বাইতুল্লাহর ছায়ায় - ৭
মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আমার ভাই সাঈদ মিছবাহ যখন সউদী আরব ছিলো, আম্মা-আব্বাকে হজ করিয়েছিলো। আম্মার কাছে এক পাকিস্তানী মহিলার ঘটনা শুনেছি। খুব গরীব, তবে খুব সাদা দিল এবং খুব কর্মঠ। বিধবা ও নিঃসন্তান। আল্লাহর ঘর যিয়ারাতের শওক ও তামান্না ছিলো দিলে, কিন্তু তা পূর্ণ হওয়ার কোন ছূরত ছিলো না। দীদারে বাইতুল্লাহর আশিক ঐ বান্দী একদিন নাকি আল্লাহ মিয়াঁকে খুব জোর সে পাকড়াও করলো যে, আমার মত লাচার বেওয়া আওরাতের জন্য তোমার ঘরের দরজা বন্ধ থাকবে, এটা কি ইনছাফ হলো! আওর কাঁহা তক তড়পাওগে বান্দী কো? আব তো বোলাহী লো।
(আর কত তড়পাবে বান্দীকে, ডেকে নাও না এবার!)
ব্যস, আল্লাহ মিয়া শুনে ফেললেন, এলাকায় হজ্বের কাফেলা তৈয়ার হলো, বিধবা কাফেলার আমীর ছাহেবকে গিয়ে ধরলো, মেহেরবানি করে আমাকে নিয়ে নিন, আমি পুরা কাফেলার খানা পাক করে দেবো। আমীর ছাহেব দেখলেন, ভালোই তো! কাফেলার আরাম হবে, বেওয়া আওরাতের হজ্ব হয়ে যাবে! তিনি রাযি হলেন।
আম্মা বলেন, অসম্ভব কর্মঠ ও উদ্যমী মহিলা ছিলো। ষাটজন লোকের রান্না সে একা করতো; আবার নিয়মিত হারাম শরীফে হাযিরা দিতো।
কাফেলার লোকেরা নাকি বিধবার খেদমতে খুশী হয়ে অনেক রিয়াল হাদিয়া দিয়েছিলো।
আল্লাহর কাছে যে চায় এভাবেই পায়, যদি চাওয়ার মধ্যে থাকে সেই তলব ও তড়প যা রহমতের দরিয়ায় জোয়ার ও মউজ পয়দা করে।
বিমান আকাশে উড়ছে, আমি তন্ময় হয়ে আছি আমার ভাব ও ভাবনার জগতে। ছেলে মুহম্মদ, ইচ্ছে করলে কোলে নেয়া যায়, এমন ছোট, তাই তার কৌতূহল অনেক। সে বিমানের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়; অবাক হয়ে মরুভূমি দেখে, সাগর দেখে, আকাশ দেখে, আর মেঘের রাজ্য দেখে।
তার প্রশ্ন হলো, আগে তো বিমান ছিলো না, মানুষ তাহলে কীভাবে আল্লাহর ঘরে যেতো!
বললাম, মরুভূমিতে উটের পিঠে করে, আবার সাগরে পানির জাহাযে করে যেতো! তখন অনেক দিন লাগতো আল্লাহর ঘরে যেতে।
সে বললো, আল্লাহ আমাদের অনেক আরাম দিয়েছেন, না আব্বু!
বললাম, হাঁ বাবা, এখন তো অনেক আরামের সফর। আমরা তো বড় একটা পাখীর পেটের ভিতরে বসে আছি, আর পাখীটা ডানা মেলে মেঘের রাজ্যের উপর দিয়ে উড়ে চলেছে! এজন্য আমাদের অনেক শোকর করা দরকার। তাই চলো আমরা বলি, আল্লাহুম্মা লাকাল হামদু ওয়া লাকাশ-শোকর।
মাগরিব হয় হয়, এমন সময় দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান অবতরণ করলো। বিমানবন্দরীয় আনুষ্ঠানিকতার আগেই আমীরাতের পক্ষ থেকে ইফতারের প্যাকেট বিতরণ করা হলো। প্যাকেট অবয়বে যেমন ছিলো দৃষ্টিনন্দন, অভ্যন্তরে ছিলো তেমনি সমৃদ্ধ। তদুপরি বিতরণে ছিলো সৌজন্য ও আন্তরিকতার ছোঁয়া।
আমার ছেলের ছিলো নফল ইফতার, তবে মাশাআল্লাহ হাত ও মুখের কারুকাজ ছিলো ফরয ইফতারের কাছাকাছি। ঠাণ্ডা জুসটা যে অনেক মজা লেগেছে, মাকে বেশ
আড়ম্বর করে জানালো। তাতে আমার কোন ভাবান্তর
হলো না, কিন্তু মায়েদের না মনে থাকে নিজের ক্ষুধার কথা, না পিপাসার কথা!
