রোহিঙ্গা মুসলিমদের পক্ষে গাম্বিয়ার আইনি লড়াই : অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত
মিয়ানমারের আরাকান বা রাখাইন রাজ্যে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যে গণহত্যা ও বর্বরতা চলেছে তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালত-আইসিজে’তে (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস) মামলা দায়ের করেছিল পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট ও গরিব মুসলিম দেশ গাম্বিয়া। এ মামলার শুনানি হয়েছে গত ডিসেম্বরের ১০ থেকে ১২ তারিখ- তিন দিন।
মামলার বাদী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী আবু বকর মারি। অপরদিকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর গণহত্যা পরিচালনকারী রাষ্ট্র মিয়ানমারের পক্ষে শুনানিতে অংশ নিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রধান ও স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি।
নেদারল্যান্ডসের দ্যা হেগ-এর গ্রেট হল অব জাস্টিস অব দ্যা পিস প্যালেসে এই শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো এ শুনানির খবর প্রচার করে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতেও এই শুনানির খবর এবং এই শুনানি নিয়ে বিভিন্ন রকম আলোচনা-পর্যালোচনা প্রকাশ করা হয়। নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর চালানো মিয়ানমারের গণহত্যা, ধর্ষণ, বর্বরতা এবং তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করার বেদনাদায়ক ঘটনা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রতিবাদী কিছু কথা ও তথ্য-প্রমাণ এই শুনানির মধ্য দিয়ে বিশ^বাসীর সামনে নতুন করে এসেছে। অত্যাচারী রাষ্ট্র মিয়ানমারকে তাদের বর্বর কর্মকা-ের জন্য একটি স্বীকৃত আইনি কাঠামোর মধ্যে কিছুটা জবাবদিহির মুখোমুখি করা গেছে। বলা হচ্ছে, রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমার রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যা বিষয়ে আইসিজে’তে (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস) দায়ের করা মামলার শুনানির এটা ছিল প্রথম ধাপ। পরবর্তী সময় ও ধাপে এ বিষয়ে আরো শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। আশা করা কঠিন যে, পরবর্তী ধাপের শুনানিগুলোর পর এই মামলা একটি কাক্সিক্ষত পরিণতির দিকে যাবে, উপযুক্ত একটি রায় আন্তর্জাতিক আদলত থেকে আসবে এবং সে রায় যথাযথভাবে বাস্তবায়নও করা হবে। কিন্তু মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত গণহত্যা নিয়ে এমন একটি মামলা ও তার প্রকাশ্য শুনানির ঘটনায় নির্যাতিত, দেশান্তরিত শরণার্থী রোহিঙ্গাদের প্রতি বিশ^দৃষ্টি আকর্ষণের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ নতুন পদক্ষেপের সূচনা হয়েছে।
