসূলের মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিলীন করে পেয়েছি। সুতরাং এতে ‘খাতামুন্নাবীঈনের’ অর্থে কোনো ব্যতিক্রম ঘটলো না। -এক গলতি কা ইযালা, রূহানী খাযায়েন ১৮/২০৮; একটি ভুল সংশোধন পৃ. ৫
সারকথা হল, মির্যা কাদিয়ানীর মতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘খাতামুন্নাবিয়্যীন’-এর অর্থ এটা নয় যে, তাঁর পরে কেউ নবুওত লাভ করতে পারবে না। বরং এর অর্থ হল, আল্লাহ তাআলা তাঁকে এমন সীলমোহর দান করেছেন, যা নবুওত দান করে। তাঁর পরে কেউ নবী হতে চাইলে ঐ সীল দ্বারা সত্যায়িত হতে হবে! বরং তাঁর সূত্র ধরে, তাঁর অনুসরণ করে এবং তাঁর মাঝে নিজেকে সম্পূর্ণ বিলীন করতে পারলে নবুওত লাভ করা যাবে! (নাউযুবিল্লাহ!)
সচেতন পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, কীভাবে সূরা আহযাবের উপরোক্ত আয়াতের মর্ম সম্পূর্ণ বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়েছে।
দুই. সূরা কাসাস, আয়াত : ৭০
وَ هُوَ اللّٰهُ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ، لَهُ الْحَمْدُ فِی الْاُوْلٰی وَ الْاٰخِرَةِ، وَلَهُ الْحُكْمُ وَ اِلَیْهِ تُرْجَعُوْنَ .
তরজমা : তিনিই আল্লাহ। তিনি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। ইহকালে ও পরকালে তাঁরই প্রশংসা। বিধান তাঁরই ক্ষমতাধীন এবং তোমরা তাঁরই কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে।
মির্যা কাদিয়ানীর বিকৃতি
মির্যা কাদিয়ানীর অনেক কুফুরি আকীদার মধ্যে একটি জঘন্য আকীদা হল তার ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ হওয়ার দাবি। তার দাবি, আল্লাহ তাকে ‘মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ’ আখ্যায়িত করেছেন এবং হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দ্বিতীয় আধ্যাত্মিক রূপে আবির্র্ভূত করেছেন। (দ্র. এক গলতি কা ইযালা, রূহানী খাযায়েন ১৮/২০৭, ২১২, ২১৫, ২১৬; একটি ভুল সংশোধন ৪, ১০, ১৪, ১৫)
আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এই কুফুরি আকীদাটিও মির্যা কুরআন থেকে প্রমাণিত করতে নানা অপচেষ্টা করেছে। বলেছে, সূরা কাসাসের এ আয়াতে দু’জন আহমদের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। একজন হলেন আহমদ মুস্তফা অর্থাৎ আমাদের নবীজী। আর অন্যজন আখেরি যুগের আহমদ! অর্থাৎ মির্যা গোলাম আহমদ নিজে! তার বক্তব্য দেখুন-
لَهُ الْحَمْدُ فِی الْاُوْلٰی وَ الْاٰخِرَةِ فأومأ فيه إلى أحمدين وجعلهما من نعمائه الكاثرة. فالأول منهما أحمدن المصطفى ورسولنا المجتبى. والثانى أحمد آخر الزمان. الذى سمي مسيحاً ومهديا من الله المنان.
অর্থ : { لَهُ الْحَمْدُ فِی الْاُوْلٰی وَ الْاٰخِرَةِ}
সুতরাং এর মধ্যে দু’জন আহমদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে এবং উভয়কে বিপুল নিআমত দ্বারা ভূষিত করা হয়েছে। প্রথমজন হলেন, আহমদ মুস্তফা এবং আমাদের মহান রাসূল। আর দ্বিতীয়জন আখেরি যুগের আহমদ। যাকে দয়াময় আল্লাহ্র পক্ষ থেকে মাসীহ এবং মাহদী আখ্যায়িত করা হয়েছে। -দেখুন, ই‘জাযুল মাসীহ, রূহানী খাযায়েন ১৮/১৩৮-১৩৯
অথচ এ আয়াতের পরিষ্কার আলোচ্য বিষয় হচ্ছে আল্লাহ তাআলার তাওহীদ এবং প্রশংসা। স্পষ্ট বলা হয়েছে- দুনিয়া ও আখেরাতের সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য।
তিন. সূরা সাফ্, আয়াত : ৮
یُرِیْدُوْنَ لِیُطْفِـُٔوْا نُوْرَ اللهِ بِاَفْوَاهِهِمْ وَ اللهُ مُتِمُّ نُوْرِهٖ وَ لَوْ كَرِهَ الْكٰفِرُوْنَ .
