অপরের মেযাজ-তবিয়ত বুঝে চলা : সামাজিক জীবনে শান্তির সোপান
তাবেয়ী যুগের একটি গল্প, হেলাল ইবনে ইসাফ [রহ.]-এর ঘরে মেহমান হলেন মুনযির ইবনে যালা সাওরী [রহ.]। দুজনই বিখ্যাত তাবেয়ী। প্রবীন তাবেয়ী রবী ইবনে খুসাইম [রহ.] তখনো জীবিত। হেলাল ইবনে ইসাফ অতিথিকে বললেন, চলুন না, শায়খের সাথে দেখা করে আসি। কিছু সময় ঈমানের কথা শুনে আসি। রবী ইবনে খুসাইম ছিলেন তাবেয়ীদের শায়েখ, গুরুজন ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি।
অতিথি মুনযির সাথে সাথে প্রস্ত্তত হয়ে গেলেন, অবশ্যই চলুন। কুফায় এসেছিই তো শায়েখ রবী ইবনে খুসাইমের সাথে সাক্ষাতের আশায়। তবে একটা কথা, শায়খের কাছে কি আমাদের যাওয়ার জন্য অনুমতি নেওয়া হয়েছে? আমি শুনেছি, অসুস্থতার পর থেকে তিনি নাকি ঘরেই অবস্থান করেন, সেখানেই ইবাদতে মশগুল থাকেন, সাক্ষাৎ-মোলাকাত পছন্দ করেন না।’ হেলাল ইবনে ইসাফ বললেন, তাঁর নির্জনপ্রিয়তা অসুস্থতার কারণে নয়। বরং কুফাবাসী আজীবন এমনই দেখে আসছে। অসুস্থতা তাঁর মধ্যে কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি।
দুজন প্রস্ত্তত হলেন। শায়খের কাছে যাবেন। তার আগে দুজন একটি জরুরি আলোচনা সেরে নিলেন। পাঠক! একটু লক্ষ্য করুন, শায়খের কাছে যাওয়ার আগ মুহূর্তে তাদের আলোচনাটা কী ছিল! লক্ষ করুন এবং অনুভব করুন। কথা কিংবা আচরণে অন্যের যেন কোন কষ্ট না হয় সে দিকে তাদের কেমন সজাগ দৃষ্টি ছিল! মুনযির বললেন, ‘কিন্তু আপনি তো জানেন এ পর্যায়ের মুরুববীদের মেযাজ বড়ই নাযুক।’ তাঁর কাছে গিয়ে কি কোন প্রশ্ন করব, না তিনি নিজ থেকে যা বলেন, চুপচাপ তাই শুনতে থাকব?
হেলাল বললেন, রবী ইবনে খুসাইমের তবিয়ত তো হল, তুমি তার সামনে এক বছরও যদি বসে থাক, নিজে অগ্রসর হয়ে কোন কথা বলবেন না। তুমি প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দেবেন। হেলাল ও মুনযির এরপর রবী-এর কাছে গেলেন।
প্রিয় পাঠক! এরপর তাদের মধ্যে কী কী কথা হল এবং আরো কী কী ঘটনা ঘটল সেসব এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজনীয় মনে করছি না। ঘটনার যতটুকু উল্লেখ করা হল তাতেই আমাদের জন্য অনেক বড় শিক্ষা নিহিত রয়েছে। সেই শিক্ষার মূল কথাটি হল, প্রত্যেকের সাথে তার মেযাজ ও তবিয়ত বুঝে আচরণ করা উচিত। হেলাল ও মুনযির [রহ.] রবী ইবনে খুসাইমের মজলিসে যাওয়ার আগে দেখুন তার মেযাজ ও তবিয়ত সম্পর্কে পরস্পরকে কীভাবে অবিহিত করছেন। সামাজিক জীবনের শান্তি ও সমৃদ্ধি এবং সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার বিরাট বড় একটি হাতিয়ার হল, এই মেযাজ বুঝে চলা। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যিন্দেগির বিভিন্ন ঘটনায় আমরা এই শিক্ষারই বহু নজির দেখতে পাই।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ আদর্শটি বর্তমানে দারুণভাবে অবহেলিত হচ্ছে। বিশেষ করে দেখা-সাক্ষাতের ক্ষেত্রের এ আদর্শটি বর্তমানে আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে বললে অত্যুক্তি হবে না।
