রবিউল আউয়াল ১৪২৯   ||   মার্চ ২০০৮

বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট : কারণ ও প্রতিকার

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

আলকাউসারের গত সংখ্যায় খাদ্যমূল্যের উপর লিখতে গিয়ে বলা হয়েছিল যে, বর্তমানে চাল-আটার দাম বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসাবে পেশ করা হয় বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকটের বিষয়টিকে। অর্থাৎ সারা বিশ্বে এখন চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য উৎপাদনের মাত্রা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। আর বাংলাদেশ যেহেতু খাদ্যে স্বনির্ভর নয়, এখনো তাকে আমদানির উপর নির্ভর করতে হয়, তাই বিশ্ববাজার থেকে বেশি মূল্যে চাল কিনে এনে দেশে তো কম দামে তা বিক্রি করা যাবে না।

এখানে দু’টি জিনিস দেখার বিষয়- [১] বাস্তবেই কি বিশ্ববাজারে খাদ্যের মূল্য বাড়ার কারণেই আমাদের দেশে তা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। [২] বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকটের কারণ কী এবং তা প্রতিকারের উপায় কী? এবং খাদ্য উৎপাদনের ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা কী?

দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়ে আজকে আলোচনা করার চেষ্টা করা হবে। যদিও আমাদের দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের [চাল, আটা, ডাল ও তেল] অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির মূল কারণ বিশ্ববাজারে মূল্যের বৃদ্ধি পাওয়া কি-না তা নিয়ে অনেক অভিজ্ঞ মহলেরই ভিন্নমত রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে লিটার প্রতি তেলের মূল্য ৬ টাকা বাড়লেও আমাদের দেশে বেড়েছে ৩০-৪০ টাকা এবং তা বেড়েই চলেছে। এমনিভাবে পার্শ্ববর্তী দেশ [বাংলাদেশের সর্বাধিক চাল রপ্তানিকারক দেশ] ভারতে মোটা চালের দাম ১১-১২ টাকা হলেও ভারতীয় সরকারের এলসি মূল্য-বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী দেশে চালের দাম বাড়িয়ে নিচ্ছে ইচ্ছা মতো। অন্যদিকে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের হাত করে ওই দেশের বাজার-দরে চাল খরিদ করছে এবং এলসিতে পরিশোধ করা অতিরিক্ত ডলার দেশে ফেরত নিয়ে আসছে হুন্ডির মাধ্যমে। আর যাদের দু’দেশেই ব্যবসা রয়েছে এবং উভয়স্থানেই আত্মীয়-স্বজন রয়েছে তাদের তো আর অতিরিক্ত ডলার ফেরতও আনতে হচ্ছে না। এভাবে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হচ্ছে এবং দেশের সাধারণ লোক এলসিমূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে উচ্চমূল্যে খাদ্যদ্রব্য খরিদ করতে বাধ্য হচ্ছে।

উপরোক্ত প্রতিবেদনটি একটি বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিকের। এমনিতে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে আগে খরিদকৃত এবং দেশীয় গুদামজাত পণ্যের দামও যে এদেশে রাতারাতি বাড়িয়ে দেওয়া হয় তা তো কারো অজানা নয়। গত ডিসেম্বরে হঠাৎ চালের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টিই ধরা যাক। ভারতের রপ্তানিমূল্য বৃদ্ধির ঘোষণার সাথে সাথে এখানে বাজারে মূল্যবিস্ফোরণ ঘটল। অথচ তখন যে চালের দাম বাড়ানো হল তা কমমূল্যে আগে খরিদকৃত এবং মজুদকৃত চাল। এমনকি সরকার ওএমএস-এর চালের দাম বাড়িয়ে দিল ২৫%। করল ২০ থেকে ২৫ টাকা। সরকার তো আর ওই চালগুলো বর্ধিত মূল্যে কিনে আনেনি। আসলে তথাকথিত মুক্তবাজার বা পুঁজিবাদী অর্থনীতির কুফলগুলোর মধ্যে এটি একটি। পুঁজিবাদীরা মুক্তবাজারের ধুয়া তুলে এভাবেই বিভিন্ন পন্থায় গরীব-দুঃখীদের কষ্টার্জিত টাকা হাতিয়ে নিয়ে থাকে। এবার মূল আলোচনায় আসা যাক।

 

বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট কেন এবং তার প্রতিকার কী?