তরজমা : তারা মুখের ফুৎকারে আল্লাহ্র আলো নিভিয়ে দিতে চায়। আল্লাহ তাঁর আলোকে পূর্ণরূপে বিকশিত করবেন যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।
মির্যা কাদিয়ানীর বিকৃতি
মির্যা কাদিয়ানী হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীতে ‘প্রতিশ্রুত মাসীহ হওয়ার দাবি’ করেছে। (দ্র. যমীমায়ে বারাহীনে আহমদিয়া ৫, রূহানী খাযায়েন ২১/৩৫৯; ইযালায়ে আওহাম, রূহানী খাযায়েন ৩/১৮৯)-এ দাবিটিকে কুরআন থেকে প্রমাণ করার বাসনায় মির্যা সূরা সাফ্-এর এ আয়াতের অপব্যাখ্যা করে বলেছে যে, এখানে পরিষ্কারভাবে তার আগমনের কথা রয়েছে! তার বক্তব্য দেখুন-
یُرِیْدُوْنَ لِیُطْفِـُٔوْا نُوْرَ اللّٰهِ بِاَفْوَاهِهِمْ وَ اللّٰهُ مُتِمُّ نُوْرِهٖ وَ لَوْ كَرِهَ الْكٰفِرُوْنَ. اس آیت میں تصریح سے سمجھایا گیاہے کہ مسیح موعود چودھویں صدی میں پیدا ہوگا۔
অর্থ :
یُرِیْدُوْنَ لِیُطْفِـُٔوْا نُوْرَ اللّٰهِ بِاَفْوَاهِهِمْ وَ اللّٰهُ مُتِمُّ نُوْرِهٖ وَ لَوْ كَرِهَ الْكٰفِرُوْنَ .
এ আয়াত দ্বারা পরিষ্কার বোঝানো হয়েছে যে, প্রতিশ্রুত মাসীহ চতুর্দশ শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করবেন।
দেখুন, তার রচিত তোহফায়ে গোলড়বিয়া, রূহানী খাযায়েন ১৭/১২৪
পাঠক! আয়াতটির অর্থ পড়–ন আর মির্যার আজগুবি অপব্যাখ্যা দেখুন। কোনো সম্পর্কই খুঁজে পাবেন না। এ আয়াতে ইসলামের বিরুদ্ধে কাফেরদের ষড়যন্ত্র এবং তার ব্যর্থতা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। অথচ মির্যা সাহেব এর মধ্যে চতুর্দশ শতাব্দীতে প্রতিশ্রুত মাসীহের আগমনের কথা বলে নিজের আলোচনা এনে বসিয়েছেন!
চার. সূরা তাহরীম, আয়াত : ১২
وَ مَرْیَمَ ابْنَتَ عِمْرٰنَ الَّتِیْۤ اَحْصَنَتْ فَرْجَهَا فَنَفَخْنَا فِیْهِ مِنْ رُّوْحِنَا وَ صَدَّقَتْ بِكَلِمٰتِ رَبِّهَا وَ كُتُبِهٖ وَ كَانَتْ مِنَ الْقٰنِتِیْنَ.
তরজমা : আর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন ইমরান তনয়া মারইয়ামের, যে তার সতিত্ব বজায় রেখেছিল। অতঃপর আমি তার মধ্যে আমার পক্ষ থেকে জীবন ফুঁকে দিয়েছিলাম এবং সে তার পালনকর্তার বাণী ও কিতাবকে সত্যে পরিণত করেছিল। সে ছিল বিনয় প্রকাশকারীনিদের একজন।
মির্যা কাদিয়ানীর বিকৃতি
মির্যার অসংখ্য দাবি-দাওয়ার মধ্যে একটি দাবি ছিল, ‘মারইয়াম হওয়া’। অর্থাৎ মির্যা দাবি করেছে, আল্লাহ তাকে ‘মারইয়াম’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। তাকে হযরত মারইয়ামের সদৃশ বানিয়েছেন। এমনকি হযরত মারইয়ামের ন্যায় তার মধ্যেও ঈসা আ.-এর রূহ ফুঁকে দিয়েছেন! এটা যে এক উদ্ভট ও বিদঘুটে কথা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এ বিষয়টিকেই মির্যা কুরআন দ্বারা প্রমাণিত করার অপচেষ্টা করেছে এ আয়াতের অর্থ বিকৃত করে। বলেছে, সূরা তাহরীমের এ আয়াতের প্রতিপাদ্য তিনি নিজে। তার দাবি, এখানে আল্লাহ তার ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন এবং তাকে মারইয়াম বলেছেন! দেখুন তার উক্তি-
اور خوب غور کر کے دیکھ لو کہ قرآن شریف کی اس آیت کا بجز میرے کوئی دنیا میں مصداق نہیں۔ پس یہ پیشگوئی سورہ تحریم میں میرے لئے ہے اور وہ آیت یہ ہے وَ مَرْیَمَ ابْنَتَ عِمْرٰنَ الَّتِیْۤ اَحْصَنَتْ فَرْجَهَا فَنَفَخْنَا فِیْهِ مِنْ رُّوْحِنَا دیکھو سورۃ تحریم الجزو نمبر ২৮ (ترجمہ)... اب ظاہر ہے کہ بموجب اس آیت کے اس امت کی مریم کو پہلی مریم کے ساتھ تب مشابہت پیدا ہوتی ہے کہ اس میں بھی عیسی کی روح پھونک دی جائے جیساکہ خدا نے خود روح پھونکنے کا ذکر بھی اس آیت میں فرمادیا ہے اور ضرور ہے کہ خدا کا کلام پورا ہو۔ پس اس تمام امت مین وہ میں ہی ہوں میراہی نام خدا نے براہین احمدیہ میں پہلے مریم رکھا اوربعد اس کے میری نسبت یہ کہا کہ ہم نے اس مریم میں اپنی طرف سے روح پھونک دی اور پھر روح پھونکنے کے بعد مجھے ہی عیسی قرار دیا ۔ پس اس آیت کا میں ہی مصداق ہوں۔
অর্থ : খুব ভাবিয়া দেখ এবং পৃথিবীতে খুঁজিয়া দেখ, আমি ছাড়া পৃথিবীতে কুরআন শরীফের এই আয়াতের অন্য কেহ প্রতীক নাই। অতএব, এই ভবিষ্যদ্বাণী সূরা তাহরীমে আমার জন্য বিশেষভাবে উল্লেখিত আছে। আয়াতটি এই যে-
وَ مَرْیَمَ ابْنَتَ عِمْرٰنَ الَّتِیْۤ اَحْصَنَتْ فَرْجَهَا فَنَفَخْنَا فِیْهِ مِنْ رُّوْحِنَا.
