জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪১   ||   ফেব্রুয়ারি ২০২০

হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক : ‘আশা করি, হালাল-হারামের এই জটিল প্রক্রিয়ায় তারা অগ্রসর হবেন না।’

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

[দুধপান সম্পর্কিত বিবাহের বিধানটি কেবল দুগ্ধপোষ্য শিশু এবং দুধমাতার সন্তানদের মধ্যে সীমিত নয়; বরং তা আরো বিস্তৃত, পুরো বংশ পরম্পরার সাথেই সম্পৃক্ত।

সম্প্রতি ঢাকার মাতুয়াইলে শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। বিষয়টি নিয়ে দ্বীনী মহলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন আপত্তি উঠে আসে। এ পর্যায়ে উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, একশ্রেণীর গণমাধ্যম ও ব্যক্তিবর্গ মিল্ক ব্যাংক-এর পক্ষে নানা রকম ধর্মীয় যুক্তিতর্ক পেশ করেন। আসলে মিল্ক ব্যাংক বিষয়ে শরীয়তের নির্দেশনা কী, মিল্ক ব্যাংকের ঝুঁকি ও বিপদগুলো কী, পৃথিবীর কোনো মুসলিম দেশে মিল্ক ব্যাংক আছে কি না,  মিল্ক ব্যাংক সম্পর্কে বিভিন্ন যুক্তিতর্কের ভিত্তি কতটুকু- এসব বিষয় নিয়ে দীর্ঘ একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা’র রঈস, মাসিক আলকাউসারের সম্পাদক মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন, মারকাযের ইফতা তৃতীয় বর্ষের তালিবুল ইলম- মুহাম্মাদ তাহের বিন মাহমুদ]

 

প্রশ্ন : সম্প্রতি দেশের বহুল আলোচিত একটি বিষয় হল, শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইসিএমএইচ)-এ বাংলাদেশের প্রথম হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক স্থাপন। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বিতর্ক দেখা দিয়েছে। শরীয়তের দৃষ্টিতে এর বৈধতা নিয়ে উলামায়ে কেরাম আপত্তি তুলেছেন। তারা একে হুরমতে রাযাআ তথা দুধ-সম্পর্কীয় আত্মীয়তা সংক্রান্ত শরীয়তের বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করেছেন। ইতিমধ্যে এর কার্যক্রমের উপর স্থগিতাদেশ চেয়ে আইনী নোটিশ পাঠানো হয়েছে। আপনার কাছে জানতে চাই, ফিকহী দৃষ্টিকোণ থেকে আপত্তিটা কতটুকু বাস্তবসম্মত?

# আমরা মনে করি, যারা এ ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়েছেন, আপত্তি করেছেন, তাদের উদ্বেগ ও আপত্তি যথাযথ। যারা কাজটি করার উদ্যোগ নিয়েছেন, তারা প্রথমে এই বিষয়ে উলামায়ে কেরামের কাছ থেকে এর শরয়ী বিধানটা  জেনে নেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু তারা  সেটা করেননি। তা না করেই তারা এটা শুরু করে দিয়েছেন, যা ঠিক হয়নি।

 

প্রশ্ন : তাহলে শরীয়তের দৃষ্টিতে এ ধরনের ব্যাংক প্রতিষ্ঠার বিধান কী?

# আসলে মিল্ক ব্যাংক অর্থাৎ মাতৃদুগ্ধ ব্যাংক বা দুধ সংরক্ষণাগার- যে উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে যে কার্যক্রম পরিচালিত হবে, সেগুলোর সাথে শরীয়তের বেশ কিছু জটিল ও স্পর্শকাতর বিধানের সম্পৃক্ততা রয়েছে। যেমন এখানে একটি বিষয় হচ্ছে, এক মায়ের দুধ অন্য মায়ের সন্তানদের পান করানো হবে। আমরা জানি, এর সাথে حرمة الرضاعة -এর বিষয়টি যুক্ত। যার একটি দিক বিয়ের সাথে সম্পর্কিত। ইসলামী শরীয়তে কাকে বিয়ে করতে পারবে, কাকে বিয়ে করতে পারবে না- সে বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। সূরায়ে নিসায় আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

حُرِّمَتْ عَلَیْكُمْ اُمَّهٰتُكُمْ وَ بَنٰتُكُمْ وَ اَخَوٰتُكُمْ وَ عَمّٰتُكُمْ وَ خٰلٰتُكُمْ وَ بَنٰتُ الْاَخِ وَ بَنٰتُ الْاُخْتِ وَ اُمَّهٰتُكُمُ الّٰتِیْۤ اَرْضَعْنَكُمْ وَ اَخَوٰتُكُمْ مِّنَ الرَّضَاعَةِ وَ اُمَّهٰتُ نِسَآىِٕكُمْ وَ رَبَآىِٕبُكُمُ الّٰتِیْ فِیْ حُجُوْرِكُمْ مِّنْ نِّسَآىِٕكُمُ الّٰتِیْ دَخَلْتُمْ بِهِنَّ ؗ فَاِنْ لَّمْ تَكُوْنُوْا دَخَلْتُمْ بِهِنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَیْكُمْ ؗ وَ حَلَآىِٕلُ اَبْنَآىِٕكُمُ الَّذِیْنَ مِنْ اَصْلَابِكُمْ،  وَ اَنْ تَجْمَعُوْا بَیْنَ الْاُخْتَیْنِ اِلَّا مَا قَدْ سَلَفَ اِنَّ اللهَ كَانَ غَفُوْرًا رَّحِیْمًا.

তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে, তোমাদের মা, তোমাদের মেয়ে, তোমাদের বোন, তোমাদের ফুফু, তোমাদের খালা, ভাতিজী, ভাগ্নি, তোমাদের সেই সকল মা, যারা তোমাদের দুধ পান করিয়েছে, তোমাদের দুধ বোন, তোমাদের স্ত্রীদের মা, তোমাদের প্রতিপালনাধীন সৎ কন্যা, যারা তোমাদের এমন স্ত্রীদের গর্ভজাত, যাদের সাথে তোমরা নিভৃতে মিলিত হয়েছ। তোমরা যদি তাদের সাথে নিভৃত-মিলন না করে থাক (এবং তাদেরকে তালাক দিয়ে দাও বা তাদের মৃত্যু হয়ে যায়) তবে (তাদের কন্যাদের বিবাহ করাতে) তোমাদের কোনো গুনাহ নেই। তোমাদের ঔরসজাত পুত্রদের স্ত্রীগণও তোমাদের জন্য হারাম এবং এটাও হারাম যে, তোমরা দুই বোনকে একত্রে বিবাহ করবে। তবে পূর্বে যা হয়েছে, হয়েছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। -সূরা নিসা (৪) : ২৩

এ আয়াতে যাদের বিয়ে করা হারাম তাদের মৌলিক নামগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীসের কিতাবাদিতেও এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট বিধি-বিধান বর্ণিত আছে। তাফসীরবিদগণ, হাদীসের ভাষ্যকারগণ এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছেন। তো যেসব মহিলা কোনো শিশুকে দুধপান করাবে তাদের ক্ষেত্রেও ঐ শিশুর বিবাহ-সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞার বিধান কার্যকর হবে। কুরআনে কারীমে বলা হয়েছে-

وَ اُمَّهٰتُكُمُ الّٰتِیْۤ اَرْضَعْنَكُمْ.

(তোমাদের সেই সকল মা, যারা তোমাদের দুধ পান করিয়েছে)

আর দুগ্ধদানকারীর সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ হওয়ার বিধানটা কেবল ঐ মহিলা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর দ্বারা তার পরবর্তী বংশধরদের সাথেও ঐ শিশু এবং তার সন্তান, সন্তানের সন্তান... -এর বিবাহ-শাদী হারাম হয়ে যায়।

উপরিউক্ত আয়াত থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। কেননা এখানে দুগ্ধদানকারী মহিলাকে একটি শিশুর মা সাব্যস্ত করা হয়েছে। তারপরও হাদীসে এর আরো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে-

يَحْرُمُ مِنَ الرّضَاعِ مَا يَحْرُمُ مِنَ النّسَبِ.

ঔরসজাত আত্মীয়তার কারণে বা বংশীয় আত্মীয়তার কারণে যা যা হারাম হয়; ‘রাযাআত’ তথা দুগ্ধদানের কারণেও  সেগুলো হারাম হয়ে যায়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৬৪৫

এমনকি দুধ-মায়ের স্বামী (দুধ-পিতা) এবং তার নিকটাত্মীয়দের সাথেও ঐ শিশুর বিবাহ-শাদী জায়েয নয়। হাদীস শরীফে এসেছে-

إِنّهُ عَمّكِ فَلْيَلِجْ عَلَيْكِ.