১০ লাখের ওপর রোহিঙ্গা মুসলিম মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে মানবেতর জীবনযাপন করছে। রোহিঙ্গাদের ওপর সবচেয়ে বড় ও সর্বশেষ আঘাতটি এসেছে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে। কিন্তু মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন এবং তাদের বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেওয়ার এ ধারা শুরু হয়েছে আরো প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর থেকে। এ নিয়ে এতদিন বাংলাদেশের উদ্বেগ ও মৃদু প্রতিবাদের পাশাপাশি কোনো কোনো মুসলিম দেশ ক্ষীণ স্বরে কিছু কিছু কথা বলেছে। মিয়ানমারের বর্বরতার বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। এমনকি কূটনৈতিক প্রতিবাদের এমন কোনো ধারাও অনুসরণ করা হয়নি, যাতে মিয়ানমারকে কিছুটা জবাবদিহির পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। এমন পরিস্থিতিতে গাম্বিয়ার মতো ছোট্ট একটি মুসলিম রাষ্ট্রের এই সাহসী উদ্যোগ একটি দৃষ্টি আকর্ষণী পদক্ষেপ হিসেবে অবশ্যই প্রশংসা কেড়েছে দুনিয়ার মুসলমানদের এবং একইসঙ্গে পৃথিবীর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সব মানুষ ও গণমাধ্যমের। ছোট দেশের এই ছোট ও সাহসী পদক্ষেপকে আমরা ছোট করে দেখতে চাই না।
দুনিয়ার দেশে দেশে মজলুম মুসলমানদের মুক্তির জন্য যে রাষ্ট্রের যতটুকু সামর্থ্য আছে, সে হিসেবে কিছু পদক্ষেপ রাখলেও দুনিয়াব্যাপী মুসলমানদের কষ্ট ও নিগ্রহের চিত্রটা একটু অন্যরকম হতে পারত। আন্তর্জাতিক নানারকম প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নিয়ম-নিয়ন্ত্রণ ও জুলুমের পরিবেশের মাধ্যেও নির্যাতিত ও দেশছাড়া রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য গাম্বিয়া আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে এবং সে মামলার শুনানি করে নির্যাতিত মুসলমানদের পক্ষে দৃষ্টি আকর্ষণ ও নির্যাতক দেশকে জবাবদিহির কাঠামোর মধ্যে আনার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, এখান থেকে সক্ষম, বিত্তবান ও প্রভাবশালী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর অনেক কিছুই শেখার আছে।
গাম্বিয়ার মতো একটি রাষ্ট্র, যার আয়তন বাংলাদেশের দুটি বড় জেলার সমান, যার জনসংখ্যা অর্ধকোটিও নয়- যদি বিশ^ পরিসরে মুসলিম নির্যাতক মিয়ানমারকে আদালতে এসে শুনানি করতে বাধ্য করতে পারে, মিয়ানমার কর্তৃক রোহিঙ্গা গণহত্যা ও ধর্ষণের দলীল-প্রমাণ প্রকাশ্যে আদালতে উপস্থাপন করে মিয়ানমারকে অন্তত কোণঠাসা করার মতো একটি অবস্থায় নিতে পারে- সেক্ষেত্রে প্রভাবশালী মুসলিম দেশগুলো জোরালো কিছু কূটনৈতিক ও কৌশলগত পদক্ষেপ নিলে মিয়ানমারের জবাবদিহির এ পরিস্থিতিটা কতটা অগ্রসর ও মজবুত হতে পারত! দুনিয়াব্যাপী ত্রাস সৃষ্টিকারী বড় রাষ্ট্রগুলোর মুখ-মর্জির দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেদের উদ্যোগে বিত্তবান ও প্রভাবশালী মুসলিম দেশের শাসকরা ভারতসহ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর যেসব নিগ্রহ ও আতংকজনক পরিস্থিতি চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে কার্যকর কিছু কৌশলী পদক্ষেপ নিলে অনেক সংকটের সমাধান-পথ খুলবে বলে আশা করা যায়। আফসোসের বিষয় হল, প্রভাবশালী ও বিত্তবান মুসলিম শাসকরা সেরকম কোনো উদ্যোগের পথে হাঁটতেই চান না।