এ প্রশ্নের সহজ জবাব হল, চাহিদা অনুপাতে খাদ্য উৎপাদন কম হচ্ছে। অতএব উৎপাদন বাড়াতে হবে। একটু বিস্তারিত উত্তর দিলে বলা যায়-

১। বিশ্বের যতগুলো জমি স্বাভাবিকভাবেই কৃষিকাজে ব্যবহারযোগ্য তার একটা বিরাট অংশই পতিত থাকছে।

২। বহু রাষ্ট্রে লক্ষ লক্ষ হেক্টর এমন জমি রয়েছে যা প্রক্রিয়াজাত করে কৃষির যোগ্য করা সম্ভব অথচ বর্তমানে তা পতিত পড়ে আছে।

৩। কৃষি উৎপাদন দরিদ্রদের হাতে হলেও অধিকাংশ জমির মালিক ধনাঢ্য ব্যক্তিরা। আর তাদের অনেকেই জমিতে ফসল ফলানোর প্রয়োজন অনুভব করে না।

৪। দুনিয়াব্যাপী কৃষির ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার ঘাটতি এবং সরকারের বিপরীতমুখী নীতি।

৫। টাকাওয়ালাদের শিল্পের প্রতি ঝোঁক।

৬। বিশাল বিশাল বাড়ি-বাগানবাড়ি করে কৃষি জমি নষ্ট করা।

৭। খরচ অনুযায়ী ফলন না হওয়ায় উৎপাদন অলাভজনক হওয়া।

৮। ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য বেশি হলেও অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদকরা সঠিক মূল্য পায় না, বরং এতে বড় অংকের ভাগ বসায় মধ্যস্বত্বভোগী, মহাজন, সুদখোর ও পাইকার-আড়তদাররা।

৯। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল বিনষ্ট হওয়া।

আসলে আমরা পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ ছুটছি উল্টো পথে। সকল প্রাণীর জন্য যে খাদ্যশস্য অপরিহার্য তা বিশ্বব্যাপী ক্রমেই কম গুরুত্বের বিষয় হয়ে উঠছে। কৃষির সাথে জড়িত লোকজন হয়ে পড়ছে অবহেলিত। অন্যদিকে খেলাধুলা, তথাকথিত বিনোদন এবং অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় শিল্পের গুরুত্ব বাড়ছে এবং সেগুলোতে বিনিয়োগ হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ক্যাপিটালিজমে যেহেতু বিশ্বের অধিকাংশ সম্পদের মালিক সীমিত কিছু লোক এবং তারাই ক্ষমতাবান, নীতিনির্ধারক, আবার কেউ পরোক্ষভাবে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক, আর এদের জন্য খাদ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্য কোন সমস্যাই নয়, তাই দুনিয়াব্যাপী বস্ত্তবাদী সমাজ খাদ্য উৎপাদনের দিকে যথাযথ নজর দিতেই বেমালুম ভুলে গেছে। আবার অনেক ক্ষমতাবান, খাদ্য রপ্তানিকারক রাষ্ট্র নাকি ইচ্ছে করেই তাদের কৃষকদেরকে খাদ্য উৎপাদন বাদ দিয়ে তুলা ইত্যাদি চাষে লাগিয়েছে। যাতে তারা খাদ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিলে জনসংখ্যাঘন দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো খাদ্য সংকটে পড়ে যায় এবং খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে ওই দেশগুলো অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। একটি দেশের আচরণ তো সবাই দেখতে পেল। তাদের বাজারে চালের যে দাম তার চেয়ে প্রায় ২৫% বেশি রপ্তানিমূল্য নির্ধারণ করেছে সে দেশের সরকার। অজুহাত হিসাবে বলা হয়েছে তাদের দেশেও খাদ্যসংকট রয়েছে। তাই নিজেরা না খেয়ে তো আর অন্যকে খাওয়াতে পারে না। প্রশ্ন হল বেশি দামে চাল রপ্তানি করলে তো তাদের টাকাই বাড়বে চাল তো আর বাড়বে না। তাহলে তারা কী খাবে। এপ্রশ্নের জবাব তো অজানাই থেকে যাচ্ছে।