অর্থাৎ এখানে দুধ পিতার ভাইকে চাচা বলা হয়েছে। (দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৪৪৫)

সুতরাং আমরা বুঝতে পারছি, ইসলামে একটি শিশুকে অন্য মায়ের দুধ খাওয়ানোর সাথে শুধু ঐ শিশুর বিবাহ ঐ মহিলার সাথে নিষিদ্ধ তা-ই নয়; বরং তার পরবর্তী বংশধরদের সাথে, এমনকি তার স্বামী এবং স্বামীর নিকটাত্মীয়দের সাথেও ঐ শিশুর এবং তার সন্তান, সন্তানের সন্তান...-এর বিবাহ-শাদী হারাম হয়ে যাওয়ার মতো বিধান আরোপিত হয়ে যায়। এটি শরীয়তের সুস্পষ্ট একটি বিধান। কারো জন্যই এর খেলাফ করার সুযোগ নেই।

অতএব ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’-এর মাধ্যমে একজন মহিলার দুধ অপর এক অপরিচিত শিশুকে দেওয়ার যে চিন্তা করা হচ্ছে এবং ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে- এর সাথে শরীয়তের এগুরুত্বপূর্ণ মাসআলাটির সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাই এ বিষয়গুলো আগে ভালোভাবে বোঝা উচিত ছিল।

 

প্রশ্ন : হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক-এর উদ্যোক্তারা তো বলছেন যে, তারা ধর্মীয় অনুশাসন মেনেই সব কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। এব্যাপারে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক-এর সমন্বয়ক ডা. মুজিবুর রহমান বলেন-

“ধর্মীয় দিক ঠিক রাখতে প্রত্যেক মায়ের দুধ আলাদা কৌটায় রাখা হবে। বুকের দুধদাতা ও  গ্রহণকারীর নাম ও পরিচয় সংরক্ষণ করা হবে, প্রত্যেকের জন্য আলাদা ডাটা এবং আলাদা আইডি কার্ড রাখা হবে। দাতা ও গ্রহীতা একে-অপরের বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন। বিবাহ বিষয়ে যে অজ্ঞতা ও অস্পষ্টতার কথা বলা হচ্ছে তা এখানে থাকবে না।”

 # হাঁ, আমিও এটা পড়েছি এবং একাধিক ওয়েবসাইটের ভিডিওতে ওখানকার ডাক্তারদের বক্তব্যও শুনেছি। একদিক থেকে তো তাদের সাধুবাদ জানাতে হয় যে, তারা তাদের বুঝমতো অন্তত ধর্মীয় বিষয়টাকে মাথায় রেখেছেন। যতটুকু তারা বুঝেছেন যে, এতটুকু করলে বিষয়টার সমাধান হয়ে যাবে- সে হিসাবে তারা আইডি-ব্যবস্থার কথা চিন্তা  করেছেন অর্থাৎ যে দুধ দান করবে তার একটা পরিচয় এবং যে দুধ পান করাবে তার একটা পরিচয়। একজনকে অন্যজনের পরিচয় দিয়ে দেওয়া- এরকম একটা ব্যবস্থা তারা রেখেছেন। এ থেকে বুঝা যায়, একটি মুসলিম রাষ্ট্রে -এবং তারা নিজেরাও মুসলমান- এই আয়োজন করতে গিয়ে এই বিষয়টা তাদের মাথায় ছিল; যতটুকু তারা বুঝেছেন। এজন্য তারা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে , আসলেও কি এতটুকু করার দ্বারা বিষয়টার সমাধান হয়ে যাবে? তারা ধারণা করে নিয়েছেন, শিশুকে দুগ্ধ দানকারী নারীর পরিচয় ধরিয়ে দিলে এবং নারীটিকে শিশুর পরিচয় দিয়ে দিলেই বিষয়টার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু শরীয়তে হারামের বিষয়টা শুধু এই পর্যন্ত নয়। একটু আগে আমরা হাদীসে দেখেছি, দুধ পান করার মাধ্যমে শুধু শিশুর সাথে ঐ মহিলার দুধের সম্পর্ক হওয়ায় তাদের পরস্পরে বিবাহ কিংবা ঐ মহিলার সন্তানদের সাথে ঐ শিশুর বিবাহ অবৈধ হয়ে যায়- বিষয়টি এ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা আরো অনেক বিস্তৃত। অতএব শুধু তাদের পরস্পরে প্রত্যেকের একটা করে আইডি কার্ড থাকলেই কথা শেষ হয়ে যায় না।

একটি উদাহরণ দিই :  মহিলার দুধ পান করল যে শিশু, ধরে নিই সে বড় হয়েছে। এদিকে ঐ মহিলার শিশুটির সমবয়সী একটা দেবর (স্বামীর ছোট ভাই) আছে। সেও বড় হয়েছে। এখন তাকে ঐ মহিলার স্বামীর ছোট ভাইয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হল। তো স্বামীর এ ভাইটি তো আর এ শিশুটির আইডি রাখে না। ঐ শিশুও জানে না যে, তার সাথে ঐ পুরুষের দুধ-সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু ওদের তো বিবাহ হারাম। মহিলা দুধ দেওয়ার কারণে তার স্বামী এবং স্বামীর নিকটাত্মীয়দের সাথেও বিবাহ হারাম হয়ে গেছে। যেমনটি আমরা একটু আগে হাদীস থেকে দেখিয়েছি যে, হাদীসের মধ্যে দুধ বাবার ভাইকে চাচা বলা হয়েছে। এরকম আরো উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

তাছাড়া তাদের বক্তব্য থেকে তো বোঝা যায় যে, তারা আইডি দেবেন কেবল যে শিশু দুধ খেয়েছে তাকে এবং যে মহিলা দুধ দান করেছেন তাকে। কিন্তু কোনো মহিলার দুধ যদি একাধিক শিশু পান করে তাহলে তাদের পরস্পরেও হুরমত সাব্যস্ত হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে কি তারা দুগ্ধদানকারীর আইডির সাথে প্রতিটি শিশুকে তাদের পরস্পরের একাধিক আইডি কার্ডও সরবরাহ করবেন? আর এত আইডি কার্ড সরবরাহ ও তার যথাযথ সংরক্ষণ কি সম্ভব?

তো এই যে, আইডি দিয়ে যে সমাধানটা দিতে চাওয়া হচ্ছে, এতে কি আসলেই সমাধান হয়ে যাবে?

তাছাড়া এ বিষয়টাও আমাদের বুঝা দরকার যে, এদেশে ধর্মীয় শিক্ষা একেবারেই কম। মানুষের মধ্যে এই তীক্ষè মাসআলা-মাসায়েলগুলো জানাশুনাও কম। আমরা তো এমনও দেখি যে, বংশীয়ভাবে যাদের মধ্যে বিবাহ হারাম- এরকম লোকদের সাথেও কারো কারো বিবাহ হয়ে যায়। এরকম ঘটনা দারুল ইফতাগুলোতে মাঝেমধ্যেই আসে। অথচ বংশীয় সম্পর্কের বিষয়টা তো মানুষের জানাশুনাই থাকে। তবুও প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এরকম কিছু কিছু ঘটনার কথা কখনো কখনো আসে। তো এই যখন আমাদের দেশের মানুষের ধর্মীয় জানাশুনার অবস্থা তখন সেখানে দুগ্ধদানকারী মহিলার একটা আইডি কার্ড শিশুকে ধরিয়ে দিলে এবং মহিলাকে শিশুর পরিচয়টা দিয়ে দিলেই ভবিষ্যতের বিবাহ-শাদীর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে, তা যথাযথভাবে হবে। অপাত্রে ঘটবে না। এমন কথা আসলে বলা যায় না।

সাথে এটাও দেখা দরকার যে, ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’-এর উদ্যোক্তারাও একথা বলেছেন যে, এতীম ও অসহায়, রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া ছিন্নমূল শিশুদের তারা দুধ পান করাবেন। প্রশ্ন হল, এই শিশুদের রক্ষা করার মতোই তো লোক নেই। তো তাদের পক্ষে দুগ্ধদানকারী মায়ের পরিচয় কে সংরক্ষণ করবে? কার্ড ধরিয়ে দিলেই তো আর হবে না, সংরক্ষণটাই আসল।

দ্বিতীয় কথা হল, তারা বলছেন,  আঠারো মাস পর্যন্ত একজন মায়ের দুধ সংরক্ষণ করে রাখা যাবে। মা তো দুধ দান করে চলে গেছেন, এখন কি তিনি আবার আঠারো মাস পর আইডিগুলো নিতে আসবেন? আর যদি একাধিক শিশুকে দুধ পান করানো হয় (আঠারো মাসে বহু শিশু পান করবে) বাস্তবে তাহলে কি উদাহরণস্বরূপ একবার ছয়মাস পর  আবার বারো মাস পর, আবার সতের মাস পর তাদের পরিচয় নিতে তিনি আসবেন? এখানে আরো অনেক বিষয় আছে। তাই এভাবে আইডি দিয়ে এটার সমাধান শুধু কঠিনই নয়; বরং অসম্ভবই বলা যায়।

প্রসঙ্গত আরেকটি বিষয় এখানে বলছি, তা হল,  তারা তো একদিকে বলছেন যে, ধর্মীয় অনুশাসন মেনেই সব কিছু করবেন, আমরা তাদের এ অনুভূতির জন্য সাধুবাদও জানিয়েছি। অন্যদিকে তাদের কেউ কেউ আবার উলামায়ে কেরামের আপত্তিকে ‘ধর্মীয় গুজব’ বলেছেন। শব্দটি খুবই আপত্তিকর। জানি না যিনি বলেছেন, ধর্মীয় বিষয়ে, শরয়ী বিষয়ে তার কী পড়াশোনা আছে? বিষয়টাকে তিনি গুজব কীভাবে বললেন। বাংলায় ভাষায় গুজব কাকে বলে? এটা গুজব নাকি বাস্তবতা। গুজবে তো কেউ কান দেয় না, তিনি কেন কান দিতে গেলেন? আর বাস্তবতা হলে তাকেও কান দিতে হবে, সবাইকেই কান দিতে হবে।