দেখো সূরা তাহরীম, আটাশতম পারা। (অনুবাদ) ... এখন প্রতীয়মান হয় যে, এই আয়াতের কারণে এই উম্মতের মরিয়মের সহিত প্রথম মরিয়মের তখনই সাদৃশ্যের সৃষ্টি হয় যখন তাহার মধ্যেও ঈসার রূহ ফুকিয়া দেওয়া হয়, যেমন খোদা স্বয়ং এই আয়াতে রূহ ফুঁকার উল্লেখ করিয়াছেন। নিশ্চয়ই খোদার কথা পূর্ণ হইয়া থাকে। অতএব, এ উম্মতের মধ্যে আমিই সেই ব্যক্তি। আমার নামই খোদা বারাহীনে আহমদীয়ায় প্রথমে মরিয়ম রাখেন এবং ইহার পরে আমারই সম্পর্কে এই কথা বলেন, আমরা এই মরিয়মের মধ্যে নিজেদের তরফ হইতে রূহ ফুঁকিয়া দিলাম। রূহ ফুঁকার পরে আমাকেই তিনি ঈসা আখ্যায়িত করেন। অতএব এই আয়াতের আমিই প্রতীক। -হাকীকাতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/৩৫১; (বাংলা) হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ২৮২
লক্ষ্য করুন, এ বক্তব্যে মির্যা কাদিয়ানী আয়াতটির ব্যাখ্যায় চারটি দাবি করেছে-
১. এ আয়াতের প্রতীক ও প্রতিপাদ্য পৃথিবীতে একমাত্র তিনি।
২. এর মধ্যে তার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে।
৩. তার মধ্যেও ঈসার রূহ ফুঁকে দিয়ে আল্লাহ এখানে তাকে পূর্ববর্তী মারয়ামের সঙ্গে সাদৃশ্য দিয়েছেন।
৪. রূহ ফুঁকে দেওয়ার পর তাকেই আল্লাহ ঈসা আখ্যায়িত করেছেন।
বলাবাহুল্য, এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্ট ভাষায় ইমরানের কন্যা হযরত মারইয়াম-এর আলোচনা করেছেন। যিনি হযরত ঈসা আ.-এর সম্মানিত মা। অথচ মির্যা কাদিয়ানী দাবি করছেন, এ আয়াতের প্রতিপাদ্যও তিনি এবং মারয়ামও তিনি! আল্লাহ তাআলা এখানে হযরত মারয়াম সম্পর্কে বলেছেন যে, তাঁর মধ্যে আমি ঈসার রূহ ফুঁকে দিয়েছি। কিন্তু মির্যা কাদিয়ানী বলছে, আমার মধ্যেও আল্লাহ ঈসার রূহ ফুঁকে দিয়েছেন এবং আমাকে পূর্ববর্তী মারইয়ামের সঙ্গে এখানে সাদৃশ্য দিয়েছেন!
ভারি আশ্চর্যের ব্যাপার! একজন পুরুষ হয়েও মির্যা কাদিয়ানী নিজেকে মারইয়াম দাবি করছে। এরপর বলছে, তার মধ্যে ঈসার রূহও আল্লাহ ফুঁকে দিয়েছেন! তারপর আবার সেই ঈসাও নাকি মির্যা সাহেব নিজেই! এসব নাকি আল্লাহও কুরআন মাজীদে বলেছেন! এমন অদ্ভূত, উদ্ভট, অরুচিকর এবং স্পর্ধিত কুফুরি দাবির সঙ্গে কুরআনের আয়াতের কোনোই সম্পর্ক নেই।
পাঁচ. সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত : ১
سُبْحٰنَ الَّذِیْۤ اَسْرٰی بِعَبْدِهٖ لَیْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ اِلَی الْمَسْجِدِ الْاَقْصَا الَّذِیْ بٰرَكْنَا حَوْلَهٗ لِنُرِیَهٗ مِنْ اٰیٰتِنَا، اِنَّهٗ هُوَ السَّمِیْعُ الْبَصِیْرُ.