পানীয়টা তিনি ছেলের দিকে এগিয়ে দিলেন। ছেলে অবশ্য কিছুতেই নিলো না,
বলে কী, আমি বুঝি খাওয়ার জন্য বলেছি! অর্থাৎ
চক্ষুলজ্জা জিনিসটা আসতে শুরু করেছে; ভালো।
বিরাট জামাতে নামায হলো।
করাচীতে বিমানের যাত্রাবিরতি ছিলো। সেখান থেকেও বাইতুল্লাহর কিছু মুসাফির উঠেছিলো। জামিয়া বিননোরিয়া নিউটাউন-এর একজন আলিম নামায পড়ালেন। মাগরিবের মুখতাছার ক্বিরাত, তবে তার তিলাওয়াত ছিলো বড় মধুর; আরবের লাহজা এবং আজমের দরদ একত্র হলে যেমন হয়! আমার তো হৃদয় এমনই বিগলিত হলো যে ...।
এবার যাত্রা শুরু হলো পবিত্র ভূমি হিজাযের উদ্দেশ্যে। রাত দশটায় বিমান হিজাযের ভূমি স্পর্শ করলো। আমরা সবার শেষে এসে দাঁড়ালাম বিমানের সিঁড়ির পাটাতনে। পবিত্র হিজাযের মৃদুমন্দ ও সুরভিত বাতাস প্রাণভরে গ্রহণ করলাম। আমার স্ত্রী ও মেয়ে একসঙ্গে বলে উঠলো, আলহামদু লিল্লাহ! হৃদয়ের কত গভীর থেকে কত আবেগ-আপ্লুত
কণ্ঠে উচ্চারিত হতে পারে আলহামদু লিল্লাহ তা
আজ আবার অনুভব
করে ধন্য ও কৃতার্থ হলাম। আমিও বললাম, আলহামদু লিল্লাহ!
নাজমুল কারীম ভাইয়ের হাত দুটো বুকের সঙ্গে লাগিয়ে গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বললাম জাযাকাল্লাহ।
মধ্যরাতের দিকে একটি মাইক্রোবাসে করে শুরু হলো নূরের শহর মদীনার উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা।
কত কিছু এখানে লেখার ছিলো! কত কিছু বলার ছিলো! বুকে তড়প ছিলো, দিলে দরদ ছিলো, মুখে দুরূদ ছিলো, আর ছিলো নীরব আকুতি ও মিনতির আশ্চর্য এক আচ্ছন্নতা। ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছিলো, হঠাৎ জেগে উঠে বললো, নবীজীর শহর এসে গেছে আব্বু?
শেষ রাতে যাত্রাবিরতি হলো। গাড়ী থেকে নামতেই অকল্পনীয় এক শৈত্যপ্রবাহ আমাদের স্বাগত জানালো। এ অভিজ্ঞতা জীবনে প্রথম, যাকে বলে জমে বরফ হওয়া, প্রায় তেমন। পরে শুনেছি, জিদ্দা থেকে মদীনার পথে এখানে সবসময় নাকি এরকম শৈত্যপ্রবাহ থাকে। জায়গাটার নাম জানা হয়নি। নাজমুল কারীম ভাই এমনিতেই অসুস্থ। তার উপর গায়ে গরম কাপড় ছিলো না। রীতিমত
কাঁপতে শুরু করলেন। আমার শালটি জোর করে তাকে দিলাম। তাতে আমার
তো শীতে কাবু হয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু আশ্চর্য এক উষ্ণতা যেন আমাকে সজীব করে রাখলো।
এখানে যাত্রীনিবাস-এ যিনি দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি বাংলাদেশী; রাজবাড়ীর মিনহাজুল আবেদীন। তার আন্তরিকতায় আমরা অভিভূত হলাম। আগে এটা স্বাভাবিক ছিলো, যখন বিদেশে প্রবাসে কালেভদ্রে কারো মুখে বাংলা কথা শোনা যেতো; এখন তো প্রায় সব দেশেই বাঙ্গালী ও বাংলাদেশীতে গিজগিজ অবস্থা।
ভাই মিনহাজুল আবেদীনের মেহমানদারিতেই আমাদের সাহরি হলো। সেদিনের ধূমায়িত কফির উষ্ণতা, তার চেয়ে বেশী, ঐ ভাইটির হৃদয়ের উষ্ণতা এখনো আমার মনে আছে। আমাদের বিদায় জানাতে তিনি গাড়ীর দরজা পর্যন্ত এসেছিলেন।