প্রশ্ন : অনেকে বলছেন যে, ইসলামে দুধ ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ হলেও অন্যের দুধ খাওয়া তো নিষিদ্ধ নয়। ’হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ তো আর কোনো ম্যারেজ মিডিয়া নয়, তারা তো কারো সাথে কারো বিবাহ দিয়ে দেয়ার কাজ করে না। হাঁ, পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে দুধ-মা ও ভাই-বোনের বিষয়টি অজানা ও অস্পষ্ট থাকে। যে কারণে  পরবর্তীতে সমস্যা হওয়ার একটা আশংকা থাকে। এক্ষেত্রে মুসলিম দেশ হিসাবে বিষয়টি মেইনটেইন করে নিলেই তো হয়। তাহলে কেন আস্ত মিল্ক ব্যাংককেই নাজায়েয বলা হচ্ছে। আর বর্তমানে আধুনিক যুগে পরিচিতির বিষয়টা মেইনটেইন করা তো আর  কোনো কঠিন কাজ নয়। কম্পিউটারে একটি সফটওয়্যার বানিয়ে নিলেই হয়। যে লগে হিসাব রাখবে, কে কার দুধ খেয়েছে। এই রেকর্ড আর্কাইভড হয়ে থাকবে এবং যখন প্রয়োজন হবে তখন ডাটাবেসে নাম, পিতা-মাতার নাম-ঠিকানা, জন্মতারিখ ইত্যাদি দিয়ে সার্চ দিলেই বেরিয়ে আসবে, কে কার দুধ পান করেছে?

# আমাদের দেশে এ এক জায়গায় সমস্যা নয়; বরং অর্থনীতি বলি, রাজনীতি বলি বিভিন্ন ক্ষেত্রেই একটি সমস্যা হচ্ছে যে, আমরা এক জগতে বাস করি আর বাস্তব ক্ষেত্রে ভিন্ন আরেক জগৎ তথা উন্নত দেশের নীতি ও পদ্ধতি এবং তাদের কথা চিন্তা করে এখানে কাজ করতে চাই। প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কোন্ দেশে বসে এ কথা বলছেন যে, একটা সফটওয়্যার বানিয়ে নিলেই হবে, একটা আর্কাইভড তৈরি করে নিলেই হবে। যেখানে আপনি বলছেনই- এতীম, অসহায়, রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া ছিন্নমূল অভিভাবকহীন পথশিশুকে দুধ পান করাবেন। যেটা এমন এক দেশ, যেখানে আজকেও সাক্ষরতার হার  অনেক কম। এখনো দস্তখতের পরিবর্তে হাতের টিপ নিয়ে বহু কাজ করতে হয়।

সে দেশের মধ্যে একটা আর্কাইভ থাকলে, একটা সফটওয়্যার থাকলেই সমাধান হয়ে যাবে? এই সফটওয়্যার ও আর্কাইভ দ্বারা কারা কারা সুবিধা ভোগ করবে, নিজের বিবাহের আগে খোঁজ নিয়ে এমনটা করবে? এটা অনেকটা অলীক কথা, যা আমাদের দেশের সাথে অন্তত কোনোভাবেই মানানসই নয়।

তাছাড়া পরিচয় সংরক্ষণের জন্য এধরনের সফটওয়্যার বাস্তবে কতটুকু শক্তিশালী মাধ্যম? বিশে^র উন্নত থেকে উন্নততর রাষ্ট্রেও মাঝে-মধ্যেই সফটওয়্যার হ্যাক হয়ে যায়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ডাটা লস হয়ে যায়। তো সেখানে আমাদের মত দেশে এরকম একটা ডাটাবেস বানালে কিংবা একটা সফটওয়্যার তৈরি করলেই সব পরিচয় সংরক্ষিত থেকে যাবে- এটা কতটুকু আস্থা বা বিশ্বাাসযোগ্য কাজ? যে কোনো অভিজ্ঞ ব্যক্তি বা মহলই বুঝতে পারবেন যে, বিষয়টা মুখে বলা যত সহজ কর্মক্ষেত্রে ততটা সহজ নয়।

আরেকটি বিষয়, যদি ধরে নিই যে, আমাদের সমাজের সবাই সু-শিক্ষিত, সবাই আর্কাইভ সংরক্ষণ করে রাখবে, তথাপি আগে আমরা বলে এসেছি যে,   দুধ পান সম্পর্কিত বিবাহের বিধানটি শুধু শিশু এবং ঐ মহিলার সন্তানদের মধ্যে সীমিত নয়; বরং বিষয়টি আরো অনেক বিস্তৃত, প্রসারিত এবং পুরো বংশ-পরম্পরার সাথে স¤পৃক্ত। তো শুধু দুগ্ধদানকারী মা ও দুধ পানকারী শিশুর পরিচয় আর্কাইভড করে রাখলে হবে? অন্যদের বিষয়গুলো কে সংরক্ষণ করবে?

তাছাড়া প্রত্যেককে আইডি কার্ড দেওয়া, আলাদা আলাদা কৌটায় দুধ রাখার যে জটিল প্রক্রিয়ার কথা বলা হচ্ছে, বিড়ালের গলায় সেই ঘণ্টা বাঁধবে কে? কথাগুলো বলা যত সহজ নিয়মিত যথাযথভাবে প্রয়োগ করা ঠিক ততটাই কঠিন। অন্যান্য সেক্টরের মতো আমাদের দেশে চিকিৎসা  ক্ষেত্রে কত ধরনের খামখেয়ালীর কথা আমরা শুনি। একজনের শিশু আরেকজনকে দিয়ে দেয়। আরো কত সব আশ্চর্য ঘটনা। তো যখন এটা ব্যাপক হবে তখন সবাই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এই আইডি প্রদান বা এজাতীয় অন্যান্য কাজ করবে- এর নিশ্চয়তা কী?

আর একথা যে, ‘এটা ম্যারেজ মিডিয়া নয়’ কথা ঠিক আছে। কিন্তু আপনি যখন একটা কাজ করবেন তখন দ্বিতীয়টা আপনার কাঁধে এমনিই বর্তাবে। আপনি বিবাহ দেওয়ার কাজ করছেন না,  সেটা তো আমরাও বলছি। আপনি যদি বিবাহের কাজও সারিয়ে দিতেন তাহলে তো ভাল ছিল। আপনি তো বুঝে শুনেই দিতেন, তার দুধ-আত্মীয়দের মধ্যে দিতেন না। আপনি দায়িত্ব নিচ্ছেন একটার, আর ওটার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যাচ্ছে অন্যটি। এটাও একটা সমস্যা।

প্রশ্ন : শুধু পরবর্তীতে সমস্যা হওয়ার আশংকায় যদি নাজায়েয হয় তাহলে আরবের মধ্যেও তো এই আশংকা ছিল। কেননা তাদের ওখানে তো অন্য মায়ের দুগ্ধপান ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল, দূর-দূরান্ত থেকে এসে অপরিচিত ব্যক্তিরা শিশুদের নিয়ে যেত। তাহলে সেক্ষেত্রেও তো নাজায়েয হওয়ার কথা ছিল। চৌদ্দশ বছরের আগের আরবরা যদি পরিচিতির বিষয়টা মেইনটেইন করতে পারত তাহলে আমরা এ আধুনিক যুগে পারব না কেন?

# হাঁ, আরবদের মধ্যে দুধ পান করানোর বিষয়টি ছিল। রাযাআত-এর পদ্ধতি ছিল বলেই তো রাযাআত সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল এসেছে।

কিন্তু আরবদের পদ্ধতিটা কেমন ছিল? ওখানে মিল্কব্যাংক অর্থাৎ মায়ের দুধের অভাবের কারণে অন্য মহিলার দুধ পান করানোর মত ব্যাপকতা ছিল না। ওখানে সাধারণ যে রেওয়াজ ছিল সেটা হল, শহুরে এলাকায় বিভিন্ন অঞ্চলের লোকেরা থাকে, প্রত্যেকে যার যার মত করে কথা বলে।  যে কারণে শিশুরা জন্মের পরই মিশ্র ভাষা ও মিশ্র সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়ে যায়। এজন্য শিশুরা যেন অরিজিনাল ভাষা এবং অরিজিনাল কালচারের সাথে ছোটকাল থেকেই পরিচিত হয়, সে উদ্দেশ্যেই বিভিন্ন পল্লি এলাকা, যেখানে সভ্যতা-সংস্কৃতি ভাল থাকত এবং ভাষাও বিশুদ্ধ থাকত- অভিজাত পরিবারের শিশুদের  সে এলাকার কোনো মহিলার কাছে দিয়ে আসা হত। যেখানে শিশুটিকে সাধারণত একজন মহিলাই দুধ পান করাতেন। মহিলাটির কাছে ঐ শিশু দীর্ঘ অনেক মাস লালিত-পালিত হত। এর ভেতরে ঐ শিশুর আত্মীয়-স্বজনরা বারবার যাওয়া-আসা করত। তাদের সাথে এদের একটা আত্মীয়তার সম্পর্কের মত হয়ে যেত। হযরত হালিমা রা. সম্পর্কে আমরা সবাই জানি যে, তিনি হলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দুধ মা। মুসলিমমাত্রই এটা অবগত। কীভাবে অবগত? এভাবে অবগত যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বড় হওয়ার পরেও এই সম্পর্কের চর্চা ছিল। তিনি তার দুধ মায়ের খোঁজ-খবর নিতেন। এই ধরনের চর্চা আরবের মধ্যে ব্যাপক ছিল।