কারো সাথে দেখা করার সময় আমরা নিজের সুবিধা ও স্বার্থগুলো আগে দেখি। যার সাথে দেখা করতে গেলাম তার সুবিধা-অসুবিধার প্রতি আমাদের নযর থাকে না। যে ব্যক্তির মেযাজ-তবিয়ত জানা নেই, তার সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইলে আগে তার কোনো নিকটজন থেকে তার মেযাজ-তবিয়ত জেনে নেওয়া উচিত।
নেযামুল আওকাত জেনে নেওয়া উচিত
কারো সাথে সাক্ষাতের আগে তার নেযামুল আওকাত জেনে নেওয়া দরকার। তিনি কখন কী কাজ করেন। তার সাথে মোলাকাতের নির্ধারিত সময় আছে কি না। সেটা কখন? নেযামুল আওকাত না জেনে কারো সাথে অসময়ে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া ঠিক নয়। এতে সাক্ষাৎদাতার নির্ধারিত কাজে বিঘ্ন ঘটে। সাক্ষাৎপ্রার্থীর উপর বিরক্তি জন্মে, যা সামাজিক জীবনের জন্য মোটেও কল্যাণকর নয়।
আমার এক মুহতারাম উস্তায একদিন খুব দুঃখ করে বলছিলেন, ‘আমি সেদিন কাজ করছিলাম, আমার ছোট কামরায়। কাজে যাতে কোনরূপ বিঘ্ন না ঘটে এবং মনোসংযোগ বিচ্ছিন্ন না হয় সে জন্যই আমি ছোট কামরায় বসি। মাগরিবের পর না কখন যেন সেখানে একটি জরুরি লেখা লিখছিলাম। আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ লেখার মধ্যেই ছিল। হঠাৎ পেছন থেকে একজনের সালাম। চমকে তাকালাম। একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। জানতে চাইলাম, কি জন্য এসেছেন? লোকটা যা বলল তাতে আমি বেশ বিস্মিত হলাম এবং একজন শিক্ষিত লোকের এমন বোকার মতো আচরণের কোন ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পেলাম না। সে বলল, ‘হুযুর! আপনার কাছে অমুক কিতাবটি আছে। আমার ওই কিতাবের একটি ফটোকপি দরকার।’
লোকটির এ আচরণে অবাক হওয়ার কী কারণ তা কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। লোকটির প্রয়োজন ছিল, প্রথমে আশপাশের লোকদের কাছে হুযুরের সাথে সাক্ষাতের নিয়ম জেনে নেওয়া। যখন লোকটি হুযুরকে বিশেষ কামরায় বিশেষ মনোযোগের সাথে একটি কাজে ডুবে থাকতে দেখল তখন তো তার উচিত ছিল কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরা কিংবা হুযুরের নেযামুল আওকাত জেনে আজ সুযোগ না হলে যোগাযোগ করে পরে কখনো আসা। যার কাছ থেকে একটি ফায়েদা হাসিল করার জন্য লোকটি এসেছে তার কাজের মধ্যে এভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি করে, তার অবস্থা বিবেচনা না করে লোকটি যা করল তা অনুচিত কাজ। লোকটি নিজের সুবিধাকে এক নম্বরে রেখেছে। এতে অন্যের কী অসুবিধা, কী ক্ষতি হচ্ছে সেদিকে লক্ষ করেনি।
