বিবাহ ও দাম্পত্য জীবন : কিছু দ্বীনী মুযাকারা
বিবাহ মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ। স্বাভাবিক জীবনের অনিবার্য একটি প্রয়োজন। একজন মানুষ যখন শিশু হিসেবে ভূমিষ্ঠ হয় তখনই তার মাঝে খাবারের চাহিদা থাকে; বরং মাতৃগর্ভে প্রাণ সঞ্চারের পর থেকেই তার মাঝে খাবারের চাহিদা সৃষ্টি হয়। এ সময় তার মাঝে মানবজীবনের অন্য অনেক সাধারণ চাহিদা থাকে না। সে ভূমিষ্ঠ হয়ে ধীরে ধীরে যখন বড় হতে থাকে তখন পর্যায়ক্রমে তার অনেক প্রয়োজন দেখা দিতে থাকে। যখন সে আরো বড় হয়, পরিণত বয়সে উপনীত হয় তখন তার বিবাহের প্রয়োজন হয়। ব্যক্তিভেদে মানুষের জীবনে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজন থাকতে পারে, তবে কিছু প্রয়োজন এমন রয়েছে, যা প্রায় প্রতিটি মানুষের মাঝেই বিদ্যমান। বিবাহ তারই একটি।
আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং একে মানবজাতির প্রতি অনুগ্রহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যেহেতু সমগ্র জগৎ আল্লাহরই সৃষ্টি, জগতের নিয়ম-নীতি তিনিই তৈরি করেছেন, মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি তাঁরই সৃষ্টি, তাই প্রত্যেক সৃষ্টির মাঝে এমন উপাদান তিনি দান করেছেন, যার মাধ্যমে জগৎটা সুন্দরভাবে পরিচালিত হতে পারে। এ ব্যবস্থা তাঁরই দেয়া। তাঁরই হিকমত।
আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ مِنْ اٰیٰتِهٖۤ اَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ اَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوْۤا اِلَیْهَا وَ جَعَلَ بَیْنَكُمْ مَّوَدَّةً وَّ رَحْمَةً ؕ اِنَّ فِیْ ذٰلِكَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوْمٍ یَّتَفَكَّرُوْن.
আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্য থেকে এটি একটি যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই মধ্য হতে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গীণীকে, যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি লাভ করতে পার এবং তোমাদের (স্বামী-স্ত্রীর) পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে বহু নিদর্শন রয়েছে, সেইসব লোকের জন্য, যারা চিন্তা-ভাবনা করে। -সূরা রূম (৩০) : ২১
অন্যত্র আরো ইরশাদ করেন-
هُوَ الَّذِیْ خَلَقَكُمْ مِّنْ نَّفْسٍ وَّاحِدَةٍ وَّ جَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا لِیَسْكُنَ اِلَیْهَا
তিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর থেকেই তাঁর স্ত্রীকে বানিয়েছেন, যাতে সে তার নিকট প্রশান্তি লাভ করতে পারে। -সূরা আরাফ (৭) : ১৮৯
একসময় মানুষ ছিল না। আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করতে চাইলেন। উদ্দেশ্য, তারা তাঁর ইবাদত করবে, তাঁর হেদায়েত মত চলবে। আল্লাহ কীভাবে মানুষ সৃষ্টি করলেন? একসাথে? না, বরং প্রথমে একজন, অতপর তার থেকে তার স্ত্রী, অতপর তাদের থেকে সকল মানুষকে। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمُ الَّذِیْ خَلَقَكُمْ مِّنْ نَّفْسٍ وَّاحِدَةٍ وَّ خَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَ بَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِیْرًا وَّ نِسَآءً.
হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক ব্যক্তি থেকে এবং তারই থেকে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, আর তাদের থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন। -সূরা নিসা (৪) : ১
মানুষের মাঝে বিবাহরীতি আল্লাহই দান করেছেন। আর আল্লাহপ্রদত্ত এ বিবাহরীতিতে শুধু জাগতিক দিকটিই মুখ্য নয়; বরং তাতে দ¦ীনী বা ধর্মীয় দিকটিও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইসলাম এ বিধানের হাকীকত ও উদ্দেশ্য এবং এর নীতিমালাকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে আলোচনা করেছে। এ সম্পর্কে কুরআন-হাদীসে বর্ণিত কিছু তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব।
আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে সৃষ্টি করে এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। তাদের মূল লক্ষ্য আখেরাতের জীবন। দুনিয়ায় সুশৃঙ্খল জীবনের সাথে সাথে আখেরাতে কীভাবে তারা সফল হবে, সেজন্য তিনি তাদের দিয়েছেন বিস্তারিত পথনির্দেশ। তাই সব কাজে আখেরাতকে স্মরণ রাখা মানুষের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সুতরাং নিছক জাগতিক বিষয়গুলোও সে এমনভাবে সম্পাদন করবে, যা দ্বারা সে আখেরাতে সফল হবে। এটাই শরীয়তে কাম্য এবং বিবেকের দাবি।
বিবাহের প্রসঙ্গটিও এমন। বিবাহকে শরীয়ত নিতান্তই জাগতিক বিষয় বিবেচনা করে না; বরং সেটাকে স্বামী-স্ত্রী এবং তৎপরবর্তী সন্তান-সন্ততি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আখেরাতের সফলতার মাধ্যমও বিবেচনা করে।
দ্বীনদার স্বামী-স্ত্রী, দ্বীনদার পরিবার
একটি দ্বীনদার পরিবার, দ্বীনদার সন্তান-সন্ততি ও বংশধরের জন্য সর্বপ্রথম যে বিষয়টি লক্ষ্যণীয় তা হল, দ্বীনদার স্বামী-স্ত্রী। এজন্য বিবাহের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবার আগে এ বিষয়টি লক্ষ রাখতে বলেছেন। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَنْكِحُوا الصّالِحِينَ وَالصّالِحَاتِ، فَمَا تَبِعَهُمْ بَعْدُ فَحَسَنٌ.