তরজমা : পরম পবিত্র ও মহিমময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি; যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।
মির্যা কাদিয়ানীর বিকৃতি
মির্যা কাদিয়ানীর দাবি, কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা অতি সম্মানের সঙ্গে কাদিয়ানের নাম উল্লেখ করেছেন। (ইযালায়ে আওহাম, রূহানী খাযায়েন ৩/১৪০) অথচ পুরো কুরআনের কোথাও এ নামের উল্লেখ নেই। এজন্য মির্যা কুরআনে এ নামের অস্তিত্ব সাব্যস্ত করতে সূরা বনী ইসরাঈলের প্রথম আয়াতে উল্লেখিত ‘মসজিদে আকসা’- কে নিজের কাদিয়ানের ইবাদতখানা আখ্যায়িত করেছে।
আরেকটি অপব্যাখ্যা
যেহেতু মির্যা কাদিয়ানী নিজেকে আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দ্বিতীয় আধ্যাত্মিক রূপ বলে দাবি করত, এজন্য আলোচ্য আয়াতে বর্ণিত নবীজীর মেরাজের ঘটনাকে মির্যা ‘স্থান ও কাল ঘটিত’- (زمانی و مکانی) দুই প্রকারের মে‘রাজ আখ্যায়িত করেছে। অর্থাৎ তার মতে আল্লাহ্র রসূলের ‘স্থান ঘটিত মে‘রাজ’ হয়েছে ফিলিস্তিনের মসজিদুল আকসা পর্যন্ত বাহ্যিক সফরের মাধ্যমে। আর ‘কালঘটিত মে‘রাজ’ হয়েছে পৃথিবীর শেষকাল অর্থাৎ মির্যার যুগে তার কাদিয়ানের মসজিদ (?) পর্যন্ত কাশ্ফী জগতে পরিভ্রমণের মাধ্যমে!
আলোচ্য আয়াতে এই দুটি অপব্যাখ্যা করে মির্যা নিজেকে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্র দ্বিতীয় রূপ এবং নিজের মসজিদকে (?) মসজিদুল আকসা প্রমাণ করতে চেয়েছেন! তার বক্তব্য দেখুন-
یہ یقینی امر ہےکہ قرآن شریف کی یہ آیت کہ سُبْحٰنَ الَّذِیْۤ اَسْرٰی بِعَبْدِهٖ لَیْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ اِلَی الْمَسْجِدِ الْاَقْصَا الَّذِیْ بٰرَكْنَا حَوْلَهٗ- معراج مکانی اور زمانی دونوں پر مشتمل ہے اور بغیر اس کے معراج ناقص رہتا ہے پس جیسا کہ سیر مکانی کے لحاظ سے خدا تعالی نے آنحضرت صلی اللہ علیہ وسلم کو مسجد الحرام سے بیت المقدس تک پہنچادیا تھا ایسا ہی سیر زمانی کے لحاظ سے آنجناب کو شوکت اسلام کے زمانہ سے جو آنحضرت صلی اللہ علیہ وسلم کا زمانہ تھا برکات اسلامی کے زمانہ تک جو مسیح موعود کازمانہ ہے پہنچا دیا۔ پس اس پہلو کے رو سے جو اسلام کے انتہاء زمانہ تک آنحضرت صلی اللہ علیہ وسلم کا سیر کشفی ہے مسجد اقصی سے مراد مسیح موعود کی مسجد ہے جو قادیان میں واقع ہے۔ ...
آنحضرت صلی اللہ علیہ وسلم کا ایک زمانی معراج بھی تھا ... اور وہ معراج یعنی بلوغ نظر کشفی دنیا کی انتہا تک تھا جو مسیح کے زمانہ سے تعبیر کیا جاتا ہے اور اس معراج میں جو آنحضرت صلی اللہ علیہ وسلم مسجد الحرام سے مسجد اقصی تک سیر فرما ہوئے وہ مسجد اقصی یہی ہے جو قادیان میں بجانب مشرق واقع ہے۔
অর্থ : এটা নিশ্চিত বিষয় যে, কুরআন শরীফের এ আয়াত-
سُبْحٰنَ الَّذِیْۤ اَسْرٰی بِعَبْدِهٖ لَیْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ اِلَی الْمَسْجِدِ الْاَقْصَا الَّذِیْ بٰرَكْنَا حَوْلَهٗ .
স্থান ও কালঘটিত উভয় প্রকার মে‘রাজকে অন্তর্ভুক্ত করে। আর এছাড়া মে‘রাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। অতএব, যেমনিভাবে স্থান ভ্রমণের বিবেচনায় খোদা তাআলা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মসজিদুল হারাম থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন, তেমনিই কাল ভ্রমণের দিক থেকে ইসলামের প্রতিপত্তির যুগ থেকে- যা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ ছিল- ইসলামের বরকতের যুগ পর্যন্ত- যা প্রতিশ্রুত মাসীহ-এর যুগ- পৌঁছে দিয়েছেন। অতএব, ইসলামের শেষযুগ পর্যন্ত হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাশ্ফী ভ্রমণের দিক বিবেচনায় মসজিদে আকসা দ্বারা উদ্দেশ্য প্রতিশ্রুত মাসীহ-এর মসজিদ। যা কাদিয়ানে অবস্থিত।...