এটা আমাদের সমাজের নিত্যদিনের চিত্র। সাক্ষাৎ করতে গিয়ে মানুষের হক নষ্ট করার একটি চিত্র প্রায়ই আমি দেখে থাকি। আমার এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। ঢাকার নামকরা একটি মাদরাসার নাযেমে তালীমাত, মাদরাসার বিভিন্ন দায়দায়িত্ব তাকে আঞ্জাম দিতে হয়। ব্যস্ত মানুষ। দায়িত্বের সুবাদে বিভিন্ন মানুষের সাথে তার ওঠাবসা। মাদরাসার দরসদানের যিম্মাদারিও রয়েছে। কিন্তু মাঝে মাঝে দেখা যায়, কেউ হয়তো তার সাথে সাক্ষাৎ করতে যায়। সাক্ষাৎ করতে গিয়ে কথা বলতে থাকে। সেই কথার নির্ধারিত কোনো বিষয়বস্ত্ত নেই। সাক্ষাৎ করতে এসেছে, তাই কথা বলতে থাকা। উদ্দেশ্যহীন কথাবার্তা, পূর্ব-পরিকল্পনাহীন আলোচনা। এ ধরনের কথাবার্তার দ্বারা আগত মানুষটি কিছু সময় কথাবার্তার স্বাদ অনুভব করেছে ঠিক, কিন্তু বেচারা নাযেমে তালীমাতের বিরাট একটা সময় নির্ধারিত নেযামের বাইরে খরচ হয়ে গেল এবং এর প্রভাব তার নিজস্ব কাজের মধ্যে যেমন পড়ে, প্রাতিষ্ঠানিক অনেক কাজও এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তী সময়ে এর মাশুল দিতে হয় বিভিন্নভাবে। তার কোনোটাই সেই সাক্ষাৎপ্রার্থীকে স্পর্শ করে না।
হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী [রহ.]-এর বদনাম করতো তৎকালীন কিছু বিরোধী লোক। তিনি নাকি রুক্ষ স্বভাবের। মানুষের সাথে তার আচরণ সুন্দর নয়। বদ-মেযাজি এবং আরো কি কি। আমার উস্তাদ হযরত মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব দা. বা. বলেন, ‘তাঁর এসব ‘বদনামের’ কারণ ছিল, তিনি মানুষকে এসব বে-উসূলি ও অসতর্ক আচরণের জন্য খুব ধরপাকড় করতেন। এসব ছোটখাটো বিষয় যেগুলোকে মানুষ গুরুত্বহীন মনে করে কিংবা অবহেলার কারণে ছেড়ে দেয় তিনি সেগুলোর সরাসরি ইসলাহের দিকে নজর দিয়েছিলেন। ইসলাহের উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে কঠোর ভাষা প্রয়োগ করতেন। তাঁর এ কঠোরতার প্রয়োজনও ছিল। সেকারণেই তাঁর নামে এই ‘বদনাম’।
যোগাযোগ করে আসা দরকার
প্রিয় পাঠক! আমাদের সমাজে এ ধরনের সমস্যার অভাব নেই। সব কিছুর মূলে হল আমাদের অসচেতনতা। অনেককে দেখা যায়, বর্তমানে যোগাযোগের এত সব সুন্দর মাধ্যম থাকা সত্ত্বেও ইত্তেলা না দিয়েই বহু দূর থেকে কারো সাথে সাক্ষাতের জন্য চলে আসে। এরপর ঘরের কাছে এসে সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করে। তখন ঘরের লোক যত গুরুত্বপূর্ণ কাজেই ব্যস্ত থাকুক, মানবিক কারণে তাকে সাক্ষাতের অনুমতি দান করে। সাক্ষাৎপ্রার্থী লোকটি সুদূর চিটাগাং থেকে ঢাকা চলে এসেছে শুধু সাক্ষাৎ করার জন্য- একথা জানার পর ঘরওয়ালা আর দেরি করে না। তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় কাজগুলো ছেড়ে হলেও তাকে সাক্ষাৎ দান করে।