নারীদেরকে সালেহ (দ্বীনদার-নেককার) পুরুষের নিকট বিবাহ দাও, আর পুরুষদেরকে সালেহা (দ্বীনদার-নেককার) নারীর সাথে বিবাহ দাও; ফলশ্রুতিতে তাদের যে সন্তান হবে তারা হবে উওম (নেককার)। -সুনানে দারিমী, হাদীস ২২২৭
এজন্য শরীয়ত বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর দ্বীনদারীর প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে।
বিবাহের ক্ষেত্রে ইসতেখারা
যে কোনো বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে এলে শরীয়ত প্রথমে ইসতেখারা করতে বলে। বিবাহও জীবনের একটি গুরুত¦পূর্ণ বিষয়, ফলে এক্ষেত্রেও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসতেখারা করতে বলেছেন। প্রিয় সাহাবী আবু আইয়ূব আনসারী রা.-কে তার বিবাহের বিষয়ে কীভাবে ইসতেখারা করবে তা শিখিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- প্রথমে তোমার প্রস্তাব গোপন রাখো, অতপর উওমরূপে অযু কর এবং যে কয় রাকাত সম্ভব নামায পড়, অতপর আল্লাহর প্রশংসা করে বল-
اللّهُمّ إِنّكَ تَقْدِرُ وَلَا أَقْدِرُ، وَتَعْلَمُ وَلَا أَعْلَمُ، وَأَنْتَ عَلّامُ الْغُيُوبِ، فَإِنْ رَأَيْتَ فِيَ فُلَانَةَ - وَتُسَمِّيهَا بِاسْمِهَا - خَيْرًا لِي فِي دِينِي وَدُنْيَايَ وَآخِرَتِي فَاقْدُرْهَا لِي، وَإِنْ كَانَ غَيْرُهَا خَيْرًا لِي مِنْهَا فِي دِينِي وَدُنْيَايَ وَآخِرَتِي فَاقْضِ لِي ذَلِكَ.
হে আল্লাহ! আপনি সক্ষম আমি অক্ষম। আপনি জানেন আমি জানি না। আপনি গায়েব তথা অদৃশ্য বিষয়ে সম্যক অবগত; আপনি যদি অমুককে (পাত্রীর নাম নিবে) আমার দ্বীন-দুনিয়া এবং আখেরাতের ক্ষেত্রে কল্যাণকর মনে করেন তাহলে তাকে আমার জন্য সহজ করে দিন। আর যদি তার থেকে অন্য কেউ আমার দ্বীন-দুনিয়া ও আখেরাতের ক্ষেত্রে কল্যাণকর হয় তাহলে আমার জন্য তাই ফয়সালা করুন। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪০৪০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৫৯৬
এ বর্ণনায় দুআটি এ ভাষায়ই এসেছে। তবে প্রসিদ্ধ হল-
اللّهُمّ إِنِّي أَسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ...
যা সহীহ বুখারীসহ হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে রয়েছে।
সামান্য ভাবলেই বুঝা যায় যে, বিবাহের ক্ষেত্রে দ্বীনদারী ও আখেরাতের কল্যাণকে কী পরিমাণ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দ্বীন-দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য সহায়ক ও মঙ্গলজনক হলে আল্লাহ তুমি সহজ কর, অন্যথায় নয়। অর্থাৎ দ্বীন-দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য সহায়ক ও মঙ্গলজনক হলে অগ্রসর হওয়া, অন্যথায় নয়। খুবই স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন নীতি ও নির্দেশনা।
পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে দ্বীনদারী ও উত্তম আখলাকের গুরুত্ব
পাত্র-পাত্রী নির্বাচন কত কঠিন বিষয়; এক দিক মেলে তো আরেক দিক মেলে না। তাই এক্ষেত্রে হাদীসের শিক্ষা হল-যখন কোনো পাত্র বা পাত্রীর মাঝে দ্বীনদারী ও উত্তম আখলাক পেয়ে যাও তো বুঝে নাও এখানে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। এমনকি যদি অন্যান্য বিষয় অতটা পছন্দ নাও হয়। একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
إِذَا جَاءَكُمْ مَنْ تَرْضَوْنَ دِينَهُ وَخُلُقَهُ فَأَنْكِحُوهُ، إِلّا تَفْعَلُوا تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الأَرْضِ وَفَسَادٌ.