পথেই ফজর হলো। নামাযের জন্য গাড়ী যেখানে থামলো সেখানে মসজিদ আছে, হাম্মাম আছে, যা নেই তা হলো পানি। তখন মনে হলো, এই তো চৌদ্দশ বছর আগের সত্যিকারের হিজায, যার কথা এখন শুধু পড়া যায় কিতাবের পাতায়। পানির অভাবে কখনো তায়াম্মুম করে নামায পড়েছি কি না মনে নেই, হিজাযের ভূমিতে আজ প্রথম পড়লাম। আমার মেয়ে সাফফানা শুধু বাবাকে দেখে নির্দ্বিধায় তায়াম্মুম করলো। অন্যদের মনে অযু ছাড়া নামায পড়ার একটা খুঁতখুঁতি থেকেই গেলো।
আবার যাত্রা শুরু হলো। এখন সবার মুখে শুধু দুরূদের গুঞ্জন। কার মনে আবেগের কী জোয়ার, কী ঢেউ, কী তরঙ্গ তা তো জানেন শুধু তিনি, হৃদয় ও হৃদয়ের আবেগ যার দান, তবে কম্পিত কণ্ঠ থেকে কিছুটা আভাস অবশ্যই পাওয়া যায়।
স্ত্রী আমার পাশেই ছিলেন, কিন্তু তিনি তখন সেখানে ছিলেন না; অন্য জগতে, অন্য কিছুতে বিভোর ছিলেন। সোনার মদীনায় এটাই তার জীবনের প্রথম সফর, কিন্তু হাবীবের দার ও দিয়ার এবং মসজিদে নববীর সুউচ্চ মিনার তিনিই প্রথম দেখতে পেলেন। শিশুর মত উচ্ছল কণ্ঠে বলে উঠলেন, ঐ যে মিনার! ঐ যে মিনার! আমি প্রথমে দেখলাম তার মুখের আনন্দ-উদ্ভাস, তারপর তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম মসজিদের মিনার। দূর থেকে মসজিদে নববীর মিনার অবলোকনের
আনন্দ ও সৌন্দর্য আমার জীবনে এটা প্রথম নয়, কিন্তু সেই মিনারের আলোর প্রতিফলনে কারো মুখের আনন্দ-উদ্ভাস অবলোকনের সৌভাগ্য জীবনে এই প্রথম। এমন ঝলমল মুখমণ্ডল হয়ত আবার ...!
আমরা সবাই দেখলাম মসজিদের মিনার এবং সবার কণ্ঠে একসঙ্গে উচ্চারিত হলো, আলহামদু লিল্লাহ! আল্লাহুম্মা ছাল্লি আলা মুহাম্মাদ ... ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম!
দেখতে দেখতে এসে গেলো ভোরের রাঙ্গা সূর্যের কোমল আলোয় উদ্ভাসিত পেয়ারা হাবীবের পেয়ারা মদীনা। দিনের প্রখর আলোতে আমি মদীনায় প্রবেশ করেছি এবং প্রবেশ করেছি রাতের আলোঝলমল মদীনায়। সে সৌন্দর্যের কোন তুলনা ছিলো না। তবে ভোরের রাঙ্গা সূর্যের কোমল আলোয় উদ্ভাসিত মদীনার সৌন্দর্য ছিলো অন্য রকম এবং অন্য কিছু। যদি জানতে চাও, কেমন সেই অন্য রকম? কেমন সেই অন্য কিছু? আমার কাছে জওয়াব নেই। শুধু বলতে পারি, তোমার হৃদয়ের পূর্বদিগন্তে যদি সূর্যের উদয় ঘটে, আর তার রাঙ্গা-কোমল আলোয় তা উদ্ভাসিত হয়, তাহলে যেমন হবে তোমার হৃদয়ের সৌন্দর্য, ভোরের মদীনার সৌন্দর্য ঠিক তেমনটি।
গাড়ী থামলো, আমরা নামলাম, আমার মেয়ে দেখলাম খালি পা। মদীনার ধূলো তো ধূলো নয়, স্বর্ণরেণু! সেই স্বর্ণরেণু সে হাতে তুলে নিলো, মুখে মাখলো। আমার নিষেধ করা উচিত ছিলো, কিন্তু নিষেধ করা হলো না। নিজেকে বোঝালাম, আমি দেখিনি।
আমাদের থাকার জায়গা হলো মসজিদে নববীর উত্তর দিকে বড় বড় হোটেলগুলোর পরে রিংরোড পার হয়ে দারে তায়বা হোটেলে। নাজমুল কারীম ভাইকে মনে মনে জাযাকাল্লাহ বললাম। সত্যি খুব আরামদায়ক ব্যবস্থা করেছেন তিনি। খুশী হলাম, কারণ সফরে মেয়েদের আরাম ও যত্নের যথাসাধ্য খেয়াল রাখার কথা পেয়ারা হাবীব তাঁর উম্মতকে বলে গেছেন।
প্রয়োজনীয় বিশ্রামের পর গোসল করে নতুন লেবাসে খোশবু মেখে আমরা প্রস্তুত হলাম।
পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যিয়ারাতে যাওয়ার সময় হৃদয় ও আত্মার গভীরে যেমন অভূতপূর্ব একটি আনন্দ থাকে, শান্তি ও প্রশান্তি থাকে, তেমনি থাকে বুকের দুরু দুরু কম্পন এবং মৃদু মৃদু ভয় ও উৎকণ্ঠা!