এই যে কোনোরূপ ইত্তেলা না দিয়ে এতদূর থেকে হুট করে চলে আসা এরপর ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে অনুমতি চাওয়া- এই অনুমতি প্রার্থনার কোনো অর্থ হয় না। এটা বরং ঘরওয়ালার উপর এক ধরনের চাপ প্রয়োগ করার মতো। অথচ লোকটির উচিত তো ছিল, চিটাগাং থেকেই ফোনে কিংবা মোবাইলে যোগাযোগ করে সময় নিয়ে আসা। পূর্ব যোগাযোগের সকল সুবিধা থাকা সত্ত্বেও যোগাযোগ না করে এভাবে চলে আসার পর ঘরওয়ালা যদি তাকে ঘরের দরজা থেকেই ফিরিয়ে দেয়, তাহলে কত মন খারাপ করার ব্যাপার হয়। অথচ নিয়ম ও নীতিগতভাবে তার এই অধিকার পুরোপুরিই আছে।
এমনও হতে পারে, যার উদ্দেশ্যে এত দূর থেকে টাকা খরচ করে এত কষ্ট করে আসা হল, তার সাথে দেখাই হল না, সে নাই। কোনো কাজে কোথাও চলে গেছে। তখন তার যে কষ্ট ও অনুশোচনা হবে এর জন্য সে নিজেকে ছাড়া আর কাকে দায়ী করতে পারবে?
এরপর ঘরের লোকটি যখন জানতে পারবে যে, একটা লোক তার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসে সাক্ষাৎ না পেয়ে চলে গেছে, তখন তার মনেও তো একটা ব্যথা লাগবে। আফসোস জাগবে এবং মনে মনে সে কষ্ট পেতে থাকবে। তার এই আফসোস করা এবং কষ্ট পাওয়ার জন্য কে দায়ী? সে, নাকি ওই সাক্ষাৎপ্রার্থী লোকটি? এসবের কিছুই ঘটতো না যদি লোকটি আসার আগেই ফোন করে সব অবস্থা জেনে নিত।
পরিচয় দেওয়া উচিত
সাক্ষাৎ করতে এসে আমরা আরেকটি সমস্যা করে থাকি। নিজের পরিচয় সাফসাফ বলি না। অস্পষ্টতা রেখে দেই। কারো সাথে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার পর দরজায় নক করলাম। ভেতর থেকে পরিচয় জিজ্ঞেস করা হল। তখন আমার উচিত নিজের এতটুকু পরিচয় উল্লেখ করা যার দ্বারা ঘরওয়ালা আমাকে চিনতে পারে, যদিও আগে থেকে তার সাথে পরিচয় থাকে। কিন্তু আমরা অনেক সময় নিজের পরিচয় না দিয়ে এমন বলি যে, ‘অমুককে বলুন, একটা লোক এসেছে, আপনার সাথে দেখা করতে চায়।’ অথচ নিয়ম হল, প্রথমে নিজের পরিচয় দেওয়া, এরপর সাক্ষাতের আবেদন জানানো। পরিচয় দেওয়ার ব্যাপারেও লক্ষ্য রাখতে হবে, যতটুকু পরিচয় দিচ্ছি তাতে কি তিনি আমাকে চিনতে পারবেন। যেমন আমার নাম আবরারুয যামান। আদীব হুযুরের সাথে দেখা করতে গেলাম। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে এই বলে খবর পাঠালাম যে, ‘আবরারুয যামান এসেছে।’ আমার বিশ্বাস, এতটুকুতেই আদীব হুযুর আমাকে চিনে ফেলবেন। তাই এক্ষেত্রে এতটুকু পরিচয়ই যথেষ্ট। আমার নাম যদি আবরারুয যামান না হয়ে আব্দুর রহমান হতো তাহলে শুধু আবদুর রহমান এসেছে বললে চলতো না। তখন বলতে হতো, অমুক জায়গা থেকে অমুকের ছেলে আবদুর রহমান এসেছে।