তোমাদের নিকট যদি এমন কারো প্রস্তাব আসে, যার দ্বীনদারী এবং চরিত্রের ব্যাপারে তোমরা সন্তুষ্ট তাহলে তার সাথে বিবাহ সম্পন্ন করে ফেল। অন্যথায় জগতে ফিতনা ও বিশৃংখলা হবে।
একথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন-
يَا رَسُولَ اللهِ، وَإِنْ كَانَ فِيهِ؟ قَالَ: إِذَا جَاءَكُمْ مَنْ تَرْضَوْنَ دِينَهُ وَخُلُقَهُ فَأَنْكِحُوهُ، ثَلَاثَ مَرّاتٍ.
ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি তার মধ্যে অন্য কোনো ত্রুটি থাকে? জবাবে আল্লাহর রাসূল তিন বার বললেন-
إِذَا جَاءَكُمْ مَنْ تَرْضَوْنَ دِينَهُ وَخُلُقَهُ فَأَنْكِحُوهُ.
তোমাদের নিকট যদি এমন কারো প্রস্তাব আসে, যার দ্বীনদারী এবং চরিত্রের ব্যাপারে তোমরা সন্তুষ্ট তাহলে তার সাথে বিবাহ সম্পন্ন করে ফেল। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১০৮৫; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ১৩৪৮১
প্রাধান্য দাও দ্বীনদারীকে
বিবাহের ক্ষেত্রে কোন্ বিষয়কে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হবে। সৌন্দর্য! তা তো দুই দিনের। সম্পদ! তা তো যখন-তখন হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। এজন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশনা দিয়েছেন- তুমি দ্বীনদারীকে প্রাধান্য দাও। তিনি বলেছেন-
تُنْكَحُ المَرْأَةُ لِأَرْبَعٍ: لِمَالِهَا وَلِحَسَبِهَا وَجَمَالِهَا وَلِدِينِهَا، فَاظْفَرْ بِذَاتِ الدِّينِ، تَرِبَتْ يَدَاكَ.
নারীকে বিবাহ করা হয় চারটি জিনিস দেখে। তার সম্পদ দেখে, বংশমর্যাদা দেখে। রূপ দেখে এবং দ্বীনদারী দেখে। (হে মুমিন!) তুমি দ্বীনদার নারী বিবাহ করে ধন্য হয়ে যাও। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০৯০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৪৬৬
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
تُنْكَحُ الْمَرْأَةُ عَلَى مَالِهَا، وَتُنْكَحُ الْمَرْأَةُ عَلَى جَمَالِهَا، وَتُنْكَحُ الْمَرْأَةُ عَلَى دِينِهَا، خُذْ ذَاتَ الدِّينِ، وَالْخُلُقِ تَرِبَتْ يَمِينُكَ.
নারীকে বিবাহ করা হয়ে থাকে তার অর্থ সম্পদের জন্য, রূপের জন্য, তার দ্বীনের জন্য। তুমি দ্বীনদার-চরিত্রবান নারীকে বিবাহ করে ধন্য হও। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪০৩৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১৭৬৫
রূপ-সৌন্দর্যে কাবু হয়ে যেও না
অনেক সময় কারো বাহ্যিক রূপ- সৌন্দর্যে মানুষ এতটাই মুগ্ধ হয় যে, দ্বীনদারী ও অন্যান্য উত্তম গুণাবলীর কথা মনে থাকে না। বা বাহ্যিক রূপ- সৌন্দর্যকেই সব মনে করে। ভুলে যায় দুনিয়ার বিপদসংকুল দীর্ঘ পথের কথা; যে পথ চলতে প্রয়োজন নেককার, চরিত্রবান ও ধৈর্যধারণকারী জীবনসঙ্গীর।
শুধু সৌন্দর্যে কাবু হয়ে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ বিস্মৃত হয়ে যায় এসকল অত্যাবশ্যকীয় গুণ-বৈশিষ্ট্যের কথা। ফলে বিবাহপরবর্তী সামান্য কিছু দিন যেতেই যখন জীবনের বাস্তবতার সম্মুখীন হয় এবং রূপ-সৌন্দর্যের ঘোর কেটে যায়, তখন আক্ষেপ-আফসোসই হয় তার নিত্যসঙ্গী। আর যদি স্বয়ং ঈমানই হয় রূপ-সৌন্দর্যের বলি, তাহলে তো সবই হারালো। তাই আল্লাহ মুমিনকে সতর্ক করেছেন-
وَ لَا تَنْكِحُوا الْمُشْرِكٰتِ حَتّٰی یُؤْمِنَّ، وَ لَاَمَةٌ مُّؤْمِنَةٌ خَیْرٌ مِّنْ مُّشْرِكَةٍ وَّ لَوْ اَعْجَبَتْكُمْ، وَ لَا تُنْكِحُوا الْمُشْرِكِیْنَ حَتّٰی یُؤْمِنُوْا، وَ لَعَبْدٌ مُّؤْمِنٌ خَیْرٌ مِّنْ مُّشْرِكٍ وَّ لَوْ اَعْجَبَكُمْ، اُولٰٓىِٕكَ یَدْعُوْنَ اِلَی النَّارِ، وَ اللّٰهُ یَدْعُوْۤا اِلَی الْجَنَّةِ وَ الْمَغْفِرَةِ بِاِذْنِهٖ، وَ یُبَیِّنُ اٰیٰتِهٖ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ یَتَذَكَّرُوْنَ.