 

ইসলাম কী বলে

ইতিহাসের কোনো বর্ণনামতে মানবকুলের আদি পিতা হযরত আদম আলাইহিস সালামকে পৃথিবীতে প্রেরণের পর আল্লাহ তাআলা এক জোড়া ষাড় পাঠিয়ে দিয়েছেন এবং ফেরেশতার মাধ্যমে চাষাবাদের পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছেন। সে প্রথম মানব থেকেই খাদ্য-উৎপাদনের পেছনে মানুষ কসরত করে আসছে যুগে যুগে।

আলকুরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ বিভিন্নভাবে বহু জায়গায় খাদ্য-শস্য উৎপাদন ও কৃষির বিষয়টি গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন। কখনো নিজের কুদরত প্রকাশের জন্য, কখনো নিজ নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য, কখনো সম্ভাব্য খাদ্যসংকট মোকাবেলায় রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা প্রসঙ্গে, আবার কোনো কোনো স্থানে উদাহরণ ও উপমা হিসাবে এসেছে খাদ্য ও কৃষিপণ্য উৎপাদনের কথা। পূর্ববর্তী উম্মতের বিভিন্ন কাহিনী বর্ণনায়ও উঠে এসেছে কৃষি প্রসঙ্গ। এভাবেই সৃষ্টিকর্তা তাঁর শ্রেষ্ঠ মাখলুককে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। আর হাদীসের কিতাবসমূহে তো বেশ কয়েকটি পরিচ্ছেদই রয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও কৃষিবিষয়ক। ইহয়াউল মাওয়াত, আলমুযারাআ, আলমুসাকাত, আশশিরব প্রভৃতি পরিচ্ছেদে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এবিষয়ক নির্দেশনাসমূহ বর্ণিত হয়েছে এবং পরবর্তী যুগে মুজতাহিদ-ফকীহগণ বিশাল বিশাল ভলিউম লিখে গেছেন খাদ্য-শস্য তথা কৃষি পণ্য উৎপাদন ও বণ্টন ইত্যাদির নীতিমালার উপর। এখানে শুধু নমুনাস্বরূপ কয়েকটি মৌলিক নীতি ও নির্দেশনার কথা তুলে ধরা হচ্ছে।

 

[১] সকল উর্বর জমিতে ফসল করতে হবে

ইসলামের দৃষ্টিতে সকল উর্বর জমি চাষের আওতায় নিয়ে আসা চাই। জমির মালিক যেই হোক তা যেন অনাবাদ না থাকে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘‘তোমাদের যার জমি আছে সে যেন তাতে চাষাবাদ করে, যদি নিজে না করতে চায় তবে যেন অন্য ভাইকে জমিটি চাষ করার জন্য দান করে দেয়।’’

এটি ইসলামের আখলাকি তথা নৈতিক নির্দেশনা। তবে বিশেষ প্রয়োজনে ইসলামী রাষ্ট্র অস্থায়ীভাবে এমন আপদকালীন আইনও করতে পারে, যাতে করে ফসল উৎপাদনে অনাগ্রহী জমির মালিক আগ্রহী কৃষকদেরকে তা বিনিময় ছাড়া ধার দেয়। এভাবে সকল উর্বর জমিকে চাষের আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশনা প্রদান করেছে ইসলাম।

 