তো এখন চিন্তা করুন। এ পদ্ধিতিতে দুধ পান করালে কি আর পরিচয়ের ক্ষেত্রে কোনো অস্পষ্টতা থাকবে?  বিষয়টির চর্চা এমন একটি স্বীকৃত পদ্ধতিতে করা হত, যার দ্বারা উভয় পরিবার পরস্পর সম্পর্কে স্থায়ীভাবে অবগত থাকত।

আরবদের বংশ-পরিচয় সংরক্ষণ-এর ব্যবস্থা- আপনি এখনকার ডাটাবেসের কথা বলছেন- এটার চেয়ে অনেক বেশি পাকা ছিল। যে জাতি তাদের ঘোড়ার বংশ-পরিচয় পর্যন্ত মুখস্থ জানত তারা নিজ শিশুকে দু’বছর দুধ দানকারিনী মহিলার সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবগত থাকবে না এবং পরবর্তীতে তার বংশ-পরিচয় সংরক্ষণে রাখবে না- তা চিন্তাই করা যায় না। সেটার সাথে বর্তমান মিল্ক ব্যাংককে মিলানোর সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। এখানে পদ্ধতিগত কোনো মিল নেই। সেগুলো হঠাৎ বা দু-একবার দুধ পান করানোর মত ঘটনা ছিল না; বরং সাধারণত সেগুলো হত একটি দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার।

সুতরাং এটার সাথে আজকের কোনো অপরিচিত মহিলার দুধ সংরক্ষিত রেখে আরেক অপরিচিত শিশুকে খাওয়ানোর ঘটনাকে মিলানো ঠিক নয়।

 

প্রশ্ন : অনেকেই এখানে মানবিকতার দিকটা খুব বড় করে সামনে নিয়ে আসছেন যে, হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক তো হচ্ছে এতীম, অসহায় ও বিপন্ন শিশুদের জীবন রক্ষার জন্যই। দেশে প্রতি বছর জন্ম দিতে গিয়ে প্রায় ৫ হাজার মায়ের মৃত্যু হয়- তাদের সন্তান; যেসব মায়েরা রোগ-ব্যাধি ও শারীরিক সমস্যার কারণে বাচ্চাকে দুধ পান করাতে অক্ষম তাদের সন্তান, এবং রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া অসহায় শিশুদের জন্য দুধের প্রয়োজনে; মিল্ক ব্যাংক এসব উদ্দেশ্যেই  প্রতিষ্ঠিত। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, মিল্ক ব্যাংকের কারণে ভারতে প্রায় ১৩ হাজার শিশু প্রাণে বেঁচে গিয়েছে। সুতরাং এত বড় ও মহৎ একটি উদ্যোগকে ইসলাম কীভাবে বাধা দিতে পারে?

তারা বলেন, একজন অসুস্থ মায়ের সন্তান বুকের দুধ পাবে, হাজারো এতীম শিশু মৃত্যু থেকে রক্ষা পাবে- এত বড় বিষয়কে হুজুররা তুচ্ছ করে কেন দেখছেন?

# এখানে কোনো কিছুকে তুচ্ছ করে দেখার কিছু নেই। আর মানবিকতার কথা যদি বলা হয় তাহলে ইসলামের বিধি-বিধানের চেয়ে বড় কোনো মানবিকতা আজ পর্যন্ত দুনিয়ার কেউ দেখাতে পারেনি। এবং সত্যিকারের মানবিকতা ও ইনসানিয়্যাত কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে সেগুলোও ইসলাম শিখিয়েছে। আজকে আমরা যখন প্রচলিত মিল্ক ব্যাংক সম্পর্কে মন্তব্য করছি তো সেই বিধানও ইসলাম থেকেই পেয়েছি। ইসলামে অন্যের শিশুকে দুধ দেওয়ার সুযোগ আছে। হাদীসে দুগ্ধদানকারীর ফযিলতের কথা এসেছে, এতে করে মহিলাদের দুগ্ধদানে উৎসাহিত করা হয়েছে। কুরআন মাজীদে, দুগ্ধদানকারী মহিলাকে একটি শিশুর মা সাব্যস্ত করা হয়েছে। এর চেয়ে বড় কথা হল আপনি যদি অসহায়, বিপন্ন শিশুদের দুধ পান করানোর কথা বলেন, তো দুধের কারণে এসব শিশুদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা হলে ইসলাম দুধ দিতে পারেন এমন সামর্থ্যবান নিকটবর্তী মহিলাদের উপর তাদের দুগ্ধদান ওয়াজিব করে দিয়েছে। শরীয়তের দৃষ্টিতে সে তাকে দুধ পান করাতে বাধ্য। ফতোয়ার কিতাবাদিতে বিধানটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোনো আইনে কি এমন নজির রয়েছে? তো ইসলামকে মানবিকতা শেখানোর প্রয়োজন নেই।

এ কাজগুলো এককভাবে করার বিষয়। ইজতেমায়ী তথা যৌথভাবে করা এবং সংরক্ষিত রেখে করার মত  বিষয় নয়। কিন্তু এখানে ইনফেরাদী (ব্যক্তিগত) কাজকে বানিয়ে  ফেলা হচ্ছে,  ইজতেমায়ী তথা সম্মিলিত উদ্যোগে করার মত বিষয়। যার কারণে অন্যান্য নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। যার দরুন অজ্ঞতাবশত অনেক দুধ সম্পর্কীয় আত্মীয়দের মাঝে বিবাহ হওয়ার আশংকা তৈরি হচ্ছে। বিষয়টা যদি ইনফেরাদী থাকত তাহলে উদ্দেশ্যও পূর্ণ হত এবং এসব খারাবীও আসত না।

তো ইসলাম একটা ভালো কাজ করতে গিয়ে আরো কয়েকটি খারাবীর রাস্তা খোলাকে সমর্থন করে না।

আর এখানে যে বিভিন্ন পরিসংখ্যান নিয়ে আসা হয়েছে,  তো এটা তো স্বীকৃত কথা যে, শিশুর একটা নির্ধারিত বয়স (৬ মাস) হয়ে গেলে ডাক্তাররা বলেন যে,  তার মায়ের দুধের বাইরে অন্য খাবার খেতে পারে। এমনকি জন্মের পর থেকেই অনেক শিশুকে  বিকল্প খাবার দেওয়া হয়। বিষয়টা এমন নয় যে, মায়ের দুধ নাই দেখেই ঐ শিশুর মৃত্যু হয়ে গিয়েছে। এমনটা কোনো ডাক্তারকে আমরা বলতে শুনিনি। হাঁ, এটা বলতে পারে যে, মায়ের দুধ বা অন্য কারো দুধ খাইয়ে তাকে বাঁচানো গেছে। ওই দুধ যদি না পাওয়া যেত তাহলে হয়ত তাকে অন্য কোনো বিকল্প খাবার  দেওয়া হত। অবশ্য কোনো জায়গায় যদি এমন অবস্থা তৈরি হয় যে, শিশু মরণাপন্ন এবং দেখা গেল যে, কোনো মহিলা আছে বা কোনো মহিলার দুধ সংরক্ষিত আছে। তাহলে সে ক্ষেত্রে ঐ মহিলা তাকে দুধ দিবে বা ঐ সংরক্ষিত দুধ থেকে তাকে দুধ দেওয়া যাবে এবং তারা পরে পরস্পরে মনে রাখবে- কে কাকে দুধ দিল। কিন্তু এটাকে আনুষ্ঠানিকতার রূপ দিলে ঐসমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে- যেগুলোর কথা আমরা আগেই বলেছি।

আরেকটি বিষয়, ভিডিওতে দেখলাম তারা  দেশে গার্মেন্টেসে কর্মরত নারীদের সন্তানদের প্রসঙ্গও এনেছেন যে, তাদের মধ্যে অনেকে আছেন, যারা তাদের সন্তানদের দুধ পান করাতে পারে না। তারাও  এ মিল্ক ব্যাংকে নিজেদের দুধ জমা রাখতে পারবেন। কথাটি শুনে বড় অবাক লাগল, যে মা নিজের সন্তানকে দুধ দিতে পারেনি, যে তার সন্তানকে দুধ দেওয়ার মত সময় পায় না,  সে মিল্ক ব্যাংকে দুধ দিবে কখন? যে মায়েদের দুধ আছে, তারাই যেখানে নিজেদের শিশুদের দুধ পান করায় না ঠিকমতো। সেখানে আমরা ঐ মায়েদের দুধ নিয়ে অন্যের শিশুদের দেওয়ার চিন্তা করছি। এটা কতটুকু যুক্তির কথা?