খবরে জানা গেছে, নোদারল্যান্ডসের হেগ শহরে অনুষ্ঠিত গাম্বিয়ার দায়ের করা এই মামলার শুনানির সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ২০ সদস্যের একটি তথ্য সহায়ক দল অংশ নিয়েছিল। পররাষ্ট্র দফতর থেকে জানানো হয়েছে, এ মামলায় কানাডা ও নেদারল্যান্ডসও তথ্য সহযোগিতা দেবে। এটি অবশ্যই ইতিবাচক খবর। কিন্তু মূল উদ্যোক্তা হয়ে সামনে এসেছে ছোট্ট মুসলিম রাষ্ট্র গাম্বিয়া এবং তার আইনমন্ত্রী আবু বকর মারি। অন্য কোনো বড় মুসলিম দেশ মামলার বাদী হয়ে সামনে আসেনি। এতে গাম্বিয়া আয়তনে ও সক্ষমতায় ছোট রাষ্ট্র হলেও সে প্রমাণ করেছে, মজলুম মুসলমানদের পক্ষে বিশ^ব্যাপী আওয়াজ উঁচু করায় দ্বিধা বা ভয়ের কিছু নেই। অপরদিকে মিয়ানমারও বিশে^র এমন কোনো অজেয় রাষ্ট্র নয় যে, তার অত্যাচার-নির্যাতন ও বর্বরতা বিশ^ পরিসরে তুলে ধরে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে অনেক ভাবনা-চিন্তা করতে হবে। অথচ পরিতাপের বিষয় হল, ছোট একটি অখ্যাত রাষ্ট্র সৎসাহসের পরিচয় দিতে পারলেও প্রভাবশালী মুসলিম রাষ্ট্রগুলো হয়ে থাকল ভীত-সন্ত্রস্ত। তাদের ক্ষমতা ও সম্পদের মোহ বিরত রাখছে তাদেরই মুসলমান ভাই-বোনদের পক্ষে দাঁড়াতে। তারা ভয় করছে মিয়ানমারের বিপক্ষে বলতে গেলে, কাশ্মীরী মুসলমানদের পক্ষে অবস্থান নিলে, ভারতের কট্টর হিন্দুবাদী সরকার কর্তৃক একের পর এক মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খুললে, ফিলিস্তীনী মুসলমানদের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিলে, উইঘুর মুসলমানদের বন্দীদশা নিয়ে বিশ^কে জানালে- না জানি আবার তাদের কোনো ক্ষতি হয়ে যায়। যদি এ কারণে তাদের মিত্র নামক প্রভুরা অখুশী হয়ে যায়! যদি এতে তাদের একনায়কতন্ত্রে চির ধরে! যদি তাদের বাণিজ্যে মন্দা দেখা দেয়- এসবেই তাদের ভয়। যদিও তাদের কেউ কেউ নিজেকে মুসলিমদের বড় নেতাই ভেবে থাকেন, নিজের নামে ‘খাদেম’সহ বিভিন্ন উপাধিও লাগিয়ে থাকেন। কেউ আবার এক অঞ্চলের মুসলমানদের নির্যাতন সম্পর্কে দু-চার কথা বললেও অন্য অঞ্চলের মুসলমানদের নির্যাতনকে সমর্থন দিয়ে যান।
আজ যদি প্রভাবশালী ও সম্পদশালী মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ইতিবাচক চিন্তা করত, যদি তারা মুসলিমবিশে^র মধ্যে সত্যিকারের ঐক্য গড়ে তুলতে পারত। যদি নিজেদের স্বতন্ত্র মুদ্রাব্যবস্থা আনার কার্যকর চেষ্টা করত তাহলে পৃথিবীর কোনো শক্তিই তাদেরকে চোখ রাঙাতে পারত না। যদি তাদের সৈন্য বহিনীগুলোকে ঈমানের বলে বলীয়ান করে তুলত, যদি নিজেদের মধ্যে অর্থনৈতিক একটি বলয় গড়ে তুলত, তবে অন্যেরা নিজেদের স্বার্থেই মুসলমানদের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হত।
মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর কাছে কী নেই? পৃথিবীতে আল্লাহ্র দেয়া খনিজ সম্পদসমূহের (তেল, গ্যাস, লৌহ, স্বর্ণ ইত্যাদি) একটি বৃহৎ অংশই মুসলিমদের হাতে রয়েছে। আছে দেড়শ কোটির অধিক জনসংখ্যা এবং সর্বোপরি তৌহিদী বিশ^াসে বলীয়ান বিশাল যুবসমাজ। কোনো আল্লাহমুখী মুসলিম শাসক যথাযথ পন্থায় ডাক দিলে তারা মুসলমানদের জান-মাল ও ইজ্জত রক্ষার জন্য কোনো পদক্ষেপ নিতেই পিছপা হবে না। কিন্তু মুসলমানদের স্বঘোষিত নেতারা বরং হাঁটছেন উল্টো পথে। নিজেদের কৃষ্টি-কালচার বিসর্জন দিয়ে অন্যদেরটা প্রচলনে মেতে উঠেছেন। তারা ভাবছেন, এতে হয়ত তাদের খুশি করা যাবে এবং নিজেদের ক্ষমতাকে স্থায়ী রূপ দেয়া যাবে। আবার এ ক্ষমতার জন্য নিজেদের মধ্যেই ঝগড়া-বিবাদ, অবরোধ-অপবাদ এমনকি যুদ্ধেও জড়িয়ে পড়ছেন। আবার মোড়লগিরীও ছাড়তে চাচ্ছেন না। তেমনি দু-চারটি মুসলিম দেশ একত্রে বসলে স্বজাতি অন্য প্রভাবশালিরাই বাধা হয়ে উঠছে।
এহেন পরিস্থিতিতে মুসলিম রাষ্ট্রনায়কদের আত্মমর্যাদাবোধ, সৎসাহস ও ঈমানী শক্তি চলে গেছে পর্দার আড়ালে। তারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন অন্যদের দ্বারা। এজন্য যেমনিভাবে নিজেদের ধর্মপ্রাণ নাগরিকদের বিভিন্নভাবে দমন-পীড়ন করছেন তেমনি বিভিন্ন দেশের সংখ্যালঘু মুসলিমদের দুর্দশাও তাদেরকে নাড়া দেয় না। তারা এসবের জন্য একটি বাক্য মুখস্থ করে রেখেছেন- ‘এটি ঐ দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়’।
আর এ করুণ চিত্রের মধ্যেই যখন একটি ছোট্ট অখ্যাত রাষ্ট্র লাখো মুসলিমের নির্যাতনকারী একটি দেশকে আন্তর্জাতিক আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য করে তখন কিছুটা হলেও আশার আলো জ¦লে ওঠে। জানি, এর মাধ্যমে তেমন কিই বা আর আশা করা যায়! আবার ভালো কোনো রায় আসলেও জাতিসংঘে গিয়ে তা বিশ^-মোড়লদের কারো কারো ভেটো’র মুখেও পড়তে পারে।
সে যা হবার হবে। কিন্তু একটি ক্ষুদ্র দেশ তার নাম লিখিয়ে ফেলেছে ইতিহাসের সোনালী পাতায়। একজন আবু বকর একবিংশ শতাব্দীর একটি সুপরিচিত ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন ইতিমধ্যেই। যে সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেনি কোনো প্রভাবশালী মুসলিম রাষ্ট্র, এমনকি রোহিঙ্গা পরিস্থিতির শিকার আমাদের দেশও। অং সান সুচির আন্তর্জাতিক আদালতে দেয়া বক্তব্য “গাম্বিয়া এ মামলা করতে পারে না, করলে বাংলাদেশ করতে পারে” খুবই অর্থবোধক।
মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এখন আজব কূটনীতি কাজ করছে। কারো জুলুম-নির্যাতন সম্পর্কে আওয়াজ বড় করার কথা উঠলেই ভয় করা হচ্ছে তার অন্য মিত্রদের। সামান্য একটি রাষ্ট্র বার্মা বা মিয়ানমার। তাকেও সমীহ করা হচ্ছে চীন, ভারত ও জাপানের জন্য। স্বাভাবিক কারণেই মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে- আমাদের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর কেন উন্নত কূটনৈতিক ব্যবস্থাপনা নেই? চীন-আমেরিকার মধ্যে অর্থনৈতিক দ¦ন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীর বহু দেশ কি তাদের উভয়ের সাথে বাণিজ্য চালাচ্ছে না? আমেরিকা ও রাশিয়ার সাথে সমানভাবে সামরিক সম্পর্ক রেখেও তো চলছে অনেকে। আর যত কূটনৈতিক ভীতি কেবল আমাদের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোরই। কিন্তু এতে কি ক্ষমতা স্থায়ী থাকবে?