তোমরা মুশরিক নারীকে বিবাহ করো না যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে। মুশরিক নারী তোমাদেরকে মুগ্ধ করলেও (জেনে রাখো,) একজন মুমিন বাদীও (স্বাধীন) মুশরিক নারী থেকে উত্তম। এবং ঈমান না আনা পর্যন্ত তোমরা মুশরিক পুরুষদের সাথে বিবাহ দিয়ো না; মুশরিক পুরুষ তোমাদেরকে মুগ্ধ করলেও। একজন মুমিন গোলামও (স্বাধীন) মুশরিক থেকে উত্তম। তারা ডাকে জাহান্নামের দিকে আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তোমাদেরকে ডাকেন জান্নাত এবং ক্ষমার দিকে। তিনি স্বীয় বিধানাবলী মানুষের জন্য সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে। -সূরা বাকারা (২) : ২২১
স্ত্রী নেককার : আর কী চাই!
পৃথিবীতে মানুষ যত নিআমত লাভ করে, এর মধ্যে নেককার স্ত্রী অন্যতম প্রধান নিআমত। স্ত্রী নেককার ও আখলাকওয়ালা হলে পরিবারে জান্নাতী আবেশ বিরাজ করে। অন্যথায় শান্তির পরিবারই হয়ে যায় সাক্ষাৎ জাহান্নাম। তাই তো নেককার স্ত্রীকে হাদীস শরীফে মহা নিআমত ও সৌভাগ্যের বিষয় বলা হয়েছে। আর বদকার স্ত্রীকে দুর্ভাগ্যের বিষয় বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مِنْ سَعَادَةِ ابْنِ آدَمَ ثَلاثَةٌ، وَمِنْ شِقْوَةِ ابْنِ آدَمَ ثَلاثَةٌ، مِن سَعَادَةِ ابْنِ آدَمَ: الْمَرْأَةُ الصّالِحَةُ، وَالْمَسْكَنُ الصّالِحُ، وَالْمَرْكَبُ الصّالِحُ، وَمِنْ شِقْوَةِ ابْنِ آدَمَ: الْمَرْأَةُ السّوءُ، وَالْمَسْكَنُ السّوءُ، وَالْمَرْكَبُ السّوءُ .
আদম সন্তানের সৌভাগ্যের বিষয় তিনটি। তেমনি দুর্ভাগ্যের বিষয়ও তিনটি। প্রথম তিনটি হল, সালিহা (দ্বীনদার-নেককার) স্ত্রী, ভালো বাসস্থান, ভালো সওয়ারী। দ্বিতীয় তিনটি হল, খারাপ স্ত্রী, খারাপ বাসস্থান ও খারাপ সওয়ারী। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৪৪
আরেক হাদীসে এসেছে-
مَا اسْتَفَادَ الْمُؤْمِنُ بَعْدَ تَقْوَى اللهِ خَيْرًا لَهُ مِنْ زَوْجَةٍ صَالِحَةٍ، إِنْ أَمَرَهَا أَطَاعَتْهُ، وَإِنْ نَظَرَ إِلَيْهَا سَرّتْهُ، وَإِنْ أَقْسَمَ عَلَيْهَا أَبَرّتْهُ، وَإِنْ غَابَ عَنْهَا نَصَحَتْهُ فِي نَفْسِهَا وَمَالِهِ.
আল্লাহর তাকওয়া অর্জনের পর একজন মুমিনের সবচেয়ে বড় অর্জন একজন সালিহা-দ্বীনদার-নেককার স্ত্রী; স্বামী কোনো আদেশ করলে তা মানে, তার দিকে তাকালে আনন্দ লাভ হয়, তার বিষয়ে স্বামী কোনো কসম করলে সে তাকে মুক্ত করে, স্বামীর অনুপস্থিতিতে নিজের বিষয়ে ত্রবং স্বামীর সম্পদের বিষয়ে কল্যাণ কামনা করে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৮৫৭
আরেক হাদীসে এসেছে-
إِنّمَا الدّنْيَا مَتَاعٌ، وَلَيْسَ مِنْ مَتَاعِ الدّنْيَا شَيْءٌ أَفْضَلَ مِنَ الْمَرْأَةِ الصَّالِحَةِ.
দুনিয়া তো (ক্ষণস্থায়ী) প্রয়োজন পূরণের। আর মানুষ দুনিয়াতে যা কিছু দ্বারা কল্যাণ ও উপকার লাভ করে, তার মধ্যে সালিহা-দ্বীনদার-নেককার স্ত্রীর চেয়ে উত্তম আর কিছু নেই। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৮৫৫
আরেক হাদীসে এসেছে-
أَرْبَعٌ مَنْ أُعْطِيَهُنّ أُعْطِيَ خَيْرَ الدّنْيَا وَالْآخِرَةِ: قَلْبًا شَاكِرًا، وَلِسَانًا ذَاكِرًا، وَبَدَنًا عَلَى الْبَلَاءِ صَابِرًا، وَزَوْجَةً لَا تَبْغِيهِ خَوْنًا فِي نَفْسِهَا وَلَا مَالِهِ.