এটার জন্য বরং ঐ পদ্ধতি রাখা কি উচিত নয় যে,  কর্মজীবি মায়েদের শিশুদেরকে কর্মস্থলে রাখার ব্যবস্থা রাখা হবে। চাইল্ড কেয়ারের আয়োজন থাকবে। মা ওখানে গিয়ে শিশুকে ফাঁকে ফাঁকে দুধপান করিয়ে আসবে।

আমরা আগে সমস্যা তৈরি করে পরে উল্টো পথে তার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করি।

সদ্য সন্তান প্রসবকারিণী মা সে তার সন্তানকে আগে দেখবে, না তার কর্মকে আগে দেখবে? কেন এমন সমাজ বিনির্মাণ করেছি, যেখানে মহিলা তার শিশুকে  দেখার সুযোগ পায় না- দুমুঠো ভাতের জন্য, রুটি রোজগারের জন্য। কেন সমাজটা এমন হয়ে গিয়েছে? সমাজটা কী এমন হওয়া উচিত ছিল না যে, মহিলাকে যদি কর্মজীবী হতেই হয় তাহলে  তার বাচ্চা হওয়ার পর তাকে দুধ পান করানোর মত সময় দেওয়া। হয়ত তাকে বেতনসহ দু বছরের ছুটি দিয়ে দেওয়া বা তাকে দিনের উল্লেখযোগ্য সময় শিশুর পরিচর্যার জন্য সময় দেওয়া। অন্যের ডিউটি যদি হয় আট ঘণ্টা তাহলে এ সময়ে তার ডিউটি হবে চার ঘণ্টা। আর চার ঘণ্টা সময় সে তার শিশুর পরিচর্যা করবে। সমাজটা একে তো হয়ে গেছে একেবারে বস্তুবাদী,  আরেকদিক থেকে হয়ে গেছে নিষ্ঠুর। না বাবা-মায়েরা নিজের সন্তানকে প্রধান্য দিচ্ছে, না তাদের নিয়োগদাতারা প্রধান্য দিচ্ছে। সমস্যাগুলো আমরা নিজে তৈরি করে অবাস্তব সমাধান খুঁজতে থাকি। তো সমস্যার গোঁড়ায় হাত দেওয়া দরকার, মাঝখানে নয়।

এছাড়া মিল্ক ব্যাংক এসব সমস্যা সমাধানে কতটুকু কার্যকর হবে তাও দেখতে হবে? বিশ্বাব্যাপী এর ইতিবাচক ফলাফল কতটুকু?  যদি এটা বাস্তবে  তেমন কোনো বড় কাজ হত তাহলে প্রতিটা দেশে শত শত ব্যাংক থাকত। ব্লাড ব্যাংকের মতো প্রতিটি বড় হাসপাতালে এর একেকটি ইউনিট থাকত। কিন্তু বিশ্বব্যাপী এর ব্যবহারের প্রতি তেমন আগ্রহের কথা শোনা যায়নি। শুধু মুসলিম বিশ্বে এটা নাই বা কম  এমনটা নয়; বরং মুসলিম দেশগুলোর বাইরে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতেও এর ব্যবহার বা আয়োজন খুবই সীমিত।

বিভিন্ন পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী,  ব্রাজিলকে বাদ দিলে পুরো বিশে^ এর সংখ্যা মাত্র তিনশ’র চেয়ে কিছু বেশি। অথচ মিল্ক ব্যাংক তো আজকের কথা নয় প্রায় একশ বছর আগে এর ধ্যান-ধারণা দুনিয়াতে এসেছে। যেভাবে এর প্রয়োজনীয়তার কথা প্রচার করা হচ্ছে, সে হিসাবে তো একেকটা দেশেই ৩০০-এর চেয়ে বেশি মিল্ক ব্যাংক হওয়ার কথা ছিল। এ থেকে কি বোঝা যায় না যে, পৃথিবীব্যাপী এর আগ্রহ কতটুকু?

সাথে সাথে এটাও মনে রাখতে হবে যে, এগুলোতে তো অনেক মারত্মক স্বাস্থ্য-ঝুঁকি রয়েছে। ধরে নিলাম আজকে যারা করছেন তারা একে জীবানুমুক্ত এবং সবধরনের স্বাস্থ্য-ঝুঁকি মুক্ত করে সংগ্রহ করবেন। কিন্তু যখন এটা ব্যাপকতা লাভ করে চারদিকে বিভিন্ন ইনিস্টিটিউট, বিভিন্ন হাসপাতালে এটা হবে তখন এটা কতটুকু নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত থাকবে? এই নিশ্চিয়তা কে দেবে? ডোনার কে, সে  ঐওঠ বা এজাতীয় অন্য কোনো সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত কি না? কতটা স্বচ্ছতা ও পরিচ্ছন্নতার সাথে তা গ্রহণ ও বিতরণ করা হবে? ঘটনা এরকম হয়ে না যায় যে, এখন যেমন পেশাদার রক্তদাতার কথা আমরা শুনি, যারা নিয়মিত রক্ত বিক্রি করে চলে, তো মিল্কের ক্ষেত্রেও  পেশাদার দুধ বিক্রিকারিনী তৈরি হবে না- এ নিশ্চয়তা কে দেবে?

এ বিষয়টাকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। আমাদের দেশে এসব কারণে এজাতীয় প্রতিষ্ঠানের উপর মানুষ আস্থা রাখতে পারে না। খুব ঠেকায় না পড়লে মানুষ এসব ব্যাংক থেকে সাধারণত রক্ত নেয় না। নিজেরা সামাজিকভাবেই এর ব্যবস্থা করে থাকে। হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক-এর ক্ষেত্রেও এমনটি হবে না- এর কী নিশ্চয়তা? তো ব্যাংক করলেন কিন্তু মানুষ অনাস্থার কারণে এ থেকে নিল না- তখন এর দ্বারা কী ফায়দা?

 

প্রশ্ন : আইসিএমএইচ কর্তৃপক্ষ এও বলেছেন যে, তাদের নিয়মানুযায়ী একজন মেয়ে শিশুর মা একজন কেবল মেয়ে শিশুকে এবং ছেলে শিশুর মা ছেলে শিশুকেই  দুধ দান করবে। তো তাদের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিবাহের বিষয়টা থাকছে না। এমনটি হলে তখন কি জায়েয হতে পারে?

# এ ব্যাপারে প্রথম কথা হল,  তারা আগে বলেছেন, এটা আঠারো মাস পর্যন্ত থাকবে। তো দুগ্ধদানের এতদিন পর তারা ছেলে শিশুর মায়ের দুধ কেবল ছেলে শিশুকে এবং মেয়ে শিশুর মায়ের দুধ কেবল মেয়ে শিশুকে দেওয়ার বিষয়টা কতটুকু নিশ্চিত করতে পারবেন?

দ্বিতীয় কথা হল, আমরা আগেই ‘রাযাআত’-এর ব্যাপক প্রভাবের বিষয়টা উল্লেখ করেছি, বংশীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেভাবে উপর-নীচ তথা বাবা, দাদা, নানা, ছেলে, নাতি, পুতি হারাম হয়, রাযাআতের ক্ষেত্রেও একই রকম। মহিলার উপর-নিচ এমনকি মহিলার স্বামীর উপর-নীচও শিশুর জন্য হারাম হয়ে যায়। সবার সাথেই তো হারামের সম্পর্কটা গিয়ে লাগবে। শুধু ছেলে আর মেয়ের বিষয়টি খেয়াল করলেই তো সব বিষয়ের সমাধান হয়ে যাবে না। সম্পর্কটা তো আরো অনেক বিস্তৃত।

পূর্বের উদাহরণটাই একটু দেখুন, মহিলার দুধ পান করল যে শিশুটি, ধরে নিই সে বড় হয়েছে, এদিকে ঐ মহিলার শিশুটির সমবয়সী এক দেবর (স্বামীর ছোট ভাই) আছে। সেও বড় হয়েছে। এখন শিশুটির ঐ মহিলার স্বামীর ছোট ভাইয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব হয়। ওদের তো বিবাহ হারাম। মহিলা দুধ দেওয়ার কারণে তার স্বামী এবং স্বামীর নিকটাত্মীয়দের সাথেও বিবাহ হারাম হয়ে গেছে। তো শুধু ছেলে আর মেয়ের বিষয়টি খেয়াল করলেই তো সব বিষয়ের সমাধান হয়ে যাবে না।

আর এর চেয়েও বড় কথা হল, যে মহিলা দুধ দান করার সময় ছেলের মা, তার কি পরে মেয়ে হতে পারে না?

 

প্রশ্ন : হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক আপাতত সাধারণ শিশুদের জন্য উন্মুক্ত নয়; বরং যেসব শিশু মায়ের দুধ না পেলে মারা যাবে, কেবল তাদের জন্যই। শরীয়তে তো ইজতেরারী হালত বলতে একটি কথা আছে। ইসলামে তো প্রাণ বাঁচানোর জন্য মৃত পশুও খাওয়ার অনুমতি আছে। তো এই জরুরি অবস্থায়ও কী মিল্ক ব্যাংক জায়েয হবে না?

# আমরা আগেই বলেছি যে, এখানে ব্যাংকের প্রশ্ন নয়, প্রাণ রক্ষা করার প্রশ্ন? আগে একটি উদাহরণ দিয়েছিলাম যে, কোনো একটা শিশু এমন অবস্থায় আছে যে, তাকে দুধ না দিলে তার জীবনের ঝুঁকি হতে পারে অথচ তার মা নাই। তাহলে সেক্ষেত্রে দুধ আছে, এমন কোনো মহিলা পাশে থাকলে তাকে দুধ পান করাবে। যদি কোনো জায়গায় দুধ সংরক্ষিত থাকে তাহলে সেই দুধও পান করাবে। এটার সাথে ব্যাংক স্থাপনের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা মানবিক বিষয়। আর কোনো সমাজই দুধ দানকারী মহিলা থেকে খালি থাকে না। যে সমাজে শিশু আছে সে সমাজে মা-ও আছে। এমন মরণাপন্ন শিশুর জন্য সে সমাজে কোনো না কোনো মা খোঁজ করে পাওয়া যাবে। এমনিতে না পেলে এর জন্য কোনো মহিলাকে টাকার বিনিময়েও নেয়া যাবে। সে সুযোগও শরীয়তে আছে।

 

প্রশ্ন : কেউ কেউ বলছেন, অনেক মুসলিম দেশ যেমন ইরাক, ইরান, কুয়েত, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তান-এ হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক রয়েছে। এটা যদি বড় ধরনের নাজায়েয হত তাহলে কি এসব মুসলিম দেশে তা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হত? তো তারা যদি শরয়ী নীতির ভেতরে থেকেই হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক করতে পারে তাহলে আমরা পারব না কেন?