আনন্দ ও উৎকণ্ঠার সেই মিশ্র অনুভূতি নিয়ে বিসমিল্লাহ বলে রওয়ানা হলাম। যখন মসজিদের চত্বরে প্রবেশ করবো, তখন আমার স্ত্রী একই রকম অনুভূতি প্রকাশ করে বললেন, সত্যি এটা তো জীবনের পরম সৌভাগ্যের মুহূর্ত, কিন্তু ভয় হয়, যদি আদব রক্ষা না হয়!
আমি বললাম, যদি নিজেদের দিকে তাকাই তাহলে তো গোনাহের অন্ধকার এবং বদআমলের গান্দেগি ছাড়া কিছু নেই। তবে আমাদের মাওলা তো রাহীম-রহমান, আর নবীজী হলেন রাহমাতুল লিল আলামীন। আল্লাহর কাছে তাওফীক চাও। তাঁর তাওফীকে সব কিছু সহজ হয়ে যাবে।
পরে আমার স্ত্রী তার সালাম পেশ করার অনুভূতি এভাবে প্রকাশ করেছেন, ভাবীদের সঙ্গে আমি ও সাফফানা রিয়াযুল জান্নায় প্রবেশ করলাম। অদ্ভূত এক প্রশান্তি যেন সমগ্র সত্তাকে আচ্ছন্ন করলো। সব বাহ্য অনুভূতি যেন লোপ পেয়ে গেলো। মনের সব ভয়ভীতি মুহূর্তে যেন মুছে গেলো। জান্নাতে তো কোন ভয়-ভীতি থাকবে না, আর আমরা তো এখন জান্নাতের বাসিন্দা! এমন শান্তি জীবনে আর কখনো অনুভব করিনি। তাহিয়্যাতুল মসজিদ আদায় করার সময় সেই হাদীছটি মনে পড়লো, যদি তুমি আল্লাহকে না দেখো, তবে আল্লাহ তো তোমাকে দেখছেন।
সত্যি তো, আমি আল্লাহকে দেখছি না, কিন্তু আল্লাহ আমাকে দেখছেন! ভিতরে কান্নার ঢেউ উঠলো, আর তা চোখের তীরে এসে আছড়ে পড়তে লাগলো। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে দেখছেন। আমার দুর্বলতা ও কমজোরি, আমার নাজাসাত ও গান্দেগি সব আপনি জানেন। হে আল্লাহ! আমরা তো আসিনি, আপনার দয়া আমাদের এনেছে। হে আল্লাহ, আপনি নিজ কুদরতে আমাদের হিফাযত করুন, আপনার পেয়ারা হাবীবের দরবারে সালাম পেশ করার তাওফীক দান করুন।
মনটা একেবারে শান্ত হয়ে গেলো। আমরা নবীজীর দরবারে সালাম পেশ করলাম। তখন মনে হলো, আমরা যেন এ যুগের এবং বাংলাদেশের মেয়ে নই। আমরা যেন সেযুগের মদীনার মেয়ে! আমরা যেন নবীজীকে চিনি, নবীজী আমাদের চেনেন। মনে হলো, নবীজী আমাদের সালাম শুনেছেন এবং জওয়াব দিয়েছেন। আহ, কী শান্তি! কী প্রশান্তি।
ফিরে আসি আগের কথায়, মেয়েরা গেলো মেয়েদের দরজা দিয়ে, আমরা বাবুস-সালামে এসে পৌঁছলাম। তেমন সমাগম নেই। বাবুস-সালামের সামনে দাঁড়ালে মসজিদের ভিতর দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে গালিচা বিছানো সোজা রাস্তা। উম্মত তার নবীর যিয়ারাতে আসবে, সে জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে যেন গালিচা-সম্বর্ধনা!
