রবিউস আখির ১৪৪১   ||   ডিসেম্বর ২০১৯

দু র্ঘ ট না

বিন কাসিম

প্রয়োজন জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা

গভীর রাত। চারদিকে নিরবতা। শুধু রেলের ঝিকঝিক শব্দ। যাত্রীরা সবাই ঘুমিয়ে আছে। হারিয়ে গেছে গভীর নিদ্রায়।  কে জানত এ নিদ্রাতেই হয়ত হারিয়ে যাবে চিরনিদ্রায়। রাত তখন বাজে প্রায় তিনটা। হঠাৎ বিকট শব্দে  কেঁপে উঠল পুরো রেল। এরপর শুধু কান্না। বুকফাটা আহাজারি। রক্তের স্রােত। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাশ। 

গত ১১ নভেম্বর দিবাগত রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঘটে গেল বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ দুর্ঘটনাগুলোর একটি। সেদিন রাত পৌনে তিনটার দিকে মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনের আউটারে (বহিঃঅংশে) চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী আন্তনগর তূর্ণা নিশীথা এবং সিলেট থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেসের সংঘর্ষ হয়। উদয়নের মাঝামাঝি তিনটি বগিতে সজোরে ঢুকে যায় তূর্ণা নিশীথা। এতে ১৬ জন যাত্রীর প্রাণহানি ঘটে এবং শতাধিক যাত্রী আহত হন।  ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার আগে তূর্ণা নিশীথার লোকোমাস্টার (চালক) একটি নয়, দুটি সংকেত অমান্য করেন। দুর্ঘটনার আগে চারটি সংকেতই তূর্ণার জন্য বিপজ্জনক ছিল।  রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান বলেন, একটি রেলস্টেশনে মোট চারটি সংকেত থাকে। আউটার, হোম, স্টার্টার, এডভান্স স্টার্টার। তূর্ণার চালক আউটার ও হোম দুটি সংকেতই অমান্য করেছেন। এ কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।

এই অনিরাপদ যোগাযোগব্যবস্থার দেশে রেলপথকেই মানুষ একটু নিরাপদ মনে করে। কিন্তু সেটাও ধীরে ধীরে  অনিরাপদ হয়ে উঠছে। গত ১১ নভেম্বর সোমবার রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভয়াবহ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৬ জন। এ ভয়াবহ ঘটনার মাত্র দু’দিন পরই আবারো ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটল সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়। রেল বিভাগের হিসাবে গত পাঁচ বছরে ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ১২৮। এরই মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলের পাকশী রেল বিভাগে জনবল সংকটের কারণে ৪৪টি স্টেশন বন্ধ রয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রেন দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ সংকেত না মানা। তূর্ণা নিশীথা ট্রেনকে আগেই সংকেত দিয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু ট্রেনচালক সংকেত না মানায় এ ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে। আইন না মানা, সিগন্যাল অমান্য করা আজ সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যে যার মত যেভাবে ইচ্ছা গাড়ি চালায়। কোনো কিছুর তোয়াক্কা করে না। এমন উগ্র ও স্বেচ্ছাচারমূলক আচরণের কারণে দেশজুড়ে সড়ক ব্যবস্থায় ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। অথচ এক্ষেত্রে সড়ক আইন মেনে চললে আমাদের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা হতে পারত সুশৃংখল ও নিরাপদ।  উন্নতবিশে^ সড়ক ব্যবস্থায় শৃংখলার অন্যতম প্রধান কারণ- এসংক্রান্ত আইন ও নিয়ম-কানুন মেনে চলা এবং কঠোরভাবে এর প্রয়োগ।

শাইখুল ইসলাম তাকী উসমানী দা. বা. দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের একটি বিবরণ দিয়েছেন এভাবে- “আজ থেকে ১৫ বছর আগে আমি প্রথমবার দক্ষিণ আফ্রিকা যাই। সেখানে দেখেছি, প্রত্যেক ছোট থেকে ছোট মোড়ের প্রান্তে রাস্তার উপর কালো রেখা অংকিত রয়েছে।  আর কোথাও কোথাও মোড় ছাড়াই এরূপ রেখা দেখা যায়। আমি সফরকালে দেখলাম যে, গাড়ীচালক এ লাইনের কাছে পৌঁছেই কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে যায় এবং ডানে-বামে দেখে সম্মুখে অগ্রসর হয়। অমি খুবই বিস্মিত হই- বহুদূর পর্যন্ত সড়ক জনশূন্য থাকা সত্ত্বেও ড্রাইভারের যত তাড়াই থাক কিংবা কথায় লিপ্ত থাক না কেন, অবশ্যই সে ঐ রেখায় এসে দাঁড়িয়ে যায় এবং তার ঘাড় নিজে নিজেই ডানে বামে ঘুরে যায়। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলে, এদেশে ট্রাফিক আইন হল, প্রত্যেক মোড়ে কিংবা যেখানেই এ রেখা টানা আছে সেখানে গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভারকে অবশ্যই ডানে বামে দেখতে হবে। এই আইন পালন করতে করতে আমাদের এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে, কোনো মোড় দেখলে কিংবা মাটিতে এই রেখা দেখলে আপনা আপনি পা ব্রেকে চলে যায় এবং গাড়ি থামতেই ঘাড় ডানে বামে ঘুরে যায়। তারপর যতদিন সেখানে অবস্থান করেছি একই দৃশ্য দেখেছি। এমন একজনও পাইনি, যে এই নিয়ম লংঘন করেছে।”