#  প্রথমত : এ দাবি কতটুকু বাস্তবসম্মত তা যাচাই করা দরকার। ওয়েব সাইটগুলোতে সম্ভাব্য খোঁজাখুজির পর ইরান ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্রে তো এ পদ্ধতির ব্যাপকতার কথা শোনা যায়নি। ইরান তো ‘শীয়া’ নীতি অনুসরণ করে। সাধারণ মুসলমানদের সাথে তাদের মিল নেই।

এছাড়া কোনো মুসলিম দেশে একটা কিছু হলেই তা তো ইসলামসম্মত বলে ধরে নেয়া যায় না। তারা কাজটি শরয়ী নীতিমালা মেনে করেছেন  কি না- তাও তো দেখতে হবে। আমরা তো বরং উল্টো চিত্র দেখছি। ওআইসি ফিকহ একাডেমী, যেখানে বিশে^র বহু দেশের বড় বড় ফকীহগণ রয়েছেন, তারা তো এটিকে শরীয়ত-বিরুদ্ধ বলে রায় দিয়েছেন। কুয়েতে এ নিয়ে সম্মিলিত গবেষণা হয়েছে। সেখানে উলামায়ে কেরাম ও বিজ্ঞজনেরা মিল্ক ব্যাংকের বিপক্ষে বলেছেন। এছাড়া ২০১১ সালের ১৫-১৭ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার জাতীয় ফতোয়া কমিটির ৯৭ তম বৈঠকে  এ বিষয়ে নাজায়েয ফতোয়া এসেছে। পাকিস্তানের অন্যতম শীর্ষ আলেম জাস্টিস মুফতী তাকী উসমানীকে বাংলাদেশে এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি এক অডিও বার্তায় বলেছেন যে, তা কোনোভাবেই জায়েয নয়। এ ব্যাংক চালু হলে নানান ফেতনা সৃষ্টি হবে।

 

প্রশ্ন : মিল্ক ব্যাংক সম্পর্কে আলেমদের কোনো সুনির্দিষ্ট তাহকীক-গবেষণা হয়েছে কি না? অনেকে বলে থাকেন  যে, বিশিষ্ট আলেম আল্লামা ইউছুফ কারযাভী এবং মুস্তফা যারকাসহ কেউ কেউ নাকি এটাকে জায়েয বলেছেন? এ বিষয়ে যদি কিছু বলতেন।

# এই বিষয়ে গবেষণা হয়েছে অনেক আগেই। আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে ১৯৮৩ সনে কুয়েতে এটা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়, দীর্ঘ সেমিনার হয়। সেখানে বড় বড় বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা ছিলেন, বিজ্ঞানীরা ছিলেন, তারা তাদের মতামত দিয়েছেন। বড় বড় ফকীহরা ছিলেন। তারা প্রবন্ধ-নিবন্ধ উপস্থাপন করেছেন।

এরপর ১৯৮৫ সনে ওআইসি ফিক্হ একাডেমিতে এ বিষয়ক সেমিনার হয়েছে। সেই সেমিনারেও বিশ্বের বড় বড় আলেমরা অংশগ্রহণ করেছেন। সেখানেও বিভিন্নজনের লিখিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা জায়েয নয়। নিম্নে ঐ সেমিনারের প্রবন্ধগুলো ও সেগুলোর পর্যালোচনার সারমর্ম ও সেমিনারের সিদ্ধান্ত ওআইসি ফিকহ একাডেমীর জার্নাল مجلة مجمع الفقه الإسلامي থেকে তুলে ধরা হল-

بسم الله الرحمن الرحيم

الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على سيدنا محمد خاتم النبيين وعلى آله وصحبه.

قرار رقم ، بشأن بنوك الحليب، أما بعد  :

فإن مجلس مجمع الفقه الإسلامي المنبثق عن منظمة المؤتمر الإسلامي في دورة انعقاد مؤتمره الثاني بجدة من ১০ - ১৯ ربيع الثاني ১৪০৬ هـ/ ২২ - ২৮ ديسمبر ১৯৮৫م.

بعد أن عرض على المجمع دراسة فقهية، ودراسة طبية حول بنوك الحليب .

وبعد التأمل فيما جاء في الدراستين ومناقشة كل منهما مناقشة مستفيضة شملت مختلف جوانب الموضوع تبين  :

 ১. أن بنوك الحليب تجربة قامت بها الأمم الغربية. ثم ظهرت مع التجربة بعض السلبيات الفنية والعلمية فيها، فانكمشت وقل الاهتمام بها.

২. أن الإسلام يعتبر الرضاع لحمة كلحمة النسب يحرم به ما يحرم من النسب بإجماع المسلمين. ومن مقاصد الشريعة الكلية المحافظة على النسب، وبنوك الحليب مؤدية إلى الاختلاط أو الريبة.

৩. أن العلاقات الاجتماعية في العالم الإسلامي توفر للمولود الخداج أو ناقصي الوزن أو المحتاج إلى اللبن البشري في الحالات الخاصة ما يحتاج إليه من الاسترضاع الطبيعي، الأمر الذي يغني عن بنوك الحليب .

وبناء على ذلك قرر :

أولا : منع إنشاء بنوك حليب الأمهات في العالم الإسلامي.

ثانيا : حرمة الرضاع منها.

 

তরজমা  :

হামদ ও ছানার পর :

রেজুলেশন-০৬

প্রসঙ্গ : মিল্ক-ব্যাংক

১০-১৯ রবীউস সানী ১৪০৬ হি. মোতাবেক ২২-২৮ ডিসেম্বর ১৯৮৫ ঈ. তারিখে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ইসলামিক ফিকহ একাডেমীর দ্বিতীয় সেমিনারে মিল্ক-ব্যাংক প্রসঙ্গে ফিকহী ও মেডিক্যাল-গবেষণা প্রবন্ধমালা উপস্থাপিত হয়। উভয় দিকের গবেষণা-প্রবন্ধসমূহের পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা ও বিস্তৃত বিচার-বিশ্লেষণের পর যা স্পষ্ট হয়ে সামনে আসে তা হচ্ছে :

এক. মিল্ক-ব্যাংক এমন একটি তত্ত্ব, যার পরীক্ষা-নিরীক্ষা পশ্চিমা বিশ্ব করেছে। ওখানে এ কারণে সাইন্টিফিক ও  টেকনিক্যাল বিভিন্ন জটিলতা তৈরি হওয়ায় ঐ দেশগুলোতেও এ ব্যাপারে উৎসাহ হ্রাস পেয়েছে।

দুই. ইসলামে দুধ-সম্পর্ক বংশীয় সম্পর্কের মতোই। মুসলিম মনীষীদের ঐকমত্য অনুসারে বংশীয় সম্পর্কের দ্বারা যা হারাম হয়, দুধ সম্পর্কের দ্বারাও তা হারাম হয়।

আর বংশ সম্পর্ক-সংরক্ষণ ইসলামী শরীয়ার প্রধান মূলনীতিসমূহের অন্যতম। মিল্ক-ব্যাংক তত্ত্বের প্রয়োগ এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে জটিলতা ও সংশয় তৈরি করে।

তিন. মুসলিম-বিশে^র পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক-কাঠামোই এমন যে, তা বিশেষ ক্ষেত্রসমূহে স্বাভাবিক পন্থায় দুধ-মায়ের মাধ্যমেই প্রি-ম্যাচিউর শিশু, কিংবা অসুস্থ ও মাতৃদুগ্ধের মুখাপেক্ষী শিশুর মাতৃদুগ্ধের প্রয়োজন পূরণে সক্ষম। কাজেই মুসলিম-সমাজে মিল্ক ব্যাংক কনসেপ্টটি অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক।

অতএব :

১. মুসলিম বিশে^ মিল্ক-ব্যাংক প্রতিষ্ঠা নিষিদ্ধ।

২. মিল্ক ব্যাংক থেকে দুধ পান করানো হারাম।

 

২০১১ সালের ১৫-১৭ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার জাতীয় ফতোয়া কমিটির ৯৭ তম বৈঠকে একই সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এসব সম্মিলিত গবেষণা ছাড়াও অনেক আলেম ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ ব্যাপারে গবেষণা করেছেন, স্বতন্ত্র প্রবন্ধ-নিবন্ধ, কিতাবাদি লিখেছেন। আপনি খোঁজ করলে এ ব্যাপারে উর্দূ-আরবী বহু স্বতন্ত্র প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও কিতাবাদি পেয়ে যাবেন।