আসলে এ বিষয়টা এমন যা শুধু উদাহরণ দিয়ে বোঝানো মুশকিল। আকল ও বুদ্ধি খরচ করে এগুলো বুঝে নিতে হয়। আমি অনেক সময় দারুণ একটা সমস্যায় পড়ি। সমস্যাটা কেমন তা লিখে বোঝাতে পারবো কি না জানি না। তবু চেষ্টা করে দেখি। আমার আববাকে অনেক মানুষ চিনে। ভক্তি করে। শ্রদ্ধা করে। আববার প্রতি ভক্তি, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার প্রকাশস্বরূপ আববার সন্তানদেরকেও স্নেহ করে। আমার ছোটকাল থেকে আমি এ জিনিসটি দেখে আসছি। সেই সুবাদে আববার অনেক ছাত্র ও ভক্ত আমাকে চিনেন, স্নেহ করেন। আমিও তাদেরকে এভাবেই চিনি যে, আববার ভক্ত ও আমাদের পরিচিত। কিন্তু তাদের নাম-ধাম-ঠিকানা কিছুই সুস্পষ্ট জানা নেই।
এমন লোকদের মধ্যে কেউ কেউ আববার সঙ্গে দেখা করতে এসে দরজায় নক করেন এবং আমার সঙ্গে দেখা হলে বলেন, ‘হুযুরকে বল আমি এসেছি।’ ব্যাস, এ পর্যন্তই। এতে আমি দারুণ এক সমস্যায় পড়ে যাই। লজ্জায় সংকোচে নাম জিজ্ঞেস করতে পারি না। যার সাথে এত পরিচয় তার নাম জিজ্ঞেস করি কীভাবে, আবার আববাকেও গিয়ে সুস্পষ্ট কিছু বলতে পারি না। আববাও বিরক্তি বোধ করেন। নাম না জানা ঘনিষ্ঠ কারো সাথে দেখা হলে অনেক সময় চমকে উঠি। এজন্য উচিত হল, প্রথম পরিচয়েই নামধাম জেনে নেওয়া এবং পরিচয় গাঢ় হওয়ার আগেই বারবার জিজ্ঞেস করে হলেও নাম আত্মস্থ করে রাখা। পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও নাম না জানা কিংবা নাম ভুলে যাওয়া-এটা অবশ্যই একটা দুর্বলতা এবং সামাজিক জীবনের একটি নিন্দনীয় বিষয়। এ ধরনের সমস্যা আমি মনে করি আমার মতো আরো অনেকের আছে। এক্ষেত্রে আমার মতো লোকদের করণীয় হল, লজ্জা সংকোচ বিসর্জন দিয়ে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠজনের নামও জিজ্ঞেস করা। কয়েকবার এমন হলে, আমার যতটুকু ধারণা এই রোগ আর থাকবে না। আর পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ সেসব লোকের জন্য উত্তম হল, পুরনো পরিচয়ের উপর নির্ভর না করে নিজের পরিচয়-সংবাদ পৌঁছানো। হুযুরকে গিয়ে বল আমি এসেছি না বলে, হুযুরকে বল অমুক জায়গা থেকে অমুক এসেছে বলাই উত্তম। অনেকে অবশ্য এমনটিই করে থাকেন। তখন ভেতর ভেতর খুব স্বস্তি বোধ করি। আমি যেহেতু এ সমস্যার ভুক্তভোগী, এজন্য আমি কোথাও কারো সাথে দেখা করতে গেলে এ নিয়মটি পালন করার চেষ্টা করি।