উম্মতকে যেন আল্লাহ সসম্মানে নিয়ে যাচ্ছেন পেয়ারা হাবীবের দরবারে সালামের নাযরানা পেশ করার জন্য! হৃদয়ের গভীরে একটি আশ্বাস জেগে উঠলো, নবীজীর দরবারে উম্মতের সালাম অবশ্যই কবুল হবে। নইলে এযুগের গোনাহগার উম্মতির প্রতি কেন এ সম্মাননা!
বুকভরা আশ্বাস নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করলাম। তাহিয়্যাতুল মসজিদ আদায় করে ভক্তি-বিহ্বল হৃদয়ে নাজমুল কারীম, আনওয়ার ও আমি- আমরা তিনজন শামিল হয়ে গেলাম নবীজীর দরবার-অভিমুখী যুগ যুগের সালামি কাফেলায়। একজন, হয়ত মানুষ, কিংবা ফিরেশতা, আমাদের আতর মেখে দিলেন। আমরা পবিত্র না হয়েও পবিত্র এবং সুবাসিত না হয়েও সুবাসিত হয়ে গেলাম। মনে এখন ভয় বা উৎকণ্ঠা নেই, ভিতরে যেন একটি আশ্বাসবাণীর অনুরণন, এসো বান্দা, এসো, আমার পেয়ারা হাবীবের দরবারে। কোন ভয় নেই, আমার ফিরেশতারা ঘিরে রেখেছে।
কী অপূর্ব এক ভাব-গম্ভীর ও শান-সমাহিত পরিবেশ! শুধু দরূদ ও সালামের মৃদু-মধুর গুঞ্জরণ! এত আলো কিসের! এত সুবাস কিসের! যুগে যুগে উম্মতের যত আলোকিত ও সুবাসিত ব্যক্তি এখানে এসেছেন, এ আলো তাঁদের হৃদয়ের, এ সুবাস তাদের ভক্তি-ভালোবাসার! তোমার যদি আলো না থাকে, তাঁদের আলোতে তুমি হতে পারো আলোকিত; তোমার যদি সুবাস না থাকে, তাঁদের সুবাসে তুমি হতে পারো সুবাসিত, শুধু নিয়ত করো উম্মতের যুগ যুগের আলোকিত ও সুবাসিত এই কাফেলায় শামিল থাকার। নযর নীচু রাখো, ইসতিগফার করো, দুরূদ পড়ো, আর ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকো। তোমাকে এগুতে হবে না, নূরানী সত্তারাই তোমাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে!
হাঁ, আমাদের এগিয়ে নেয়া হলো, আমরা অবনত দৃষ্টিতে আদবের সঙ্গে দাঁড়ালাম তাজদারে মদীনা সরওয়ারে কাইনাত ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওযা শরীফের মোকামে-
আছ-ছালাতু আস-সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ! ...
কল্পনা করতে দোষ কী যে, পেয়ারা হাবীব আমাদের সালাম শুনেছেন এবং জওয়াব দিয়েছেন!
তিন বছরের বাচ্চা বাবার সঙ্গে নবীজীর দরবারে সালাম পেশ করে এসে মাকে বলে, আমি সালাম দিয়েছি, আর নবীজী হেসে বলেছেন, ওয়ালাইকুম সালাম, কেমন আছো আফনান!
মাসুম বাচ্চা হয়ত শুনতে পেয়েছে, আমরা শুনতে পাই না, বিশ্বাস তো করতে পারি। হয়ত আল্লাহ বান্দার সুধারণা সত্য করে দেবেন!