চারটি বস্তু যাকে দান করা হল, তাকে দুনিয়া ও আখেরাতের সকল কল্যাণ দান করা হল। শোকরকারী অন্তর, যিকিরকারী জিহ্বা, বিপদে ধৈর্যধারণকারী শরীর এবং এমন স্ত্রী, যে নিজের ক্ষেত্রে এবং স্বামীর সম্পদের ক্ষেত্রে কোনো খেয়ানত করে না। -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ১১২৭৫; আমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ৭২১২ মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৭৪৩৭
নেককার স্ত্রী : আল্লাহ তোমার দ্বীনদারী অর্ধেক এগিয়ে দিয়েছেন
মুমিনের জীবনে নেককার স্ত্রীর এতটাই গুরুত্ব যে, একে দ্বীনদারীর পথে অর্ধেক এগিয়ে যাওয়া ধরা হয়েছে। আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ رَزَقَهُ اللهُ امْرَأَةً صَالِحَةً، فَقَدْ أَعَانَهُ عَلَى شَطْرِ دِينِهِ، فَلْيَتّقِ اللهَ فِي الشّطْرِ الثّانِي.
আল্লাহ তাআলা যাকে সালিহা স্ত্রী দান করেছেন, তাকে তার দ্বীনের অর্ধাংশের ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন, (অর্ধাংশ সহজ করে দিয়েছেন।) সুতরাং সে যেন বাকি অর্ধাংশের ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করে। -মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ২৬৮১; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৫১০১; আলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ৯৭২; মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৪/২৭২
পরস্পরে আখেরাতের সহযোগী
বিবাহের মাধ্যমে দুটি জীবন একসাথে পথচলা শুরু করে। তাই সবক্ষেত্রে একে অপরের সহযোগী, উভয়ে উভয়ের কল্যাণকামী। আর দুনিয়ার কল্যাণ ও আখেরাতের কল্যাণ- এ দুয়ে মিলেই মুমিনের কল্যাণ। কারণ, মুমিন দুআ করে-
رَبَّنَاۤ اٰتِنَا فِی الدُّنْیَا حَسَنَةً وَّ فِی الْاٰخِرَةِ حَسَنَةً وَّ قِنَا عَذَابَ النَّار.
হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দাও এবং আখেরাতে কল্যাণ দাও এবং আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা কর। -সূরা বাকারা (২) : ২০১
তাই মুমিন দম্পতি দুনিয়ার ক্ষেত্রে যেমন একে অপরের সহযোগী ও কল্যাণকামী তেমনি আখেরাতের ক্ষেত্রেও। এটাই মুমিন দম্পতির জীবনের স্বাভাবিক ধারা।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রিয় সাহাবী হযরত মুআয রা.-কে বলেন-
يَا مُعَاذُ قَلْبًا شَاكِرًا، وَلِسَانًا ذَاكِرًا، وَزَوْجَةً صَالِحَةً تُعِينُكَ عَلَى أَمْرِ دُنْيَاكَ وَدِينِكَ خَيْرُ مَا اكْتَسَبَهُ النّاسُ.
হে মুআয, মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন হল, শোকরকারী অন্তর, যিকিরকারী জিহ্বা, সালিহা (দ্বীনদার) স্ত্রী, যে তাকে দুনিয়া ও দ্বীনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে। -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৭৮২৮; মাযমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৭৪৩৮
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
مَنِ اسْتَيْقَظَ مِنَ اللّيْلِ وَأَيْقَظَ امْرَأَتَهُ، فَصَلّيَا رَكْعَتَيْنِ جَمِيعًا، كُتِبَا مِنَ الذّاكِرِينَ اللهَ كَثِيرًا، وَالذّاكِرَاتِ.
যখন কোনো পুরুষ রাতে জাগ্রত হয় অতপর তার স্ত্রীকেও জাগ্রত করে, অতপর উভয়ে দুই রাকাত নামায আদায় করে, তাদেরকে ‘যাকিরীন’ ও ‘যাকিরাত’-এর তালিকাভুক্ত করা হয়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৪৫১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩৩৫
হযরত উসমান ইবনু আবিল আস রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে-
كَانَ لِدَاوُدَ نَبِيِّ اللهِ عَلَيْهِ السّلَامُ مِنَ اللّيْلِ سَاعَةٌ يُوقِظُ فِيهَا أَهْلَهُ، فَيَقُولُ: يَا آلَ دَاوُدَ قُومُوا فَصَلّوا، فَإِنّ هَذِهِ سَاعَةٌ يَسْتَجِيبُ اللهُ فِيهَا الدّعَاءَ.
হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম রাতের এক সময়ে জাগ্রত হয়ে পরিবারের সকলকে জাগিয়ে দিতেন এবং বলতেন, হে দাউদ- পরিবার! ওঠ এবং নামায পড়। কেননা এটা এমন এক সময় যখন আল্লাহ তাআলা দুআ কবুল করেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬২৮১; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৪৪৭১
আশা করি, উল্লেখিত আয়াত-হাদীসসমূহে বিবাহের মাকসাদ কী, তাতে কী কী বিষয় লক্ষণীয় এবং দাম্পত্য জীবনে কী কী করণীয়- এর কিছু দিক আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে এসেছে। এখন দেখার বিষয় হল, আমরা এসব বিষয়ের প্রতি কতটুকু লক্ষ রাখছি।
একটু ভাবি
মুমিনের সকল বিষয়ের মতো বিবাহের ক্ষেত্রেও সূচনাতেই দ্বীনদারী তথা আখেরাতের দিকটি বিবেচনায় রেখে অগ্রসর হতে বলা হয়েছে। আমরা তা করছি কি? সর্বাগ্রে পাত্র-পাত্রীর দ্বীনদারী লক্ষ করার কথা বলা হয়েছে; আমাদের সমাজে তা করা হয় কি না? বাহ্যিক রূপ-সৌন্দর্য ও সহায়-সম্পত্তি বা জাগতিক অন্য কিছুকে দ্বীনের উপর প্রাধান্য দিচ্ছি না তো! কোনো পাত্র বা পাত্রীর জাগতিক কিছু নেই বা তুলনামূলক কম আছে; কিন্তু তার দ্বীনদারী, উত্তম চরিত্র ও দ্বীনী জ্ঞান অন্যান্য বিষয় থেকে অনেক বেশি, সেক্ষেত্রে আমরা দ্বীনদারী ও আখলাকের বিশেষ মূল্যায়ন করছি কি? শরীয়তে দ্বীনদারীকে প্রাধান্য দিতে বলা হয়েছে। আমরা অন্যগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে দ্বীনদারীকে পিছে ঠেলছি না তো!
দাম্পত্য জীবনে পরস্পরের কল্যাণভাবনা
বিবাহ কার্য সম্পাদন হয়ে গেল। অতপর স্বামী-স্ত্রী পরস্পরে জাগতিক সকল ক্ষেত্রে একে অপরের সহযোগী ও শরীক হয়ে গেল, কিন্তু আখেরাতের ক্ষেত্রে তারা একে অপরের সহযোগী হল কি? জাগতিক সকল ক্ষেত্রে পরস্পরের কল্যাণ তালাশ করে, কিন্তু আখেরাতের কল্যাণ তালাশ করে কি? এ বিষয়টি ভাবতে হবে প্রতিটি স্বামী-স্ত্রীর।
যে স্বামী স্ত্রীর আখেরাত নিয়ে ভাবে এবং যে স্ত্রী স্বামীর আখেরাত নিয়ে ভাবে, তাদের জন্য নবীজী রহমতের দুআ করেছেন। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
رَحِمَ اللهُ رَجُلًا قَامَ مِنَ اللّيْلِ فَصَلّى وَأَيْقَظَ امْرَأَتَهُ فَصَلّتْ، فَإِنْ أَبَتْ رَشّ فِي وَجْهِهَا الْمَاءَ، رَحِمَ اللهُ امْرَأَةً قَامَتْ مِنَ اللّيْلِ فَصَلَّتْ وَأَيْقَظَتْ زَوْجَهَا فَصَلّى، فَإِنْ أَبَى رَشّتْ فِي وَجْهِهِ الْمَاءَ.
আল্লাহ রহমত করুন ঐ স্বামীর প্রতি, যে রাতে জাগ্রত হয়ে নামায পড়ে এবং স্ত্রীকেও জাগ্রত করে; উঠতে না চাইলে চেহারায় পানি ছিটিয়ে হলেও ওঠানোর চেষ্টা করে। আল্লাহ রহমত করুন ঐ স্ত্রীর প্রতি, যে রাতে জাগ্রত হয়ে নামায পড়ে এবং স্বামীকে জাগিয়ে দেয়; সে উঠতে না চাইলে চেহারায় পানি ছিটিয়ে ওঠানোর চেষ্টা করে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩৩৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৪৫০
হাঁ, এমনই হওয়া উচিত মুমিন দম্পতির আখেরাতের ক্ষেত্রে পরস্পরের কল্যাণকামনা ও সহযোগিতা।
একজন মুমিনের সবচে বড় সম্পদ তার ঈমান ও আকীদা। তাই সর্বাগ্রে স্বামীর উচিত স্ত্রীর ঈমানের খোঁজ-খবর নেয়া। সে ইসলামী আকীদাগুলো জানে কি না এবং নিঃসন্দেহে মানে কি না। তার মাঝে ঈমান-বিরোধী কোনো চিন্তা-দর্শন বা কোনো আমল আছে কি না। সহীহ আকীদা পোষণ করে থাকলে তা তার মধ্যে বদ্ধমূল হয়েছে কি না?