দেখা-সাক্ষাৎ সম্পর্কিত আরেকটা বিষয়। আব্দুল মালেক সাহেব দা. বা. সেদিন খুব দুঃখ নিয়ে কথাটা বললেন। কিছু মানুষ অযথাই অসত্য কথা বলে। কোন কাজে হয়তো কোথাও গেছে। কাজ শেষ করার পর মনে পড়ে, এখানে যখন এসেছি অমুকের সাথে এই সুযোগে দেখা করে আসি। অমুকের কাছে দেখা করতে যাওয়ার পর অমুক যখন আগমনের কারণ জিজ্ঞেস করে তখন কথায় বা ভাবে এ কথা বোঝায় যে আপনার সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে এসেছি। অথচ তার উচিত ছিল এভাবে বলা যে, একটা কাজে এখানে এসেছিলাম। আপনার কথা মনে পড়ল। কখনো আবার সুযোগ হয় কি না। এই সুযোগে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম। আর নয়তো এটা এক ধরনের খেয়ানত হিসেবে গণ্য হবে।
মাদরাসাতুল মাদীনায় পাঁচ বছর পড়াশোনা করে যখন অন্য মাদরাসায় ভর্তি হলাম, মাঝে মাঝে মাদরাসাতুল মাদীনায় যেতাম। এই যাওয়া কখনো মাদরাসাতুল মাদীনার উদ্দেশ্যে হতো, কখনো আত্মীয়দের বাড়ি বেড়ানোর উদ্দেশ্যে হতো। তখন আদীব হুযুরের সঙ্গে দেখা করলে হুযুর আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, কোথায় এসেছিলে। মাদরাসাতুল মাদীনায় এসেছো, না খালা-মামার বাড়ি বেড়াতে এসেছো? আমি তখন বোকার মতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উত্তর দিতাম। এ ধরনের প্রশ্নের কী তাৎপর্য, অনেকদিন পর্যন্ত তা বুঝিনি, যখন বুঝেছি, হুযুরের প্রতি মনটা কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠছে। সেদিন আব্দুল মালেক সাহেব হুযুর একই প্রসঙ্গ যখন তুললেন, অনেক বছর আগে মাদরাসাতুল মাদীনার বারান্দায় আদীব হুযুরের সঙ্গে সাক্ষাতের দৃশ্য মনে পড়ে গেল। বড়রাতো এভাবেই শিখিয়ে থাকেন।
সাক্ষাতের উদ্দেশ্য গোপন রাখা
অনেকে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে উদ্দেশ্যের কথা গোপন রাখে। জিজ্ঞেস করলে বলে, দেখা করার জন্য এসেছি। সাক্ষাৎ শেষে বিদায়ের সময় হলে বলে, একটা কথা ছিল। এরপর সে তার আগমনের আসল উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে। অথচ প্রথমেই তার উদ্দেশ্যের কথা জানিয়ে দিলে এতক্ষণ হয়ত সেই আলোচনা শেষ হয়ে যেতো। সৌজন্য সাক্ষাৎ মনে করে যে সময়টা ব্যয় করা হলো, তা আর নষ্ট হতো না। এজন্য যেকোন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে সাফসাফ বলে দেওয়া উচিত কোত্থেকে এসেছে, কেন এসেছে ইত্যাদি। সাক্ষাৎদাতাও এতে স্বস্তি বোধ করতে পারেন। বিশেষ করে যারা কর্মব্যস্ত তাদের বেলায় তো এ নিয়মটি আরো বেশি প্রযোজ্য।
সাক্ষাৎ না পেলে পরিচয় না দিয়েই চলে যাওয়া