[২] অনুর্বর জমিকে উর্বর করা

শুধু উর্বর জমিতে ফসল করার নির্দেশনা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি ইসলাম। বরং মরুভূমি এবং অন্যান্য অনুর্বর জমিকে সেঁচের মাধ্যমে চাষের আওতায় নিয়ে আসার এক অপূর্ব ও যুগান্তকারী ঘোষণাও প্রদান করেছেন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি কোনো মৃত [অনুর্বর] জমিকে জীবিত করবে সেটির মালিক হবে সে নিজে।’’ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বা পরিত্যাক্ত সম্পত্তি কেউ স্ব-উদ্যোগে আবাদ করে ফসলের উপযুক্ত করলে এর মালিকানা-স্বত্ব সে ভোগ করবে। এমনটি করতে হলে সরকারের পূর্বঅনুমোদন নেওয়া লাগবে কিনা-এ ব্যাপারে মুজাতাহিদীনে কেরামের দু’টি মত রয়েছে। তবে বিষয়টি সকল মাজহাবে স্বীকৃত। ফিকহ ও হাদীসে বিষয়টি ‘ইহয়াউল মাওয়াত’ নামে প্রসিদ্ধ। যার অর্থ হচ্ছে, ‘মৃতদের জীবিত করা।’ এভাবেই ইসলাম সকল খালি ভূমিকে ফসল উৎপাদনের আওতায় এনে খাদ্যসংকট থেকে বাঁচার পথ দেখিয়েছে। সমগ্র বিশ্বে যত জমি খালি পড়ে আছে সেগুলোর কিছু অংশও যদি এভাবে উর্বর করে তাতে খাদ্য উৎপাদন করা হয় তবে সহজেই বর্তমান সংকট দূর করা সম্ভব।

 

[৩] ভূমিহীনদের ভূমি বরাদ্দ দান

হাদীস ও সীরাতের কিতাবসমূহে একটি অধ্যায় রয়েছে ‘আলইক্তা’ নামে। যার অর্থ জমি বরাদ্দ দান। দেশের পরিত্যক্ত ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সরকারের প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমিগুলো ভূমিহীনদের মাঝে বরাদ্দ দেওয়ার বিধান রয়েছে ইসলামে। বর্তমানে দেখা যায় ‘তেলা মাথায় তেল দেওয়া’র অবস্থা কার্যকর। অর্থাৎ সরকারি জমি বরাদ্দ পেয়ে থাকেন প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিগণ। প্রান্তিক কৃষকগণ তার আশাও করতে পারে না। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে তারাই এ ব্যাপারে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। আর তাদের হাতে জমি গেলেই সেটিতে ফসল উৎপাদিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সরকার ইচ্ছা করলে চাষাবাদ করার শর্তেই তা ওদেরকে দিতে পারে।

 

[৪] আলমুযারাআ

এটি ইসলামী বর্গা ব্যবস্থা। জমিমালিক ও কৃষকের মাঝে কিছু শর্তযুক্ত চুক্তির মাধ্যমে এটি কার্যকর হয়। এ ব্যবস্থার ফলে জমির মালিক নিজে ফসল না করতে পারলেও অন্য কৃষক দিয়ে করিয়ে লাভবান হতে পারে। অপর দিকে কৃষি কাজে পারদর্শী লোকজন অন্য মানুষের জমিতে ফসল করে উপকৃত হওয়ার সুযোগ পায়। আর এ ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বেড়ে দেশের খাদ্যভান্ডার সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

 

[৫] সেচ ব্যবস্থাপনা

ইসলামের দৃষ্টিতে নদীনালা ও খালবিলের পানি যৌথ সম্পদ। এতে কখনো ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় না। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘‘মানুষ তিনটি বিষয়ে যৌথ অংশীদার- পানি, আগুন ও ঘাস।’’ ইসলাম এ ব্যবস্থা এজন্য দিয়েছে যেন কোনো প্রভাবশালী, ক্ষমতাবান বা ধনাঢ্য ব্যক্তি এককভাবে সকল পানি কুক্ষিগত করে নিতে না পারে। এমনকি কারো যদি ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গায় সেচের অনেক পানি থাকে এবং তা লোকটির কোনো কাজে না আসে তবে ওই পানিও অন্য কৃষকদেরকে তাদের জমির জন্য দিয়ে দিতে ইসলাম উৎসাহিত করে।