ছোট্ট মুহম্মদ মায়ের সঙ্গেই যিয়ারত করেছে। পরের দিন, বলতে যাচ্ছিলাম সে আমার সঙ্গে যিয়ারাত করলো, কিন্তু আসলে বলতে হবে, আমি তার সঙ্গে যিয়ারত করলাম। কেন বলতে হবে, শোনো।
যোহরের পর, হযরত হাফেজ্জী হুযূর (রহ) যেখানে বসতেন এবং তাঁর স্মৃতি স্মরণ করে আমি যেখানে বসি সেখানে বসে আছি, আর ভাবছি, একটু পর ছেলেকে যিয়ারতে নিয়ে যাবো। হঠাৎ ছেলে আমার বলে কী! চলো, আব্বু তোমাকে যিয়ারত করাবো। আল্লাহর শোকর, বুঝতে দেরী হলো না, গায়বের কোন ইশারা আছে, তাই খুশী হয়ে বললাম, আচ্ছা! তুমি আমাকে যিয়ারত করাবে! আলহামদু লিল্লাহ! চলো তাহলে।
ছেলের পিছনে পিছনে চললাম। বাবে সালাম দিয়ে প্রবেশ করলাম। হঠাৎ এমন এক চাপ এলো যে, প্রায় দিশেহারা অবস্থা। ছেলেকে সঙ্গে সঙ্গে কোলে তুলে নিলাম। যিয়ারতে যাওয়ার স্থানটির অর্ধেক অংশ সম্ভবত কোন রাজপুরুষের জন্য ঘেরাও করা হয়েছে।
আমার তখন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, ভাবছি, ছেলেটাকে কী করি! অবস্থা বুঝতে পেরে সে বললো, আব্বু! ঐ জায়গাটা তো খালি ওখানে যাও না! আমি বলতে যাচ্ছি, বাবা, ওখানে যাওয়া যাবে না। এমন সময় একজন নিরাপত্তাকর্মী, আল্লাহ তাকে জাযা দান করুন, আমার কোল থেকে ছেলেকে নিয়ে নিলো এবং আমাকেও টেনে ভেতরে নিয়ে এলো।
এর পর তো খোলা পথ, আমি যেতে চাই ধীরে ধীরে, ছেলে আমাকে টেনে নিয়ে যায় দ্রুত। ছেলেকেই অনুসরণ করলাম। আজকের যিয়ারাতে সেই তো আমার পথপ্রদর্শক! পথপ্রদর্শক যে তাকে তো অনুসরণ করতেই হবে!
মাছুম বাচ্চাকে সবাই আদর করে, আর নবীজীর রওযা শরীফের মুকামে তো ...। সম্ভবত তিনি সউদি রাজপরিবারের কেউ। নিজে সরে গিয়ে ছেলেকে ঠিক স্থানে দাঁড় করিয়ে বললেন, সাল্লিম, সাল্লিম!
ছেলে কিন্তু তার দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ। আমাকেও সঙ্গে টেনে নিয়ে এলো, আর বললো, বলো আব্বু-
আছ-ছালাতু আস-সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ! সেদিন বড় ইতমিনানের সঙ্গে এবং বড় সৌভাগ্যের অনুভূতির সঙ্গে সালাম ও যিয়ারত নছীব হলো। সেই যিয়ারতের কিছু অনুভব-অনুভূতি এখনো মনে আছে। বলতে ইচ্ছে করে, আবার ইচ্ছে করে না। থাক, ইচ্ছে না করাকেই গ্রহণ করি।
আমরা তো গোনাহগার, মাছূম বাচ্চা যদি আমাদের সঙ্গে থাকে, আরো ভালো হয়, যদি আমরা মাছুম বাচ্চার সঙ্গে থাকি, তাহলে আমাদের গোনাহের গান্দেগি তাদের মাছূমিয়াতের খোশবুতে ঢাকা পড়ে যায়, আল্লাহর রহমত তখন...। বৃষ্টির নামাযে মাছুম বাচ্চাদের সঙ্গে নেয়ার কথা আছে না! কী জন্য তা!
আরেকদিন। মসজিদে নববীর জামাতে তারাবীহ পড়ছি। ছেলে পাশে শুয়ে আছে। হঠাৎ তার হাম্মামের খুব জরুরত হলো। আমি জামাত ছেড়ে তাকে কোলে নিয়ে হাম্মামের উদ্দেশ্যে দৌড় দিলাম। সে বললো, আব্বু, তোমার কষ্ট হচ্ছে, আমাকে নামিয়ে দাও। আমি বললাম, বাবা, তুমি মাছূম বাচ্চা, তোমার জন্য এতটুকু কষ্ট করতে পারবো না!