ঈমানের পর তার নামাযের খোঁজ নেয়া। গুরুত্বের সাথে ওয়াক্তমত নামায পড়ে কি না। পড়লে তা সহীহ তরীকায় পড়ে কি না। এটা তো বাস্তব যে, আমাদের সমাজে পুরুষরা নামায ইত্যাদি মকতবের উসতায বা ইমাম সাহেব থেকে শিখলেও নারীরা শেখে ঘরের অন্য নারী থেকে। ফলে অনেক সময় দেখা যায়, যে নারী থেকে শিখেছে তার শেখানোটা সহীহ ছিল না। ফলে শেখাটা অসম্পূর্ণ বা অশুদ্ধ থেকে যায়।
নামাযের প্রাণ হল কুরআন তিলাওয়াত। তাই দেখা দরকার, সে সহীহ-শুদ্ধভাবে তিলাওয়াত করতে পারে কি না। সহীহ-শুদ্ধ হলে প্রাত্যহিক নির্দিষ্ট পরিমাণ তিলাওয়াত করে কি না। তেমনিভাবে নামাযের দুআগুলো- সানা, তাসবীহ, আত্তাহিয়্যাতু, দরূদ, দুআ ইত্যাদি সহীহ-শুদ্ধভাবে পড়তে পারে কি না।
নামাযের দুআগুলো ছাড়াও দৈনন্দিন জীবনে আমলের অনেক দুআ আছে, যা একজন মুমিনের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ; সেগুলো পাঠে মুমিনের দুনিয়া-আখেরাতের বহু কল্যাণ অর্জিত হয়, যাকে আমরা দুআয়ে মাছূরা বা মাসনূন দুআ বলি। এগুলোর মধ্যে কিছু তো আছে নির্দিষ্ট সময় বা আমলের সাথে সম্পৃক্ত, যথা সকাল-সন্ধ্যা, আহার, নিদ্রা-জাগরণ ইত্যাদি সময়ে পঠিত দুআ। আর কিছু আছে ব্যাপক দুআ, যা মুনাজাত, নামায বা যেকোনো সময় পড়া যায়। যে মুমিন এসব থেকে মাহরূম হল সে বহু কল্যাণ থেকে মাহরূম হল। তাই স্বামীর কর্তব্য, স্ত্রী এসব দুআ পারে কি না বা আমল করে কি না- খোঁজ নেয়া।
পর্দা নারীর স্বভাবজাত বিষয়। শরীয়তেরও বিধান। স্ত্রী তা যথাযথ পালন করছে কি না- তাও খুব গুরুত্ব সহকারে খোঁজ রাখা স্বামীর জন্য জরুরি।
সর্বোপরি দ্বীন শেখা প্রত্যেক নর-নারীর জন্য আবশ্যক। স্ত্রীর দ্বীনী জ্ঞান অর্জনের ব্যবস্থা করছে কি না? ঘরে তালীম হচ্ছে কি না? দ্বীনী কিতাবাদি সংগ্রহ করে স্ত্রীকে পড়ার সুযোগ করে দিচ্ছে কি না?
আসলে সব দিক এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয় এবং তার প্রয়োজনও নেই। মূলকথা হল, স্ত্রীর আখেরাতের বিষয়ে ফিকির করা এবং তাকে সার্বিক সহযোগিতা করা।
এ তো গেল স্ত্রীর প্রতি স্বামীর করণীয়। একজন স্ত্রীরও দায়িত্ব স্বামীর ইবাদত, আমল-আখলাক, লেনদেন, হালাল উপার্জন ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে দৃষ্টি রাখা এবং তাকে সহযোগিতা করা। বিশেষ করে স্বামীর আয়-উপার্জনের বিষয়ে ফিকির করা- তা হালাল কি না। কারণ, খাবার হারাম হলে ইবাদাত-বন্দেগী কবুল হয় না। তাই একজন স্ত্রীর কর্তব্য, স্বামীর আয়-উপার্জনের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা এবং সবর ও অল্পেতুষ্টির মাধ্যমে হালাল উপার্জনের ক্ষেত্রে স্বামীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। কিন্তু এমন যেন না হয় যে, স্বামী আখেরাতের পথে চলতে চায় আর স্ত্রী তার বিরোধিতা করে। কিংবা স্বামী নিজ স্ত্রীর দ্বীনদারীতে বাধা দেয়।
মোদ্দাকথা, স্বামী-স্ত্রী যেহেতু একে অপরের আখেরাতেরও সহযোগী, তাই প্রত্যেকে নিজের আখেরাতের ফিকিরের সাথে সাথে অপরের আখেরাতের ফিকির করাও আবশ্যক। তাই তাদের মাঝে জাগতিক বিষয়ের আলোচনার ন্যায় আখেরাতের বিষয় নিয়েও আলোচনা হতে হবে। কারও মধ্যে কোনো আমল বা গুণের অভাব থাকলে তা চিিহ্নত করে বাস্তবে আনার চেষ্টা করতে হবে। একজন কোনো ভালো কিছু পড়লে, শুনলে বা জানলে অপরকে জানাবে, একজন একটি নেক কাজ করলে অপরজনকেও শরীক করবে। সর্বদা ঘরে আখেরাতের মুযাকারার পরিবেশ রাখবে।
কিন্তু আমাদের অনেকের অবস্থা হল, তাদের সম্পর্ক শুধু জাগতিক; জাগতিক কাজ-কর্মে একজন আরেকজনের নিত্যসঙ্গী, কিন্তু আখেরাতের ক্ষেত্রে পরস্পরের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই। ফলে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কোনো দ্বীনী মুযাকারা নেই, কোনো আমলের কথা নেই, কোনো ভালো কথা শুনলে তা অপরজনকে শোনানো নেই।
এমনকি কোনো কোনো পরিবারে স্বামী দ্বীনদার ও দ্বীনী জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও স্ত্রীর দ্বীনদারী ও দ্বীনী জ্ঞান আজীবন ঐ অবস্থায়ই থেকে যায়, যা নিয়ে বিবাহের সময় সে এ ঘরে এসেছে। স্বামী আলেম, কুরআনের পারদর্শী, কিন্তু স্ত্রী কুরআনের ক্ষেত্রে প্রায় অজ্ঞ, না জানে পূর্ণ শুদ্ধ করে তিলাওয়াত করতে, না পারে বুঝতে; এভাবে জীবন কেটে যায়!