জীবন চলার পথে আমাদের ব্যক্তিগত অনেক আচরণের ফলাফল শুধু ব্যক্তির মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু যখন আমরা গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে অধিষ্ঠিত হই তখন আমার আচরণ বা সিদ্ধান্তের সাথে জড়িয়ে থাকে হাজারো মানুষের কল্যাণ ও জীবন। এসকল ক্ষেত্রে  সর্বোচ্চ সতর্কতা ও সচেতনতা প্রয়োজন। কারণ তখন একজন মানুষের সামান্য একটু গাফলতি ও ভুলের কারণে হাজারো মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুর্ঘটনাটি আমাদের সামনে এ বিষয়টিই আরো স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়ে গেল। একজন মানুষের সামান্য একটু গাফলত ও ভুলের জন্য কতগুলো প্রাণ ঝরে গেল। কত মানুষ জীবনের তরে পঙ্গু হয়ে গেল। বাস বা ট্রেন চালকদের এধরনের ভুল ও গাফলতি অমার্জনীয় অপরাধ। শুধু বাস বা ট্রেনেরই চালক নন, যেকোনো প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, কোম্পানী ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা আছেন, যাদের আচরণ বা সিদ্ধান্তের সাথে অনেক মানুষের ভাগ্য জড়িত, যাদের একটু ভুল সিদ্ধান্তও ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

কেউ কেউ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের আরো উন্নত প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা বলেছেন। আসলে শুধু প্রশিক্ষণই সবকিছু নয়; প্রয়োজন প্রশিক্ষণের উপর আমল ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি। শুধু প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কি এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব? সংকেত থাকা অবস্থায় ট্রেন  চালানো নিষেধের ব্যাপারটি কি তূর্ণা নিশীথার চালকের অজানা ছিল? এ প্রশিক্ষণ কি তার ছিল না? কিন্তু এর পরও কেন সে ট্রেন চালাল? শুধু প্রশিক্ষণ দিয়েই কি এ ত্রুটিগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব? আসলে নিছক জ্ঞান কখনো মানুষকে  আইন মানতে উদ্বুদ্ধ কিংবা আইনের বিরুদ্ধাচরণ করা থেকে বিরত রাখতে পারে না; বরং আইন অমান্য করলে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করার সংস্কৃতি গড়ে ওঠা দরকার। দুর্নীতির মাধ্যমে উপরওয়ালাদের হাত করে অথবা আইনের ফাঁকফোকরে পার পেয়ে যাওয়ার  প্রবণতা বন্ধ হওয়া দরকার সবার আগে। এর সাথে প্রয়োজন নৈতিকতা ও তাকওয়ার অনুশীলন।

একবার বাংলাদেশের এক সফরে মুহিউস্ সুন্নাহ হযরত মাওলানা আবরারুল হক ছাহেব রাহ. গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে এক জায়গায় ট্রাফিক সিগন্যালে লাল বাতি জ¦লে ওঠে। গাড়ির চালক তখন একটু ব্রেক করে আবার সজোরে চালিয়ে যায়। লাল বাতি জ¦লা অবস্থায়ও সে গাড়ি কেন চালাল- হযরত জানতে চাইলে সে উত্তরে বলল- ‘হুযুর! পুলিশ নাইক্ক্যা’। অর্থাৎ যেহেতু কোনো ট্রাফিক পুর্লিশ নেই, সুতরাং গাড়ি চালিয়ে যেতে আর সমস্যা কোথায়। এ কথা শুনে হযরত কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন, এরপর বললেন-  ‘ইসি লিয়ে কাহা যাতা হ্যায়, ইলম কাফী নেহী তাকওয়া চাহিয়ে (শুধু জ্ঞান যথেষ্ট নয়। তাকওয়াও থাকতে হবে।) অর্থাৎ লাল বাতি জ¦লা অবস্থায় গাড়ি চালানো নিষেধের বিষয়টি চালক জানলেও সে আইন অমান্য করেছে তাকওয়া ও  জবাবদিহিতার অনুভূতির অভাবে। আখিরাতের বিষয়টিও এমনই; যদি মানুষের মধ্যে আল্লাহ্র ভয় না থাকে তাহলে সে জানা থাকা সত্ত্বেও গুনাহ করতে পারে। মূল কথা হচ্ছে, উন্নত প্রশিক্ষণের পাশাপাশি কীভাবে সর্বস্তরে জবাবদিহিতার অনুভূতি তৈরি হয় সে ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করাও আশু প্রয়োজন। আর তাহলে ট্রেন দুর্ঘটনার মত জাতীয় আরো অনেক সমস্যার সমাধানের পথ খুলতে পারে।

 

 

advertisement