বাচ্চাটা সেদিন আমার জন্য দুআ করেছিলো। কী দুআ করেছিলো বলবো! থাক।
শুধু কামনা করি, আমাদের ছয় বছরের বাচ্চারা ষাট বছরেও যেন এমনই মাছুম থাকে, আমীন। আমরা অনেক সময় বাচ্চাদের কষ্ট বুঝতে পারি না; উল্টো ধমক দিয়ে তাদের কষ্ট আরো বাড়িয়ে দেই। আসলে তাদের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা করেন। যারা দুর্বল, শিশু, নারী ও বৃদ্ধ, বিশেষ করে পথে ও সফরে তাদের আরাম ও সুবিধার খুব খেয়াল রাখা দরকার। তাতে সফরে বে-ইনতিহা খায়র ও বরকত হাছিল হয়। এটা আমাদের পেয়ারা নবীর সুন্নত।
একদিন ফজরের পর মেয়ে বললো, আব্বু আমাকে সবুজ গম্বুজের কাছে নিয়ে চলো। তাকে নিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে কেবলার দিক হয়ে পূর্ব দিকে এসে দাঁড়ালাম। চোখের সামনে এখন সবুজ গম্বুজ। একদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে ছিলো সেই সবুজের দিকে। তাঁর মনে তখন কী ভাব ছিলো, কী আবেগ ছিলো, জানি না, তবে তার সেই আত্মসমাহিত ছবিটি আমার মনে আঁকা হয়ে আছে চিরকালের জন্য।
এই সফরের একটি বড় প্রাপ্তি এই যে, যতদিন মদীনা শরীফে ছিলাম, মেয়েকে সবুজ গম্বুজের কাছে বসিয়ে কোরআন শরীফের কিছু তরজমা পড়ানোর তাওফীক হয়েছে এবং আমি স্পষ্ট অনুভব করেছি যে, পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্যের বরকতে হঠাৎ করেই তার মধ্যে ইলমের তলব ও শওক পয়দা হয়ে গেলো। তার পর থেকে আলহামদু লিল্লাহ শাওক ও তলব বেড়েই চলেছে। আল্লাহ তাআলা ভরপুর কবুল করুন, আমীন।
একদিন ফজরের পর ছেলেকে নিয়ে রিয়াযুল জান্নায় যাওয়ার চেষ্টা করলাম। আশেকীনের এমন হুজূম যে, এককদম আগে বাড়ার উপায় নেই, কিন্তু আল্লাহ আসান করে দিলেন। ছেলেকে বললাম, বাবা! ঐ যে দেখো, ওটা হলো জান্নাতের টুকরো। দুআ করো আল্লাহ যেন ওখানে যাওয়ার তাওফীক দান করেন। জান্নাতের কথা শুনে ছেলে আমার এত খুশী হলো এবং তার এমন আশ্চর্য এক ...!
সেদিন যেন আমি নতুনভাবে উপলদ্ধি করলাম পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই মহান বাণীর তাৎপর্য, প্রতিটি মানবশিশু ফিতরতের উপর জন্ম গ্রহণ করে।
ছেলে আমার বলে কী! দেখো আমি তোমাকে জান্নাতে নিয়ে যাবো। শুনে আমার কান্না এসে গেলো। সন্তানের মুখে একজন বাবা এর চেয়ে মধুর বচন আর কী আকাঙ্ক্ষা করতে পারে!
মানুষের ফাঁক গলে গলে কীভাবে যেন তর তর করে সে রিয়াযুল জান্নায় পৌঁছে গেলো এবং আমাকেও টেনে নিয়ে গেলো, কেউ বাধা তো দিলোই না, হাসি মুখে পথ করে দিলো। আমার বাচ্চা আমাকে রিয়াযুল জান্নায় নিয়ে গেলো। আসলে ছোট যারা তাদের সবচে বড় ছাড়পত্র এই যে, তারা মাছূম ও নিষ্পাপ।
আল্লাহ যেন তাওফীক দান করেন, আখেরাতে সে যেন তার মা-বাবাকে জান্নাতে নিয়ে যেতে পারে, তার আমলের নূর দ্বারা। উম্মাহর সব সন্তানকে আল্লাহ যেন তাওফীক দান করেন; আমরা যেন সেভাবেই তাদের রেখে যেতে পারি দুনিয়াতে; নেক আওলাদের নেক আমল যেন আমাদের নিয়ে যেতে পারে জান্নাতের পথে, আমীন।
আল্লাহর একবান্দা ইশারায় জানতে চাইলো, তোমার ছেলে? আমিও ইশারায় বললাম, হাঁ। তিনি বসার জায়গা করে দিলেন।
আসলে জায়গা ছিলো না, কিন্তু তিনি নিয়ত করেছেন এক মুসলিম ভাইকে, এক মাছুম বাচ্চার বাবাকে ইকরাম করবেন, সেই নিয়তের বরকতে জায়গার মধ্যে বরকত হয়ে গেলো। এমনই হয়। আমাদের দিলে যখন জায়গা হয় তখন না থেকেও জায়গা হয়ে যায়, আল্লাহ বরকত দিয়ে দেন।
রিয়াযুল জান্নায় সেদিন কী যে শান্তি পেয়েছিলাম! এখানে আমার আব্বা এসেছিলেন; আমার জন্য দুআ করেছিলেন। একদিন আমি এসেছিলাম
এবং দুআ করেছিলাম, আমার সন্তান যেন আসতে
পারে। সে দুআ আল্লাহ মেহেরবান কবুল করেছেন। আজ আমার মাছুম বাচ্চা রিয়াযুল জান্নায় বসে আছে আমার পাশে। একদিন সে বড় হবে, ইনশাআল্লাহ আবার সে এখানে আসবে, হয়ত আমি থাকবো না, হয়ত তার পাশে থাকবে তার সন্তান। এভাবেই তো চলছে যুগ যুগের সিলসিলা! ইনশাআল্লাহ এভাবেই আমরা জান্নাতে একত্র হবো। তখন কোন জুদায়ী থাকবে না, বিচ্ছেদ থাকবে না। শুধু শান্তি! অনন্ত কালের শান্তি!