উপরিউক্ত সেমিনারগুলোতে দু-একজন গবেষক মিল্ক ব্যাংকের পক্ষেও মতামত দিয়েছেন। কিন্তু ব্যাপকভাবে আলেমরা নাজায়েয হওয়ার মত দিয়েছেন। এর পক্ষে মত দেওয়া লোকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম হচ্ছে, ড. ইউছুফ আলকারযাভী সাহেব। তিনি যতটুকু না শরীয়তের দলীল পেশ করেছেন, তার চেয়ে বেশি মানবিকতাকে দেখাতে চেয়েছেন। তিনি ইসলামের প্রসিদ্ধ চার মাজহাবের বাইরে গিয়ে একটি শায (বিচ্ছিন্ন) মত দিয়ে দলীল দিয়েছেন। যাতে বলা হয়েছে, স্তনের সাথে মুখ না লাগিয়ে যদি দুধ পান করা হয় তাহলে সেটা দ্বারা দুগ্ধ-সম্পর্ক স্থাপিত হয় না এবং হারামও হয় না। এই কথা উক্ত সেমিনারেই অনান্য আলেমরা স্পষ্টভাবে খ-ন করেছেন এবং এটা খ-ন করার জন্য অন্যান্য দলীলের পাশাপাশি এই হাদীসও পেশ করেছেন-

إِنّ امْرَأَةَ أَبِي حُذَيْفَةَ قَالَتْ: يَا رَسُولَ اللهِ، إِنّ سَالِمًا يَدْخُلُ عَلَيّ وَهُوَ رَجُلٌ، وَفِي نَفْسِ أَبِي حُذَيْفَةَ مِنْهُ شَيْءٌ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: أَرْضِعِيهِ حَتّى يَدْخُلَ عَلَيْكِ. (صحيح مسلم، ১৪৫৩)

এ হাদীস দ্বারাও উপস্থিত অনেক আলেম শায়েখ কারযাভী সাহেবের মতের খ-ন করেছেন।

আর শায়েখ মুস্তফা যারকা কিন্তু মিল্ক ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তাকেই স্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন, এটির কোনো দরকার নেই, তবে এমন কিছু হয়ে গেলে সে দুধ কেউ পান করলে তা দ্বারা ‘রাযাআত’-এর হুকুম আসবে না। তাঁর একথাও সেমিনারে গৃহীত হয়নি।

তো যেটা আমরা বলতে চাই সেটা হল, ইসলামকে এসব বিষয়ে পশ্চাৎপদ ভাবা কিংবা এধরনের উদ্যোগের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যক্তিত্বরা চোখ বন্ধ করে বিরোধিতা করেন- এই ধারণা পোষণ করা কিছুতেই উচিত নয়। যারা এবিষয়ে খোঁজ-খবর রাখেন তারা জানবেন যে, এধরনের যে কোনো বিষয়, যেগুলোর সাথে শরীয়তের সম্পৃক্ততা রয়েছে- আলেমরা সময়ে সময়ে এগুলো নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং করছেন। অনেক বিষয়ে দেখা যায় যে, আলেমরা আগে সতর্ক করেন, পরে অন্যদের খবর হয়। মিল্ক ব্যাংক এখন আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হচ্ছে, অথচ এ বিষয়ে আলেমগণ কয়েক দশক আগেই তাদের মতামত দিয়ে দিয়েছেন।

 

প্রশ্ন : ইউছুফ কারযাভী সাহেবের মূল যুক্তিটা তো হুজুর বললেন । এছাড়াও তিনি আরেকটি যুক্তি দিয়েছেন। সেটা হচ্ছে, হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের মাধ্যমে, হুরমতে রাযাআত এর ক্ষেত্রে কেবল শক (সন্দেহ) তৈরি হয়, ইয়াকীন তথা নিশ্চিতভাবে হুরমত প্রমাণিত হয় না। কেননা মিল্ক ব্যাংকে বহু মহিলার দুধ একত্রে মিশ্রিত থাকে। তাই কোন্ মহিলা দুধ পান করিয়েছে, কতটুকু দুধ পান করিয়েছে, দুই মহিলার মিশ্রিত দুধ হলে কার পরিমাণ বেশি, কার কম এসব বিষয়ের কোনো কিছুই নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। আর এরকম শক-সন্দেহের কারণে হুরমত প্রমাণিত হয় না। তার একথাটিকে কেউ কেউ খুব শক্তিশালী যুক্তি বলে উল্লেখ করেছেন। কেননা শুধু শকের কারণে যে হুরমত প্রমাণিত হয় না- এ ব্যাপারে চার ইমামই একমত। হুজুর এটাকে কীভাবে দেখছেন, ফিক্হী দৃষ্টিকোণ থেকে এটা কি কোনো মজবুত কথা?

# আমরা শায়েখ কারযাভীর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, -অন্য অনেকেও তাঁর এ কথার জবাব দিয়েছেন- তিনি এখানে দুটি বিষয়কে গুলিয়ে ফেলেছেন। আসলে বিষয়টা হচ্ছে, একটা হল সন্দেহ সৃষ্টি হওয়া, আর অন্যটি হল সন্দেহ তৈরি করা। তিনি যে পদ্ধতি দিতে চেয়েছেন, এটা হল সন্দেহ তৈরি করা। কয়েকজনের দুধ মিশ্রিত করে প্রথমে, সন্দেহ তৈরি করে ফেল এরপর شك তথা সন্দেহের হুকুম প্রয়োগ কর। শরীয়তে আলোচিত সন্দেহের অর্থ কি এটা?  সন্দেহের মাসআলাগুলো কি শরীয়তে এই কারণে এসেছে?

ইসলামের একটা মৌলিক বিধান হল, কোনো বিষয়ে যদি হালাল ও হারামের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে হারামকে প্রাধান্য দিতে হয়। আপনার সামনে একটি গ্লাস আছে, গ্লাসের মধ্যে যে পানি আছে, একজন বলছে, তাতে কিছু নাপাকী পড়েছে, আরেকজন বলছে না পড়েনি। তাহলে যে বলেছে, নাপাকী পড়েছে আপনি সেটাকে প্রাধান্য দেবেন।

এছাড়া সন্দেহের ভিত্তিতে যে হুরমত প্রমাণিত হয় না সেটা তো কাযী তথা বিচারকের আমলের জন্য। আদালতে অর্থাৎ মামলা দায়ের হলে তখন কাযী সাহেব শক-সন্দেহের ভিত্তিতে রায় দিতে পারবেন না। কিন্তু যখন নিজের মধ্যে হালাল-হারামের ব্যাপারে সন্দেহ হবে এবং সন্দেহের কোন মজবুত ভিত্তি থাকবে তখন তাকে সতর্কতার খাতিরে হারামটাকেই প্রাধান্য দিতে হবে।

আর আমাদের দেশের যারা মিল্ক ব্যাংকের উদ্যোগ নিয়েছেন তারা  তো মনে হয় কারযাভী সাহেবের মতটি মানেননি। তারা তো বলেছেন যে, সবার দুধ আলাদা আলাদা করে রাখা হবে। অর্থাৎ তারাও মৌলিকভাবে এক্ষেত্রে হুরমতে রাযাআত মানছেন।

আসলে শায়েখ কারযাভীর মত ওআইসি সেমিনারে এ জন্যেই গৃহীত হয়নি যে, এর দালীলিক ভিত্তি খুবই দুর্বল ছিল।

 

প্রশ্ন : আমাদের দেশের কোনো এক আলেমের মন্তব্য হচ্ছে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই অন্যের দুধ পান করেছেন, তার একাধিক দুধ মাতা ছিলেন, তাই তিনি হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় আপত্তির কিছু দেখছেন না। বিষয়টাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

# এটা খুবই আশ্চর্যজনক কথা, কোনো আলেম যদি এমন কথা বলে থাকেন তাহলে তিনি আপত্তির জায়গাটা-ই বুঝতে পারেননি। এখানে কি কেউ বলেছে যে, নিজের মা ছাড়া অন্য কারো দুধ পান করা যাবে না, আমরা আগেই বলেছি, রাযাআতের বিষয়টা ছিল বলেই তো রাযাআত সংক্রান্ত বিধি-বিধান এসেছে। মিল্ক ব্যাংক নিয়ে মূল আপত্তির জায়গা তো সেটি নয়, সমস্যাটা কোথায় তা আগেই আলোচিত হয়েছে।

 

প্রশ্ন : হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক-এর উদ্যোক্তা এবং তাদের সমর্থকদের বক্তব্য হল, যারা এর বিরোধিতা করছেন তারা আসলে বিষয়টি বুঝতে পারেননি। সঠিকভাবে বিষয়টি বুঝতে পারলে এর বিরোধিতা করতেন না। এজন্য তারা দেশের আলেমদেরকে বিষয়টা ভালোভাবে বুঝার জন্য বারবার আহ্বান করছেন। আপনি কি মনে করেন যে, বিষয়টা খুবই সূক্ষ¥ বিষয়। এ বিষয়ে উলামায়ে কেরামের আরো কোনো কিছু গভীরভাবে বুঝার আছে? 