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এক মে‘রাজ কাল-সম্পর্কিতও ছিল। ... আর সেই মে‘রাজ কাশ্ফী দুনিয়ার শেষ পর্যন্ত ছিল, যাকে মাসীহ-এর কাল বলে ব্যক্ত করা হয়। এ মে‘রাজের মধ্যে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত যে ভ্রমণ করেছেন, সেই মসজিদে আকসা এটিই, যা কাদিয়ানে পূর্বদিকে অবস্থিত। -দেখুন, খোৎবায়ে ইলহামিয়া, রূহানী খাযায়েন ১৬/২০-২২
লক্ষ্য করুন, এ বক্তব্যে মির্যা কাদিয়ানী আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় পাঁচটি দাবি করেছে-
১. আল্লাহ্র আসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দু’প্রকারের মে‘রাজ হয়েছে। এক. মাকানী বা স্থানঘটিত, যা মক্কা থেকে ফিলিস্তিনের মসজিদুল আকসা পর্যন্ত হয়েছে। দুই. যামানী বা কালঘটিত। যা ইসলামের প্রথম যুগ থেকে মির্যা কাদিয়ানীর যুগে তার নির্মিত ‘মসজিদ’ পর্যন্ত হয়েছে।
২. মেরাজের এ উভয় প্রকার ব্যতীত নবীজীর মে‘রাজ অসম্পূর্ণ।
৩. যামানী (কালঘটিত) মে‘রাজ হয়েছে বাস্তব জগতের বাইরে কাফ্শী জগতে আধ্যাত্মিক ভ্রমণের মাধ্যমে।
৪. এ কাশ্ফী জগৎ ভ্রমণের মে‘রাজে আল্লাহ তাঁর নবীকে ইসলামের প্রতিপত্তির কাল থেকে মির্যা সাহেবের কালে পৌঁছে দিয়েছেন।
৫. এ কাশ্ফী মে‘রাজের ‘মসজিদুল আকসা’ হচ্ছে পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলার কাদিয়ানে অবস্থিত মির্যা সাহেবের মসজিদ।
বলার অপেক্ষা রাখে না- এ সবই মির্যার মনগড়া দাবি ও প্রলাপোক্তি এবং কুরআনের আয়াত বিকৃতির ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত। আয়াতে আল্লাহ্র রাসূলের একটিমাত্র সশরীরে মে‘রাজের ঘটনাই আলোচিত হয়েছে এবং সেটা এই বাস্তব পৃথিবীতেই সংঘটিত হয়েছে। মির্যা কাদিয়ানীর এইসব প্রলাপ মূলত তার ‘দ্বিতীয় মুহাম্মাদ’ দাবির সাথেই সংশ্লিষ্ট।
ছয়. সূরা ফাতেহা, আয়াত : ৭
صِرَاطَ الَّذِیْنَ اَنْعَمْتَ عَلَیْهِمْ، غَیْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَیْهِمْ، وَ لَا الضَّآلِّیْنَ.
তরজমা :......... ঐসকল লোকের পথে নয়, (অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমাদেরকে পরিচালিত করবেন না) যাদের প্রতি গযব নাযিল হয়েছে এবং তাদের পথেও নয়, যারা পথহারা।
এ আয়াতে الْمَغْضُوْبِ عَلَیْهِمْ বা যাদের প্রতি গযব নাযিল হওয়ার কথা বলা হয়েছে, তারা হচ্ছে ইহুদী সম্প্রদায়। আর الضَّآلِّیْنَ বা ‘পথভ্রষ্ট’ দ্বারা উদ্দেশ্য খ্রিস্টান সম্প্রদায়। কুরআনে কারীমের অন্যত্র সূরা মায়েদার ৬০নং আয়াতে স্পষ্ট ভাষায় ইহুদীদেরকে লা‘নত ও গযবপ্রাপ্ত এবং ৭৭নং আয়াতে খ্রিস্টানদের সম্পর্কে পথভ্রষ্ট বলা হয়েছে। নির্ভরযোগ্য একাধিক হাদীসেও আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
الْمَغْضُوْبِ عَلَیْهِمْ: الْيَهُودُ، وَالضَّالُّونَ : النّصَارَى
অর্থ : গযবপ্রাপ্ত হল ইহুদীরা। আর পথভ্রষ্ট হচ্ছে খ্রিস্টানরা। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৬২৪৬, ৭২০৬; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯৫৪; তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৪১
মির্যা কাদিয়ানীর বিকৃতি
মির্যা কাদিয়ানীর কুফুরী আকীদা-বিশ্বাসের কারণে গোটা পৃথিবীর উলামায়ে কেরাম তার ব্যাপারে কাফের ফতোয়া দিয়েছেন; যা নিঃসন্দেহে তাদের গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনী যিম্মাদারি। সারা পৃথিবীর মুসলমানরাও তাদেরকে কাফের বিশ্বাাস করে; যা তাদের ঈমানী দায়িত্ব। কিন্তু মির্যা কাদিয়ানী মুসলমানদের ‘এই কাফের বলাকেই’ নিজের সত্যতার নিদর্শন আখ্যা দিয়েছে। আর সেটাও কুরআনের অপব্যাখ্যা করে!