সন্তানের কল্যাণকামনা : এগিয়ে দিন আখেরাতের পথে
জানাকথা, স্বাভাবিকভাবে বিবাহের পর সন্তান-সন্ততি হবে। আর সন্তানের প্রতি মাতা-পিতার ভালবাসা ও কল্যাণকামনার কোনো তুলনা হয় না। সন্তানের কল্যাণ কামনারও দুটি দিক রয়েছে। এক হল জাগতিক হিসাবে; আমার সন্তান বড় হবে, আয়-উপার্জন করবে, অনেক বড় সম্পদশালী হবে, নাম-সুনাম কামাবে, আমার সুখ ও সুনাম হবে। আরেকটি হল, এ সন্তান যেহেতু আল্লাহ দান করেছেন, সুতরাং তাকে খাঁটি আল্লাহর বান্দারূপে গড়ে তুলব। এজন্যই আল্লাহর নবীগণ যখন আল্লাহ তাআলার নিকট সন্তান চাইতেন এ উদ্দেশ্যেই চাইতেন। হযরত যাকারিয়া আলাইহিস সালাম বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার পরও আল্লাহর নিকট এ বলে সন্তান চেয়েছেন। (তরজমা) হে আল্লাহ! আমার অস্থিরাজি পর্যন্ত দুর্বল হয়ে গেছে, মাথায় বার্ধক্য উজ্জ¦ল হয়ে উঠেছে। ...সুতরাং আপনি আপনার নিকট থেকে এমন এক উত্তরাধিকারী দান করুন, যে আমারও উত্তরাধিকারী হবে এবং ইয়াকুবেরও এবং আপনি তাকে আপনার সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত বানান। -সূরা মারইয়াম (১৯) : ৪-৬
ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সন্তানদের জন্য এভাবে দুআ করেন-
رَبِّ اجْعَلْنِیْ مُقِیْمَ الصَّلٰوةِ وَ مِنْ ذُرِّیَّتِیْ، رَبَّنَا وَ تَقَبَّلْ دُعَآءِ.
হে আমার প্রতিপালক! আমাকে সালাত কায়েমকারী করুন; এবং আমার বংশধরদের মধ্য হতেও। হে আমাদের প্রতিপালক আমার প্রার্থনা কবুল করুন। -সূরা ইবরাহীম (১৪) : ৪০
সন্তানেরা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে- সুলাইমান আলাইহিস সালাম এজন্যও সন্তান কামনা করেছেন। ইমাম বুখারী রাহ. তাঁর ঘটনা উল্লেখ করেছেন এ শিরোনামে- ‘বাবু মান তালাবাল ওলাদা লিল জিহাদ’ (অধ্যায় : যিনি জিহাদের উদ্দেশ্যে সন্তান কামনা করেছেন)
আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে ইবাদুর রহমান (রহমানের বান্দা)-এর গুণাগুণ বর্ণনা করে একটি দীর্ঘ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন, সেখানে তাদের একটা গুণ বর্ণিত হয়েছে এভাবে-
‘এবং যারা বলে,
رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ اَزْوَاجِنَا وَ ذُرِّیّٰتِنَا قُرَّةَ اَعْیُنٍ وَّ اجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِیْنَ اِمَامًا.
‘হে আমাদের রব আমাদেরকে চক্ষু শীতলকারী স্ত্রী-সন্তান দান করুন এবং আমাদেরকে বানান মুত্তাকীদের ইমাম-মুত্তাকীদের জন্য অনুসরণযোগ্য। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৭৪
অর্থাৎ স্ত্রী-সন্তানদের দ¦ীনদারী কামনা ইবাদুর রহমানের বৈশিষ্ট্য। এমন দুআ করা আল্লাহর বিশেষ বান্দাদের গুণ।
আশা করি, পূর্বের আলোচনা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে যে, বিবাহের মধ্যে দুটি দিক রয়েছে, একটি হল জাগতিক দিক, অন্যটি হল দ্বীনী বা আখেরাতের দিক। তাই মুমিন স্বামী-স্ত্রী একে অপরের জাগতিক কল্যাণ নিয়ে যেমন ভাববে, তেমনি আখেরাতের কল্যাণ কামনায়ও ব্যাকুল হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন, রহম করুন- আমীন।