 

[৬] মনোপলি ও গোপন স্টক নিষিদ্ধ

বর্তমানে প্রায়ই দেখা যায়, কোনো দ্রব্যের দাম বাড়ার গন্ধ পেলেই বা কোনো গুজবের আওয়াজ পেলেই এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী তাদের সকল স্টক গোপন করে ফেলে এবং বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। ইসলামে এর কোনো সুযোগ নেই, বরং এ ধরনের সকল মজুদদারি ইসলামে নিষিদ্ধ। কেউ এমনটি করলে সে কঠিন শাস্তি পাওয়ার যোগ্য এবং তার সকল অবৈধ স্টক খোলা বাজারে এনে সাধারণ মূল্যে বিক্রি করে দেওয়া ইসলামের নির্দেশ। মোটকথা, এ ধরনের বহু পন্থা অবলম্বন করে এবং বিভিন্নভাবে নির্দেশনা প্রদান করে ইসলাম খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এবং তা বাজারে সহজলভ্য করার ব্যবস্থা দিয়েছে। এসবের আলোকে বিশ্বব্যাপী খাদ্য-সংকট দূরীভূত করার জন্য যা যা করা দরকার তা হল-

* শুধু শিল্পের প্রসার নয়, সাথে সাথে কৃষির প্রবৃদ্ধির উপরও নজর দিতে হবে।

* আমাদের মত দরিদ্র দেশে কৃষিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করতে হবে। সময়মত যেন কৃষকরা সার, বীজ পায় এবং সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

* দেশের সকল উপযুক্ত জমিকে কৃষির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

* কৃষি জমিতে প্রয়োজনের অধিক বিশাল বিশাল বাড়ি, বাগান-বাড়ি করে কৃষি জমি নষ্ট করা বন্ধ করতে হবে।

* প্রয়োজনে কৃষকদেরকে বিনা মুনাফায় ঋণ দিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কারেন্ট একাউন্টে গচ্ছিত টাকার একটি অংশ দ্বারাও এ কাজ করা যেতে পারে।

* উচ্চ ফলনশীল বীজ ব্যবহার করে এবং গবেষণার মাধ্যমে এক ফসলি জমিকে দু’ফসলি করে উৎপাদন বাড়াতে হবে।

* মানুষের তেমন কোনো কাজে আসে না অথবা শুধুই তথাকথিত বিনোদনের কাজে আসে এমন কোনো কাজের জন্য বা এ ধরনের পণ্য তৈরির জন্য শিল্প-কারখানা করে জমি নষ্ট করা বন্ধ করতে হবে।

* জাতিসংঘ ও ডব্লিউএফসি [বিশ্বখাদ্য কর্মসূচি]-এর মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের খালি পড়ে থাকা জমিগুলোর একটি বড় অংশকে ক্রমান্বয়ে কৃষির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এভাবেই খাদ্য উৎপাদন বাড়বে এবং সংকট দূর হবে ইনশাআল্লাহ।

মনে রাখতে হবে, খাদ্য দ্রব্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রেখে সেগুলোর মূল্য সাধারণ লোকের নাগালের মধ্যে না রাখলে এর কুপ্রভাব শিল্পের উপরও পড়তে পারে। কারণ শ্রমিক তার বর্তমান আয় দ্বারা নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যাদি না কিনতে পারলে সে বেতন বাড়ানোর জন্য আন্দোলন করবে। আর বাজার চাহিদা অনুযায়ী তাদের বেতন দিতে গেলে অনেক শিল্পই টিকে থাকতে পারবে না। অপরদিকে দরিদ্র মানুষ প্রয়োজনের দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত শিল্পপণ্য কিনতে আগ্রহী হবে না। সুতরাং সময় থাকতেই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

 

 

advertisement