মির্যা বলেছে, সূরা ফাতেহার সর্বশেষ আয়াত-এর মধ্যে দুআর আঙ্গিকে দুটি ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। এক. এই উম্মতের মধ্য হতে একজন প্রতিশ্রুত ঈসার জন্ম হবে। (অর্থাৎ তার দাবিমতে সে নিজেই।) দুই. এ উম্মতের কিছু লোক তাকে কাফের বলবে, অপমান করবে। যার পরিণামে তারা আল্লাহ্র গযবের পাত্র হবে। দেখুন-
اور اس دعا میں ہے کہ یا الہی ہمیں وہ فرقہ مت بنا جن کا نام مغضوب علیھم ہے۔ پس اس دعا کے رنگ میں یہ ایک پیشگوئی ہے جو دو خبر پر مشتمل ہے۔ ایک یہ کہ اس امت میں بھی ایک مسیح موعود پیدا ہوگا۔ اور دوسری یہ پیشگوئی ہے کہ بعض لوگ اس امت میں سے اس کی بھی تکفیر اور توہین کریں گے اور وہ لوگ مورد غضب الہی ہوں گے۔
অর্থ : আর এ দুআটি, অর্থাৎ হে আল্লাহ আমাদেরকে ঐ দল বানাবেন না, যাদের নাম الْمَغْضُوْبِ عَلَیْهِمْ (গযবপ্রাপ্ত)। অতএব, এ দুআর আঙ্গিকে এটি একটি ভবিষ্যদ্বাণী। যা দুটি সংবাদ বহন করে। এক হচ্ছে, এ উম্মতের মধ্যেও একজন প্রতিশ্রুত মাসীহ জন্ম হবে। আর দ্বিতীয় ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে, এ উম্মতের মধ্যে কিছু লোক তাকেও কাফের আখ্যা দিবে, অপমান করবে। ফলে তারা গযবের পাত্র হবে। -তোহফায়ে গোলড়বিয়া, রূহানী খাযায়েন ১৭/২১৩
লক্ষ্য করুন- কুরআন বলছে, الْمَغْضُوْبِ عَلَیْهِمْ অর্থাৎ গযবপ্রাপ্ত হল ইহুদীরা। কিন্তু মির্যা গোলাম আহমদ বলছে, الْمَغْضُوْبِ عَلَیْهِمْ বা গযবপ্রাপ্ত দলের মধ্যে তাকে কাফের আখ্যাদানকারী এবং অপমানকারীরাও অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন, সূরা ফাতেহার এ আয়াতে الْمَغْضُوْبِ عَلَیْهِمْ বা গযবপ্রাপ্ত হল ইহুদীরা। الضَّآلِّیْنَ বা পথভ্রষ্ট হল খ্রিস্টানরা। অথচ মির্যা সাহেব বলছে, এখানে দুআর আঙ্গিকে তার আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে! আর এ উম্মতের মধ্যে যারা তাকে অপমান করবে, কাফের আখ্যা দেবে- তারাই গযবেরর পাত্র হবে!
এই অপব্যাখ্যা মির্যা সাহেবের চিন্তার সঙ্গে মানিয়েছেও বেশ। কারণ, যে খ্রিস্টান ইংরেজ সরকারের তিনি স্বঘোষিত ‘চারা’ ছিলেন (মাজমুআয়ে ইশতেহারাত ২/১৯৮ নতুন সংস্করণ) এবং যে ইহুদী জাতির সঙ্গে তার জামাতের আজন্ম ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক, তাদেরকে কীভাবে গযব ও ভ্রষ্টতার দুর্নাম দেওয়া যায়! এজন্য মির্যা তাদের পরিবর্তে মুসলমানদেরকেই বেছে নিয়েছেন দোষগুলো আরোপ করার জন্য।
সাত. সূরা কাহাফ, আয়াত : ৮৯-৯১
ثُمَّ اَتْبَعَ سَبَبًا، حَتّٰۤی اِذَا بَلَغَ مَطْلِعَ الشَّمْسِ وَجَدَهَا تَطْلُعُ عَلٰی قَوْمٍ لَّمْ نَجْعَلْ لَّهُمْ مِّنْ دُوْنِهَا سِتْرًا، كَذٰلِكَ، وَ قَدْ اَحَطْنَا بِمَا لَدَیْهِ خُبْرًا.
তরজমা : অতঃপর সে (যুলকারনাইন) আরেক পথে চলল। চলতে চলতে যখন সূর্যোদয়ের স্থানে পৌঁছল, তখন সে দেখল সেটি উদয় হচ্ছে এমন এক জাতির উপর, যাদের জন্য আমি তা থেকে (অর্থাৎ রোদ থেকে) বাঁচার কোনো অন্তরালের ব্যবস্থা করিনি।
মির্যা কাদিয়ানীর বিকৃতি
মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী দাবি করে বলেছে, আল্লাহ তাআলা ওহীযোগে আমাকে ‘যুলকারনাইন’ আখ্যা দিয়েছেন। এ দাবির স্বপক্ষে মির্যা সূরা কাহফের শেষে বর্ণিত প্রাচীন যুগের নেককার বাদশাহ যুলকারনাইনের প্রতিপাদ্য নিজেকেও আখ্যা দিয়ে বলেছে, যুলকারনাইন মানে প্রতিশ্রুত মাসীহ! এমনকি হযরত যুলকারনাইন সম্পর্কে আয়াতে বর্ণিত পুরো ঘটনাটির রূপক অর্থ করে নিজের ওপরও প্রয়োগের হাস্যকর অপচেষ্টা করেছে! দেখুন-
پھر اللہ تعالی فرماتا ہے۔ ثُمَّ اَتْبَعَ سَبَبًا، حَتّٰۤی اِذَا بَلَغَ مَطْلِعَ الشَّمْسِ وَجَدَهَا تَطْلُعُ عَلٰی قَوْمٍ لَّمْ نَجْعَلْ لَّهُمْ مِّنْ دُوْنِهَا سِتْرًا، كَذٰلِكَ، وَ قَدْ اَحَطْنَا بِمَا لَدَیْهِ خُبْرًا. یعنی پھر ذو القرنین جو مسیح موعود ہے جس کو ہر ایک سامان عطا کیاجائے گا ایک اور سامان کے پیچھے پڑے گا یعنی ممالک مشرقیہ کے لوگوں کی حالت پر نظر ڈالے گا اور وہ جگہ جس سے سچائی کا آفتاب نکلتا ہے اس کو ایسا پائے گا کہ ایک ایسی نادان قوم پر آفتاب نکلا ہے جن کے پاس دھوپ سے بچنے کے لئےکوئی بھی سامان نہیں یعنی وہ لوگ ظاہر پرستی اورافراط کی دھوپ سے جلتے ہوں گے۔
অর্থ : এরপর আল্লাহ তাআলা বলছেন-
ثُمَّ اَتْبَعَ سَبَبًا، حَتّٰۤی اِذَا بَلَغَ مَطْلِعَ الشَّمْسِ وَجَدَهَا تَطْلُعُ عَلٰی قَوْمٍ لَّمْ نَجْعَلْ لَّهُمْ مِّنْ دُوْنِهَا سِتْرًا، كَذٰلِكَ، وَ قَدْ اَحَطْنَا بِمَا لَدَیْهِ خُبْرًا.