কারো সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলাম, তাকে পেলাম না, অপেক্ষা করার সুযোগ নেই। তখন করণীয় হল, আশপাশের দায়িত্বশীল কাউকে নিজের পরিচয় জানিয়ে আসা। আর নয়তো যার সাথে দেখা করতে গেলাম সে যখন জানবে একজন লোক তার খোঁজে এসেছিল, তখন সে পেরেশান হবে। কে এসেছিল, কেন এসেছিল। আবার আসবে কি না, কখন আসবে ইত্যাদি। অবশ্য এ বিষয়টি এমন ব্যক্তির ব্যাপারেই অধিক প্রযোজ্য যার কাছে মানুষের যাতায়াত কম। আর যার কাছে অহরহ লোকজন আসছে যাচ্ছে তার জন্য কারো আগমন সংবাদ তেমন পেরেশানির কারণ হয় না।
ফোনে কিংবা মোবাইলে কথা বলার শুরুতেই পরিচয় দেওয়া উচিত
একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এল। অপর দিক থেকে পুরোদমে কথা শুরু হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, কে বলছেন? উত্তর এল, চিনতে পারনি? ক্ষমা প্রার্থনার স্বরে বললাম, না, ভাই চিনতে পারিনি। অপর দিক থেকে অনুযোগ কিংবা অভিমানের কষ্ঠ ভেসে এল। এত জলদি ভুলে গেলেন? এভাবে কিছুক্ষণ কথা চলতে থাকল। এক পর্যায়ে সে তার পরিচয় দিল। তখন আমার মধ্যে স্বস্তি ফিলে এল। ‘ও আচ্ছা আপনি।’
কথা বলার এ পদ্ধতিটি ভুল। এতে প্রথমত বিনা প্রয়োজনে মূল্যবান কিছু সময় খরচ হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত পরিচয় না পাওয়া পর্যন্ত এপাশের লোকটি চরম অস্বস্তির মধ্যে থাকে। অপর ব্যক্তিটিও কখনো একথা ভেবে কষ্ট পেয়ে থাকে যে, আমাকে চিনল না!
সেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ ফোন এল। ফোন তুললাম। অপর দিক থেকে প্রশ্ন, ‘আবরার ভাই, কেমন আছেন? বললাম, ভাল, আলহামদু লিল্লাহ। কণ্ঠটি আবার বলে উঠল, আবরার ভাই, একটা প্রশ্ন, জুমার নামাযের আযান দুটি কেন? জানতে চাইলাম, আপনি কে বলছেন? কণ্ঠটি বলল, আগে উত্তর দিন, তারপর বলছি। আমি তখন দুটি সমস্যার মধ্যে পড়লাম। প্রথম সমস্যা, তাকে সম্বোধন করবো কী বলে। তুমি না আপনি, দ্বিতীয় সমস্যা, পরিচিত ও অপরিচিত হিসেবে বলার ধরণ বিভিন্ন হয়। উত্তরটা কোন উসলুবে দেব? তাকে চিনতে পারলে বলার উসলুব নির্ধারণ করা যেত। এ অবস্থায় আমার উচিত ছিল, কোন উত্তর না দিয়ে তার পরিচয়ের অপেক্ষা করা কিংবা ফোন রেখে দেওয়া। তা না করে ভদ্রতা করে আমি উত্তর দিলাম। এরপর সে তার পরিচয় দিল। এ পরিচয়টা যদি আগেই সে দিয়ে দিত এতসব ভোগান্তি পোহাতে হত না। আরো স্বাভাবিক ও সহজভাবে উত্তর দেওয়া যেত। সম্বোধনটাও অপরিচয়ের সুরে ‘আপনি’ হতো না। তুমি তে চলে আসতো।
প্রিয় পাঠক! আমার লেখার বিষয় ছিল, দেখা-সাক্ষাৎ, তার মধ্যে ফোনের প্রসঙ্গ কেন চলে এল বুঝতে পারছি না। আসলে লেখাটি লিখতে বসার পরই এধরনের একটি ফোন এসেছিল। তাই ফোনের বিষয়টিকেও লেখার মাঝেই স্থান দিয়ে দিলাম। এতে যদি সবাই কিছু সচেতন হই সবারই হয়তো উপকার হবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।