ছেলেকে বললাম, চলো বাবা, এবার আমরা যাই।
ছেলে তো অবাক! জান্নাত থেকে যাবো কেন?
তাই তো, জান্নাত থেকে যাবো কেন! অনেক দিন আগের একটি সুন্দর ছবি মনের পর্দায় ভেসে উঠলো। এখানে এই রিয়াযুল জান্নায় বসে ছিলাম হযরত হাফেজ্জী হুযূর (রহ.)-এর ছোহবতে। তাঁর পাশে এক বাবার কোলে ছিলো ছোট্ট এক শিশু। আমি বলতে পারতাম, যেন একটুকরো চাঁদ! কিন্তু সে ছিলো আরো সুন্দর এবং সুবাসিত! তাই বলতে ইচ্ছে করে, সে ছিলো জান্নাত থেকে ঝরে পড়া একটি ফুল!
ছোট্ট শিশু, কিন্তু কী সুন্দর তার মুখের কথা! হঠাৎ সে বলে উঠলো, বাবা, জান্নাত মেঁ তো ফূল হোতে হ্যাঁয়, ফল হোতে হা্যঁয়, পর ইয়ে সব কাহাঁ? (বাবা, জান্নাতে তো
ফুল হয়, ফল হয়, কিন্তু এগুলো কোথায়?)
আমার মনে আছে, হযরত হাফেজ্জী হুযূর হাসিমুখে শিশুটিকে আদর করেছিলেন এবং দুআ দিয়েছিলেন।
আমার পকেটে ছিলো খেজুর, আমি একটি খেজুর দিয়ে বললাম, এখন এটা খাও, যখন তুমি বড় জান্নাতে যাবে, তখন আল্লাহ তোমাকে অনেক মযাদার ফল দেবেন।
মাসুম বাচ্চা সুন্দর করে মাথা দুলিয়ে বললো, আচ্ছা।
শিশুরা কত সহজে বিশ্বাস করে এবং মেনে নেয়! আমরা যদি এমন সহজ-সরল বিশ্বাস অর্জন করতে পারতাম! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথায় এমন সুন্দর করে বলতে পারতাম, আচ্ছা!
ছাহাবা কেরাম তো এমনই ছিলেন!
জান্নাতি ফুলের মত সেই নিষ্পাপ শিশুটি কোথায় এখন! সেই শিশুর সরলতা কি এখনো আছে তার মধ্যে! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ-নিষেধ শুনে এখন কি সে তার শৈশবের সেই সরলতা নিয়ে বলে, আচ্ছা?
হয়ত তার কোলে এখন আছে তারই মত কোন শিশু! জীবনের চাকা তো এভাবেই ঘুরছে, ঘোরবে; ঘুরতেই থাকবে শেষ দিন পর্যন্ত।
আজ এত বছর পর সেদিনের সেই ছোট্ট শিশুটির কথা মনে পড়লো কেন? কারণ সেও তার বাবাকে অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলো, কিউঁ, হাম জান্নাত সে যায়েঁ কিউঁ? (কেন, আমরা জান্নাত থেকে যাবো কেন?)
সেদিন মনে মনে
বলেছিলাম, আল্লাহ পাক, ছোট্ট শিশুটির এই প্রশ্নের
কী উত্তর হতে পারে তুমিই বুঝিয়ে দাও।
আজ আমার ছেলেকে
বললাম, বাবা, আমরা যদি
উঠে গিয়ে অন্যদের জায়গা দেই তাহলে আল্লাহ
খুশী হবেন এবং আমাদের সেই জান্নাত দান করবেন যেখান থেকে আর কখনো বের
হতে হবে না।
এবং আশ্চর্য! আমার ছেলে মাথা দুলিয়ে বললো, আচ্ছা!
(চলবে ইনশাআল্লাহ)