অর্থাৎ অতঃপর যুলকারনাইন যিনি প্রতিশ্রুত মাসীহ, যাকে সমস্ত উপকরণ প্রদান করা হয়েছে। আরো একটি উপকরণের প্রতি মনোযোগী হবে অর্থাৎ প্রাচ্যের দেশগুলোর বাসিন্দাদের অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করবে এবং যে স্থান থেকে সত্যের সূর্য উদিত হয়- তাকে এমন অবস্থায় পাবে যে, সেখানে এমন এক মূর্খ সম্প্রদায়ের উপর সূর্য উদিত হয়েছে- যাদের নিকট রোদ থেকে সুরক্ষার কোনও ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ ঐ লোকগুলো জাহির পূজা- বাহ্যিক বিবেচনা এবং সীমালংঘনের রোদে পুড়তে থাকবে। -বারাহীনে আহমদিয়া ৫, রূহানী খাযায়েন ২১/১২১
লক্ষ্য করুন, এ বক্তব্যে মির্যা কাদিয়ানী আয়াতটির ব্যাখ্যায় চারটি দাবি করেছে-
১. যুলকারনাইন দ্বারা উদ্দেশ্য প্রতিশ্রুত মাসীহ (অর্থাৎ তিনি নিজেই)।
২. ‘যুলকারনাইন আরেক পথে চলল’- অর্থ হচ্ছে, প্রতিশ্রুত মাসীহ আরেকটি উপকরণের প্রতি মনোযোগী হল। অর্থাৎ প্রাচ্যের দেশগুলোর মানুষদের অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করল।
৩. ‘যুলকারনাইন একটি জাতির উপর সূর্যোদয় হতে দেখছেন, যাদের রোদ থেকে রক্ষার কোনো অবলম্বন নেই।’ একথার উদ্দেশ্য, প্রতিশ্রুত মাসীহ এমন এক মূর্খ সম্প্রদায়ের উপর সত্যের সূর্য উদিত হতে দেখছে, যাদের জাহির পূজা, বাহ্যিক বিবেচনা ও সীমালংঘনের রোদ থেকে বাঁচার কোনো অবলম্বন নেই।
বলাবাহুল্য, এ সবই মির্যার অসার প্রলাপ। এর কোনোটিই আয়াতের উদ্দেশ্য নয়। নিজ দাবি প্রমাণ করতে কুরআনের আয়াতে এধরনের অদ্ভূত অপব্যাখ্যা আরোপ করা মির্যা সাহেবের মজ্জাগত প্রবণতা। মির্যা কাদিয়ানীর সমস্যা হচ্ছে, কুরআনে কারীমের সর্বত্র তিনি শুধু নিজেকে দেখতে পান। কুরআনের যেখানেই কারো কোনো শ্রেষ্ঠত্ব এবং ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, সেখানেই তিনি নিজের অবয়ব দেখতে পেয়েছেন। আল্লামা ইকবাল যথার্থ বলেছেন-
عصر من پیغمبرے ہم آفرید
آں کہ در قرآں بجز خود را ندید۔
‘আমার যুগ এমন এক পয়গম্বর আবিষ্কার করেছে/ যে কুরআনের ভেতর নিজেকে ছাড়া আর কিছু দেখে না!’
আট. সূরা সাফ্, আয়াত : ৯
هُوَ الَّذِیْۤ اَرْسَلَ رَسُوْلَهٗ بِالْهُدٰی وَ دِیْنِ الْحَقِّ لِیُظْهِرَهٗ عَلَی الدِّیْنِ كُلِّهٖ وَ لَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُوْنَ.
তরজমা : তিনিই তাঁর রাসূলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, তাকে সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী করার জন্য, তা মুশরিকদের জন্য যতই অপ্রীতিকর হোক।
মির্যা কাদিয়ানীর বিকৃতি
মির্যা কাদিয়ানী যেহেতু নিজেকে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্র দ্বিতীয় রূপ এবং হযরত ঈসার দ্বিতীয় রূপ বলে দাবি করেছে, এজন্য কুরআনের যেসব আয়াতে আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং হযরত ঈসা আ.-এর আলোচনা এসেছে, তার মধ্যে মির্যা নিজেকেও প্রতিপাদ্য দাবি করেছে। আলোচ্য আয়াতটি তারই একটি উদাহরণ। মির্যা কাদিয়ানী নিজেকে ঈসা দাবি করার পরই বলেছে, এ আয়াতের প্রতিপাদ্য তিনি নিজে।
اسی براہین میں میرا نام عیسی رکھا گیا تھا اور مجھے خاتم الخلفاء ٹھہرایا گیا تھا اور میری نسبت کہا گیا تھا کہ تو ہی کسر صلیب کرے گا اور مجھے بتلایاگیا تھا کہ تیری خبر قرآن اور حدیث میں موجود ہے اور تو ہی اس آیت کا مصداق ہے کہ هُوَ الَّذِیْۤ اَرْسَلَ رَسُوْلَهٗ بِالْهُدٰی وَ دِیْنِ الْحَقِّ لِیُظْهِرَهٗ عَلَی الدِّیْنِ كُلِّهٖ .