# একটু আগেই তো বলেছি যে, হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক এদেশে এসেছে মাত্র কয়েক মাস আগে ২০১৯ সনে। অথচ চার দশক আগেই ইসলামী ব্যক্তিত্বগণ এ বিষয়ে গবেষণা করে মতামত দিয়েছেন। যার বিবরণ আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। অনেক কাজই এমন হয় যে, বিদেশে পুরান হয়ে গেলে এদেশে আমদানী করা হয় এবং ভাবটা ধরা হয় এমন যে, তারা খুব অত্যাধুনিক কিছু করে ফেলেছেন। নতুন কিছু নিয়ে এসেছেন। অথচ এ বিষয়ে সমাধান আলেমরা অনেক আগেই দিয়ে রেখেছেন।

একটা উদাহরণ দিই, মাল্টিলেভেল মার্কেটিং যখন এ দেশে শুরু হল তখন কিছুদিনের মধ্যেই আলেমরা সম্মিলিতভাবে ফতোয়া দিলেন যে, ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকেও এটা অবৈধ এবং বাণিজ্যিক দিক থেকেও তা ব্যবসার কোনো সঠিক পদ্ধতি নয়। এটাকে নিয়মিত ব্যবসা বলাই ঠিক নয়। এরপর একদশকেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে বিভিন্নভাবে এই নামে সেই নামে এধরনের বহু প্রতিষ্ঠান হয়েছে। মানুষের হাজারো কোটি টাকা যখন ওরা খতম করে ছেড়েছে তখন সংশ্লিষ্ট মহলের খবর হয়েছে এবং ধর-পাকড় হয়েছে। অথচ যদি তখনি আলেমদের কথা আমলে নেয়া হত তাহলে সাধারণ মানুষের কোটি কোটি টাকা মুষ্টিমেয় লোক কুক্ষিগত করতে পারত না।

 

প্রশ্ন : কেউ কেউ সিঙ্গেল চাইল্ড সিঙ্গেল ডোনার তথা এক মহিলা কর্তৃক কেবল এক শিশুকেই দুধ দেওয়ার কথা বলছেন। তখন আর আইডেন্টিটি ট্রেস করা কঠিন হবে না-  এমনটি করা কি সম্ভব আর এরকম করলে কি হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা বৈধ হবে?

# সিঙ্গেল চাইল্ড-সিঙ্গেল ডোনার হলে  তো পুরাতন রাজাআতের পদ্ধতিই ফেরত আসবে। ওটাকে মিল্ক ব্যাংক বলা বা ডোনেশন বলা ঠিক না। এটা সিঙ্গেল চাইল্ড-সিঙ্গেল ডোনার নয়, বরং বলা যেতে পারে সিঙ্গেল চাইল্ড-সিঙ্গেল মাদার। সিঙ্গেল ডোনার একবার দুধ দান করে চলে যায়। বিষয়টা এমন যে, একজন মহিলা, যার হয়ত বাচ্চা মারা গেছে অথবা শিশু আছে তবে তার এত দুধ লাগে না, তার দুধ বেশি আছে; ঐ শিশুর সাথে অন্য শিশুকে যুক্ত করে দেওয়া হল। নির্ধারিত সময়ে তিনি তাকে দুধ পান করাবেন। এটা হল, সিঙ্গেল চাইল্ড সিঙ্গেল মাদার। কিন্তু মিল্ক ব্যাংকগুলো এ পদ্ধতিতে চলে না। এখানে এসে এসে তো নিয়মিত একটি নির্ধারিত শিশুর জন্য কেউ দুধ দিয়ে যাবে না।

প্রশ্ন : মিল্ক ব্যাংক বিষয়ে যেহেতু দু-একজন আলেমের ইতিবাচক মত রয়েছে। যদিও তাদের মত দুর্বল। কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থে কি দুর্বল মতের উপর আমল করা যায় না?

# আমরা আগেই বলেছি যে, দ্বিমত বা ভিন্ন মত পোষণকারী আলেমের সংখ্যা একান্তই কম এবং তাদের মতের ভিত্তিটাও এত দুর্বল যে তা কোনো মতের ভিত্তি হতে পারে না। এক্ষেত্রে তাদের মত শুধু দুর্বলই নয়; বরং একটি বিচ্ছন্ন মত। আর আপনি যে বললেন, বৃহত্তর জনস্বার্থে রুখসত-এর উপর আমল করার কথা, তো সেটা হল এমন ক্ষেত্রে, যা ইজতিহাদী বিষয়। কুরআন-সুন্নাহ্য়  যে ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য নেই। সেখানে ইজতিহাদ করে কোনো ফকীহ কোনো কথা বলেছেন। কিন্তু যে বিষয়গুলো সরাসরি কুরআন-সুন্নাহ্র নস দ্বারা প্রমাণিত এবং যেখানে হালাল-হারামের প্রশ্ন জড়িত- সেখানে এমন বিচ্ছিন্ন মতের উপর ভিত্তি করে কোনো কাজ করার সুযোগ নেই।

 

প্রশ্ন : কেউ কেউ বলছেন, দেশে তো আরো অনেক অনৈসলামিক কাজকর্ম হচ্ছে। পুরো দেশের আর্থিক খাত সুদী ব্যাংক কর্তৃক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। কোথাও ব্যাংক প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করতে তো আর কাউকে দেখা যায় না? তাহলে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক নিয়ে এত মাতামাতি ও বিতর্কের কী কারণ?

# যারা একথা বলেছেন তারা তাদের সীমিত বুঝ থেকেই এ ধরনের মন্তব্য করছেন। ব্যাংকের শাখা খোলা নিয়ে আলেমরা নতুন করে কী বলবেন? ব্যাংকের  গোড়ার বিষয় তথা সুদের কথা আলেমরা যুগ যুগ ধরে বলে আসছেন, এখনও বলছেন, সামনেও বলবেন। সুদী ব্যাংক বিষয়ে বাংলাসহ অসংখ্য ভাষায় বড় বড় বইপত্রও প্রকাশিত হয়েছে। সুদ হারাম- একথা ক’জন মুসলমানের অজানা? এবং কোন্ জায়গার আলেমরা এগুলো বলেন না? সব জায়গায়ই তো এগুলো বলা হচ্ছে। অন্যান্য বিভিন্ন হারামের কথা আলেমরা বিভিন্নভাবে বলছেন। তো আলেমরা বলেন না, একথা ঠিক নয়। আসলে এসব হীলা-বাহানার পিছনে না পড়ে বিষয়টির নাজুকতা উপলব্ধি করা উচিত। কারণ এক্ষেত্রে হালাল-হারামের সম্পর্কটা হল পুরো বংশের সাথে। এর সাথে জড়িয়ে আছে মানুষের দাম্পত্য জীবন এবং পরবর্তীতে তার সন্তানাদির বংশ পরিচয়ের বিষয়। যে শংকা থেকে এই মাসআলাটি  তৈরি হয়েছে, সেই শংকা অনেক গভীর ও স্পর্শকাতর।

 

প্রশ্ন : স্বাভাবিকভাবে মিল্ক ব্যাংক তো শিশুদের কল্যাণের জন্য। ইসলাম  তো কল্যাণের ধর্ম। শরীয়সম্মত পন্থায় এ মিল্ক ব্যাংকের কি বিকল্প হতে পারে?

# আমরা আগেই বলেছি যে, বস্তুবাদী সমাজব্যবস্থাই  তৈরি করেছে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক-এর প্রয়োজনীয়তা। আমরা আগে সমস্যা তৈরি করি, তারপর উল্টো পথে এর সমাধান খুঁজি। মাঝে একসময় ছিল, তথাকথিত একশ্রেণীর আধুনিক মহিলারা তাদের রূপচর্চার নামে, ফ্যাশনের নামে শিশুদের নিজের বুকের দুধ পান করাতে আগ্রহী হত না। শিশুদের নিজের বুকের দুধ দেওয়ার প্রবণতা শহুরে এলাকায় কমে গিয়েছিল। এরপর ডাক্তাররা সোচ্চার হয়েছেন। ‘মায়ের দুধের বিকল্প নাই’- এধরনের কথা ব্যাপকভাবে প্রচার হয়েছে। পরে আবার অনেকে নিজের সন্তানকে দুধ পান করাবার দিকে ঝুঁকেছেন।  সেই ফ্যাশন থেকে বেরিয়ে এসেছেন। কুরআনে কারীমে খুবই সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, দু’বছর পর্যন্ত মায়েরা তাদের সন্তানদের দুধ পান করাবে। [সূরা বাকার (২) : ২৩৩]

এক্ষেত্রে আরবের পুরাতন পদ্ধতিতেই ফিরে যেতে হবে।

 

প্রশ্ন : এ ধরনের ব্যাংক প্রতিষ্ঠা থেকে নিবৃত্ত রাখতে বর্তমান পরিস্থিতিতে উলামায়ে কেরামের কী কী করণীয় আছে বলে মনে করেন? বিরোধিতা সত্ত্বেও (আল্লাহ না করুন) যদি তা স্থাপিত হয়ে যায় তখন উলামায়ে কেরামের দায়িত্ব কী হবে?

# একজন আইনজীবি ইতিমধ্যে আইনী নোটিশ পাঠিয়েছেন। তাকে আমরা মোবারকবাদ জানাই। তিনি ইসলামের পক্ষে ভালো কাজ করেছেন। শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরাম এবং ধর্মপ্রাণ মুসলিম, যাদের সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ রয়েছে তাদেরও এ বিষয়ে নিজেদের প্রভাব খাটানো দরকার। বিষয়টার ভয়াবহতা এবং এর সুদূরপ্রসারী স্পর্শকাতর ও ক্ষতিকর দিকগুলো সংশ্লিষ্টদের  বুঝিয়ে এ ধরনের উদ্যোগ বন্ধ করা উচিত। যেহেতু হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের উদ্যোক্তদের কথাবার্তায় তাদেরকে ধর্মবিরোধী বা ধর্ম বিদ্বেষী মনে হয়নি; তাই আশা করি, তারা এ নাজায়েয ও জটিল প্রক্রিয়ায় আর অগ্রসর হবেন না।

 

 

advertisement