অর্থ : এ বারাহীনেই আমার নাম ঈসা রাখা হয়েছিল। আমাকে খাতামুল খুলাফা (সর্বশেষ খলিফা) আখ্যায়িত করা হয়েছিল এবং আমার সম্পর্কে বলা হয়েছিল যে, তুমিই ক্রুশ চূর্ণ করবে। আমাকে বলা হয়েছিল যে, তোমার সংবাদ কুরআন ও হাদীসে বিদ্যমান রয়েছে। আর তুমিই এ আয়াতের প্রতিপাদ্য-
هُوَ الَّذِیْۤ اَرْسَلَ رَسُوْلَهٗ بِالْهُدٰی وَ دِیْنِ الْحَقِّ لِیُظْهِرَهٗ عَلَی الدِّیْنِ كُلِّهٖ.
দেখুন, তার রচিত ই‘জাযে আহমদী, রূহানী খাযায়েন ১৯/১১৩
অথচ আয়াতটিতে পরিষ্কার আল্লাহ্র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইসলামসহ আগমন সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে।
এভাবে অগণিত আয়াতের অনুবাদ ও তাফসীরে নবী-রাসূলগণের স্থলে নিজেকে প্রতিপাদ্য দাবি, নবীগণের শত্রুর আলোচনায় নিজের শত্রুকে উদ্দেশ্য, নবীগণের ওহী-অবতরণ, শরীয়ত প্রাপ্তি, দাওয়াত-জিহাদ, মু‘জেযা, সান্ত¡না, সুসংবাদ প্রভৃতির স্থানে নিজের কল্পিত দাবি-দাওয়াকে দাঁড় করিয়ে- কখনো সরাসরি, কখনো কাশ্ফ ও স্বপ্নের নাম দিয়ে ইচ্ছেমতো আয়াত থেকে ইঙ্গিত-উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যদ্বাণী নির্মাণ করে করে মির্যা সাহেব তার রচনাবলির পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কালো করে ফেলেছেন। এমনকি কিয়ামতের ধ্বংসলীলা, শবে কদরের ফযীলত, মাকামে ইবরাহীমের সামনে নামায আদায় সংক্রান্ত আয়াতের অর্থেও তিনি নিজের ‘কথিত আবির্ভাব’-এর মর্ম আরোপ করতে ছাড়েননি!
সমস্ত উদাহরণের উল্লেখ এখানে সম্ভব নয়। যে কয়টি দেয়া হয়েছে তা-ও অতি সংক্ষিপ্ত। প্রতিটি উদাহরণ যদি সবিস্তারে আলোকপাত করতে হয় তবে দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন। আমরা শুধু বলতে চাই যে, স্বয়ং ধর্মগুরুই যখন এমন চরম বিকৃতিকারী, যে নিজের পরিকল্পনাকে রূপ দিতে কুরআনে কারীমের শব্দ-মর্মকে খেলনার বস্তু ভেবে নিয়েছে, যেভাবে ইচ্ছা কুরআনের উদ্দেশ্যের মধ্যে নির্মাণ ও খোদাইয়ের স্পর্ধা দেখিয়েছে, তাহলে তার অনুসারীরা কী না করতে পারে!
এমন বিকৃতিপ্রবণ গুরুর ভক্তরা যখন ডজন-ডজন ভাষায় পবিত্র কুরআন অনুবাদে হাত দেবে, তখন সেই অনুবাদের কী দশা হবে? সেইসব অনূদিত কুরআনে কতটুকু প্রকৃত কুরআন থাকবে? বলাবাহুল্য, কাদিয়ানীরা করেছেও তাই। বিশে^র বিভিন্ন ভাষায় তারা কুরআনে কারীমের যেসকল অনুবাদ প্রকাশ করেছে, তার মধ্যে তারা নিজেদের ধর্মগুরুর সকল দাবি-দাওয়া ও কথিত আবির্ভাব সাব্যস্ত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে। কুরআনের পাতায় পাতায় ইসলামের অকাট্য বিশ্বাসসমূহের আলোচনায়, নবী-রাসূলগণের বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনায় তারা এমন সব ভয়াবহ অপব্যাখ্যা করেছে, যা কুরআনের অবয়বকেই পাল্টে দিয়েছে।
তাদের উদ্দেশ্য, মানুষের হাতে এমন এক বিকৃত অনুবাদ তুলে দেওয়া, যা শুধু কাদিয়ানিবাদের কথা বলবে, কাদিয়ানী ধর্মের দাওয়াত দেবে, মির্যা কাদিয়ানীর কথিত নবুওতের প্রচার করবে। সহজভাবে বললে, কাদিয়ানীরা তাদের অনূদিত কুরআন দিয়ে নিজ ধর্মেরই মিশনারী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যেকোনো অমুসলিম সম্প্রদায়ের মিশনারী কার্যক্রমের চেয়ে যা অত্যন্ত প্রতারণা ও ধূর্ততাপূর্ণ। সহজ-সরল মুসলমানরা অজ্ঞতার কারণে বিষয়টি ধরতে পারছেন না। আগামীতে ইনশাআল্লাহ বিভিন্ন ভাষায় কাদিয়ানীদের অনূদিত কুরআন থেকে বিকৃতির কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হবে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)